১২৪তম অধ্যায়
চ্যবনকর্ত্তৃক শৰ্য্যাতির যজ্ঞসম্পাদন
লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! তদনন্তর রাজা শৰ্য্যাতি ভাৰ্গবের তরুণাবস্থা-প্ৰাপ্তিবৃত্তান্ত শ্রবণপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে সেনাসমভিব্যাহারে সস্ত্রীক হইয়া তদীয় আশ্রমে গমন করিলেন। নৃপদম্পতি তথায় সুরসদৃশ জামাতা ও দুহিতাকে নয়নগোচর করিয়া অপার আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন হইলেন। ঋষি রাজা ও রাজমহিষীর যথাবিধি সৎকার করিলে পর তাঁহারা সুখোপবিষ্ট হইয়া নানাবিধ শুভকরী মনোহারিণী কথা আরম্ভ করিলেন। তৎপরে ভৃগুনন্দন রাজা শৰ্য্যাতিকে আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে রাজন! আমি আপনার যজ্ঞ-সম্পাদন করিব; আপনি যজ্ঞীয় সম্ভারসকল আহরণ করুন।” রাজা ভার্গববাক্য শিরোধারণপূর্ব্বক যজ্ঞোপযোগী প্রশস্ত দিবসে নানা সমৃদ্ধিসম্পন্ন যজ্ঞায়তন নির্ম্মাণ করাইলেন। সেই আয়তনে ভৃগুনন্দন চ্যবন রাজা শৰ্য্যাতিকে যজ্ঞ করাইলে তদুপলক্ষে যে-সকল অদ্ভুত ঘটনা হইয়াছিল, তাহা শ্রবণ করুন।
অশ্বিনীকুমারের যজ্ঞভাগনিরূপণে ইন্দ্রের কোপ
চ্যবন তপোধন সেই যজ্ঞানুষ্ঠানসময়ে অশ্বিনীকুমারদিগের নিমিত্ত সোমরস গ্রহণ করিলে ইন্দ্ৰ তাঁহাকে নিবারণ করিয়া কহিলেন, ‘আশ্বিনীকুমারেরা দেবগণের চিকিৎসক; তাহাদিগের বৃত্তি অতি সামান্য; অতএব তাহারা কখন সোমার্হ হইতে পারে না।” চ্যবন কহিলেন, “হে দেবেন্দ্ৰ! যে মহাত্মা অশ্বিনীকুমারযুগল আমাকে অমরের ন্যায় অজর করিয়াছেন, তাঁহারা সোমরসভাজন না হইয়া কেবল আপনারই সোমভাগী হইবেন, এ কথা অতি অযোগ্য; আপনি তাঁহাদিগকেও দেবতা বলিয়া বোধ করিবেন।” ইন্দ্ৰ কহিলেন, “যাহারা চিকিৎসক, নানা কাৰ্য্যে ব্যাপৃত ও কামরূপী হইয়া মর্ত্যলোকে বিচরণ করে, তাহারা কি জন্য সোমরসের যোগ্য হইবে?” দেবরাজ বাগাড়ম্বরপূর্ব্বক পুনঃ পুনঃ উহারই আন্দোলন করিতে লাগিলেন; কিন্তু ভৃগুনন্দন চ্যবন তাঁহার প্রতি অনাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক স্বয়ং অশ্বিনীকুমারের অংশ গ্ৰহণ করিলেন।
“তখন দেবরাজ ইন্দ্ৰ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, “যদি তুমি স্বয়ং তাহাদিগের নিমিত্ত সোমরস গ্রহণ কর, তাহা হইলে আমি এই ভীষণদর্শন বজ্র প্ৰহারে তোমার প্রাণসংহার করিব।” ভার্গব দেবরাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সহাস্যবদনে তাহাকে উপেক্ষা করিয়া সেই অনুত্তম সোমরস গ্রহণ করিলেন।
ইন্দ্রের বিরুদ্ধে মদাসুরের উৎপত্তি
‘অনন্তর শচীপতি ক্ৰোধাভরে ভার্গবকে বজা-প্রহার করিতে উদ্যত হইলে মহাতপাঃ ভৃগুনন্দন তদীয় বাহু সংস্তম্ভিত করিয়া তাঁহাকে নিহত করিবার মানসে মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক হুতাশনে আহুতি প্ৰদান করিলেন। অনন্তর তপোবলে মদ-নামে এক মহাবলপরাক্রান্ত বিকটাকার মহাসুর সমুৎপন্ন হইল। নিখিল সুরাসুরেরাও তাহার শরীরনির্ণয় করিতে অসমর্থ। সেই মহাসুরের তীক্ষাগ্ৰ দশন ও মুখমণ্ডল অতিশয় ভয়ঙ্কর। তাহার একটি হনু ভূমণ্ডলে ও অপরটি স্বর্গে সংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে। প্রধান প্রধান দন্তচতুষ্টয় শত-যোজন বিস্তীর্ণ এবং অপরাপর দন্তসকল দশ যোজন আয়ত, প্রাসাদ-শিখরাকার ও শূলাগ্ৰ-সমদর্শন। তাহার বাহুযুগল অযুতযোজন বিস্তীর্ণ ও পর্ব্বতপ্রতিম; নেত্ৰদ্ধয় চন্দ্ৰসূৰ্য্যসদৃশ, বক্ত্র কালাগ্নি-সন্নিভ। সে যখন ভীষণ আননব্যাদান ও বিদ্যুচ্চপল জিহ্বাদ্বারা লেহনপূর্ব্বক ইতস্ততঃ ঘোরতর দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল, তখন বোধ হইল যেন এককালে চরাচরবিশ্ব গ্ৰাস করিতে উদ্যত হইয়াছে। সেই মহাসুর অতিভয়ঙ্কর গভীর গর্জ্জন-শব্দে ত্ৰিভুবন নিনাদিত করিয়া ইন্দ্রকে ভক্ষণ করিবার নিমিত্ত ক্ৰোধাভরে ধাবমান হইল।”