১২৪তম অধ্যায়
কৃষ্ণবাক্যসমর্থনসহকারে ভীষ্মের উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, কেশবের বাক্য শ্রবণ করিয়া অসহিষ্ণুস্বভাব [অধীরপ্রকৃতি] দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, “দুৰ্য্যোধন! বাসুদেব সুহৃদগণের শান্তিবিধানে সমুৎসুক হইয়া তোমাকে যাহা কহিতেছেন, তুমি তাহার অনুবর্ত্তী হও; কদাচ ক্ৰোধের বশীভূত হইও না। মহাত্মা কেশবের বাক্যানুসারে না চলিলে কদাপি কল্যাণ বা সুখলাভ হইবে না। মহাবাহু কেশব তোমাকে ধর্ম্মার্থসঙ্গত বাক্যই কহিতেছেন; তুমি তাঁহার অনুবর্ত্তী হও, প্ৰজাগণকে বিনষ্ট করিও না। তুমি কুলঘ্ন, কাপুরুষ, দুবুর্দ্ধি ও কুপথগামী; তুমি কেশব, ধৃতরাষ্ট্র ও ধীমান বিদুরের অর্থবৎ বাক্য অতিক্রম করিতেছ; সুতরাং তোমার দৌরাত্ম্যে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের জীবদ্দশাতেই ভারতকুলের দীপ্যমান রাজলক্ষ্মী দূরীকৃত হইবেন এবং তুমি অহঙ্কারবশতঃ আপনাকে অমাত্য, পুত্র, ভ্রাতা ও বান্ধবগণের সহিত জীবিতভ্ৰষ্ট [প্রাণ হইতে বিচ্যুত] করিবে। হে বৎস! তুমি পিতামাতাকে শোকসাগরে নিমগ্ন করিও না।”
দ্রোণের উপদেশ
রাজা দুৰ্য্যোধন ভীষ্মের বাক্য শ্রবণ করিয়া ক্রোধবশতঃ পুনঃ পুনঃ দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। এমন সময়ে আচাৰ্য্য দ্রোণ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে রাজন! কেশব ও ভীষ্ম তোমাকে ধর্ম্মার্থযুক্ত বাক্যই কহিয়াছেন; তুমি তাহার অনুগামী হও। ইহারা প্রাজ্ঞ, মেধাবী, দান্ত, অর্থকাম ও শাস্ত্ৰজ্ঞ, অতএব ইঁহারা তোমায় হিতবাক্যই কহিয়াছেন, তুমি তাহা গ্ৰহণ করা। হে মহাপ্রাজ্ঞা! বাসুদেব ও ভীষ্ম যাহা কহিলেন, তুমি তাহার অনুষ্ঠান কর। মোহবশতঃ কৃষ্ণকে অবমাননা করিও না। এইসকল বীর তোমাকে উৎসাহিত করিতেছেন বটে, কিন্তু ইঁহারা কিছুমাত্ৰ কাৰ্য্যসম্পাদন করিতে সমর্থ হইবেন না; যুদ্ধকালে বীরভার [বীৰ্য্যেশ্বৰ্য্য-রণচাতুৰ্য্য] অন্যের স্কন্ধে নিক্ষেপ করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। অতএব প্ৰজা, পুত্র ও ভ্রাতৃগণকে বিনষ্ট করিও না। বাসুদেব ও অৰ্জ্জুন যে সেনাগণের মধ্যে বিদ্যমান থাকেন, কেহই তাঁহাদিগকে পরাজয় করিতে সমর্থ নয়। পরমসুহৃৎ কেশব ও ভীষ্ম যে মত প্রকাশ করিলেন, তাহা যথার্থ; যদি তাহা গ্ৰহণ না কর, তবে অতিশয় অনুতাপ করিতে হইবে। পরশুরাম অর্জ্জুনের যে প্রকার তেজ বর্ণনা করিয়াছেন, অর্জ্জুন তদপেক্ষাও তেজস্বী এবং বাসুদেব দেবগণেরও অজেয়। মহারাজ! এক্ষণে তোমার নিকট হিত ও প্রিয় কথা কহিবার প্রয়োজন নাই। যাহা বক্তব্য, সমুদয়ই বলিলাম, এখন তোমার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহাই করা, তোমাকে আর অধিক বলিতে বাসনা করি না।”
বিদুরের উপদেশপ্রদান
দ্রোণাচাৰ্য্যের বাক্য পরিসমাপ্ত হইলে মহামতি বিদ্যুর দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “দুৰ্য্যোধন!! আমি তোমার নিমিত্ত শোক করিতেছি না; তোমার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্যই শোকাকুল হইতেছি; তোমার হৃদয় এমন জঘন্য ও তুমি এমন পাপাত্মা কুলনাশক যে, ইহারা তোমাকে উৎপাদনা করিয়া হতমিত্র [*বান্ধবসমূহের ও মন্ত্রিদিগের মৃত্যু] ও হতামাত্য [*] হইয়া ছিন্নপক্ষ পক্ষীর ন্যায় অনাথ হইবেন; আর পরিশেষে ইঁহাদিগকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া শোকাকুলিতচিত্তে সমুদয় পৃথিবী পর্য্যটন করিতে হইবে।”
বিদুরের বাক্যাবসানে রাজা ধৃতরাষ্ট্র দুর্য্যোধনকে কহিলেন, “বৎসে! মহাত্মা বাসুদেবের বাক্য অত্যন্ত কল্যাণকর, যোগক্ষেমশালী [জীবনযাত্রা কুশলকর] ও অপরিবর্ত্তনীয়, তুমি ইহা শ্রবণ ও গ্রহণ কর। তাহা হইলে অন্যান্য রাজার প্রতি আমাদিগের যে অভিসন্ধি আছে, এই অক্লিষ্টকর্ম্মা কৃষ্ণের সাহায্যে তাহাও সংসাধিত হইবে। এক্ষণে তুমি কেশবের সহিত একত্র হইয়া যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন কর, ভরতকুলের কুশলের নিমিত্ত সম্পূর্ণরূপে স্বস্ত্যয়ন [মঙ্গল আনয়ন] কর; এই বাসুদেবকে সহায় করিয়া শান্তিলাভ করিবার প্রকৃত সময় সমুপস্থিত হইয়াছে; এ সময় অতিক্রম করিও না। মহাত্মা কেশব সন্ধিপ্রার্থনায় তোমার নিমিত্ত অনেক কথা কহিতেছেন; ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিও না; তাহা হইলে তোমার পরাজয় হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”