শচী-হাসি দেখিয়া সতীর অভিমান।
গোবিন্দে চাহিয়া বলে, কর অবধান।।
প্রণাম করিলা তুমি ইন্দ্রের চরণে।
হাসিয়া চাহিয়া মোরে দেখায় নয়নে।।
যে প্রতিজ্ঞা কৈল শচী, হইল সম্পূর্ণ।
বলছিলা গর্ব্ব আজি করিব যে চূর্ণ।।
কি কারণে এমত করিলা জগন্নাথ।
ছিল ভাল এ মতে না লৈলে পারিজাত।।
হাসিয়া বলেন প্রভু কমল-লোচন।
এই হেতু সতী কেন হও দুঃখমন।।
যতেক দেখহ প্রাণী এ তিন ভুবনে।
আমা হৈতে বিভিন্ন নাহি কোন জনে।।
আপনারে নমস্কার করি যে আপনে।
তোমার ইহাতে লজ্জা হৈল কি কারণে।।
সতী বলে, তাহার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ কৈলা।
আপন প্রতিজ্ঞা দেব বিস্মৃত হইলা।।
সহস্র লোচনে দিব ধূলির অঞ্জন।
ভাঙ্গিব ইন্দ্রেরর গর্ব্ব কহিলা তখন।।
ক্ষত্রিয়-প্রতিজ্ঞা না পালিলে ধর্ম্ম নহে।
বিশেষে শচীর হাসি দেখি অঙ্গ দহে।।
কৃষ্ণ বলে, আমার প্রতিজ্ঞা নহে স্থির।
ভক্তেরে বিক্রীত দেবী আমার শরীর।।
না পারি শিবের বাক্য করিতে লঙ্ঘন।
ইন্দ্র-অপরাধ ক্ষমিলাম সে কারণ।।
সতী বলে, আমি প্রায় অভক্ত তোমার।
সে কারণে ক্রোধে দহে শরীর আমার।।
গোবিন্দ বলেন, তুমি ক্রোধ ত্যজ মনে।
এক্ষণে লোটাব ইন্দ্রে তোমার চরণে।।
সত্যভামা আশ্বাসিয়া দেবকী-তনয়।
ডাকিয়া বলেন শুন দেব মৃত্যুঞ্জয়।।
তোমার বচন আমি লঙ্ঘিতে না পারি।
তাহার কারণে আমি ইন্দ্রে মান্য করি।।
ইন্দ্রেতে আমাতে কিবা সম্বন্ধ নির্ণয়।
কত অবতার মম ধরণীতে হয়।।
হিরণ্যাক্ষ হিরণ্যকশিপু দুইজন।
প্রতাপেতে লয়েছিল সকল ভুবন।।
মারিলাম তাহারে হইয়া অবতার।
নিষ্কণ্টক স্বর্গেতে দিলাম অধিকার।।
ধর্ম্মবলে বলী লয়েছিল ত্রিভুবন।
ছলিয়া পাতালে রাখি করিয়া বন্ধন।।
দুই পদে ব্যাপিলাম ব্রহ্মাণ্ড সকল।
নিষ্কণ্টক করিয়া দিলাম আখণ্ডল।।
কুম্ভকর্ণ রাবণ রাক্ষস-অধিপতি।
সকলে জানহ ইন্দ্রে কৈল যেই গতি।।
তাহারে মারি যে আমি রাম-অবতারে।
নিষ্কণ্টক করি স্বর্গ দিলাম তাহারে।।
উহায় আমায় শিব কিসের সম্বন্ধ।
এই বাক্য তাহারে বলহ সদানন্দ।।
ভূমিতলে লোটাইয়া সহস্র-লোচনে।
প্রণাম করিয়া পড়ুক সতীর চরণে।।
তবে তার অপরাধ করি আমি দূর।
নহিলে এখনি অন্যে দিব স্বর্গপুর।।
ইন্দ্রে কহিলেন এ সকল মহেশ্বর।
শুনি ইন্দ্র ক্রোধেতে কম্পিত কলেবর।।
না করে স্বীকার, শিব কহেন কৃষ্ণেরে।
গরুড়ে ডাকিয়া কৃষ্ণ বলেন সত্বরে।।
যাহ বীর খগেশ্বর পাতাল ভুবন।
আন গিয়া শীঘ্র বিরোচনের নন্দন।।
বলিবে করিব আজি স্বর্গে অধিপতি।
সাধুসেব্য গুণে বলি আমাতে ভকতি।।
গরুড় ইন্দ্রের সখা অতিশয় প্রীত।
গোবিন্দ-চরণে পড়ে সখার নিমিত্ত।।
সবিনয়ে বচন বলেন খগেশ্বর।
অদিতির সত্য পাসরিলা চক্রধর।।
মন্বন্তরে বলিরে করিবা অধিকারী।
এক্ষণে বলিরে কি করণে ডাক হরি।।
কোন্ ছাড় ইন্দ্র, প্রভু তারে এত কেনে।
দেখি আমি, তোমারে কেমনে নাহি মানে।।
এত বলি আপনি চলিল খগেশ্বর।
কহিল, অজ্ঞান কেন হও পুরন্দর।।
যাঁহার পালন সৃষ্টি সৃজন যাঁহার।
যেই প্রভু তোমারে দিয়াছে অধিকার।।
তাঁর আজ্ঞা লঙ্ঘহ করিয়া অবহেলা।
দেখিয়া না দেখ চক্ষে ইন্দ্রপদে ভোলা।।
আইস তোমার দোষ ক্ষমা করাইব।
সতীর চরণতলে তোমা ফেলাইব।।
আমার বচনে যদি না হয় প্রবোধ।
বলি ইন্দ্রপদ লৈবে বাড়িবেক ক্রোধ।।
খগেন্দ্রের বাক্য শুনি চিন্তে মঘবান।
বুঝিলাম মোরে ক্রোধ কৈল ভগবান।।
ত্রৈলোক্যের নাথ প্রভু দেব নারায়ণ।
অজ্ঞান হইয়া তাঁর সঙ্গে কৈনু রণ।।
গরুড়ে বলিল ইন্দ্র, শুন সখা তুমি।
গোবিন্দে বাড়ানু ক্রোধ না জানিয়া আমি।।
খগেশ্বর বলে, সখা শুন মম বাণী।
মোর সহ আসি শান্ত কর চক্রপাণি।।
আইস তোমার দোষ করাইব ক্ষমা।
নারায়ণ-সম্মুখে লইয়া যাব তোমা।।
এত বলি গরুড়ে করিয়া হাতাহাতি।
সতীর চরণতলে ফেলে সুরপতি।।
পড়ি তার সহস্রলোচনে লাগে ধূলি।
দেখিতে না পায় ইন্দ্র হাতাড়িয়া বুলি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।