১২৩তম অধ্যায়
সন্ধি করিতে ধৃতরাষ্ট্রের অসামর্থপ্রকাশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা ধৃতরাস্ট্র নারদকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভগবন! আপনি যে প্রকার কহিতেছেন, সেরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই, উহা আমার অভিপ্রেত বটে, কিন্তু তাহা সম্পাদন করা আমার সাধ্যায়ত্ত নহে।” রাজা ধৃতরাষ্ট্র নারদকে এইরূপ কহিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, “হে কেশব! তোমার বাক্য সুখকর, লোকাচারসঙ্গত, ধর্ম্মানুগত ও ন্যায়োপেত [নীতিমুক্ত], তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু আমি স্বাধীন নই। সুতরাং আমার প্রিয়কাৰ্য্য অনুষ্ঠিত হয় না; অতএব তুমি পাপাত্মা দুৰ্য্যোধনকে সান্ত্বনা করিবার নিমিত্ত যত্ন কর। সে গান্ধারী, ধীমান বিদুর বা ভীষ্মপ্রভৃতি অন্যান্য হিতৈষী সুহৃদগণের হিতকর বাক্য শ্রবণ করে না। তুমি স্বয়ং সেই ক্রূরাত্মাকে শাসন কর, তাহা হইলে তোমার বন্ধুজনোচিত কাৰ্য্য করা হইবে।”
দুৰ্য্যোধনের প্রতি কৃষ্ণের উক্তি
অর্ম্মার্থতত্ত্বজ্ঞ বাসুদেব রাজা ধৃতরাষ্ট্রের বাক্যম্রবণে দুর্য্যোধনের অভিমুখে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া মধুরবচনে কহিতে লাগিলেন, “দুৰ্য্যোধন!! তোমার ও তোমার বংশের সবিশেষ শান্তিকর বাক্য শ্ৰবণ কর। তুমি মহাপ্রাজ্ঞকূলে [অত্যন্ত বুদ্ধিমানদিগের বংশেঅত্যন্ত বুদ্ধিমানদিগের বংশে] সমুৎপন্ন, শাস্ত্ৰজ্ঞতা ও সদাচারপ্রভৃতি সমুদয় সদগুণে অলঙ্কৃত হইয়াছ; অতএব সন্ধিসংস্থাপন করাই তোমার সমুচিত কর্ম্ম। তোমার যেরূপ সঙ্কল্প, দুষ্কুলজাত, নৃশংস, নির্লজ্জ ব্যক্তিরাই তদনুযায়ী কাৰ্য্য করিয়া থাকে। সাধু ব্যক্তিদিগের প্রবৃত্তি ধর্ম্মার্থের অনুগত, অসাধুরাই বিপরীত ব্যবহার করিয়া থাকে। কিন্তু তোমাতে সেই বিপরীত ব্যবহার বারংবার নয়নগোচর হইতেছে; ঈদৃশ ব্যবহারে ঘোরতর ধর্ম্ম, প্রাণনাশের কারণ, অনিষ্ট ও অপ্রতিবিধেয় [প্রতীকারের অযোগ্য] দুর্নিমিত্ত [অনিষ্ট] সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। এক্ষণে তুমি সেই অনর্থ পরিহারপূর্ব্বক আপনার, ভ্রাতৃগণের, ভৃত্যগণের ও মিত্ৰগণের শ্ৰেয়ঃসাধন কর; তাহা হইলে তুমি অধৰ্মজনক, অযশস্কর কর্ম্ম হইতে বিমুক্ত হইবে আর এক্ষণে প্ৰজ্ঞ, শূর, মহোৎসাহসম্পন্ন, মহানুভব, শাস্ত্ৰজ্ঞ পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন কর। তাহা হইলে ধীমান ধৃতরাষ্ট্র, পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণ, মহামতি বিদুর, কৃপ, সোমদত্ত, বাহ্লীক, অশ্বত্থামা, বিকৰ্ণ, সঞ্জয়, বিবিংশতি, জ্ঞাতিগণ ও জ্ঞানসম্পন্ন অন্যান্য মিত্ৰগণ সাতিশয় সুখী হইবেন। ফলতঃ সন্ধিসংস্থাপন হইলে সমস্ত জগৎ আনন্দে পরিপূর্ণ হইবে, সন্দেহ নাই। তুমি লজ্জাশীল, সৎকুলজাত, শাস্ত্ৰজ্ঞ ও সদয়স্বভাব। অতএব পিতামাতার শাসনে অবস্থান কর। পিতার শাসনপরবশ [শাসনাধীন] হওয়া পুত্রের নিতান্ত শ্ৰেয়স্কর; দেখ, মনুষ্যেরা বিপন্ন হইলে পিতৃশাসন স্মরণ করিয়া থাকে।
‘ভ্ৰাতঃ! পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন করা তোমার পিতার ও অমাত্যগণের নিতান্ত অভিপ্রেত; এক্ষণে তাহা তোমারও অনুমোদিত হউক। যে ব্যক্তি সুহৃদ্বাক্য শ্রবণ করিয়া গ্রাহ্য না করে, যেমন মহাকালফল [বিষফল] ভক্ষণ করিলে পরিণামে পরিতাপিত হইতে হয়, তদ্রূপ সেই ব্যক্তিকে পরিশেষে সাতিশয় ক্লেশ ভোগ করিতে হয়। যে দীর্ঘসূত্রী [সদ্য সম্পাদ্য কাৰ্য্যের বহু বিলম্বে সম্পাদনকারী] মোহবশতঃ কল্যাণকর বাক্য পরিত্যাগ করে, তাহাকে পুরুষাৰ্থ হইতে পরিভ্রষ্ট ও পশ্চাত্তাপে পরিতাপিত হইতে হয়। যে ব্যক্তি অর্থকাম ব্যক্তিদিগের মতবিরোধী বাক্য সহ্য না করে, কিন্তু বাস্তবিক প্রতিকূল বাক্য গ্রহণ করে, সে অরাতিগণের বশবর্ত্তী হয়। যে ব্যক্তি সাধুগণের মত অতিক্রম করিয়া অসতের মতে অবস্থান করে, অচিরকালমধ্যে তাহার বিপদে মিত্রগণকে শোকাকুল হইতে হয়। যে ব্যক্তি প্রধান প্রধান অমাত্যগণকে পরিত্যাগ করিয়া হীনস্বভাব [নীচপ্রকৃতি] দিগকে সেবা করে, সে এরূপ ঘোরতর বিপদে নিপতিত হয় যে, তাহা হইতে আর উদ্ধার হইবার সম্ভাবনা থাকে না। যে ব্যক্তি অসাধুগণের সেবা, অনৰ্থকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান, সাধু সুহৃদগণের বাক্যে উপেক্ষা, অনাত্মীয়ের সমাদর ও আত্মীয়গণের প্রতি দ্বেস প্রকাশ করে, পৃথিবী তাহাকে পরিত্যাগ করেন। অতএব তুমি কি নিমিত্ত মহাবীর পাণ্ডবগণের সহিত বিরোধ করিয়া অশিষ্ট অসমর্থ মূঢ়গণের সাহায্যে পরিত্রাণলাভের অভিলাষ করিতেছ? এই মেদিনীমণ্ডলে তোমা ভিন্ন কোন ব্যক্তি ইন্দ্রসদৃশ মহারথ [একাকী দশসহস্র ধনুৰ্দ্ধারীদিগের সহিত যুদ্ধকারী অথবা যুদ্ধে নিজেকে, সারথিকে ও অশ্বসমূহকে রক্ষা করিতে সমর্থ।] ভূপতিগণকে অতিক্ৰম করিয়া অন্য হইতে পরিত্রাণের প্রত্যাশা করে? পাণ্ডবগণ এরূপ ধর্ম্মপরায়ণ যে তুমি তাঁহাদিগকে জন্মাবধি প্রতিনিয়ত নিগৃহীত [নিৰ্য্যাতিত-পীড়িত] করিয়াছ, তথাপি তাঁহারা কখন জাতক্ৰোধ [ক্রুদ্ধ] হয়েন নাই। তুমি জন্ম [শৈশব কাল হইতে] প্রভৃতি সেই বান্ধবগণের প্রতি মিথ্যা ব্যবহার করিয়াছ, তথাপি তাঁহারা তোমার প্রতি সম্যক সন্তুষ্ট আছেন; তাঁহাদের প্রতি পরিতুষ্ট হওয়া তোমারও কর্ত্তব্য। প্রকৃত বন্ধুগণের প্রতি কদাচ জাতক্ৰোধ হইও না। প্রাজ্ঞগণের কর্ম্ম ত্ৰিবৰ্গসংযুক্ত; অন্যান্য লোক ত্রিবর্গসাধনে অসমর্থ হইয়া কেবল ধর্ম্ম ও অর্থের অনুগামী হয়; কিন্তু ধীর ব্যক্তি পৃথক পৃথক কৰ্মলভ্য ত্রিবর্গের মধ্যে কেবল ধর্ম্মকেই লক্ষ্য করিয়া চলেন। মধ্যম লোকে কলহের মূল অর্থের নিমিত্ত কর্ম্ম করে, আর বালকেরাই কেবল কামনার বশবর্ত্তী হয়। যে নীচ ব্যক্তি লোভপরতন্ত্র [লোভের বশীভূত] হইয়া ইন্দ্ৰিয়গণকে চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত ধর্ম্ম পরিত্যাগ করে, সে ব্যক্তি প্রকৃত উপায়ের অভাবে কেবল কাম ও অর্থের অভিলাষী হইয়া বিনাশপ্ৰাপ্ত হয়। কেন না, কাম ও অর্থ কদাপি ধর্ম্ম হইতে বিচ্ছিন্ন থাকে না; অতএব যিনি কাম ও অর্থ লাভের কামনা করেন, প্রথমে তাঁহার ধর্ম্মলাভ করাই নিতান্ত কর্ত্তব্য। ধর্ম্মই ত্ৰিবৰ্গলাভের উপায়। যে ব্যক্তি ধর্ম্মস্বরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া ত্ৰিবৰ্গলাভের অভিলাষ করেন, তিনি কক্ষগত [গৃহের প্রকোষ্ঠ (কুঠুরী) গত] পাবকের ন্যায় পরিবর্দ্ধিত হইতে থাকেন।
“হে দুৰ্য্যোধন! তুমি হীন উপায় অবলম্বন করিয়া সকলরাজবিখ্যাত অতি বিস্তীর্ণ অধিরাজ্যলাভে [সকল দিকে বিস্তৃত রাজ্য] সমুৎসুক হইয়াছ। যে ব্যক্তি সত্যপরায়ণদিগের প্রতি মিথ্যা ব্যবহার করে, সে পরশুদ্বারা [কুঠার] বনচ্ছেদনের ন্যায় আপনাকে ছেদন করে। যে ব্যক্তির জয় ইচ্ছা করিবে না, তাহার মতিভ্ৰংশ [বুদ্ধিভ্রম] করা একান্ত অবিধেয় [অনুচিত]। মানব মতিভ্ৰংশ না হইলে সতত কল্যাণকর কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে। পাণ্ডবগণের কথা কি, মহানুভব ব্যক্তি ত্ৰিলোকের ব্যক্তিরা কিছুই বুঝিতে পারে না; তাহারা অতি বিশদ [প্রাঞ্জল] সাধারণ প্রমাণসকলেও অস্বীকার করে। হে ভারত! অসাধুসংসর্গ অপেক্ষা পাণ্ডবগণের সহিত সমাগম তোমার নিতান্ত শ্রেয়স্কর। তাঁহারা তোমার প্রতি পরিতুষ্ট থাকিলে তোমার সকল কামনা পরিপূর্ণ হইবে। তুমি যে দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনির উপর রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া ঐশ্বৰ্য্যাভিলাষী হইয়াছ, তাহারা কি জ্ঞানে, কি ধর্মে, কি অর্থে, কি বিক্রমে, কিছুতেই পাণ্ডবগণের সমকক্ষ নহে। কেবল উহারা নয়, এই সমুদয় রাজা একত্ৰ হইলেও যুদ্ধকালে কুপিত বৃকোদরের মুখসন্দর্শনে [ভয়ে মুখের দিকে তাকাইতো] সমর্থ হইবেন। না। এই সন্নিহিত [যুদ্ধার্থ উদযুক্ত] সেনাগণ এবং ভীষ্ম, কৰ্ণ, কৃপ, ভূরিশ্রবা, সৌমদত্তি, অশ্বত্থামা ও জয়দ্ৰথ ধনঞ্জয়ের সহিত যুদ্ধে অসমর্থ হইবেন। কি সুর, কি অসুর, কি মনুষ্য, কি গন্ধৰ্ব, কেহই ধনঞ্জয়কে পরাজয় করিতে পারেন না; অতএব তুমি যুদ্ধাভিলাষ পরিত্যাগ কর ।
“অথবা সমুদয় পার্থিব সেনার মধ্যে এমন এক বীরকে অনুসন্ধান কর, যে ব্যক্তি ধনঞ্জয়ের সহিত সংগ্রাম করিয়া সুমঙ্গলে গৃহে প্রত্যাগত হইতে সমর্থ হয়েন। অনর্থক লোকক্ষয়ের প্রয়োজন নাই। যিনি জয়লাভ করিলে তোমার জয়লাভ হইবে, ঈদৃশ কোন পুরুষকে আনয়ন কর। কিন্তু যে ধনঞ্জয় খাণ্ডবপ্রন্থে দেব, গন্ধৰ্ব, যক্ষ, অসুর ও পন্নগগণকে পরাভূত করিয়াছেন, কে তাঁহার সহিত সংগ্রাম করিবে; আর একজন যে বহুব্যক্তিকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়, বিরাটনগরে ইহার আশ্চৰ্য্য নিদর্শন অবলোকন করিয়াছ। যিনি সময়ে আদিদেব ভগবান মহাদেবকে পরিতুষ্ট করিয়াছেন, তুমি কি সেই অজেয়, অধৃষ্য [অন্যের অধৰ্ষণীয়], বীরবর, অতি তেজস্বী অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে অভিলাষ কর? আমি সাহায্য করিলে কে তাঁহার সহিত যুদ্ধ প্রার্থনা করিবে? যদি ধনঞ্জয় যুদ্ধে আগমন করেন, সাক্ষাৎ দেবরাজ কি তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হয়েন? যে ব্যক্তি বাহুদ্বারা ধরাধারণে সমর্থ হয়, যে ব্যক্তি অমৰ্ষপরবশ হইয়া সমুদয় প্রজাকে দগ্ধ করিতে পারে এবং যে ব্যক্তি দেবগণকে স্বর্গভ্ৰষ্ট করিতে সমর্থ হয়, সে ব্যক্তি ধনঞ্জয়কে পরাজয় করিতে পারে। পুত্ৰ, ভ্রাতা, জ্ঞাতি ও সম্বন্ধিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত কর, এইসকল ভরতশ্রেষ্ঠগণ যেন তোমার নিমিত্ত বিনাশপ্ৰাপ্ত না হয়; যেন কৌরবগণের শেষ [অবশিষ্ট] বিদ্যমান থাকে; সমুদয় কুল উচ্ছিন্ন করিও না। তুমি যেন নষ্টকীর্ত্তি ও কুলঘ্ন [বংশনাশী-সর্ব্বনাশী] বলিয়া বিখ্যাত না হও। মহারথ পাণ্ডবগণ তোমাকে যৌবরাজ্যে ও তোমার পিতাকে মহারাজ্যে অভিষিক্ত করিবেন।
“অতএব এই আগমনোন্মুখী [অঙ্কাগতপ্রায়া] রাজলক্ষ্মীকে অবমাননা করিও না। সুহৃদগণের বাক্যরক্ষা, পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন ও তাঁহাদিগকে রাজ্যার্দ্ধ প্ৰদান করিয়া মহতী শ্ৰী লাভ কর এবং মিত্ৰগণের প্রতিভাজন হইয়া চিরকাল কুশলে অবস্থান কর।”