১২২তম অধ্যায়
ব্রহ্মার যযাতি-অভিনন্দন
“এইরূপে মহারাজ যযাতি সজ্জনগণের অগ্রগণ্য স্বীয় দৌহিত্ৰগণের প্রভাবে সদগতিলাভ করিয়া তাঁহাদিগকে সম্ভাষণপূর্ব্বক স্বৰ্গে গমন করিতে লাগিলেন। গমনকালে তাঁহার মস্তকে নানাবিধ সুগন্ধি পুষ্পবৃষ্টি ও গাত্রে পরমপবিত্ৰ সুগন্ধ সমীরণ সংলগ্ন হইতে লাগিল। মহারাজ নহুষতনয় দৌহিত্ৰগণের তপঃপ্রভাবনিমজ্জিত অবিচল স্থানে [যে স্থান হইতে স্থলন নাই] সংস্থিত ও স্বীয় কর্ম্মপ্রভাবে পরমোৎকৃষ্ট শোভাসম্পন্ন হইয়া জাজ্বল্যমান হইতে লাগিলেন। গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাগণ তাঁহার সমীপে নৃত্যগীতাদি করিতে লাগিল, চতুর্দ্দিকে দুন্দুভিধ্বনি হইতে লাগিল, বিবিধ দেবর্ষি, রাজর্ষি ও চারণগণ তাঁহার স্তব ও অর্চনা করিতে লাগিলেন এবং দেবগণ তাঁহাকে অভিনন্দন করিলেন।
“এইরূপে মহারাজ যযাতি স্বৰ্গপ্রাপ্ত হইয়া শান্তমনাঃ [প্ৰসন্ন চিত্ত] হইলে সর্ব্বলোকপিতামহ ভগবান কমলযোনি [ব্ৰহ্মা] তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে নহুষতনয়! তুমি লৌকিক কর্ম্মদ্বারা চতুষ্পাদধর্ম্ম উপার্জ্জন করিয়া এই লোক পরাজয় ও স্বর্গে অক্ষয় কীর্ত্তি লাভ করিয়াছিলে। তোমার স্বীয় কর্ম্মদোষেই তৎসমুদয় বিনষ্ট হয়। স্বৰ্গবাসিগণের মন তমোবৃত [তমোপ্তণারিত] হওয়াতে তাঁহারা তোমাকে প্রত্যভিজ্ঞাত হইতে পারেন নাই; সেই নিমিত্তই তুমি ভূতলে নিপতিত হইয়াছিলে। এক্ষণে স্বীয় দৌহিত্ৰগণের প্রীতিনিবন্ধন পুনরায় স্বকর্ম্মনিমর্জিত পরমপবিত্র শ্বাশত অব্যয় স্থান প্রাপ্ত হইয়াছ।”
অভিমানের দোষ কথন
“তখন যযাতি কহিলেন, “হে ভগবন! আমার একটি সংশয় সমুপস্থিত হইয়াছে, আপনি অনুগ্রহ করিয়া উহা ছেদন করুন; আপনা ব্যতীত অন্য কাহারও নিকট সেই সংশয় প্রকাশ করিতে আমার শ্রদ্ধা হয় না। হে পিতামহ! আমি বহুসহস্ৰ বৎসর প্রজাপালন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও দানদ্বারা যে মহাফল লাভ করিয়াছিলাম, তাহা কিরূপে অতি অল্পকালমধ্যে বিলুপ্ত হইয়া আমাকে পতিত করিল? হে ভগবন! আমি ধর্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা যে শাশ্বত লোক লাভ করিয়াছিলাম, তাহা আপনার অবিদিত নাই; অতএব এক্ষণে বলুন, কি নিমিত্ত উহা বিনষ্ট হইল?”
“ব্ৰহ্মা কহিলেন, “হে নহুষতনয়! তুমি বহুসহস্ৰ বৎসর প্রজাপালন, যজ্ঞানুষ্ঠান ও দানদ্বারা যে ফললাভ করিয়াছিলে, তোমার অভিমাননিবন্ধন তাহা বিনষ্ট হওয়াতে তুমি স্বৰ্গচ্যুত হও। দেখ, যে ব্যক্তি অভিমান, বল, হিংসা, শঠতা বা মায়া প্ৰকাশ করে, এই লোক তাহার পক্ষে চিরস্থায়ী হয় না। কি উত্তম, কি মধ্যম, কি অধম, কাহাকেও অবমাননা করা তোমার বিধেয় নহে। অভিমানানলদগ্ধ [অভিমানরূপ অগ্নিতে দগ্ধ] ব্যক্তিগণের শান্তি কোথায়? হে যযাতি! যে ব্যক্তি তোমার এই পতনারোহণ[স্বৰ্গ হইতে পতন, পুনঃ স্বৰ্গে আরোহণ]বৃত্তান্ত শ্রবণ করিবে, সে অতি বিষম সঙ্কটে নিপতিত হইলেও অনায়াসে মুক্ত হইতে পরিবে।”
“পূর্ব্বে ভূপতি যযাতি অভিমানপ্রযুক্ত ও মহাতপঃ গালব নির্ব্বন্ধতিশয় নিবন্ধন এইরূপে যৎপরোনাস্তি বিপন্ন হইয়াছিলেন। হে কৌরবরাজ! হিতাভিলাষী সুহৃজনের বাক্য শ্রবণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য; নির্ব্বন্ধতিশয় কদাপি বিধেয় নহে। অতএব আপনি অভিমান ও ক্ৰোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি করুন। লোকে দান তপ ও হোম প্রভৃতি যে সমুদয় কাৰ্য্য করে, তাহার হ্রাস বা বিনাশ হয় না, আর যে ব্যক্তি ধর্ম্মানুষ্ঠান করে, সেই তাহার ফলভোগ করিয়া থাকে; অন্যে কদাচ তাহা করিতে সমর্থ হয় না; যে ব্যক্তি এই বহুশ্রুতিসম্পন্ন [বিজ্ঞজনসম্মত] রাগরোষাবিবর্জিত [কামনার অপূরণজনিত ক্ৰোধ] সজ্জনগণের নানা-শাস্ত্ৰবিনিশ্চিত যুক্তিযুক্ত আখ্যান শ্রবণপূর্ব্বক ত্রিবর্গে [ধর্ম্ম, অর্থ, কামে] দৃষ্টি রাখিয়া কার্য্য করেন, তিনি অনায়াসে সমুদয় পৃথিবী ভোগ করিতে সমর্থ হয়েন।”