১২২তম অধ্যায়
পলায়মান দুঃশাসন-প্রতি দ্রোণতিরস্কার
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর দ্রোণাচার্য্য দুঃশাসনকে রথসম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপপূর্ব্বক কহিলেন, “ওহে দুঃশাসন। রথীসকল কি নিমিত্ত পালায়ন করিতেছে? মহারাজের মঙ্গল ত’? সিন্ধুরাজ ত’ জীবিত আছেন? তুমি রাজপুত্র, রাজসহোদর ও একজন মহারথ; তবে কি নিমিত্তও পলায়ন করিতেছ? সিন্ধুরাজ অভিষিক্ত হও। তুমি পূর্ব্বে দ্রৌপদীকে বলিয়াছিলে, “রে দাসি! আমরা তোকে দ্যূতক্রীড়ায় পরাজয় করিয়াছি; অতএব এক্ষণে তুই স্বেচ্ছাচারিণী হইয়া আমার জ্যেষ্ঠ সহোদর রাজা দুর্য্যোধনের বস্ত্র বহন কর, তোর পতিগণ যণ্ডতিলসদৃশ নিতান্ত অকর্ম্মণ্য; তাহারা আর জীবিত নাই।” হে যুবরাজ? পূর্ব্বে দ্রুপদতনয়াকে এইরূপ বলিয়া এক্ষণে কি নিমিত্ত সমর পরিহারপূর্ব্বক পলায়ন করিতেছ? তুমিই পাপ ও পাণ্ডবগণের সহিত ঘোরতর বৈর উপস্থিত করিবার মূলীভূত; কিন্তু এখন রণস্থলে একমাত্র সাত্যকিকে অবলোকন করিয়া কি জন্য ভীত হইতেছ? পূর্ব্বে দূতক্রীড়াকালে অক্ষ গ্রহণ করিয়া কি জানিতে পার নাই যে, এই অক্ষই পরিণামে ভীষণ ভূজাগাকার শরস্বরূপে পরিণত হইবে? তুমিই পুর্ব্বে পাণ্ডবগণের প্রতি অসংখ্য অপ্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলে; তোমার নিমিত্তই দ্রুপদতনয়া যৎপরোনাস্তি ক্লেশ সহ্য করিয়াছেন। হে মহারথ! এখন তোমার সে মান কোথায়, সে দর্প কোথায় ও সেই বীর্য্যই বা কোথায়? তুমি সর্পসদৃশ পাণ্ডবগণকে রোষিত করিয়া কোথায় পলায়ন করিতেছ? তুমি দুৰ্য্যোধনের সাহসী সহোদর হইয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করায় কুরুরাজের এবং কৌরপক্ষীয় সৈন্যগণের নিতান্ত শোচনীয় অবস্থা সমুপস্থিত হইল। হে বীর! আজ স্বীয় বাহুবলে এই ভয়ার্ত্ত কৌরবসৈন্যগণকে রক্ষা করা তোমার অতীব কৰ্ত্তব্য। তুমি তাহা না করিয়া সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল শত্রুগণের হর্ষবর্দ্ধন করিতেছ। হে শত্রুনিসূদন! তুমি সেনাপতি হইয়া ভীতচিত্তে রণ পরিত্যাগ। করিলে আর কে সমরভূমিতে অবস্থান করিতে সমর্থ হইবে? হে কৌরব! তুমি আজ একমাত্র সাত্যকির সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া
পলায়নে কৃতনিশ্চয় হইয়াছ; কিন্তু গাণ্ডীবধ অর্জ্জুন, মহাবীর বৃকোদর এবং মাদ্ৰীতনয় নকুল ও সহদেবের সহিত রণস্থলে সাক্ষাৎ হইলে কি করিবে? সাত্যকির শরজাল মহাবীর অর্জ্জুনের সূৰ্য্যাগ্নিসদৃশ শরনিকরের তুল্য নহে; তুমি সেই শরজালের আঘাতেই ভীত হইয়া পলায়ন করিলে? যদি পলায়নে নিতান্তই কৃতনিশ্চয় হইয়া থাক, তাহা হইলে মহাবীর অর্জ্জুনের নিম্মোকনির্মুক্ত ভুজগাকার নারাচ তোমার শরীরমধ্যে প্রবিষ্ট না হইতে হইতে, মহাত্মা পাণ্ডবগণ তোমাদের শত ভ্রাতাকে বিনাশ করিয়া রাজ্য গ্রহণ না করিতে করিতে, ধৰ্মপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির ও সমরবিজয়ী কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ না হইতে হইতে এবং মহাবাহু ভীমসেন এই মহতী চমূমধ্যে অবগাহন করিয়া তোমার ভ্রাতৃগণকে শমনভবনে প্রেরণ না করিতে করিতে তুমি পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধিস্থাপন করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্য প্রদান কর। পূৰ্ব্বে মহাবীর ভীষ্ম তোমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা দুৰ্য্যোধনকে বলিয়াছিলেন যে, রণস্থলে পাণ্ডবগণকে কখনই পরাজয় করিতে সমর্থ হইবে না; এক্ষণে তাহাদিগের সহিত সন্ধি সংস্থাপন কর। কিন্তু মন্দবুদ্ধি দুৰ্য্যোধন তাহা করে নাই। অতএব তুমি ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক যত্নশীল হইয়া পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। সাত্যকি যেস্থানে অবস্থান করিতেছে, শীঘ্র তথায় গমন কর; নচেৎ সমুদয় সৈন্য পলায়ন করিবে।’
পাণ্ডবপক্ষীয় যোর্দ্ধৃসহ দ্রোণদুঃশাসনযুদ্ধ
“হে মহারাজ! আপনার পুত্র আচার্য্যের বাক্য শ্রবণ করিয়া কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন না; দ্রোণের বচনসকল যেন তাহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হয় নাই, তিনি এইরূপ ভাণ করিয়া অপ্রতিনিবৃত্ত ম্লেচ্ছগণে পরিবৃত হইয়া, যে পথে সাত্যকি গমন করিয়াছিলেন, সেই পথে গমন করিলেন। তথায় সাত্যকির সহিত তাহার তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। এদিকে মহারথ দ্রোণাচাৰ্য্য রোষাবিষ্ট হইয়া বেগে পাঞ্চাল ও পাণ্ডবদিগের প্রতি ধাবমান হইলেন এবং তাঁহাদিগের সৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক অসংখ্য যোধগণকে বিদ্রাবিত ও স্বীয় নাম বিশ্রাবিত করিয়া পাণ্ডবসৈন্য, পাঞ্চাল ও মৎস্যসৈন্যগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর দ্যুতিমান্ পাঞ্চালপুত্র বীরকেতু সৈন্যবিজয়ী দ্রোণাচাৰ্য্যকে আহ্বানপূর্ব্বক সন্নতপর্ব্বপাঁচশরে বিদ্ধ করিয়া একবাণে তাঁহার ধ্বজ ও সাতবাণে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য যত্নবান হইয়াও বীরকেতুকে নিবৃত্ত করিতে সমর্থ হইলেন না। তদ্দর্শনে আমরা সকলেই চমকৃত হইলাম।
পাণ্ডবপক্ষীয় বীরেকতুপ্রমুখ পাঞ্চালবধ
“অনন্তর ধর্ম্মরাজের জয়াভিলাষী পাঞ্চালেরা সমরভূমিতে দ্রোণকে রুদ্ধ দেখিয়া সকলে চতুর্দ্দিক বেষ্টনপূর্ব্বক তাঁহার উপর হুতাশনসদৃশ সুদৃঢ় শত শত তোমর ও বিবিধ অস্ত্র বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের সেই শরজাল দ্রোণের শরনিকরে বিচ্ছিন্ন হইয়া নভোমণ্ডলে পবনচালিত জলধরের ন্যায় শোভমান হইল। তখন শত্ৰুহন্তা দ্রোণ সূৰ্য্য ও অনলসদৃশ অতি ভীষণ শরসন্ধানপূর্ব্বক বীরকেতুর প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। দ্রোণনির্মুক্ত শর বীরকেতুর দেহ বিদারণপূর্ব্বক রুধিরাক্ত হইয়া প্রজ্বলিতের ন্যায় ধরাতলে প্রবিষ্ট হইল। পাঞ্চালনন্দন বীরকেতুও বায়ুভ চম্পকতরু যেরূপ পর্ব্বতাগ্র হইতে নিপতিত হয়, তদ্রূপ রথ হইতে নিপতিত হইলেন। এইরূপে ধনুর্ধারী মহাবলপরাক্রান্ত রাজপুত্র বীরকেতু নিহত হইলে পাঞ্চালগণও সত্বর চতুর্দ্দিক হইতে দ্রোণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় মহাবীর সুধ, চিত্রকেতু, চিত্ৰবর্ম্মা ও চিত্ররথ ভ্রাতৃব্যসনে নিতান্ত ক্লিষ্ট হইয়া দ্রোণের সহিত যুদ্ধ করিবার মানসে বর্ষাকালীন বারিধারাবর্ষী জলধরের ন্যায় শরবর্ষণপূর্ব্বক ধাবমান হইলেন। দ্বিজশ্রেষ্ঠ দ্রোণ সেই মহারথ রাজপুত্রগণের শরে বিদ্ধ হইয়া তাঁহাদিগের নিধনবাসনায় কোপকম্পিতকলেবরে তাঁহাদিগের উপর শরজাল বিস্তার করিলেন। পাঞ্চালরাজকুমারেরা দ্রোণের আকর্ণাকৃষ্ট শরাসনবিমুক্ত শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন। মহাযশস্বী আচাৰ্য্য তাঁহাদিগকে মুগ্ধ দেখিয়া ঈষৎ হাস্যপূর্ব্বক তাহাদের অশ্ব, রথ ও সারথিকে সংহার করিয়া ভল্ল ও নিশিতশরনিপাতে তাঁহাদিগের মস্তকচ্ছেদন করিলেন। কুমারগণ এইরূপে দ্রোণশরে বিগতাসু হইয়া দেবাসুরসংগ্রামস্থ দানবগণের ন্যায় রথ হইতে ক্ষিতিতলে নিপতিত হইলেন। হে মহারাজ! প্রতাপশালী দ্রোণাচাৰ্য্য তাঁহাদিগকে নিহত করিয়া দুরাসদ হেমপৃষ্ঠ কার্মুক বিঘূর্ণন করিতে লাগিলেন।
দ্রোণধৃষ্টদ্যুম্নযুদ্ধ—পাণ্ডবপরাজয়
“অনন্তর মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দেবকল্প মহারথ পাঞ্চালগণকে নিহত দেখিয়া অমোচনপূর্ব্বক ক্রোধভরে ভারদ্বাজের অভিমুখে। আগমনপূর্ব্বক তাঁহার উপর সুতীক্ষ্ণ শরনিকর নিক্ষেপ করিলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য ধৃষ্টদ্যুম্নের শরে সমাচ্ছাদিত হইলে সংগ্রামস্থলে সহসা হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। কিন্তু মহাবীর দ্রোণ সেই শরজালে কিছুমাত্র ব্যথিত না হইয়া হাস্যপূর্ব্বক যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ক্ৰোধান্ধ হইয়া তাঁহার বক্ষঃস্থলে নতপর্ব্ব নবতি বাণ নিক্ষেপ করিলে মহাযশস্বী ভারদ্বাজ সেই শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া রথোপরি মূর্চ্ছিত হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণকে তদবস্থ দেখিয়া ক্ৰোধারুণলোচনে শাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক তরবারি ধারণ করিয়া তাঁহার শিরচ্ছেদবাসনায় সত্বর স্বীয় রথ হইতে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক তাঁহার রথে আরোহণ করিলেন। মহাবীর দ্রোণ ঐ সময় সংজ্ঞালাভপূর্ব্বক জিঘাংসু ধৃষ্টদ্যুম্নকে সমীপবর্তী দেখিয়া পুনর্ব্বার ধনু গ্রহণপূর্ব্বক আসন্ন-যুদ্ধোপযোগী বিতস্তিপ্রমাণ শরদ্বারা তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহার বাণে বিদ্ধ হইয়া সত্বর লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক স্বীয় রথে আরোহণ ও নিপুণ কোদণ্ড গ্রহণ করিয়া দ্রোণকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন; ভারদ্বাজও তাঁহাকে প্রহার করিতে লাগিলেন। এইরূপে ত্রৈলোক্যাভিলাষী ইন্দ্র ও প্রহ্লাদের ন্যায় সেই মহাবীরদ্বয়ের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। সেই রণপণ্ডিত মহাবীরদ্বয় বিচিত্র মণ্ডপ ও যমক প্রভৃতি বিবিধ গতি প্রদর্শনপূর্ব্বক ইতস্ততঃ বিচরণ করিয়া সায়নিকরে পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন। পরে যোধগণকে মোহিত করিয়া বর্ষাকালীন জলধরনির্মুক্ত বারিধারার ন্যায় শরসমুদয় বর্ষণপূর্ব্বক একেবারে ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। তত্রত্য সমুদয় ক্ষত্রিয় ও সৈনিকপুরুষেরা সেই অদ্ভুত যুদ্ধের প্রশংসাবাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পাঞ্চালগণ যখন দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, তখন উনি অবশ্যই আজ আমাদিগের বশবর্তী হইবেন’, এই বলিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর মহাবীর দ্রোণ সত্বর বৃক্ষের পরিপক্ক ফলের ন্যায় ধৃষ্টদ্যুম্নের সারথির মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নের অশ্বগণ সারথিবিহীন হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইতে লাগিল। তখন মহাবীর দ্রোণ পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণকে বিদ্রাবিত করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে অরাতিপাতন প্রবলপ্রতাপ ভারদ্বাজ পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে পরাজিত করিয়া পুনৰ্ব্বার স্বীয় বব্যূমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবেরা কেহই তাঁহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইলেন না।”