১২১তম অধ্যায়
ভীষ্ম-পরাজয়ে পাণ্ডব-হৰ্ষ-কৌরব-বিমর্ষ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! যিনি পিতার নিমিত্ত ব্ৰহ্মচারী হইয়াছিলেন, সেই মহাবল, দেবকল্প, ভীষ্ম নিহত হইলে যোদ্ধৃগণ কি প্রকার হইয়াছিল? তিনি যখন ঘৃণাবশতঃ শিখণ্ডীকে প্রহার করেন নাই, তখনই কৌরবগণ পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইয়াছে বলিয়া মনে করিয়াছিল। ইহা অপেক্ষা দুঃখতর আর কি আছে যে, এই পাপাত্মাকে পিতার নিধনবার্ত্তা শ্রবণ করিতে হইল। আমার হৃদয় প্রস্তরের সারাংশে নির্ম্মিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই; যে হেতু, ভীষ্মের মৃত্যুবার্ত্তা শ্রবণ করিয়াও তাহা শতধা বিদীর্ণ হইতেছে না। যাহা হউক, জয়াভিলাষী ভীষ্ম আহত হইয়া কি করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা কীর্ত্তন কর; তিনি পুনঃ পুনঃ আহত হইয়াছিলেন, ইহা আমার সহ্য হইতেছে না। পূর্ব্বে পরশুরাম যাঁহাকে দিব্যাস্ত্রনিকরে বিনাশ করিতে পারেন নাই, আজি তিনি দ্রুপদানন্দন শিখণ্ডীর হস্তে নিহত হইলেন!”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! কুরুপিতামহ ভীষ্ম সায়াহ্ণসময়ে [সন্ধ্যাকালে] ধরাতলে নিপতিত হইয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে বিষাদসাগরে নিমগ্ন ও পাঞ্চালগণকে আহ্লাদনীরে অভিষিক্ত করিয়া শরশয্যাতেই শয়ান রহিলেন; তাঁহাকে ভূমি-স্পর্শ করিতে হয় নাই। কুরুগণের সীমাবৃক্ষ [সীমারক্ষক বৃক্ষের ন্যায় আশ্রয়স্বরূপ] ভীষ্ম রথ হইতে নিপতিত হইলে সকল ভূতের মধ্যে হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল; উভয়পক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণই ভয়াবিষ্ট হইলেন। কৌরব ও পাণ্ডবগণ মহারথ ভীষ্মকে বিশীর্ণ-কবচ [ছিন্নবর্ম্মা—বর্ম্ম ছিঁড়িয়া যাওয়া] ও স্রস্তধ্বজ [স্বলিতধ্বজ—ধ্বজ খুলিয়া পড়া] নিরীক্ষণ করিয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত হইলেন। আকাশমণ্ডল অন্ধকারে আচ্ছন্ন, দিবাকর প্রভাশূন্য ও ধরাতল ধ্বনিত হইয়া উঠিল। ‘ইনি ব্ৰহ্মাবেত্তা[ব্রহ্মবিদ]গণের শ্রেষ্ঠ, ইনি বেদবেত্তা[বেদজ্ঞ]গণের প্রধান’, এই কথা বলিয়া লোকে ভীষ্মকে সম্ভাষণ করিতে লাগিল। ঋষি, সিদ্ধ ও চারণগণ শরতল্পগত [শর-শয্যা শয়ান] ভীষ্মকে লক্ষ্য করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘ইনি পূর্ব্বে পিতাকে কামাকুলিত দেখিয়া স্বয়ং ঊৰ্দ্ধারেতা [অস্বলিত ব্ৰহ্মচৰ্য্য—অকৃতদারহেতু শুক্রাধারণক্ষম] হইয়াছিলেন।” আপনার পুত্ৰগণ, কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া বিষণ্নবদন, শ্ৰীভ্রষ্ট এবং লজ্জায় নম্রমুখ হইয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ জয়লাভ করিয়া রণমস্তকে [রণক্ষেত্রের অগ্রভাগে] অবস্থানপূর্ব্বক হেমজলি-চিত্রিত মহাশঙ্খের বাদ্য আরম্ভ করিলেন। হৰ্ষনিবন্ধন তুৰ্য্যসহস্ৰ বাদিত হইতে আরম্ভ হইলে দেখিলাম, মহাবল ভীমসেন বেগপ্রভাবে মহাবল শক্রকে সংহার করিয়া আহ্লাদে ক্রীড়া করিতেছেন। কৌরবগণ মোহাচ্ছন্ন হইয়াছেন। কর্ণ ও দুৰ্য্যোধন মুহুর্ম্মুহুঃ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছেন। সকলেই মৰ্য্যাদাবিহীন হইয়া হাহাকার করিতেছে।
যুদ্ধনিবৃত্ত- পক্ষদ্বয়ের ভীষ্মসমীপে গমন
“হে রাজন! দেবব্রত ভীষ্ম রথ হইতে পতিত হইবামাত্র দুঃশাসন দুৰ্য্যোধনের নিয়োগানুসারে সসৈন্যে বর্ম্মিত হইয়া তাহাদিগকে বিষাদসাগরে নিমগ্ন করিয়া ত্বরিত-গমনে দ্রোণাচাৰ্য্যের সৈন্যাভিমুখে গমন করিতেছিলেন; কুরুগণ তদ্দর্শনে তিনি কি কহিবেন ভাবিয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিলেন। অনন্তর তিনি দ্রোণাচাৰ্য্যকে ভীষ্মের নিধনবার্ত্তা কহিলে দ্রোণাচাৰ্য্য সেই অপ্রিয় সংবাদ শ্রবণমাত্ৰ সহসা রথ হইতে নিপতিত হইলেন এবং অনতিবিলম্বেই সংজ্ঞা লাভ করিয়া স্বীয় সৈন্যগণকে প্রতিনিবৃত্ত করিলেন। পাণ্ডবগণ কৌরবগণকে প্রতিনিবৃত্ত নিরীক্ষণ করিয়া দ্রুতগামী অশ্বে আরূঢ় দূতগণদ্বারা স্বীয় সৈন্যগণকে নিবারিত করিতে লাগিলেন।
“সৈন্যগণ পরম্পৰ্য্যক্রমে নিবৃত্ত হইলে ভূপতিগণ কবচ পরিত্যাগ করিয়া ভীষ্মের নিকট গমন করিলেন এবং যোদ্ধৃগণ যুদ্ধ হইতে বিরত হইয়া যেমন অমরগণ প্রজাপতির সমীপে গমন করেন, সেইরূপ ভীষ্মের সমীপে উপস্থিত হইলেন। অনন্তর কৌরব ও পাণ্ডবগণ শরশয্যায় শয়ন ভীষ্মের নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলে তিনি সকলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহাভাগগণ! তোমাদিগের স্বাগত! হে মহারথীগণ! তোমাদিগের স্বাগত! আমি তোমাদিগের দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইতেছি।’ লম্বমানমস্তক [অবলম্বনের অভাবে দোদুল্যমান মস্তক-ঝুলে পড়া] কুরুপিতামহ ভীষ্ম তাঁহাদিগকে এইরূপ আমন্ত্রণ করিয়া পুনরায় কহিলেন, “হে ভূপতিগণ! আমার মস্তক অতিশয় লম্বমান হইতেছে, অতএব আমাকে উপাধান প্ৰদান কর।” ভূপতিগণ তৎক্ষণাৎ সূক্ষ্ম, কোমল ও উৎকৃষ্ট উপাধান সকল আহরণ করিলেন। ভীষ্ম তাহা গ্ৰহণ করিতে অনিচ্ছুক হইয়া সহাস্যবদনে কহিলেন, “হে পার্থিবগণ! এ সকল উপাধান এই বীরশয্যার উপযুক্ত নয়।” অনন্তর পুরুষপ্রধান শান্তনুনন্দন ধনঞ্জয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! হে মহাবাহো! হে বৎস! আমার মস্তক লম্বমান হইতেছে, অতএব উপযুক্ত উপাধান প্ৰদান কর।’ ”