একবিংশত্যধিকশততম অধ্যায়
পুৎত্রার্থ কুন্তীর উদ্বোধন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! কুরুকুলতিলক পাণ্ডু মহীপতির এই উপদেশবাক্যে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া পতিপ্রাণা কুন্তী কহিলেন, ”হে ধর্ম্মাত্মা! আমি তোমার ধর্ম্মপত্নী, বিশেষতঃ তোমাতেই অনুরক্ত, অতএব তোমার আমাকে এরূপ অনুমতি করা অতীব অসঙ্গত ও অনুচিত হইতেছে। হে মহাবাহো! তুমি স্বয়ং আমার গর্ভে অপতোৎপাদন করিতে পার, তাহাতে ধরম্মেরও অনুমাত্র হানি হয় না; হে কুরুবংশাবতংস! তুমি অপতোৎপাদনের নিমিত্ত আমার সহিত সহবাস কর, তাহা হইলে আমি তোমার সহিত স্বর্গে যাইতে পারিব। হে মহাত্মান! আমি তোমা ভিন্ন অন্য পুরুষকে কদাচ মনেও করি না, তোমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নর জগতীতলে আর কে আছে? হে মহাত্মান! আমি এ বিষয়ে একটি পৌরাণিকী কথা উল্লেখ করিতেছি, অনুগ্রহ করিয়া তাহা শ্রবণ কর।
মৃত্যৃর পর ব্যুষিতাশ্বের পুৎত্রলাভ
পূর্ব্বকালে পুরুবংশীয় পরম-ধার্ম্মিক ব্যুষিতাশ্ব নামে এক নরপতি ছিলেন। মহাত্মা ব্যুষিতাশ্ব যজ্ঞানুষ্ঠান করিলে ইন্দ্রাদি সমস্ত দেবগণ ও দেবর্ষিগণ আগমন করিয়াছিলেন। ইন্দ্র সোমরসপানে মত্ত ও ব্রাহ্মণগণ দক্ষিণালাভে পরিতৃপ্ত হন। দেবগণ ও ব্রহ্মর্ষিগণ স্বয়ং যজ্ঞকর্ম্ম করেন। ঐ যজ্ঞের অবসান হইলে মহারাজ ব্যুষিতাশ্ব গ্রীষ্মকালের দিবাকরের ন্যায় প্রখর-প্রতাপশালী হইয়া উঠিলেন। তিনি ক্রমে ক্রমে প্রাচ্য, উদীচ্য, পাশ্চাত্ত্য, দাক্ষিণাত্য সমস্ত দেশ জয় করিয়া তত্রত্য ভূপতিগণকে আপনার বশীভূত করিলেন এবং তত্তদ্দেশাহৃত নানাপ্রকার ধনসম্পত্তি দ্বারা পুনর্ব্বার এক যজ্ঞের আয়োজন করিলেন। যজ্ঞ নির্ব্বিঘ্নে সমাপ্ত হইল। তৎকালে ব্যুষিতাশ্ব দশ হস্তির বল প্রাপ্ত হইল । এইরূপে রাজা মহাবলপরাক্রান্ত হইয়া নিজ ভুজবলে সসাগরা ধরা জয় করিয়া ঔরসবৎ প্রজাপালন, মহাযজ্ঞানুষ্ঠান, দ্বিজাতিদিগকে প্রার্থনাধিক দান ও যজ্ঞে সোমরসপান ইত্যাদি নানাবিধ ধর্ম্মকর্ম্মানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন।
পরমরূপবতী ভদ্রানাম্মী কাক্ষীবানের তনয়া মহিষী হইয়াছিলেন। তাঁহার অলৌকিক রূপলাবণ্যগুণে পরম বিজ্ঞ মহিপতী অল্পদিনেই একান্ত বশীভূত হইলেন। এমন কি, রাজকার্য্য পর্য্যপ্ত পরিত্যাগ করিয়া দিনযামিনী সেই কামিনীর সহিত অন্তঃপুরবিহার করিতে লাগিলেন। অপরিমিত ইন্দ্রিয়াসক্তিবশতঃ অল্পকালের মধ্যেই তিনি যক্ষ্মারোগাক্রান্ত হইয়া কৃতান্তের করাল কবলে নিপতিত হইলেন। রাজাকে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত দেখিয়া অপুৎত্রা ভদ্রা সাতিশয় দুঃখিত হইয়া করুণস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন এবং নানাপ্রকার বিলাপ-সহকারে মৃতপতিকে সন্বোধন করিয়া কহিলেন, ”হে ধর্ম্মজ্ঞ! পতি বিনা নারীর আর গত্যন্তর নাই; বিধবার জীবন-ধারণ কেবল বিড়ম্বনামাত্র; মৃত্যু হইলেই মুক্তিপদ প্রাপ্ত হ্য়। হে নাথ! আমি তোমার সহগমন বাসনা করি; আমি তোমা বিনা একক্ষণও বাঁচিতে পারিব না; তুমি প্রসন্ন হইয়া আমাকে সমভিব্যাহারিণী কর। হে ক্ষৎত্রিয়শ্রেষ্ঠ! কি সমস্থলে, কি বিষমস্থলে, তুমি যেখানে গমন করিবে, আমি তোমার প্রিয়কারিণী ও বশবর্ত্তিনী হইয়া ছায়ার ন্যায় অনুগমন করিব। হে রাজন! অদ্যাবধি হৃদয়শোষক মনোদুঃখ সাতিশয় প্রবল হইয়া আমাকে যৎপরোনাস্তি কষ্ট প্রদান করিবে। হে নরনাথ! বোধ হয়, আমি পূর্ব্বজন্মে অনেকানেক প্রণয়িনীর প্রিয়বিচ্ছেদ করিয়াছিলাম, তন্নিমিত্তই এক্ষণে তোমার সহিত আমার বিচ্ছেদ হইল। হে রাজন! পতিবিহীন হইয়া নারীর মুহূর্ত্তমাত্র মর্ত্ত্যলোকে বাস নিতান্ত ক্লেশকর, না জানি, পূর্ব্বজন্মে আমি কতই দুষ্কর্ম্ম করিয়াছিলাম, তন্নিমিত্ত এক্ষণে আমাকে তোমার অনিবার্য্য বিয়োগানলে দগ্ধ হইতে হইল। আমি অদ্যাবধি কুশসংস্তর [দর্ভশয্যা–কুশের বিছানা] শায়িনী হইয়া ভবদীয় মোহনমূর্ত্তি দর্শনমানসে অতি কষ্টেই কালাতিপাত করিব। হে নরশ্রেষ্ঠ! একবার অনুগ্রহ করিয়া এই অনাথা, অশরণা [আশ্রয়হীনা], বিলাপকারিণী দীনাকে দর্শন প্রদান কর।’
ভদ্রা মৃতপতিকে আলিঙ্গন করিয়া পুনঃ পুনঃ এইরূপ বিলাপ করিতেছিলেন, এমন সময়ে আকাশবাণী শুনিতে পাইলেন, ‘হে বরারোহে! বিলাপ করিও না, গাত্রোত্থান করিয়া গমন কর; হে চারুহাসিনি! আমি তোমাকে বরপ্রদান করিতেছি, তুমি চতুর্দ্দশী বা অষ্টমীতে ঋতুস্নান করিয়া আমার সঙ্গে নিজ শয্যায় শয়ান থাকিবে, তাহা হইলে আমি স্বীয় শবে আবির্ভূত হইয়া তোমার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করিব।’ এই অমৃতময় বচনপরম্পরা শ্রবণে পরিব্রতা ভদ্রা কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া পুৎত্রকামনায় যথোক্ত কার্য্যের অনুষ্ঠানে তৎপর হইলেন এবং সেই শবসংসর্গে তিনজন শাল্ব ও চারিজন মদ্র প্রসব করিলেন। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! যেমন পরলোকগত ব্যুষিতাশ্ব স্বীয় সহধর্ম্মিণীর করুণবাক্যশ্রবণে দয়ার্দ্রচিত্ত হইয়া আপনার বংশরক্ষার্থ তাঁহার গর্ভে সন্তানোৎপাদন করিয়াছিলেন, সেইরূপ তুমিও আমার গর্ভে আপনার মানসপুৎত্র সমুৎপন্ন করিয়া নিজ বংশ ও আমার সতীত্ব রক্ষা করিতে পার।