১২০তম অধ্যায়
রাজ্যের উন্নতিজনক বিবিধ নীতি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি রাজধর্ম্মাৰ্থবেত্তা পূর্ধ্বতন রাজাদিগের আচরিত সাধুসম্মত বিবিধ রাজধৰ্ম্ম সবিস্তর কীৰ্ত্তন কবিলেন, এক্ষণে তাহার সারাংশ কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সমুদয় প্রাণীদিগের রক্ষণাবেক্ষণ করাই রাজাদিগের প্রধান ধর্ম্ম। অতএব যেরূপে লোকদিগকে রক্ষা করিতে হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ময়ূর যেমন নানাবিধ পক্ষ ধারণ করে, তদ্রূপ ধৰ্ম্মপরায়ণ নরপতিও বিবিধ রূপ ধারণ করিবেন। যে রাজা ক্রূরতা, কুটিলতা, ভীষণতা, সত্য, সরলতা ও তেজঃ প্রভৃতি বিবিধ গুণে ভূষিত হয়েন, তিনি নিশ্চয়ই সুখভোগ করিতে পারেন। যে কাৰ্য্যসাধনসময়ে যেরূপ রূপধারণ করিলে হিত হইবার সম্ভাবনা, সেই কাৰ্য্যসাধনসময়ে সেইরূপ রূপধারণ করা রাজাদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। বহুরূপধারী নরপতি অতি সূক্ষ্ম অর্থসাধনেও অসমর্থ হয়েন না। শরৎকালীন শিখীর [ময়ূরের] ন্যায় মূকভার অবলম্বনপূৰ্ব্বক মন্ত্রণা-গোপন, অল্পবাক্য প্রয়োগ, শাস্ত্রে পারদর্শিতালাভ, মন্ত্রভেদাদি কাৰ্য্য-পরিত্যাগ ও সিদ্ধ ব্রাহ্মণগণের উপাসনা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে রাজা অর্থসংগ্রহ করিতে বাসনা করেন, তিনি ধৰ্ম্মের চিহ্ন প্রকাশ করিয়া স্বীয় ক্রূরতাদি দোষ গোপন রাখিবেন এবং প্রতিনিয়ত উদ্যতদণ্ড ও অপ্রমত্ত হইয়া প্রজাগণের আয়-ব্যয় বিবেচনাপূৰ্ব্বক করগ্রহণ করিবেন। স্বপক্ষের প্রতি বিশুদ্ধ ব্যবহার, অশ্বাদি-সঞ্চারণদ্বারা শত্রুগণের শস্যক্ষয় ও আপনার দোষের প্রতি দৃষ্টিপাত করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। বুদ্ধিমান্ নরপতি সহায়সম্পন্ন হইয়াই বিক্রম প্রকাশ, শত্রুগণের দোষ উদঘোষণ ও তাহাদিগকে নিপীড়ন করিবেন; অন্যপ্রদেশ হইতে আরণ্য কুসুমের ন্যায় অর্থ আহরণে প্রবৃত্ত হইবেন। সমৃদ্ধিশালী মহাবলপরাক্রান্ত নরেন্দ্রগণের দুর্গাধিপতির সহিত সন্ধি করিয়া ছলসহকারে দুর্গে প্রবেশ ও গোপনে যুদ্ধ করিয়া ভূপতিগণের প্রাণসংহার করিবেন। বর্ষাকালীন ময়ূরের ন্যায় অদৃশ্যভাবে রজনীযোগে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া বিচরণ করিবেন, কদাচ বর্ম্ম পরিত্যাগ করিবেন না; স্বয়ং আত্মরক্ষায় যত্নবান থাকিবেন এবং যাহাতে পরকীয় চরগণের মায়াজালে নিপতিত হইতে না হয়, সতত এরূপ চেষ্টা করিবেন। শত্রুসম্পর্কীয় চরদিগের কপটজাল বুঝিতে না পারিয়া তাহাতে নিপতিত হইলে রাজাকে নিশ্চয়ই বিনষ্ট হইতে হয়। অতএব যাহাতে উহাদের ঐ কপটতা প্রকাশ হয়, তদ্বিষয়ে যত্ন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। কুটিলস্বভাব ক্রুদ্ধ শত্রুগণকে বিনাশ, নটনর্ত্তকাদির পুর হইতে নির্ব্বাসন ও দৃঢ়মূল স্বীয় অমাত্যগণকে যত্নসহকারে রক্ষা করা আবশ্যক। বুদ্ধিমান ভূপতি ময়ূরের ন্যায় আত্মপক্ষবিস্তার এবং গহনবনে প্রবিষ্ট পতঙ্গগণের ন্যায় শত্রুরাজ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক উহা আক্রমণ করিবেন।
“যত্নসহকারে রাজ্যপালন ও নীতি অবলম্বন করা বিচক্ষণ ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। আত্মবুদ্ধিদ্বারা কর্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য বিচার ও পরবুদ্ধিদ্বারা দৃঢ়তাসম্পাদন করা আবশ্যক। শাস্ত্রবুদ্ধিদ্বারাই কর্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য স্থির করিতে পারা যায়, এই নিমিত্তই শাস্ত্র প্রয়োজনীয় বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। সন্ধিস্থাপনপূর্ব্বক শত্রুর বিশ্বাস উৎপাদন, পরাক্রম প্রকাশ ও স্বীয় বুদ্ধিদ্বারা কাৰ্য্যের যথার্থ নিরূপণ করা ভূপতিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। যাঁহারা স্বভাবতঃ শান্তপ্রকৃতি, প্রাজ্ঞ ও কার্য্যাকাৰ্য্য বিবেচক, তাঁহাদিগকে নিগূঢ়বুদ্ধি [মন্ত্রগোপনের শক্তিসম্পন্ন] পণ্ডিতগণের উপদেশের অপেক্ষা করিতে হয় না। বৃহস্পতিতুল্য বুদ্ধিমান প্রাজ্ঞ ব্যক্তি দৈবভ্রমে একবার নির্ব্বোধের ন্যায় কাৰ্য্য করিয়া জনসমাজে নিন্দিত হইলে অচিরাৎ সলিলনিক্ষিপ্ত তপ্ত লৌহের ন্যায় পুনরায় স্বীয় প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়েন।
“কি আপনার, কি অন্যের, সকলেরই কাৰ্য্যসমুদয় শাস্ত্রানুসারে সম্পাদন করা ভূপতির অবশ্য কর্ত্তব্য। অর্থবিধানজ্ঞ মহীপাল সুশীল, প্রাজ্ঞ, বীর ও বলবানদিগকে স্বীয় কার্য্যে নিযুক্ত করিয়া তাহাদের অনুষ্ঠিত কাৰ্য্যে অনুমোদন করিবেন। ধৰ্ম্মের অবিরোধে সমুদয় লোকের প্রিয় আচরণ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। প্রজাগণ যে রাজাকে আত্মীয় বলিয়া বিবেচনা করে, তাঁহাকে পৰ্ব্বতের ন্যায় স্থির বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে। ব্যবহারসময়ে প্রিয় ও অপ্রিয়কে সমান জ্ঞান করিয়া ধৰ্ম্মরক্ষা করাই নরপতির প্রধান কার্য্য। কুলধৰ্ম্মজ্ঞ, দেশধৰ্ম্মবেত্তা, মৃদুভাষী, হিতৈষী, জিতেন্দ্রিয়, অলুব্ধ, সুশিক্ষিত, ধৰ্ম্মনিষ্ঠ, প্রৌঢ়াবস্থ [প্রৌঢ় বয়সপ্রাপ্ত—বার্দ্ধক্যের পূর্ব্বাবস্থাপন্ন], নির্দ্দোষ ব্যক্তিদিগের প্রতি সমুদয় কাৰ্য্যের ভারাপণ করা উচিত। ভূপতিগণ এইরূপে কার্য্যের গতি নিরূপণপূৰ্ব্বক চরগণের সহিত সন্তুষ্টচিত্তে কালহরণ করিবেন। যে রাজার ক্রোধ ও হর্ষ অব্যর্থ এবং যিনি স্বয়ং সমুদয় রাজকাৰ্য্য পর্য্যবেক্ষণ ও আয়ব্যয় নিরূপণ করেন, বসুন্ধরা তাঁহাকেই বিপুল সম্পত্তিপ্রদান করিয়া থাকেন, সন্দেহ নাই। যে রাজা প্রকাশরূপে অনুগ্রহপ্রদর্শন, ধৰ্ম্মানুসারে দণ্ডবিধান এবং সতত. আত্মরক্ষা ও রাজ্যপালন করেন, তিনিই যথার্থ রাজধৰ্ম্মজ্ঞ। নরপতি কিরণজালমণ্ডিত সমুদিত দিবাকরের ন্যায় প্রত্যহ স্বয়ং পরিভ্রমণপূৰ্ব্বক স্বীয় রাজ্য পর্য্যবেক্ষণ করিয়া সমুদয় সমাচার অবগত হইবেন। লোকে যেমন গাভী দোহন করে, তদ্রূপ বুদ্ধিমান রাজা প্রত্যহ পৃথিবী হইতে অর্থসংগ্রহ করিবেন। উপযুক্ত সময়ে প্রজাগণের নিকট অর্থগ্রহণ ও অর্থলাভবিষয় গোপন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। মধুকর যেমন ক্রমে ক্রমে পুষ্প হইতে মধু আহরণ করে, রাজাও তদ্রূপ ক্রমশঃ অর্থসঞ্চয় করিবেন। শাস্ত্রজ্ঞ নরপতি সহজে সঞ্চিতার্থ ব্যয় করেন না। সঞ্চয় করিয়া যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে, তদ্দ্বারাই ধৰ্ম্ম ও কামের অনুশীলন করা কর্ত্তব্য। অল্প অর্থে তাচ্ছিল্য প্রকাশ, শত্ৰুদিগের প্রতি অবজ্ঞা ও নির্ব্বোধের প্রতি বিশ্বাস না করিয়া স্বীয় বুদ্ধিবলে আপনার উন্নতিসাধনে চেষ্টা করা রাজাদিগের নিতান্ত আবশ্যক।
“ধৈৰ্য্য, দক্ষতা, লোভাদি-সংযম, বুদ্ধিবৃত্তি, শরীরের পটুতা, গাম্ভীর্য্য, শৌর্য্য এবং সাবধানে দেশকাল পর্য্যবেক্ষণ এই আটটি অল্প বা প্রভূত অর্থের বৃদ্ধির হেতু। হুতাশন অল্পমাত্র হইলেও ঘৃতসংযোগে পরিবর্দ্ধিত হয় এবং বীজ একমাত্র হইলেও সহস্র অঙ্কুর উৎপাদন করে; অতএব প্রভূত আয়ব্যয়শালী ব্যক্তির অল্পমাত্র ধনেও সাবধানতা প্রদর্শন করা কর্ত্তব্য। শত্রু বালক, যুবা ও বৃদ্ধ যেরূপ হউক না কেন, প্রমত্ত পুরুষের বিনাশসাধনে অনায়াসেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারে; আর শত্রু কালসহকারে সুসম্পন্ন হইলে রাজাকে সমূলে উন্মূলিত করিতে সমর্থ হয়; অতএব যে নরপতি কালজ্ঞ, তিনিই সকলের শ্রেষ্ঠ সন্দেহ নাই। বিদ্বেষপরবশ শত্ৰু দুর্ব্বল হউক বা বলবাই হউক, চেষ্টা করিলেই বিপক্ষের কীৰ্ত্তি, ধর্ম্ম ও বীৰ্য্য উচ্ছিন্ন করিতে সমর্থ হয়; অতএব যে রাজার শত্রু আছে, তাঁহার কদাপি প্রমত্ত হওয়া উচিত নহে। রাজা জয়লাভ বা ঐশ্বৰ্য্যলাভের আকাঙ্ক্ষা করিলে অর্থের ক্ষয়, বৃদ্ধি, সঞ্চয় ও পালন সবিশেষ অনুধাবনপূৰ্ব্বক সন্ধি বা যুদ্ধাদি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিবেন। ঐ সমস্ত কার্য্যসংসাধনের নিমিত্ত বুদ্ধিমানের আশ্রয় গ্রহণ করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। অতি প্রখরবুদ্ধি বলবান্ শত্রুকেও বিনষ্ট ও অবসন্ন করিতে পারে এবং বুদ্ধিপ্রভাবে পরিবর্দ্ধিতবলও সুরক্ষিত হয়; সুতরাং বুদ্ধিপূৰ্ব্বক যেসমস্ত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা যায়, তৎসমুদয়ই প্রশস্ত। যে মহীপাল গম্ভীরস্বভাব ও নির্দ্দোষ, তিনি অল্পবলেই সমস্ত অভিলাষ সফল করিতে সমর্থ হয়েন। আর যিনি অল্পবলে লুব্ধ ও গর্ব্বিত হইয়া উঠেন, তিনি কখনই মঙ্গললাভ করিতে পারেন না। অতএব বুদ্ধিমান রাজা শান্তভাব অবলম্বন করিয়াই প্রজাবর্গ হইতে কর গ্রহণ করিবেন। যে রাজা বহুকাল প্রজাদিগকে পীড়ন করেন, তাঁহাকে বিদ্যুতের ন্যায় অচিরাৎ নিমীলিত [নিঃশেষিত-নিশ্চিহ্ন] হইতে হয়। বিদ্যা, তপঃ ও বিপুলবিত্ত প্রভৃতি বুদ্ধিসাধ্য কাৰ্য্যসমুদয় উদ্যোগদ্বারাই লব্ধ হইয়া থাকে; অতএব অধ্যবসায়ই সর্ব্বোৎকৃষ্ট।
“ইন্দ্র, বিষ্ণু, সরস্বতী ও বুদ্ধিমান্, মনস্বী [প্রশস্তমনাঃ], এবং অন্যান্য প্রাণীগণ দেহ আশ্রয় করিয়া আছেন; অতএব বিদ্বান্ব্যক্তি কদাচ দেহের অবমাননা করিবেন না। অর্থদান করিয়া লুব্ধকে আয়ত্ত করিবার চেষ্টা করিবে। লুব্ধ ব্যক্তি প্রভূত পরিমাণে পরধন প্রাপ্ত হইলেও পরিতৃপ্ত হয় না এবং অর্থহীন হইলে ধৰ্ম্মকাম পরিত্যাগ করিয়া থাকে। লুব্ধ ব্যক্তি অন্যের পুত্র, কলত্র, সমৃদ্ধি ও ভোগ্যবস্তু প্রার্থনা করে। লোভাক্ৰান্ত লোকের বিস্তর দোষ জন্মিবার সম্ভাবনা; অতএব রাজা লুব্ধ ব্যক্তিকে কদাচ আশ্রয় প্রদান করিবেন না। বুদ্ধিমান্ ভূপতি নীচব্যক্তিকেও শত্রুর কাৰ্য্যসন্দর্শনার্থ প্রেরণ করিয়া তাহার সমুদয় উদ্যোগ ও অনুষ্ঠান বিনষ্ট করিবেন। যে সৎকুলসম্ভূত মহীপাল সতত ব্রাহ্মণমণ্ডলীতে তত্ত্বানুসন্ধান করেন, এবং যিনি মন্ত্রিগণদ্বারা সতত সুরক্ষিত হয়েন, তিনিই সমস্ত নরপতিগণকে বশীভূত করিতে পারেন।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি সংক্ষেপে যেসমুদয় বিধি নির্দিষ্ট রাজধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলাম, তৎসমুদয় তোমার হৃদয়ঙ্গম হউক। যে রাজা এই সমুদয় বিলক্ষণরূপে অবগত হয়েন, তিনি অনায়াসে পৃথিবী পালন করিতে পারেন। যে নরপতি নীতিসম্ভূত সুখভোগে অনাস্থা করিয়া দৈবপ্রাপ্ত সুখভোগে অভিলাষী হয়েন, তাঁহার রাজ্যসুখ বা উৎকৃষ্ট গতিলাভের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। রাজা সন্ধিবিগ্রহাদিবিষয়ে অপ্রমত্ত হইলে অনায়াসে ধনশালী সৌর্য্যাদিযুক্ত দৃঢ়বিক্রম শত্রুগণকে বিনষ্ট করিতে পারেন। কাৰ্য্যসাধনসময়ে দৈবের উপর নির্ভর না করিয়া বিবিধ উপায় নির্দ্ধারণ করাই বুদ্ধিমানের কর্ত্তব্য। যাঁহারা নির্দোষের প্রতি দোষারোপ করেন, তাঁহারা কদাচ বিপুল সম্পত্তি ও প্রভূত যশঃলাভ করিতে পারেন না। দুইজন মিত্র পরস্পর প্রীতিসম্বন্ধ হইয়া পরস্পরের কাৰ্য্যসাধনে প্রবৃত্ত হইলে উহাদের মধ্যে যিনি অপেক্ষাকৃত গুরুতর কাৰ্য্যসাধন করেন, পণ্ডিতেরা তাঁহারই প্রশংসা করিয়া থাকেন। হে বৎস! আমি এক্ষণে যেরূপ রাজধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলাম, তুমি তাহার অনুবর্তী হইয়া প্রজাপালনে অনুরক্ত হও, তাহা হইলেই পরমসুখে পুণ্যফল ভোগ করিতে পারিবে। ধৰ্ম্মই সমুদয় লোকরক্ষার মূলকারণ।”