১২০তম অধ্যায়
যযাতির স্বৰ্গচ্যুতি
“কিয়ৎক্ষণ পরে মহারাজ যযাতি কম্পিতমনাঃ, শোকাভিভূত ও জ্ঞানশূন্য হইয়া আসনভ্রষ্ট ও স্বস্থান হইতে প্রচলিত হইলেন। তাঁহার মাল্য স্নান এবং বসন, মুকুট ও অঙ্গদপ্রভৃতি আভরণসমুদয় স্থলিত হইল, তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ বিঘূর্ণিত হইতে লাগিল। দেবগণপ্রভৃতি [স্বৰ্গবাসী অন্যান্য গণদেবতা] সকলে কখন তাঁহার নয়নগোচর ও কখন বা নয়নের বহির্ভূত হইতে লাগিলেন। তিনি অদৃশ্য হইয়া শূন্যচিত্তে মহীতল নিরীক্ষণপূর্ব্বক মনে মনে চিন্তা করিলেন, আমি মনোমধ্যে এমন কি ধর্ম্মদূষণ [ধর্ম্মগর্হিত] অশুভকর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়াছি যে স্থানচ্যুত হইলাম? তখন তত্রস্থ ভূপতি, অপ্সরা ও সিদ্ধগণ দেখিলেন, নহুষতনয় যযাতি স্বৰ্গচ্যুত হইতেছেন।
“ক্ষীণপুণ্য জনগণকে ভূতলে নিক্ষেপ করিবার নিমিত্ত স্বৰ্গমধ্যে যেসকল দূত নির্দ্দিষ্ট আছে, ঐ সময় তাহাদের মধ্যে একজন সুররাজের আদেশানুসারে যযাতির সমীপে উপস্থিত হইয়া কহিল, “মহারাজ! তুমি সাতিশয় গর্ব্বিত, সকলেরই অবমাননা করিয়া থাক, তন্নিবন্ধন তোমার স্বৰ্গভোগ বিনষ্ট হইয়াছে; তুমি স্বর্গের অনুপযুক্ত; অতএব ত্বরায় স্বৰ্গ হইতে পরিচ্যুত [পরিভ্রষ্ট] হইয়া ভূতলে পতিত হও।” পতনোন্মুখ নহুষাত্মজ মহারাজ যযাতি, ‘আমি যেন সাধুগণের মধ্যে নিপতিত হই’ এই কথা তিনবার বলিয়া আপনার গতি চিন্তা করিতেছেন, এমন সময় নৈমিষারণ্যে প্ৰতর্দন, বসুমনা, ঔশীনর [উশীনরের পুত্র], শিবি ও অষ্টক এই চারিজন প্রধান ভূপতিকে দেখিলেন। ঐ লোকপালসদৃশ ভূপতিচতুষ্টয় বাজপেয়যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা সুররাজের প্রীতিসাধন করিতেছেন। যজ্ঞধূম স্বৰ্গদ্বারা পর্য্যন্ত সমুত্থিত হইয়া ধূমময়ী নদীর ন্যায়, স্বৰ্গ হইতে ভূতলে নিপতিত মন্দাকিনীর ন্যায় শোভা ধারণ করিয়াছে। মহারাজ নহুষতনয় সেই পরমপবিত্ৰ যজ্ঞধূম আঘ্রাণ ও অবলম্বন করিয়া ঐ ভূপতিচতুষ্টয়ের মধ্যে নিপতিত হইলেন।
দৌহিত্রপ্রভাবে যযাতির পুনঃ স্বৰ্গাধিকার
“প্ৰতর্দ্দনপ্রমুখ ভূপতিচতুষ্টয় যযাতিকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! আপনি কে? কাহার বন্ধু? আপনি গ্ৰাম্য কি নাগরিক [নগরবাসী]? আপনাকে মনুষ্য বলিয়া বোধ হইতেছে না; আপনি কি দেব, না যক্ষ, না গন্ধৰ্ব, না রাক্ষস, আপনার এখানে আগমনের প্রয়োজন কি?”
“যযাতি কহিলেন, “মহাশয়! আমার নাম যযাতি। আমি পুণ্যক্ষয় হওয়াতে স্বৰ্গচ্যুত হইয়া ভূতলে পতিত হইয়াছি। আমি সাধুদিগের মধ্যে পতিত হইব মনে করিয়াছিলাম বলিয়া আপনাদের মধ্যে নিপতিত হইয়াছি।”
“তখন নৃপচতুষ্টয় কহিলেন, “মহাশয়! আপনি যথার্থই কহিয়াছেন; যাহা হউক, এক্ষণে আমাদিগের যজ্ঞফল ও ধর্ম্মগ্রহণপূর্ব্বক স্বর্গে গমন করুন।”
“যযাতি কহিলেন, “হে সাধুগণ! আমি প্রতিগ্রহজীবী [দানগ্রহণদ্বারা প্ৰাণধারণকারী] ব্রাহ্মণ নহি; আমি ক্ষত্রিয়, বিশেষতঃ পরপুণ্যনির্যাকরণে [অপরের পুণ্যগ্ৰহণদ্বারা তাহার পুণ্যক্ষয় করার] আমার প্রবৃত্তি নাই।”
“মহারাজ যযাতি ও প্রতর্দ্দনপ্রভৃতি ভূপতিচতুষ্টয় এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময়ে যযাতিকন্যা মাধবী মৃগচৰ্য্যাক্রমে [বনভ্ৰমণ করিতে করিতে] তথায় সমুপস্থিত হইলেন। প্রতর্দ্দনাদি ভূপতিচতুষ্টয় তাঁহাকে অবলোকন করিয়া অভিবাদনপূর্ব্বক কহিলেন, “জননি! এই আপনার পুত্ৰগণ সমুপস্থিত আছে, আজ্ঞা করুন, কি করিতে হইবে?” মাধবী তাঁহাদের বাক্যে পরম পরিতুষ্ট হইয়া স্বীয় পিতা যযাতির সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে অভিবাদনপূর্ব্বক ও পুত্ৰগণের মস্তক স্পর্শ করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে তাত! এই চারিজন আমার পুত্র ও আপনার দৌহিত্র, ইহারা আপনাকে উদ্ধার করিবে, আর আমি আপনার কন্যা মাধবী, আমি যে ধর্ম্ম উপার্জ্জন করিয়াছি, আপনি তাহার অৰ্দ্ধভাগ গ্রহণ করুন। মনুষ্যগণ অপত্যোপার্জিত [বংশধরগণের অর্জিত] ধর্মের ফলভোগ করিয়া থাকে। এবং সদগতিলাভের নিমিত্ত দৌহিত্র প্রার্থনা করে।”
“অনন্তর প্রতর্দ্দনপ্রমুখ ভূপতিগণ মাতা ও মাতামহকে অভিবাদন করিয়া অতি উচ্চ গভীরস্বরে মেদিনীমণ্ডল প্ৰতিধ্বনিত করিয়া মাতামহকে উদ্ধার করিবার বাসনা প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে তপোধন গালব তথায় সমুপস্থিত হইয়া যযাতিকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনি আমার তপস্যার অংশ গ্রহণপূর্ব্বক স্বর্গে গমন করুন।’ ”