ইউনিকর্ন? জিজ্ঞেস করল কিশোর, কি হয়েছে ওর?
রান্নাঘরের দরজার নিচে একটা নোট পেয়েছে লিলি। তাতে লেখা হয়েছে…
লিলি কোথায়?
ওপরে। ঘরে।
একটা মুহর্ত আর দেরি করল না কিশোর। দৌড় দিল। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে লাগল। পেছনে রয়েছে রবিন আর মুসা। জানালার চৌকাঠে লিলিকে বসে থাকতে দেখল ওরা। তাকিয়ে রয়েছে মাঠের দিকে। কাঁধ ঝুলে পড়েছে। হাতে একটুকরো সাদা কাগজ।
তিন গোয়েন্দার সাড়া পেয়ে মুখ ফেরাল সে। কিশোরের চোখে পড়তে বলল, তুমি ঠিকই অনুমান করেছ। চুরিই করেছে। হাতের কাগজটা দলামোচড়া করে ফেলল। কিন্তু আমার এত বড় সর্বনাশ করলটা কে?
কিছুটা আন্দাজ করতে পারি আমি, জবাব দিল কিশোর।
কাগজটা কিশোরের হাতে দিল লিলি।
খুলল কিশোর। টাইপ করে লেখা রয়েছে, লিলি, ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিওতে তুমি যোগ দিতে গেলে মারা যাবে ইউনিকর্ন। তোমার ঘোড়া আমিই চুরি করেছি, গাড়িতে বাজি রেখে পুড়িয়ে দিয়েছি। তারমানে ঘোড়াটাকে মারতে যে আমার হাত কাঁপবে না বুঝতেই পারছ।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। লিলি, ব্রড জেসনের ব্যাপারে কতখানি জানেন আপনি?
বড় বড় হয়ে গেল লিলির সবুজ চোখ। ব্রড এতে জড়িত নয়।
সেটা জোর দিয়ে বলতে পারেন না। এমন কেউ ইউনিকর্নকে চুরি করেছে যে এই র্যাঞ্চের সব কিছুই চেনে। যে আপনার গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পায়।
সে রকম তো অনেকেই আছে এই র্যাঞ্চে।
সেই অনেকে কি জ্যান্ত ব্যাটলম্নেক নাড়াচাড়া করতে পারে? বাজি বিশেষজ্ঞ? আমার ব্যাগে যে সাপটা পাওয়া গেছে ওটা বনের সাপ নয়, মরুভূমির। নিয়ে আসা হয়েছে কুপারের চিড়িয়াখানা থেকে। কুপারের ধারণা, ব্রডই চুরি করেছে।
দাঁতে দাঁতে ঘষল লিলি। এইমাত্র গেল কুপার। সাপের দাম চাইতে এসেছিল। সোজা ভাগিয়ে দিয়েছে তাকে লুক। কুপারকে দুচোখে দেখতে পারে না। অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে লিলি। ওর ধারণা, ডাবল সিতে গোলমাল লাগানর মূলে ওই কুপার র্যাঞ্চ।
আপনার কি ধারণা?
কাকে দায়ী করব বুঝতে পারছি না। তবে ইউনিক আব্বাকে ফেলে দেয়ার পর অনেকগুলো অঘটন ঘটেছে এই র্যাঞ্চে।
আরেকবার নোটটা পড়ল কিশোর। ব্রডকে চাকরি দেয়ার পর থেকে অঘটনগুলো ঘটতে শুরু করেনি তো? ভাল করে ভেবে দেখুন।
না। ব্রডকে আমার সন্দেহ হয় না।
কিন্তু ওর ক্রিমিন্যাল রেকর্ড রয়েছে, রবিন বলল। চুরি করত।
এখন করে না। ইউনিকের ক্ষতিও করবে না। এই র্যাঞ্চের জন্যে ও একটা বিরাট সাহায্য। ভাল হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে।
কিন্তু ঘোড়াটাকে নিয়ে প্রচুর আজেবাজে কথা বলেছে সে, রবিন বলল।
ও কিছু না। বাবাকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছে বলে রাগ। তাই বলে পছন্দ করে না এটা ঠিক নয়। উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরের হাত থেকে নোটটা নিল লিলি। আরেকবার পড়ল। আমাকে খুন করার চেষ্টা সে কেন করবে?
গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলছেন তো? কিশোর বলল, করেছেহয়তো বেনিকে সাহায্য করার জন্যে। আপনাকে ঠেকাতে চাইছে যাতে রোডিওতে যোগ দিতে না পারেন, যাতে বেনির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারেন। আপনি গেলে তার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মাথা নাড়ল লিলি, বুঝতে পারছি না কি করব?
আর, যাই করেন, রোডিওতে যোগ না দেয়ার চিন্তা করবেন না। এখন বলুন, র্যাঞ্চে টাইপরাইটার আছে?
একটা। তবে নোটের লেখা আর ওটার লেখা এক নয়। হরফ মেলে না।
নোটটা নিয়ে গিয়ে ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ডকে দেখান। ইউনিকর্নের চুরির ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিতে পারে এবার।
আবার বাজল ডিনারের ঘণ্টা। মুসা বলল, চলো, আমার খিদে পেয়েছে।
আমার খিদে নষ্ট হয়ে গেছে, লিলি বলল। তোমরা যাও। একটু পরেই আসছি। কেরোলিন আন্টিকে চিন্তা করতে মানা করো।
করিডরে বেরিয়ে রবিন বলল, করতে মানা করলেই কি আর চিন্তা করা বন্ধ করে দেবেন। উদ্বেগ নিয়েই যেন জন্মেছেন মহিলা, সবার জন্যেই খালি চিন্তা।
বোনপোর কথা শুনুক আগে, মুসা বলল, তারপর দেখবে চিন্তা কাকে বলে। সত্যি, ব্রডটা যে কেন একাজ করতে গেল। ভীষণ কষ্ট পাবেন মহিলা। আরও বেশি কষ্ট লাগবে চাকরিটা তিনিই দিয়েছেন বলে।
কিশোর কিছু বলল না। চুপচাপ এসে ঢুকল ঘরে। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এল। কাপড় পাল্টাল। চুল আঁচড়াল। কি যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না ওর। ঠিক করল, খাওয়ার পর ভাবতে বসবে। প্রথম থেকে যা যা ঘটেছে সব খতিয়ে দেখবে। বোঝার চেষ্টা করবে কোন ব্যাপারটা মিস করেছে। যদি তা-ও বুঝতে না পারে, সরাসরিই গিয়ে ব্রডকে বলবে তার সন্দেহের কথা।
.
খাওয়ার পরে সবাইকে শান্ত দেখা গেল। কেউ আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিল, কেউ ঢেকুর তুলল, কেউ বা খিলাল দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগল। কেবল কিশোরই অস্থির। উসখুস করছে আর বারবার জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে মিস্টি ক্যানিয়নের দিকে। ওখানে, ওখানেই কোথাও নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ইউনিককে। ব্রড হয়ত জানে, কোথায়।
এমন কিছু কি আছে বাঙ্কহাউসে কিংবা ট্যাক রুমে যা ওর চোখ এড়িয়ে গেছে? থাকলে, গিয়ে খুঁজে বের করার এটাই সুযোগ। রবিনকে একধারে নিয়ে। গিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলল। তারপর উঠে এল ওপরে। একটা স্টেটসন হ্যাট মাথায় বসিয়ে, টর্চ হাতে বেরিয়ে এল। নিঃশব্দে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে চলে এল চত্বরে।
আকাশে মেঘ জমেছে। গায়ে লাগল ঠাণ্ডা বাতাস। দ্রুতপায়ে বাঙ্কহাউসের দিকে এগোল সে। কাছে এসে টোকা দিল দরজায়, ভেতরে কেউ আছে কিনা জানার জন্যে। সাড়া পেল না।
দম বন্ধ করে আস্তে ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা।
বড় একটা স্লিপিং রুম, একটা বাথরুম আর লকার রয়েছে বাঙ্কহাউসে। লকারগুলোতে আলো ফেলল। কাগজে নাম লিখে লিখে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ওগুলোর পাল্লায়, কার কোনটা বোঝানোর জন্যে। একটাতে দেখা গেল ব্রড জেসনের নাম। হ্যাঁণ্ডেল ধরে টান দিল কিশোর। জোরে ক্যাচকোচ করে খুলে গেল পাল্লা।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকটার জিনিসপত্র দেখতে লাগল সে। সন্দেহজনক আর কিছুই পেল না, একটা রূপার বাকলসওয়ালা বেল্ট বাদে। এক বাণ্ডিল চিঠিপত্র আর কাগজ দেখে সেগুলোতে চোখ বোলাল। এমনকি বুটের ভেতরেও খুঁজল। কিছু পেল না।
লকারের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। বাড়ির দিকে তাকাল, চত্বরে চোখ বোলাল। কাউকে দেখতে পেল না। তাকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি চলছে এরকম কোন লক্ষণও নেই। লিভিং রুমের জানালা দিয়ে মেহমানদের দেখা যাচ্ছে। পাতাবাহারের একটা বেড়ার আড়ালে চলে এল সে। বেড়াটা চলে গেছে ট্যাক রুমের কাছে। আড়ালে থেকে এগিয়ে চলল।
জানালা নেই ট্যাক রুমের। বাতাসে চামড়া আর তেলের গন্ধ। ঝুলিয়ে রাখা। জিনিসগুলোর ওপর আলো ফেলল সে। কোন কিছু অস্বাভাবিক লাগছে না, কিছু খোয়া গেছে বলেও মনে হচ্ছে না। ব্রডের ঘোড়ায় চড়ার সরঞ্জামগুলো খুঁজে কিছু পেল না।
হতাশ হল কিশোর। ঘড়ি দেখল। আধ ঘন্টা হয়েছে বেরিয়েছে। আর বেশি দেরি করা যাবে না, তাহলে কেউ লক্ষ্য করে বসবে যে অনেকক্ষণ ধরে সে নেই ওদের মাঝে। খোঁজ পড়তে পারে।
ভাবতে ভাবতেই গিয়ে মেডিক্যাল কেবিনেট খুলল সে। প্রতিটি টিউব আর শিশি-বোতলের লেবেল পড়তে লাগল। যদি কিছু পেয়ে যায়, এই আশায়। কিন্তু এখানেও নিরাশ হতে হলো তাকে।
কিন্তু আছেই, নিজেকে বোঝাল সে, থাকতেই হবে। না থেকে পারে না। নইলে হারিকেন অস্বাভাবিক আচরণ করল কেন? আরেকবার ভাল করে দেখতে গিয়ে একটা শিশির গায়ে চোখ আটকে গেল। আগের বার খেয়াল করেনি। একটা পারঅক্সাইডের বোতলের ওপাশে রাখা হয়েছে। লেবেল দেখার জন্যে বের করতে গেল ওটা, এই সময় পেছনে শোনা গেল বুটের শব্দ।
আরেকটু হলেই হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল শিশিটা। লেবেল দেখার সময় নেই। পকেটে রেখে দিল। সাথে করে নিয়ে যাবে। টর্চ নিভিয়ে দিল সে। দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল, চোখে না পড়ার জন্যে। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। আওয়াজটা কোথায় হলো? ট্যাক রুমের ভেতরে, না বাইরে?
ধক ধক করে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। কি মনে হতে আস্তে করে ঘুরে তাকাল দরজার দিকে। বিশালদেহী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, ছায়ামূর্তির মত। হাত তুলল লোকটা।
দম আটকে গেল যেন কিশোরের। লোকটার হাতে একটা চাবুক। এগিয়ে আসতে শুরু করল, যেন জানে কোথায় লুকিয়ে আছে কিশোর।
ঝট করে বসে পড়ল সে। শপাং করে উঠল লোকটার হাতের চাবুক। বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল কিশোরের মুখের কাছ দিয়ে।