১১-২০. ব্লাউজের দোকানে

১১.

বন্দনা বিরস গলায় বললেন, কে খবর দিল ভদ্রা এসেছে?

বাঃ! বললাম না সেদিন ব্লাউজের দোকানে চন্দ্রার সঙ্গে দেখা, বলল দিদি সামনের রবিবারে আসবে। তো আজ তো বুধবার হয়ে গেল।

বন্দনা আরও বিরস হলেন, তা সে তো কই একবার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেনা? তুইই কেবল ছুটে ছুটে যাস।

বাঃ! ও এতদিন পরে পরে আসে, মা বাবা ভাইবোন সবাই হাঁ করে থাকে, আসবে কী করে?

 ঠিক আছে, যাও, বেশি দেরি কোরো না।

শানু নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়েই যাচ্ছিল, মায়ের এই নিষেধবাণী শুনে ঠিকরে উঠল। ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ওঃ, শানু লক্ষ্মীছড়ি কোথাও একটু যেতে চাইলেই পাশপোর্ট পারমিশান, কেন, কী বৃত্তান্ত, দেরি করিস না! আর মহারানি যে যখন ইচ্ছে তখন জরির আঁচল উড়িয়ে ফুরফুরিয়ে বেরিয়ে যান, তখন তো স্রেফ মুখে তালাচাবি।…আচ্ছা এসো! দুর্গা দুর্গা।

মার ভঙ্গিটা নকল করল শানু।

বন্দনা গম্ভীর হলেন, বললেন, তোমার উপর যতক্ষণ এক্তার আছে বলছি, পরে আর বলব না।

চমৎকার! বউয়ের উপর কোনও এক্তার নেই তোমার?

নাঃ!

 বলে বন্দনা মুখ ফেরান।

তুমি গোড়া থেকে কিছু বলনি বলেই, শানু বলল, মহারানির অভ্যেস হল না যে রাজমাতার কথাটাও একটু শুনতে হয়।

বন্দনা উদাস গলায় বললেন, এসব নাটকে আমার শখ নেই শানু, যেখানে যাচ্ছিস যা!

বন্দনা মনে মনে বলেন, বলবার আমার মুখই বা কোথায়? আমার নিজের মেয়েরা খোকার দিদি তারা। নিত্যি গোছ গোছ রঙিন ছবি পাঠাচ্ছে। চুল ছাঁটা পেন্টুল পরা, বরের গায়ে ল্যাপটানো ল্যাপটানো। সেই সব ছবি দেখছে না বউ? মা হওয়া যে কী জ্বালা, এখন কি বুঝবি? শাঁখের করাত।

বন্দনার মনে মনে উচ্চারিত কথাগুলো যদি অদৃশ্য কোনও টেপ রেকর্ডারে ভোলা থাকত। মহাভারত হয়ে যেত।

.

১২.

ভদ্রার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা তো ছুতো। শানু দেখল, পার্থ ওদের গলির মোড়ে ঘোরাঘুরি করছে। করবেই, এটাই ব্যবস্থা।

শানু দূর থেকেই দেখতে পেল! শ্যামলা মুখটা আলোয় ভরে উঠল।

তাড়াতাড়ি চলে এসে বলল, গিয়েছিলে?

 হুঁ!

কী হল? মুখটা এমন ঝুলে গেল মানে?

 মানে খুব প্রাঞ্জল! চাকরিটা হল না।

 ভ্যাট। ইয়ার্কি করার আর প্রসঙ্গ পেলে না?

মুখ দেখে কি মনে হচ্ছে ইয়ার্কি?

 পার্থর গলার স্বর ভীষণ!

নাঃ ঠাট্টা নয়।…শানুর মুখটা শুকিয়ে গেল, বলল, কী হল?

বললাম তো, কিছু হল না।

শানু আরও ভয়ে ভয়ে বলল, তোমার মামা ছিলেন না?

জাহান্নমে যাক মামা। ছোটলোক, চামার। মনে জানি নিশ্চিতই হবে, তবু ইন্টারভিউটা মন দিয়ে ভালই দিয়েছি,…লাস্ট মোমেন্টে কোন শালা যে কলকাঠি নাড়ল। হাতে আসা জিনিসটা চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। যত সব চামার ছোটলোক বেবুনের বাচ্চার দল।

আঃ! কী হচ্ছে পার্থদা, মুখ খারাপ করছ কেন? কলকাঠিটা নাড়ল কে?

দেখিয়ে নাড়েনি!..পার্থ নিজেই মুখটাকে বেবুনের মতো খিঁচিয়ে উগ্রভাবে বলল, তবে স্থির বিশ্বাস আমার ওই পরম স্নেহশীল মাতুলটি।

ধ্যাৎ! কী বলছ বোকার মতো। তুমিই তো মামার ক্যান্ডিডেট ছিলে?

 ছিলাম! তখন মামার শালির ছেলে পিকচারে ছিল না। লাস্ট মোমেন্টে স্পটে এসে গেল। তো গিন্নির বোনগোর আখেরটার থেকে কি নিজের বোনপোর আখেরটা জরুরি হবে?…মুখ শুকিয়ে বলল, ওর কোয়ালিফিকেশান অনেক বেশি রে। কিছু বলা গেল না। ও যে আসছে জানতুম না।

জানতেনই না? আশ্চর্য তো! তা হলে অবশ্য—

 থাম থাম! ন্যাকা সাজিসনি। জানত না! হু! শয়তানি ভণ্ডামি! ছোটলোক।

শানুর খুবই কষ্ট হচ্ছে পার্থর ওই যন্ত্রণা বিকৃত মুখটা দেখে, খুব কষ্ট হচ্ছে নিজের জন্যেও, পার্থর ওই শাঁসালো চাকরিটার আশ্বাসের উপরই তো শানুর স্বর্গের সিঁড়ি গাঁথা।..তবু শানু ধিক্কারের গলায় বলল, কী বলে চলেছ বাজে বাজে। তোমার মুখে এ রকম কথা! খুব খারাপ লাগছে শুনে। ভুলেই গেলে তুমি একজন কবি।

পার্থ এ ধিক্কারে দমল না সেইভাবেই বলল, মোটেই ভুলে যাইনি! তুই-ই যাচ্ছিস–

আমরা মানুষের মহত্ত্বের জয়গান করতে আসা ন্যাকামার্কা কবি নই। ওসব ন্যাকামার্কা সেন্টিমেন্টের বুজরুকি আর চলে না, বুঝলি?…পৃথিবীর মুখোশ খুলে দেবার জন্যেই আমরা কলম ধরেছি। সমস্ত ভণ্ডামি, শয়তানি, নীচতা, ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান!

শানু খুব নিরীহ গলায় বলল, তোমরা মানে, তোমাদের ওই লিট্‌ল ম্যাগাজিনের দল?

আমাদের দল ওই একটা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে নয় শানু। আমরা নতুনরা, যারা নামকরা ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠায় জায়গা পাই না, জায়গা পাই না যে কোনও একটা ভদ্রমতো অফিসের চেয়ারে, জায়গা পাই না সমাজজীবনের মলাটের কোথাও, তারা সবাই একটাই দল। তাই আমাদের আত্মপ্রকাশের যন্ত্রণাকে প্রকাশ করতে লিটল ম্যাগাজিন।…পড়িস কখনও কবিতাগুলো?…এই সমাজের যত ক্ষমতাসীন নেতাদের কাজ কী? শুধু দলবৃদ্ধি, শুধু ঘুষ দিয়ে দিয়ে গদি সামলানো, শুধু নির্লজ্জের মতো মিথ্যে কথা বলা। দেশের লোকের ভাল-মন্দর ধার ধারে না। শুধু নিজের আখের গোছানো, এবং যার যেখানে যত শালা-শালি আর শালার বেটা শালির ছাঁ আছে তাদের আখের গোছানো, ব্যস। এই ওদের কাজ।..উঃ একটা পৃথিবী ধ্বংসী বোমা পড়ে একসঙ্গে সব ধ্বংস হয়ে যায়, তবে সব নোংরামি আর ইতরতার শেষ হয়।

শানুর নিজের স্বর্গের সিঁড়ি স্থগিত থাকল। তবুশানু মনে মনে প্রায় হেসেই ফেলল, কিন্তু হে কবি পার্থ সেন, আজ যদি তোমার এই চাকরিটা হয়ে যেত?…হয়তো বা আজই রাত্তিরে মানুষের মহত্ত্বের জয়গান করেই একটা কবিতা লিখে ফেলতে। পৃথিবীর সমস্ত মালিন্যের উপর জ্যোৎস্নার চাদর বিছিয়ে যেত! কিন্তু এখন ঠাট্টা করার সময় নয়।

তা শানু খুব শান্ত গলায় বলল, থাকগে পার্থদা, ওই নিয়ে মন খারাপ করো না! পৃথিবীতে চিরকালই এইসব আছে, থাকবে!

থাকবে!

তা থাকবে বইকী! ক্ষমতার এমন গুণ, ওটা হাতে পেলেই মানুষ আর মানুষ থাকে না, বনমানুষ হয়ে যায়।…বাড়ি আসছো তো? চল। ভদ্রার নাম করে মাকে অনেক তুতিয়ে পাতিয়ে তবে আসতে হয়েছে। ওর সঙ্গে দেখা না করে গেলে বিপাকে পড়ে যাব।

পার্থ বলল, তুই যা, আমি এখন যাচ্ছি না।

 তোমার খবরটা বাড়ির লোক জেনেছে?

জানবে না মানে?

 পার্থ ফের হিংস্র গলায় কথা বলে উঠল, এসেই তো মাতৃদেবীকে তাঁর পূজনীয় দাদার মহত্ত্বর কথা জানিয়ে, যাচ্ছেতাই করেছি।

আহা, মাসিমা কী করবেন? মাসিমা কী করে জানবেন তাঁর দাদার সবার উপরে শালিই সত্য তাহার উপরে নাই।

হেসে উঠল শানু। আবহাওয়াটাকে একটু হালকা করবার চেষ্টা করল।

পার্থ অন্যদিকে চলে যেতে যেতে বলল, খবরদার আর ঘ্যান ঘ্যান করতে আসিসনি বলে দিচ্ছি। বিয়ে-ফিয়ের বিলাসিতা আমাদের জন্যে নয়।

আহা, তোমার আবার বেশি বেশি। যেন বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না। চাকরি-বাকরি একটা করতে হয় তাই

বলে ঘাড় দুলিয়ে একটু হেসে বলল, যাচ্ছি। ভদ্রা খুব মুটিয়েছে তো?

বলে ওদের গলির মধ্যে ঢুকে গেল।

বড় আশায় ছাই। হাঁড়ি চড়াবার দায় না থাকলেও, বেকার পার্থ তো আর বিয়ে করবে না?..

বুকটা কি ধসে যায়নি শানুর? ভাবছিল না কি ওই ভবদেব সেনের চৌকাঠটা পার হয়ে আসতে পারার টিকিটটা হাতে এসেই গেছে।…তবু চুপ করেই থাকতে হবে।…এখন ভদ্রার সঙ্গে হাসিঠাট্টাও করতে হবে। …পার্থ নামের একটা লোকের চাকরি পাওয়া না পাওয়ায় তার কিছু এল গেল বুঝতে দেওয়া চলবে না। তা হলেই তো মানসম্মান খতম!

.

১৩.

পার্থদের বাড়ির মধ্যে চলে এলে, আদৌ মনে হবে না, পার্থর কিছু অভাব আছে। শুধু বাড়ির একমাত্র ছেলে বলেই না, পার্থর বাবার অবস্থা যথেষ্ট শাঁসালো আর পার্থ ছাড়া সন্তানের মধ্যে ওই দুই মেয়ে ভদ্রা আর চন্দ্রা। একজনের তো বিয়ে হয়েই গেছে, আর একজনেরও হয়ে যাবে। অতএব ভবিষ্যতে পার্থর বউই হবে এ সংসারের অধিশ্বরী।…ভবিষ্যতে যাই হোক, আপাতত এই ঘরটার অধীশ্বরী তো হবেই।

গলির মধ্যে বাড়ি হলেও, এই ঘরটায় দক্ষিণের অগাধ দাক্ষিণ্য। কারণ ওখানে একটা পোড়া জমি আছে, যার মালিক অনেককাল আগে বাড়ির ভিত খুঁড়েই গত হয়েছেন, এমন আর কেউ নেই যে তাঁর আরব্ধ কাজ শেষ করে। অথচ মালিকানী মহিলা জমিটা বিক্রি করতেও নারাজ। অতএব ঘরটার দু দুটো জানলা দিয়েই আলো হাওয়ার অগাধ প্রবেশ।  

পার্থর মা বলেন, যতদিন না ওদের সুবিধের দিন আসছে, ততদিনই আমাদের সুবিধে বাবা।

তা সেই সুবিধের সদ্ব্যয় করতে ছেলের ঘরটি তিনি যতটা সম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন।…একটি শৌখিন তরুণ ছেলের যা যা দরকার হতে পারে সবই পার্থর হাতের কাছে মজুত! পার্থর ঘরটায় ঢুকলেই মনটা আবেশে ভরে যায় শানুর। শানু এর মাঝখানে নিজেকে স্থাপন করে নানা ভঙ্গিতে দেখে।…এ ঘরে ঢুকে আসার জবর একটা ছুতোও আছে।…দেখি পার্থদা নতুন কী বই এনেছে? বলতে বলতে চলে আসা!

সত্যি বলতে সেই সদ্য কৈশোর থেকে পার্থর এই ঘরটাও শানুকে কম মোহগ্রস্ত করেনি।…

যদিও পার্থ বলে, কলকাতায় থাকতে চাই না। অনেক দুরে কোথাও, সভ্যতার সংস্পর্শশূন্য কোনও জায়গায় চাকরি পেলে বেঁচে যাই। তবে বর্তমানের এই হাতছাড়া চাকরিটা ছিল মাত্র টাটায়। সেখানে আর যাই হোক সভ্যতার অভাব নেই। তথাপি এটা হারিয়েও পার্থ ক্ষিপ্ত। ক্ষিপ্ত, শুধু আশাভঙ্গেই নয়, শানুর কাছে মুখ হেঁট হবার মনোভঙ্গেও নয়, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে মানুষের এই বিশ্বাসভঙ্গের নীচতায়।

.

১৪.

ভদ্রার সঙ্গে গল্প করে আর সুখ নেই। (কোনও কালেই কি ছিল? এ বাড়িতে আসার কারণ বজায় রাখতে সুখের ভান করা বই তো নয়।) ভদ্রার গল্প কেবল তার বরের মহিমা নিয়ে। …অবশ্য মহিমার ভঙ্গিটা হচ্ছে লোকটা কত নীরেট কত আহাম্মক, কত ভুলো কত কাণ্ডজ্ঞানহীন, এবং ভদ্রার কত বশ্য।

একঘণ্টা ধরে এই সব শুনতে ভাল লাগে?

বারেবারেই তো শোনা হয়ে গেছে।

আচ্ছা রে এখন আসি–

বলে উঠল শানু। আর সেই সময় সত্যিকার নীরেট ভদ্রা একটা বোকার মতো কথা বলে বসল। বলল, শুনেছিস কাণ্ড? দাদার চাকরিটা মামার বিশ্বাসঘাতকতায় হল না? তো আমি বলি, না হয় না হল, দুজনেই মরছিস, বিয়েটা করে ফেল না বাবা! বাবা আর একটা বউকে খেতে দিতে পারবে না? তা–

হঠাৎ দপ করে জ্বলে উঠল শানু।

একটু তেতো হাসি হেসে বলল, শুধু তোর বাবার পারা না পারার প্রশ্ন?…আমার বাবা একটা বেকার ছেলেকে জামাই করতে রাজি হবে? বাবার অন্য জামাইদের কথা ভাব?

চলে গেল খরখরিয়ে। বুঝল না কী বজ্রপাত করে গেল তার এতদিনের সাজানো বাগানে।

.

১৫.

বাপী একটা মোটরবাইক কিনেছে, এবং যখন তখন পাড়া কাঁপিয়ে ভটভটিয়ে আসা যাওয়া করছে। ভবদেব একদিন কাছে ডাকলেন তাকে। বললেন, টাকাকড়ি করছ, ভাল। কীভাবে করছ জানতে চাই না, তবে করছই যখন, আর কিছুটা দিন অপেক্ষা করে একটা সত্যি গাড়ি কিনলেই পারতে।… এই একটা বিশ্রি অশ্লীল গাড়ি

অশ্লীল!

 চোখ কপালে তুলল বাপী, অশ্লীল মানে? গাড়ির সঙ্গে শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্ন কোথায়?

আমার সেটাই মনে হয়। তাই বললাম। সেদিন দেখলাম বোধহয় কোনও বন্ধুকে পিঠে সেঁটে নিয়ে ছুটেছ দেখে হনুমান হনুমান লাগল।

বাপী রাগে না। বাপীর এটাই বাহাদুরি। বাপী সব বিরুদ্ধ কথা নস্যাৎ করে ফেলবার ক্ষমতা ধরে। বাপী তাই হো হো করে হেসে উঠল, আপনাদের চশমাগুলো বড় পুরনো হয়ে গেছে বাবা! আপনার কথা শুনে মনে হল বুঝি শহরের রাস্তায় বেরোন না।

ভবদেব বললেন, বেরোই বলেই তো দেখে খারাপ লাগে। সেটাই আবার নিজের বাড়িতে

বাপী আবার হেসে উঠল, বাড়ি কারও নিজের হয় না বাবা, হয় যুগের। যাকগে ও আপনাকে বোঝানো যাবে না।… কিনব। সত্যি গাড়িই কিনব, নিশ্চিন্ত থাকুন। একটা অ্যামবাসাডার কিনব শিগগিরই।

চলে গেল বাবার সামনে ছাড়া হয়েই শিস দিতে দিতে।

পেনসন আনতে গিয়েছিলেন ভবদেব, দেখলেন, পুরো বাড়িটায় নতুন রং হচ্ছে। অবাক হলেন। এ নির্দেশ তো ছিল না সুকুমারের উপর। এই তো বছর দুই আগে খোকার বিয়ের সময় আগাগোড়া রং টং করানো হয়েছে।

এই ভাগের বাড়ির মধ্যে ভবদেবের অংশটা তত জ্ঞাতিদের ঈর্ষাস্থল। …ভবদেবের অথবা বন্দনার সংসারে জলের কলের ওয়াশার কেটে গেলে তক্ষুনি কলের মিস্ত্রি এসে সারিয়ে দিয়ে যায়, বিভাদের বাড়ির মতো কলটা মুখে ছিপি খুঁজে আর গলায় দড়ি বেঁধে, অনন্তকাল ঝিরঝির করে জল ঝরায় না। বন্দনার বাড়িতেই ইলেকট্রিক খারাপ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই মিস্ত্রি এসে সারিয়ে দিয়ে যায়, ওদের বাড়ির মতো, একটা বাল্ক কেটে গেলে বদলাবার অভাবে মাসের পর মাস সিঁড়িতে পা ঘষে ঘষে নামাওঠা করা হয় না। বন্দনার বাড়িতে কাজ করার তোক ছেড়ে গেলে কোথা থেকে যেন একটাকে এনে হাজির করা হয়, নতুন বউদের মতো দিনের পর দিন উঠোনে বসে বাসন মাজতে আর পলাতকা ঝিকে গাল পাড়তে দেখা যায় না বন্দনাকে। কাজেই ঈর্ষা বিদ্বেষ! …এসব ব্যাপারে অবশ্য আজ বলেই নয়, চিরস্থায়ী হচ্ছে মেজছেলে বাপী। বাপী বরাবর করিৎকর্মা অসাধ্যসাধক। বাপী বন্দনার ডান হাত। …এখন তো আবার বাপীর ডানহাতের অগাধ দাক্ষিণ্যের যোগ। বাপী দশ টাকার দরকার শুনলে ফস করে বিশ টাকা দিয়ে বসে। কাজেই সংসারের বহিরঙ্গের ছন্দটা বেশ তরতরে।

এ ছাড়াও জ্ঞাতিদের ঈর্ষাস্থল বন্দনার মেয়েরা। দুই মেয়েই মর্তে স্বর্গের বাসিন্দা। …তাদের সেই স্বর্গভূমিতে তারা প্রায়শই বাড়ি বদলে নতুন বাড়ি কিনছে, গাড়ি বদলে নতুন গাড়ি কিনছে, সেইসব নতুনদের মধ্যে লীলায়িত হয়ে থাকার রঙিন ফটো পাঠাচ্ছে, আর প্রতি চিঠিতে মা আর বাবাকে তাদের কাছে যাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

এসব খবর ওদের অজানা নেই। কারণ ভবদেবের সঙ্গে বিশ্বদেব আর মহাদেবের প্রত্যক্ষ কোনও অসম্প্রীতি নেই। গিন্নিদের মধ্যে ভালই সম্পর্ক। বিভার কৌতূহল হয়তো এই সম্পর্ক বন্ধনটি বেশ মজবুত রেখেছে।

কিন্তু ভিতরের ঈর্ষা?

সেটাও তেমন গোপন থাকে না। যাক ও নিয়ে মাথা ঘামান না বন্দনা। তবে বাপী মেসোকে ঢালা আদেশ দিল, জানলা দরজায় রং দিয়ে বাড়িটাকে একবারে ফ্রেশ করে দিন ছোটমেসো। বাড়ির রংটাও বদলে দিন।

তখন বন্দনা মনে মনে শঙ্কিত হলেন! এই দ্যাখো আবার পাঁচজনের চোখ টাটানোর ব্যবস্থা।

বন্দনা ছেলেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন। বললেন, বেশ তো ছিল রে।

 বাপী বলল, মোটেই বেশ ছিল না। দাদার বিয়ের সময় খুব বাজে করে কাজ হয়েছিল। আসলে ভাল থাকার সম্বন্ধে আমাদের কোনও ধারণাই নেই।

প্রবলের কাছে কে না পরাস্ত হয়?

তায় আবার যদি টাকার দায়িত্বটা বহন করে।

 ভবদেব বললেন, এসব আবার কেন সুকুমার?

সুকুমার বলল, মেজ রাজকুমারের অর্ডার।

 অকারণ এতগুলো খরচের কোনও মানে হয়?

সুকুমার হাসল, অকারণ যদি বাড়তি কিছু টাকা এসে পড়তে শুরু করে তা হলে সেই টাকারা কামড় মারে, বুঝলেন? ও নিয়ে ভাবনা করবেন না দাদা। কিছুদিন পরে যখন দেখবে বোকামি করে মরেছি, সেরে যাবে। এখনও নিজের ভবিষ্যৎটুকুই মাত্র না ভেবে যে সকলের কথা ভাবছে, সেটাই সুলক্ষণ! বাধা দেবেন না।

আবার হাসল, অবশ্য যদি ভাবেন নিজের ব্যবসার আয় উন্নতির চেষ্টায় ব্যাটাকে প্ররোচনা দিয়েছে–

হাসিটা বড় নির্মল।

 ভবদেব বললেন, আঃ সুকুমার তোমার মুখে দেখছি কিছুই আটকায় না।

 সুকুমার বলল, না দাদা, ছেলেটা বাইরে যতই মাতব্বরি দেখাক, ভিতরে এখনও খুব ছেলেমানুষ আছে।

.

 ১৬.

সুকুমারের দিব্যদৃষ্টি আছে বলতেই হবে।

তা নইলে সত্যিই ওর সর্বদা গাঢ় রঙের ট্রাউজারের উপর টকটকে লাল আঁটো গেঞ্জি পরে পদভরে মেদিনী কম্পমানের ভঙ্গিতে ভবদেবের ভাষায় সেই অশ্লীল গাড়িটায় চেপে ব্যাঘ্র গর্জন তুলে যে ছেলেটা অবিরত ছুটোছুটি করে বেড়ায়, দেখলে মনে হয় মহামস্তান, সে কিনা এমন একটা বোকাটে ছেলেমানুষি কাণ্ড করে বসে?

আসলে কাল হয়েছে তার ওই সম্প্রতি জাগ্রত সৌন্দর্যবোধ!

বাড়ি রং করার সময় বাপী বলেছিল, টাকাকড়ির ব্যাপারে পরোয়া করবেন না ছোট মেসো, একেবারে ফাস্টক্লাস রং-টং ব্যাভার করবেন।

অতএব তাই করা হয়েছিল।

 সত্যি নবরাগই বলা চলে।

কিন্তু ভারাখোলা অন্তে বাপী রাস্তায় বেরিয়ে দুরে থেকে দু চোখ খুলে এক চোখ বুজে যাকে বলে অবলোকন করতে গিয়েই, বাপী যেন দৃশ্যটা দেখে সিটিয়ে কুঁচকে গেল। এ কী বিশ্রি কুৎসিত কুদৃশ্য।

বাপী বুঝতে পারল না রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ওই দোতলা ইমারতখানার কোন অংশটা বেশি কটু দেখাচ্ছে। …নোনাধরা বালিখসা দেয়াল, ফাটা আর ফাঁকা শার্সি এবং অর্ধেক খড়খড়ি উড়ে যাওয়া জীর্ণ বিবর্ণ জানলাটার গলা পচা অংশটা, না সদ্য রংমাখা নবযৌবন প্রাপ্ত অন্য অংশটা।

এখানে তো কোনও বিভেদ প্রাচীর নেই, শুধু জানলা গুনতিতে সীমানা। …সামনের দিকের শার্সি খড়খড়িটার আটটা জানলার চারটে ভবদেবের ভাগে, চারটে বিশ্বদেবের ভাগে। অপারেশনটা হয়েছে ঠিক মাঝামাঝি।

আগেও এইভাবেই বাড়িতে রং হয়েছে, কিন্তু তখন বাপীর চোখে পড়েনি। মানে বাপী তখন এভাবে রাস্তায় বেরিয়ে একচোখ বুজে অবলোকন করে দেখতে যায়নি। কারণ বাপী তখন স্পটে ছিল না। আজ এখন এই ভোর সকালের আলোয় পুরো দৃশ্যটার উপর চোখ ফেলে বাপীর মনে হল নতুন রংদার অংশটাই যেন হয়ে আলোয় পুরো দৃশ্যটার উপর চোখমপাতখন স্পটে ছিল না। আজ

উঃ, ছোটমেসোর মিস্ত্রিদেরও হাত বটে একখানা। যেন সার্জারির হাত। কী নিখুঁতভাবে বিভেদ রেখা টেনেছে। যেন সমান করে ছুরি চালিয়ে একটা সার্থক অপারেশন করে ফেলেছে। ছাদের কার্নিসে টানা একটা ফুল ফুল গোছের বালি কাজের নকশা ছিল। সে আমলে যেমন থাকত অনেক গেরস্তবাড়িতেও বাড়তি একটু বিলাসিতার নমুনাস্বরূপ। কালের প্রকোপে সেই বালির ফুলেরা তাদের পাপড়ি টাপড়ি হারিয়ে খ্যাঁদানাকি মেয়ের মতো থ্যাবড়া মুখ নিয়ে পড়ে ছিল। ইতিপূর্বের মেরামতকারীরা তার উপর একটু পোঁচড়া বুলনো ছাড়া আর কিছু করেনি। …সুকুমারের মিস্ত্রিদের হাতে পড়ে তারা আবার আগের চেহারা ফিরে পেয়েছে। আর তাদের হাতের নিপুণ দক্ষতায় দু বাড়ির সীমারেখায় অবস্থিত কার্নিসে একটা ফুলের তিনটে পাপড়ি বিক্ষত বিবর্ণ মূর্তি নিয়ে যেন একটা ব্যঙ্গচিত্রের মতো বসে আছে।

বাপীর চোখটা কুঁচকে গেল।

 বাপী কয়েকবার এগিয়ে পিছিয়ে ওই অর্ধনারীশ্বর ছবিটা দেখল। বাপীর মনে হল কাজটা খুব নির্লজ্জের মতো হয়েছে।

বাপী মনস্থির করে ফেলল।

.

১৭.

বিশ্বদেব কেরোসিনে লাইন দিতে গিয়েছিল।

স্কুলের চাকরি। এখন গরমের ছুটি, তাই বাড়ির কাজগুলোর দায়িত্ব পড়েছে। নচেৎ রেশন আনা, তেলের লাইন দেওয়া এসব কাজগুলো বিভাকেই করতে হয়। ছেলের সাহায্য পাবার প্রশ্ন ওঠে না।

বেরোবার সময় কিছু দেখেনি। ঘন্টা আড়াই পরে ফিরে এসে দৃশ্যটা দেখে বিশ্বদেবের এতক্ষণের খাড়া দাঁড়ানো পিঠটা যেন আড় ভেঙে ছিলে পরানো ধনুকের মতো ছিটকে উঠল।

পরনে লুঙ্গি, গায়ে পিঠ ফুটো গেঞ্জি, হাতে কেরোসিনের বোল। সেই অবস্থাতেই ভবদেবের বাড়ির সামনে এসে হাঁক পাড়ল, বড়দা! বড়দা!

ভবদেব দোতলা থেকে নেমে আসার আগেই বন্দনা বেরিয়ে এলেন একতলার রান্নাঘর থেকে। হাসিমুখে বললেন, নতুন ঠাকুরপো যে? কী ভাগ্যি! ওমা, বোতল হাতে কেন গো?

বিশ্বদেব এ পরিহাসের ধার ধারল না। উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, হঠাৎ আবার কী বাহারের কাজ পড়ল আপনাদের যে, আমার বাড়ির গায়ে ভারার বাঁশ?

বন্দনা অবাক হয়ে বললেন, ভারা তো পরশুই খুলে ফেলেছে। বাঁশগুলো তোমার পথ আটকে ফেলে রেখেছে বুঝি?

পথ আটকেনয়, খোলা বাঁশগুলো তুলে আবার ভারা বাঁধা হচ্ছে আমার দেয়ালে। এটা কোন আইনে হচ্ছে?

বিশ্বদেবের কথাবার্তা চিরদিনই এমনি চ্যাটাং চ্যাটাং। বন্দনার অজানা নয়, বিশেষ করে এ বাড়ির এই শোভা সৌন্দর্যে যে তার বুক ফাটছে, তাও বন্দনার অবোধ্য নয়, তবু আইন শব্দটা কানে খট করে বাজল। বললেন, আইন আদালতের কথা হলে তো ভাই আমার কাছে জবাব নেই। তোমার দেয়ালে কে ভারা বাঁধতে গেল তাও জানি না। বোসো একটু, ডাকি তোমার দাদাকে।

বসার দরকার নেই। সময়ও নেই, ডাকুন একবার বড়দাকে। ব্যাপারটা জেনে যাই। …এই দীনদুঃখী হতভাগার দেয়ালে নতুন বাঁশের ভারা! তাজ্জব! দু ঘণ্টা আগে বেরিয়েছি, তখন কিছু না। ইতিমধ্যে উঃ। লোকটা যেন ফাটছে।

বন্দনা আস্তে বললেন, নতুন বউ কিছু জানে না? সে হয়তো কিছু ভেবে লাগিয়েছে। নতুন বউ?

নতুন বউয়ের চোদ্দপুরুষের সাধ্যি আছে, আমায় না জানিয়ে দেয়ালে একটা পেরেক পোঁতে? …আচ্ছা বোতলটা রেখে আসছি।

ঘুরে দাঁড়াবার আগেই পিছনে ব্যাঘ্রগর্জন।

গাড়িটা থামিয়ে নামতে সময় লাগবে, তাই বাপী তার ব্যাঘ্রাসনে বসেই হাত তুলে বলে উঠল, এই যে নতুন কাকা! উঃ আপনাকে ধরবার জন্যে ফোর টাইমস নতুন কাকিমা বলল, ক্রাচিনে লাইন দিতে গেছ।

সেখানেও খুঁজে এলাম, দেখতে পেলাম না। …কেরোসিনের জন্যে এত দিকদারি? আমায় একবার বললেই তো মিটে যেত। মাসে কত লিটার তেল আপনার লাগে বলুন? ঘরে বসে পেয়ে যাবেন।

নতুন কাকা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওই মস্তানের দিকে তাকিয়ে বলেন, কেন, তুমি কি আজকাল কোনও কেরোসিন ডিপোর ইনচার্জ?

গাড়িটা গজরাচ্ছে, বাপী তার উপর বসেই ভারসাম্য ঠিক রাখতে রাখতে কথা চালাচ্ছে। কাকার এই ক্রর প্রশ্নে নিজস্ব ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠে বলল, বাপী সেন কীসের ইনচার্জ নয়? বলুন না কী কী চাই?

বিশ্বদেব পেশি-পেশি মুখটা বাঁকিয়ে বলল, থ্যাঙ্কিউ! কিন্তু চাওয়ার ধান্ধায় তোমার কাছে আসবার মতন দুরবস্থা হয়নি এখনও। শুধু জানতে চাইতে এসেছি আবার কোথায় কী কারুকার্য হবে তোমাদের যে, এই গরিবের বাড়ির গায়ে ভারার বাঁশ উঠছে?

বাপী এখন তার ব্যাঘ্রাসন থেকে নামল। হাতটা তুলে বলল, আরে সেই ধান্ধাতেই তো হন্যে হয়ে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। দেখলাম বেদম দেরি হয়ে যাচ্ছে, লোকগুলো ফরনাথিং বসে আছে, তাই বলে দিলাম, যাকগে কাজে হাতলাগা।

বলে দিলে হাতলাগা! বাঃ। চমৎকার।

উত্তেজিত বিশ্বদেবের হাতের বোতলটা তার অজানিতেই দোল খেতে লাগল।

বন্দনা অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপার কী রে বাপী? কীসের ভারা?

 বাপীর অগ্রাহ্যের গলা, ব্যাপার ফ্যাপার কিছু নয় বাবা। পাশাপাশি দুটো বাড়ি একেবারে কী বলে অমাবস্যে পূর্ণিমে দেখাচ্ছে দেখে, বিতিকিচ্ছিরি লাগল। মনে হল যেন দাঁত খিচোচ্ছে, তাই ছোট মেসোকে বলে এসেছিলাম, ভারার বাঁশ ফেরত নিয়ে যাবেন না, ওদিকটাতেও কাজে লেগে যান।

বন্দনা হাঁ হয়ে বললেন, ওদিকটা মানে? নতুন ঠাকুরপোর দিকটা?

 তবে আবার কোন দিক?

 সুকুমার তাই রাজি হল?

বাপী প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বার করে উড়িয়ে উড়িয়ে বাতাস খেতে খেতে বলল, না হবার কী আছে? টাকাটা তো আর তোমার বোনাইয়ের যাচ্ছে না? …তবে হ্যাঁ আপত্তি করেছিল, বলেছিল বাড়িতে মত নিয়েছ? বললাম, সে চিন্তা আমার।

সে চিন্তা আমার!

বিশ্বদেব ছিটফিটিয়ে বলে উঠল, তুমি আর তোমার মেসো ব্যস? মাঝখানে আর কোনও পার্টি নেই কেমন? ছেলের হাতের মোয়া!… কাকার ভারী পয়সা দেখেছ না?

বাপী রুমাল উড়নো থামিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠল, মাই গড! টাকা কি আপনার ঘাড় ভেঙে নিতে যাব নাকি? ডোন্ট ওয়ারি নিউ আঙ্কল, ইয়ে নতুন কাকা।

বাপী অভয়মুদ্রা তুলে বলল, নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনার একটি পাঁচ নয়াও লাগবে না। ওটা এই ব্যাটাই বেয়ার করবে।

বটে!

নতুন কাকা কেরোসিনের বোতলটা গেটের সামনে ঠক করে বসিয়ে রেখে ঝুলে পড়া লুঙ্গিটাকে দুহাতে টাইট করতে করতে গলার শির তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, খুব পয়সা হয়েছে, না? তাই ধরাকে সরা দেখছ। পয়সার গরম দেখাতে এসেছ বিশু সেনের কাছে। …আমার বাড়ি দাঁত খিঁচিয়ে আছে তা তোমার কী হে? অ্যাঁ? তোমার কী? …তোমার বাড়ির বাহারের হানি হচ্ছে বলে আমার বাড়িতে পোঁচড়া বোলাতে এসেছ! মগের মুলুক! আইন নেই? অ্যাাঁ আমাকে না বলা না কওয়া–আমার বাড়িতে চড়াও হয়ে

বিশ্বদেব আর একবার লুঙ্গি টাইট করে নেয়। এই অবকাশেই বাপী বলে ওঠে, আঃ, এ তো আচ্ছা অবুঝ। বলছি তো আপনার খোঁজ করতে আপনার বাড়িতে দু-তিনবার গেছি।

মাথা কিনেছ। বলি, আমার বাড়ি নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন অ্যাঁ? কোন সাহসে তুমিউঃ! বড়দা কোথায়? বড়দা? ডাক তো তাঁকে একবার।

কেন? সেই নিরীহ ম্যানকে আবার টানাটানি কেন? বাপী বুকের উপর দুহাত আড় করে টানটান হয়ে দাঁড়াল। মুখে একটু মধুর হাসি। বলল, বাতচিত যা হবার আমার সঙ্গেই হয়ে যাক। থানায় ডায়েরি করতে যাবেন? বিশেষ সুবিধে করতে পারবেন না। ইচ্ছে করলে আমি আমার ফোর্স আনিয়ে, তাদের হেফাজতে আপনার বাড়ির নব কলেবর করিয়ে ছাড়তে পারি। পুলিশের বাপের সাধ্য নেই যে বাপী সেনের চুলের ডগাটিও টাচ করে। তবে এসব ঝুট ঝামেলায় যেতে যাচ্ছি না, বাঁশ দড়ি খুলে নিতে বলে দিচ্ছি।

বাপী বুকটা আর একটু চিতিয়ে দাঁড়াল, বলল, ভেবেছিলাম হেভি খারাপ দেখাচ্ছে, নিজেকে ছোটলোক মনে হচ্ছে, আমিই ওটা ম্যানেজ করে ফেলি। হাজার কয়েক টাকার ব্যাপার বই তো নয়। বাড়িরই তো ছেলে? একদা বাড়িটা যিনি বানিয়েছিলেন সেই ভূদেব সেন না কে, তিনি ছিলেন নাকি ভবদেব বিশ্বদেব মহাদেব সব দেবগণেরই গ্র্যান্ডফাদার। এতে যে আপনার একেবারে প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে তা ভাবিনি। তা আপনার মান-জ্ঞান যখন এত টনটনে তখন বলে রাখি আপনার সবেধন নীলমণি পানুচন্দরকে একটু দেখবেন এবার থেকে। বাপী সেন কাট মারছে।

বিশ্বদেব থতমত খেল।

দেখব মানে?

দেখবেন মানে দেখবেন। নজরে রাখবেন। আমিই এ পর্যন্ত শেলটার দিয়ে দিয়ে টিকিয়ে রেখেছি। নইলে বাংলার দোকানের ধারের দায়ে কবেই ভোলাই খেয়ে ফরসা হয়ে যেত!

বন্দনা শিউরে উঠে বললেন, বাংলার দোকান মানে?

মানে তুমি বুঝবে না অবোধ বালিকা, যাও বাড়ির মধ্যে ঢুকে যাও! দরজার সামনে যত ঝুট ঝামেলা! রাস্তার লোক তাকাচ্ছে।

বিশ্বদেব কী বলবে ভেবে না পেয়ে রাগে কাঁপছিল, এখন খিঁচিয়ে উঠে চেরা ফাটা গলায় বলে উঠল, এত অহংকার তোর থাকবে না বাপী। পয়সার গরমে যা মুখে আসবে তাই বলে পার পাবি না। বলতে চাস কী তুই? পানু ম-ম-মদ খায়?

হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল বাপী! বেশ জোর গলায়। হাসি থামলে বলল, গুড! এমন ইনোসেন্ট পিতা না হলে, এই বয়েসেই অমন সুপুরটি হয়! এক একদিন ভাবি, থাক থাক, একদিন আচ্ছা করে ধোলাই দিক, শিক্ষা হোক! কিন্তু যতই হোক বাড়ির ছেলে। এই সেদিনও ইজের পরে রাস্তায় বসে মার্বেল খেলেছে। মায়া হয়। যাক আপনার যখন এত প্রেস্টিজ জ্ঞান, তখন আমি আর ওই বাজে সেন্টিমেন্টটা নিয়ে মাথা ঘামাব না। ইচ্ছে হলে নজর রাখবেন। শুধু বাংলাই নয়, আরও অনেক রকম ধরেছেন বাবু, খবরটা জানিয়ে রাখলাম আঙ্কেল। যাই আপনার হুকুমটা তামিল করে আসি।

শিস দিতে দিতে পাশের বাড়ির দিকে চলে গেল। বোধহয় মিস্ত্রিদের নির্দেশ দিতে।

.

 ১৮.

ভবদেব এত ঘটনার কিছুই টের পান না। তিনি তখন নতুন সারানো সেই তাঁর বাবার ঘরে বসে বাবার খাতাখানা পড়বার চেষ্টা করছেন।

হাতের লেখাটা খারাপ নয়। কিন্তু আগের স্টাইলের অতিরিক্ত টানাটানা।..মুদির দোকানের খাতায় যেমন দেখাটেখা যেত।

তবু পাঠোদ্ধার করছেন ভবদেব।

এক জায়গায় দেখলেন

আজ শিবকৃষ্ণ এসেছিল। অনেক কথা বলে গেল। আমায় আহাম্মক বলে গাল পাড়ল।

বলল, যদি আমি রাজি থাকি, ও আমার জন্যে চেষ্টা করে দেখতে পারে। কম করেও মাসে অন্তত শ আড়াই টাকা করে ভাতা পাইয়ে দিতে পারে।

… রাজি নই বলে আরও একচোট গাল পাড়ল, বেকুব বলে।…ওর যুক্তি হচ্ছে এটা আমার ন্যায্য পাওনা। একদিনের পিকেটার, শুধু একরাত হাজত বাস করে, নাকে কানে খত দিয়ে খত লিখে দিয়ে এসেছে। এমন কিছু কিছু লোকও নাকি দরখাস্তর জোরে স্বাধীনতা সংগ্রামীর ভাতাটা বাগিয়ে ফেলে, মাস মাস দুআড়াইশো থেকে চারশো পর্যন্ত ঘরে তুলছে।

কিন্তু এই জন্যেই কি সেদিন আমরা দলে দলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলুম পুলিশের বেয়নেটের মুখে?

আর একটা জায়গায় দেখলেন–

শুনতে পাই স্বাধীনতা এসেছে। কিন্তু কাদের কাছে এসেছে সেটা? যত সব স্বার্থান্বেষী ভণ্ড জোচ্চর মুখোশধারী মহাত্মার কাছে, এই তো?

এই কি চেয়েছিলুম আমরা?

ভবদেব খাতাটা মুড়ে একবার চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করলেন, সেই জরাজীর্ণ শয্যাশায়ী মানুষটা এইভাবে চিন্তা করেছেন। আশ্চর্য, কোনওদিন কারও কাছে নিজের অতীত মহিমা নিয়ে গল্প করতে বসেননি তো।

ভবদেব জানতেন সেকালের অনেক ছেলের মতো, বাবাও কলেজ লাইফে স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিয়ে পড়াশোনা ছেড়েছিলেন এবং পরে বেশ বড় বয়েসে বিয়ে করার ফলে একমাত্র সন্তান ভবদেবের সঙ্গে বয়েসের এত পার্থক্য।

ভবদেব বড় হয়ে পর্যন্ত সাংসারিক দায় দায়িত্ব মাকেই বহন করতে দেখেছে। বাবা বরাবরই ভগ্নস্বাস্থ্য নির্লিপ্ত গোছের। …স্নেহ ছিল গভীর, প্রকাশের আতিশয্য ছিল না। বাবা শব্দটা তাই ভবদেবের কাছে একজন মাননীয় গুরুজন ছাড়া, আর বিশেষ কোনও অনুভূতি বহন করে আনত না।

তরতর করে পড়া যাচ্ছে না, তাই মাঝে মাঝে এক একটা পাতা ওলটাচ্ছেন ভবদেব।

 সাল তারিখের বালাই দেখছেন না, মনে হয় নিখুঁত কিছু একটা করার চেষ্টাও ছিল না, মনের ভাব ব্যক্ত করতে পারেন এমন কাউকে পাননি। তাই খাতার পাতায় ব্যক্ত করেছেন। …ভবদেবের মা যিনি নাকি স্বামীর থেকে অন্ততপক্ষে পনেরো ষোলো বছরের ছোট ছিলেন, তিনি তো ভবদেবের স্কুলের গণ্ডি পার হবার আগেই গত হয়েছিলেন। সংসার চালাত একজন পুরনো চাকর।

বন্দনার তাড়াতাড়ি এসে পড়াটাই তাই জরুরি হয়েছিল।

কিন্তু তাতে সংসার পরিচালনার সুরাহা হতে পারে, একজন রুগ্ন বৃদ্ধের নিঃসঙ্গতা দুর হবার প্রশ্ন কোথায়?

আমিও তো তেমন করে ভাবিনি, ভাবলেন ভবদেব, একটু যেন অপরাধ বোধ করলেন।

খাতায় চোখ রাখলেন—

 স্বাধীনতা এসেছে স্ত্রীলোকদিগেরও।

দেশ স্বাধীনতার আন্দোলনের তলায় তলায় এই চিন্তাটাও দানা বাঁধছিল, স্ত্রীশিক্ষা চাই, স্ত্রীস্বাধীনতা চাই। …স্ত্রীলোকদের আর অন্তঃপুরে আবদ্ধ রাখার দিন নেই।

তা সেই চিন্তার চেষ্টা ফলবতী হয়েছে বইকী!

আমি সত্যদেব সেন ঘরে বসে বসেই জানতে পাচ্ছি! …স্ত্রীলোকদের তো আইনগত অধিকার সবই হল, অবরোধ গেল, কর্মজগতে নেমে পড়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও হচ্ছে ক্রমশ, কিন্তু তারপর? শেষ অবধি কী হচ্ছে? যা রাষ্ট্রে তাই সমাজে!…।

স্বাধীনতালাভের যে একটা দায়িত্ব আছে, সেই বোধবুদ্ধিটা কোথায়? স্বাধীনতা মানে কি খানিকটা ক্ষমতালাভ? খানিকটা সুবিধা লাভের পথ সুগম হওয়া?

বিবেকানন্দ দেশে স্ত্রীলোকদের যে স্বাধীনমূর্তি দেখতে চেয়েছিলেন, সে কি এই?

ভবদেব দেখলেন এই লেখাটার পর কয়েকটা পাতা সাদা পড়ে রয়েছে। …ভাবলেন, বাবা কি এই বিষয়ে আরও কিছু লিখতে চেয়েছিলেন?

তারপর ভাবলেন, আচ্ছা আমি কি কখনও এভাবে চিন্তা করে দেখেছি? …সারাজীবন অফিস সংক্রান্ত চিন্তা ছাড়া আর কবে কী নিয়ে ভেবেছি? …সাময়িকের স্রোতেই তো ভেসে চলেছি।

সংসার? ছেলেমেয়ে? আত্মীয়স্বজন? এই সব কিছুই তো ভেবে এসেছি বন্দনার ডিপার্টমেন্ট, ভাববার যদি কিছু থাকে তো সেটা হচ্ছে সাময়িক অবস্থা নির্ভর। হয়তো কারও অসুখ বিসুখ, অথবা আর্থিক অনটন, এইগুলোই আমাদের ভাবনার খোরাক। এ ছাড়া আর কী? দেশের দশের কথায়? ..বড়জোর কাগজ পড়ে চারদিকের ভয়াবহ অবস্থা জেনে উত্তেজিত হই, ক্রুদ্ধ হই, অতঃপর হতাশ হই। আসলে আজকের জীবনযাত্রা আমাদের কিছুক্ষণ ভাববার অবকাশও দেয় না। অবকাশের অভাবেই ক্রমেই আমরা ভাবতে ভুলে যাচ্ছি।

.

১৯.

বাড়ির মধ্যে নয়, বাড়ির বাইরে।

বাপী তার জগদ্দল বাহনটিকে বাড়ির পাশের প্যাসেজ থেকে টেনে বার করে হাতের ধুলো ঝাড়ছে, নীরা বাড়ির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে ললিতকণ্ঠে ঝংকার দিয়ে উঠল, খুব ছেলে বাবা!

নীরার আপাদমস্তক প্রসাধনের ছাপ, নীরার অঙ্গে মিহি সিনথেটিক শাড়ি! …তার মানে নীরা বেরোবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছে। …বাপীর গাড়িটা দেখে বোধহয় লোভে কম্পমান হয়ে একটু দাঁড়িয়ে পড়েছে।

বাপী মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই বলে উঠল, নতুন গাড়ি কিনলে, একদিনও একটু লিফট দেবার জন্যে অফার করলে না! এটা ভদ্রতা?

বাপীর মুখ সদা উজ্জ্বল, বাপীর স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ বলিষ্ঠ দেহটা সদা উন্নত। আর বাপীর প্রতিটি পদক্ষেপে গর্বিত ভঙ্গি!

নীরা ভাবে, এমন ভাইয়ের দাদাটা অমন মিনমিনে হল কেন!

নীরার ঝংকারে বাপী টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল হাসি হেসে বলল, এটাকে কি গাড়ি বলে ম্যাডাম? বলা যায় বাহন। যমের যেমন মহিষ, শিবঠাকুরের যেমন বৃষ, বাপী সেনের এটা সেই রকম একটা মাল।

নীরা ভুরু তুলে বলল, পুরাণ টুরান সবই পড়া আছে দেখছি। কার কী বাহন মুখস্থ! আমার মতে বাহনই হোক আর যাই হোক, যা চলে, তাই গাড়ি। চল তো, আমায় একটু লিফট দাও।

বাপীর মুখে হাসির ছটা, পিঠে চাপিয়ে?

 নীরার উঁচু ভুরু ঝুলে পড়ল। বলল, চাপানো মনে করলে থাক।

আরে, আমার আবার মনে করা কী?

বাপী বলল, আমার এমন একখানা মার্ভেলাস বউদি আছে, এটা তো গর্বের বিষয়। লোককে দেখিয়ে সুখ। ওটা হচ্ছে ফাদারের ভাষা। …একটা বন্ধুকে চাপিয়ে আনছিলাম, ফাদারের চোখে পড়ে গিয়েছিল। …বলল, হনুমান হনুমান দেখতে লাগছিল আমায়।

হনুমান শব্দটা নীরার ঝোলা ভুরু আবার উপরে তুলে দিল,নীরা হি হি করে উঠল, চমৎকার! ভাল বিশেষণ তো পাওয়াই হয়ে গেছে। তা হলে আর সীতাদেবীকে পিঠে তুলতে আপত্তি কি হে বীরহনুমান?

চলো চলো! একটু থ্রিল আসুক। তোমাদের বাড়িতে এসে অবধি মিয়োনো বিস্কিট হয়ে গেছি।

বীরহনুমান কিন্তু বীরোচিত ভঙ্গিতে বেশ তবে আসুন বলে বাহনে উঠে বসল না, নিজস্ব ভঙ্গিতে দুই পাঁজর পালিশ করতে করতে বলল, বাপী সেনের কোনও কিছুতেই আপত্তি নেই সিস্টার ইন ল, তবে কথা হচ্ছে ফাদার ওই দৃশ্যটি দেখলে ফায়ার হয়ে উঠবেন কি না।

ফায়ার! তোমার বাবা আবার ফায়ার-টায়ার হতে জানেন নাকি?

 নীরার প্রশ্নে বিদ্রুপের ঝলক।

বাপী বলল, জানে না সেটা আমাদের গুডলাক। তবে জানতে কতক্ষণ? কিছু না হোক মেজাজটা গড়বড় হয়ে যেতে পারে!

নীরা বুঝল আশা নেই। তার মানে মুখে যতই মাস্তানি করুক, ভিতরে ভিতরে সেই এ বাড়ির রক্ষণশীলতা। …নীরার সুন্দর মুখটা ব্যঙ্গে কুঁচকে গেল। বলল, ফাদারের মেজাজ গড়বড় হবার মতো কোনও কিছুই মহাশয়ের করা হয় না বোধহয়?

টোয়েন্টিফোর আওয়ার্সই করা হচ্ছে! হরবখৎ!…বাপী গাড়ির উপর টোকা দিতে দিতে বলল, তবে সেটা হচ্ছে নিজেকে নিয়ে ব্যাপার। একটা বাউণ্ডুলে বখা ছেলে কী করল আর না করল। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা হচ্ছে রীতিমত টাচি! তুমি হচ্ছ এই সেন পরিবারের সভ্যতা ভব্যতা মান মর্যাদার ধারক বাহক! …আর গোটা কতক দিন ওয়েট করো ম্যাডাম, সত্যিকার গাড়ি একটা কিনে ফেলছি। তখন দেখবে কত লিফট চাইতে পার।

অনেক ধন্যবাদ।

বলে নীরা একটা ঝটকা মেরে পাক খেয়ে গটগট করে হাঁটতে শুরু করল।

বাপী তক্ষুনি বাইকে চড়ে বসল না, গলাটা একটু তুলে বলল, যাচ্ছ কোথায়? পার্ক সার্কাসে নিশ্চয়? ওখানে কিছু বিজনেসটিজনেস খুলেছ নাকি?

হেসেই বলল, কিন্তু নীরা দপ করে জ্বলে উঠল। কড়া গলায় বলল, ওঃ তুমিও তা হলে স্পাইদের একজন!

স্পাই? মানে?

মানে নিজেই ভাল জানেনা! আমি কোথায় যাই না যাই কে বলেছে, শুনতে পাই না?

বাপী বুকে একটা থাবড়া মেরে বলল, বাপী সেনকে কারুর কিছু বলে দিতে লাগে না ম্যাডাম, আপসেই সব জানা হয়ে যায় তার! মাঝে মাঝেই তো একটা ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে ঢুকে বসে থাকো, থাকো না?

নীরা একটি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁত চেপে চলে যায়।

 চলে গেলে বাপী, ধূস সক্কালবেলা মেজাজটা খিঁচড়ে দিল! বলে বাঘের পিঠে চড়ে গর্জন তুলে বেরিয়ে গেল।

একটু যেতেই দেখল নীরা একটা উলটোমুখো বাসে উঠছে। যেটা গড়িয়ার দিকে যাবে!

বাপী মনে মনে একটু হেসে চলে গেল গড়িয়াহাটের দিকে।

.

২০.

নীরা যে তার বরের কাছে হাপসে পড়ে পড়ে বলে, এ বাড়িতে সবাই তার উপর গোয়েন্দাগিরি করে, খুব ভুলও বলে না বলতেই হবে।

বাপীর গাড়ি বেরিয়ে যাবার পরই শানু হাসতে হাসতে মায়ের কুটনো কোটার কাছে গিয়ে বসে পড়ে বলল, ছোড়দাটাকে যত এলোমেলো মনে হয়, তা কিন্তু নয় বাপু।

বন্দনা বললেন, কেন? হঠাৎ কী এমন বুদ্ধিমানের মতো কাজ করলেন তিনি?

জ্ঞাতির বাড়িটা রং করানোর ব্যাপারে যা একখানা পরিস্থিতি করে তুলেছে ছেলে, বন্দনা তাই ব্যাজার।

সেদিনের পর বিভা এসে একশো কথা শুনিয়ে গেছে, এবং স্পষ্টই বলে গেছে বাপী ইচ্ছে করে পানুকে নেশার পয়সা জুগিয়ে তাকে উচ্ছন্নের পথে ঠেলে দিচ্ছে জ্ঞাতিশত্রুতা সাধতে। …এবং তদবধি কপাট বন্ধ। কারণে অকারণে এসে বসাটাও বন্ধ।

মায়াও আসে বন্দনার, বড়দির বাড়ির চা বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হত বিভা, অতএব যে কোনও সময়ই এসে বসুক, বিভার জন্যে চায়ের বরাদ্দ ছিল অবাধ! বুদ্ধিহীন ছেলেটা সেই ছন্দটাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দিল।

বন্দনার ব্যাজার প্রশ্নে শানু বলল, ছোড়দার মনটা উঁচু বলেই ওই একটা বোকামি করে বসেছিল মা। নতুনকাকা তিলকে তাল করল। বোকামি করল বরং নতুনকাকাই। যাক–আজ দেখি মহারানি বিয়েবাড়ি যাবার মতো সেজেগুজে, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছোড়দাকে খোশামোদ করছে?

খোশামোদ? তোদের বউদি খোশামোদ করার মেয়ে?

ওই হল আর কি। অনুরোধ উপরোধ, ছোড়দা যাতে বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যায়। তা নিয়ে গেল না। শ্রীমতী রাগ, বিদ্রূপ অনেক রকমই করল, ছোড়দা দিব্যি হেসে হেসে অ্যাভয়েড করল। বলল, বাবা রেগে যাবে।

তবু ভাল।

বন্দনা গামলার জলে শাক আছড়াতে আছড়াতে বললেন, সে জ্ঞানটুকু আছে এখনও। কিন্তু বউমাকেও বলি, কী বুকের পাটা! এই অবস্থায় ওই গাড়িতে চড়ায় বিপদ নেই?

শানু থতমত খেল, বলল, অবস্থাটা সত্যি?

–ও আবার মিথ্যে হয় নাকি? আর মিথ্যে হবেই বা কেন?

 শানু বলল, তা বিপদ হলেই বা কী? …অবস্থাটা তো ওর আপদ বালাই।

কুমারী মেয়ে মায়ের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনায় আর বেশি এগোয় না, উঠে চলে যায়। …কিন্তু জানতে তো বাকি নেই তার এই আকস্মিক হয়ে পড়া অবস্থাটা নিয়ে দাদার সঙ্গে বউদির কী দারুণ কথা কাটাকাটি চলছে।…

আগে টিপু বলত, পি সি সরকারের এক্স-রে আইয়ের মতো তোর কি এক্স-রে ইয়ার আছে ছোড়দি? যেখানে যা কথা হয় তুই টের পাস কী করে?

বুদ্ধি থাকলেই পাওয়া যায়।

টিপু বলত, বাজে কথা! আসলে তুই সেই আড়িপাতা না কী বলে, তাই করিস।

শানু বলত, মারব থাপ্পড়।

পিঠোপিঠি দুই ভাইবোনের ভাব আর ঝগড়ার বিরাম ছিল না। …এখন টিপু যেন সমস্ত স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলতে বসেছে।

সর্বদা গুম হয়ে বসে থাকে, অথবা দেয়ালমুখো হয়ে শুয়ে থাকে, ডাকতে ডাকতে খেতে আসে, ঘাড়গুঁজে খেয়ে চলে যায়।…

লেখাপড়ার কথা তুলে বাবা কিছু বলতে এলে সংক্ষেপে বলে, শরীর খারাপ, এ বছরে পরীক্ষা দেব না। …আর মা শানু কিছু বলতে এলে বলে, বেশি ফ্যাচফ্যাচ করতে এলে বাড়ি থেকে চলে যাব বলে দিচ্ছি।

এর পর আর কে কী বলতে আসতে সাহস করবে?

বাপী?

তাকে মা বলেছিল, একদিন, তুই একটু বুঝিয়ে বল না।

বাপী বলেছিল, বোঝাবার ব্যাপার নয় মা, ব্যাপারটা হচ্ছে বোঝবার। সময়ের হাতে ছেড়ে দাও। টানাটানি করতে গেলে ফল উলটো হবে, দড়ি ছিঁড়ে যাবে। বাড়ির মধ্যে পড়ে থাকে, তবু ভাল। ভাল ভাল ফ্রেন্ডরা তত কজা করতে পারে না। …পরীক্ষা পরীক্ষা করে মাথা ঘামিও না মাদার, ও এখন সর্বদা যে তুরীয়ানন্দে থাকে, সেখানে তুচ্ছ পরীক্ষার চিন্তা পৌঁছয় না। …কী আছে? একটা বছর পরীক্ষা না দিলে রাজ্য রসাতলে যাবে না!

অতএব টিপু নামের সেই দুরন্ত আর বাউণ্ডুলে ছেলেটা, প্রায় একটা জড় পদার্থের মতো হয়ে পড়ে আছে। খেতে-টেতে কী ভালই বাসত টিপু! ভাল খাবার-টাবার যা কিছু করতেন বন্দনা, বেশিরভাগই টিপুর আবদারে। আর তার সিংহভাগটাই রেখে দিতেন সর্বকনিষ্ঠ এই কোলের ছেলেটির জন্যে।

এখন আর যেন খাবার-টাবার করতে মনই লাগে না। গোড়ায় গোড়ায় খুব হালকা হয়ে এসে বলতেন, এই টিপু, চটপট চলে আয়, কড়াইশুটির কচুরি ভাজছি। …ওরে টিপু আজ তোর প্রিয় জিনিস বানিয়েছি একখানা, তালের বড়া। …টিপু শোন, এদিকে আয় একবার। দেরি করলে ঠকে যাবি। ভেটকির ফ্রাই ভাজছি, তোর জন্যে স্পেশাল দুখানা বাড়তি

কোনও কৌশলই কাজে লাগেনি। টিপু বলেছে, খিদে নেই; বলেছে পরে খাব; বলেছে, আঃ, ভাল লাগে না।

চোখে উপচে পড়া জলকে ভিতরে ভরে ফেলে বন্দনা এদিকে এসে আরও লঘু হয়েছে, আমি বলছি নির্ঘাত এই ছেলেকে ভূতে পেয়েছে। যে যতই উড়িয়ে দাও বাবা, ভূত ভগবান সবই আছে। ..ভূতে না পেলে এমন হয়?

শানু ড্রাগ-ফাগ অনেক সব ছাইভস্ম কথা বলে, বিশ্বাস করেন না বন্দনা, তাঁর যা আশঙ্কা তাতেই কণ্টকিত হয়ে থাকেন। আর পাছে সেই আতঙ্কটা মূর্তি নিয়ে ঘাড়ে এসে পড়ে, তাই ডাক্তারকেও দেখাতে উদ্যোগী হন না। কিন্তু মাথার দোষ না হলে সহজ ছেলেটা এমন হতে থাকবে কেন?

বন্দনা অবাক হয়ে ভাবেন, হঠাৎ এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটছে কেন? আবার ভাবেন এটা তাঁর বাড়াবাড়ি ধারণা। এই বয়েসে মেয়েগুলো হয়ে ওঠে প্রখর মুখরা, যেন ডানামেলা, আর ছেলেগুলো হয়ে যায় লাজুক ঘরকুনো মুখচোরা। এটা প্রকৃতির নিয়ম।

নিজের মনকে নিজে বুঝিয়ে জীবনের ছন্দ ঠিক রাখার চেষ্টা। অথবা শুধু নিজেকেই নয়, অন্যকেও। কেউ যেন না কিছু সন্দেহ করে বসে।

চিরদিন বন্দনার এই সংসারটি ঘিরেই জীবন। স্বামী সন্তানের পরিচর্যা, আর তাদের পরিতৃপ্তি সাধন, এই তো ছিল জীবনের ধ্যান জ্ঞান। ছিল কেন, আজই কি নেই? আছে। শুধু নিজের সেই পরিতৃপ্তির সুখটা নেই।

সকলের সুখ চেয়েছেন বন্দনা, কিন্তু এ সংসারে কে সুখী, সন্তুষ্ট?

ভবদেব বোধহয় ছিলেন, কিন্তু কর্মজীবনে যবনিকাপাতের পর থেকেই ভবদেব যেন কেমন অন্যমনস্ক, ভবদেবের কপালে রেখা পড়তে শুরু করেছে। ভবদেবের মুখের সেই সদাপ্রসন্ন ছবিটি প্রায় অন্তর্হিত!

অথচ পরিচিত জনেরা বন্দনার ভাগ্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। কখনও বা মিশোনো থাকে ঈর্ষা। বন্দনার নিজের বোন নন্দনাই তো বলে, সত্যি বলতে দিদি, আগে তোর ন্যানজারি অবস্থা দেখে তোকে খুব বোকা মনে হত। এখন দেখছি তুই-ই বাবা চালাক, সময়কালে কিছু সৈন্যবল বাড়িয়ে রেখেছিস। …খোদার নামে ছেড়ে দিয়ে সব কটাকে একসঙ্গে টেনে তুলেছিস, এখন কত নিশ্চিন্দি। দুটো মেয়ে বিদেশে চালান হয়েছে, তবু একটা কাছে আছে। তার উপর ছেলেরা! মনটা ভরাট, সংসারটি ভরাট। …আর আমার দশা দেখ? তিনটে ছেলেমেয়ে, তিনটেই বিদেশে। …আস্ত একটা বাড়িতে দুটো বুড়োবুড়ি।

তোরাও বুড়োবুড়ি?

বন্দনার এ প্রশ্নে নন্দনা আরও উদ্দীপ্ত হয়। বলে, তা ছাড়া আবার কী? ছেলেমেয়েরাও তো বলে, কেন আর তোমরা দুটো বুড়োবুড়ি ওই হতভাগা দেশে পড়ে আছ? চলে এসো না বাবা এখানে। দেশ বলে বাজে একটা সেন্টিমেন্টের কোনও মানে হয় না, পৃথিবীটাকেই আপন বলে ভাবতে শেখো। …বলে, তিনজনের কাছে চার মাস করে থাকলেও তো তোমাদের আরামসে কেটে যাবে, একঘেয়ে লাগবে না। ..মাঝে মাঝে মনে হয় যাই চলে। নাতিনাতনি সবাই তো ওদেশে। তা তোর ভগ্নিপতিটিকে তো জানিস? কুনোর রাজা। অ্যাভয়েড করতে হেসে গা পাতলা করে বলে, চার মাস করে পালার সেবা? তার মানে পৈতৃক নারায়ণ শিলার দশা? প্রথমে বিগ্রহ, অতঃপর গলগ্রহ, শেষ অবধি নিগ্রহ। এ বেশ আছি বাবা। তা আমার যদি আর দুটো চারটে সৈন্য সংখ্যা থাকত, চুটিয়ে সংসারটাও তো করতে পারতাম তোর মতো।

এ ভীষণ ঈর্ষার গা ঘেঁষা কিনা?

আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, নিজের কথাই বা কী বলব? বেচারা চন্দনটার কী অবস্থা? বয়েস তো ফুরিয়ে এল, আর কি আশা আছে? …দেখ, সব থেকেও সংসার সুখে বঞ্চিত! ভাগ্য!

তার মানে ঘুরেফিরে বন্দনার ভাগ্যটাই সর্বাঙ্গসুন্দর বলে গণ্য করা হয়।

তা লোকের সেই ধারণাটাকে কি ধূলিসাৎ করে দিয়ে সেই ধুলোটা নিজের মুখে মাখবেন বন্দনা?

বলে উঠবেন এখন কি আর আমি সংসার করছি? না করছি না। এখন যা করছি সেটা হচ্ছে সংসারের কাজ! সংসারের কারুর সেই কাজগুলোর প্রতি সম্ভ্রম দৃষ্টি নেই, নেই সপ্রশংস দৃষ্টি! ওরা অনায়াসেই মুখের উপর বলে, আমি নাকি নিজের মূল্য বোঝাবার জন্যে ইচ্ছে করে বাড়িয়ে বাড়িয়ে খাঁটি। আমি বসে থাকলেও নাকি সংসার দিব্যি চলে যেতে পারে।

অথচ পান থেকে চুনটি খসলেই বাবু বিবিদের রসাতল। সব দাপট গিয়ে পড়ে ওই বাচ্চা দেবুটার উপর।

ওদের ধারণা আমি প্রশ্রয় দিয়েই ওর মাথাটা খেয়েছি। আমার সেদিনের বিয়ের কনে বউটি পর্যন্ত শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, তার মার ট্রেনিঙের গুণে, একটা বাচ্চা মেয়েকে দিয়েও সংসার কীরকম নির্ভুল চলে। …এখন এই আমার সংসার করা। আমার ট্রেনিঙের সমালোচনা প্রতি পদে।

তা এ সব কি আমি উদঘাটিত করতে যাব লোকের কাছে? হলেও বা মায়ের পেটের বোন। নিজের মানের হানির মতো কথা বলা চলে না। আকাশে ধুলো ছুঁড়লে, নিজের গায়েই এসে পড়বে, এ তো চিরকেলে কথা।