১১.
চিকিৎসার মধ্যে গরম জলে ধুইয়ে দিয়ে শুকনো কাপড়ের সেঁক, ওষুধের মধ্যে ভক্তিভূষণের নিত্যবরাদ্দ মকরধ্বজের এক মাত্রা। ব্যবস্থার মধ্যে তোশকের বিছানায় শুইয়ে দেওয়া।
তবু তাই কি কম?
রাস্তায় পড়ে মরবার মতো ভাগ্য নিয়ে যারা মৃত্যুপথে যাত্রা করে, তাদের পক্ষে ওই যথেষ্ট, ওই পরম চিকিৎসা। ওতেই মৃত্যুপথযাত্রিণীকে নিয়ে আসা যাচ্ছে জীবনের আলোকোজ্জ্বল কক্ষের দিকে।
কিন্তু এদের তাতে আহ্লাদ কেন? ওর নিথর দেহে জীবনের স্পন্দন দেখা যাচ্ছে দেখে লীলাবতী আগ্রহে ঝুঁকে পড়ছেন কেন? বারবার এসে খাটের ধারে দাঁড়াচ্ছে লীলাবতীর ছেলে?
আর লীলাবতীর স্বামী পাঁচ মিনিট অন্তর ওর নাড়িটা দেখে যাচ্ছেন কেন? ও যে ওর মৃতদেহটা নিয়ে এসে ফেলে দেয়নি, এই কৃতজ্ঞতাতেই কি ওকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে?
এমনি করে যদি বউমাকে পাওয়া যেত।
ফিসফিস করে বললেন লীলাবতী।
কাউকে শোনাতে নয়, নিজেকেই শোনাতে শুধু।
মনে হচ্ছে বুঝি বউমাই এসেছে!
ফিসফিস করেও নয়, মনে মনে।
হায় ভগবান, তাকে যদি এনে দিতে এমনি করে!
.
১২.
এ ঘরটা লীলাবতীর সেই ফুলশয্যার ঘর। এ পালঙ্কটা সেই উঁচু-পায়া পুরনো পালঙ্ক। এর উপরেই শুইয়ে দেওয়া হয়েছে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটাকে। কারণ এমনি একটু আরামের দরকার ছিল ওর।
কিন্তু শুধুই ওর দরকার বলে?
ও যদি বাসনমাজা-ঝি গোপালের মার সমগোত্র হত? লীলাবতীর পালঙ্কের উপর পুরু তোশক পাতা বিছানায় তুলে শুইয়ে দিত লীলাবতীর ছেলে?
বারবার এসে দাঁড়াত ওই পালঙ্কের ধারে?
দাঁড়াত না, দিত না। দিয়েছে ও মৃণালদেরই সমগোত্র বলে। ওর মুখের রেখায়, ওর দেহের গঠন-ভঙ্গিতে, ওর সাজ-সজ্জায় সেই কথাই ঘোষিত হচ্ছে।
ওর নিমীলিত চোখের পাতা দুটো মৌনতার আবরণে নিজেকে ঢেকে রেখে দিয়েছে, তবু যেন বলে উঠতে চাইছে, আমি তোমাদেরই লোক।
তুই আর কত জাগবি, শুয়ে পড়গে যা।
কাল থেকে আজকের এই রাত পর্যন্ত এই এখন প্রথম ছেলের সঙ্গে একটা সহজ কথা কইলেন লীলাবতী।
মৃণালও সহজ কথা কইল। সে-ও বোধহয় এই প্রথম। বলল, তার থেকে বাবারই শুয়ে পড়া উচিত। বাবার একটু ঘুমের দরকার।
না না, আমি ঠিক আছি। বললেন ভক্তিভূষণ।
কিন্তু আর বার দুই অনুরোধ করতেই গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
পাশের ঘরে। যে ঘরে ভক্তিভূষণের অকৃতদার জ্যাঠতুতো দাদা বরাবর শুয়ে এসেছেন একটা সরু চৌকিতে।
শুয়ে পড়ে প্রথম মনে হল তাঁর, কাল থেকে শুধু এক পেয়ালা চা ছাড়া আর কিছু খাননি।
.
১৩.
লীলাবতী ছেলেকেও শুয়ে পড়বার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন, বলেছিলেন, আমি ঠিক খাড়া থাকব, কিন্তু ঢুলতে লাগলেন। বারবার সামলে নিতে থাকেন, আর মনে পড়তে থাকে, পরশু থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।
দিনের বেলা কখন যেন ভক্তিভূষণ একবার বলেছিলেন আস্তে উদাসী গলায়, একটু চা খেলে–
একটু চা খেলে কী হত, তা আর বলতে পারেননি। লীলাবতী ডুকরে উঠেছিলেন, বউমার হাতের সাজানো চায়ের সাজ, হাতে করে নড়চড় করতে পারব না গো আমি! সে যে কত শখ করে নতুন সেট কিনেছিল এখানে আনবে বলে–
ভক্তিভূষণ অপ্রতিভ হয়েছিলেন। থাক থাক, বলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
মনে পড়েছিল তাঁর, সত্যিই বটে কিনে এনেছিল জ্যোতি কিছু কাচের বাসনপত্র।
ভক্তিভূষণ বলেছিলেন, বাড়িতে এত কাপ-ডিশ-গ্লাস, আবার কিনে আনলে বউমা?
জ্যোতি হেসে হেসে বলেছিল, এ আমার গাঁইয়া শ্বশুরবাড়ির জন্যে বাবা। দেখছেন না কেমন মোটা মোটা, গাঁইয়া! ওখানে রেখে আসব।….
এখানে এসে মহোৎসাহে তার দিদিশাশুড়ির ভাঁড়ারের তাক ঝেড়ে পুরনো খবরের কাগজে পেতে সাজিয়ে ফেলেছিল সেইসব সরঞ্জাম। পাশে পাশে সাজিয়েছিল চিনির বোতল, চায়ের কৌটো, কনডেন্স মিল্ক, ভক্তিভূষণের হরলিকস।
ভক্তিভূষণ হেসে হেসে বলেছিলেন, মা জননী কি এখানেই বসবাস করবে ঠিক করেছ নাকি? দু-চার দিনের জন্যে
জ্যোতি আলো আলো মুখে বলেছিল, বাঃ, তা বলে গাছতলায় থাকার মতো থাকতে হবে নাকি? দু-চারদিনই ভালভাবে থাকব। ভাল করে সাজিয়ে থাকব।
সেদিন বিকেলে চায়ের পাট সেরে ভালভাবে সাজিয়ে রেখেছিল। সব পরিপাটি করে। লীলাবতী তবু সেইসব নিয়েই চা বানিয়েছিলেন।
আজ ঢুলতে ঢুলতে বারবার ভাবলেন, কাল সকালে উঠে চা একটু করতেই হবে ভাল করে। ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে। উনি বুড়োমানুষ!
ভাবলেন, কাল সকালের গাড়িতে তো যাওয়া হচ্ছে না বোঝাই যাচ্ছে।
এখন এই ঘাড়ে-এসে-পড়া মেয়েটাকে অন্যায়কারী বলে মনে হল।
আর জায়গা পেলি না তুই?
আমার এই বিপদ, এই হাহাকারের উপর বিপদ বাড়াতে এলি!
এখানে কি তেমন হাসপাতালই আছে ছাই যে, তোক্র ভর্তি করে দিয়ে চলে যাব? অতএব যতদিন তুই উঠে দাঁড়াতে পারছিস, তোকে গলায় গেঁথে মরতে হবে আমাদের।
উঃ, কী শাস্তি! কী শাস্তি!
কার মুখ দেখে কলকাতা থেকে পা বাড়িয়েছিলাম।
মনে হচ্ছিল কলকাতায় ফিরে গেলেই বুঝি সব সুরাহা হবে। কলকাতার থানা পুলিশ কিছু একটা করবে।
কিন্তু এখন কলকাতাটা দূরে সরে যাচ্ছে।
এই মেয়েটা অন্যায় করে সুযোগ নিতে এসেছে।
বউমাকে হারিয়ে এ কাকে আমি খাট-বিছানায় শুইয়ে তোয়াজ করছি!
মরতে আমি আবার গেলাম গোয়ালের দিকে হঠাৎ শিউরে উঠলেন লীলাবতী। ভাবলেন, ইস! যদি না যেতাম!
.
১৪.
হারিকেন লণ্ঠনের মৃদু শিখা বাতাসে কাঁপছিল, ঘরটা ছায়াচ্ছন্ন।
লীলাবতী খাটের বাজুতে ঠেস দিয়ে বসে ঢুলছেন। মৃণাল ঢুলছে প্রকাণ্ড পিঠওয়ালা ভারী কাঠের একটা সাবেকি চেয়ারে বসে।
নড়তে চড়তে ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ হচ্ছে, তবু বসা যায়। বিশ বছর ফেলে রেখে চলে যাওয়ার অপরাধে অভিমানে খানখান হয়নি।
শব্দটা বরং উপকারী। জেগে থাকতে সাহায্য করছে।
মাঝে মাঝেই টর্চ জ্বেলে দেখতে হচ্ছে কিনা, চোখের পাতা দুটো হঠাৎ খুলে পড়ে দেখতে চাইছে কিনা কোথায় আছে! অথবা হঠাৎ বুকের সেই ওঠা-পড়া টুকু থেমে গিয়ে সবটা স্থির হয়ে গিয়েছে কিনা।
তন্দ্রাচ্ছন্ন চেতনায় ভাবতে ইচ্ছে করছে, বিছানায় শুয়ে আছে জ্যোতি। ওকে পাওয়া গেছে। ভয়ে দিশেহারা হয়ে ছিটকে কোথায় চলে গিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে। ফিরে আসতে বৃষ্টিতে ভিজেছে, কষ্ট পেয়েছে, অজ্ঞান হয়ে গেছে।
যাবেই তো! মানুষটা যে বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে সুকুমার, সবচেয়ে আদরের, আর সবচেয়ে ছোট্ট। অত কষ্ট সহ্য হয় ওর?
রাত্রের অন্ধকারে বিভ্রান্ত হয়েছি আমরা, তাই ভাবছি ও আর-কেউ। সকালের আলোয় যখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে, দেখব ও জ্যোতি হয়ে গেছে। চোখ খুলে তাকিয়ে বলছে, জল খাব।
ভাবতে ইচ্ছে করছে। ভাবতে ভাল লাগছে।
ঘুম আর জাগা, স্বপ্ন আর সত্যির দোলায় দুলতে দুলতে রাতটা কেটে গেল মৃণালের, আস্তে আস্তে।
ট্রেন ধরতে যাবার প্রশ্ন আজ আর নেই, অতএব এই সময় একটু ঘুমিয়ে নিলে কেমন হয়? জ্যোতি ততক্ষণে সত্য হয়ে উঠুক। উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল জ্যোতির বালিশে মুখ চেপে। যে বিছানা জ্যোতি পেতে রেখে গিয়েছে।
.
১৫.
এখনও তো কোনও সাড়া দেখছি না–ভাবলেন লীলাবতী ভোরের আলোর দিকে তাকিয়ে, এই অবসরে চানটা করে এসে একটু চা তৈরি করি। আজ দুটো ভাতে-ভাতও ফুটিয়ে নিতেই হবে, একজনকে হারিয়ে ফেলেছি বলে কি অবহেলা করে স্বামী-পুত্তুরকেও হারাব?।
উঠলেন মনের জোর করে। যেন ওই-একটা মৃতকল্প মেয়ে জোরটার জোগান দিল।
উঠেই দেখলেন, উঠোনের বেড়ার দরজা ঠেলে গোপালের মা ঢুকছে।
লীলাবতী যেন বসে পড়লেন। লীলাবতীর মনে হল, সবাই জেনে ফেলেছে।
জেনে ফেলেছে, কদিনের জন্যে আমোদ করতে এসে ভক্তিভূষণ ঘোষের সংসারটা মুখে কলঙ্কের কালি মেখেছে, যথাসর্বস্ব হারিয়েছে।
এবার ধিক্কার দেবে সবাই।
বলবে, ছি ছি! এই মুরোদ তোমাদের? দেশের বাড়িতে বেড়াতে এসে পাড়ার লোকের কান ফুটো করে গ্রামোফোন বাজিয়ে গান শুনছিলে না? বড় বড় মাছ কিনে এনে খাচ্ছিলে না? হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি?
গ্রামের দীনহীন জ্ঞাতিদের দিকে করুণার সৌজন্যে তাকিয়ে বলছিলে না–ভাল তো? এই এলাম কদিন বেড়িয়ে যেতে। বউমার ইচ্ছে–
এখন?
এখন যদি আমরা বলি, কোথায় গো তোমার সেই বউমা?
গোপালের মাকে দেখে লীলাবতী দিশেহারা হলেন।
গোপালের মাকে দেখে পায়ের তলায় মাটি হারালেন।
কিন্তু গোপালের মা পাড়ার লোকের প্রতিনিধি হয়ে আসেনি। গোপালের মা পরশু রাতের সেই ভয়াবহতার বর্ণনা নিয়ে এসে আছড়ে পড়েছে।
জানে-প্রাণে আছ মা তা হলে তোমরা? আমি বলি বুঝি ভয়-তরাসে চলেই গেছ। কী কাণ্ড মা, কী কাণ্ড! পরশু রাত থেকে ঘুম নেই খাওয়া নেই মা, কেবল বিভীষিকা দেখছি।
একসঙ্গে ঝুড়ি ঝুড়ি কথা বলে যায় গোপালের মা। সেদিনের হামলায় কার কার কী কী ক্ষতি হয়েছে তার বিশদ বর্ণনা করে, আর থেকে থেকেই কপাল চাপড়ে বলে, তোমরা তো দিব্যি কলকেতায় বসে আছ মা, টের পাও না কিছু। আমরা এই পাপ নিয়ে ঘর করছি। সংসার করছি, না যমের মুখে পড়ে আছি! হতাশায় ভেঙে পড়ে বলে, থেকে থেকে একবার করে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ে, তোল মাটি ঘোল করে, গোরু বাছুর আর রাখে না কারুর। সাত ট্যাকা দিয়ে বকনা বাছুরটা কিনলাম ও-মাসে, সেটাকে টেনে নে গেল মা! গরিবের সর্বনাশ করাল যারা, তাদের ভাল হবে? যমে নেবে না তাদের? হাত পা খসে যাবে না? দুচক্ষু অন্ধ হয়ে যাবে না?
গোপালের মা কান্নায় উচ্ছ্বসিত–তার উপর মুখপোড়া আকাশ যেন ভেঙে এসে মাথায় পড়ল! কোথাকার মানুষ কোথায়, কোথাকার বস্তু কোথায়, চোখে কানে আঁধার!
এতক্ষণে লীলাবতী একটা কথা বললেন। বললেন, তবু তো আগুনগুলো নিভল। মশাল নিয়ে তছনছ করছিল।
তা বলেছ হক কথা!
গোপালের মা বলে, দুদিন আর আসতে পারিনি মা! আজ বলি যাই দেখে আসি, মা রইল না চলে গেল।
পরিচিত জায়গা থেকে ঝাঁটাগাছটা বার করে জুত করে ঠুকতে থাকে গোপালের মা প্রস্তুতি হিসেবে।
লীলাবতী ভয় পান। গোপালের মাকে তাড়াতে চেষ্টা করেন।
লীলাবতী বলেন, থাক থাক গোপালের মা, আজ তোমার মন ভাল নেই, আজ আর কিছু করতে হবে না।
গোপালের মা এ করুণা গ্রহণ করে না। বলে, এসেছি যখন, সাফ করে দিয়ে যাই।
প্রতিদিন নগদ একটাকা হিসেবে পারিশ্রমিক দিচ্ছেন লীলাবতী, এ কাজকে অবহেলা করা যায় না।
উঠোনে ঝাড়ু দিতে দিতে বকবক করেই চলে গোপালের মা, ভেবেছিলাম তোমার কাছ থেকে পাওয়া টাকাটা দিয়ে আর একটা নই বাছুর কিনব, তা মূলে হাবাত হল! কপাল! দুঃখীর কপাল!
লীলাবতী ওই ক্ষুব্ধ আশাহত প্রৌঢ় মুখটার দিকে তাকিয়ে আস্তে বলেন, কত টাকা লাগে?
গোপালের মা চমকে মুখ তুলে তাকায়। বলে, মায়ের কি শরীর ভাল নেই?
লীলাবতী গোঁজামিল করেন। বলেন, না, ভালই তো আছে। মানে একটু খারাপ হয়েছে।
না বাপু, একটু না, চোখ-মুখ বসে গেছে মনে হচ্ছে। সুখী শরীর তোমাদের, পাড়াগাঁয়ে কি সয় গো? বাছুরের কথা বলছ? নই বাছুর একটা ষোলো টাকার কম নয়। তা সে আর এখন ভাবা মিথ্যে। সবাইয়ের সব ঘুচল, কে বেচবে?
লীলাবতী ওর শূন্যতার দিকে তাকিয়ে দেখেন। ওর ওই শূন্যতা দূর করার ক্ষমতা লীলাবতীর হাতে রয়েছে। ষোলোটা টাকা লীলাবতীর কাছে এমন কিছু নয়, ওর কাছে অনেক। লীলাবতী দেবেন ওকে।
দুদিন আগে হলে এমন দিলদরিয়া ভাবনা ভাবতে বসতেন না লীলাবতী, আজ ভাবলেন। বললেন, তা হোক, পরে কিনো। দেব আজ টাকাটা।
গোপালের মার অবশ্য প্রস্তাবটা বুঝতে অনেক সময় গেল, তারপর বিগলিত হয়ে পায়ে পড়ে প্রণাম করল, সহস্র শুভ কামনা করল, স্বামী-পুত্তুর নিয়ে সোনার সংসার করার প্রার্থনা জানাল। তারপর বলল, বাসন দেখছি না মা! রাতে রাঁধনি!
লীলাবতী মাথা নাড়লেন।
তাই বলছি, মায়ের শরীর ভাল দেখছি না। তা বউদি পারে না রাঁধতে?
লীলাবতীর পায়ের নীচের মাটি সরে গেল।
লীলাবতী হঠাৎ ঘরের মধ্যে কার যেন ডাক শোনার ভঙ্গিতে যাই বলে শিথিল ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
লীলাবতী খেয়াল করলেন না, গোপালের মা-ও আসবে পিছন পিছন।
আসবে, ঘর পরিষ্কার করাও কর্তব্য ওর। তা ছাড়া আজ যে প্রস্তাব দিয়েছেন লীলাবতী, আজ তো ও পায়ে পায়ে ঘুরবে।
লীলাবতী দেখলেন তাঁর ঘরের দরজায় মৃণাল দাঁড়িয়ে, তাঁর ঘরের ভিতর ভক্তিভূষণ। ওরা বুঝতে পারছে না, দরজাটা বন্ধ করে দেবে কিনা।
বুঝতে পারছে না ঝিটাকে ধমক দিয়ে ভাগাবে কিনা।
লীলাবতীকে দেখে ভয়ংকর একটা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল ওরা। আর ঠিক সেই মহামুহূর্তে সেই ভয়ানক কথাটা বলে উঠল গোপালের মা। লীলাবতীর পিছু পিছু চলে এসেছিল সে ঘরের দরজা অবধি।
.
১৬.
ওই ভয়ানক কথাটা যেন ভয়ানক একটা বিদ্যুতের ধাক্কা দিয়ে গেল ওদের। ওই ভয়ানক কথাটা যেন অগাধ সমুদ্রে একটা ভেলা এগিয়ে দিল। ওরা যেন হাতে স্বর্গ পেল। ওরা বুদ্ধিবৃত্তি হারাল।
তিনটে মানুষ পরস্পরের দিকে তাকাল, আর সেই ভেলায় চড়ে বসল।
তাই একই প্রশ্নে তিনজনে মাথা হেলাল, তিনজনের নিজস্ব ভঙ্গিতে।
গোপালের মা ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে বলে উঠেছিল, ওমা, বউদিদির বুঝি অসুখ?
ওরা তিনজনে মাথা হেলিয়ে জানাল, হ্যাঁ।
কারণ ওরা দেখতে পাচ্ছিল, বাইরে থেকে শয্যাগতার চাদর ঢাকা দেওয়া পায়ের দিকটা ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।
গোপালের মা বিবেচনা দেখাল। বলল, ঘুমুচ্ছে বুঝি? জ্বর বেশি?..তবে থাক, এখন আর ওঘরে ঢুকে কাজ নেই। পরে সাফ হবে।
নেমে গেল দালান থেকে, বলতে বলতে গেল, তাই বলি মায়ের মুখটা শুকনো কেন! ভাবনা কোরনি মা, সে রাত্তিরের জলে ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ্বর।…উনুনটায় আগুন দিই মা?
লীলাবতী আর ওকে ওদিকে এগিয়ে যাবার সুযোগ দেবেন না। দেবেন না সন্দেহ করবার সুযোগ। বেরিয়ে এলেন। বললেন, দাও।
ভয় কোরো না মা, ভাল হয়ে যাবে। তারপর এদিক-ওদিক খানিক কাজ করে এসে হঠাৎ এগিয়ে এল লীলাবতীর কাছে।
কেউ নেই, তবু এদিক-ওদিক তাকাল। কারণ নেই, তবু গলার স্বর নামাল। তারপর বলল, আর এক ঘটনা শুনেছ মা?
লীলাবতী পাথরের চোখে তাকিয়ে রইলেন।
ও সে চোখ দেখল না। ও ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, সরকারি ইস্কুলের দিদিমণিকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না সেই রাত থেকে।
লীলাবতীর গলা থেকে কিছু একটু শব্দ বার হল।…
লীলাবতীর সংবাদদাতা আরও গলা নামায়, সবাই বলছে, সন্দর আর কিছু নেই, নিয্যস লুঠ করে নিয়ে গেছে! সন্ধের আগে পর্যন্ত দেখেছে লোকে, তারপর হাওয়া! যাবে কোথায়? এই কদিন হল এসেছিল গোয় কারুর সঙ্গে চেনা-জানা হয়নি এখনও। কে জানে কোথায় ঘরবাড়ি! তবে তোকেও বলি, কাঁচা বয়েস, একা তোর বিদেশ-বিভুয়ে আসা কেন? মাঠের মাঝখানে টিনের চালার ইস্কুল, কে রক্ষে করে তোকে?
পুলিশে কিছু করবে না?
শ্রান্ত গলার একটা ঢিলে প্রশ্ন যেন এই কথার স্রোতটায় বাঁধ দিতে চাইল।
তা বাঁধ পড়ল।
গোপালের মা জিভে একটা তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ করে বলল, পুলিশ! হু!
আর কথা বলল না, জোরে জোরে ঝাঁটাতে লাগল। যেন ওই পুলিশ শব্দটার উপরই ঝাঁটাটা চালাতে লাগল।
.
১৭.
ধীরে ধীরে চেতনা ফিরছে।
মৃত্যুর হিমশীতল থাবার ভিতর থেকে জীবনের সাড়া আসছে।
বুকের স্পন্দন দ্রুত হচ্ছে, শৃঙ্খলার ছন্দ দেখা যাচ্ছে তাতে।
কপালের উপর একটা মাছি বসল, ভুরুটা কোঁচকাল। তার মানে অনুভূত ফিরছে।… হয়তো আর একটু পরেই ওই গালের উপর লেপটে থাকা চোখের পলকগুলো গাল থেকে উঠে পড়বে।
বিহ্বল দৃষ্টি মেলে একবার চারদিক দেখে আবার চোখটা বুজবে। তারপরে আস্তে আস্তে ভাবতে থাকবে, এরা কারা? আমি এখানে কেন?
তারপর উঠে বসবে। তারপর ট্রেনে উঠতে যেতে পারবে।
কিন্তু ওই ঘাড়ে-এসে-পড়া বিপদটাকে বহন করে নিয়ে যেতে চায় কেন এরা?
ওরা তো ওই সরকারি ইস্কুলটায় খোঁজ নিতে পারত!ওরা তো হাসপাতালের সন্ধান করতে পারত!
তা করছে না ওরা। কারণ ওরা কাঠের ভেলায় পা রেখেছে।
ওরা আপাত চিন্তাকে বড় করে তুলছে। ওরা দেখছে মানুষ আর প্রকৃতিতে মিলে যে দুর্দশা ঘটিয়েছে। লোকের, তাই নিয়েই ব্যস্ত তারা। ঘোষেদের পুরনো বাড়িতে যারা কদিনের জন্যে বড়মানুষী দেখাতে এসেছিল, তাদের খোঁজ নিতে আসার গরজ কারও নেই।
এই ফাঁকে সরে পড়তে হবে।
গরজ হবার আগে, কেউ এসে উঁকি দেবার আগে।
তবে এটাই ভাল। চারজন এসেছিল ঘোষেরা, চারজনই চলে গেল। বউ অসুস্থ, শুইয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে।
বউয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি-স্বামী যদি তার মুখের কাছে ঝুঁকে থাকে, কে আর উঁকি দিয়ে সেই মুখ তল্লাশ করতে আসবে?
কলকাতায় গিয়ে? সে তখন বোঝা যাবে।
কিন্তু ও উঠে দাঁড়াতে পারলে তবে তো! বারো-তেরো ঘণ্টা হয়ে গেল, চোখই খুলছে না।
চোখ খুলছে না, তাই ওর দিকে চোখ মেলে বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে।
আর সম্ভব হচ্ছে বলেই ধরা পড়ছে, ওর চোখে চশমা না থাকলেও নাকে চশমা পরার খাঁজ, ওর হাতে ঘড়ি না থাকলেও মণিবন্ধে ঘড়ির ব্যান্ডের দাগ।
তার মানে ঘড়ি আর চশমা খুইয়েছে।
কিন্তু শুধুই কি ঘড়ি-চশমা? আর কিছু খোয়া যায়নি?
কে বলবে? ওর যখন জ্ঞান হবে, ও কি বলবে সেকথা?
হয়তো জ্ঞান হলে ও বিরক্ত হবে। ওই মাছি বসার ভুরুর মতো ভুরুটা কুঁচকে বলবে, কে বলেছিল আমাকে তুলে আনতে?
বলবে, কী আশ্চর্য, এত কৌতূহল!…বলবে, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব মানে?
হয়তো বা তা নয়। হয়তো বা কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হবে, বলবে, আপনারা আমার পূর্বজন্মের পরমাত্মীয় ছিলেন।
এখন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে না ওর নাম কী, ওর স্বভাব কী।
এখন শুধু নিষ্পলক চেয়ে বসে থাকা, ও কখন চোখ খুলবে।
কিন্তু মৃণাল কেন?
যার প্রাণের মধ্যে আছড়া-আছড়ি করছে, যার মনে হচ্ছে সমস্ত পৃথিবীটা ছুটোছুটি করে দেখে বেড়ায় কোথায় আছে তার জীবনের জ্যোতি, সে কেন একটা অর্ধেক-দরজা-ভেজানো আধ-অন্ধকার ঘরে নাম-পরিচয়হীন সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা অচৈতন্য মেয়েকে আগলে বসে আছে স্তব্ধ হয়ে?
সেকথা খুঁজতে গেলে ওই স্তব্ধতার গহ্বরেই চোখ ফেলতে হয়।
সমস্ত বিশ্ব ছুটোছুটি করে বেড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর, কিন্তু পথে বেরোবার সাহস নেই। ওর মনে হচ্ছে ওর সর্বাঙ্গে লেখা হয়ে গেছে সেই ভয়ংকর পরাজয়ের ইতিহাস। ওর ললাটে আঁকা হয়ে গেছে। সেই কলঙ্কের রেখা।
ও পথে বেরোলেই লোকে প্রশ্ন করবে, ব্যাপারটা কী হল বলুন তো?
অতএব চোরের মতো লুকিয়ে থাকবে ও।
কলকাতায় ফিরে গিয়ে সেই চোরকে মুখ দেখাতে হবে?
হবে না। হবে না। জ্যোতিকে যদি খুঁজে না পাওয়া যায়, কলকাতার ওই বেসরকারি অফিসের কাজটা ত্যাগ করে চলে যাবে সে পরিচিত সমাজ থেকে অনেক দূরে। যেখানে কেউ জিজ্ঞেস করবে না, ব্যাপারটা কী হল বলুন তো?
কিন্তু জ্যোতিকে তবে খুঁজবে কে? জ্যোতিকে খোঁজা হবে কী করে?
খুঁজতে হলেই তো তার প্রথম সোপান হবে ঘোষণা করে বলা, জ্যোতিকে হারিয়েছি আমি।
না, মৃত্যু এসে নিয়ে যায়নি তাকে, গৌরবের পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা নয় তার। তার পথ অন্ধকারের। আর তার পৌরুষহীন স্বামীর নির্লজ্জ ভীরুতা সেই অন্ধকারের দর্শক।
জ্যোতি যদি বেঁচে থাকে, খোঁজ দেবে না নিজের? যেমন করে হোক? এক লাইন চিঠিতে? একটা মানুষের মুখে?
কিন্তু তারপর? জ্যোতি যদি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে আসে?
চিন্তায় দৃঢ় হল মৃণাল।
জ্যোতি, তুমি যে অবস্থায় আসো, এ ঘর তোমার জন্যে চিরদিন খোলা থাকবে। মৃণাল প্রমাণ করবে ভালবাসা কখনও মরে না।
.
১৮.
তবু প্রশ্নটা তো রয়েই গেল! মৃণাল কেন?
মৃণালের হাহাকারের কথা বাদ দাও, নিয়মনীতির কথাই বলো। মৃণাল কেন আগলাবে বসে অচৈতন্য একটা অপরিচিতা তরুণী মেয়েকে?
লীলাবতী নেই? ভক্তিভূষণ নেই? মানবিকতা করতে চান তো ওঁরাই করুন। নিয়মকানুনের জ্ঞান নেই ওঁদের?
আছে। কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি আছে ভয়। লজ্জার ভয়, সম্ভ্রমহানির ভয়, সমস্ত অহংকার ধূলিসাৎ হবার ভয়। যদি হঠাৎ কেউ এসে পড়ে? পড়শির তত্ত্ব নেওয়া কর্তব্য মনে করে? মহিলা অথবা পুরুষ? তারা তো লীলাবতীর কাছেই আসবে, ভক্তিভূষণের কাছে আসবে। তখন?
তার থেকে ওঁরা বাইরের দিকে ঘাঁটি আগলান, মৃণাল ভিতরে পাহারা দিক। কেউ এলে লীলাবতী বলবেন, হ্যাঁ খুব জ্বর, ছেলে রয়েছে ঘরে, আমি এই দুটো রান্না করে নিচ্ছি।
ছেলে রয়েছে ঘরে–ওটা একপ্রকার নিষেধবাণী। যাবে না কেউ।
যদি ভক্তিভূষণের কাছে আসে?
ভক্তিভূষণ বলবেন, হ্যাঁ জ্বর। বোধহয় হঠাৎ ঠাণ্ডায়।…না না, ডাক্তার লাগবে না, আমি দিয়েছি ওষুধ। একটু-আধটু হোমিওর চর্চা করে থাকি। তারপর দেশের সমস্যার কথা পাড়বেন।
বসে বসে মিথ্যার জাল রচনা করা হচ্ছে। জানে না সেই জালে আর কেউ পড়তে আসবে না। এ বাড়ির এই তিনটে মানুষকেই ঘিরে ফেলতে সেই জাল।
কিন্তু জাল যারা রচনা করে, তারা কি বোঝে তা? তারা ফাঁসের পর ফাঁস গাঁথে, আর ভাবে বিপদ-মুক্তির পথ আবিষ্কার করছি।
.
১৯.
মাছিটা ঘুরছে। বারবার এসে বসছে গালে কপালে মুখে।
বারবার কুঞ্চনরেখা পড়ছে ভুরুতে।
মৃণাল তাকিয়ে আছে সেই দিকে। আছে প্রত্যাশার দৃষ্টি মেলে।
ওই স্পন্দনের পথ ধরে কখন খুলে পড়বে ওই ভুরুর নীচের বুজে থাকা চোখ দুটো। মাছিটাকে তাই তাড়াবে না মৃণাল।
মৃণালের চিন্তাটা কার্যকরী হল।
ওই ভুরুটা আর একবার কুঁচকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে একটা শব্দ উঠল, উঃ!
মৃণাল সরে এল।
মৃণাল ওর নাকের সেই চশমা পরার খাঁজটা দেখল, গলার সরু ঝিরঝিরে হারটা দেখল, লীলাবতীর ঢাউস শেমিজ আর চওড়া পাড়ের শাড়ি-পরা অদ্ভুত-দেখানো দেহটা দেখল, এলিয়ে পড়া হাত দুটো দেখল, দেখল রুক্ষু জমাটবাঁধা চুলগুলো, তারপর আস্তে আস্তে ডাকল, শুনুন।…শুনছেন?
চোখটা কুঁচকে ছিল, তবু বোজাই ছিল। এই ডাকে, অথবা এমনিই সেই বোজা চোখ দুটো একবার খুলল।
কেমন একটা বিহ্বল অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর আবার বুজে ফেলল। একটা যেন নিশ্বাস পড়ল।
মৃণালের বুকের মধ্যেটা মোচড় দিয়ে উঠল।
মৃণাল ভাবল, অথচ বিধাতার এতটুকু ইচ্ছেয় এ জ্যোতি হয়ে যেতে পারত।
তারপর ভাবল, হয়তো জ্যোতিও এমনি কোনওখানে অসহায় চোখ মেলে চারদিক তাকিয়ে দেখে আবার চোখ বুজে ফেলছে। হয়তো গভীর একটা নিশ্বাস পড়ছে তার বুক ভেঙে।
চৈতন্য নেই। তবু ক্লান্ত বিষঃ নিশ্বাসটা উঠে আসতে পারে কোথা থেকে?
মৃণাল আবার বলল, শুনছেন?
এবার ও চোখ খুলল।
তাকিয়ে তাকল।
বিস্ময় নয়, প্রশ্ন নয়, ভাবশূন্য দৃষ্টি।
মৃণাল কোনও প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে বলল, জল খাবেন?
ও উত্তর দিল না। যেন অচেতনার অন্ধকার থেকে চেতনার মোহানায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেন বুঝতে পারছে না কোন দিকে তাকাবে। সামনে না পিছনে।
মৃণাল ব্যগ্রভাবে আবার বলে, শুনুন, জল খাবেন?
ও সম্মতির দৃষ্টিতে তাকাল।
মৃণাল উঠে গিয়ে কুঁজো থেকে জল এনে দাঁড়াল, মৃণাল ঘরের দরজাটার দিকে তাকাল।
আধ-ভেজানোই রয়েছে।
এখানে দরজা জানলায় পরদা নেই।
জ্যোতি একখানা পরদা এনেছিল শাড়ি জামার সঙ্গে, নিজের শোয়ার ঘরে টাঙিয়েছিল। এ ঘরটা লীলাবতীর। এখানে পরদার প্রয়োজন ছিল না। এখন যদি প্রয়োজন হয়, দরজাটাকেই বন্ধ করতে হবে। কিন্তু বন্ধ দরজা কী অস্বস্তিকর!
সেই অস্বস্তির দিকে তাকাল মৃণাল।
আর শুনতে পেল ঝিটা বলছে, বউদি যে তোমার ঘরে মা?
মৃণালের ভয় হল।
মৃণালের মনে হল, ওই ঝিটা সব যেন জেনে বুঝে অবোধের ভান করে জেরা করছে। ওর জেরার স্রোতের মুখে পড়ে লীলাবতী কুটোর মতো ভেসে যাবেন। আর তখন গ্রামসুষ্ঠু সবাই জেনে ফেলবে–
জলটা হাতে নিয়েই মৃণাল কানখাড়া করল, মা কী বলেন। কিন্তু লীলাবতীকে ভয় করবার কিছু নেই। লীলাবতী ভেসে যাবেন না। লীলাবতী এখন পাকা অভিনেত্রী হবেন। ভেঙে পড়া শরীরকে এখন চাঙ্গা করে নিয়ে আবার উঠেছেন লীলাবতী শুধু ওই অভিনয়ের তাড়নায়। তাই লীলাবতী সহজেই বলতে পারলেন, সারারাত মাথায় জল বাতাস, হাতে পায়ে সেঁক, দাদাবাবু অত পারবে কেন? তাই এ ঘরেই নিয়ে এসেছি
মৃণাল একটু আশ্বস্ত হল।
মৃণালের মনে হল, মাকে যেমন বোকা ভাবি তা নয়। মা বেশ ম্যানেজ করে ফেলতে পারবেন। একে সঙ্গে নিয়েই যেতে হবে আমাদের, নিজেদের প্রেস্টিজ রাখতেই। কিন্তু জ্ঞান হলে কি থাকতে চাইবে সে?
ঝি-টা বলছিল, সরকারি ইস্কুলের দিদিমণি হারিয়ে গেছে।
এই কি তা হলে সেই দিদিমণি?
এরও কি জ্যোতির মতো অবস্থা ঘটেছিল? শুধু এ তাদের কবল থেকে পালিয়ে এসে
মৃণাল একটু ক্ষুব্ধ হাসি হাসল, আমি জগতের সব ঘটনাতেই সেই একই ঘটনা দেখব নাকি?
হয়তো ঝড়ে এর চাল উড়ে গিয়েছিল, হয়তো ছুটে কোথাও আশ্রয় নিতে গিয়ে প্রবল বর্ষণের দাপটে দিশেহারা হয়ে ছুটে এসে ওই ভাঙা গোয়ালটায় আশ্রয় নিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু কোথায় সেই সরকারি স্কুল?
কোথায় তার সেই কোয়ার্টার্স?
.
মাছিটা আবার উড়ে উড়ে বসছে।
ওটাই কি ওই অচৈতন্য মানুষটাকে চৈতন্যের দরজায় টেনে আনবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে?
তা তার চেষ্টায় কাজ হল।
মানুষটা মাছি ওড়ানোর অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। বলে উঠল, আঃ।তারপর বলল, জল।
মৃণালের হাতে জলের গ্লাস, অথচ মৃণাল ভেবে পাচ্ছিল না তারপর কী করবে।
ও কি মাকে ডেকে আনবে?
না নিজেই ভার নেবে?
এবার সচেতন হল, আস্তে ওর কপালে একটা হাত রেখে সাবধানে জল ঢেলে দিল।
ও জল খাবার পর যেন পরিষ্কার দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর আস্তে বলল, এ বাড়িটা কাদের?
আমাদেরই।
আপনারা কে?
আমরা? মৃণাল ইতস্তত করে বলল, আমার নাম মৃণাল ঘোষ।
ও আবার ক্লান্তিতে চোখ বুজল।
মৃণাল তাকিয়ে দেখল, ওর চোখের পাতা কাঁপছে। কাঁপছে নাকের পাশ। ঠোঁটের কোণে স্পন্দন উঠছে মাঝে মাঝে।
বোধ হয় ভাবতে চেষ্টা করছে।
কিছু খাবেন?
মৃণাল বলল।
মেয়েটা এবার চোখ খুলে ভাল গলায় বলল, কী খাব?
এই…ইয়ে গরম দুধ কি হরলিক!
বাবার হরলিকস আছে, জানে মৃণাল।
মেয়েটা কী ভাবল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, না।
মৃণাল ব্যগ্র গলায় বলল, কেন? না কেন? দু-তিনদিন তো খাননি?
মেয়েটা বিরক্তিতে কপাল কোঁচকাল।
বলল, কে বললে?
দেখতেই তো পাচ্ছি। সেই ঝড়ের রাত থেকে
আঃ। চুপ করুন।
মেয়েটা হঠাৎ তীব্র চিৎকার করে উঠল।
মৃণালের মনে হল, ওই ঝড়ের স্মৃতি ওর কাছে ভীতিকর।
মৃণালের হঠাৎ মনে হল, এই মেয়েটা কি সত্যি কোনও মেয়ে? না একটা ছলনা? শুধু জ্যোতির অবস্থাটা বোঝাতে, ওই ছলনামূর্তি এসে আছড়ে পড়েছে?
জ্যোতিও হয়তো এমনি এই তিন-তিনটে দিন অনাহারে—
সমস্ত শরীরটার মধ্যে একটা আলোড়ন উঠল, মাথার মধ্যে রক্তের ছুটোছুটি।
মৃণাল এখন কে-জানে-কে একটা মেয়েকে তোষামোদ করছে গরম দুধ খাবার জন্যে, হরলিক খাবার জন্যে।
মৃণাল তা হলে পাথর?
হয়তো পাথর!
হয়তো মমতার সাগর!
তাই মৃণাল আবার বলল, ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়েছেন, একটু কিছু না খেলে—
মেয়েটার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
মেয়েটা আস্তে বলল, আমি বাঁচতে চাই না।
.
বাঁচতে চাই! বাঁচতে চাই!
এই হচ্ছে পৃথিবীর সার ধ্বনি।
আসুক দুঃখ, আসুক লাঞ্ছনা, আসুক ক্ষয়-ক্ষতি শোক তাপ, দারিদ্র্য, দুর্বিপাক, তবু বাঁচতে চাই। দেহে বাঁচতে চাই, মনে বাঁচতে চাই।
তবু বাঁচার পথ দুরূহ। বাঁচার পারমিটটা দুষ্প্রাপ্য।
কিন্তু ওই সমবেত কণ্ঠের কলরোলের মধ্যেও কদাচ কখনও এক আধটি ক্ষীণ কণ্ঠ বলে ওঠে, আমি বাঁচতে চাই না।
অথচ তাকে বেঁচে থাকতে হয়।
মনে না হোক, দেহে।
প্রতিক্ষণ মৃত্যুকামনা করে করে আয়ুর ঋণ শোধ করতে হয়।
তাই এই বর্ষার জলে ভেসে আসা মেয়েটার আপত্তিও টিকল না, তাকে বাঁচবার জন্যে গরম দুধ খেতে হল, তাকে গরম হরলিকস খেতে হল।
লীলাবতীই এলেন গরম দুধ নিয়ে।
বললেন, এটুকু খেয়ে ফেলো দিকি।
ও বলল, আপনারা আমার জন্যে এত করছেন কেন?
লীলাবতী রসহীন গলায় বললেন, এত আর কি! মানুষের জন্যে মানুষ এটুকু করবে না? নাও, খেয়ে নাও।
মেয়েটা উঠে বসতে গেল।
লীলাবতী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, উঠো না উঠো না, মাথা ঘুরে যাবে। দুর্বল হয়ে গেছ তো বেজায়!
মেয়েটা তবু উঠে বসল, আস্তে সাবধানে।
হাত বাড়িয়ে দুধটা নিল।
লীলাবতী বললেন, নাম কী তোমার?
মালবিকা মিত্র।
তুমি এখানকার ইস্কুলের দিদিমণি?
মা! মৃণাল ঘরের কোণে একটা হাতলভাঙা আরাম চেয়ারে বসে একখানা বই পড়ছিল, মার ওই প্রশ্নে নিষেধের সুরে ডাকল, মা!
অর্থাৎ এখনই ওকে ব্যস্ত কোরো না মা!
লীলাবতীর রাগ হল।
লীলাবতীর মনে হল, মৃণাল যেন অধিকারের কোঠায় দাঁড়িয়ে লীলাবতীকে অনধিকারচর্চায় নিষেধ করছে।
কেন?
হঠাৎ মৃণালই বা এই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়েটার স্বত্বাধিকারী হয়ে উঠল কেন?
লীলাবতী রাগের গলায় বললেন, কেন? জিজ্ঞেস করলে কী হয়? কোথা থেকে এসেছে, কাদের মেয়ে, সেটা জানতে হবে না?
সেটা পরে জেনে নিলেও চলবে—
দৃঢ়কণ্ঠে বলল মৃণাল।
লীলাবতী গুম হয়ে গেলেন।
লীলাবতী কথা বললেন না, খালি গ্লাসটা নিয়ে চলে গেলেন। গিয়েই ভক্তিভূষণের সামনে দাঁড়ালেন।
রুদ্ধকণ্ঠ বললেন, কী জাত না কী জাত, তার এটো ধরতে হবে, অথচ একটা কথা জিজ্ঞেস করবার স্বাধীনতা থাকবে না আমার?
ভক্তিভূষণ বোধহয় ব্যাপারটা অনুমান করলেন। ভক্তিভূষণ বললেন, দুর্বলতাটা একটু যাক—
সেটুকু জ্ঞান আমার আছে, লীলাবতী তীব্র স্বরে বলেন, নামটাও তো জানা দরকার? না কি? ডেকে খাওয়াতে হবে যখন।
.
লীলাবতী চলে যেতে মালবিকা আস্তে ডাকে, শুনুন—
মৃণাল উঠে এসে বলে, বলুন।
উনি আপনার মা?
হ্যাঁ।
আপনারা এখানেই থাকেন?
মৃণাল কষ্টে বলে, না, কলকাতায়। এখানে বেড়াতে আসা হয়েছিল।
বেড়াতে?
মালবিকার মুখে বুঝি একটু হাসি ফুটে ওঠে, এখানে কেউ বেড়াতে আসে? দেশের বাড়ি।
ওঃ।
মালবিকা একটু চুপ করে থেকে বলে, আপনি, আপনার মা আর বাবা?
আবার মাথার মধ্যে উত্তপ্ত রক্তের ছুটোছুটি।
তবু মৃণাল কষ্টে বলে, হ্যাঁ।
আমাকে নিয়ে আপনাদের বিপদ হল।
ক্ষীণ মৃদুকণ্ঠে বলল মালবিকা।
মৃণাল ভাবল, বিপদ না বিপদ-ত্রাণ!
আমরা যা পরিকল্পনা করছি, তাতে তুমিই হবে আমাদের মানসম্ভ্রমের রক্ষয়িত্রী। কিন্তু তুমি কি তাতে রাজি হবে?
অবশ্য তোমায় আমরা কিছু বলব না, শুধু বলব–তোমার চিকিৎসার দরকার, আমাদের সঙ্গে চলো–
কিন্তু তুমি সেই যাওয়াটায় রাজি না হতেও পারো। দুর্বলও তো তুমি কম নও।
অথচ এখনই আমাদের চলে গেলে ভাল হয়। পাড়ার লোক না জানতে!
আশ্চর্য!
এই দুদিন আগে ভক্তিভূষণ মৃণালের ছুটির কথা তুলেছিলেন বলে মৃণাল অবাক হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আজ নিজেই মৃণাল এইসব সাংসারিক কথাগুলো ভাবতে পারছে।
হয়তো মানুষের সবকিছুর উপর হচ্ছে সম্ভ্রম।
সব যায় যাক। সম্ভ্রমটুকু যেন না যায়।
মৃণালরা চারজন এসেছিল, চারজনকেই ফিরে যেতে হবে। তা নইলে একজনের ঘাটতিতে এক হাজার কথার জবাব দিতে হবে। আর শেষ পর্যন্ত মাথা হেঁট করে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
অতএব
আমরা চারজন এসেছিলাম, চারজনেই যাব। কথাটা বলেছিলেন ভক্তিভূষণ। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওর একটা চিকিৎসারও দরকার।
.
কিন্তু সেটা কোথায় রেখে?
মৃণালদের সেই দুঘরের ফ্ল্যাটটাতেও কি সেই নিয়মটাই রক্ষিত হবে?
চারজনের জায়গায় চারজন?
আঃ! পাগল তো নই আমি বলেছিলাম ভক্তিভূষণ, এ ছাড়া আর উপায় দেখছি না বলেই বলতে হচ্ছে। গিয়েই হসপিটালে ভর্তি করে দিতে হবে। কে জানে কী অবস্থায়
চুপ করে গিয়েছিলেন।
একটা ভয়াবহ আশঙ্কা তো সকলেরই বুকে পাথর চাপিয়ে রেখেছে।
মুখ ফুটে কেউ বলে না।
কী করে বলবে?
সেই বলার মুখে যে জ্যোতি দাঁড়িয়ে আছে অনড় হয়ে।
অন্য কারও কথা বলতে গেলেই যে জ্যোতি নিরাবরণ হয়ে যাবে।
.
মৃণাল বলল, বিপদ বলছেন কেন?
বিপদ নয়?
সাধারণ কর্তব্য মানুষ মাত্রেই করে থাকে।
মানুষ! মালবিকা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, মানুষ শব্দটার মানে ভুলে গেছি।
মৃণাল একটু চমকাল। মৃণালের মনে হল, নেহাত আজেবাজে সাধারণ মেয়ে নয়। কথা বলতে জানে।
কথা বলতে জানে এটা একটা প্রশংসাপত্র বইকী! কজন জানে কথা বলতে? বেশির ভাগ লোকই তো শুধু কথা কয়।
.
২০.
আমার মনে হয়, একেবারে কিছু না বলাটা ঠিক হবে না।
ভক্তিভূষণই বললেন এ-ঘরে বসে। একটু অবহিত করিয়ে নিয়ে গেলেই বোধ হয়—
লীলাবতী বললেন, কীসের অবহিত?
এই যে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাব অন্য পরিচয়ে
ভাবছিলেন ভক্তিভূষণ, সেই কথা।
কিন্তু আশ্চর্য, মালবিকা নামের মেয়েটাও ঠিক সেই কথাই ভাবছে, এখান থেকে চলে যাব নিজের পরিচয়ে নয়, অন্য পরিচয়ে
গ্রামোন্নয়ন শিল্প-শিক্ষণ কেন্দ্রের দিদিমণি মালবিকা মিত্র মুছে যাক, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। একটা নাম-গোত্রহীন পথে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে নতুন পরিচয়ে বেঁচে উঠুক।
আমি যখন মানুষ শব্দটার মানে ভুলে যাচ্ছিলাম, তখন এদের দেখলাম।
মনে মনে ভাবল মালবিকা।
তারপর একসময়ে যখম মৃণাল একবার এসেছে ওর তত্ত্ব-তল্লাশ নিতে, তখন আস্তে বলল– আমার নাম পরিচয়, সব কিছু এখানে ফেলে দিয়ে চলে যেতে চাই।
মৃণাল তাকিয়ে দেখল।
মৃণালের চোখে একটা জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল।
মালবিকা বলল, আমার পরিচয়ে আমার ঘৃণা!
.
ভগবান নেই, আবার আছেনও।
নইলে এরা যখন ভাবতে বসেছে ওকে কী করে বলা যায়–তোমার ওই মালবিকা মিত্র নামটা কয়েক ঘণ্টার জন্যে ভুলে যেতে হবে তোমাকে। ঘোষ পরিচয়ে আমাদের সঙ্গে চলো তুমি
ও তখন নিজেই বলে ওঠে, আমার পরিচয় নিশ্চিহ্ন করে মুছে দিয়ে নতুন পরিচয়ে জন্মাতে চাই।
তবে?
ভগবান নেই?
ভক্তিভূষণ বললেন, তাই যদি তো চলো এখন আমাদের পরিচয়ে। সেটাই হবে তোমার নতুন পরিচয়। ঘোষদের একজন হলে তুমি।
ভক্তিভূষণ এসে স্ত্রীকে বললেন, হাতে চাঁদ পেলাম আমি! এখন ওই ভাবেই নিজেদের লোক বলে জানিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তারপর কলকাতায় গিয়ে
লীলাবতীও ষড়যন্ত্রে ছিলেন।
লীলাবতী এই নতুন মেয়েটার প্রতি আর তেমন বিরূপও থাকছিলেন না, কিন্তু আজ হঠাৎ লীলাবতী ডুকরে কেঁদে বললেন, ওগো কী পাষণ্ড প্রাণ আমার। আমার সোনার প্রতিমাকে এখানে ফেলে রেখে কাকেনাকাকে তার নামে সাজিয়ে ফিরে চলে যাচ্ছি!
ভক্তিভূষণ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, চুপ করলেন। মৃণাল এসে দাঁড়িয়েছে। মা, কী পাগলামি শুরু করছ বলো তো? ওঁর জ্ঞান হয়েছে, সব বুঝতে পারছেন, যদি এসব কানে যায়?
লীলাবতী বললেন, আমি যে ধৈর্য ধরতে পারছি না বাবা!
মৃণাল শুকনো গলায় বলল, আমি পারছি।
লীলাবতী চুপ করে গেলেন। সত্যিই তো, মৃণাল যদি পারে, তিনি অধীর হবেন কোন মুখে? লীলাবতী কি মৃণালের থেকেও বেশি আপন জ্যোতির?
ভক্তিভূষণ বললেন, ও রাজি আছে তো?
সেটাও হওয়াতেই হবে।
বেশ সুস্থ বোধ করছে?
নিজেই তো দেখছ সবসময়।
দেখলাম–ঘরের মধ্যে আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো আর হাসপাতালের দরকার হবে না।
অসুখ তো কিছু না, শুধু অমানুষিক কষ্টে সেন্সলেস হয়ে যাওয়ার দুর্বলতা। বলল মৃণাল।
ভক্তিভূষণ মনে মনে বললেন, সেই অমানুষিক কষ্টটা কীসের, সেটাই তো জানা গেল না। তুমি যে আবার বড্ড বেশি ইয়ে করছ। কিছু জিজ্ঞেস করতে পারা যাবে না। এ কী আশ্চয্যি।
মুখে বললেন, ঘোড়ার গাড়িকে বলে এলাম। ভোরের ট্রেন ধরিয়ে দেবে।
কটার গাড়ি?
সাড়ে পাঁচটা। সেটাই ভাল!
তা সেটাই ভাল বইকী! পাড়ার লোক টের পাবে না।
কেউ এসে উঁকি দিয়ে বলে উঠবে না, এ কী, তোমাদের চারজনের মধ্যে একজনের চেহারা বদলে গেল কী করে?