১১-১৫. সুজন বোস একটু চিন্তিত

সুজন বোস সকালবেলা থেকেই একটু চিন্তিত, তিন কাপ কালো কফি খেয়ে বাগানে পায়চারি করে চিন্তার জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন, তাতে মাথার মেঘ কাটেনি। এখন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ নিজের ল্যাবরেটারিতে বসে একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন।

দক্ষিণের জানালার দিকটায় ফণিমনসার ঝোঁপজঙ্গল, সেদিক থেকেই মৃদু একটু গলা খাঁকারির আওয়াজ এল।

সুজন ভ্রুটা সামান্য কুঁচকে মৃদু গলায় বললেন, ।আসতে পারো।

মিনিটখানেক বাদে ল্যাবরেটারির খোলা দরজায় পাগলু এসে বশংবদ মুখ করে দাঁড়াল।

কী খবর পাগলু?

আজ্ঞে খবর তো মেলা, ধীরে ধীরে বলতে হবে। সময় লাগবে।

সুজন একটু হেসে বললেন, গাঁয়ের লোকের একটা দোষ কী জানো? তাদের কাছে সময়ের কোনও দামই নেই। সময় কেমন করে কাটাবে তাই তারা ভেবে পায় না। এক মিনিটের কথা এক ঘণ্টা ধরে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলে।

তা যা বলেছেন।

গুরুতর খবর হলে বলতে পারো, তবে সংক্ষেপে।

যে আজ্ঞে। আমার এক স্যাঙাত আছে, জগা। জানেন তো!

শুনেছি, চোর তো!

আজ্ঞে, তবে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। আজ তাকে দিনুগুণ্ডা ধরেছিল একটা খুনের কাজে লাগানোর জন্য। আর গোঁসাই গোপেশ্বর আমাদের পাকড়াও করেছিল নিতাই পালের খবরের জন্য।

ভ্রুটা একটু কোঁচকালো সুজনের। বললেন, নিতাই পালের কথা সে কী বলছে?

সে বলছে নিতাই পালই নাকি শূলপাণিকে গুম করেছে।

সুজন গম্ভীরভাবে শুধু বললেন, গুম। আর কিছু?

মাথা নেড়ে পাগলু বলল, সংক্ষেপে বলতে বলছেন, তাই সংক্ষেপেই বললুম, তবে গোপেশ্বরের বিশ্বাস সরলাবুড়ির দু ঘড়া মোহর আছে।

সুজন একটু হাসলেন, বললেন, বমোহরের গপ্পো আমিও শুনেছি। মোহর কি ছেলের হাতের মোয়া?

আজ্ঞে, আমরাও তাই বলেছি।

ঠিক আছে, এখন যাও। পরঞ্জয়বাবুর খবর-টবর একটু নিও।

আজ্ঞে নিয়েছি। কাল রাতেই গিয়েছিলাম। দিব্যি মনের আনন্দে আছেন। কোনও খবর দিতে হবে কি?

খবর দেওয়ার কিছু নেই। শুধু জেনে আসবে কিছু লাগবে-টাগবে কি, কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না।

কিছু লাগবে না। মনের আনন্দে আছেন।

ঠিক আছে। এখন যাও।

পাগলু চলে যাওয়ার পর সুজন চুপ করে বসে রইলেন।

মিনিট দশেক ধ্যানস্থ থাকার পর উঠে ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে লোহার আলমারিটা খুললেন। ভেতর থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে ডালাটা খুলে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। বাক্সের ভেতর সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সা। রোজই কিছুক্ষণ তিনি জিনিসগুলো দেখেন। সাতটা কড়ি মানে সাতকড়ি নামের কেউ একজন–এটা বুঝবার জন্য বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। কিন্তু মুশকিল হল সাতটা পয়সা নিয়ে। পয়সার ধাঁধা তিনি এখনও সমাধান করতে পারেননি। সাতটা পয়সা মানে সাত পা হাঁটার সংকেত হতে পারে, সাত ফুট দূরত্ব হতে পারে, কিংবা আরও অনেক কিছু।

সুজন বাক্সটা আবার যথাস্থানে রেখে আলমারি বন্ধ করে চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন এমন সময়ে বাইরে হেঁড়ে গলায় কে ডাকল, সুজনবাবু আছেন নাকি?

সুজন দরজা খুলে দেখলেন, গদাই নস্কর আর নগেন দারোগা দাঁড়িয়ে আছেন।

সুজন মৃদু হেসে বললেন, আসুন আসুন।

ল্যাবরেটরির এক ধারে চেয়ার-টেয়ার পাতা আছে। দুজনে বসবার পর নগেন দারোগা বলল, এসে ডিস্টার্ব করলাম নাকি? কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছিলেন না তো!

সুজন হেসে বললেন, কথাটা ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে। এই ল্যাবরেটারিতে কি গবেষণা হয়? যন্ত্রপাতি কোথায়? ইলেকট্রিক কোথায়? গবেষণা টবেষণা নয়, বসে বসে চিন্তা-ভাবনা করি আর কি, তা কী খবর বলুন?

নগেন দারোগা পা ছড়িয়ে বসে বললেন, এ গাঁয়ে আপনিই সবচেয়ে মান্যগণ্য লোক। অনেক লেখাপড়া করেছেন, বিলেত-বিদেশ ঘুরে এসেছেন। আপনার কাছে একটা কথা বলতে আসা।

বলুন।

হরিপুর বড় শান্তির জায়গা ছিল। কখনও কোনও গণ্ডগোল হয়নি, কিন্তু ইদানীং এসব কী হচ্ছে বলুন তো!

সুজন শান্ত গলায় বললেন, শূলপাণির নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে ভাবছেন নাকি?

শুধু শূলপাণি কেন? আমাদের পরঞ্জয়দাদারও তো একই কথা। দু-দুটো লোক গাঁ থেকে উবে গেল মশাই, এ কি সোজা কথা?

সুজন একটু চিন্তিতভাবে বললেন, ঘটনা দুটি নিয়ে আমিও ভাবছি। শূলপাণির সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ ছিল। পরঞ্জয়বাবু অবশ্য একরকম বন্ধু মানুষ। কিন্তু এঁরা কোথায় যেতে পারেন তা আমিও ভেবে পাচ্ছি না।

গদাই নস্কর বলল, এ অঞ্চল আমার চেয়ে ভাল কেউ চেনে না। একসময়ে সারা তল্লাট জুড়ে আমি ডাকাতি করে বেড়িয়েছি। সব জায়গাতেই আজও আমার পুরনো চরেরা আছে। কিন্তু তারাও কেউ কোনও হদিস দিতে পারেনি।

সুজন গম্ভীরভাবে বললেন, চিন্তার কথা।

নগেন দারোগা বলল, আপনি বুড়ো মানুষ, একা থাকেন, চোর ডাকাত জানে যে আপনি বিদেশ থেকে মেলা টাকা পয়সা নিয়ে এসেছেন। তাই আপনাকে নিয়েও আমাদের ভাবনা হচ্ছে। আপনি দুর্জয় সাহসী না হলে এভাবে একা থাকতেন না। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার নিরাপত্তার জন্য একটা পাহারা বসাব।

সুজন চমকে উঠে বললেন, সর্বনাশ! ও কাজও করতে যাবেন না।

কেন বলুন তো!

সুজন মাথা নেড়ে বললেন, আপনাদের ধারণা ভুল। টাকা-পয়সা আমার বিশেষ কিছু নেই। বিদেশে আমি অনেক রোজগার করেছিলুম বটে, কিন্তু দেশে ফিরে একটা ব্যবসা করতে গিয়ে আমার বেশিরভাগ টাকা পয়সাই নষ্ট হয়েছে। এখন যা সামান্য আছে তা দিয়ে কোনওরকমে চলে যায়। চিন্তা করবেন না, টাকা-পয়সা আমার ঘরে থাকে না, কালীপুরের ব্যাংকে রাখা আছে।

নগেন দারোগা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু চোর-ডাকাতরা তো আর তা জানে না, তারা হানা দিতে পারে।

সুজন একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনি প্রাক্তন দারোগা বলেই বলছি, দোষ ধরবেন না, এ-তল্লাটের চোর-ডাকাতদের আমি চিনি, কিছু ভাবসাবও আছে। আমাকে নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন হবেন না। আপনাদের কি ধরণা হয়েছে যে, শূলপাণি আর পরঞ্জয়ের পর এবার আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার পালা?

নগেন দারোগা মাথা চুলকে বলে, বলা তো যায় না।

সুজন বললেন, গুম করলে অন্যকথা, কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় হঠাৎ এ বয়সে নিরুদ্দেশ হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আর গুম করার চেষ্টা কেউ করলেও কাজটা সহজ হবে না। সত্তরেও আমি বেশ তেজী লোক। বালিশের পাশে পিস্তল নিয়ে শুই। ঘাবড়াবেন না, পিস্তলের লাইসেন্স আছে।

গদাই লস্কর চিন্তিতভাবে বলল, তবু সাবধানের মার নেই। আপনার বাড়িতে আলাদা করে পাহারা না বসালেও সারা গাঁয়ে সারা রাত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সুজন বললেন, ভালই করেছেন। তবে আমার বিশ্বাস, এসব গুম-টুম নয়।

নগেন বলল, তাহলে কী?

সুজন একটু চিন্তিতভাবে বললেন, শূলপাণি একজন বাতিকগ্রস্ত মাথাপাগলা লোক। আমি বৈজ্ঞানিক বলে সে আমার কাছে নানা উদ্ভট প্রস্তাব নিয়ে আসত। গুপ্তবিদ্যা আর অলৌকিকের ওপর খুব ঝোঁক ছিল। আমার মনে হয় সে সেরকমই কোনও বিদ্যা অর্জনের জন্য কোথাও গেছে। কিংবা…

নগেন ঝুঁকে বসে বলে, কিংবা?

সে কথা থাক। আর একটু বিচার-বিশ্লেষণ করে ভেবে তবে বলা যাবে।

গদাই বলল, আপনি কি শুনেছেন যে তার ঘরে একটা কাঠের বাক্সে সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সা ছিল?

হ্যাঁ, শুনেছি। জিনিসগুলো সে আমাকে দেখিয়েও গেছে।

কেন দেখিয়েছিল?

মাথা নেড়ে সুজন বলল, তা জানি না, সে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল এগুলো দেখে আমি কিছু বুঝতে পারছি কি না।

আপনি কী বললেন?

আমি কিছু বুঝতে পারিনি আর সেটাই বললাম।

আপনি কি জানেন যেদিন সে গুম হয় সেদিন আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বাক্সটা লোপাট হয়ে যায়?

তাও জানি।

ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হচ্ছে না?

হচ্ছে।

ওই কড়ি আর পয়সা কোনও সঙ্কেতও হতে পারে তো!

হতেই পারে। কিন্তু সেই সঙ্কেত ভেদ করার মতো বুদ্ধি আমার নেই। আপনাদের বলি, এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এত ভাবছেন কেন? গাঁয়ের মানুষ সহজেই রহস্যের গন্ধ পায়। আমি বিজ্ঞানী বলেই বাস্তবভাবে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি। ওই পয়সা আর কড়ির ভেতরে কোথাও সংকেত বা রহস্য না থাকারই সম্ভাবনা বেশি। যে বাক্সটা চুরি করেছে সে গুপ্তধনের সম্ভাবনার কথা ভেবেই করেছে হয়তো। কিন্তু লাভ হবে বলে মনে হয় না।

গদাই বলল, রাত আটটার সময় শূলপাণি রোজ অট্টহাসি হাসত। এখন সেটাকেও অনেকে সংকেত বলে মনে করছে। আপনার কী মনে হয়?

সুজন মৃদু হেসে বললেন, “হাসিটা আমিও শুনেছি। কিছু মনে হয়নি। বাতিক ছাড়া কিছু নয়।

নগেন দারোগা হতাশার গলায় বলল, না, আপনি দেখছি সবই উড়িয়ে দিচ্ছেন।

সব উড়িয়ে দিচ্ছি না। আপনারা যা বললেন এসব নিয়েও ভাবব।

গদাই নস্কর আর নগেন দারোগা উঠতে যাচ্ছিল, সুজন বললেন, “একটা কথা, গোপেশ্বর গোস্বামীকে তো চেনেন নিশ্চয়ই।

নগেন বলল, চিনবো না? সে নে গাঁয়েরই লোক?

লোকটা কেমন?

মিটমিটে বিচ্ছু টাইপের, তবে তার নামে তেমন বড় কোনও অভিযোগ নেই। কেন বলুন তো?

এমনিই, কৌতূহল, সে মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে।

কী বলে সে?

সুজন একটু হেসে বললেন, “কূটকচালি করতেই আসে। লোকটাকে সুবিধের ঠেকে না।

নগেন মাথা নেড়ে বলে, লোক সুবিধের নয় ও। তেমন কিছু হলে জানাবেন, ধমকে দেবো।

না, না, ধমকানোর কিছু নেই।

দুজনে চলে যাওয়ার পর সুজন উঠলেন। স্নান-খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর একখানা মোড়ে আছে। মোপেডটা ঘর থেকে বের করে উঠোনে নামিয়ে স্টার্ট দিলেন। তারপর গাঁয়ের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে গাড়িটা চালিয়ে দিলেন।

হরিপুর ছাড়িয়ে মাইল পাঁচেক আসার পর মোপেড় থামিয়ে কাঁধের থলি থেকে একটা শক্তিশালী ক্ষুদে দূরবীন বের করে পেছনের দিকটা ভাল করে লক্ষ্য করলেন সুজন, না, কেউ আসছে না অনুসরণ করে। নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি ফের গাড়ি ছাড়লেন।

প্রায় কুড়ি মাইল তফাতে সাতগাঁ। গ্রামের উত্তর দিকে একখানা পাকা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নামলেন সুজন। বারান্দায় উঠে দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে একটা বেঁটে লোক উঁকি দিল।

আরে, আপনি?

জরুরী কথা আছে।

আসুন, ভেতরে আসুন।

সুজন ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

.

১২.

সন্ধের মুখে আজও ঝোড়ো হাওয়া ছাড়ল এবং ঘন মেঘ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর নামল তেড়ে বৃষ্টি।

কবিরাজ রামহরি কিছু গাছ-গাছড়ার খোঁজে হরিপুরের দক্ষিণে গড়নাসিমপুরের জঙ্গলে গিয়েছিলেন। ফেরার সময়ে এই দুযোগ। সঙ্গে অবশ্য ছাতা ছিল, কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা উল্টে শিকগুলো ছয় ছত্রখান। ঠাণ্ডা হাওয়ায় বরফের কুচির মতো বৃষ্টির ফোঁটা থেকে মাথা বাঁচাতে রামহরি দৌড়ে সামনে যে বাড়িটা পেলেন তার মধ্যেই ঢুকে পড়লেন।

ঢুকেই খেয়াল হল এটা সরলাবুড়ির বাড়ি। এ-বাড়ি থেকে শূলপাণি নিরুদ্দেশ মনায় আঠ দাঁড়ালেন জটি দেখলেন। চারদিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ভয়ে লোকে এ বাড়ির ত্রিসীমানায় আসে না।

রামহরি দাওয়ায় উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু দাওয়াতেও বৃষ্টির প্রবল ছাঁট আসছে। হাতড়ে হাতড়ে ঘরের দরজাটা দেখলেন। বেশ বড়সড় তালা লাগানো। সুতরাং ঘরে ঢুকে যে গা বাঁচাবেন সে উপায় নেই। চারদিকে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। ব্যাঙ ডাকছে পেছনের পুকুরে। গাছপালায় বাতাসের

অতিপ্রাকৃত শব্দ হচ্ছে। যেন পেত্নীর শ্বাস। / রামহরি গাঁয়ের লোক, সহজে ভয় খান না। কিন্তু আজ যেন গা-টা একটু ছমছম করছে। সরলাবুড়ির বাড়িটা গাঁয়ের বাইরে। কাছেপিঠে অন্য বাড়িঘর নেই। সরলা পিসির সাহস ছিল বটে। একা এই নির্জন পুরীতে বুড়ি দীর্ঘদিন বাস করেছে। শূলপাণি তো এল এই সেদিন।

কবিরাজি চিকিৎসায় খুব বিশ্বাস ছিল পিসির। শেষ কয়েক বছর রামহরিই তার চিকিৎসা করেছেন। বাড়িটার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আজ অনেক কথা মনে পড়ছিল রামহরির। বিশেষ করে এক সন্ধেবেলার কথা। খুব শীত পড়েছিল সেদিন। গড়নাসিমপুরের জঙ্গলে সেইদিনই সন্ধেবেলা বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছিল। খুব কুয়াশা ছিল চারদিকে। এটা যে সময়ের কথা তখন শূলপাণি আসেনি।

রামহরি যখন বুড়ির নাড়ী দেখছিল মন দিয়ে তখন বুড়ি হঠাৎ বলল, “ও বাবা রামহরি, তোকে একটা কথা বলব?”

“বলুন পিসিমা।”

আগে এ-গাঁয়ে মেলা চোর-ছ্যাঁচড় ছিল। বাইরে থেকেও আসত সব দেহাতি চোর। এ-বাড়িতে মাঝরাতেই আনাগোনা করত তারা। তখন ঘরের দোর এঁটে বসে খুব বকাঝকা করতুম তাদের। তা তারাও মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বাইরে থেকে ঝগড়া করত। দু-চারটে চোরের সঙ্গে এ-ভাবেই বেশ ভাব সাব হয়ে গিয়েছিল।

রামহরি অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি? এ তো সাঙ্ঘাতিক কথা পিসি!”

একগাল হেসে বুড়ি বলল, “তা কী করি বল। আমার তিনকুলে কেউ নেই, গাঁয়ের লোকও কেউ বড় একটা আসে না। একা থাকি। তা চোর ছ্যাঁচড়দের সঙ্গেই যা একটু কথাটথা বলতুম। এখন তারা আর আসে না। কেন বলতে পারিস?”

“তা তো জানি না পিসি। চোর-ছ্যাঁচড়দের সঙ্গে আপনারই দরকারটা কী?”

“ওই যে বললুম তোকে, তারা এলে দুটো কথা কয়ে বাঁচতুম। দু চারজনের সঙ্গে তো বেশ ভাবই হয়ে গিয়েছিল। কালীচোর ছিল, সাতগাঁয়ে বাড়ি। চার ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে বড় সংসার। তার আবার হাতে বাতব্যাধি ছিল। বউটা দজ্জাল বলে কত দুঃখ করত। আর ছিল নবা চোর। একেবারে ছেলেমানুষ। তার সৎ-মা বলে বাড়িতে আদর ছিল না। একবার তাকে জানালা গলিয়ে এক বাটি পান্তা ভাত খাইয়েছিলুম। আরও ছিল গণশা চোর। খুব পাজি ছিল। জানালায় দমাদম ইট মারত। একখানা টাকা ছিল তার বরাদ্দ। টাকা দিলেই চলে যেত।”

রামহরি হাসলেন, “উরেব্বাস! এ তো সাঙ্ঘাতিক কথা।”

“তা বাবা, চোরসকল যে উধাও হয়ে গেল। এরকমটা কি ভাল?”

“লোকে তো বলে চোর-ছ্যাঁচড় না থাকাই ভাল।”

“সে তোদের বেলায়। আমার বাপু, চোরটোর তেমন খারাপ লাগে না।

রামহরি মাথা চুলকে বললেন, “একা থেকে থেকে আপনার মাথাটাই গেছে দেখছি পিসি। তা একা থাকবার দরকারটাই বা কী? একজন কাজের মেয়ে রেখে দিন না, সে দিনরাত থাকবে আর মনের আনন্দে তার সঙ্গে বকবক করবেন।”

ওরে বাবা, কাজের মেয়ে রাখব কী রে? তারা যে ভীষণ চোর হয়। আমি বুড়োমানুষ, কোথা থেকে কোন জিনিসটা সরাবে টেরও পাব না।”

রামহরি হেসে ফেললেন, “তা সরালে সরাক না। আপনি তো চোরই খুঁজছেন?”

“না, না বাবা, ঘরে চোর পুষতে পারব না। তবে আমার এখন একজন চোর খুব দরকার। একটা ভাল দেখে চোর খুঁজে পেতে দিবি বাবা? আনাড়ি হলে চলবে না। বেশ পাকা চোর চাই। পারবি?”

রামহরির তো একগাল মাছি। সরলা পিসির মাথাটা যে একটু বিগড়েছে যে বিষয়ে তাঁর আর সন্দেহ রইল না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মাথা বিগড়োনোর অন্যান্য লক্ষণ ঠিকমতো মিলছে না। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “আচ্ছা দেখব’খন। আমার কাছে রুগি যারা আসে তাদের মধ্যে খুঁজলে হয়তো একআধজন চোর পাওয়া যেতেও পারে।”

“ওরে না না, ব্যাপারটা হালকাভাবে নিসনি। শক্ত কাজ, পাকা হাতের চোর ছাড়া পেরে উঠবে না।”

রামহরি অবাকের ওপর আরও অবাক হয়ে বললেন, “চোরকে দিয়ে কী কাজ করবেন পিসি?”

“তোর মাথায় কি গোবর রে রামহরি? চোর চাইছি কি চণ্ডীপাঠ করবে বলে?”

“তাহলে?”

“চোরকে দিয়ে চুরিই করাব বাবা। তবে কাজটা শক্ত। তাই পাকা হাতের লোক খুঁজছি।”

“চুরি করাবেন পিসি? কী সব্বোনেশে কথা! কী চুরি করাবেন? কেন চুরি করাবেন? চুরি করা যে মহা পাপ।”

ফোকলা মুখে এক গাল হেসে সরলা পিসি বলল, “শান্তরের কথা কি আর জানি না রে বাপ! সব জানি, চুরি করা পাপ, মিথ্যে কথা বলা পাপ, আরও কত পাপ আছে।”

“তাহলে চুরি করতে চাইছেন কেন?”

“কথাটা ভেঙে বলতে পারছি না রে বাপ। বলতে ইচ্ছে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কথাটা এখুনি ফাঁস হয়ে গেলে মুশকিল। আগে একটা ভাল দেখে চোর এনে দে, কাজটা উদ্ধার হোক, তারপর একদিন তোকে সব খুলে বলব।”

রামহরির যদিও সরলা পিসির মাথার গণ্ডগোল হয়েছে বলে সন্দেহ রয়ে গেল, তবু চোরও তিনি কিন্তু খুঁজেছিলেন। তাঁর রুগিদের মধ্যে একজন ছিল নিতাই পাল। তার আধকপালে মাথা ধরার জন্য চিকিৎসা করাতে আসত। নিতাই নানা জায়গায় ঘোরে, খুব ফিকিরফন্দি জানে। তা তাকেই রামহরি চোরের কথা বললেন, “ও নিতাই, আমাকে ভাল একজন চোরের সন্ধান দিতে পারো?”

“চোর!” বলে নিতাইয়ের যে কী হাসি, হাসি আর থামেই না, তারপর বলল, “কবরেজমশাই, ব্যাপারটা কী?”

“সে আছে, বলা যাবে না।”

“বলি চোর ধরে তাকে বেটে বা ঘেঁতো করে ওষুধ বানাবেন না তো! আয়ুর্বেদে নাকি কিম্ভুত আর বিটকেল নানা জিনিস দিয়ে ওষুধ বানায়।”

“আর না না অন্য ব্যাপার।”

তা নিতাই এনেছিল দুটো চোরকে, একজন ফিচকে, অন্যজন ফটিক, দুজনেরই বয়স কম, দুজনেই রোগা, দু’জনেই কালো, দুজনেরই মাথায় বাবরি চুল, দুজনের চোখেই বেশ চালাক-চালাক দৃষ্টি আর দু’জনেরই মুখে মিচকে হাসি, রামহরি বুঝলেন, এরা সত্যিই কাজের লোক।

দুজনকেই সরলা পিসির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন রামহরি, চোর দেখে পিসির আনন্দ আর ধরে না। তাড়াতাড়ি মুড়ির মোয়া আর নাড়ু খেতে দিলেন। তারপর রামহরিকে বললেন, “তোর উপকারের কথা ভুলব না। এবার তুই বাড়ি যা এদের সঙ্গে আমার গোপন শলাপরামর্শ আছে।”

এতদিন বাদে সেইসব কথা মনে পড়ে রামহরির একটু হাসি পাচ্ছিল, চোর দিয়ে সরলা পিসি কী করেছিল তা আজও জানে না রামহরি।

সামনেই একটা তালগাছের মাথায় নীল একটা বিদ্যুতের ধাঁধানো শিখা নেমে এল। দপ করে আগুন জ্বলে উঠল গাছের মাথায়। তারপর যে বাজের শব্দটা হল তা থেকে কান বাঁচাতে রামহরি দু’কান চেপে ধরে রইলেন।

তারপরই হঠাৎ শুনতে পেলেন খুব কাছে কারা যেন কথা কইছে, একটু থতমত খেয়ে ঠাহর করে শুনলেন, তালাবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে কথা শোনা যাচ্ছে। রামহরির মেরুদণ্ড বেয়ে হিমের স্রোত নেমে গেল।

.

১৩.

রামহরি আসলে সাহসী মানুষ, বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে কথার আওয়াজ পেয়ে প্রথমটায় ভয় খেলেও সামলে গেলেন। তারপর জানালার বন্ধ পাল্লায় গিয়ে কান পাতলেন, ঝড়-বৃষ্টির শব্দে প্রথমটায় কিছু শুনতে পেলেন না। কিন্তু প্রাণপণ মনঃসংযোগ করে থাকার ফলে একটু বাদে শুনতে পেলেন, কে যেন কাকে বলছে, “হাঁ হাঁ বাবু ও বাত তো ঠিক আছে, কসুর হই গিছে বাবু। হামি সমঝলাম কি বহোত দিন বাদে ইস তরফ যখন এসেই গেছি তখন বুড়ি মায়ের সঙ্গে একটু বাতচিত করিয়ে যাই। উসি লিয়ে–”

অন্য গলাটা বাঘা গর্জন করে উঠল, “চোপ বেয়াদব, ফের মিছে কথা হচ্ছে! বুড়িমাকে তুই চিনতিস? তুই তো ঢুকেছিলি চুরি করতে!”

অন্য গলাটিতে বিনয় ঝরে পড়ল, “নেই মালিক চোরি ওরিহামার কাম নেই। আমি তো মুলকমে চাষবাস করে খাই।”

“চোর যদি না হোস তবে ওই সিদটা কেটেছে কে?”

কই চোর টোরের কাম হোবে হজৌর। শিয়াল ভি হেতে পারে। হামি উসব কাজ জানি না মালিক।”

“না তুমি ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানো না তা বুঝেছি। কিন্তু তোর হাতে যে মাটির দাগ লেগে আছে, পায়ের কাছে যে সিঁকাটি পড়ে আছে এগুলো কোত্থেকে এল?”

“উরে বাপ! এটা কি সিকাটুয়া আছে নাকি বাবু? এইরকম চিজ তো হামি কখুন দেখি নাই! হুজুর মালুম হয়েছে কি কোনই চোর চোট্টা-বদমাশ জরুর ঘুসিয়ে কোথা ছিপকে বৈসে আছে। টুড়লে উসকো মিলে যাবে।”

“হ্যাঁ, তুমি বড় সাধুপুরুষ। এখন বল তোকে যদি মেরে পুঁতে ফেলি তাহলে কেমন হয়?”

“খুব খারাপ হোবে মালিক, হামি ভালা আদমি আছে।”

“তুই ওই সি দিয়ে ঢুকেছিস। নইলে তোর গায়ে অত কাদামাটি লেগে আছে কেন?”

“ওই বাত ঠিক আছে মালিক। বহোত দিন বাদ ইদিকে আসলাম তো ভাবলাম কি বুড়িমার সঙ্গে একটু মুলাকাত করে যাই। দরওয়াজা বন্ধ দেখে বুড়ি মা বুড়ি-মা বোলকে চিল্লমিল্লি কোরে দেখলাম কোই আওয়াজ নেই। তখুন কোঠিকে পিছে এসে দেখলাম ই গোর্তটা আছে। তখুন ভাবলাম কি বুড়িমার জরুর কোই তকলিফ হোচ্ছে। উস লিয়ে গোর্তোর ভেতর দিয়ে ঢুকে আসলাম।”

মোটা গলার লোকটা হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হেসে বলল, “বটে! তোর মনটা দেখছি ভারি নরম। এখন বল তো, বুড়িমাকে তুই চিনতিস?”

“হাঁ হাঁ, জরুর। বুড়ি মা বহুৎ ভাল আদমি ছিলেন।”

“তোর সঙ্গে কী করে আলাপ হল?”

“আমি বুড়িমার কাজ-কাম কুছ কোরে দিতাম। লাকড়ি কেটে দিতাম, পানি তুলে দিতাম, বাতচিত ভি হোতো।”

“কী বাতচিত হত?”

“কোই খাস বাত নেই, বুড়ি মা পুছ করতেন, বেটা রামপ্রসাদ, তোহার মতো আইসা আচ্ছা লেড়কার ইতনা মুসিববত কাছে? আশমানে ভগবান যদি থাকেন তো তেরা ভি একদিন ডাল গলেগা। হা হা, কুছু হোবে তোর রামপ্রসাদ। এই বুড়িমার আশীর্বাদ তোহার ভালা হি কোরবে।”

“বটে! বুড়ি মা তোকে আশীর্বাদ করত! আর তার জন্যই তুই বুড়িমার ঘরে সিঁদ কাটলি?”

“ছিঃ ছিঃ হুজুর, সিঁদ তো আর কোই কাটিয়েছে, হামি তো শুধু ঘুসেছি।”

“কেন ঘুসেছিস সত্যি করে বল। নইলে এই যে ভোজালি দেখছিস এটা তোর পেটে ঢুকে যাবে।”

“রাম রাম বাবুজি, উসব ভোজালি-উজালি খুব খারাপ জিনিস আছে। রামপ্রসাদ ছোটামোটা আদমি আছে, ছুছুন্দর মারিয়ে হাতমে গোন্ধো কাহে করবেন?”

“হাত গন্ধ করতে আমার আপত্তি নেই। এখন খোলসা করে বল তো, কী খুঁজতে এখানে ঢুকেছিলি?”

“হনুমানজিকি কিরিয়া হুজুর, মতলব কুছু খারাপ ছিল না। বুড়িমার আশীর্বাদ লিব বলে একবার এসেছি। কাম কাজ কুছু খারাপ যাচ্ছে।”

“চোপ ব্যাটা! ফের মিথ্যে কথা!”

পটাং করে একটা থাপ্পড়ের শব্দ শুনে বাইরে রামহরি চমকে উঠলেন, থাপ্পড়টার যেন বাজের মতোই আওয়াজ হল।

“মর গয়া বাপ রে!”

“এবার বল ব্যাটা। নইলে–”

“আচ্ছা, আচ্ছা, বলছি মালিক, ইতনা জোর বাপটা নেই খায়া হুজুর।”

“এবার বলবি? না ফের একটা বসাতে হবে?”

“নেহি হুজুর, আউর নেহি, আমি ঘুসেছিলাম একটা জিনিস একটু ছুঁড়তে।”

“কী জিনিস?”

“কোই খাস জিনিস না আছে বাবুজি। একটা বাক্স।”

“বাক্স! তাতে কী আছে?”

“সে হামি জানি না। তবে বাক্সটা বুড়ি মা চোরাই করিয়ে লিয়ে এসেছিলেন।”

“চুরি করে? কে বলল তোকে?”

“যৌন চুরি করিয়েছিল উসি আদমি বোলা মালিক।”

“সে কে?”

“নাম বললে আপনি চিনবেন?”

“বলেই দ্যাখ না।”

“একটার নাম ছিল ফটিক আর দুসরার নাম ছিল ফিচকে।“

“ফটিক আর ফিচকে? কই এরকম নামে তো কাউকে চিনি না।”

“দেখে চিনবেন মালিক, দোনো চোর ছিল।”

“মিছে কথা বলছিস না তো?”

“সীতা মায়িকি কিরিয়া, মালিক, ঝুট কিউ বোলবে?”

“বাক্সে কী ছিল?”

“কিসকো মালুম? কোই খাস চিজ হোতে পারে। ওই দেখনেকে নিয়ে এসেছিলাম তো এসে দেখি আপনি ঘোরের মধ্যে বসিয়ে আছেন। রাম রাম বাবুজি, হামি তাহলে এখুন আসি?”

ফের সেই হাঃ হাঃ অট্টহাসি। তারপর গর্জন আমাকে “বোকা ঠাওয়ালি নাকি রে রামপ্রসাদ? এত সহজে ছাড়া পাবি ভেবেছিস? আগে কথা ওগরা, ওই বাক্সে কী ছিল বল, নইলে-”

“হাঁ হাঁ পরেসান কেন হোবেন হুজুর? ফিন ঝাঁপটা মারলে আমি তো মরিয়ে যাবে।”

“তাহলে ভালয় ভালয় বলে ফ্যাল।”

“হুঁজুর কসুর মাফ করিয়ে দিবেন, ফটিক হামাকে বলেছিল কি বাক্সের মধ্যে কুছ তামাকা পয়সা আর কড়ি ছিল। কুছ খাস চিজ নেহি। বুড়ি মা উন দো চোরকো দোশো রুপিয়া বকশিশ দিয়েছিল। স্রিফ. কড়ি আর পয়সাকা লিয়ে বুড়ি মা কেন দো শো রুপে বকশিশ দিয়েছিল ওহি পুছনেকে লিয়ে হামি এসেছিলাম।”

“সেটা তো আমারও জানা দরকার। সাতটা পয়সা আর সাতটা কড়ির জন্য সরলা পিসি এত উতলা হয়েছিল কেন। তুই কিছু জানিস না?”

“নাহি মালিক, রামপ্রসাদ বুরবাক আদমি আছে।”

“কেমন বুরবাক তা বুঝতেই পারছি। তা বাক্সটা সরাল কে তা জানিস?”

“নেহি মালিক, আমি তো মুলুকে চালিয়ে গিয়েছিলাম।”

“চোর দুটো কোথায় থাকে জানিস?”

“নেহি হুজুর।”

“তোর সঙ্গে দোস্তি ছিল?”

“জাদা দোস্তি ছিল না, থোড়া সে জান-পহছান ছিল।”

“কত দিন আগে?”

“চার-পাঁচ বরস হবে, গুস্তাকি মাফ করবেন বাবুজি, বাক্সটা কুথায়?”

“কোথায় তা জানলে কি আর বসে আছিরে ব্যাটা? তন্নতন্ন করে খুঁজে কোথাও পাইনি। যে সরিয়েছে তাকে হাতের কাছে পেলে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা করতাম।”

“হজুর একটা বাত বলব?”

“বল।”

“রাত হোয়ে আসছে। আধিয়ারি মে হামি কুছু ভাল দেখতে পাই না। আমাকে আভি ছোড়িয়ে দিন। বরখা ভি হোচ্ছে। ভুখ ভি লাগা হ্যাঁয়।”

“বটে! পালাতে চাস? দাঁড়া, আমার একটা স্যাঙাৎ এখনই এসে পড়বে। সে এলে তোর বিচার হবে। তারপর ভেবে দেখব তোকে ছাড়া যায় কি না।”

.

১৪.

রামহরি একটু ভ্রূ কুঁচকে ভাবলেন, সরলা পিসির বন্ধ ঘরে যে নাটকটা হচ্ছে তার কুশীলবকে একটু স্বচক্ষে না দেখলে তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। কিন্তু হট করে ঢুকবার পথ নেই। আর ঢুকলেও যে বিপদ হবে না তা কে বলতে পারে?

ঠিক এই সময়ে রামহরির হঠাৎ মনে হল, তাঁর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, একবার ঘাড় ঘোরালেন রামহরি, কিন্তু ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে কিছু ঠাহর হল না। বৃষ্টির তোড় আর বাতাসের জোর দুই-ই বাড়ছে। রামহরি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, দু-একবার বিদ্যুৎ চমকাল বটে, কিন্তু সে আলোতে কাউকে দেখা গেল না।

রামহরি ভাবলেন, মনের ভুলই হবে। এই দুর্যোগে কে এসে তাঁর পেছনে লাগবে? তবে এখানে আর কালক্ষেপ করা যে যুক্তিযুক্ত হবে না সেটা বুঝতে পারলেন রামহরি। সুতরাং ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেই তিনি দাওয়া থেকে নেমে পড়লেন, তারপর বয়স অনুপাতে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যত জোরে ছোটা যায় তো জোরেই ছুটতে লাগলেন। কিন্তু সম্মুখে এত ঘুটঘুটি অন্ধকার যে, দৌড় কেন হাঁটাও খুব কঠিন, রামহরি প্রথমে একটা বাগানের বেড়া ভেঙে হুড়মুড় করে পড়লেন, তাতে “চোর, চোর” বলে কেউ চেঁচিয়ে ওঠায় ভয় খেয়ে রামহরি আর এক দফা ছুটতে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেজায় ধাক্কা খেয়ে ধরণীতলে জলকাদায় পপাত হলেন, এবং ফের উঠে দিগভ্রান্ত হয়ে কোথায় যে যাচ্ছেন তা বুঝতে না পেরে হাঁটতে লাগলেন।

একবার তাঁর মনে হল পথ ভুলে গাঁয়ে ঢোকার বদলে গাঁয়ের বাইরেই চলে এলেন নাকি? এখন চেপে বৃষ্টি হচ্ছে, বিদ্যুতের চমকানি নেই বলে রাস্তাঘাট কিন্তু ঠাহর করার উপায় দেখছেন না। এ অবস্থায় হাঁটা অতীব বিপজ্জনক। কোন খানাখন্দ পুকুরে-ডোবায় পড়েন তার ঠিক কী?

রামহরি সুতরাংএকটা গাছ ঠাহর করে তার নিচে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছোটোছুটিতে যথেষ্ট ধকলও গেছে। একটু জিরোনোও দরকার। সরলাপিসির বাড়িতে কারা ঢুকে বসে আছে সে কথাটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সার কথাও ভুলতে পারছেন না।

ঝড়বৃষ্টি এবং ঘুটঘুট্টি অন্ধকারের ভেতরে হঠাৎ রামহরি একটা ক্ষীণ আলোর রেশ দেখতে পেলেন। সামনে, পঞ্চাশ-ষাট গজ দুরে যেন একটা লণ্ঠনের আলো দেখা যাচ্ছে। মনে হল, কোনও বাড়ি থেকেই আলোটা আসছে, যার বাড়ি হোক আশ্রয় তো আপাতত জুটবে, গাঁয়ের সব লোকই তো চেনা।

রামহরি গুটিগুটি আলোটার দিকে এগোতে লাগলেন, যত এগোচ্ছেন আলোটা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, গাছপালার মধ্যে বাড়ির মতো কিছু একটার আকার দেখা যাচ্ছে। রামহরি জয়দুর্গা’ বলে এগিয়ে একেবারে বাড়ির দাওয়ায় উঠে পড়লেন, পাকা দালান, সামনেই একটা ঘরের কাঁচের শার্শি দিয়ে লণ্ঠনের জোরালো বাতি দেখা যাচ্ছে। চিনতে আর ভুল হল না রামহরির, কাঁচের শার্শিওলা বাড়ি হরিপুরে একটাই আছে। এ হল সুজন বোসের বাড়ি।

সুজন বোসের বাড়িতে সর্বদা গরম কফি পাওয়া যায়। মানুষটি পণ্ডিতও বটে, কথা কয়ে যেন আরাম, গা পুঁছে একটু জিরিয়ে বৃষ্টির তোড়টা কমলে বাড়ি যাওয়া যাবে।

দরজার কড়া নেড়ে রামহরি হাঁক মারলেন, “সুজনবাবু আছেন নাকি? ও সুজনবাবু–”

কেউ সাড়া দিল না। রামহরি আরও বারকয়েক হাঁকডাক করলেন, আশ্চর্যের ব্যাপার! ভেতরে আলো জ্বলছে। তালাও দরজায় দেওয়া নেই, তবে লোকটা কি বাথরুম-টাথরুমে গোছে? রামহরি জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেন, জানালায় একটা হাফ পরদা টানা থাকায় কিছুই দেখতে পেলেন না প্রথমে। কিন্তু পরদার ডানদিকে নিচের কোনাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। দেখে সেখানে চোখ পেতে রামহরি আপনমনেই বলে উঠলেন, সর্বনাশ!

যা দেখলেন তা হল পায়জামা-পরা দুখানা পা মোঝতে সটান হয়ে আছে। এক পায়ে চটি, অন্য পা খালি, এর মানে সুজন হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে গেছে, যেমনটা স্ট্রোক হলে হয় নইলে অন্য কিছু…

রামহরি আতঙ্কিত হলেও তিনি কবিরাজ মানুষ, লোকের রোগ ভোগ, বিপদ দেখলে পালানো তাঁর ধর্ম নয়, তিনি দরজায় ফের ধাক্কা দিলেন, তারপর ওপর দিকটা হাতড়ে দেখলেন, বাইরে থেকে শেকল তোলা আছে। শেকলটা খুলতেই বাতাসের ধাক্কায় দরজার দুটো পাল্লা ধড়াস করে খুলে গেল।

ঘুরে ঢুকেই আগে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি দিলেন রামহরি। তারপর দেখলেন ঘরটার অবস্থা লণ্ডভণ্ড। স্টিলের আলমারিটা হাঁ করে খোলা। সুজন মেঝেতে সটান হয়ে শুয়ে আছেন উপুড় হয়ে।

হাঁটু গেড়ে বসে আগে নাড়ীটা পরীক্ষা করলেন রামহরি, নাড়ী আছে, প্রাণে বেঁচে আছে লোকটা। ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে রামহরি সুজনের মাথার পেছনে ক্ষতস্থানটা আবিষ্কার করলেন। লাঠি বা ওরকম কিছু নয়, নরম ভারী জিনিস দিয়ে সুজনকে মারা হয়েছে মাথায়। তার ফলে জায়গাটা ফুলে কালশিটের মতো পড়লেও রক্তক্ষরণ তেমন হয়নি, রবারের হোস দিয়ে মারলে এরকম হতে পারে।

মুখে-চোখে একটু জল ছিটিয়ে দিলেন রামহরি, তারপর হাত-পা ভাঁজ করে কিছু প্রক্রিয়া চেষ্টা করলেন, মিনিট দশেকের চেষ্টায় সুজন চোখ মেলে চাইলেন, খুব ভ্যাবলা চোখ। যেন কিছুই চিনতে পারছেন না।

আরও মিনিটদশেক বাদে সুজন উঠে চেয়ারে বসতে পরলেন, মুখে কথাও ফুটল।

“ওঃ, মাথাটা ছিঁড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়!”

“কে মারল আপনাকে?” সুজন মাথা নেড়ে বললেন, “জানি না, মুখ ঢাকা দুটো লোক।”

“কখন হল?”

“সন্ধের পর। ঘরে বসে কাজ করছিলাম, কে যেন দরজায় কড়া নাড়ল, উঠে দরজা খুলতেই দুই মূর্তি ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল!”

“তারপর?”

“পিস্তল বার করার চেষ্টা করেছিলাম, পারলাম না, তার আগেই পেছন থেকে মাথায় এমন মারল, তারপর আর কিছু মনে নেই।”

“আপনার ঘরে ঢুকে ওরা তো লুটপাট করে নিয়ে গেছে বলেই মনে হবেই, নাঃ, এ-গাঁ ক্রমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে দেখছি।”

সুজন মাথাটা দুহাতে চেপে বসে ছিলেন, হঠাৎ মুখ তুলে আলমারিটার দিকে চেয়ে বললেন, “সর্বনাশ!”

বলেই তাড়াতাড়ি উঠে এসে আলমারিটার ভেতরে কী যেন আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখলেন, তারপর বললেন, “নাঃ, নিয়েই গেছে!”

“কী নিয়ে গেছে সুজনবাবু?”

“ওঃ সে একটা সোনার গয়না।”

“কীরকম গয়না?”

“ঠিক গয়ন্না নয়। একটা সোনার ঘড়ি। দামি জিনিস।”

কথাটা যেন একটু কেমন ভাবে বলা। রামহরি একটু সন্দিহান হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।

সুজন বললেন, “আমার ঘরে দামি জিনিস বা টাকা-পয়সা তেমন কিছু থাকে না। সবই যেত।”

রামহরি চিন্তিতভাবে বললেন, “সোনার ঘড়িটাই বা কম কিসের? কত ভরি সোনা ছিল ওতে?”

“দু-তিন ভরি হবে বোধ হয় ওজন করিনি।”

“কী ঘড়ি?”

“রোলেক্স।”

“টেবিলের ওপর এই যে ঘড়িটা দেখছি এটাও তো রোলেক্স বলেই মনে হচ্ছে। এটা নয় তো!”

সুজন যেন একটু তটস্থ হয়ে বললেন, “না ওটা তো আমি হাতে পরি। এটা ছিল তোলা ঘড়ি।”

“ওষুধপত্র ঘরে কিছু আছে? ক্ষতস্থানে একটু বরফ দিলে হত।”

“বরফ কোথায় পাব? তবে আমার কাছে কিছু ওষুধ থাকে। চিন্তা করবেন না, সামলে নেব, আপনি এসে না পড়লে কী যে হত।”

রামহরি বললেন, “আমি না এলেও তেমন কিছু হত না। একটু বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকতে হত আর কি।”

সুজন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমার একটা কথা রাখবেন রামহরি বাবু?”

“বলুন।”

“এ ঘটনাটার কথা কাউকে জানাবেন না।”

“কেন বলুন তো? এত বড় ঘটনা চেপে যাবো?”

চাপতে হবে না। দুদিন সময় চাইছি। আমি নিজে একটু তদন্ত করতে চাই। তারপর বলবেন।

.

১৫.

ঝড়-জলের রাত বলে তো আর ঘরে শুয়ে নাক ডাকলে জগার চলবে না। জগা তাই নিশুত রাতে শহিদলালের দক্ষিণের ঘরের একখানা কমজোরি জানালার পুরো কাঠামটাই খুলে ফেলল, ঝড়-জলের রাত বলে দুটো সুবিধে, আজ রাত-পাহারার লোকেরা কেউ বোরোয়নি, আর দুনম্বর সুবিধে হল, একটু-আধটু শব্দ হলেও কেউ শুনতে পাবে না।

বৃষ্টিটা বেশ চেপেই পড়ছে হাওয়াটাও বেশ তেজালোই, শহিদলালের জামাই এসেছে শহর থেকে। বেশ ফাঁপালো জামাই, তামাক বেচে কাঁচা পয়সা। পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম এঁটে কাল বিকেলেও টহল দিচ্ছিল, চার আঙুলে আংটি, বুকপকেটে সর্বদা দু-পাঁচটা একশো টাকার নোট।

জগা বাঁশবনের দিকটা একটু চেয়ে দেখল। কাজ সেরে এই পথেই সটকে পড়া যাবে।

অন্ধকার ঘরে ঢোকা নানা কারণেই একটু ভয়ের। তাই জগা উঁকি মেরে দেখে নিল ভেতরটা, চোখ তার খুবই ভাল, অন্ধকারেও দেখতে পেল, মশারির ভেতরে লেপমুড়ি দিয়ে মেয়ে-জামাই ঘুমোচ্ছে। জামাইয়ের স্যুটকেসখানা একটা টেবিলের ওপর রাখা, পাঞ্জাবিটা আলনায় ঝুলছে। জিনিসগুলো যেন তাকে দেখতে পেয়ে আহ্লাদে ডাকাডাকি শুরু করে দিল, এসো এসো জগাভায়া, তোমার জন্যে হ্যাঁ-পিত্যেস করে বসে আছি।

জগা জানালায় উঠে ভেতরে লাফ দিয়ে নামল, কাজটা বেশ জলের মতো সোজা বলেই মনে হচ্ছে। মেয়ে-জামাই অঘোর ঘুমে, চারদিক শুনসান, তবে জগা বেশি লোভ করবে না, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। জামাইয়ের স্যুটকেসখানা, সোনার বোতাম সমেত পাঞ্জাবি আর কাঁসার বাসান-টাসন যদি কিছু থাকে।

কাজটা বড্ড সোজা দেখে জগার একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাবও এল। তাই সে তাড়াহুড়ো না করে একটু জিরিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল টেবিলের দিকে।

ঠিক এই সময়ে কে যেন খুব চাপা স্বরে বলল, উঁহু!

জগা চমকাল এবং থমকাল, কে কথা কয়? জামাই নাকি?

দাঁড়ানো লোককে সহজেই দেখা যায়, জগা তাই টক করে উবু হয়ে বসে পড়ল। আর বসতেই লোকটার একেবারে মুখোমুখি। টেবিলের নিচে ঘাপটি পেরে জাম্বুবানের মতো বসে আছে, আর জুলজুল করে তাকে দেখছে।

জগা ভয় খেয়ে বলল, জামাই বাবাজি নাকি? ইয়ে-তা-একটু দেখা করতে এলুম আর কি? শত হলেও আপনি গাঁয়ের কুটুম, দেখা না করাটা ভারি অভদ্রতা হয়ে যাচ্ছিল।

লোকটা চাপা গলায় বলল, কৌন জামাই? আমি তো রামপ্রসাদ আছে।

জগা টক করে বুঝতে পারল, লোকটা জামাই নয়। তবে কি পুলিশ টুলিশ? একটু মাথা চুলকে সে বলল, তা সেপাইজি, কেমন আছেন? শরীর গতিক সব ভাল? বাড়িতে বালবাচ্চা সব ভাল তো!

কৌন সিপাহী হ্যাঁয় রে বুরবক? ঐ ঘরে হামি আগে ঘুসিয়েছি, মাল উল সব আমি লিব। তু আভি ভাগ।

জগা এবার জলের মতো পরিষ্কার বুঝতে পারল এ লোকটা জামাইও নয়, সেপাইও নয়। এ লোকটা আর এক চোর, আগেভাগে ঢুকে বসে আছে। বুঝতে পেরেই জগার রাগ হল, বলল, তার মানে? তুমি যেমন রামপ্রসাদ, আমিও তেমনি জগা। তুম ভি মিলিটারি হাম ভি মিলিটারি। ভাগেকা কাহে? মাল উল সরাতে আমিও জানি।

হাঁ হাঁ উ বাত তো ঠিক আছে রে জগুয়া লেকিন কুছ কানুন ভি তো আছে রে। এক ঘর মে দো চোর কভি ঘুষতা হ্যাঁয়? আশমানমে কি দোঠো চাঁদ হোয় রে পাগল, যৌন আগে ঘুসিয়েছে সেই সব লিবে।

জগার মাথাটা একটু গরম হয়েছিল, এবার আরও এক ডিগ্রি চড়ল। সে বলল, এঃ, আমাকে আইন শেখাতে এলেন! আইন আমিও কিন্তু কম জানি না। আমি এ গাঁয়ের চোর, আমার হক অনেক বেশি। তুমি তো বাইরের চোর গাঁয়ে ঢুকে অন্যায় করেছ।

তুকে কে বলল হামি বাহারের লোক আছি? তুহার উমর কতো রে বদমাশ? হামি বহৎ আগে ই গেরামে কত কাম কাজ করিয়েছি সো জানিস? জগাইবাবু নগেনবাবু জমিদারবাবু সব আমাকে চিনে, তু তো দো দিন কা ছোঁকরা।

আমি দু দিনের ছোঁকরা?

না তো কি আছিস? আভি তো তুহার হাত ভি তরুস্ত হোয়নি, ওইভাবে জানালা ভেঙে কেউ ঢোকে? এইসাব আওয়াজ কিয়া যে মালুম তুয়া চোর নেহি ডাকু গিরা।

এঃ আমাকে বিদ্যে শেখাচ্ছে! তা তুমি কী করে ঢুকলে?

হামি তুহার মতো থোড়াই আছি, আমি যখন কুনও বাড়িতে ঘুসব তো অ্যায়সা চুপচাপ ঘুসে যাবে যে কুত্তা ভি ডাকবে না।

জগা একটু দমে গেল, লোকটা হয়তো সত্যিই তার চেয়ে পাকা লোক, নামটাও তার চেনা-চেনা ঠেকছে। একটু দমে গিয়েও সে বলে ফেলল, মাপ করে দাও দাদা, ঢুকেই যখন গেছি তখন ভাইটিকে বঞ্চিত করবে কেন? আধাআধি বখরা হোক।

রামপ্রসাদ বলল, আই ব্যাপ! আধা হিস্যা? তু তো খুনিয়া আছিস রে জুগুয়া।

কেন প্রস্তাবটা কি খারাপ?

দো-পাঁচ রুপয়া লিয়ে ভেগে যা।

এবার সত্যিই ভারি রেগে গেল জগা। বেশ হেঁকে বলল কী বললে! দো প্যাঁচ রুপেয়া! হোঃ!

রামবিলাস বেশ ঠাঙা গলাতেই বলল, তো কত লিবি? বিশ রুপেয়া হোলে খুশ তো! তাই লিয়ে যা, উখানে জামাইদাদার ম্যানিব্যাগটা পড়িয়ে আছে টেবিলের টানার মধ্যে। পঁচিশ পেয়া আছে, হামি দেখে নিয়েছি, তু বিশ রুপেয়া গিনকে লিয়ে যা।

জগা ফ্যাচ করে উঠল, আর সোনার বোতাম, হাতঘড়ি স্যুটকেস? সেগুলো সব তুমি গায়ব করবে ভেবেছো? অত সোজা নয়। আমি তাহলে চোর-চোর বলে চেঁচাব।

জগাকে চেঁচাতে হল না, তাদের কথাবার্তা বে-খেয়ালে এত উঁচু গ্রামে উঠে গিয়েছিল যে জামাইবাবাজি উঠে পড়লেন ধড়মড় করে।

কে? কে রে ঘরের মধ্যে কথা কয়? অ্যাঁ! চোর নাকি? চোর নাকি হে? এ তো ভারি আস্পদা দেখছি হরিপুরের চোরদের! আমি হলুম হারু রায়, আমার ঘরে চোর ঢোকে কোন সাহসে শুনি? জানিস শ্বশুরবাড়ির গাঁ না হয়ে আমার গাঁ মল্লিকপুরে হলে এতক্ষণে তোদের থামে বেঁধে জলবিচুটি দেওয়াতাম?

রামপ্রসাদ চাপা গলায় বলল, সত্যনাস কিয়া রে জাগুয়া! হামার নাগরা জুতিজোড়া কুথা রাখিয়েছি ইয়াদে আসছে না।

ওঃ এই তো মুরোদ, চোর নিজের জুতো খুঁজে পায় না, সে আবার আমাকে চুরি শেখাতে আসেন!

বলে গদগদ হয়ে জগা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, জামাইবাবুর কাঁচা ঘুমটা ভাঙাতে হল–বড় দুঃখের কথা।

পট করে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে মুখের ওপর পড়ল।

তুই কে?

আজ্ঞে আমরা পাড়া-পড়শির মধ্যেই পড়ি।

ঘরে ঢুকেছিস যে! হা!

মাথা নেড়ে জগা বলল, আজ্ঞে দায়ে পড়ে ঢুকেছি, বাইরে থেকে মেলা ডাকাডাকি করেছি। তা দেখলুম বাদলার রাতটিতে আপনার ঘুমটিও বেশ জমাটিই হচ্ছে। একেবারে ক্ষীরের মতো জমাট ঘুম। হওয়ারই কথা, শ্বশুরবাড়িতে ভালমন্দ পেটে পড়েছে তার ওপর লেপের ওম। ঘুমের আর দোষ কী?

জামাই হেঁকে উঠল, বাজে কথা রাখো। কী চাও?

জিব কেটে জগা বলল, আরে ছিঃ ছিঃ, চাইব কি? গরিব বটে, কিন্তু মাগুনে মানুষ নই। বুঝলেন!

বুঝলাম, তুমি মহাশয় লোক।

আজ্ঞে তা যা বলেন, তবে কিনা পাড়া-পড়শির বিপদে আপদে না এসে উপায়ই বা কী বলুন!

বিপদ! কিসের বিপদ হে?

আজ্ঞে সেই কথাটাই বলতে আসা। মাঝরাতে চেঁচামেচি শুনে বাদলা মাথায় করে ছুটে এসেছি। আমাদের শহিদখুডোর শরীরটা বড্ড খারাপ। এখন তখন অবস্থা, এই যাব কি সেই যাব, একেবারে ধড়ফড় করছেন।

বলো কী? কই কিছু টের পাইনি তো!

আজ্ঞে উঠোনের ওপাশের ঘরে মেলা লোক জড়ো হয়ে গেছে, আপনি জামাইমানুষ বলে শাশুড়িঠাকুরণ খবর দিতে লজ্জা পাচ্ছেন, তা আমি বললুম, সে কি কথা! জামাই হল আপনার জন্য। খবরটা কি তাকে না। দিয়ে পারা যায়? তা এসে দেখি আপনি বড্ড ঘুমোচ্ছেন। মেলা ডাকাডাকিতেও সাড়া পাওয়া গেল না, তাই অগত্যা জানালাটা খুলে ঢুকে পড়েছি।

জামাই ভারি ব্যস্ত হয়ে বউকে ডাকতে লাগল, ওগো, ওঠো, ওঠো, শ্বশুরমশাই যে চললেন।

অ্যাঁ! বলে শহিদলালের মেয়ে উঠে পড়ল, তারপর দুজন হুড়মুড় করে দরজা খুলে বেরিয়ে ঝড়জলেই উঠোন পেরিয়ে ছুটল।

রামপ্রসাদ জুলজুল করে চেয়েছিল জগার দিকে।

জগা তার দিকে চেয়ে বলল, এঃ, চুরি শেখাতে এয়েছেন, দিয়েছিলে তো কাজ ভণ্ডুল করে!

রামপ্রসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ঠিক আছে রে জগুয়া, তুহার আধা হিস্যা।