সরমা দেবীর শেষের কথায় মনে হল, কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি ভাবল। তারপর সহসা যেন দুপা এগিয়ে এল, চেয়ারে উপবিষ্টা সরমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি মুখে স্বীকার না করলেও আমার কিন্তু ধারণা এ বাড়ির, বিশেষ করে বিমলবাবু ও তার ভাইঝির কোন কথাই আপনার অজানা নয়।
চোখ তুলে তাকাল নিঃশব্দে সরমা কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, কারণ আপনার সম্পর্কে যেটুকু ইতিপূর্বে শকুন্তলা দেবীর কাছ থেকে জেনেছি, তাতে করে আমার অনুমান আপনি অনেক কিছুই জানেন।
দেখলাম নিঃশব্দে তখনো সরমা তাকিয়ে রয়েছে কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ, কিরীটী আবার বললে, আপনি হয়তো সব কথা বলতে ইচ্ছুক নন, অবশ্যই আপনি স্বেচ্ছায় না বললে আমি পীড়াপীড়ি করব না, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম—
দেখছি ঠিক পূর্বের মতই তাকিয়ে আছে সরমা কিরীটীর মুখের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে, নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে।
ভেবেছিলাম বিমলবাবুর নৃশংস হত্যার তদন্তের ব্যাপারে অন্ততঃ আপনার অকপট সাহায্যই পাব!
ধীরে ধীরে সরমা এতক্ষণে কথা বলল আবার, আমি যা জানি সবই বলেছি।
কিরীটী মৃদু হাসল। তারপর পূর্ববৎ শান্তকণ্ঠে বলল, ঠিক আছে। আচ্ছা সরমা দেবী, দুষ্মন্তবাবুর মত পাত্রকে বাদ দিয়ে বিমলবাবু হঠাৎ প্রৌঢ় রাঘব সরকারের সঙ্গে শকুন্তলা দেবীর বিবাহ দেবেন স্থির করলেন কেন বলুন তো? কিছু অনুমান করতে পারেন?
না, অনুমান করতে পারি না কিন্তু কার কাছে শুনলেন এ-কথা?
শকুন্তলা দেবীর মুখে। কিরীটী বলে।
সে বলেছে আপনাকে এ কথা?
হ্যাঁ।
তা হলে সে নিশ্চয় একথা বলেছে, কেন তিনি ঐ কাজ করতে মনস্থ করেছিলেন!
না, সে-কথা তিনি স্পষ্ট করে কিছুই বলেন নি। কেবল বলেছেন, বিমলবাবু তাই স্থির করেছিলেন–
তা তো ঠিকই, তার ভাইঝি—ভাইঝির বিবাহ তিনি কার সঙ্গে দেবেন বা না-দেবেন সেটা সম্পূর্ণ তার ইচ্ছা–
কিন্তু আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম, কেন তার অমন ইচ্ছাটা হল সে-সম্পর্কে কিছু আপনি জানেন কিনা?
ব্যাপারটা অনেকদিন আগে থাকতেই স্থির হয়েছিল শুনেছি—
কতদিন আগে?
বলতে পারব না।
আচ্ছা আপনার মত আছে এ বিবাহে?
আমার মতামতের কতটুকু মূল্য থাকতে পারে বলুন? কেউ তো নই আমি এদের!
তবু তো শুনেছি, আপনি শকুন্তলা দেবীকে একপ্রকার কন্যার মতই পালন করেছেন।
তা করেছি।
তবে?
কিন্তু তাই যদি বলেন তো পাত্র হিসাবে রাঘব সরকার নিন্দনীয়ই বা কি?
সে-কথা আমি বলি নি।, আমি বলছিলাম ওরা যখন পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট—
ক্ষমা করবেন, আমি এর বেশী কিছু জানি না।
ওঃ। আচ্ছা সরমা দেবী, এই রঞ্জন বোসকে আপনার কেমন মনে হয়?
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটু চমক লক্ষ্য করলাম সরমার চোখেমুখে। কিন্তু সেও ক্ষণিকের জন্য।
পরমুহূর্তে সে যেমন শান্ত ছিল শান্ত হয়ে গেল।
আমার কথার জবাবটা এখনো পাই নি সরমা দেবী!
ওর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না।
তবু যে কয়দিন ওকে দেখেছেন—
ও কারো সঙ্গেই বড় একটা কথা বলে না বা মেলামেশা করে না—
আপনিও কি সেই দলে?
অন্য রকম আমার বেলায় হবার কোন কারণ নেই।
ওকে আপনি পূর্বে কখনো দেখেছেন?
না–না।
আচ্ছা সরমা দেবী, আপনি এবারে যেতে পারেন।
চেয়ার থেকে উঠে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল সরমা।
সরমা ঘর ছেড়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা ঘরের মধ্যে থমথম করতে থাকে।
কয়েকটা মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলে না।
অবশেষে কিরীটীই সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে একসময় উঠে দাঁড়িয়ে বললে, এবারে আমি বিদায় নেব শিবেনবাবু!
হ্যাঁ চলুন, আমরাও উঠব।
কেবল একটা কথা শিবেনবাবু—
কি?
ঐ ঘরটা অর্থাৎ যে ঘরে বিমলবাবু নিহত হয়েছেন, তালা দিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করবেন। কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না কিরীটী, আমার দিকে তাকিয়ে বলে, চল্ সুব্রত।
দুজনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলায় আসতেই দেখা গেল সিঁড়ির ঠিক সামনেই রেলিং ধরে পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে শকুন্তলা।
শকুন্তলাকে সামনে দেখে কিরীটী দাঁড়াল, কিছু বলবেন মিস চৌধুরী?
মিঃ রায়! শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল।
বলুন?
আপনি—মানে সত্যিই আপনার স্থির বিশ্বাস—
কি?
কাকা–কাকাকে সত্যিই কেউ হত্যা করেছে?
মনে হল কথাটা বলতে গিয়ে শকুন্তলার গলাটা যেন কেঁপে উঠল।
হ্যাঁ, সত্যি তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তবু কিন্তু শকুন্তলা পথ ছাড়ে না।
কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে, আর কিছু বলবেন?
আপনি—আপনি কাউকে সন্দেহ করেছেন?
কিরীটী মুহূর্তকাল মনে হল যেন কি ভাবল, তারপর মৃদুকণ্ঠে বললে, আপনার ঐ প্রশ্নের জবাবে বর্তমানে কেবল এইটুকুই বলতে পারি মিস চৌধুরী, কোন অজ্ঞাত বা অপরিচিত ব্যক্তির হাতে তিনি নিহত হন নি!
তবে? যেন একটা অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে এল শকুন্তলার কণ্ঠ চিড়ে।
যে তাকে হত্যা করেছে, সে তার অত্যন্ত পরিচিত কেউ। তাই—
তাই?
তাই শেষ মুহূর্তে ব্যাপারটা তার কাছে যেমন আকস্মিক তেমনি অভাবিতই ছিল হয়তো!
কি বলতে চান আপনি?
হত্যাকারী যখন তাকে হত্যা করবার জন্য সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি পরমুহূর্তেই ব্যাপারটা কি ঘটতে চলেছে! ইট ওয়াজ সো সাডেন! কিন্তু মিস চৌধুরী–
কি?
আপনি বোধ হয় একটু সতর্ক থাকলে ব্যাপারটা ঘটত না!
কি বললেন?
বলছিলাম ইউ অ্যাপ্রিহেণ্ডেড ইট—আপনি পূর্বেই ঐ ধরনের একটা কিছু যে ঘটবে বা ঘটতে পারে অনুমান করেছিলেন–
না বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমি—
হ্যাঁ, আপনি সেটা অনুমান করতে পেরেছিলেন বলেই কাল আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন!
না না—আমি—
কিন্তু কেন যে কাল সব কথা বললেন না শেষ পর্যন্ত তা আপনিই জানেন। বললে হয়ত আজকের এই দুর্ঘটনাটা না ঘটতেও পারত।
আপনি—আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, যা আপনি বলছেন তার বিন্দুবিসর্গও আমি—
মিস চৌধুরী, বিয়ের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে যে কাল আপনি আমার কাছে ছুটে যান নি সে বিষয়ে আমি স্থিরনিশ্চিন্ত। কিন্তু কেন জানেন, মাত্র একটি কারণে—
একটি কারণে!
হ্যাঁ, একটি কারণে। আপনার আঙুলের ঐ আংটিটিই—
আংটি!
হ্যাঁ, আংটিটিই কাল আমাকে বলে দিয়েছিল আমার কাছে ছুটে যাবার যে কারণ আপনি দেখিয়েছেন তা মিথ্যা!
মিঃ রায়!
কিন্তু আর নয়, এদিকে রাত প্রায় শেষ হয়ে এল। যদি সত্যিই কিছু আপনার বলবার থাকে তো কাল বিকেলের দিকে আমার বাড়িতে আসতে পারেন। আচ্ছা আসি নমস্কার—চলো সুব্রত।
কিরীটী কথাটা শেষ করেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
.
১২.
পরের দিন দ্বিপ্রহরে কিরীটীর বাড়িতে বসে আমি, কিরীটী ও শিবেন সোম তিনজনে মিলে বিমলবাবুর হত্যার ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করছিলাম।
শিবেন সোম এসেছেন প্রায় ঘণ্টাখানেক হবে।
দ্বিপ্রহরের কিছু আগে হঠাৎ যেন কিছুটা হন্তদন্ত হয়েই শিবেন সোম এসে হাজির।
কিরীটী অত্যন্ত শিথিল ভঙ্গীতে বসে এক প্যাকেট তাস নিয়ে পেসেন্স খেলছিল একা একা।
আর আমি একটা রহস্য উপন্যাসের পাতায় ড়ুবেছিলাম।
হন্তদন্ত হয়ে শিবেন সোমকে ঘরে ঢুকতে দেখে দুজনেই আমরা মুখ তুলে তাকালাম। একই সঙ্গে যুগপৎ।
কি ব্যাপার, অত হাঁপাচ্ছেন কেন? কিরীটী শুধায়।
না, হাঁপাই নিসোফাটার উপর বসতে বসতে শিবেন সোম কথাটা বললেন।
নতুন কোন সংবাদ আছে বুঝতে পারছি, কিন্তু কি বলুন তো? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
যে তালাটা গতকাল বিমলবাবুর শোবার ঘরের দরজায় লাগিয়ে এসেছিলাম—
শিবেন সোমের কথাটা শেষ হয় না, হাতের তাসগুলো সাফল করতে করতে একান্ত যেন নির্বিকার কণ্ঠেই কিরীটী জবাব দেয়, তালাটা খোলা—এই তো!
শুধু খোলাই নয় মিঃ রায়, তালাটা ভাঙা!
ও একই কথা হল।
আমি অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে তালাটার গা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেবার ব্যবস্থা করে এসেছি—
বেশ করেছেন। তবে পণ্ডশ্রমই করেছেন–
পণ্ডশ্রম মানে?
মানে আর কি, সকলের আঙুলের ছাপই হয়তো তাতে পাবেন ঐ বাড়ির একমাত্র খুনীটির বাদ দিয়ে–
কিন্তু–
শিবেনবাবু, একটা কথা আপনার জানা দরকার বলেই বলছি—খুনী অসাধারণ চালাক, শুধু তাই নয়, প্রতিটি স্টেপ তার সুচিন্তিত। এভরিথিং ওয়েলপ্ল্যান্ড্র–পূর্বপরিকল্পিত!
আপনি—আপনি কি তবে–
না শিবেনবাবু, হত্যাকারীর নাগাল এখনো আমি পাই নি। যতই আপনারা কিছু তথাকথিত অতিবোদ্ধা কিন্তু আসলে বঞ্চিত ও উন্নাসিকের দল আমাকে অদ্ভুত করিৎকর্মা বলে নিছক হিংসার জ্বালায় গাল পাড়ন না কেন, কিরীটী রায়ও মানুষ, দোষত্রুটি তারও আছে হয়তো অজ্ঞতা হেতু মধ্যে মধ্যে কথা বলতে গিয়ে দু-চারটে ভুল ইংরাজী শব্দেরও প্রয়োগ করতে পারে, কিন্তু তার মস্তিষ্কে সত্যিই কিছু না থাকলে যে এতদিন টিকতে না কথাটা—সত্যিই অত্যুক্তি নয়। যাক গে সেকথা, কাল থেকে একটা কথা ভাবছি–
কি বলুন তো?
আমাদের রঞ্জনবাবুর অতীত সম্পর্কে ইন-ডিটেইলস যতটা সম্ভব খবরটা আপনাদের ডিপার্টমেন্টের থু দিয়ে একটু সংগ্রহ করবার চেষ্টা করতে পারেন?
কেন পারব না! আজই বড়সাহেবকে বলে মালয়ে সংবাদ পাঠাবার চেষ্টা করছি সেখানকার পুলিস ডিপার্টমেন্টে–
হ্যাঁ, তাই করুন। আর—
আর?
রাঘব সরকার সম্পর্কেও একটু খোঁজখবর করুন।
তাও করব। কিন্তু আমি বলছিলাম, ঐ তালা ভাঙার ব্যাপারটা—
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তালা ভাঙার ব্যাপারটা দেখছি আপনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন শিবেনবাবু!
না, আমি বলছিলাম হয়তো খুনীই—
কোন বিশেষ কারণে আবার তালা ভেঙে ঐ ঘরে ঢুকেছিল—এই কি?
হ্যাঁ, মানে–
অনুমানটা আপনার মিথ্যা নয় শিবেনবাবু। খুব সম্ভবত তাই। কিন্তু বিমলবাবুর হত্যারহস্যের কিনারা করতে হলে আপাততঃ আপনাকে যে অন্য দিকেও আর একটা দৃষ্টি দিতে হবে!
অন্য দিকে?
হ্যাঁ। বর্তমানে রহস্য-কাহিনীর নায়ক-নায়িকা–বলছিলাম তরুণ নায়ক ও তরুণী নায়িকা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার উপরে–
সে কি!
ভুলে যাচ্ছেন কেন, ওদের বয়সটাই যে বিশ্রী—তার উপরে রয়েছে একজনের প্রতি অন্যের আকর্ষণ, জানেন তো আকর্ষণেরই উল্টো দিক হচ্ছে বিকর্ষণ!
মিঃ রায়, আমি ঠিক আপনার কথাটা বুঝতে পারছি না—
সে কি মশাই! প্রথম যৌবনে কোন মেয়ের প্রেমে পড়েন নি নাকি?
কিরীটীর ঐ ধরনের আচমকা স্পষ্ট কথায় সহসা শিবেন সোমের মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। মুখটা উনি নীচু করেন।
কিরীটী হেসে ওঠে।
জংলী ট্রেতে করে চা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
চা-পান করতে করতেই কিরীটী বললে, ভাল কথা শিবেনবাবু, পোস্টমর্টেম হয়ে গেল?
ডাঃ রুদ্রকে বলেছি আজই যাতে পোস্টমর্টেমটা করে ফেলেন–
হ্যাঁ, ডাঃ রুদ্রের রিপোর্টটা না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের ধারণাটা যে মিথ্যা নয় সেটা প্রমাণ করা যাবে না।
কাল-পরশুর মধ্যেই আশা করছি পেয়ে যাব। আচ্ছা মিঃ রায়—
শিবেন সোমের ডাকে তার দিকে মুখ তুলে তাকাল কিরীটী, কিছু বলছিলেন?
আমার কিন্তু ঐ রাঘব সরকার লোকটাকেই বেশী সন্দেহ হচ্ছে!
শুধু একা রাঘব সরকার কেন, সন্দেহ তো সে রাত্রে যারা যারা অকুস্থানে ঐ সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের উপরেই হওয়া উচিত।
কিন্তু–
হ্যাঁ শিবেনবাবু, ওঁরা কেউই সন্দেহের বাইরে যেতে পারছেন না। বিশেষ করে রাঘব সরকার, দুষ্মন্ত রায়, রঞ্জনবাবু, শকুন্তলা দেবী, সরমা দেবী–
কি বলছেন আপনি? সরমা দেবী, শকুন্তলা দেবী–
ভুলে যাবেন না শিবেনবাবু, নারীর মন শুধু বিচিত্রই নয়—এমন অন্ধকার বাঁকা গলিখুঁজি ওদের মনের মধ্যে থাকে যার হদিস এ জীবনেও কোনদিন আপনি পাবেন না
কিন্তু তাদের কি এমন মোটিভ থাকতে পারে বিশেষ করে সরমা দেবী ও শকুন্তলা দেবীর বিমলবাবুকে হত্যা করবার?
মোটিভের কথাই যদি বলেন তো সে কখন কি রূপে প্রকাশ পায় বা মূলে কি থাকতে পারে, বিশেষ করে নারীমনের—সে-কথা চিন্তা করতে গেলে খেই পাবেন না! যাক সে কথা, সরল ও দ্বিধাহীন মন নিয়ে ভাববার চেষ্টা করুন—বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে লঘু রহস্যপ্রিয়তার একটা সুর যেন ধ্বনিত হয়ে ওঠে। সে আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শিবেন সোমকে সম্বোধন করে বলে, আরে বেশী দূরে যেতে হবে কেন, আপনি ঐ সুব্রতকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন না—এত বয়স হল তবু আজও যে ও কুমার কার্তিকটিই রয়ে গেল, সেও ঐ নারীমনের কোন হদিস পেল না বলেই না!
সে কি, সুব্রতবাবু—
শিবেন সোমের প্রশ্নসূচক কথাটা শেষ করল কিরীটীই। বললে, না, বেচারী আজও ওপথে পা মাড়ায় নি। কিন্তু এবারে সত্যিই গাত্রোখান করতে হবে, তালাটা যখন ভাঙা তখন। একটিবার সেখানে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন—বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, একটু অপেক্ষা করুন আমি আসছি—
.
বিমলবাবুর গৃহে যখন আমরা এসে পৌঁছলাম আসন্ন সন্ধ্যার ধূসর ছায়ায় চারদিক তখন ম্লান হয়ে এসেছে। বাড়ির দোতলায় ইতিমধ্যেই আলো জ্বলে উঠেছে, নীচের তলাটা অন্ধকার।
বারান্দার কাছাকাছি আসতেই বারান্দার ডান দিক থেকে পুরুষকণ্ঠে প্রশ্ন ভেসে এল, কে?
জবাব দিলেন শিবেন সোম, আমি শিবেন সোম।
প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসেছিলেন। আবছা আলোছায়ায় সামনের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোককে চিনতে কষ্ট হল না, মৃত বিমলবাবুর ছোটবেলার বন্ধু বিনায়ক সেন।
বিনায়ক সেন বারেকের জন্য আমাদের সকলের মুখের উপরে একবার দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ও আপনারা!
বিনায়ক সেনের গলার স্বর শুনে সেই দিকে তাকাতেই আবছা আলোছায়ার মধ্যেও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছিলাম, বিনায়ক সেনের পাশ থেকে আবছা একটা ছায়ামূর্তি যেন আমাদের সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদিককার অন্ধকারে দ্রুত মিশিয়ে গেল। এবং ব্যাপারটা যে কিরীটীরও নজরে এসেছিল বুঝতে পারলাম তার পরবর্তী প্রশ্নেই।
অন্ধকারে আপনার পাশে ওখানে আর কে ছিল মিঃ সেন?
কিরীটীর আচমকা প্রশ্নে যেন বিনায়ক সেন হঠাৎ কেমন থতমত খেয়ে যান, বলেন, আ-আমার পাশে? কই না–কেউ তো নয়!
কিন্তু মনে হল যেন—
কই না—আমি তো একাই ছিলাম!
কিন্তু অন্ধকারে একা একা ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলেন?
না, মানে—এত বড় একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল তাই একবার খোঁজখবর নিতে। এসেছিলাম। তারপরই একটু থেমে আবার বললেন বিনায়ক সেন, বুঝতেই তো পারছেন মিঃ। রায়, বিমলের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়, কেউ তাকে হত্যা করেছে ব্যাপারটা জানার পর থেকেই সকলেই এরা কেমন যেন আপসেট হয়ে পড়েছে
তা তো হবারই কথা!
হ্যাঁ, দেখুন তো কোথাও কিছু নেই হঠাৎ কোথা থেকে কি একটা দুম করে বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল!
তা তো বটেই!
বলুন তো, আমি তো মশাই সত্যি কথা বলতে কি, মাথামুণ্ডু ব্যাপারটার কিছুই এখনো বুঝতে পারছি না! হঠাৎ তাকে ঐভাবে কেউ হত্যাই বা করতে গেল কেন?
ব্যাপারটা হঠাৎ নয় বিনায়কবাবু, শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে কিরীটী কথাটা বললে।
হঠাৎ নয়?
না, আদৌ নয়। সব কিছুই পূর্বপ্রস্তুতি এবং পূর্ব-প্ল্যান বা পরিকল্পনা মত ঘটেছে।
মানে?
মানে কালই ঠিক না হলেও আজ-কাল-পরশু খুব শীঘ্রই যে কোন একদিন তিনি নিহত। হতেনই!
না না—এ আপনি কি বলছেন মিঃ রায়?
কথাটা আমি একবিন্দুও মিথ্যা বলছি না বা অত্যুক্তি করছি না মিঃ সেন। সত্যিই মৃত্যু তার পাশে এসে একেবারে দাঁড়িয়েছিল—মৃত্যুর কালো ছায়া তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল। যাক সেকথা, চলুন ওপরে যাওয়া যাক।
না না–এখন আর ওপরে যাব না আমি। আমার একটু কাজ আছে, আমি যাই—
দেখা করবেন না ওঁদের সঙ্গে?
না, থাক। অন্য সময় আসবখন। আচ্ছা চলি মিঃ রায়, নমস্কার।
কথাটা বলে আর মুহূর্তমাত্র দাঁড়ালেন না বিনায়ক সেন, বারান্দা থেকে নেমে দ্রুত সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।
.
হঠাৎ যেন মনে হল সকলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিরীটীই, শিবেনবাবু, মৃতদেহ প্রথম ডিসকভার্ড হয় কাল রাত্রে ঠিক। কটার সময় যেন?
।রাত আটটা পঁয়তাল্লিশ, মানে—
পৌনে নটা নাগাদ, না? এবং সোয়া সাতটা নাগাদ রঞ্জনবাবু এসে জানান ফোনে কেউ তাকে ডাকছে–
হ্যাঁ।
কাল দেখেছিলাম, মনে আছে মৃতদেহ পরীক্ষার সময়, তখনো রাইগার মর্টিস সেট ইন করে নি। তা হলে মনে হচ্ছে সম্ভবতঃ সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটার মধ্যে—অর্থাৎ মাঝখানের ঐ দেড় ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় হত্যা করা হয়েছে। দেড় ঘণ্টা সময়—নট এ জোক! শেষের দিকে কথাগুলো কিরীটী যেন কতকটা আত্মগতভাবেই অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললে।
ফলে শেষের কথাগুলো বোধ করি শিবেনবাবুর কর্ণগোচর হয় নি। তাই তিনি বলেন, কি বললেন মিঃ রায়?
মৃদুকণ্ঠে কিরীটী আবার বলে, র্যাদার কুঈয়ার—বেশ একটু আশ্চর্যই—
আশ্চর্য! কি আশ্চর্য মিঃ রায়?
কিছু না। চলুন ওপরে যাওয়া যাক। কিন্তু নীচের তলাটা একেবারে খালি, একজন চাকরবাকরকেও তো দেখছি না ব্যাপার কি? এ বাড়িতে চাকরবাকর কেউ নেই নাকি?
.
১৩.
কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, দপ্ করে ঐ সময় সিঁড়ির আলোটা জ্বলে উঠল। দেখা গেল একজন প্রৌঢ় এবং বেশভূষায় ও চেহারায় ভৃত্য শ্রেণীরই কোন লোক হবে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে।
লোকটার পরনে একটা আধময়লা ধুতি, গায়ে ফতুয়া। কাচায়-পাকায় মেশানো মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। ভারী পুরুষ্টু একজোড়া কাঁচা-পাকা গোঁফ ওষ্ঠের ওপরে।
লোকটি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমাদের সিঁড়ির নীচে দেখেই সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যায়, কে–কে আপনারা?
প্রশ্ন করলেন শিবেন সোম, তুমি কে? কি নাম তোমার?
এতক্ষণে বোধ হয় শিবেন সোমের পরিহিত পুলিসের ইউনিফর্মের উপরে ভাল করে নজর পড়ে লোকটার। সঙ্গে সঙ্গে সে আরো দু-ধাপ নেমে এসে সম্রমের সুরে বলে, আজ্ঞে আমার নাম রামচরণ বটে। এ বাড়িতে কাজ করি। চাকর।
রামচরণ!
আজ্ঞে—আরো দু-ধাপ নেমে এসেছে রামচরণ ততক্ষণে।
রঞ্জনবাবু, শকুন্তলা দেবী—ওঁরা বাড়িতে আছেন?
যে যাঁর নিজের ঘরেই আছেন।
শকুন্তলা দেবীকে খবর দাও, থানা থেকে শিবেনবাবু এসেছেন।
আজ্ঞে আপনি বাইরের ঘরে বোস করেন, আমি তেনাদের খবর দিচ্ছি এখুনি। চলেন—
রামচরণই নীচের বসবার ঘর খুলে আলো জ্বেলে আমাদের বসতে দিল। ছিমছাম করে। সাজানো ঘরটি, যদিচ আসবাবপত্র সামান্যই।
খবর দেবার জন্যই বোধ হয় রামচরণ ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, বাধা দিল কিরীটী, রামচরণ!
আস্তে–
কাল কই তোমাকে এ বাড়িতে তো দেখি নি! কোথায় ছিলে কাল? বাড়িতে ছিলে না নাকি?
আজ্ঞে ছিলাম।
ছিলে?
আজ্ঞে নীচেই ছিলাম। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না বাবু, এমনটা কেমন করে হল? কালই আমি দেশে চলে যাচ্ছি বাবু—কথাটা বলতে বলতে দেখলাম, দু চোখের কোল বেয়ে রামচরণের ট ট করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
কালই চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ বাবু।
আর একদণ্ডও এখানে টিকতে পারছি না।
কতদিন আছ এখানে?
দিদিমণি এ বাড়িতে আসার বছর দুই পরে–ছোট্টটি এসে দেখেছি দিদিমণিকে। সে কি আজকের কথা বাবু! জীবনটাই তো এ বাড়িতে আমার কেটে গেল। সব শেষ হয়ে গেল যখন তখন আর কেন—বলতে বলতে কাপড়ের খুঁটে প্রবহমান অশ্রুধারা মুছতে লাগল রামচরণ।
রামচরণ!
কিরীটীর ডাকে জলে-ভেজা চোখ তুলে তাকাল রামচরণ ওর মুখের দিকে।
কাল যখন বাবুরা সব এসেছিলেন তখন তুমি কোথায় ছিলে?
উপরেই তো খাটা-খাটনি করছিলাম বাবু। উপরেই ছিলাম।
তুমি বোধ হয় শুনেছ তোমার বাবুকে কেউ খুন করেছে!
শুনেছি বৈকি। তাই তো কাল থেকে ভাবছি, কে এমন কাজটা করলে?
আচ্ছা রামচরণ, কাল যখন রঞ্জনবাবু এসে তোমার কত্তাবাবুকে ফোনের খবর দেন তখন তুমি কোথায় ছিলে?
ছাদেই ছিলাম। টেবিল পরিষ্কার করছিলাম।
তার পর যখন সকলে জানল তোমার কত্তাবাবু মারা গিয়েছেন, তখন তুমি কোথায় ছিলে?
দোতলায় ঘরের সামনে বারান্দায় মা বলেছিলেন খাবারগুলো গুছিয়ে রাখতে, তাই গুছোচ্ছিলাম।
মা! মা কে?
আজ্ঞে সরমা মাকে দেখেন নি?
ও, তুমি বুঝি তাকে মা বলে ডাক?
আজ্ঞে।
তিনি তোমাকে খুব স্নেহ করেন, তাই না?
মার মত দয়া আর স্নেহ এ পৃথিবীতে আমি তো আর দেখি নি বাবু। অমন মানুষ হয়। বিধাতা যে আমার অমন মায়ের কপালে এত বড় দুঃখ কেন লিখে দিলেন তাই তো মাঝে মাঝে ভাবি–
দুঃখ!
দুঃখ নয়? শুনেছি এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু একটি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সব শেষ হয়ে গেল। তবু ভাগ্যি ভাল আমার কত্তাবাবুর এখানে ঠাঁই পেয়েছিলেন কিন্তু দেখুন না কপাল, সেটুকুও বিধাতার সইল না, এবারে যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন কে জানে!
কেন? এখানে?
এখানে! হুঁ, এখন রঞ্জনবাবু হলেন এ বাড়ির কত্তা, তিনি তাড়িয়ে দিলেন বলে। তা
ড়িয়ে দেবেন?
না তাড়িয়ে দিলেও যা কথার ঝাজ রঞ্জনবাবুর—তাছাড়া এখানে পা দেওয়া অবধি প্রথম দিন থেকেই যে কি বিষনজরে দেখেছেন রঞ্জনবাবু মাকে আমার—তাই তো মাকে বলছিলাম, চলো মা, আমার দেশে আমার কুঁড়েতেই না হয় চলল। ছেলের দু-মুঠো জুটলে তোমারও জুটবে। না হয় উপোস করেই থাকবে। আমি তো জানি এ অপমান সারাক্ষণ তোমার সইবে না।
চেয়ে ছিলাম রামচরণের মুখের দিকে, শুনছিলাম ওর কথাগুলো। কথাগুলো তো কোন পেঁয়ো চাষার চাষাড়ে কথা নয়। কেবলমাত্র তো সরল দরদই নয়, আরো কিছু যে আছে প্রতিটি কথার মধ্যে!
আচ্ছা রামচরণ?
বলেন আজ্ঞে—
বাবুকে—তোমার কত্তাবাবুকে তার ঘরে ঢুকতে তুমি কাল দেখেছিলে?
না। তবে—
তবে?
ফোন ধরবার জন্য কত্তাবাবু কখন ঘরে ঢুকেছিলেন তা জানি না—তবে তার কিছুক্ষণ পর বারান্দায় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি কাজ করছি, শুনছিলাম বাবু যেন কার সঙ্গে ঘরের মধ্যে কথা বলছেন। পরে ভেবেছি ফোনেই হয়তো কত্তাবাবু কথা বলছেন—
ঘরের মধ্যে ফোন করছেন মানে? তোমার কত্তাবাবুর ঘরে তো ফোন নেই! ফোন তো বারান্দায়! কিরীটী যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ বাবু, বারান্দাতেই ফোন থাকে, তবে কত্তাবাবুর ঘরেও প্লাগ পয়েন্ট আছে।
কাল যখন ফোন আসে তখন কোথায় ফোনটা ছিল?
কত্তাবাবুর ঘরেই কাল দুপুর থেকে ফোনটা ছিল।
বলো কি! তবে—
কি বাবু?
কাল রাত্রে আমরা যখন ঘরে গিয়ে ঢুকলাম তখন তো ফোনটা কই তোমার কত্তাবাবুর ঘরে ছিল না।
ছিল না?
না। তবে ফোনটা আবার কে বাইরে নিয়ে এল? নিশ্চয়ই কেউ এনেছে—তুমি কিছু জানো রামচরণ কে এনেছিল ফোনটা আবার বারান্দায়?
আজ্ঞে জানি না তো!
হুঁ, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এবারে দিদিমণিকে তোমার একটা খবর দাও রামচরণ। বলো গে যে আমরা এসেছি।
কিরীটী এতক্ষণ সোফায় বসেছিল এবং কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কতার মধ্যে কখন এক সময় যেন তার সিগারটা নিভে গিয়েছিল, সিগারটায় পুনঃঅগ্নিসংযোগ করে সিগারটা মুখে দিয়ে কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।
.
মিনিট দশেকের মধ্যেই শকুন্তলা এসে ঘরে প্রবেশ করল।
মিঃ রায় আপনি কতক্ষণ?
এই কিছুক্ষণ। আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, কাল রাত্রে আপনি যখন আমাকে ফোন করেন তখন ফোনটা কোথায় ছিল নিশ্চয় আপনার মনে আছে—ঘরে না বারান্দায়?
মনে আছে বৈকি, বারান্দাতেই স্ট্যাণ্ডের ওপর ফোনটা ছিল। কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করছেন?
আচ্ছা আপনার কাকাকে যখন ফোনে ডাকছে বলে রঞ্জনবাবু সংবাদ দেন তখন ফোনটা কোথায় ছিল জানেন কিছু?
না। তবে—
তবে?
আমার যতদূর মনে পড়ছে কাল দুপুর থেকে ফোনটা বোধ হয় কাকার ঘরেই ছিল।
বলতে পারেন ফোনটা কে তাহলে বাইরের বারান্দায় নিয়ে এল? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না তো!
কেউ নিশ্চয়ই নিয়ে এসেছে, কিন্তু কে? বিড়বিড় করে কথাটা যেন আপন মনেই কিরীটী বলে, কে নিয়ে এল?
কে—কিছু বললেন?
না, কিছু না। আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, কাল রাত সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটা পর্যন্ত আপনি ঠিক কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন—মনে করে আমাকে বলতে পারেন?
যতদূর মনে পড়ছে আমি ঐ সময়টা দোতলাতেই আমার ঘরে বোধ হয় ছিলাম।
আর রঞ্জনবাবু?
সে তো ছাদেই ছিল বেশীর ভাগ সময়, তবে—
বলুন?
একবার যেন মনে পড়ছে কাকাকে ফোনের সংবাদটা দেবার পর কাকার পিছনে পিছনে গিয়েছিল। হা মনে পড়েছে, একবার তাকে যেন আমি তার ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখেছি।
রাত তখন কটা বাজে, মনে করতে পারেন কি?
না। তবে কত আর হবে—বোধ করি সাড়ে আটটা কি আটটা চল্লিশা তাই হবে, তার কারণ একটু আগেই দুষ্মন্ত এসেছে—তাকে আমি বলছিলাম, এতক্ষণে তোমার সময় হল, কটা বাজে দেখেছ! মনে আছে তো ডিনার নয়, টি-র নিমন্ত্রণ ছিল!
তারপর? কিরীটী শুধায়, কোথায় দেখা হয়েছিল আপনাদের?
দোতলার বারান্দায়। এবং দুষ্মন্ত তাতে জবাব দিয়েছিল, এই তো সবে আটটা বেজে দশ মিনিট।
আটটা দশ নিশ্চয়ই সন্ধ্যা নয়!
একটা জরুরী ব্যাপারে আটকে গেলাম। তা কোথায় তিনি, তাকে একটা প্রণাম করে নিই দীর্ঘায়ু কামনা করে!
.
শকুন্তলা বলতে লাগল, তারপরে রঞ্জনকে যখন তার ঘর থেকে বের হয়ে আসতে দেখি—রাত তখন ঐ সাড়ে আটটার মতন হবে মনে হয়।
হুঁ এবং পৌনে নটা নাগাদ বিমলবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হয়!
হঠাৎ যেন কিরীটীর শেষের কথায় শকুন্তলা চমকে ওঠে এবং চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, হোয়াট—হোয়াট আর ইউ ড্রাইভিং অ্যাট মি রায়? কি কি আপনি বলতে চান?
কিরীটী যেন শকুন্তলার কথাগুলো শুনতেই পায় নি এমন ভাবে বলে, তা হলে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না মাত্র পনেরটা মিনিটেরজাস্ট ফিফটিন মিনিটস্!
কিরীটীবাবু? শকুন্তলা উদ্বেগাকুল কণ্ঠে পুনরায় ডাকে।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, ঐ সময়টা সরমা দেবীকে আশেপাশে কোথাও দেখেছিলেন?
সরমা! কই না—মনে পড়ছে না তো!
ট্রাই টু রিমেম্বার! খুব ভাল করে চিন্তা করে বলুন!
না, মনে পড়ছে না!
আর ইউ সিয়োর?
হ্যাঁ, মানে—
মিস চৌধুরী, আবার ভাবুন। ভাবলেই বলতে পারবেন। সব মনে পড়বে, কারণ সে সময়টা আপনি অকুস্থানের—প্লেস অফ অকারেন্স-এর আশপাশেই ছিলেন।
না, আমার মনে পড়ছে না।
কিন্তু মিস চৌধুরী, আমি যদি বলি—স্থির দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটী শকুন্তলার চোখের দিকে, আপনি—হ্যাঁ আপনি দেখেছেন সে-সময় আরো একজনকে সেখানে–
কে–কাকে?
সরমা দেবীকে!
না না—আমি দেখি নি, আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়। আর দেখেই যদি থাকি তা বলব কেন?
যাক শকুন্তলা দেবী, আপনি কি জানেন, অকস্মাৎ কিরীটী তার প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে দিল, কাল রাত্রে এখান থেকে যাবার আগে শিবেনবাবু আপনার কাকার ঘরে যে তালাটা দিয়ে গিয়েছিলেন সে তালাটা কেউ ভেঙে ফেলেছে
সে কি! কে বললে?
শিবেনবাবু আজ বেলা বারোটা নাগাদ এখানে একবার এসেছিলেন। আপনি তো জানেন তখনই তিনি তালাটা ভাঙা দেখে গিয়েছেন–
শিবেনবাবু, সত্যি? শিবেন সোমের মুখের দিকে তাকিয়ে শকুন্তলা উৎকণ্ঠার সঙ্গে প্রশ্নটা করল।
হ্যাঁ, মিস চৌধুরী। তালাটা এখনো ভাঙাই আছে।
আশ্চর্য! কে আবার তালাটা ভাঙল?
.
১৪.
মিস চৌধুরী, রঞ্জনবাবু তো বাড়িতেই আছেন, তাকে একটু ডেকে দেবেন?
হ্যাঁ, দিচ্ছি–কথাটা বলে শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী শিবেন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, একটা কাজ আপনাকে করতে হবে শিবেনবাবু!
কি বলুন?
সাতজনের ফটো আমাকে যোগাড় করে দিতে হবে—
সাতজনের ফটো!
হ্যাঁ।
কার কার?
সাতজনের–দুটি নারীর ও পাঁচটি পুরুষের। ফটোতে শুধু সমস্ত মুখখানা বুক পর্যন্ত।
কিন্তু কার কার?
রাঘব সরকার, দুষ্মন্ত রায়, রঞ্জন বোস, অধ্যাপক বিমল চৌধুরী, বিনায়ক সেন, সরমা ও শকুন্তলার।
বেশ তো। কালই তোলাবার ব্যবস্থা করছি—পরশুই পাবেন।
হ্যাঁ, তা হলেই হবে। আর একটা কথা কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না, রঞ্জন এসে ঘরে ঢুকল।
আসুন, আসুন মিঃ বোস! কিরীটী রঞ্জনকে আহ্বান জানায়।
রঞ্জন কিন্তু কিরীটীর কথার কোন জবাব না দিয়ে সোজা একেবারে শিবেন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, এই যে শিবেনবাবু, আমি আপনাকে ফোন করব ভাবছিলাম, তা আপনি এসে পড়েছেন ভালই হয়েছে কাল সকালের দিকে ডেড বডি আমরা পাব তো?
নিশ্চয়ই। ইচ্ছা করলে আজ রাত্রেই নিতে পারেন, সে ব্যবস্থাও হতে পারে।
দরকার নেই। কাল খুব সকাল সকাল যাতে পাই সেই ব্যবস্থাই করবেন।
বেশ তাই হবে।
কিরীটী এতক্ষণ চুপ করে ছিল, আবার কথা বলল, রঞ্জনবাবু, আপনাকে আমাদের কয়েকটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল।
রঞ্জন বোস কিরীটীর দিকে চোখ তুলে তাকাল। মনে হল হৃদুটো কুঁচকে কপালের উপরে যেন বিরক্তির চিহ্ন একটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রঞ্জন বোসের।
বলুন?
গতকাল রাত্রে সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?
কোথায় ছিলাম আর কি করছিলাম! না মশাই, আমি অত্যন্ত দুঃখিত—ঠিক মনে করতে পারছি না।
মনে করতে পারছেন না?
না।
ওঃ, আচ্ছা আপনার মামাবাবুকে কেউ ফোনে ডেকেছিল আর আপনি তাকে ডেকে দিয়েছিলেন সে কথাটা আশা করি মনে আছে আপনার?
তা আছে।
কে তাকে ফোনে ডেকেছিল মনে আছে আপনার?
না। তাছাড়া জানব কি করে বলুন, আমি তো আর নাম জিজ্ঞাসা করি নি।
নাম জিজ্ঞাসা করেন নি?
না।
ছেলে না মেয়ে?
পুরুষেরই কণ্ঠস্বর যেন শুনেছিলাম।
কি বলেছিলেন তিনি?
বিশেষ কিছুই না, কেবল বলেছিলেন, মামার সঙ্গে তাঁর বিশেষ কি জরুরী কথা আছে— একবার দয়া করে তাকে ডেকে দিতে।
ফোনটা তখন কোথায় ছিল?
মামার ঘরেই।
ঠিক মনে আছে তা আপনার?
তা মনে আছে বৈকি।
আপনি আপনার মামার পিছনে পিছনে এসেছিলেন, তাই না?
এসেছিলাম।
আপনার মামার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরে ঢুকেছিলেন কি?
মামার ঘরে? কই না তো!
তবে আপনি কোথায় গেলেন?
আমি তো আবার ছাদেই ফিরে যাই।
না, আপনি ছাদে ফিরে যান নি!
ফিরে যাই নি? তার মানে?
ফিরে যান নি তাই বললাম। কিন্তু কেন যে ফিরে যান নি সে তো আমি বলতে পারব না, আপনিই পারবেন!
তবে কোথায় গিয়েছিলাম আমি সেটা আপনি নিশ্চয় জানেন বলেই মনে হচ্ছে!
জানি না বলেই তো জিজ্ঞাসা করছি।
রঞ্জন বোস অতঃপর চুপ করে থাকে।
মনে করে দেখুন, আপনার ঘরেই ফিরে যান নি তো?
না।
যান নি?
না।
তা হলে মিঃ বোস, ঐ সময়টা আপনি কি করেছেন, কোথায় ছিলেন, কিছুই মনে নেই বলতে চান?
তাই।
মনে নেই যখন—আচ্ছা আপনি আসতে পারেন। হ্যাঁ ভাল কথা, সরমা দেবীকে একটিবার এই ঘরে পাঠিয়ে দেবেন কি?
কি বললেন! ভ্র-দুটো কুঁচকে ওঠে রঞ্জন বোসের।
বলছিলাম সরমা দেবীকে—
দেবী নয়, আপনারা হয়তো জানেন না, সে সামান্য একজন চাকরানী ছাড়া কিছুই নয়।
তাই নাকি? তা কথাটা আপনি জানলেন কি করে? আপনি তো কিছুদিন মাত্র এখানে এসেছেন রঞ্জনবাবু, ওঁর আসল ও সত্যকারের পরিচয়টা এত শীঘ্র কি করে জেনে ফেললেন বলুন তো!
পরিচয়! পরিচয় আবার কি? এভরিবডি নো শি ইজ নাথিং বাট এ মেড-সারভেন্ট ইন দিস হাউস! সামান্য একজন চাকরানী মাত্র এ বাড়ির
কিরীটী আবার হাসল এবং হাসতে হাসতে বললে, আপনি মনে হচ্ছে যে কারণেই হোক সরমা দেবীর ওপরে তেমন সন্তুষ্ট নন রঞ্জনবাবু! কিন্তু একটা কথা কি জানেন, একজনের ওপরে কোন কারণে আপনি সন্তুষ্ট নন বলেই তাকে অশ্রদ্ধা করবেন, তার সম্পর্কে কটুভাবে কথা বলবেন সেটাও তো ভদ্রতা নয়!
থামুন মশাই, আপনারা দেখছি সব এক দলের! একটা অতি সাধারণ—
কিরীটী, কিন্তু কথাটা রঞ্জনকে শেষ করতে দিল না। তার আগেই শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে এক প্রকার যেন বাধা দিয়েই বললে, থাক রঞ্জনবাবু, আপনাকে কষ্ট করে তার পরিচয় দিতে হবে, আপনি দয়া করে একবার বরং মিস চৌধুরীকে বলে দেবেন, সরমা দেবীকে যেন একটিবার এ ঘরে তিনি পাঠিয়ে দেন। যান—
এক প্রকার যেন ঠেলেই কিরীটী রঞ্জন বোসকে ঘর থেকে বের করে দিল।
কিরীটীর প্রতি একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে রঞ্জন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মিনিট পনের বাদে সরমা ঘরে এসে ঢুকল।
সেই শান্ত আত্মসমাহিত চেহারা।
বসুন সরমা দেবী। যতদিন না ব্যাপারটার কিনারা হয় মধ্যে মধ্যে হয়তো আপনাকে বিরক্ত করতে আমরা বাধ্য হব। একটা কথা বলছিলাম, রামচরণ বলছিল রঞ্জনবাবু নাকি আপনাকে ঠিক সহ্য করতে পারছে না! কথাটা কি সত্য?
শান্ত স্থির দৃষ্টি তুলে তাকাল সরমা কিরীটীর মুখের দিকে নিঃশব্দে।
বুঝেছি, আপনাকে আর বলতে হবে না, কিন্তু কেন বলুন তো, আপনার প্রতি তার এত বিতৃষ্ণার কারণটা কি কিছু বুঝতে পেরেছেন? আগে তো তিনি আপনাকে কখনো দেখেন নি, আপনার সঙ্গে তার কোন পরিচয়ও ছিল না—
বলতে পারি না!
বিমলবাবু নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন?
ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলেও এতদিন এতটা উগ্র হয়ে দেখা দেয় নি। কিন্তু—
বুঝেছি তার মৃত্যুর পর থেকেই—
হ্যাঁ, এ বাড়িতে আমার যে আর জায়গা হবে না তাও—
তাও বলেছেন উনি?
হ্যাঁ, আজই দুপুরে বলেছেন সে কথা।
শকুন্তলা দেবী জানেন সে কথাটা?
না, তাকে আমি বলি নি কিছু।
কিন্তু কেন বলেন নি? এ বাড়িতে সব অধিকার তো একমাত্র রঞ্জনবাবুরই নয়, মিস চৌধুরীরও তো সমান অধিকার আছে।
সে তারা বুঝবে। আমি তো এ বাড়িতে সত্যিই সামান্য দাসী বই কিছুই নয়।
কিন্তু সরমা দেবী, আমি যদি বলি, সামান্য দাসী মাত্রই আপনি নন
কি—কি বললেন?
হঠাৎ যেন কথাটা বলতে বলতে চমকে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে সরমা, মেঘে ঢাকা আকাশের গায়ে বিদ্যুৎচমকের মতই যেন তার অটুট শান্ত গাম্ভীর্য মুহূর্তের জন্য খসে পড়ল বলে মনে হল।
হ্যাঁ, আপনি এ বাড়িতে সামান্য দাসী নন! কিরীটী আবার কথাটা উচ্চারণ করে।
না, না—আমি দাসীদাসী বৈকি—দাসীই তো!
সরমার কণ্ঠ থেকে শেষের বেদনাসিক্ত কথাগুলো যেন একটা আকস্মিক কান্নার মতই উচ্চারিত হল। এবং স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম সরমার দুচোখের কোল ছলছল করছে।
হ্যাঁ সরমা দেবী, আর কেউ না জানুক, বুঝতে না পারুক, আমি জানি, আমি বুঝতে পেরেছি। যাক সে কথা, আপনাকে শুধু আমার একটা অনুরোধ–
অনুরোধ!
হ্যাঁ, আমাকে না জানিয়ে এ বাড়ি থেকে আপনি যাবেন না।
কিন্তু–
বলুন, কথা দিলেন?
আমি—
জানি। বুঝতে পারছি বৈকি, এখানে থাকা আর একটা দিনও আপনার পক্ষে সত্যই দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে দুঃসহ অপমান মেনে নিতে হবে তাও জানি সব জেনেও কটা দিন এখানে আপনাকে আমি থাকতে বলছি বিশেষ কোন কারণ আছে বলেই।
কারণ! সরমা কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকাল।
হ্যাঁ কারণ, নচেৎ জানবেন এখানে এই অপমানের মধ্যে কিছুতেই আপনাকে আমি ধরে রাখতাম না—অনুরোধও করতাম না।
সরমা চুপ করে থাকে। কোন জবাব দেয় না।
সরমা দেবী! কিরীটী আবার ডাকে কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে।
কি?
আপনি কি জানেন কাল রাত্রে পুলিস বিমলবাবুর ঘরে যে তালাটা দিয়ে গিয়েছিল, সেই তালাটা কেউ ভেঙেছে!
ভেঙেছে?
হ্যাঁ, ভেঙেছে। যা গে। আর একটা কথা—
কি?
শুনেছি বিমলবাবু নাকি ডাইরী রাখতেন, সে-সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
না।
আচ্ছা আজ বিনায়কবাবু কেন এসেছিলেন, জানেন কিছু?
কে—কে এসেছিল?
বিমলবাবুর বাল্যবন্ধু বিনায়ক সেন! দেখা হয় নি আপনার তার সঙ্গে আজ কিছুক্ষণ আগে?
সরমা চুপ।
কিরীটী বলে চলে, জানি আপনার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, কিন্তু কেন এসেছিলেন তিনি?
সরমা তথাপি নীরব।
আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলেন, তাই না?
পূর্ববৎ নিশ্চুপ সরমা। সে যেন নিষ্প্রাণ, একেবারে পাথর।
কি বলতে এসেছিলেন তিনি আপনাকে? বিমলবাবুর সম্পর্কে কোন কথাই কি?
হঠাৎ যেন ভেঙে পড়ল সরমা, আমি—আমি জানি না, আমি জানি না—কথাগুলো বলতে বলতে দুহাতে অকস্মাৎ মুখ ঢাকল সে।
কিরীটী ক্ষণকাল স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সরমার মুখের দিকে। তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন সরমা দেবী।
.
১৫.
একটি নিষ্প্রাণ দম-দেওয়া পুতুলের মতই যেন অতঃপর চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সরমা।
সরমার ক্রম-অপস্রিয়মাণ দেহটার দিকেই তাকিয়েছিল কিরীটী এবং সরমার দেহটা যখন দরজার ওপাশে আমাদের দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে গেল কিরীটী মৃদুকণ্ঠে একটিমাত্র কথা বললে, বেচারী!
কথাটা ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি শিবেন সোমের কানে না গেলেও আমার কানে গিয়েছিল, আমি মুখ তুলে তাকালাম কিরীটীর দিকে। কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে পারলাম না। ওকে, কারণ মনে হল ও যেন একটু অন্যমনস্ক। কিন্তু সে ঐ মুহূর্তে কিছু একটা ভাবছিল এবং সেটা যে সরমাকে কেন্দ্র করেই, সেটা বুঝতে আমার দেরি হয় না। এবং এও যেন আমি অনুভব করতে পারছিলাম নাটক দানা বেঁধে উঠেছে বিশেষ করে দুটি প্রাণীকে কেন্দ্র করে, অথচ
সহসা আমার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল শিবেন সোমের কথায়।
দোতলার ঘরটা একবার দেখলে হতো না মিঃ রায়?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখতে হবে বৈকি। আচ্ছা শিবেন, তোমার কি মনে হয়?
কিসের কি মনে হয়?
বলছিলাম ঐ সরমা দেবীর কথা—
সরমা দেবী!
হ্যাঁ। ওঁর কথা শুনলে, ওঁর মুখের দিকে তাকালে, ওঁর কণ্ঠস্বরে, ওঁর মুখের চেহারায় কি মনে হয় না যে ওঁর মনের মধ্যে কোথাও একটা গভীর লজ্জা, গভীর ব্যথা জমাট বেঁধে আছে–
গভীর লজ্জা, ব্যথা!
হ্যাঁ, যে লজ্জা যে ব্যথা কারো কাছে প্রকাশ করবার নয়। যাক গে, কি যেন বলছিলে একটু আগে তুমি? ওপরের ঘরটা দেখবার কথা! হ্যাঁ চলো, ঘরটা দেখে আসা যাক। রামচরণকে একবার ডাকো না, তাকেই সঙ্গে নিয়ে না-হয় ওপরে যাওয়া যাবে।
.
বলা বাহুল্য, রামচরণকে নিয়েই আমরা উপরের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ঘরের তালাটা ভাঙা ছিল, সেটা ধরে সামান্য টানতেই খুলে গেল। খোলা দরজাপথে অতঃপর প্রথমে শিবেন সোম, তার পশ্চাতে আমি, কিরীটী ও রামচরণ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
অন্ধকার ঘর। ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, একটু আগেও ঘরের মধ্যে কেউ ছিল, যে আমাদের ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক ঐ মুহূর্তেই ঘর থেকে চলে গেল।
নিজেদের অজ্ঞাতেই, বুঝি আমাদের ঐ কথাটা মনে হওয়াতেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এবং সকলেই যেন নিশ্চুপ, মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
ঘরের আলোটাও যে জ্বালানো দরকার, সে কথাটাও যেন ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু রামচরণ আমাদের বাঁচাল। সুইচ টিপে সে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
দপ করে ঘরের বিদ্যুৎ-বাতিটা জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সমস্ত অন্ধকার অপসারিত হল।
সেই ঘর—যে ঘরে কাল রাত্রে প্রবেশ করেই চেয়ারটার উপরে শায়িত অধ্যাপকের মৃতদেহটা আমাদের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল।
আজও সর্বপ্রথমেই সেই চেয়ারটার উপরে, বুঝি একান্ত স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্য, চেয়ারটা ঠিক গতকাল যেখানে ছিল সেখানে তো নেই, চেয়ারটা একটু যেন কাত হয়ে রয়েছে–হ্যাঁ, তাই!
বেতের হাতলওয়ালা আরামকেদারা। এবং চেয়ারটা কাত হয়ে থাকার দরুনই যে ব্যাপারটা আমাদের ঐ সঙ্গে দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে সেটা হচ্ছে চেয়ারের ডান পায়াটা ভাঙা। মনে হল, কেউ যেন কোন কিছু দিয়ে চাপ দিতে গিয়েই পায়াটা ভেঙে ফেলেছে।
কিন্তু পায়াটা হঠাৎ কেউ অমনভাবে ভাঙতেই বা গেল কেন? কি এমন প্রয়োজন হয়েছিল কারো চেয়ারের পায়াটা ভাঙবার?
কিরীটী কিন্তু ততক্ষণে চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, আমিও এগিয়ে গেলাম।
চেয়ারের ভাঙা পায়াটা লক্ষ্য করতে করতে কিরীটী বললে, হুঁ, বুঝতে পেরেছি—
চেয়ারের ঐ পায়ার সঙ্গে একটা কোটর ছিল। কোটরের ডালাটা খুলতে পারে নি, বোধ হয় চাবি পায় নি, তাই শেষ পর্যন্ত কোন কিছু লোহার পাত জাতীয় শক্ত জিনিস ডালার ফাকের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ডালাটা খোলবার চেষ্টা করেছিল, তাতেও কৃতকার্য না হয়ে শেষ পর্যন্ত পায়াটা ভেঙে ফেলেছে!
পরীক্ষা করে দেখলাম, কিরীটীর কথাটা মিথ্যা নয়।
কিরীটী আবার বলে, খুব সম্ভবত ঐ কোটরের মধ্যে এমন কিছু ছিল আর সেটা এমন মারাত্মক কিছু অবশ্য-প্রয়োজনীয় ছিল খুনীর পক্ষে, যেজন্য গতরাত্রে আমরা চলে যাবার পর এই ঘরে তাকে প্রবেশ করতেই হয়েছিল।
কিরীটীর শেষের কথায় যেন চমকে উঠি এবং সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের দিকে তাকাই। তবে কি খুনী—কিন্তু সহসা চিন্তাসূত্রে আমার বাধা পড়ল কিরীটীর পরবর্তী কথাতেই, সে বললে, চলো শিবেন, এ শূন্য ঘরে বসে থেকে আর কি হবে?
কিন্তু ঘরটা তো দেখলে না ভাল করে?
কিরীটী মৃদু হাসতে হাসতে বললে, যা দেখবার সে তো স্পষ্টই চোখের সামনে রয়েছে। আর কি দেখব! তাছাড়া দেখবার নতুন করে আর আছেই বা কি!
কিন্তু–
না হে—মস্ত বড় একটা ফাঁক ভরাট হয়ে গিয়েছে—
ফাঁক!
হ্যাঁ, খানিকটা এগিয়ে আর এগুতে পারছিলাম না, দুটি ফাঁকের জন্যে এক জায়গায় এসে—তার মধ্যে একটি ফাঁক খুনী নিজেই ভরাট করে দিয়ে গিয়েছে বাকি আর একটি, আশা করি সেটার জন্যও আর বেশী ভাবতে হবে না আমাদের!
তাহলে কি তুমি–
হ্যাঁ শিবেন, ব্যাপারটা প্রথমে যত জটিল মনে হয়েছিল আসলে এখন দেখছি ততটা বোধ হয় নয়।
তুমি—
কি?
তুমি কি তবে হত্যাকারী কে—
তা আন্দাজ একটা করেছি বৈকি!
কে–কে?
অত তাড়াতাড়ি করলে কি আর হয় ডিয়ার ফ্রেণ্ড! কথায় বলে হত্যারহস্য! দুম করে কি হত্যাকারীর নামটা উচ্চারণ করা যায়! তাছাড়া
কি?
হত্যাকারী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তাকে আমরা সন্দেহ করছি সে সাবধান হয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই সে স্বাভাবিক নিশ্চয়তার সঙ্গেই আমাদের সকলের সামনে এসে দাঁড়াক। যাতে করে বিনা ক্লেশে প্রয়োজনের মুহূর্তটিতে আমরা অনায়াসেই শিবেনবাবুর আইনের লোহার হাতকড়াটা দিয়ে তার হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে পারি, এবং সে আর না পালাবার সুযোগ কোন দিক দিয়েই পায়। যাক চলো, রাত হলো।
.
দিন-দুই পরে দ্বিপ্রহরে।
কিরীটীর ঘরের মধ্যেই আমরা—মানে আমি, কিরীটী ও কৃষ্ণা বসে কতকগুলো ফটো নিয়ে বিশ্লেষণ করছিলাম।
বলা বাহুল্য, ফটোগুলো ঐদিনই ময়না-তদন্তের পুরো রিপোর্টের সঙ্গে একটা সরকারী লেফাফায় ভরে শিবেন সোম কিরীটীর নির্দেশমত ঘণ্টাখানেক আগে মাত্র একজন কনস্টেবল মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ময়না-তদন্তের রিপোর্টে প্রকাশ, তীব্র ডিজিট্যালিনের বিষক্রিয়ায় অধ্যাপকের মৃত্যু ঘটেছে। এবং খুব সম্ভবতঃ ক্লোরোফরমের হুইপ দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ঐ ডিজিট্যালিন অধ্যাপকের দেহে প্রবেশ করানো হয়েছিল।
রিপোর্টটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর একটি মাত্র কথাই বলেছিল, হত্যাকারী বুদ্ধির খেলা দেখিয়েছে নিঃসন্দেহে।
আর একটা কথাও বলে নি ঐ কথাটা ছাড়া।
তারপরই ময়না-তদন্তের রিপোর্টটা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে দিয়ে কতকটা যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ফটোগুলো দেখতে শুরু করে।
পাঁচখানি ফটো পাঠিয়েছিলেন শিবেন সোম।
অধ্যাপক বিমলবাবুর, সরমার, শকুন্তলার, বিনায়ক সেনের এবং রঞ্জন বোসের। এবং পাঁচখানি ফটোর উপরে বারেকের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে পরপর শেষ পর্যন্ত শকুন্তলা ও সরমার ফটোটি দুহাতে তুলে নেয় কিরীটী। এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফটো দুটো বার বার পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
তারপরই কিরীটী আমাদের দুজনের দিকে ফটোগুলো এগিয়ে দিতে দিতে বললে, দেখ তো তোমরা, ফটোগুলোর মধ্যে কোন বিশেষত্ব আছে কিনা?
বলা বাহুল্য, আমরা কিন্তু ফটোগুলো বহুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেও কিরীটী ঠিক কী বলতে চায় ধরতে পারি না।