সমস্ত ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা করে গেলেন মিঃ বসাক রজত ও সুজাতার জ্ঞাতার্থে।
চা পান করতে করতেই মিঃ বসাক সমগ্র দুর্ঘটনাটা বর্ণনা করছিলেন।
উপস্থিত সকলেই চা পান করছিলেন একমাত্র সুজাতা বাদে।
সুজাতা নীলকুঠিতে পা দিয়েই তার ছোটকার মৃত্যু-সংবাদটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই যে কেমন নিচুপ হয়ে গিয়েছিল এবং মাঝখানে একবার ঐ রাত্রেই কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কথাই বলেনি।
তার মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না যে, অকস্মাৎ যেন সে কেমন বিহ্বল হয়ে গিয়েছে ঘটনা-বিপর্যয়ে।
মিঃ বসাকের বর্ণনা প্রসঙ্গে রজত মধ্যে মধ্যে দু-একটা কথা বললেও সুজাতা একবারের জন্যও তার মুখ খোলেনি! চায়ের কাপটা সে মিঃ বসাকের অনুরোধে হাতে তুলে নিয়েছিল মাত্র, ওষ্ঠে কাপটা স্পর্শও করেনি।
ধূমায়িত চায়ের কাপটা ক্রমে ক্রমে একসময় ঠাণ্ডা হয়ে জুড়িয়ে গেল, সেদিকেও যেন তার লক্ষ্য ছিল না।
রামচরণ এসে ঘরে আবার প্রবেশ করল।
ট্রের উপরে শূন্য চায়ের কাপগুলো তুলে নিতে নিতে বললে, আপনারা তাহলে রাত্রে এখানেই থাকবেন তো দাদাবাবু?
প্রশ্নটা রামচরণ রজতকে করলেও তার দৃষ্টি ছিল সুজাতার মখের উপরেই নিবদ্ধ।
হ্যাঁ হ্যাঁ—এখানেই থাকবো বৈকি। তুমি সব ব্যবস্থা করে রেখো। রজত সুজাতার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে কথাগুলো বললে।
সুজাতা কোন জবাব দিল না।
উপরের তলার ঘরগুলো অনেকদিন তো ব্যবহার হয় না—
রামচরণকে বাধা দিয়ে রজত বললে, ওরই মধ্যে একটা যাহোক ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার করে দাও—আজকের রাতের মত। তারপর কাল সকালে দেখা যাবে।
সেই ভাল রামচরণ। আমারে শোবার ব্যবস্থা যে ঘরে করেছ, তারই পাশের ঘর দুটোয় ওদের ভাই-বোনের থাকবার ব্যবস্থা করে দাও, মিঃ বসাক বললেন।
রামচরণ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুজাতা ছাড়াও ঘরের মধ্যে উপস্থিত আর একজন প্রায় বলতে গেলে চুপচাপ বসেছিলেন, পুরন্দর চৌধুরী।
একটা বিচিত্র লম্বা বাঁকানো কালো পাইপে উগ্র কটুগন্ধী টোব্যাকো ভরে পুরন্দর চৌধুরী চেয়ারটার উপরে হেলান দিয়ে বসে নিঃশব্দে ধূমপান করছিলেন।
ঘরের বাতাসে টোব্যাকোর উগ্র কটু গন্ধটা ভেসে বেড়াচ্ছিল।
রামচরণ ঘর থেকে চলে যাবার পর সকলেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।
ঘরের আবহাওয়াটা যেন কেমন বিশ্রী থমথমে হয়ে উঠেছে।
ইন্সপেক্টার বসাকই আবার ঘরের স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন।
আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ধরে ঐ রামচরণের সঙ্গে আমি কথাবার্তা বলে ও নানা প্রশ্ন করে বিনয়েন্দ্রবাবুর সম্পর্কে যা জানতে পেরেছি, তার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনা হচ্ছে, মাস চার-পাঁচ আগে একটি তরুণী একদিন সকালবেলা নাকি বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
তরুণী! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল রজত মিঃ বসাকের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, তরুণীটি দেখতে নাকি বেশ সুশ্রীই ছিলেন। সাধারণ বাঙালী মেয়েদের মত দেহের গঠন নয়। বরং বেশ উঁচু লম্বাই। বয়স ছাব্বিশ-আটাশের মধ্যেই নাকি হবে।
কিন্তু কেন এসেছিলেন তিনি জানতে পেরেছেন? প্রশ্ন করে আবার রজতই।
হ্যাঁ, শুনলাম তরুণীটি এসেছিলেন দেখা করতে, বিনয়েন্দ্রবাবু কাগজে তাঁর একজন ল্যাবরেটরী-অ্যাসিস্টেস্টের প্রয়োজন বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, সেই বিজ্ঞাপন দেখে।
তারপর?
তরুণীটি এসে বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ায় রামচরণ তার বাবুকে সংবাদ দেয়।
মিঃ বসাক বলতে লাগলেন, বিনয়েন্দ্র তাঁর ল্যাবরেটরীর মধ্যে ওই সময় কাজ করছিলেন। সংবাদ পেয়ে রামচরণকে তিনি বলেন, আগন্তুক তরুণীকে তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরেই পাঠিয়ে দিতে। তরুণী ল্যাবরেটরী ঘরে গিয়ে ঢোকেন।
ঘণ্টা দুই বাদে আবার তরুণী চলে যান। এবং সেই দিনই সন্ধ্যার সময় বিনয়েন্দ্র রামচরণকে ডেকে বলেন, যে তরুণীটি ওই দিন সকালবেলা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আগামী পরশু সকালে আবার সে আসবে। তরুণীটির জন্য রামচরণ যেন দোতলার একটি ঘর ঠিক করে রাখে, কারণ এবার থেকে সে এ বাড়িতেই থাকবে।
তারপর রজত আবার প্রশ্ন করল, নির্দিষ্ট দিনে তরুণীটি এলেন এবং এখানে থাকতে লাগলেন? কি নাম তাঁর?
জানতে পারা যায়নি। রামচরণও তাঁর নাম বলতে পারেনি, মেমসাহেব বলেই রামচরণ তাঁকে ডাকত। তরুণী অত্যন্ত নির্বিরোধী ও স্বল্পবাক ছিলেন। অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে নাকি কারও সঙ্গেই বড় একটা কথা বলতেন না। দিনেরাত্রে বেশির ভাগ সময়ই তাঁর কাটত বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গবেষণাগারের মধ্যে। যে চার মাস এখানে তিনি ছিলেন, মাসের মধ্যে একবার কি দুবার ছাড়া তিনি কখনও একটা বাড়ির বাইরেই যেতেন না।
আর একজন নতুন লোক যে এ বাড়িতে এসেছে বাইরে থেকে কারও পক্ষে তা বোঝবারও উপায় ছিল না।
সারাটা দিন এবং প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত দুজনেই যে যাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। এবং সে সময়টা বিশেষ কাজের এবং প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া দুজনের মধ্যে কোন কথাই নাকি হত না।
একমাত্র দুজনের মধ্যে সামান্য যা কথাবার্তা মধ্যে মধ্যে হত—সেটা ওই খাবার টেবিলে বসে।
বিনয়েন্দ্রকে নিয়ে এক টেবিলে বসেই তিনি খেতেন।
সেই সময় বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে শুনেছে রামচরণ, কিন্তু তাও সে-সব কথাবার্তার কিছুই প্রায় সে বুঝতে পারেনি, কারণ খাওয়ার টেবিলে বসে যা কিছু আলাপ তাঁর বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে চলত তা সাধারণত ইংরেজীতেই হত।
এমনি করে চলছিল, তারপর হঠাৎ একদিন আবার যেমন তরুণীর ঐ গৃহে আবির্ভাব ঘটেছিল তেমনি হঠাৎই একদিন আবার তরুণী যেন কোথায় চলে গেলেন।
নিয়মিত খুব ভোরে গিয়ে রামচরণ তরুণীকে তাঁর প্রভাতী চা দিয়ে আসত, একদিন সকালবেলা তাঁর প্রাত্যহিক প্রভাতী চা দিতে গিয়ে রামচরণ তাঁর ঘরে আর তাঁকে দেখতে পেল না।
একটি মাত্র বড় সুটকেস কেবল যা সঙ্গে এনেছিলেন তিনি, সেইটিই ডালা-খোলা অবস্থায় ঘরের একপাশে পড়ে ছিল।
রামচরণ প্রথমে ভেবেছিল, তিনি বোধ হয় ল্যাবরেটরী ঘরেই গেছেন কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে বিনয়েন্দ্র অ্যাপ্রন গায়ে একা-একাই কাজ করছেন।
সকালবেলার পরে দ্বিপ্রহরেও খাওয়ার টেবিলে তাঁকে না দেখে রামচরণ বিনয়েন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে, মেমসাহেবকে দেখছি না বাবু? তিনি খাবেন না?
না।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে রামচরণেরও যেমন সাহস হয়নি, বিনয়েন্দ্রও আর তাকে সেই তরুণী সম্পর্কে দ্বিতীয় কোন কথা বলেননি নিজে থেকে।
তবে তরুণীকে আর তারপর এ বাড়িতে রামচরণ দেখেনি।
চার মাস আগে অকস্মাৎ একদিন যেমন তিনি এসেছিলেন, চার মাস বাদে অকস্মাৎই তেমনি আবার যেন উধাও হয়ে গেলেন।
কোথা থেকেই বা এসেছিলেন আর কোথায়ই বা চলে গেলেন কে জানে!
রামচরণ তাঁকে আবার দেখলে হয়তো চিনতে পারবে, তবে তাঁর নাম-ধাম কিছুই জানে না।
তরুণী চলে যান আজ থেকে ঠিক দশ দিন আগে।
এই একটি সংবাদ। এবং দ্বিতীয় সংবাদটি ওই তরুণী ছাড়াও আর একজন পুরুষ আগন্তুক বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে গত এক বছরের মধ্যে বার দুই দেখা করেছেন।
আগন্তুক সম্ভবত একজন ইউ.পি.বাসী।
লম্বা-চওড়া চেহারা, মুখে নূর দাড়ি, চোখে কালো কাঁচের চশমা ছিল আগন্তুকের। এবং পরিধানে ছিল কেনা পায়জামা, সেরওয়ানী ও মাথায় গান্ধী-টুপি।
তিনি নাকি প্রথমবার এসে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরে বসে আধঘণ্টাটাক আলাপ করে চলে যান।
দ্বিতীয়বার তিনি আসেন দুর্ঘটনার মাস চারেকের কিছু আগে।
তৃতীয় সংবাদ যা ইন্সপেক্টার সংগ্রহ করেছেন রামচরণের কাছ থেকে তা এই: পুরন্দর চৌধুরী গত দু-বছর থেকে মধ্যে মধ্যে চার-পাঁচ মাস অন্তর অন্তর বার পাঁচেক নাকি এবাড়িতে এসেছেন। এবং রামচরণ তাঁকে চেনেন। পুরন্দর চৌধুরী এখানে এলে নাকি দু-পাঁচদিন থাকতেন।
চতুর্থ সংবাদটি হচ্ছে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এবং শুধু উল্লেখযোগ্যই নয়, একটু রহস্যপূর্ণও।
গত দেড় বছর ধরে ঠিক দু মাস অন্তর অন্তর সিঙ্গাপুর থেকে বিনয়েন্দ্রর নামে একটি করে নাকি রেজিস্টার্ড পার্শেল আসত।
পার্সেলের মধ্যে কি যে আসত তা রামচরণ বলতে পারে না। কারণ পার্সেলটি আসবার সঙ্গে সঙ্গেই রসিদে সই করেই বিনয়েন্দ্র পার্সেলটি নিয়েই ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করতেন। কখনও তিনি রামচরণের সামনে পার্সেলটি খোলেন নি।
এবং একটা ব্যাপার রামচরণ লক্ষ্য করেছিল, পার্সেলটি আসবার সময় হয়ে এলেই বিনয়েন্দ্র যেন কেমন বিশেষ রকম একটু চঞ্চল ও অস্থির হয়ে উঠতেন। বার বার সকালবেলা পিওন আসবার সময়টিতে একবার ঘর একবার বারান্দা করতেন।
যদি কখনও দু-একদিন পার্সেলটি আসতে দেরি হত, বিনয়েন্দ্রর মেজাজ ও ব্যবহার যেন কেমন খিটখিটে হয়ে উঠত। আবার পার্সেলটি এসে গেলেই ঠাণ্ডা হয়ে যেতেন।
শান্ত ধীর যেমন তাঁর স্বভাব।
ছোট একটি চৌকো বাক্সে পার্সেলটি আসত।
সিঙ্গাপুর থেকে যে পার্সেলটি আসত রামচরণ তা জেনেছিল একদিন বাবুর কথাতেই, কিন্তু জানত না কে পাঠাত পার্সেলটি এবং পার্সেলটির মধ্যে কি থাকতই বা।
.
১২.
দরজার বাইরে এমন সময় জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেল।
কেউ আসছে এ ঘরের দিকে। ইন্সপেক্টার বসাক চোখ তুলে খোলা দরজাটার দিকে তাকালেন।
ভিতরে আসতে পারি স্যার? বাইরে থেকে ভারী পুরুষ-কণ্ঠে প্রশ্ন এল।
কে, সীতেশ? এস এস—
চব্বিশ-পঁচিশ বৎসর বয়স্ক একটি যুবক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল। পরিধানে তার ক্যালকাটা পুলিশের সাদা ইউনিফর্ম।
কি খবর সীতেশ?
জামার পকেট থেকে একটি মুখ আঁটা অন হিজ ম্যাজেস্টিস সার্ভিস ছাপ দেওয়া লম্বা খাম বের করে এগিয়ে দিতে দিতে বললে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট স্যার।
আগ্রহের সঙ্গে খামটা হাতে নিয়ে ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, থ্যাঙ্কস্। আচ্ছা তুমি যেতে পার সীতেশ।
সার্জেন্ট সীতেশ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ইন্সপেক্টার বসাক খামটা ছিড়ে রিপোর্টটা বের করলেন।
.
বিনয়েন্দ্রর মৃতদেহের ময়না তদন্তের রিপোর্ট।
ডাঃ বক্সীই ময়না তদন্ত করেছেন নিজে।
দেখলেন মৃতদেহে বিষই পাওয়া গেছে, তবে সে সাধারণ কোন কেমিকেল বিষ নয়, মেক-ভেন। সর্প-বিষ!
বিষপ্রয়োগেও যে বিনয়েন্দ্রকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল সেটা ইন্সপেক্টার বসাক সকালে মৃতদেহ পরীক্ষা করতে গিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন।
কিন্তু বুঝতে পারেননি সেটা সর্প-বিষ হতে পারে। ঘাড়ের নিচে যেরক্ত জমার (একিমোসি) চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল মৃতদেহে, সেটাও কোন ভারি বস্তুর দ্বারা আঘাতই প্রমাণ করছে। এবং শুধু রক্ত জমাই নয়, base of the skull-এ ফ্র্যাকচারও পাওয়া গিয়েছে। সে আঘাতে মৃত্যুও ঘটতে পারত।
এদিকে দেহে সর্প-বিষ প্রয়োগের চিহ্নও যথেষ্ট পাওয়া গিয়েছে।
মৃত্যুর কারণ তাই ওই সর্প-বিষ বা আঘাতের যে কোন একটিই হতে পারে।
অথবা একসঙ্গে দুটিই হতে পারে। ডাঃ বক্সীর অন্তত তাই ধারণা। কাজেই বলা শক্ত, এক্ষেত্রে উক্ত দুটি কারণের কোটি প্রথম এবং কোনটি দ্বিতীয়।
তবে এ থেকে আরও একটি সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, ব্যাপারটি আদৌ আত্মহত্যা নয়, নিষ্ঠুর হত্যা।
ময়না তদন্তে কি পাওয়া গেল মিঃ বসাক? প্রশ্ন করে রজতই।
ইন্সপেক্টার ময়না তদন্তের রিপোর্টটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললেন।
সে কি! স্নেক-ভেন! সর্প-বিষ! বিস্মিত কণ্ঠে রজত বলে।
হ্যাঁ।
কিন্তু সর্প-বিষ কাকার শরীরে এল কি করে? তবে কি সর্পদংশনেই তাঁর মৃত্যু হল?
সম্ভবত না, গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন ইন্সপেক্টার।
সর্প-দংশন নয়?
না।
তবে সর্প-বিষ তাঁর দেহে এল কোথা থেকে?
সেটাই তো বর্তমান রহস্য।
কিন্তু সর্প-দংশন যে নয় বুঝলেন কি করে?
কারণ সর্প-দংশনে মৃত্যু হলে প্রথমত বিনয়েন্দ্রবাবুর শরীরের কোথাও না কোথাও সর্পদংশনের চিহ্ন নিশ্চয়ই পাওয়া যেত, এবং দ্বিতীয়ত কাউকে আচমকা সর্প-দংশন করলে তার পক্ষে নিঃশব্দে ওইভাবে মরে থাকা সম্ভবপর হত না। শুধু তাই নয়, সর্পদংশনেই যদি মৃত্যু হবে তবে মৃতের ঘাড়ের নীচে সেই কালসিটার দাগ অর্থাৎ একটা শক্ত আঘাতের চিহ্ন এল কোথা থেকে? নিজে নিজে তিনি নিশ্চয়ই ঘাড়ে আঘাত করেননি বা পড়ে গিয়েও ওইভাবে আঘাত পাননি! পেতে পারেন না।
তবে?
মৃতের ঘাড়ের ও ঠোঁটের ক্ষতচিহ্ন দেখে আমার যতদূর মনে হচ্ছে রজতবাবু, হত্যাকারী হয়তো তাঁকে অতর্কিতে আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলে, পরে মুখ দিয়ে সর্পবিষ কোন নল বা ওই জাতীয় কিছুর সাহায্যে তাঁর শরীরের মধ্যে প্রয়োগ করেছিল।
তাহলে আপনি স্থিরনিশ্চিত যে ব্যাপারটা হত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়?
হ্যাঁ। Clean murder। নৃশংস হত্যা।
Clean murder তাই বা অমন জোর গলায় আপনি বলছেন কি করে ইন্সপেক্টার?
এতক্ষণে এই প্রথম পুরন্দর চৌধুরী পাইপটা মুখ থেকে সরিয়ে কথা বললেন।
সকলে যুগপৎ পুরন্দর চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল।
কি বলছেন মিঃ চৌধুরী? ইন্সপেক্টার বসাক প্রশ্ন করলেন।
বলছিলাম আপনার পোেস্ট মর্টে রিপোর্টের ওই findings টুকুই কি আপনার ওই ধরনের উক্তির অবিসংবাদী প্রফ? ব্যাপারটা তত আগাগোড়া pure and simple একটা accidentও হতে পারে?
পুরন্দর চৌধুরীর দ্বিতীয়বারের কথাগুলো শুনেই সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টার বসাক জবাব দিতে পারলেন না, তাঁর মুখের দিকে কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে রইলেন।
পুরন্দর চৌধুরীও ইন্সপেক্টার বসাকের দিকেই তাকিয়েছিলেন। পুরন্দর চৌধুরীর চোখের উপরের ও নীচের পাতা দুটো যেন একটু কুঁচকে আছে, তথাপি সেই কোঁচকানো চোখের ফাঁক দিয়ে যে দৃষ্টিটা তাঁর প্রতি স্থিরনিবদ্ধ তার মধ্যে যেন সুস্পষ্ট একটা চ্যালেঞ্জের আহ্বান আছে বলে বসাকের মনে হয় ঐ মুহূর্তে।
কয়েকটা মুহূর্ত একটা গুমোট স্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেল।
হঠাৎ ইন্সপেক্টারের ওষ্ঠপ্রান্তে ক্ষীণ একটা বঙ্কিম হাসির রেখা জেগে উঠল। এবং তিনি মৃদুকণ্ঠে বললেন, না মিঃ চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমি ঠিক একমত হতে পারছি না। ঘাড়ের নীচে একটা বেশ জোরালো আঘাত ও সেই সঙ্গে সর্পবিষ ব্যাপারটাকে ঠিক আকস্মিক একটা দুর্ঘটনার পর্যায়ে ফেলতে পারছি না।
কেন বলুন তো?
আমার position-এ আপনি থাকলেও কি তাই বলতেন না মিঃ চৌধুরী? ধরুন না যদি ব্যাপারটা আপনি যেমন বলছেন simple একটা accident-ই হয়, আঘাতটা ঠিক ঘাড়ের নীচেই লাগল—শরীরের আর কোথায়ও আঘাত এতটুকু লাগল না, তা কেমন করে হবে বলুন? তারপর সর্পবিষের ব্যাপারটা-সেটাই বা accident-এর সঙ্গে খাপ খাওয়াচ্ছেন কি করে?
সেটা সর্প-দংশনও হতে পারে। সর্পদংশনের জায়গাটা হয়তো আপনাদের ময়না তদন্তে এড়িয়ে গিয়েছে। তদন্তের সময় ডাক্তারের চোখে পড়েনি।
তারপর একটু থেমে বলেন, এবং সেটা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়। সাপ দংশন করলেও তো এমন একটা বড় রকমের কিছু তার দন্ত-দংশন চিহ্ন রেখে যাবে না যেটা সহজেই নজরে পড়তে পারে!
মৃদু হেসে ইন্সপেক্টার বসাক আবার বললেন, আপনার কথাটা হয়তো ঠিক, এবং যুক্তি যে একবারেই নেই তাও বলছি না। কিন্তু কথা হচ্ছে একটা লোককে সাপে দংশন করল অথচ বাড়ির কেউ তা জানতেও পারলে না তাই বা কেমন করে সম্ভব বলুন?
রামচরণ এমন সময় আবার এসে ঘরে প্রবেশ করল, রান্না হয়ে গেছে। টেবিলে কি খাবার দেওয়া হবে?
ইন্সপেক্টার বসাক বললেন, হ্যাঁ, দিতে বল।
.
দোতলার একটি ঘরই বিনয়েন্দ্র ডাইনিং রুম হিসাবে ব্যবহার করতেন।
রামচরণ সকলকে সেই ঘরে নিয়ে এল।
মাঝারি গোছের ঘরটি।
ঘরের মাঝখানে লম্বা একটি ডাইনিং টেবিল; তার উপরে ধবধবে একটি চাদর পেতে দেওয়া হয়েছে। মাথার উপরে সিলিং থেকে ঝুলন্ত সুদৃশ্য ডিম্বাকৃতি সাদা ডোমের মধ্যে উজ্জ্বল বিদ্যুৎবাতি জ্বলছে। ঘরের একধারে একটি ফ্রিজ, তার উপরে বসানোে একটা সুদৃশ্য টাইমপিস। ঘড়িটা দশটা বেজে বন্ধ হয়ে আছে।
টেবিলের দু পাশে গদি-মোড়া সুদৃশ্য সব আরামদায়ক চেয়ার।
টেবিলের একদিকে বসলেন ইন্সপেক্টার বসাক ও পুরন্দর স্টেধুরী, অন্যদিকে বসল রজত ও সুজাতা।
পাচক কাঁচের প্লেটে করে পরিবেশন করে গেল আহার্য।
কিন্তু আহারে বসে দেখা গেল, কারোরই আহারে যেন তেমন একটা উৎসাহ বা রুচি নেই। খেতে হবে তাই যেন সব খেয়ে চলেছে।
বিশেষ করে সুজাতা যেন একেবারেই কোন খাওয়ার স্পৃহা বোধ করছিল না।
ঘটনার আকস্মিকতায় সে যেন কেমন বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। বার বার তার কাকা বিনয়েন্দ্রর কথাটা ও তাঁর মুখখানাই যেন মনের পাতায় ভেসে উঠছিল।
বছর দশেক হবে তার কাকার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তাদের ছেড়ে কাকার অকস্মাৎ এখানে চলে আসাটা তার জেঠিমা ও দাদা রজত কাকার কর্তব্যের মস্ত বড় একটা ক্ৰটি বলেই কোনদিন যেন ক্ষমা করতে পারেননি।
কিন্তু সুজাতা কাকার চলে আসা ও এখানে থেকে যাওয়াটা তত বড় একটা ক্রটি বলে মনে করতে পারেনি কোনদিনই।
কারণ কাকা বিনয়েন্দ্রর সে ছিল অশেষ স্নেহের পাত্রী।
অনেক সময় কাকার সঙ্গে তার অনেক মনের কথা হত। কাকা ও ভাইঝিতে পরস্পরের ভবিষ্যৎ ও কর্মজীবন নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা হত। কাকার মনের মধ্যে ছিল সত্যিকারের জ্ঞানলিষ্ণু বিজ্ঞানী মানুষ। সে মানুষটা ছিল যেমনি সহজ তেমনি শিশুর মত সরল।
কোনপ্রকার ঘোরপ্যাঁচই তাঁর মনের কোথাও ছিল না।
এ কথা সাদা কাগজের পৃষ্ঠার মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
কাকা ভাইঝিতে কতদিন আলোচনা হয়েছে, যদি বিনয়েন্দ্রর প্রচুর টাকা থাকত তবে সে কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে তৈরী করত একটি মনের মত ল্যাবরেটরী-গবেষণাগার। দিনরাত সেই গবেষণাগারের মধ্যে বসে সে তার আপন ইচ্ছা ও খুশিমত গবেষণা করে যেত। কোন ঝামেলা নেই, সংসারের কোন দুশ্চিন্তা নেই। নেই কোন দায়িত্ব।
কাকার কথায় হাসতে হাসতে সুজাতা বলত, এক কাজ কর না কেন ছোটকা, লটারির টিকিট একটা একটা করে কিনতে থাক। হঠাৎ যদি ভাগ্যে একটা মোটা টাকা পেয়ে যাও তো আর কোন অভাবই থাকবে না। দিব্যি মনের খুশিতে মনোমত এক গবেষণাগার তৈরী করে দিনরাত বসে বসে গবেষণা চালাতে পারবে তখন।
হেসে বিনয়েন্দ্র জবাব দিয়েছেন, ঠাট্টা নয় রে সুজাতা, এক মস্ত বড় জ্যোতিষী আমার হস্তরেখা বিচার করে বলেছে হঠাৎই আমার নাকি ধনপ্রাপ্তি হবে একদিন।
তবে আর কি! তবে তো নির্ভাবনায় লটারির টিকিট কিনতে শুরু করতে পার ছোটকা।
না। লটারিতে আমার বিশ্বাস নেই।
তবে আর হঠাৎ ধনপ্রাপ্তি হবে কি করে?
কেন, অন্য ভাবেও তো হতে পারে।
হ্যাঁ–হতে পারে যদি তোমার দাদামশাই তোমাকে তার বিষয়সম্পত্তি মরবার আগে দিয়ে যান।
সে গুড়ে বালি।
কেন?
আমাদের ওপরে দাদামশাইয়ের যে কি প্রচণ্ড আক্রোশ আর ঘৃণা তা তো তুই জানিস না।
সে আর সকলের যার ওপরেই থাক তোমার ওপরে তো ছোটবেলায় বুড়ো খুব খুশিই ছিল।
সে তো অতীত কাহিনী। সেখান থেকে চলে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই সে স্নেহ সব উবে গেছে কবে, তার কি আর কিছু অবশিষ্ট আছে রে?
তাহলে তো কটা বছর তোমার অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায়ই দেখছি না ছোটকা।
কী রকম?
চাকরিবাকরি করি আমি, তারপর মাসে মাসে তোমাকে টাকা দিতে শুরু করব, তুমি সেই টাকা জমিয়ে ল্যাবরেটরী তৈরী করবে।
তা হলেই হয়েছে। ততদিনে চুলে পাক ধরবে, মাথার ঘিলু আসবে শুকিয়ে; তাছাড়া তোকে চাকরি করতে আমি দেবই বা কেন? চমৎকার একটা ছেলে দেখে তোর বিয়ে দেব, তারপর বুড়ো বয়েসে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তোর বাড়িতে তোর ছেলেমেয়েদের নিয়ে—
খিলখিল করে হেসে উঠেছে সুজাতা।
হাসছিস যে?
তা কি করব বল? বিয়েই আমি করব না ঠিক করেছি।
মেয়েছেলে বিয়ে করবি না কি রে?
কেন, ছেলে হয়ে তুমি যদি বিয়ে না করে থাকতে পার তো মেয়ে হয়ে আমিই বা বিয়ে না করে কেন থাকতে পারব না?
দূর পাগলী! বিয়ে তোকে করতে হবে বৈকি।
না ছোটকা, বিয়ে আমি কিছুতেই করতে পারব না।
কেন রে?
বিয়ে করলে তোমার বুড়ো বয়সে তোমাকে দেখবে কে?
কেন, বিয়ে হলেও তো আমাকে দেখাশুনা করতে পারবি।
না কাকামণি, তা হয় না। বিয়ে হয়ে গেলে স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা আর থাকে না।
সেই ছোট্রকা যখন হঠাৎ একদিন কলেজ থেকেই সেই যে তাদের কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে চলে গেল তার দাদামশাইয়ের ওখানে এবং আর ফিরে এল না, সুজাতার অভিমানই হয়েছিল খুব বেশি তার ছোট্কার উপরে।
তার জেঠিমার মত অভিমানমিশ্রিত আক্রোশ বা দাদার মত শুধু আক্রোশই হয়নি।
সে তার ছোটকার মনের কথা জানত বলেই ভেবেছিল, ছোটকার এতদিনকার মনের সাধটা বোধ হয় মিটতে চলেছে, তাই আপাতত ছোট্কা কটা দিন দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন মাত্র।
তাদের পরস্পরের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়নি। হবেও না কোনদিন।
ফলত সুজাতা যেমন তার জেঠিমাকে লেখা বিনয়েন্দ্রর দুখানা চিঠির কথা ঘুণাক্ষরেও জানত না তেমনি এও জানতে পারেনি যে, কী কঠোর শর্তে বিনয়েন্দ্রর দাদামশাই তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বিনয়েন্দ্রকে একা দান করে গেছেন।
তারপর পাস করার পরেই লক্ষ্ণৌয়ে চাকরি পেয়ে সুজাতা চলে গেল। ছোট্কার সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ বা পত্র মারফৎ কোনরূপ যোগাযোগ না থাকলেও ছোট্রকাকে সে একটি দিনের জন্যও ভুলতে পারেনি বা তাঁর কথা না মনে করে থাকতে পারেনি।
এমনকি ইদানীং কিছুদিন থেকেই সে ভাবছিল, এবারে ছোট্রকাকে ও একটা চিঠি দেবে। কিন্তু নানা কাজের ঝাটে সময় করে উঠতে পারছিল না। ঠিক এমনি সময়ে বিনয়েন্দ্রর জরুরী চিঠিটা হাতে এল। একটা মুহূর্তও আর সুজাতা দেরি করল না। চিঠি পাওয়া মাত্রই ছুটি নিয়ে সে রওনা হয়ে পড়ল।
এখানে পৌঁছেই অকস্মাৎ ছোট্কার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে তাই বোধ হয় সব চাইতে বেশী আঘাত পেল সুজাতা।
নেই! তার ছোট্কা আর নেই!
অতদূর থেকে এতদিন অদর্শনের পর তীব্র একটা দর্শনাকাঙ্খা নিয়ে এসেও ছোটকার সঙ্গে তার দেখা হল না। শুধু যে দেখাই হল না তাই নয়, এ জীবনে আর কখনো তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না।
মৃত্যু! নিষ্ঠুর মৃত্যু চিরদিনের মতই তার ছোট্রকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাদের নাগালের বাইরে।
নিরুপায় কান্নায় বুকের ভিতরটা সুজাতার গুমরে গুমরে উঠছিল অথচ চোখে তার এক ফোঁটা জলও নেই।
সে কাঁদতে চাইছে, অথচ কাঁদতে পারছে না।
সমস্ত ব্যাপারটা যেন এখনো কেমন অবিশ্বাস্য বলেই মনে হচ্ছে। তার ছোট্কাকে কেউ নাকি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। অমন শান্ত সরল স্নেহময় লোকটিকে কে হত্যা করল! আর কেনই বা হত্যা করল! কেউ তো ছোটকার এমন শত্রু ছিল না!
কি নিষ্ঠুর হত্যা! সর্পবিষ প্রয়োগে হত্যা! রামচরণের নিকট হতে সংগৃহীত ইন্সপেক্টার বসাকের মুখে শোনা ক্ষণপূর্বের সেই কাহিনীটাই মনে মনে সুজাতা বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করছিল।
কে সেই রহস্যময় তরুণী!
কোথা থেকে এসেছিল সে বিনয়েন্দ্রর কাছে! আর হঠাৎই বা কেন সে কাকামণির মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে অমন করে চলে গেল!
ছোট্কার এই নিষ্ঠুর হত্যা-ব্যাপারের মধ্যে তার কোন হাত নেই তো!
.
১৩.
হঠাৎ ইন্সপেক্টার বসাকের প্রশ্নে সুজাতার চমক ভাঙল, সুজাতাদেবী, আপনি তো কিছুই খেলেন না?
একেবারেই ক্ষিধে নেই।
ইন্সপেক্টার বসাক বুঝতে পারেন, একে দীর্ঘ ট্রেন-জানি, তার উপর এই আকস্মিক দুঃসংবাদ, নারীর মন স্বভাবতই হয়তো মুষড়ে পড়েছে।
কিছু আর বললেন না ইন্সপেক্টার।
আহারপর্ব সমাপ্ত হয়েছিল। সকলে উঠে পড়লেন।
রামচরণ ইতিমধ্যেই সকলের শয়নের ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
দোতলায় চারটি ঘরের একটি ঘরে পুরন্দর চৌধুরীর, একটি ঘরে রজতের, একটি ঘরে সুজাতার ও অন্য একটি ঘরে ইন্সপেক্টার বসাকের।
সকলেই শ্রান্ত। তাছাড়া রাত অনেক হয়েছিল। একে একে তাই সকলেই আহারের পর যে যার নির্দিষ্ট শয়নঘরে গিয়ে প্রবেশ করল।
নীলকুঠীর আশেপাশে একমাত্র, বামপাশে প্রায় লাগোয়া দোতলা একটি বাড়ি ছাড়া অন্য কোন বাড়ি নেই।
ডানদিকে অপ্রশস্ত একটি গলিপথ, তারপর একটা চুন-সুরকির আড়ৎ। তার ওদিকে আবার বাড়ি।
নিজের নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে বাগানের দিককার জানলাটা খুলে বসাক জানলার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে সিগারেট-কেসটা বের করে, কেস থেকে একটা সিগারেট নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করলেন।
মিঃ বসাক খুব বেশি ধূমপান করেন না। রাত্রে দিনে হয়তো চার-পাঁচটার বেশি সিগারেট নয়।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে।
ক্ষীণ একফালি চাঁদ আকাশে উঠেছে। তারই ক্ষীণ আলো বাগানের গাছপালায় যেন একটা ধূসর চাদর টেনে দিয়েছে। গঙ্গায় বোধ হয় এখন জোয়ার। বাগানের সামনে ঘাটের সিঁড়ির শেষ ধাপ পর্যন্ত নিশ্চয়ই স্ফীত জলরাশি উঠে এসেছে।
কলকল ছলছল শব্দ কানে আসে।
গঙ্গার ওপারে মিলের আলোকমালা অন্ধকার আকাশপটে যেন সাতনরী হারের মত দোলে।
বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপারটাই মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল তখন বসাকের। আসলে মৃত্যুর কারণ কোন্টা। ঘাড়ের নীচে আঘাত, না সর্পবিষ! দুটি কারণের যে কোন একটিই পৃথক পৃথকভাবে মৃত্যু ঘটিয়ে থাকতে পারে। আবার দুটি একত্রেও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। আর চোখে যা দেখা গেছে ও হাতের কাছে যে-সব প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাতে মনে হয় ঘাড়ে কোন ভারি শক্ত বস্তু দিয়ে আঘাত করাতেই বিনয়েন্দ্র অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল, তারপর সেই অবস্থাতেই সম্ভবত বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে তাকে।
আরও কতকগুলো ব্যাপার যার কোন সঠিক উত্তর যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিনয়েন্দ্রর সর্বদা ব্যবহৃত সাদা রবারের চপ্পলজোড়া কোথায় গেল? ঘড়িটা ভাঙা অবস্থাতেই ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল কেন?
ল্যাবরেটরী ঘরের দরজাটি খোলা ছিল কেন?
যে তরুণী মহিলাটি বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে কাজ করতে এসেছিল, মাস চারেক কাজ করবার পর হঠাৎই বা সে কাউকে কোন কিছু না জানিয়ে বিনয়েন্দ্রর নিহত হবার দিন দশেক আগে চলে গেল কেন?
যে নূর দাড়ি, চোখে চশমা—সম্ভবত ইউ.পি. হতে আগত ভদ্রলোকটি দুবার বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তিনিই বা কে?
কি তাঁর পরিচয়?
সিঙ্গাপুর থেকে যে পার্সেলটি নিয়মিত বিনয়েন্দ্রর কাছে আসত তার মধ্যেই বা কি থাকত? আর কে-ই বা পাঠাত পার্সেলটি?
হঠাৎ চকিতে একটা কথা মনের মধ্যে উদয় হয়।
পুরন্দর চৌধুরী!
পুরন্দর চৌধুরী সিঙ্গাপুরেই থাকেন। এবং সেখান থেকেই বিনয়েন্দ্রর চিঠি পেয়ে এসেছেন। পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রর বিশেষ বন্ধু ছিলেন। সিঙ্গাপুর হতে প্রেরিত সেই রহস্যময় পার্সেলের সঙ্গে ওই পুরন্দর চৌধুরীর কোন সম্পর্ক নেই তো!
কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিন্তাটা যেন পুরন্দর চৌধুরীকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খেতে শুরু করে বসাকের মাথার মধ্যে।
.
পুরন্দর চৌধুরী।
লোকটির চেহারাটা আর একবার বসাকের মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কি করেন ভদ্রলোক সিঙ্গাপুরে তাও জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ঘনিষ্ঠতা ছিল পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে বিনয়েন্দ্রর অনেক কাল, কিন্তু সে ঘনিষ্ঠতা সত্যিকারের কতখানি ছিল তা এখনও জানা যায়নি।
তারপর ওই চিঠি।
পুরন্দর চৌধুরী, সুজাতাদেবী ও রজতবাবু প্রত্যেকেই চিঠি পেয়ে এখানে আসছেন।
চিঠির তারিখ কবেকার?
তিনখানি চিঠিই মিঃ বসাকের পকেটে ছিল। ঘরের আলো জ্বেলে তিনখানি চিঠিই পকেট থেকে টেনে বের করলেন মিঃ বসাক।
আজ মাসের সতের তারিখ। ১৬ই তারিখে রাত্রি একটা থেকে সোয়া একটার মধ্যে নিহত হয়েছেন বিনয়েন্দ্র। এবং চিঠি লেখার তারিখ দেখা যাচ্ছে ১২ই।
হঠাৎ মনে হয় সুজাতাদেক বা রজতবাবুর হয়তো চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হয়ে এখানে আজ এসে পৌঁছানো সম্ভবপর হয়েছে, কিন্তু পুরন্দর চৌধুরীর পক্ষে সিঙ্গাপুরে চিঠি পেয়ে আজ সকালেই এসে পৌঁছানো সম্ভব হল কি করে?
হঠাৎ এমন সময় খুট করে একটা অস্পষ্ট শব্দ মিঃ বসাকের কানে এল। চকিতে শ্রবণেন্দ্রিয় তাঁর সজাগ হয়ে ওঠে এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা নিবিয়ে, দিলেন মিঃ বসাক।
ঘর অন্ধকার হয়ে গেল মুহূর্তে।
সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকেন মিঃ বসাক।
স্পষ্ট শুনেছেন তিনি খুট করে একটা শব্দ–মৃদু কিন্তু স্পষ্ট।
মুহূর্ত-পরে আবার সেই মৃদু অথচ স্পষ্ট শব্দটা শোনা গেল।
মুহূর্তকাল অতঃপর বসাক কি যেন ভাবলেন, তারপরই এগিয়ে গিয়ে নিঃশব্দে হাত দিয়ে চেপে ধরে ধীরে ধীরে ঘরের খিলটা খুলে দরজাটা ফাঁক করে বারান্দায় দৃষ্টিপাত করলেন।
লম্বা টানা বারান্দাটা ক্ষীণ চাঁদের আলোয় স্পষ্ট না হলেও বেশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছিল।
আবার সেই শব্দটা শোনা গেল।
তাকিয়ে রইলেন মিঃ বসাক।
হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল, তৃতীয় ঘর থেকে সর্বাঙ্গ একটা সাদা চাদরে আবৃত দীর্ঘকায় একটি মূর্তি যেন পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
রুদ্ধশ্বাসে দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকেন মিঃ বসাক সেই দিকে।
.
১৪.
আপাদমস্তক শ্বেতবস্ত্রে আবৃত দীর্ঘ মূর্তিটি ঘর থেকে বের হয়ে ক্ষণেকের জন্য মনে হল যেন বসাকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারান্দাটার এক প্রান্ত হতে অন্য এক প্রান্ত পর্যন্ত দেখে নিল সতর্কভাবে।
তারপর ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে তাঁরই ঘরের দিকে যেন এগিয়ে আসতে লাগল সেই মূর্তি।
বারান্দায় যেটুকু ক্ষীণ চাঁদের আলো আসছিল তাও হঠাৎ যেন অন্তর্হিত হয়। বোধ হয় মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়েছে।
মিঃ বসাক তাকিয়ে রইলেন সেই দিকে।
মূর্তিটা খুব অস্পষ্ট দেখা যায়, এগিয়ে আসছে।
অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টিতে মিঃ বসাক অগ্রবর্তী মূর্তির দিকে নজর রাখলেন। ক্রমশ পায়ে পায়ে মূর্তি দাঁড়াল ঠিক গিয়ে ল্যাবরেটরী ঘরের বদ্ধ দরজার সামনে।
মিঃ বসাকের মনে পড়ল বাড়িতে আর বড় মজবুত তালা না খুঁজে পাওয়ায় একতলা ও দোতলার সংযোজিত সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেটটাতে ওই ল্যাবরেটরী ঘরের দরজার তালাটাই রাত্রে খুলিয়েই লাগিয়েছিলেন রামচরণকে দিয়ে।
ল্যাবরেটরীটা এখন খোলাই রয়েছে।
দরজা খোলার শব্দ পাওয়া গেল অত্যন্ত মৃদু হলেও স্পষ্ট। মূর্তি ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হল।
কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন রুদ্ধশ্বাসে ইন্সপেক্টার বসাক।
তারপর ঘর থেকে বের হয়ে এগিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরী ঘরের দরজাটার দিকে পা টিপে অতি সন্তর্পণে।
দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।
এক মুহূর্ত কি ভাবলেন, তারপর পকেট থেকে রুমালটা বের করে দরজার কড়া দুটো সেই রুমাল দিয়ে বেশ শক্ত করে গিট দিয়ে বাঁধলেন।
এবং সোজা নিজের ঘরে ফিরে এসে তাঁর ঘর ও বিনয়েন্দ্রর শয়নঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে সেই শয়নঘরে প্রবেশ করলেন। পকেটে পিস্তল ও শক্তিশালী একটা টর্চ নিতে ভুললেন না।
এ বাড়ির সমস্ত ঘর ও ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই তিনি ভাল করে সব পরীক্ষা করে জেনে নিয়েছিলেন।
বিনয়েন্দ্রর শয়নঘর ও ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা এবারে খুলে ফেলে ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলেন।
একটা আলোর সন্ধানী রশ্মি অন্ধকার ল্যাবরেটরী ঘরটার মধ্যে ইতস্তত সঞ্চারিত হচ্ছে। বুঝতে কষ্ট হল না বসাকের, ক্ষণপূর্বে যে বস্ত্রাবৃত মূর্তি ঐ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে তারই হাতের সন্ধানী আলোর সঞ্চরণশীল রশ্মি ওটা।
পা টিপে টিপে নিঃশব্দে দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে এগিয়ে চললেন মিঃ বসাক ঘরের দেওয়ালের সুইচ বোর্ডটার দিকে। খুট করে সুইচ টেপার একটা শব্দ হল এবং সঙ্গে সঙ্গে অত্যুজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোয় ঘরের অন্ধকার অপসারিত হল।
অস্ফুট একটা শব্দ শোনা গেল।
নড়বেন না। দাঁড়ান–যেমন আছেন। কঠিন নির্দেশ যেন উচ্চারিত হল ইন্সপেক্টার বসাকের কণ্ঠ থেকে।
দিনের আলোর মতই সমস্ত ঘরটা চোখের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মাত্র হাত পাঁচেক ব্যবধানেনিঃশব্দে দাঁড়িয়েসেইশ্বেতবস্ত্রাবৃতমূৰ্তিতখন। শ্বেতবস্ত্রে আবৃতযেন একটি প্রস্তরমূর্তি।
কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত কেটে গেল।
ইন্সপেক্টারই আবার কথা বললেন, পুরন্দরবাবু, ঘুরে দাঁড়ান।
পুরন্দর চৌধুরী ঘুরে দাঁড়ালেন। নিজেই গায়ের চাদরটা খুলে ফেললেন।
বসুন পুরন্দরবাবু, কথা আছে আপনার সঙ্গে। বসুন ওই টুলটায়।
পুরন্দর চৌধুরী যেন যন্ত্রচালিতের মতই সামনের টুলটার উপরে গিয়ে বসলেন।
ঘরে একটা আরামকেদারা একপাশে ছিল, সেটা টেনে এনে সামনাসামৰিউপবেশন করলেন ইন্সপেক্টার প্রশান্ত বসাক, তারপর প্রশ্ন শুরু করলেন।
এবারে বলুন শুনি, কেন এই মাঝরাত্রে চোরের মত লুকিয়ে এ ঘরে এসেছেন?
ইন্সপেক্টার বসাক প্রশ্ন করা সত্ত্বেও পুরন্দর চৌধুরী চুপ করে রইলেন। কোন জবাব দিলেন না।
পুরন্দরবাবু? আবার ডাকলেন মিঃ বসাক।
পুরন্দর চৌধুরী মুখ তুলে তাকালেন ইন্সপেক্টারের মুখের দিকে। তারপর যেন মনে হল একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস তাঁর বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে এল।
কথা বললেন পুরন্দর চৌধুরী অতঃপর অত্যন্ত মৃদু শান্তকঠে, আপনি কি ভাবছেন জানি না ইন্সপেক্টার, কিন্তু বিশ্বাস করুন বিনয়েন্দ্রকে আমি হত্যা করিনি। সে আমার বন্ধু ছিল। সেই কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়।
আমি তো বলিনি মিঃ চৌধুরী যে আপনিই তাঁকে হত্যা করেছেন। জবাব দিলেন ইন্সপেক্টার শান্ত মৃদু কণ্ঠে।
বিশ্বাস করুন মিঃ বসাক, আমি নিজেও কম বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে যাইনি তার এই আকস্মিক মৃত্যুতে। পুরন্দর চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন, চিঠিটা তার পাওয়া মাত্রই এরোপ্লেনে আমি রওনা হই–
কথার মাঝখানে হঠাৎ বাধা দিলেন ইন্সপেক্টার, কিন্তু সিঙ্গাপুরের প্লেন তো রাত দশটায় কলকাতায় পৌঁছায়। সে ক্ষেত্রে চিঠিটা জরুরী মনে করে চিঠিটা পাওয়া মাত্রই যদি রওনা হয়ে এসে থাকেন তো সেই রাত্রেই সোজা এখানে আপনার বন্ধুর কাছে চলে না এসে পরের দিন সকালে এলেন কেন মিঃ চৌধুরী?
ইন্সপেক্টারের আকস্মিক প্রশ্নে পুরন্দর চৌধুরী সত্যিই মনে হল কেমন যেন একটু বিব্রত বোধ করেন, কিন্তু পরক্ষণেই সে বিব্রত ভাবটা সামলে নিয়ে বললেন, অত রাত্রে আর এসে কি হবে, তাই রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরের দিন সকালেই চলে আসি।
যদি কিছু না মনে করেন তো কোন্ হোটেলে রাত্রে উঠেছিলেন?
হোটেল স্যাভয়ে।
হুঁ। আচ্ছা মিঃ চৌধুরী?
বলুন।
একটা কথা আপনি শুনেছেন বিনয়েন্দ্রবাবুর নামে নিয়মিতভাবে সিঙ্গাপুর থেকে কিসের একটা পার্সেল আসত?
হ্যাঁ।
আপনি বলতে পারেন সে পার্সেল সম্পর্কে কিছু? সিঙ্গাপুরের কার কাছ থেকে পার্সেলটা আসত? আপনিও তো সিঙ্গাপুরেই থাকেন।
পুরন্দর চৌধুরী চুপ করে থাকেন।
কি, জবাব দিচ্ছেন না যে? পার্সেলটা সম্পর্কে আপনি তাহলে কিছু জানেন না বোধ হয়?
পার্সেলটা আমিই পাঠাতাম তাকে। মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন পুরন্দর চৌধুরী এবারে।
আপনি! আপনিই তাহলে পার্সেলটা পাঠাতেন!
হ্যাঁ।
ও, তা কি পাঠাতেন পার্সেলের মধ্যে করে, জানতে পারি কি?
একটা tonic।
টনিক! কিসের tonic পাঠাতেন মিঃ চৌধুরী আপনার বন্ধুকে?
পুরন্দর চৌধুরী আবার চুপ করে থাকেন।
মিথ্যে আর সব কথা গোপন করবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই পুরন্দরবাবু। আপনি না বললেও সব কথা আমরা সিঙ্গাপুর পুলিসকে তার করলে তারা খোঁজ নিয়ে আমাদের জানাবে।
একপ্রকার মাদক দ্রব্য তার মধ্যে থাকত।
মাদক দ্রব্য! হুঁ, আমি ওই রকমই কিছু অনুমান করেছিলাম রামচরণের মুখে সব কথা শুনে। কিন্তু কি ধরনের মাদক দ্রব্য তার মধ্যে থাকত বলবেন কি?
দু-তিন রকমের বুনো গাছের শিকড়, বাকল আর—
আর—আর কি থাকত তার মধ্যে?
সর্প-বিষ।
কি? কি বললেন?
সর্প-বিষ। মেক-ভেনম্।
আপনি! আপনি পাঠাতেন সেই বস্তুটি! তাহলে আপনিই বোধ হয় আপনার বন্ধুটিকে ওই বিষের সঙ্গে পরিচিতি করিয়েছিলেন?
কতকটা হাঁও বটে, আবার নাও বলতে পারেন।
মানে?
তাহলে আপনাকে সব কথা খুলে বলতে হয়।
বলুন।
ইন্সপেক্টার বসাকের নির্দেশে পুরন্দর অতঃপর যে কাহিনী বিবৃত করলেন তা যেমন বিস্ময়কর তেমনি চমকপ্রদ।
.
১৫.
আই. এস-সি ও বি. এস-সি-তে এক বছর কলকাতার কলেজে পুরন্দর চৌধুরী ও বিনয়েন্দ্র সহপাঠী ছিলেন।
সেই সময়েই উভয়ের মধ্যে নাকি প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়।
উভয়েরই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে ধৈর্য বা একনিষ্ঠতা যা বিনয়েন্দ্রর চরিত্রে সব চাইতে বড় গুণ ছিল, সে দুটির একটিও ছিল না পুরন্দরের চরিত্রে।
শুধু তাই নয়, পুরন্দরের চিরদিনই প্রচণ্ড একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল যেমন করেই হোক, যে কোন উপায়ে বড়লোক বা ধনী হবার। ছোটবেলায় মা-বাপকে হারিয়ে পুরন্দর মানুষ হয়েছিলেন এক গরীব কেরানী মাতুলের আশ্রয়ে।
থার্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই হঠাৎ সেই মাতুল মারা গেলেন। সংসার হল অচল। পুরন্দরের পড়াশুনাও বন্ধ হল।
কলেজ ছেড়ে পুরন্দর এদিক-ওদিক কিছুদিন চাকরির চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোথাও বিশেষ কিছু সুবিধা হল না।
এমন সময় হঠাৎ ডকে এক জাহাজের মেটের সঙ্গে ঘটনাচক্রে পুরন্দরের আলাপ হয়। ইদ্রিস মিঞা।
বম মুলুকে গিয়ে অনেকের বরাতের চাকা নাকি ঘুরে গেছে। এ ধরনের দু-চারটে সরস গল্প এ-ওর কাছে পুরন্দর চৌধুরী শোনা অবধি ওই সময় প্রায়ই তিনি ডক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতেন, যদি কাউকে ধরে কোনমতে জাহাজে চেপে বিনা পয়সায় সেই সব জায়গায় যাওয়া যায় একবার।
কোনক্রমে একবার সেখানে গিয়ে সে পৌঁছতে পারলে সে ঠিক তার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরিয়ে দেবে।
ইদ্রিস মিঞা জাহাজে বয়লারের খালাসীর চাকরি দিয়ে বময় নিয়ে যাবার নাম করে পুরন্দরকে। পুরন্দর সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যান এবং নির্দিষ্ট দিনে জাহাজে উঠে পড়েন। সেবার জাহাজটা চায়নায় যাচ্ছিল মাল নিয়ে। জাহাজটা ছিল মাল-টানা জাহাজ। কাগো জাহাজ। জাহাজটা সিঙ্গাপুর ঘুরে যাচ্ছিল, সিঙ্গাপুরে থামতেই পুরন্দর কিন্তু বন্দরে নেমে গেলেন আর উঠলেন না জাহাজে, কেন না, দিন দশেক বয়লার ঘরের প্রচণ্ড তাপের মধ্যে কয়লা ঠেলে ঠেলে হাতে ফোস্কা তো পড়েছিলই, শরীরও প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল গরমে আর পরিশ্রমে। হাতে মাত্র পাঁচটি টাকা, গায়ে খালাসীর নীল পোশাক। পুরন্দর পথে পথে ঘুরতে লাগলেন যা হোক কোন একটা চাকরির সন্ধানে।
কিন্তু একজন বিদেশীর পক্ষে চাকরি পাওয়া অত সহজ নয়।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন হোটেলে এক বাঙালী প্রৌঢ়ের সঙ্গে আলাপ হয়। শোনা গেল, সেও নাকি একটা এসেছিল ভাগ্যান্বেষণে সিঙ্গাপুরে। সে-ইতাকে একরবার গুডসেরফ্যাক্টরীতে চাকরি করে দেয়। এবং সেখানেই আলাপ হয় বছর দেড়েক বাদে এক চীনা ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম তার লিং সিং।
লিং সিংয়ের দেহে পুরোপুরি চীনের রক্ত ছিল না। তার মা ছিল চীনা, আর বাপ ছিল অ্যাংলো মালয়ী। শহরের মধ্যেই লিং সিংয়ের ছিল একটা কিউরিও শপ। লোকজনের মধ্যে লিং সিং ও তার স্ত্রী–কু-সি। দুজনেরই বয়স হয়েছে।
শহরের একটা হোটেলে সাধারণতঃ যেখানে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরাই যাতায়াত করত, লিং সিং-ও সেখানে যেত। পুরন্দর চৌধুরীও সেই হোটেলে মধ্যে মধ্যে যেতেন। সেইখানেই আলাপ হয় দুজনের।
লিং সিংকে মধ্যে মধ্যে পুরন্দর চৌধুরী কোথাও একটা ভাল চাকরি করে দেবার জন্য বলতেন।
লিং সিং আশ্বাস দিত সে চেষ্টা করবে।
শেষে একদিন লিং সিং তাঁকে বললে, সত্যিই যদি সে চাকরি করতে চায় তো যেন সে আজ সন্ধ্যার পর তার কিউরিও শপে যায়। ঠিকানা দিয়ে দিল লিং সিং পুরন্দরকে তার দোকানের।
সেই দিনই সন্ধ্যার পর পুরন্দর লিং সিংয়ের কিউরিও শপে গেলেন তার সঙ্গে দেখা করতে।
এ-কথা সে-কথার পর লিং সিং এক সময় বললে, সে এবং তার স্ত্রী দুজনেরই বয়স হয়েছে। তাদের কোন ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়স্বজনও কেউ নেই। তারা একজন পুরন্দরের মতই বিশ্বাসী ও কর্মঠ লোক খুঁজছে, তাদের দোকানে থাকবে, দোকান দেখাশোনা করবে, খাওয়া থাকা ছাড়াও একশ ডলার করে মাসে মাইনে পাবে।
মাত্র পঞ্চাশ ডলার করে মাইনে পাচ্ছিলেন পুরন্দর ফ্যাক্টরীতে; সানন্দে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। এবং পরের দিন থেকেই লিং সিংয়ের কিউরিও শপে কাজে লেগে গেলেন।
তারপর? মিঃ বসাক শুধালেন।
তারপর?
হ্যাঁ।