১১-১৫. লক্ষ করো বেনভেনুটি

লক্ষ করো বেনভেনুটি, ওই যে মেয়েটি করিডর ঝাড়ু দিচ্ছে, ওর মতো উরু তুমি কখনও দেখেছ? ওরকম যার ঊরু সে কোন দুঃখে জ্যানিটরের কাজ করছে বলতে পারো? এ তো কোটিপতিদের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারে।

বেনভেনুটি নামক গরিলার মতো বলবান লোকটি করিডরের সিঁড়ি ও লিফটের মুখোমুখি একটা পাথরের মূর্তির আড়ালে দুটি চেয়ারের একটিতে বসে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে বলল, বাসিলোঁ, লক্ষ করাই আমার কাজ।

বাসিলোঁ ছিপছিপে এবং বেশ লম্বা। তার দেহ-গঠনে একটা চিতা বাঘের মতো তৎপরতা আছে। বয়সে সে বেনভেনুটির চেয়ে অন্তত আট-দশ বছরের ছোট। বেনভেনুটির যদি মধ্য ত্রিশ তা হলে এ ছেলেটি পঁচিশ হতে পারে। দু’জনের পরনেই জিক্স এবং ঊর্ধ্বাঙ্গে গরম জ্যাকেট। রোমে একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। বাসিলোঁ তরল গলায় বলল, তুমি কি ইমপ্রেসড নও?

অবশ্যই। সুন্দরী মেয়েরা বরাবরই আমাকে ইমপ্রেস করে থাকে।

বেনভেনুটি, তুমি ভাল করে মেয়েটাকে দেখোনি। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটা আমাদের লোভাতুর করতে চাইছে। বুঝলে! ঠিক একজন ব্যালেরিনার মতোই চমৎকার ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে কেমন ঝাড়ু চালাচ্ছে দেখো।

বেনভেনুটি মাথার টুপিটা ভ্রু পর্যন্ত টেনে নামিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিনি স্কার্ট পরা কোনও ঝাড়ুদার আমি দেখিনি কখনও বাপু।

মেয়েটা বোধহয় নতুন কাজ পেয়েছে। একটু আলাপ করে আসব?

আসতে পারো। তবে বেশি মজে যেয়ো না। ওর হয়তো বয়ফ্রেন্ড আছে, কিংবা স্বামী।

তুমি সত্যিই বুড়ো হয়েছ। দেখো, দেখো, মেয়েটার মুখখানা কী সুন্দর! এতক্ষণ পিছন ফিরে ছিল বলে মুখটা দেখা যায়নি। সোনালি চুল, নীল চোখ এবং অসাধারণ ঠোঁট।

মেয়েমানুষই তোমাকে খেলো, বাসিলোঁ।

আহা, গত সাতদিন ধরে একঘেয়ে যে কাজটা আমাদের করতে হচ্ছে সেটাই বা কোন মজার কাজ? একটা ভিতুর ডিম ইন্ডিয়ান তার ঘরে দরজা বন্ধ করে দিন-রাত বসে আছে আর আমরা বাইরে বসে মাছি তাড়াচ্ছি।

ইন্ডিয়ানটা হয়তো ইম্পর্ট্যান্ট লোক। আমাদের কাজ নজর রাখা, রাখছি।

তুমি কি জানো, বেনভেনুটি, যে পৃথিবীতে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট লোকগুলোই হয় সবচেয়ে বেশি বোর?

জানি।

এ লোকটা যদি একটু পালানোটালানোর চেষ্টা করত তা হলেও না হয় হত। এ তো শুধু মাঝে মাঝে নীচের ল্যান্ডিং-এ গিয়ে ফোন করে, আর রাস্তার ওপাশে সুপার স্টোরে কেনাকাটা করতে যায়। কোনও অ্যাডভেঞ্চারই নেই। আমাকেও ও চিনে ফেলেছে। ওর গায়ের সঙ্গে লেগে লেগে তো আমাকেই থাকতে হচ্ছে।

আমাদের যা করতে বলা হয়েছে তা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই বাসিলোঁ। আমরা এ কাজের জন্য যথেষ্ট টাকা পাচ্ছি।

লোকটাকে এক-আধটা ঘুসি মারা কি বারণ?

হ্যাঁ, বারণ। ওর গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। হয়তো সময়মতো ওকে খুন করা হবে এবং সে ভার পাবে হয়তো বা তুমিই।

চমৎকার। আমি সেই হুকুমটার জন্যই অপেক্ষা করছি। কিন্তু বেনভেনুটি, মেয়েটা যে বড্ড কাছে এসে পড়েছে এবং আমাকে কটাক্ষও করল বোধহয়।

ঠিক আছে, এগিয়ে যাও। এখন সকাল আটটা বাজে, সন্ধে ছ’টায় আমাদের জায়গা নিতে আসবে দিনো আর নিনো দুই ভাই। যদি মেয়েটার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে চাও সেটা ছ’টার পরে যেন হয়।

তাই হবে।

একটু শিস দিতে দিতে হালকা পায়ে বাসিলোঁ এগিয়ে গেল।

সুপ্রভাত।

মেয়েটা যেমন অবাক তেমনি যেন শিহরিত। বড় বড় নিষ্পাপ চোখে চাইল, তারপর স্মিত হাসি হেসে বলল, সুপ্রভাত।

কী নাম তোমার?

সিসি। তোমার?

বাসিলোঁ। তুমি কি জানো, তুমি ভীষণ সুন্দর?

মেয়েটা যেন ভীষণ লজ্জা পেয়ে খুশির গলায় বলল, ধন্যবাদ।

তোমাকে তো আগে দেখিনি। নতুন নাকি?

মেয়েটা একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, আসলে আমার বাবা এ বাড়ির জ্যানিটার। আমি এখানে থাকি না, প্যারিসে রান্না শিখতে গিয়েছিলাম। ছুটিতে এসেছি। বাবাকে একটু বিশ্রাম দিতেই তার কাজ করে দিচ্ছি।

দুটো হাত ঘষাঘষি করতে করতে বাসিলোঁ বলল, ভাল, ভাল, খুব ভাল কথা। 

মেয়েটা হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে বলল, আচ্ছা, তোমরা এখানে বসে আছ কেন? কারও জন্য অপেক্ষা করছ নাকি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওইরকমই কিছু। আচ্ছা, তোমার সঙ্গে কোথায় দেখা হতে পারে? ধরো যদি আজ সন্ধেবেলায় তোমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করি?

মেয়েটা আবার শিহরিত হল আনন্দে। রাঙা হয়ে বলল, সত্যি। উঃ, তা হলে তো ভীষণ মজা হয়। কিন্তু আজ নয়। আজ আমার বিকেলটা আগে থেকেই আর একজনকে দিয়ে রেখেছি।

সে কে?

কোনও বয়ফ্রেন্ড নয়। আমার এক বিধবা নিঃসন্তান বুড়ি পিসি৷ সে মারা গেলে তার সম্পত্তি আমিই পাব। পিসি রাগী মানুষ, তাকে খুশি রাখতেই হবে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। কাল হলেও হবে।

তোমরা দু’জন বুঝি বন্ধু?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা খুব বন্ধু।

ওর নাম কী? বেনভেনুটি। একজন প্রাক্তন হেভিওয়েট বক্সার।

বক্সার? আমি বক্সারদের খুব পছন্দ করি।

বাসিলোঁ একটু হেসে বলল, শুধু বক্সারদের? জানো তো, বক্সারদের মাথা মোটা হয়? আর আমাকে দেখো, দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক।

মেয়েটি খুব লজ্জা পেয়ে বলল, তুমিও ভাল। নিশ্চয়ই খুব ভাল তুমি।

 আচ্ছা, আচ্ছা। আমি ভাল কিনা সেটা তো তুমি বিচার করতে পারবেই। কাল সন্ধেবেলা তা হলে?

মেয়েটি ফের যেন লাল হল। বলল, আমার হাতে এখন একটু সময় আছে। তোমাদের দু’জনকে আমি কফি আর কুকি খাওয়াতে পারি।

পারো! কী ভাল কথা! সত্যিই পারো?

হ্যাঁ। এর ঠিক নীচের তলাতেই আমার ঘর।

কেন, তুমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকে না?

আমাদের জায়গা হয় না। তাই দোতলায় একটা ছোট ঘর নিয়ে আছি। এসো না, তোমার বন্ধুকেও ডাকো।

একটা হাই তুলে বাসিলোঁ বলল, একটু অসুবিধে আছে। এখানে একজনকে মোতায়েন থাকতেই হবে।

কেন বলো তো!

আমাদের এক বন্ধুর ওপর নজর রাখতে হচ্ছে।

 ও, তা হলে থাক।

কেন, থাকবে কেন? আমি তো যেতে প্রস্তুত।

মেয়েটি হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, থাক, পরে হবে।

ওঃ, তুমি তো দেখছি সত্যিই বক্সারদের খুব পছন্দ করো। শোনো, আমি বক্সার না হলেও আমার অন্য বিদ্যে জানা আছে। আমি সার্কাসে খেলা দেখাতাম, জানো? ট্রাপিজের খেলা।

মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল, তাই!

বাসিলোঁ হাসল, এবার খাওয়াবে কফি?

মেয়েটা একটু দুষ্টু হাসি হেসে বলল, তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে, একা ঘরে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানো বিপজ্জনক। আমার একজন দেহরক্ষী দরকার।

বাসিলোঁ হেসে বলল, বুঝেছি।

তারপর ফিরে সে বেনভেনুটিকে ডেকে বলল, কিছুক্ষণের জন্য একটা কফি ব্রেক নেওয়া যাবে কি?

বেনভেনুটি প্রায় নিরবচ্ছিন্ন সিগারেট খায়। বলল, না।

একটি সুন্দরী মেয়ের সম্মানেও নয়? সিসি তোমাকে খুব পছন্দ করেছে।

কাজটা উচিত হবে না।

আরে ওই ইন্ডিয়ানটা তো নড়াচড়াই করছে না। বোধহয় এখন ঘুমোচ্ছে।

কত কী ঘটে যেতে পারে।

 দশ মিনিটে কিছুই ঘটবে না, সাত দিনে যখন ঘটেনি। সিসির বক্সারকে পছন্দ।

বেনভেনুটি গড়িমসি করে উঠল। বলল, দশ মিনিট, তার বেশি নয় কিন্তু।

আরে না। এসো, এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

তিনজনে কথা বলতে বলতে নীচের তলায় নামল। মেয়েটি তাদের করিডরের শেষ প্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দোতলার সিঁড়ির মুখোমুখি আর একটা ঘরের দরজা খুলে হরিণের পায়ে ওপরে উঠে এল সুধাকর দত্ত। সোজা গিয়ে গোপীনাথের দরজায় টোকা দিয়ে বলল, দরজাটা খুলুন। তাড়াতাড়ি।

গোপীনাথ বাংলা কথা শুনে তাড়াতাড়িই দরজা খুলল।

সুধাকর চাপা গলায় বলল, শিগগির আসুন। পাসপোর্টটা নিয়ে।

কোথায়?

কথা বলার সময় নেই। প্লিজ।

গোপীনাথ পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে এল। সুধাকরের পিছু পিছু দোতলায় নেমে এল সে। সুধাকর তার ঘরের দরজা খুলে গোপীনাথকে প্রায় টেনে ঢুকিয়ে নিল ঘরে। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, এখন আপনি অনেকটা নিরাপদ।

গোপীনাথ বলল, আপনি কে?

সুধাকর হাত তুলে বলল, এসব প্রশ্নের জবাব পরে দেব। আমি কে জেনে আপনার লাভ নেই। শত্রুও হতে পারি, মিত্রও হতে পারি। সমুদ্রে শয়ান যার, শিশিরে কি ভয় তার? আপনার তো মশাই, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। তাই নয় কি?

গোপীনাথ ক্লিষ্ট একটু হেসে বলল, তা বটে।

বসুন। একটু কফি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেবেন?

তা খেতে পারি।

খান মশাই, আপনার এখন অনেক কিছু বলার আছে।

আমার ওপর কিন্তু সারাক্ষণ নজর রাখা হচ্ছে। আপনি যে আমাকে নিয়ে এলেন এটা ওরা টের পাবে না?

এখনই পাবে না। কারণ ওরা আপনার ঘরের দরজাটা শুধু নজরে রাখে, আর আপনি বেরোলে পিছু নেয়, তাই না?

হ্যাঁ।

তা হলে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্ত। আপনার ঘরে কি ফোন আছে?

না।

বাঃ চমৎকার।

গোপীনাথ মৃদুস্বরে বলল, করিডরের পাহারাদার দু’জন কোথায় গেল?

কাছেপিঠেই আছে। ওদের কফি খেতে পাঠিয়েছি।

পাঠিয়েছেন? তার মানে কি ওরা আপনার লোক?

না মশাই, না। পাঠিয়েছি মানে কি আর আমার হুকুমে গেছে? টোপ ফেলে সরাতে হয়েছে। এবার কফি খেতে খেতে আপনার সমস্যার কথা বলুন।

সমস্যা! বলে গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সমস্যা বললে কিছুই বলা হয় না। আমি রয়েছি অন্তিম সংকটের মধ্যে। রামেও মারবে, রাবণেও মারবে।

তবু বলুন।

গোপীনাথ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থাকল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলল, আপনি একজন বাঙালি। এইসব ঘটনার মধ্যে আপনি কী করে এসে পড়লেন বুঝলাম না। তবু আপনাকে বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। তাই বলছি।

গোপীনাথ আদ্যোপান্ত তার সব ঘটনাই সংক্ষেপে বলে গেল।

সুধাকর চাপা গলায় বলল, আপনি এখন কী চান?

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, আপনি আমাকে বাঁচাতে পারবেন না। বাঁচার সম্ভাবনা আমার নেই। শুধু আমার বিষয়সম্পত্তিগুলো যাতে শয়তানদের হাতে না পড়ে এইটেই আমার চিন্তা।

কী করতে চান?

আমার প্রাক্তন স্ত্রীকে অনুরোধ করেছি আমার উত্তরাধিকারী হতে। তিনি রাজি হলে নিশ্চিন্ত হই।

এখনও রাজি হননি?

জানি না। ভায়া মিডিয়া কথা চলছে। একটা টেলিফোন থাকলে জেনে নিতাম।

 টেলিফোন? দাঁড়ান।

বলে সুধাকর উঠে গিয়ে একটা কর্ডলেস রিসিভার এনে গোপীনাথের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা স্ক্র্যাম্বলার। ট্যাপ করার ভয় নেই। করুন।

কিন্তু কলকাতায় এখন তো শেষ রাত।

তাতে কী? আপনার বিপদ চলছে। এখন কারও ঘুম ভাঙানো অপরাধ নয়।

গোপীনাথ সুব্রতর নম্বর ডায়াল করল।

সুব্রত, গোপীদা বলছি।

বলুন গোপীদা।

কী খবর? আমার চিঠি পেয়েছিস?

পেয়েছি।

সোনালি কী বলল?

আগে বলুন, আপনি কেমন আছেন?

এখনও মরিনি, বুঝতেই পারছিস।

 বিপদ কি চলছে?

হ্যাঁ, ভীষণভাবে। সোনালি কী বলল?

নেগেটিভ।

তার মানে? উনি সম্পত্তি চান না।

 বলল?

হ্যাঁ। উনি বললেন, আপনি টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করেন। এটাই ওঁর অপছন্দ।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, ও।

গোপীদা, আমিও বলি, আপনি এসব নিয়ে ভাবছেন কেন? ওসব ভাবনা ছেড়ে দিন।

গোপীনাথ বলল, ঠিক আছে।

ভাল থাকুন গোপীদা। অল গুড উইশেস।

গোপীনাথ ফোনটা অফ করে মলিন মুখে রিসিভার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ধন্যবাদ।

সুধাকর একটু হাসল, সোনালিদেবী রিফিউজ করলেন বুঝি?

হ্যাঁ।

তা হলে কী হবে?

গোপীনাথ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কে জানে। উড়ে পুড়ে যাক।

সুধাকর হঠাৎ চকিতে উঠে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতল। তারপর ফিরে এসে বলল, আপনার পাহারাদাররা ওপরে গেল।

বিবর্ণ মুখে গোপীনাথ বলল, তা হলে কি আমার বিপদ?

না। এখনও নয়। বাঁপাশে একটা ছোট ঘর আছে। সেখানে নতুন পোশাক আর কিছু মেক-আপ আছে। আপনি কি ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারেন?

না।

চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।

ছদ্মবেশে কি কাজ হবে?

অন্তত একটা ঝুঁকি তো নিতেই হবে। আসুন, সময় নেই।

গোপীনাথকে নিয়ে সুধাকর ভিতরের ঘরটায় গেল এবং নিপুণ হাতে তার চেহারার পরিবর্তন ঘটাতে লাগল।

প্রায় আধঘণ্টা বাদে গোপীনাথ আয়নার দিকে চেয়ে নিজেকে একদম চিনতে পারল না। তাকে হুবহু একজন কাফ্রি বলে মনে হচ্ছে।

এবার কী হবে?

সুধাকর মৃদু হেসে বলল, লেট আস টেক এ চান্স। আপনাকে এ বাড়ি থেকে বের করে নিতে হবে। আসুন।

সুধাকরের পিছু পিছু গোপীনাথ বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা দরজা দিয়ে একটি মেয়ে বেরোল অন্য ঘর থেকে।

আপনি মেয়েটার একটা হাত ধরে ধীরেসুস্থে নামুন। তাড়াহুড়ো করবেন না।

 ঠিক আছে।

নীচে গাড়ি আছে। কোনও দিকে তাকাবেন না।

গোপীনাথ মেয়েটার হাত ধরে নামতে লাগল। বুক কাঁপছে, পা টলছে। ধরা পড়ে যাবে নাকি গোপীনাথ?

১২.

উমাকান্ত প্রসাদের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথাভরতি কাঁচাপাকা চুল। একটু আত্মভোলা কাজপাগল লোক। চোখ দুখানা সবসময়েই যেন অন্তর্গত কোনও চিন্তায় তন্ময় হয়ে আছে। বিহারের লোক এই মানুষটি মনোজ ও রোজমারির অনেকদিনের চেনা। পরিচয় জার্মানিতেই। প্রসাদ বিদেশে থাকা পছন্দ করছিলেন না। দেশে ফেরার প্রস্তাবে উজ্জ্বল সম্মতি দিয়েছিলেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের কেমিক্যাল ল্যাব-এর ভার পেয়ে খুব খুশি। প্রসাদের একটাই ছেলে, এখন সে আমেরিকায় পিএইচডি করছে।

সকালে অফিসে এসে প্রসাদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ডুবেছিল মনোজ। একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। মনোজের সন্দেহ হচ্ছে, তাদের তৈরি অ্যালয়টার উদ্দিষ্ট ব্যবহারযোগ্যতা ছাড়াও আরও কিছু উপযোগ আছে। সেটা তারা ধরতে পারছে না। কথাটা তাই নিয়েই।

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলল, এই অ্যালয় সোজাসুজি অন্য কাজে লাগানো সম্ভব নয়। তবে কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন ঘটিয়ে হতে পারে। আপনি বলার পর থেকে গত সাতদিন আমি দিনে প্রায় আঠারো-উনিশ ঘণ্টা ধরে নানারকম টেস্ট করেছি। কিছু পাইনি। তবে এও বলছি, টেস্ট আরও অনেক করা যায়।

পারলে আপনিই পারবেন।

আমি শুধু ভাবছি, এটা বুনো হাঁসের পিছনে ছোটা হচ্ছে কি না, সবটাই পণ্ডশ্রম হবে তো। মনোজ মাথা নেড়ে বলল, তা বোধহয় হবে না। এর আর একটা ইউজ নিশ্চয়ই আছে। ঘটনাগুলি অন্তত তারই সাক্ষী দেয়।

প্রসাদ গম্ভীর মুখ করে বলে, আদ্রেঁর মৃত্যুর কথা বলছেন?

সেটা অনেক ঘটনার মধ্যে একটা।

মুখে আপশোসের একটা চুকচুক শব্দ করে প্রসাদ বলল, এ গ্রেট লস। আদ্রেঁ ওয়াজ এ জিনিয়াস।

আপনি কি ওকে চিনতেন? বলেননি তো কখনও!

চিনতাম। তবে ডেলিগেটদের মধ্যে যে সেও আছে তা জানতাম না। যেমন সেও জানত যে, আমি এই কোম্পানিতে কাজ করি।

আপনি কি জানেন যে, আদ্রেঁর ডেডবডি নিয়ে গিয়ে রোমে একটা অটোপসি করা হয়েছে। এ ভেরি সফিস্টিকেটেড টেস্ট। তাতে ধরা পড়েছে যে, হি ওয়াজ পয়জনড।

তাও শুনেছি। রোজমারি বলেছেন। ঘটনা কি আরও আছে?

আছে। সাক্কি ইনকরপোরেটেড তাদের অর্ডার বহু গুণ বাড়াতে চাইছে। তার পিছনে অন্য মতলব? ঠিক তাই। সাক্কি যা নেয় এ প্রায় তার দশ গুণ। খবরটা ব্যাবসার পক্ষে নিশ্চয়ই ভাল, কিন্তু আরও ভাল হয় যদি আমরা তাদের মতলবটা বুঝতে পারি এবং তাদের আগেই জিনিসটা তৈরি করে বাজারটা ধরে ফেলি।

ওয়াইজ অব ইউ।

সেইজন্যই আপনাকে খাটাচ্ছি।

প্রসাদ মৃদু হেসে বলল, খাটতে আমার কোনওদিনই আপত্তি নেই। কাজ তো আমি ভালইবাসি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার চেয়েও অনেক বড় এক্সপার্ট ছিল আদ্রেঁ।

তা তো ঠিকই। কিন্তু আদ্রেঁ আমাদের নাগালের বাইরে।

 প্রসাদ একটু ভাবল। তারপর বলল, আর একজন আছে।

সে কে? তার নাম গোপীনাথ বসু।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নাম শুনেছি। কিন্তু তিনি তো আদ্রেঁর লাইনের লোক নন।

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলল, না। তবে গোপীনাথ হ্যাজ ইনমেনন্স কোয়ালিটিজ। আরও একটা কারণ হল, সে আদ্রেঁর বন্ধু।

আপনি এত সব জানলেন কী করে?

আদ্রেঁ আমার বন্ধু। গোপীনাথও আমার খুব চেনা। তারা দুজনেই সাক্কিতে কাজ করত। ইন ফ্যাক্ট, সাক্কিতে আদ্রেঁকে ঢুকিয়েছিল গোপীনাথই। বিশাল কোম্পানি, অনেক প্রোজেক্ট।

জানি। আমরা সাক্কির সঙ্গে বিজনেস করি, আপনি কি তা জানেন না?

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলে, আমি ল্যাব নিয়ে পড়ে থাকি, বিজনেসের খবরে আমার ইন্টারেস্ট নেই। তবে গোপীনাথ বসুর সঙ্গে যদি যোগাযোগ করতে পারেন, হি মে বি অব সাম হেলপ।

গোগাপীনাথ কি সাক্কির গোপন প্রোজেক্টের খবর আমাদের দেবে?

প্রসাদ একটু ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, না। তবে হয়তো একটা হিন্ট দিলেও দিতে পারে। ওয়ান হিন্ট উইল বি এনাফ ফর মি। আমি অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছি। কী করতে চাইছি তাই তো জানি না।

মনোজ ভ্রু একটু কুঁচকে রইল কিছুক্ষণ। তারপর অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমিও জানি না। আপনি কি গোপীনাথবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন?

প্রসাদ একটু হাসল, দেয়ার ইজ এ ওয়ে। কিন্তু সেটা কতটা প্র্যাক্টিকেবল হবে জানি।

কী বলুন তো!

আপনার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট মিস সোম গোপীনাথের এক্স ওয়াইফ।

মনোজ অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি? তা হলে তো বলেই মনোজ টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল।

প্রসাদ হাত তুলে মৃদু হেসে বলল, ডোন্ট বি হেস্টি।

লেট আস আস্ক হার।

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলল, ওদের সম্পর্কটা এখন ভীষণ সেনসিটিভ। কেউ কারও নাম শুনতে পারে না।

তা হলে?

মিস সোম আপনাকে হেল্প করবেন না। তবে শি মে গিভ আস দি টেলিফোন নাম্বার অব গোপীনাথ। কিন্তু ও কাজটা আমিই করব।

মনোজ বলল, ঠিক আছে।

প্রসাদ মৃদু হেসে উঠল। বলল, গোপীনাথ যদি ভাইট্যাল হিন্টটা নাও দেয় তা হলেও আমি হাল ছাড়ছি না। চিন্তা করবেন না।

আচ্ছা। থ্যাঙ্ক ইউ।

প্রসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যদি একটা অত্যাধুনিক ল্যাব এবং যন্ত্রপাতি পেতাম তা হলেও না হয় হত। আমাদের ল্যাব তো তেমন সফিস্টিকেটেড নয়।

মনোজ গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছেন। তবু যতদূর যা করা যায়। তারপর দেখা যাবে।

প্রসাদ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল মনোজ। একটু অবাক লাগছে। সোনালি গোপীনাথ বসুর স্ত্রী! কী আশ্চর্য। গোপীনাথ মস্ত মানুষ। জিনিয়াস।

সোনালি এল আরও আধ ঘণ্টা পরে। কয়েকটা জরুরি চিঠিপত্র সই করাতে।

সইগুলো করে দিয়ে মনোজ হঠাৎ বলল, মিস সোম। বসুন। একটু কথা আছে।

সোনালি হয়তো অবাক হল। তবু বসল।

মনোজ ভদ্রতা বজায় রেখে আড়চোখে সোনালির মুখখানা লক্ষ করে নিল। মুখখানা ঠিক স্বাভাবিক নয়। এমনিতেই সোনালির মুখটা বেশ গম্ভীর। তার ওপর এখন একটা বিষাদের ভাব যেন যুক্ত হয়েছে।

প্রসাদ সাবধান করে দিয়ে গেছে, তবু মনোজ কথাটা উত্থাপনের লোভ সামলাতে পারল না। একটু দ্বিধা ও দোলাচলের পর বলল, মিস সোম, আমি যদি দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করি তা হলে কি কিছু মনে করবেন?

সোনালি একটু অবাক হয়ে বলল, কী কথা?

একটু পারসোনাল।

পারসোনাল?

মানে রিগার্ডিং এ পার্সন।

পার্সনটি কে?

গোপীনাথ বসু।

হঠাৎ তার কথা কেন?

মনোজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, উই আর ইন এ জ্যাম। সর্ট অব জ্যাম। আমাদের প্রোডাকশন কিনে নিয়ে কেউ অন্যরকম কিছু কাজ করছে।

ও। কিন্তু এসবের সঙ্গে তো আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

হয়তো একটু আছে। কিন্তু সে-কথা পরে। আমাদের সমস্যাটার কথা একটু বুঝে দেখুন। আমাদের ধারণা হয়েছে এই অ্যালয় থেকে কেউ আরও কোনও একটা প্রফিটেবল জিনিস তৈরি করছে। সেটা করছে সাক্কি।

সোনালি গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে যাচ্ছিল। বলল, কিন্তু আমি কী করতে পারি?

এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারত আদ্রেঁ। ইন ফ্যাক্ট, কাজটা সে-ই করছিল। কিন্তু আদ্রেঁ এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আদ্রেঁ ছাড়া আর যে পারে সে হল গোপীনাথ বসু।

সোনালি হঠাৎ শুকনো মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারি না।

মনোজ অপ্রতিভ হয়ে বলল, আই অ্যাম সরি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম—

সোনালি সামান্য হাঁফ-ধরা গলায় বলল, দেখুন, আমি অফিসিয়াল কাজকর্মের বাইরে যেতে চাই না।

মনোজ বেকুবের মতো চেয়ে রইল। প্রসাদের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করাটা মস্ত ভুল হয়ে গেল হয়তো। বড্ড বোকা বোকা লাগল নিজেকে।

সোনালি বলল, আর কিছু বলবেন?

না না। আপনাকে ডিস্টার্ব করেছি বলে ক্ষমা করবেন।

সোনালি আর একটাও কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল।

মনোজ ঘটনাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য এক কাপ কফি খেল। তারপর কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বিকেলের দিকে পিআরও সুব্রতর একটা ফোন এল।

স্যার, একটু আসতে পারি?

এসো।

সুব্রত এল। ছেলেটিকে মনোজের বেশ পছন্দ। স্মার্ট, চটপটে, হাসিখুশি। বসে হাসিমুখে বলল, আপনি কি কারও সম্পর্কে কোনও ইনফর্মেশন চান?

বুঝতে না পেরে মনোজ বলল, কার কথা বলছ?

সুব্রত সামান্য দ্বিধা করে বলল, শুনলাম আপনি গোপীনাথ বসুর ইনফর্মেশন চাইছেন।

 মনোজ বলল, চাইছিলাম। কিন্তু তোমাকে কে বলল?

মিস সোম।

মনোজ অবাক হয়ে বলে, মিস সোম। আশ্চর্য! উনি তো মনে হল, গোপীনাথ প্রসঙ্গে অসন্তুষ্টই হলেন।

সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, শি হ্যাজ হার গ্রাজ।

তা তুমি কী জানো?

আমি বলতে এসেছি যে, গোপীনাথ বসু টেলিফোনে অ্যাভেলেবল নন।

 কেন, ওঁর টেলিফোন নেই?

আছে। কিন্তু উনি একটা ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আছেন।

তুমি কী করে জানলে?

গোপীনাথ বসুকে আমি ছেলেবেলা থেকে চিনি আর দাদা বলে ডাকি।

ওঃ, দ্যাটস গুড। কিন্তু বিপদের কথা কী বলছিলে?

 উনি একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। আপাতত, ওঁর প্রাণসংশয়।

মনোজ একটু ভাবল। গোপীনাথ বসুকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না, সুতরাং তার বিপদে বিচলিতও সে হচ্ছিল না। সে বলল, বিপদটা কীরকম এবং কেন তা জানো?

খানিকটা জানি। ভিকিজ মব নামে একটা গুন্ডার দল ওঁকে চেজ করছিল। তারপর সাক্কির কর্তারাও ওঁর পিছনে মাফিয়া লাগিয়েছে।

কিন্তু কেন?

কারণ হল আদ্রেঁর মৃত্যু এবং তার গবেষণার কাগজপত্র। গোপীদা সেগুলো নিরাপদে রাখতে গিয়ে উলটে বিপদে পড়ে গেছেন।

মনোজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেঁচে আছেন কি না জানো? যেরকম গুন্ডার কথা বলছ তাতে তো মনে হচ্ছে মর্টাল ডেনজারের মধ্যে আছেন।

হয়তো তাই।

মনোজ কাধ একটু ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি আমার হয়ে সোনালিকে বোলো যে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করেছি বলে আমি দুঃখিত।

ঠিক আছে স্যার, বলে দেব।

সুব্রত চলে যাওয়ার পর ঘড়ি দেখে মনোজ তার ফোন তুলে নিয়ে সোজা রোমের একটা নম্বর ডায়াল করল নোটবই দেখে।

কিছুক্ষণ পর একটা গমগমে গলা ফোনে ভেসে এল, হ্যালো… হ্যালো…হ্যালো…

মনোজ একটু হাসল। জার্মান ভাষায় বলল, গলাটা নামাও মার্ক।

মার্ক বলল, আরে সেন নাকি? কী খবর?

খবর ভাল নয়। আমাদের একটা বাজে সময় যাচ্ছে।

সেরকম তো সকলেরই হয়। ও কিছু নয়।

শোনো, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

বলে ফেলো।

তুমি সাক্কির একজন মস্ত কর্তা। খবরটা তোমার জানা উচিত।

কী খবর?

তোমাদের একজন সায়েন্টিস্ট আছে, গোপীনাথ বসু। চেনো?

কে না চেনে? সবাই চেনে। বিগ ম্যান।

তার কী খবর?

কেন, খবর তো ভালই হওয়ার কথা।

 সে কি অফিসে আসে?

এক মিনিট ধরে থাকো। খবর নিয়ে বলছি।

মনোজ ধরে রইল।

একটু বাদে মার্ক বলল, না আসেনি আজ।

গতকাল কি এসেছিল?

 না। মনে হচ্ছে ছুটি নিয়ে কোথাও গেছে। ওর বাড়িতে রিং করে দেখতে পারো।

তাতে লাভ নেই। তুমি আরও একটু খোঁজ নাও। আমি বাড়ি যাচ্ছি। রাতে আমাকে আমার বাড়িতে ফোন করে খবরটা জানাও জরুরি।

ঠিক আছে।

মনোজ তার কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়ল। বাড়িতে ফিরে ডিনার খেয়ে নিল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল।

রাত প্রায় দশটা নাগাদ মার্কের ফোন এল।

কী জানতে চাও?

মনোজ বলল, সবকিছু।

সবকিছু আমি জানি না। তবে আমি অফিশিয়াল সোর্সে খবর নিয়ে জেনেছি যে, সে বাড়িতে নেই, অফিসে আসছে না।

আনঅফিসিয়ালি কী জানো?

সেটা তোমাকে আনঅফিশিয়ালি বলছি। লোকটা খুব সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে ছিল।

ছিল? পাস্ট টেন্স?

তাঁ। পাস্ট টেন্স। আমার সঙ্গে রোমের আন্ডারওয়ার্ল্ডের যোগাযোগ আছে। আমি তাদের কাছে জেনেছি, মিস্টার বোস অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে একটা প্রায় অসম্ভব অবস্থা থেকে পালিয়ে গেছে। নইলে মাফিয়া আর ভিকিজ মব তাকে প্রায় শেষ করে এনেছিল।

মাই গড! পালাল কীভাবে?

বোধহয় কারও সাহায্যে। আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। জানি না।

তোমাকে ধন্যবাদ। শোনো, গোপীনাথ বসুকে আমার খুব দরকার। কোনও খবর পেলে জানাবে?

জানাব। তবে সে বোধহয় সাক্কিতে ফিরবে না। সেটা সম্ভব নয়। সাক্কি চারদিকে ওকে খুঁজছে। এটাও আনঅফিশিয়াল।

১৩.

রুমিং হাউস থেকে বেরিয়ে এসে যখন সামনের চাতালে একটা লাল টুকটুকে ছোট্ট স্পোর্টস কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল গোপীনাথ, তখন তার বাঁ হাত ধরে যুবতীটি বারবার ঢলে পড়ছে তার গায়ে, ভীষণ মজার কথা বলছে এবং হাসছে। তারও হাসা এবং কিছু কথা বলা উচিত। কিন্তু গোপীনাথ কিছুতেই হাসতে পারছে না।

গোপীনাথ ভিতু নয়। বরং অত্যন্ত সাহসী। কিন্তু গত কয়েক দিনের কিছু ঘটনা তার ভিতরটাকে একেবারে নির্জীব করে ফেলেছে। আদ্রেঁর মৃত্যু এবং তার কাজকর্ম সম্পর্কে সাক্কির অতি-উৎসাহ। তার ওপর সোনালির শীতল প্রত্যাখান। গোপীনাথের ভিতরে একটা ভাঙচুর হয়েই গেছে। তাই সে যেন নিজের বশে ছিল না। যুবতীটি যথেষ্ট ভাল অভিনয় করছিল, কিন্তু গোপীনাথ পারছিল না। সে এর সঙ্গে কেন যাচ্ছে, কেন এরা তাকে ছদ্মবেশ পরিয়েছে কিছুই সে বুঝতে পারছিল না। সে তাই অভিনয়ও করছিল না।

চাতালটা স্বাভাবিক। দু-চারটে গাড়ি পার্ক করা। দু-চারজন লোক এধারে ওধারে। কোনও অস্বাভাবিকতা নেই।

মেয়েটা গাড়ির দরজা খুলল। গোপীনাথ বাকেট সিটে বসে পড়ল নির্বিকারভাবে। মেয়েটা স্টিয়ারিং ধরে বসল। খুব স্বাভাবিকভাবেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ধীর গতিতে ফটক পেরিয়ে বা ধারের রাস্তা ধরল।

গোপীনাথ ইতালিয়ান ভাষায় জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

কোথাও যাচ্ছি। চুপ করে থাকো।

তুমি কে?

লুসিল।

তুমি কার লোক?

তার মানে?

ও লোকটা কে?

লুসিল একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার বস।

লোকটা বাঙালি?

হ্যাঁ।

বস মানে কী? তোমরা কি সরকারি লোক?

না।

তা হলে তোমরা আসলে কারা?

সে কথা বস হয়তো তোমাকে কখনও বলবে। এখন চুপ করে থাকো। আমার মনে হচ্ছে, একটা গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।

গোপীনাথ আয়নার দিকে চেয়ে বলল, কোন গাড়িটা?

একটা কালো সিত্রঁন।

গোপীনাথ কিছুক্ষণ গাড়িটাকে লক্ষ করল আয়নায়। মেয়েটা কয়েকটা মোড় ফিরল ইচ্ছে করেই। গাড়িটা লেগে রইল পিছনে। গোপীনাথ মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ, গাড়িটা পিছু নিয়েছে। তুমি কি পারবে ওটাকে ঝেড়ে ফেলতে?

মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর। লম্বাটে, মেদহীন, নমনীয় চেহারা। ব্যালেরিনার মতো দেখতে। মুখখানাও বেশ সুন্দর। কিন্তু এসব ব্যাপারে কতখানি দক্ষ তা বোঝা যাচ্ছে না। গোপীনাথ বলল, শোনো সুন্দরী লুসিল, অত বেশি পাক খেয়ো না। তা হলে ওরা জানতে পারবে যে তুমি ওদের অস্তিত্ব টের পেয়েছ।

তা হলে কী করতে হবে?

স্বাভাবিক গতিতে চালাও। টাইবার নদীর দিকে চলল। ওদের বুঝতে দাও, আমাদের পালানোর কিছু নেই।

মেয়েটা মৃদু একটু হেসে বলল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তোমাকে ওই জয়েন্ট থেকে বের করে আনতে আমাদের অনেক মেহনত আর ঝুঁকি গেছে। একটা বোকামির ফলে ঘটনাটা কেঁচে গেলে সর্বনাশ।

কিন্তু তুমি গাড়িটা নাটকীয়ভাবে চালিয়ো না। যে-কোনও একটা রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ চালাও। তোমার যদি ব্যাক আপ থেকে থাকে তবে কার-টেলিফোনে তাকে খবর দাও। যদি গাড়ি সুইচ করার ব্যবস্থা থাকে, তবে ভালই। না হলে একটু মুশকিল আছে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে দু-তিনটে গাড়ির ব্যবস্থা রাখা ভাল।

মেয়েটা একবার গোপীনাথের দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, তোমার কি এরকম সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করার অভিজ্ঞতা আছে?

গোপীনাথ ম্লান একটু হেসে বলল, আমি নিরীহ একজন প্রযুক্তিবিদ মাত্র। আমি বিপজ্জনক জীবন যাপন করি না। তবে এরকম কয়েকটা বিপদে আমাকে পড়তে হয়েছে। শোন, রোম আমার ভীষণ চেনা শহর। তুমি স্টিয়ারিং আমার হাতে দাও। হয়তো তোমার চেয়ে আমি সিচুয়েশনটা একটু বেশি সামাল দিতে পারব।

কীভাবে সামাল দেবে? তোমার ইগো তো খুব স্ট্রং দেখছি।

 ইগো নয়। অস্তিত্বের সংকট থেকে আমি কিছু বেশি দক্ষতার অধিকারী।

তুমি চুপ করে বসে থাকো। এটা তোমার মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। তুমি অতিথি।

তারা রোমের প্রধান সড়কগুলিতেই মাঝারি গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটু পিছনে সিত্রঁন গাড়িটা। সামনের সিটে দু’জন কালো সুট পরা লোক বসে আছে। দু’জনেরই কালো টুপি কপাল পর্যন্ত ঢাকা। দু’জনেরই চোখে কালো চশমা।

গোপীনাথ বলল, তুমি বোধহয় তেমন ভয় পাওনি।

আমি অকারণে ভয় পাই না।

অকারণে?

এখন পর্যন্ত তো তাই। ওরা পিছু নিয়েছে, কিন্তু এখনও অবধি তোমাকে ছিনতাই করার তো চেষ্টা করেনি।

করলে?

দেখা যাবে।

লুসিল, আমার একটু টয়লেটে যাওয়া দরকার।

টয়লেট! মাই গড!

খুবই দরকার।

দাঁড়াও দাঁড়াও, এখন টয়লেটে যাওয়া মানেই হল—

প্লিজ! কতগুলো ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক চলে না।

বুঝতে পারছি।

মেয়েটা হঠাৎ বাঁ ধারে একটা রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিল। বলল, তুমি কোনও ফন্দি করছ নাকি?

না। আমার যা অবস্থা, ফন্দি করে লাভ নেই।

একটা ছোট হোটেলের চত্বরে গাড়িটা ঢুকিয়ে দিল লুসিল। বলল, চলো।

গোপীনাথ গম্ভীর মুখে নামল। তার বাথরুম পায়নি এবং সে সত্যিই একটা প্ল্যান করেছে। সেটা কতদুর ফলপ্রসূ হবে তা সে জানে না।

লুসিল তাকে সোজা রিসেপশনের পিছনে টয়লেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, পালানোর চেষ্টা করবে না তো! করে লাভ নেই। এটা আমার কাকার হোটেল। চারদিকেই আমাদের লোক।

গোপীনাথ মৃদু হেসে বলল, তোমার মতো সুন্দরীকে ছেড়ে পালায় কোন আহাম্মক?

টয়লেটে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল গোপীনাথ। বাস্তবিক সে কোথায় যাবে এবং কী করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু তার মনে হচ্ছে–কিংবা বলা যায় মনের মধ্যে একটা অস্পষ্ট অস্বস্তি হচ্ছে–সে আর একটা জালে জড়িয়ে পড়ছে না তো?

টয়লেটের আয়নায় নিজের ছদ্মবেশে ঢাকা চেহারাটা দেখে সে একটু আঁতকে উঠল। এরকম অদ্ভুত ছদ্মবেশ তাকে কেন পরানো হল কে জানে? এরকম ছদ্মবেশ বরং লোকের দৃষ্টি বেশিই আকর্ষণ করে। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল গোপীনাথ। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ঘুরে চেয়ে অবাক হয়ে দেখল, একটা বেঁটে এবং স্বাস্থ্যবান ইতালিয়ান যুবক তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

গোপীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, কী চাও?

তুমি একটু বেশি সময় নিচ্ছ।

 তাতে কী? আমার কোথাও যাওয়ার তাড়াহুড়ো নেই। তুমি কে?

আমি লুসিলের জ্ঞাতি ভাই। আমরা তোমাকে পালাতে সাহায্য করছি।

 গোপীনাথ একটা শ্বাস ফেলে বলল, তা হয়তো করছ, কিন্তু তোমাদের সব কাজই কাঁচা এবং অ্যামেচারিশ। আমাদের ফলো করে এসেছে একটি সিত্রঁন গাড়ি, লুসিল সেটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। তার ওপর কোথাও গাড়ি সুইচ করার ব্যবস্থা রাখেনি। আমাকে এরকম কাফ্রি সাজানোরই বা মানে কী?

ওসব আমরা জানি না। আমাদের যা করতে বলা হয়েছে আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে করেছি।

এই অপারেশনটা করাচ্ছে কে?

 আমাদের বস।

তোমরা কারা?

হয়তো তোমার বন্ধু।

গোপীনাথ কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, নির্বোধের বন্ধুত্বের চেয়ে বুদ্ধিমানের শত্রুতাও ভাল। তোমরা আমাকে বের করে এনেছ কি খোলা ময়দানে খুনির সামনে এগিয়ে দেওয়ার জন্য?

আমাদের বস যদি তাই চান তবে তাই হবে।

তোমাদের বসের সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার। কে তোমাদের বস?

বিগ ম্যান। এখন চলে এসো, আমাদের অনেক জায়গায় যেতে হবে।

গোপীনাথকে নিয়ে ছেলেটা বেরিয়ে এল। বাইরে মেয়েটা রিসেপশনের চেয়ারে বসে মন দিয়ে কিছু নোট করছে। একবার চোখ তুলে তাকাল। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ভয় পেয়েছ নাকি?

না। তবু দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

মেয়েটি হেসে বলল, ওই সিত্রঁন গাড়িটা ওখানে পার্ক করা আছে। ওতে যারা ছিল তারা আমাদেরই লোক। ব্যাক আপ কথাটা বোঝো। ওরা হল আমাদের ব্যাক আপ। এখন ওরা। ডাইনিং হলে বসে কফি খাচ্ছে।

গোপীনাথ একটু বেকুব হয়ে গেল। বলল, এরপর আমরা কোথায় যাব?

সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত এই হোটেলেই একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে।

 গোপীনাথ একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলল, বাঁচা গেল। এবার কি আমি আমার মুখের মেক-আপ তুলতে পারি?

পারো। কিন্তু জানালা দিয়ে বেশি উকিঝুঁকি মেরো না। তোমার খোঁজখবর হচ্ছে। জুতো জামা পরেই থেকো, যে-কোনও সময়ে পাঁচ মিনিটের নোটিসে রওনা হতে পড়তে পারে। লুইজি, বোসকে তার ঘরে নিয়ে যাও।  

লুইজি হল বেঁটে ছেলেটা। গোপীনাথকে লিফটে করে চারতলায় এনে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে গেল, রুম সার্ভিস চালু আছে। খাবার বা পানীয় ঘরেই আনিয়ে নিয়ো। ঘরের বাইরে না যাওয়াই নিরাপদ। আর হ্যাঁ, এ ঘরে কিন্তু টেলিফোন নেই। শুধু ইন্টারকম।

গোপীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, কেন নেই?

নিরাপত্তার কারণে। টেলিফোন কল ট্রেস ব্যাক করা যায়। ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী?

গোপীনাথ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মেক আপ তুলল। জামাকাপড় বদলানোর উপায় নেই। তাই ঘরের বিছানায় জামাকাপড় সমেত শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ওই বাঙালিটি নিছক তাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য এতটা ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করে এনেছে। বরং এর পিছনে আর একটা চক্র যে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে তাতে সন্দেহ নেই। এত তাড়াতাড়ি সবাই স্বার্থের গন্ধ কী করে টের পেয়ে গেল তা বুঝতে পারছে না গোপীনাথ।

কিন্তু এই গণ্ডিবদ্ধ জীবনটাও তার ভাল লাগছে না। তাকে ঘিরে, তাকে নিয়ে কিছু ঘটনা ঘটছে যেগুলোর ওপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এটাই বা সে মেনে নেবে কী করে?

ঘণ্টাখানেক বাদে সে রুম সার্ভিসকে ডাকল ইন্টারকমে। বেশ রাজসিক একটা লাঞ্চের অর্ডার দিল। যতদূর সম্ভব এদের ঘাড় ভাঙা যাক।

লাঞ্চ আসতে সময় লাগল প্রায় চল্লিশ মিনিট। সত্যিই এলাহি লাঞ্চ। তিনজন ওয়েটার তিনটে ট্রে-তে বয়ে আনল। ইতালিয়ান আর ফরাসি খাবার।

গোপীনাথ খেল। ফেললও অনেক। এত খাওয়া একজনের পক্ষে তো সম্ভব নয়।

লাঞ্চের পর সে একটু ঘুমিয়ে নিল। ঘুমের মধ্যে সে নানা ধরনের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নগুলোর কোনও মানে হয় না। অসংলগ্ন প্রলাপের মতো।

সন্ধের পর দরজায় টোকা পড়ল। সাড়া দিতেই লুইজি এল ঘরে। তার হাতে একটা সুটকেস।

এটা কী?

তোমার জিনিসপত্র। সবই নতুন কেনা হয়েছে।

গোপীনাথ অবাক হল। এরা তার পিছনে যথেষ্ট খরচ করছে। পরে সুদে আসলে তুলবে বোধহয়।

লুইজি সুটকেসটা বিছানায় রেখে ডালা খুলে দিয়ে বলল, দেখে নাও। পাজামা-সুট থেকে শুরু করে সবকিছু আছে। শেভিং সেট, কোলন, সবকিছু।

ধন্যবাদ। রুমিং হাউসে আমার অনুপস্থিতি কি ধরা পড়েছে?

যতদুর জানি, এখনও কেউ টের পায়নি। ল্যান্ডিং-এর পাহারা বদল হয়েছে। তবে বেশিক্ষণ আর নয়। টের পেল বলে।

আজকাল পেশাদার গুন্ডারা এত অসাবধানি হয়, জানা ছিল না।

লুইজি একটু হাসল। বলল, আমাদের চালাকিটা এতই ছোট আর সাধারণ যে, ওরা এরকম ঘটতে পারে বলে ভাবতেই পারেনি। বাই দি বাই, তুমি কি বেনভেনুটিকে চেনো?

কে বেনভেনুটি?

তোমাকে যে দু’জন পাহারা দিচ্ছিল তাদের একজন।

 সে আসলে কে?

বেনভেনুটি একসময়ে দুরন্ত বক্সার ছিল। অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রাইজ ফাইটিং-এও দুনিয়া কাপিয়ে দিয়েছিল।

বক্সিং! ওঃ হ্যাঁ, নামটা শুনেছি বটে।

আমি ওর খুব ফ্যান। দুঃখের বিষয়, বেনভেনুটি এখন একজন মাফিয়া ডনের হয়ে গুন্ডামি করে বেড়ায়। প্রতিভার কী অপচয়।

গুন্ডামি করে কেন?

কপাল। রোমের একটা নাইট ক্লাবে মারপিট করে একটা লোককে খুন করে বসেছিল। জেল তো হতই, ফাঁসিও হতে পারত। সেই সময় বেনভেনুটি ডনের কাছে আশ্রয় নেয়। বক্সিং আর পারত না। তবে গুন্ডামিটাই এখন ওর রুজি রোজগার।

তুমি কি ওর খুব ভক্ত?

লুইজি হাসল, খুব। আমিও বক্সার। যে-কোনও বক্সারই জানে বেনভেনুটির মধ্যে কী সাংঘাতিক সম্ভাবনা ছিল। আমাদের স্বপ্নের মানুষ। তোমার সৌভাগ্য যে ওরকম একটা লোক তোমায় পাহারা দিচ্ছিল।

বেনভেনুটি কার হয়ে কাজ করছিল জানো?

না। তবে ও ভিকিজ মব-এর লোক নয়।

তা হলে কি সাক্কির?

 হলেও হতে পারে।

লুইজি, আমি অনেক কিছুই জানি না। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

করো।

সকালে একজন বাঙালি আমাকে উদ্ধার করে। সে কে?

লুইজি অবাক হয়ে বলে, ও তো দাতা।

দাতা!

হ্যাঁ। ওই তো দাতা। আমাদের বস।

১৪.

শুভ আর মৈত্রেয়ী এয়ারপোর্টে ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ রোজমারি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরবে।

রোজমারি প্রায়ই সিঙ্গাপুর যায়। ওখানে ওর এক বোন থাকে, তার স্বামী আন্তর্জাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা। বোনও ওই কোম্পানিরই একজিকিউটিভ। সিঙ্গাপুরে রোজমারির কিছু কেনাকাটাও থাকে। মাসে বা দু’মাসে একবার কয়েক দিনের জন্য তার সিঙ্গাপুরে যাওয়া চাই-ই।

শুভ বলছিল, আচ্ছা, রোজমারি দুনিয়ার সব বড় শহরেই তো যায়, তবু সিঙ্গাপুর ওর এত প্রিয় কেন বলো তো!

মৈত্রেয়ী বলল, কে জানে বাবা, আমার তো মনে হয় ওর বোনের বাচ্চাকে বোধহয় ভালবাসে, নিজের তো নেই। তাই ঘনঘন বোনের কাছে যায়।

যাঃ, ওটা কোনও কারণ হতে পারে না। একটা বাচ্চাকে ভালবাসে বলেই দু’দিন পর পর এক কাঁড়ি টাকা গচ্চা দিয়ে এত দূর যায় কখনও?

সিঙ্গাপুর আর কী এমন দূর। আর টাকাটা আমাদের হিসেবে অনেক হলেও রোজমারির কাছে কিছুই নয়। ওর বোনপোটাকে খুব ভালবাসে রোজমারি। গতবার খ্রিসমাসে এসেছিল, কী ফুটফুটে দেখতে। খুব চটকাতে ইচ্ছে করছিল।

আমার মনে হয় বাচ্চা ছাড়াও অন্য কারণ আছে।

 আছেই তো। মার্কেটিং। সিঙ্গাপুর থেকে কত কী নিয়ে আসছে প্রতি মাসে।

শুভ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, দেখো মৈত্রেয়ী, রোজমারির অনেক টাকা। কিন্তু কখনও বেহিসেবি নয়। রোজমারি কখনও কোনও ফ্যান্সি সেন্টিমেন্টের জন্য টাকার অপচয় করবে না। আমি রোজমারিকে কৃপণ বলছি না, কিন্তু ভীষণ হিসেবি।

তোমার অত মাথা ঘামানোর দরকার কী? তুমি তো আর গোয়েন্দা নও। বেশ করে সিঙ্গাপুরে যায়। এর পরের বার আমাকেও সঙ্গে নেবে বলেছে।

তাই বলো! সেইজন্যই রোজমারির পক্ষ নিচ্ছ। কিন্তু কথাটা একটু ভেবে দেখো।

আচ্ছা, একজন মানুষ ঘনঘন সিঙ্গাপুর যায়–এর মধ্যে ভেবে দেখার কী আছে বলো তো! তুমি একটু বেশ অদ্ভুত আছ কিন্তু।

শুভ একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ স্বগতোক্তির মতো করে বলল, ভাগ্যিস তুমি বক্কেশ্বরের কথা জানো না।

মৈত্রেয়ী ভ্রু কুঁচকে বলল, বক্কেশ্বর। সেটা আবার কে?

একটা বেঁটে মতো লোক। বেশ ফরসা আর টাইট চেহারা। খুব স্মার্ট।

সে আবার কে?

সে-ই বক্কেশ্বর।

তার মানে?

 শুভ একটুও না হেসে বলল, গত চারবার লোকটাকে লক্ষ করেছি।

 কোথায় লক্ষ করেছ?

শুভ বলল, আমার ভিতরে বোধহয় একজন ন্যাচারাল গোয়েন্দা আছে। লক্ষ করা এবং ডিডিউস করা আমার ভীষণ প্রিয় পাসটাইম।

থাক, আর নিজের সম্পর্কে অত সার্টিফিকেট দিতে হবে না। লোকটা কে?

তার আমি কী জানি।

এই যে বললে বক্কেশ্বর!

ওঃ, নামটা আমিই দিয়েছি। কেন যে লোকটাকে দেখলেই আমার বক্কেশ্বর নামটা মনে আসে।

কিন্তু লোকটাকে নিয়ে ভাবছ কেন?

ভাবছি কে বলল? আমি ভাবছি রোজমারিকে নিয়ে।

তা হলে বক্কেশ্বরবক্কেশ্বর করছ কেন?

গত চার মাসে রোজমারি যতবার সিঙ্গাপুরে গেছে ততবারই একই ফ্লাইটে বক্কেশ্বরও গেছে।

মৈত্রেয়ী প্রথমটায় একটু অবাক হলেও সামলে নিয়ে হাসল। সে বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে। বলল, গত চার মাসে রোজমারি সিঙ্গাপুর গেছে মোট তিনবার।

তিনবার?

পাক্কা হিসেব। চার মাসে তিনবার সিঙ্গাপুরে যাওয়াটা বড় কথা নয়। সিঙ্গাপুরে আরও অনেকেই আরও বেশি ঘনঘন যায়। অনেকেরই বিজনেস ইন্টারেস্ট আছে। আমাদের এক কাকু আছেন, যিনি প্রতি সপ্তাহে হংকং যান। বুঝেছ?

হ্যাঁ। এটা আমার মাথায় খেলেনি।

সুতরাং তোমার গোয়ন্দাগিরিটা জলে গেল।

তুমি বলছ বক্কেশ্বরও খুব ঘনঘন সিঙ্গাপুর যায় এবং গত চারবার রোজমারির সঙ্গে তার সিঙ্গাপুর যাওয়াটা কোনও সন্দেহজনক ঘটনা নয়?

ঠিক তাই। তবু লোকটাকে আমি দেখতে চাই।

শুভ যেন খুব লজ্জিত হয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, আসাটাও তাই?

তার মানে?

লোকটা

 শুধু যায় না, আসেও।

একই ফ্লাইটে?

অবশ্যই।

মৈত্রেয়ী শুভর দিকে চেয়ে বলল, ইউ মাস্ট বি কিডিং।

শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ মুখ করে বলল, আমার দুঃখটা কী জানো?

কী?

তোমারও দু’খানা ড্যাবডেবে চোখ আছে। সে দুটোকে মাশকারা, কাজল ইত্যাদি দিয়ে সেবাও কম দাও না। কিন্তু সে দুটোর আসল কাজটায় কেন যে এত ফাঁক থাকে!

তুমি শুধু ফাজিলই নও, অসভ্যও। সাজগোজ নিয়ে কথা বলা এটিকেট নয়।

শুভ নিপাট ভালমানুষের মতো বলল, সাজতে কেউ বারণ করেনি। বারণ করলেই বা শুনছে কে? আমি বলছি ভগবানের দেওয়া ইন্দ্রিয় সকলের সদ্ব্যবহার করা উচিত। চোখ শুধু কটাক্ষ করার জন্য তো নয়, পর্যবেক্ষণও তার আর একটা কাজ।

আহা, আমি বুঝি তোমার চেয়ে কম অবজার্ভ করি? তুমিই তো বরং গত শুক্রবার রাস্তা পেরোনোর সময় স্কুটারের ধাক্কা খেয়েছিলে।

আচ্ছা, লেট আস মেক পিস। কথা হল, গত চারবার রোজমারির ফ্লাইটে আমি লোকটাকে যেতে এবং আসতে দেখেছি। রোজমারির সঙ্গে লোকটার আলাপ নেই, কেউ কাউকে চেনে বলেও মনে হয় না। না, একটু ভুল হল। রোজমারি চেনে বলে মনে হয় না। কিন্তু লোকটা সম্পর্কে আমি শিয়োর নই।

রহস্য পুষে না রেখে রোজমারিকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতে।

অবাক হয়ে শুভ বলল, কেন জিজ্ঞেস করব? কিছু তো ঘটেনি। জাস্ট কো-ইনসিডেন্স।

কিছুই যদি ঘটেনি তা হলে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?

দুটো কারণে। রোজমারিকে সম্প্রতি ভুল জন্মদিনে লাল গোলাপ পাঠানো এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের আচমকা গুরুত্ব বৃদ্ধি। আমার মনে হচ্ছে ম্যাডাম রোজমারির আরও একটু সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।

রোজমারিকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। উনি নিজের দেখভাল ভালই করতে পারেন।

শুভ একটু চুপ করে থেকে মৈত্রেয়ীর দিকে চেয়ে বলল, তোমার কি সত্যিই তাই মনে হয়?

মৈত্রেয়ী একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এই তো বলছ তেমন ঘটনা কিছু ঘটেনি বলে রোজমারিকে কিছু বলোনি। আবার বলছ রোজমারির সতর্ক হওয়া দরকার।

শুভ কৃত্রিম দুঃখের সঙ্গে বলল, আমার দোষ কী জানো? কাউকেই কিছু ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে পারলাম না। সেইজন্যই না বিদিশা কোনওদিন আমার ভালবাসা টেরই পেল না। বিয়ে করে বসল একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্টকে।

মৈত্রেয়ী হেসে ফেলে বলল, আর ইয়ারকি করতে হবে না। বিদিশার গল্পটা পুরো গুল।

শুভ মাথা নেড়ে বলল, গুল! বলো কী? আমার আজও তার জন্য কী ভীষণ কষ্ট হয়। অথচ সে তো অপ্রাপ্য ছিল না। শুধু একটু বুঝিয়ে বললেই হত।

মৈত্রেয়ী হেসে বলল, আমি বিদিশা নই। বুঝতে পারি।

কী বুঝতে পারো?

 তুমি একটু বোকা আর একটু পাগল। যা বলছিলে বলো।

 শুনবে? বোরিং নয় তো!

 বোরিং হবে কেন? এ তো রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের গল্প।

গল্প হবে কেন? একটা হাইপোথেসিস বলতে পারো, বেসড অন সলিড ফ্যাক্টস।

কিন্তু ফ্যাক্টগুলো এলোমেলো, ক্যাওটিক।

তাও ঠিক। প্রথম অবস্থায় প্যাটার্নটা বোঝা যায় না। তবে আমার মনে হচ্ছে, রোজমারি ইজ বিয়িং টেইলড। এভরিহোয়ার।

রোজমারিকে ফলো করে কী হবে?

 সেইজন্যই তো সিঙ্গাপুর যাওয়াটার একটা ব্যাখ্যা খুঁজছিলাম। রোজমারি একটা বাচ্চাকে আদর করতে প্রায়ই সিঙ্গাপুর যাচ্ছে, আর আর-একটা লোক কাজকর্ম ফেলে এক কাঁড়ি টাকা খরচ করে তাকে ফলো করছে, এটা আমার কাছে বাড়াবাড়ি ঠেকছে।

বাড়াবাড়িই তো। লোকটা মোটেই রোজমারিকে ফলো করছে না। সে যাচ্ছে নিজের কাজে। তোমার উর্বর মাথা বাকিটা বানিয়ে নিচ্ছে।

শুভ চিন্তিতভাবে চেয়ে রইল মৈত্রেয়ীর মুখের দিকে। তারপর বলল, সে যাই হোক, আজ রোজমারির সঙ্গে তার গাড়িতে তুমিই যাবে। আমি মোটরবাইক এনেছি।

হ্যাঁ, সেটাও জিজ্ঞেস করা হয়নি তোমাকে। মোটরবাইক এনেছ কেন?

আমি বক্কেশ্বরকে ফলো করব।

মৈত্রেয়ী চোখ বড় করে বলল, বলো কী? তোমার কী দরকার লোকটাকে ফলো করার?

কারণ আছে। আই ওয়ান্ট টু নো।

শোনো শুভ, মোটরবাইক তুমি সবে কিনেছ। এখনও হাত সেট হয়নি। পাগলামি কোরো না।

তুমি কি জানো নলেজ জিনিসটা মানুষের মস্ত বড় হাতিয়ার?

এটাকে নলেজ বলে না শুভ, বড়জোর ইনফর্মেশন বলা যায়।

ইনফর্মেশনও নলেজ। তবে ছোট মাপের, এই যা।

বাড়াবাড়ি কোরো না শুভ। পুলিশের কাছে বলে দিলে তারাই হয়তো লোকটার খোঁজ করবে।

পুলিশ কেন ইন্টারেস্ট নেবে? লোকটা তো এখনও কোনও ক্রাইম করেনি। এমনকী একমাত্র রোজমারির পিছু পিছু সিঙ্গাপুর যাওয়া-আসা ছাড়া বিশেষ কোনও সন্দেহজনক কাজও করেনি।

ওঃ, তোমার সঙ্গে কিছুতেই পারা যায় না।

শুভ একটু হাসল, রোজমারি আমার বস, তার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব আমার নয়। কিন্তু রহস্যের গন্ধ পেলে আমি কেন যেন একটু চনমনে হয়ে উঠি। ছেলেবেলা থেকে ডিটেকটিভ বই আর থ্রিলার পড়ে পড়েই বোধহয় এরকমটা হয়েছে।

বুঝেছি। এখন খোঁজ নাও তো, ফ্লাইট এত দেরি করছে কেন? ল্যান্ড করার শিডিউল টাইম তো ঘণ্টাখানেক আগে পেরিয়ে গেছে।

আধ ঘণ্টা লেট তো ছিল। হয়তো আরও একটু বেড়েছে। ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। ফ্লাইট যখন আসবার আসবে। আমাদের কাজ হল অপেক্ষা করা।

তা হলে চলো, গাড়িতে গিয়ে বসি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেল। এরা যে কেন লাউঞ্জে আমাদের ঢুকতে দেয় না।

এ দেশের প্রশাসন খুবই নির্বোধ। সিকিউরিটির অজুহাতে আজকাল ভিতরে ঢুকতে দেয় না, কিন্তু আদতে সিকিউরিটি ব্যাপারটায় হাজার ফুটো। তুমি কি বিশ্বাস করবে যে, ইচ্ছে করলে এই আমিই কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে যে-কোনও প্লেন হাইজ্যাক করতে পারি? কিংবা পারি যে-কোনও প্লেনে এক্সপ্লোসিভ লোড করে দিতে?

থাক বাবা, তোমাকে আর ওসব পারতে হবে না। তবে কথাটা হয়তো মিথ্যে বলোনি। পাবলিককে লাউঞ্জে ঢুকতে না দিয়ে খুব একটা কাজের কাজ কিছু হয়নি।

তারা ফিরে এসে পার্কিং লটে রাখা গাড়িতে বসে রইল। স্টিয়ারিং-এ অতীব বিশ্বস্ত শিউশরণ। গম্ভীর, মিতবাক শিউশরণ খুবই ঠান্ডা মানুষ। এরকম কর্তব্যপরায়ণ ও প্রভুভক্ত লোক বিশেষ দেখা যায় না। স্টিয়ারিং-এর পিছনে বসে সে একখানা নাম-কিতাব পড়ছে। বইখানা মজার। ওতে কেবল একটি বীজমন্ত্র পর পর ছাপা আছে। বইটা পড়ে যাওয়া মানেই জপ করে যাওয়া। শিউশরণ অবসর পেলেই বইখানা খুলে বসে যায়। শুভ আর মৈত্রেয়ী যখন গাড়িতে উঠে বসল তখন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখে নিল শিউশরণ। কোনও প্রশ্ন করল না, প্লেন দেরি কেন তা নিয়ে উদ্বেগ দেখাল না, নাম বই পড়ে যেতে লাগল শুধু।

মৈত্রেয়ী বলল, শুভ, তোমার বক্কেশ্বর কি পাজি লোক?

কে জানে! তবে সন্দেহজনক।

সত্যিই পিছু নেবে নাকি?

প্রয়োজন হলে। যদি দেখি, ওকে নিতে কোনও গাড়ি এসেছে তা হলে ফলো করব না। গাড়ির নম্বরটা টুকে নেব। পরে ট্রেস করা যাবে।

ট্যাক্সি নিলে?

অবশ্যই পিছু নেব।

কিন্তু তার আগে রোজমারিকে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া ভাল, লোকটাকে সে চেনে কি না।

করেছি।

করেছ? কবে?

এর আগের বার। জিজ্ঞেস করেছিলাম এরকম ড্রেসক্রিপশনের কোনও লোককে সে চেনে কি না। রোজমারি আকাশ থেকে পড়ল। তুমি কি একটু টেনশন করছ আমি লোকটার পিছু নেব বলে?

মৈত্রেয়ী বলল, হ্যাঁ। রিস্ক নেওয়ার দরকারটা কী বুঝছি না।

এসব পরে বোঝা যাবে।

হঠাৎ শিউশরণ মুখ ঘুরিয়ে বলল, হাওয়াই জাহাজ নামছে।

মৈত্রেয়ী শুভ ব্যস্ত হল না। তারা জানে প্লেন নামলেও কাস্টমস ইমিগ্রেশন ইত্যাদিতে আধ ঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট কম করেও লাগবে। ধীরেসুস্থে নেমে তারা যখন টার্মিনালের দরজার বাইরে দাঁড়াল তখন খাড়া দুপুর। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছিল, সিঙ্গাপুর ফ্লাইটের যাত্রীরা ইমিগ্রেশনে জড়ো হচ্ছে এসে। তবে এত দূর থেকে কাউকে চেনা যাচ্ছিল না।

হঠাৎ শুভ বলল, মৈত্রেয়ী, ওই যে বক্কেশ্বর!

মৈত্রেয়ী চমকে উঠে বলল, কোথায়? আসছে। ওর কোনও মালপত্র নেই, শুধু একটা ছোট ব্যাগ। ও আগে বেরিয়ে যাবে। তুমি রোজমারির জন্য থাকো।

দাঁড়াও, দাঁড়াও, রোজমারি তোমাকে খুঁজবে যে! তিনটে বড় বড় সুটকেস আসছে, কে টানবে বাবা?

পোর্টার আছে। আমার সময় হবে না আজ।

টার্মিনালের গেট দিয়ে যে-লোকটা বেরিয়ে এল সে একটু বেঁটে সন্দেহ নেই, কিন্তু ফরসা টকটকে গায়ের রং। চুলগুলো একটু লালচে, মোটা লালচে গোঁফ। চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে। ঝকঝকে ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক। পরনে জিন্স ও মেরুন রঙের টি শার্ট। লোকটা বেরিয়ে আসার পথে প্রি-পেইড ট্যাক্সি বুথে থেমে ট্যাক্সি বুক করল।

শুভ বলল, সরি মৈত্রেয়ী, আমাকে যেতেই হচ্ছে।

 ওয়াইল্ড গুজ চেজ।

 বোধহয় ব্যাপারটা ততটা কো-ইনসিডেন্স নয়। এনিওয়ে, গুডবাই…

 কিন্তু রোজমারিকে কী বলব?

সত্যি কথাই বোলো। শি উইল আন্ডারস্ট্যান্ড।

শুভ একরকম দৌড়ে গিয়ে তার মোটরবাইকে চেপে বসল। হেলমেট মাথায় বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। ওদিকে বঙ্কেশ্বর ট্যাক্সির লাইন ধরে গিয়ে উদ্দিষ্ট গাড়িটার কাছে পৌঁছে গেল। বেশ ধীর-স্থির হাবভাব। মৈত্রেয়ী ভাবল, এত হ্যান্ডসাম একটা লোক কি খুব খারাপ লোক হতে পারে?

ট্যাক্সিটা ছাড়ল। বিশ গজ পিছনে শুভর বাইক। শুভ একবার বাঁ হাতটা তুলে তাকে একটা অস্পষ্ট সংকেত জানিয়ে চলে গেল।

হাই মৈত্রেয়ী! শুভ কোথায়?

 মৈত্রেয়ী চমকে উঠল।

১৫.

কলকাতার রাস্তায় মধ্য দ্বিপ্রহরে একটা ট্যাক্সিকে অনুসরণ করা যে কত কঠিন তা বুঝতে একটুও দেরি হল না শুভর। কলকাতার রাস্তায় শয়ে শয়ে ট্যাক্সি। তার মধ্যে কেবল একটিকে লক্ষ রাখা যে কত কঠিন। শুধু নম্বর প্লেটটা ভরসা, তার ওপর মোটরবাইক চালানোর অভিজ্ঞতা শুভর খুব দীর্ঘ নয়। তাকে পেরিয়ে বহুট্যাক্সি, গাড়ি এবং অটোরিকশাও ট্যাক্সিটাকে আড়ালে ফেলে দিয়েছে। শুভ তবু প্রাণপাত করছিল। ভিআইপি রোডেই যদি এই অবস্থা হয় তা হলে শহরের ভিতরকার ঘিঞ্জি রাস্তা বা গলিঘুজিতে ঢুকলে কী হবে?

উলটোডাঙার মোড় অবধি অবশ্য ট্যাক্সিটাকে শেষ পর্যন্ত নজরে রাখতে পারল শুভ। তার পর থেকেই শুরু হল ভজঘট্ট। হাজারো গাড়ি, হাজারো বাইক আর স্কুটারের জঙ্গলে দিশেহারা শুভ যে কতবার দুর্ঘটনা থেকে বরাতজোরে বেঁচে গেল তার হিসেব নেই। বার কয়েক রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথেও উঠে পড়ল সে। ট্যাক্সিটা অবধারিত মানিকতলার মোড়ের দিকেই চলেছে। মোড়গুলোকেই ভয়। কোনদিকে বাঁক নেবে কে জানে। তাই বেশ কাছাকাছিই থাকতে হচ্ছিল তাকে। লক্ষ করল লোকটা একবারও পিছন দিকে তাকাল না। বেশ আয়েশ করেই বসে রইল। বাঁচোয়া।

মানিকতলা ছাড়িয়ে বিবেকানন্দ রোড। তারপর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের খাঁচাকল। তারপর ডানধারে মোড় নিয়ে সোজা এসে থামল পোন্দার বিল্ডিং-এর কাছ বরাবর। ট্যাক্সি থামল। তারপর অলস ভঙ্গিতে নেমে ফুটপাথে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে যেন চারদিকটা খুব মেপেৰুপে দেখল, ক্রিটিক্যাল আই।

শুভ বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে লক করল। তারপর ধীর কদমে লোকটার দশ হাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। বক্কেশ্বর এখন কোনদিকে যায় সেইটেই সমস্যা।

বক্কেশ্বর তার দিকে তাকাল না। সোজা হেঁটে যেতে লাগল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের দিকে। ডানদিকে মোড় ফিরল। হাঁটতে লাগল। দুলকি চাল। কোনও তাড়া নেই। মিনিট পাঁচেক ভিড়ের রাস্তায় ডানধার ঘেঁষে হাঁটবার পর আচমকাই ডানধারে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল।

একটু দ্বিধায় পড়ে গেল শুভ। সেও কি ঢুকবে? কাজটা উচিত হবে কি? অবশ্য এই অঞ্চলের বাড়িগুলির ভিতরে অসংখ্য অফিস, গুদাম এবং দোকান রয়েছে। ঢুকলেও কেউ কিছু সন্দেহ করবে না, সুতরাং দ্বিধার ভাবটা ঝেড়ে ফেলে শুভও ঢুকল। কিন্তু ওই সামান্য দ্বিধা আর কালক্ষেপই সব গণ্ডগোল করে দিল।

বাড়ির ভিতরে ঘিঞ্জি সব দোকান, আড়ত এবং থিকথিক ভিড়। দিশাহারা পরিস্থিতি। শুভ সেই ভিড়ের মধ্যে বেদিশা হয়ে খানিকক্ষণ ঘোরাফেরা করল। ডান ধারে একটা সরু সিঁড়ি পেয়ে সেটা বেয়ে ওপরেও উঠল সে। ওপরেও হাজার রকমের ব্যাবসা বাণিজ্যের আয়োজন। সর্বত্রই মানুষ আর মানুষ। কোথাও বন্ধেশ্বরকে দেখা গেল না।

প্রায় চল্লিশ মিনিট ঘোরাঘুরি করার পর হতাশ হয়ে নেমে এল সে। একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে বাড়িটার নম্বর শুধু টুকে নিল সে। যদিও বুঝতে পারল, নম্বর নিয়ে কোনও লাভ নেই, এই বিশাল বাড়িতে অচেনা একটা লোককে খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় উঁচ খোঁজার মতো ব্যাপার।

হতাশ হয়ে বেরিয়ে এসে সে হাঁটতে হাঁটতে মোটরবাইকের কাছে ফিরে এল। ভাগ্য ভাল ইতিমধ্যে মোটরবাইকটা চুরি হয়ে যায়নি। নতুন কেনা মোটরবাইকটাকে নিয়ে সর্বদাই তার দুশ্চিন্তা থাকে।

যখন অফিসে ফিরে এল শুভ তখন তিনটে বেজে গেছে। তাকে দেখে মৈত্রেয়ী চোখ বড় বড় করে বলল, আর আধ ঘণ্টা দেরি হলেই পুলিশে খবর দেওয়া হত। রোজমারি তোমার ওপর খুব রেগে আছে ওরকম রিস্ক নিয়েছ বলে।

শুভ অপ্রতিভ হয়ে বলল, তুমি কি রোজমারিকে সব বলে দিয়েছ নাকি?

না বলে উপায় ছিল? কী অ্যাডভেঞ্চার করে এলে?

শুভ মাথা নেড়ে বলল, কলকাতা শহরটা ফলোটলো করার পক্ষে একদম স্যুটেবল নয়, লোকটা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে একটা বিরাট বাড়িতে ঢুকে হারিয়ে গেল।

তুমি যে ফলো করছিলে তা টের পেয়েছিল?

না, বোধহয় না।

এখন যাও, রোজমারি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

বকাঝকা করবে নাকি?

করতেও পারে, যাও।

শুভ কাঁধ ঝাঁকাল, বলল, আমি তো ওর ভালই করতে চেয়েছিলাম।

মৈত্রেয়ী একটু হেসে বলল, তা হলে ভয় পাচ্ছ কেন?

রোজমারি একতলার বাঁ হাতি উইং-এ বসে। তার এলাকাটা খুব সাজানো গোছানো। শুভ আর মৈত্রেয়ীর বসার জায়গা উইংটার মুখে। রোজমারির ঘরখানা একটু তফাতে, মাঝখানে একটা কনফারেন্স রুম আছে।

বিনা অনুমতিতে রোজমারির ঘরে ঢোকা বারণ। বাইরে একজন বেয়ারা মোতায়েন রয়েছে। ভিতরে খবর পাঠিয়ে একটু অপেক্ষা করতে হল শুভকে৷ মিনিট তিনেক বাদে বাইরের দরজার মাথায় সবুজ আলোটা দু’বার জ্বলে নিবে গেল।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল শুভ। যাকে খুশিয়াল ঘর বলে রোজমারির ঘরখানা তাই। চার দেওয়ালে সিলিং থেকে মেঝে অবধি চিত্রিত মাদুরের ঢাকনা। সিলিং-এ চমৎকার বাঁশের কাজ, বাঁশের তৈরি ঝাড়বাতি আছে। বাঁশ আর মাদুরের কাজের জন্য ত্রিপুরা থেকে কারিগর আনানো হয়েছিল। মেঝেতে কার্পেট পাতেনি রোজমারি। খুব সুন্দর নরম রঙের নকশাদার টাইলস বসানো হয়েছে। রোজমারির কাজের টেবিলটাও তিন ভাগে বিভক্ত এবং ডিজাইন প্রায় ফিউচারিস্টিক। আসবাব বিশেষ নেই। একধারে, হাতের নাগালে একটি স্ট্যান্ডের ওপর খুব দামি একটা বিদেশি কম্পিউটার বসানো। পাঁচখানা টেলিফোন আছে রোজমারির। শুভ যখন ঢুকল তখন রোজমারি কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছিল। শুভকে ইঙ্গিতে বসতে বলে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল রোজমারি। তারপর টেলিফোন রেখে শুভর দিকে কৃত্রিম ভ্রুকুটি করে বলল, তারপর, কোন অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছিলে?

আমি লোকটার কথা আপনাকে আগেও বলেছি। লোকটা প্রতিবার আপনার ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর যায় এবং আসে।

রোজমারি মাথা নেড়ে বলল, তাতে কী হয়েছে?

আমি লোকটাকে ট্রেস করার চেষ্টা করেছিলাম।

তুমি আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছ বলে ধন্যবাদ। তুমি সত্যিই একটি ভাল ছেলে। কিন্তু আমাদের বিপদটা মনে হয় আরও গভীর। আর শত্রুও বোধহয় অনেক কঠিন।

শুভ একটু অবাক হয়ে বলল, একথা কেন বলছেন?

রোজমারি একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, তুমি কি আমাদের কারখানাটির সম্পর্কে সব জানো?

শুভ মাথা নেড়ে বলল, না, আমি তো বৈজ্ঞানিক নই। তবে জানি যে, এটা খুবই আধুনিক কারখানা, ভারতবর্ষে কেন, এশিয়াতেও এরকম অত্যাধুনিক কারখানা নেই।

ঠিক তাই। আর আমাদের প্রোডাকশনটাও আংশিক একচেটিয়া ব্যাবসা করছে। ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট বাড়িয়ে দিলে শতকরা মুনাফা কোথায় পৌঁছোবে তার ঠিক নেই। কারণ পৃথিবীতেও এরকম কারখানা বেশি নেই। কিন্তু আমরা যে ব্যাবসাটা করছি তা অনেকেই ভাল চোখে দেখছে না। প্রথমে এটা আমাদের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এখন চেষ্টা হচ্ছে কেড়ে নেওয়ার, ভয় দেখিয়ে।

কিন্তু কেন?

সেইটে আমরা এখনও বুঝতে পারছি না।

শুভ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, তা হলে এখন কী করবেন?

ভাবছি।

পুলিশকে জানালে হয় না?

পুলিশকে জানালে একটা কংক্রিট অভিযোগ করতে হয়। আমরা সেটা করতে পারছি না। আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ এবং তথ্য নেই। পুলিশকে জানালে তারা বড়জোর কিছুদিন কারখানা বা আমাদের বাড়ি পাহারা দেবে। কিন্তু তাতে তো লাভ নেই।

কেন নেই?

রোজমারি হেসে বলল, এই লড়াইটা অর্থনৈতিক লড়াই। এই লড়াইয়ে পুলিশের ভূমিকা নেই।

শুভ খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ম্যাডাম, আমার এক কাকা লালবাজারের গোয়েন্দা, তিনি সাহায্য করতে পারেন।

তোমাকে ধন্যবাদ শুভ। আমার মনে হয় তোমার কাকা এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন না। তবু তিনি যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে আমাদের পরামর্শ দিতে পারেন।

শুভর মনটা খারাপ লাগছিল। সে ভারাক্রান্ত মনে বেরিয়ে এল। রোজমারিকে সে নিজের মতো করে পছন্দ করে। রোজমারি অনেকটা তার দিদির মতো। স্নেহশীলা এবং প্রশ্রয়দাত্রী।

তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল, কী হল?

কিছুই নয়।

তোমাকে বকেননি তো!

না। তবে রোজমারি বিপদের মধ্যে আছে বলে মনে হল।

তোমাকে তো বলেইছি বড়লোকদের সবসময়েই বিপদ, তুমি কেন মাথা ঘামাচ্ছ?

আমরা কি কিছু করতে পারি না মৈত্রেয়ী?

কী করবে?

রোজমারি বলল, এই কারখানা নিয়েই নাকি নানারকম খেলা চলছে।

কীরকম খেলা?

খুব একটা ভেঙে বলল না। তোমার কি মনে আছে রোজমারিকে কিছুদিন আগে একগোছা লাল গোলাপ পাঠানো হয়েছিল!

কেন থাকবে না? খুব মনে আছে।

ট্যাগে লেখা ছিল আর আই পি, খ্রিস্টানদের কবরে লেখা থাকে।

তাও জানি।

ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস মৈত্রেয়ী।

হলেও তোমার কিন্তু কিছু করার নেই শুভ।

.

শুভ ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরই রোজমারি ফোন তুলে একটা নম্বর ডায়াল করল।

ওপাশ থেকে একটা মোলায়েম গলা বলল, লুলু হিয়ার।

রোজমারি জার্মান ভাষায় বলে, বোকামিটা কেন করলে?

জার্মান ভাষাতেই জবাব এল, বোকামি করিনি। শেষ অবধি ছেলেটাকে ঝেড়ে ফেলেছি।

সেটা কথা নয়। তোমার চলাফেরা এবং হাবভাবই তোমাকে ধরিয়ে দিচ্ছে। তোমার আরও অনেক ট্রেনিং বাকি।

আসলে তোমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে যাওয়া এবং আসাটাই একটা বোকামি হয়েছে। কিন্তু ইদানীং আমি তোমার নিরাপত্তা নিয়ে একটু চিন্তিত বলেই একই ফ্লাইটে যাই আসি।

বুঝলাম, কিন্তু ধরা পড়ে গেছ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তোমাকে শেষ অবধি ট্রেস করতে পারেনি।

এর পর থেকে আমি আরও একটু সতর্ক হব রোজমারি।

ছেলেটা তোমার মুখ মনে রেখেছে। কাজেই তুমি আমার অফিসে কখনও আসবে না।

না। আর কিছু?

আপাতত কিছু নয়, পরে কথা হবে।

রোজমারি ফোনটা রেখে দিল।

ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত রোজমারি কিছুক্ষণ ফাঁকা ঘরে পায়চারি করল, তারপর মনোজকে ফোন করল।

মনোজ, কী খবর?

কোনও খবর নেই। গোপীনাথ বসু অদৃশ্য হয়ে গেছে।

আমাদের সায়েন্টিস্ট কী বলছে?

না, কোনও পথ দেখাতে পারছে না।

তা হলে?

অপেক্ষা করা ছাড়া পথ দেখছি না।

আমি কি একটু রোমে যাব?

যেতে পারো, কিন্তু কী লাভ হবে?

তা জানি না, কিন্তু এভাবে অনিশ্চয়তা নিয়েও তো থাকা যায় না। আমার টেনশন হচ্ছে।

 টেনশন, টেনশনের কী আছে? গোপীনাথ বসু যদি বেঁচে থাকে তবে একদিন যোগাযোগ করতে পারব।

তুমি কি সোনালিকে একটু ট্যাপ করছ?

ও বাবা, তাতে উলটো ফল হয়েছে। কিন্তু সুব্রত গোপীনাথের খুব কাছের লোক। পারলে সে-ই সাহায্য করবে।

.

যাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল সেই গোপীনাথ বসুর অবস্থা গৃহবন্দির মতোই। ঘর থেকে বেরোনোর উপায় নেই। টেলিফোনে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। শুয়ে বসে সময় কাটানোর ধাত তার নয়। ফলে ক্রমে ক্রমে সে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল।

মজা হল, দ্বিতীয় রাতেই তার কাছে ফোন করে একজন গম্ভীর গলার মানুষ জানতে চাইল, তার বান্ধবীর দরকার আছে কি না।

গোপীনাথ অবাক হয়ে বলল, বান্ধবী! হঠাৎ একথা কেন?

টেনশন কাটাতে বান্ধবী খুব সাহায্য করে।

 গোপীনাথের মনে হল ফোনটা করছে ওই দাতা, অর্থাৎ বাঙালি মস্তানটি, যদিও কথা বলছিল ইতালিয়ানে। ফোন বলতে ইন্টারকম। তার মানে লোকটা এখন এই হোটেলেই আছে।

গোপীনাথ বলল, আমার বান্ধবীর দরকার হয় না।

আপনি হোমোসেক্সুয়াল নন তো?

না, এ প্রশ্নই বা কেন?

আপনার সব খবর আমাদের জানা নেই বলে, ভয় পাবেন না, বান্ধবীটি কিন্তু অন্য কোনও মতলবে যাবে না, শুধুই সঙ্গ দেবে।

গোপীনাথ একটু দ্বিধায় পড়ে বলল, পাঠিয়ে দিন।

বান্ধবী এল দশ মিনিট বাদে। তাকে দেখে চমকে গেল গোপীনাথ। বছর পচিশ-ছাব্বিশ বয়সের চাবুক চেহারার একটি ইতালিয়ান মেয়ে। জিপসিদের ধরনের পোশাক পরা। মাথায় একটা ধাতুর তৈরি সাপের মুকুট।

কটাক্ষ এবং লোল হাসির পর মেয়েটি বলল, পছন্দ?

হ্যাঁ।

ড্রিঙ্কস?

না।

তুমি ড্রিঙ্ক করো না?

না, আমার অভ্যাস নেই।

তা হলে সন্ধেটা কাটাবে কী করে?

আমরা কথা বলতে তো পারি? কথা,

কথা দিয়ে সময় কাটানো যায় নাকি?

 যায় না?

কিছু অ্যাকশনও তো দরকার, নাচলে কেমন হয়?

আমি নাচ জানি না।

তুমি কি পণ্ডিত লোক?

 গোপীনাথ হাসল, পণ্ডিতরাও ফুর্তি করে। আমি আসলে ফুর্তিবাজ নই।

তুমি কেমন?

সেটা তুমিই আজ আবিষ্কার করো।

মেয়েটা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বাঃ, এই তো সুন্দর কথা, আমি আজ তোমার ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে দেব। তুমি নিজেকে চিনতেই পারবে না।

তথাস্তু।