১১. অভিযান
তাহলে, অবশেষে, যাকে চোখে দেখা যায় না, কানে শোনা যায় না, সেই আবিষ্কারক আবার এসে মার্কিন মুলুকের ভূখণ্ডে আবির্ভূত হয়েছে! ইওরোপে সে কখনও আত্মপ্রকাশ করেনি, জলেও না, ডাঙাতেও না। সে তাহলে অ্যাটলান্টিক পেরোয়নি, যা সে হয়তো তিনদিনেই অতিক্রম করে যেতে পারতো। তাহলে কি সে মনে-মনে ঠিক করে নিয়েছে যে আমেরিকাকেই সে তার রগরগে রোমাঞ্চকর অভিযানের রঙ্গভূমি হিশেবে ব্যবহার করবে? তা থেকে এই সিদ্ধান্ত করা কি ঠিক হবে যে সে আসলে একজন মার্কিন নাগরিক?
আরো-একবার এ-ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখা যাক। এটা তো স্পষ্ট যে তার ডুবোজাহাজের সাহায্যে সে অনায়াসেই এই বিশাল মহাসমুদ্র পেরিয়ে ইওরোপে পৌঁছে যেতে পারতো। তার ডুবোজাহাজের দুরন্ত গতি যে দ্রুততম বাষ্পচালিত জাহাজের চেয়েও তার সমুদ্রযাত্রাকে অনায়াস ও ক্ষণস্থায়ী করে তুলতে পারতো তা-ই নয়, পথে সমুদ্রে যত ঝড়তুফান ওঠে তার হাত থেকেও অনায়াসেই সে তার ডুবোজাহাজে করে রেহাই পেতে পারতো। সমুদ্রঝড় বলে কিছুই তার অভিধানে থাকতো না। ঝড় উঠলেই সে চলে যেতে পারতো জলের তলায়, আর সমুদ্রের গভীরে সে পেতো শান্ত নিস্তরঙ্গ জল। কিন্তু তবু এই আবিষ্কারক অ্যাটলান্টিক পেরিয়ে ওপারে চলে যায়নি, আর এখন যদি সে ধরা পড়ে যায় তবে সে সম্ভবত ধরা পড়বে ওহায়ো রাজ্যে, কারণ টলেডো তো ওহায়োরই একটা শহর।
এবারে অবশ্য এই আশ্চর্য যানটাকে দেখা গিয়েছে, সে-তথ্যটা সযত্নে চেপে রাখা হয়েছে । যে-গোয়েন্দাটি খবরটি পুলিশদফতরে জানিয়েছিলো, সে ছাড়া দফতরের আর কয়েকজন লোক মাত্রই খবরটা জানে। এখন আমি শশব্যস্তভাবে সেই নজরদারের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি। কোনো খবরকাগজই–আর তাদের মধ্যে অনেকেই খবরটা ছাপবার জন্যে বিস্তর টাকা খরচ করতে-এ-খবরটা ছাপতে পারবে না। আমরা আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি ব্যাপারটার একটা সুষ্ঠু উপসংহার না-হওয়া অব্দি একটি কথাও বাইরে প্রকাশ করা হবে না। আমি কিংবা আমার সহকারীরা–সেই-যে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছি, সেই কুলুপ আর সহজে খুলছি না।
মিস্টার ওয়ার্ডের নির্দেশমতো যার কাছে আমি দেখা করতে চলেছি, তার নাম আর্থার ওয়েলস। সে আমাদের জন্যে টলেডোতেই অপেক্ষা করে আছে। লেক ইরির পশ্চিম প্রান্তে এই টলেডো নগরী। আমাদের ট্রেন পূর্ণবেগে সারা রাত ধরে ছুটে চলেছে পশ্চিম ভার্জিনিয়া আর ওহায়োর মধ্য দিয়ে। রাস্তায় কোনোকারণেই দেরি হয়নি; পরদিন বেলা দুপুর হবার আগেই টলেডোের স্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন থেমেছে ।
জন হার্ট, ন্যাব ওয়াকার আর আমি তৎক্ষণাৎ আমাদের স্যুটকেস নিয়ে নেমে পড়েছি, সকলেরই পকেটে রিভলবার। তাকে আক্রমণ করতে হলে অস্ত্র লাগবে, যদি আত্মরক্ষা করার দরকার হয় তখনও হাতে অস্ত্র থাকলে ভালো। ট্রেন থেকে নামতে না-নামতেই আমি আর্থার ওয়েলসের দেখা পেয়ে গেছি–সে আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। অধীরভাবে সে যাত্রীদের ওপর চোখ বোলাচ্ছিলো, বোঝাই যাচ্ছিলো যে সে আমার মতোই অধীর হয়ে আছে–কোনো-এক বিষম তাড়ায়।
আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিগেস করেছি, মিস্টার ওয়েলস?
মিস্টার স্ট্রক? সেও উলটে আমায় জিগেস করেছে।
হ্যাঁ।
আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষা করছি, ওয়েলস বলেছে।
আমাদের কি কখনও টলেডোতে থেমে অপেক্ষা করতে হবে? আমি তার কাছে। জানতে চেয়েছি।
না, আপনার অনুমতি নিয়েই বলছি, মিস্টার স্ট্রক। দুটি টগবগে ঘোড়ায় টানা একটা গাড়ি স্টেশনের বাইরে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। যত-শিগগির-সম্ভব যাতে গন্তব্যে পৌঁছুতে পারি সেইজন্যে আমাদের এক্ষুনি রওনা হয়ে পড়তে হবে।
আমরা এখনিই যাবো, এই বলে আমি দুই সহকারীর দিকে ফিরে ইশারা করেছি। কতদূর যেতে হবে? অনেকটা পথ?
সব শুদু কুড়ি মাইল।
আর, যেখানে যাচ্ছি, সে-জায়গাটার নাম?
ব্ল্যাক রক ক্রীক।
একটা হোটেলে আমাদের মালপত্র জিম্ম করে রেখে তক্ষুনি আমরা ঘোড়ার গাড়িটায় করে বেরিয়ে পড়েছি। একটু বুঝি বিস্মিতভাবেই লক্ষ করেছি, গাড়িতে, আমাদের সীটের তলায়, বেশ কয়েকদিনের উপযোগী রসদ। মিস্টার ওয়ে আমাকে এর মধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে ব্ল্যাক রক ক্রীক-এর আশপাশের অঞ্চলটা সারা রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বন্য, পরিত্যক্ত। চাষী কিংবা জেলে-কাউকেই আকৃষ্ট করার মতো কিছুই সেখানে নেই। খাবার-দাবার মিলবে না সেখানে, কেননা সেখানে কোনো সরাই নেই, এমনকী রাতের বেলা আশ্রয় নেবার মতো কোনো কুঠিও মিলবে না।
ভাগ্যিশ এখন জুলাই মাস, বেশ গরম পড়েছে, তাই আকাশের তারার তলায় দু একটি রাত কাটাতে হলে তেমন-একটা কষ্ট হবে না।
আর যেটা সবচাইতে সম্ভব, আমরা যদি আদৌ কৃতকার্য হই, তবে ব্যাপারটা সুষ্ঠুভাবে সমাধা করতে কয়েক ঘণ্টার বেশি লাগবে না। হয় বিভীষিকার সর্বাধিনায়ককে পালাবার কোনো সুযোগ না-দিয়েই আচম্বিতে আমরা আক্রমণ করবো, আর নয়তো দেখতে পাবো যে সে তার যান চালিয়ে দিয়েছে–এবং তখন তাকে গ্রেফতার করার সব আশাই বিসর্জন দিতে হবে।
আর্থার ওয়েসের বয়েস সম্ভবত চল্লিশ, তাগড়া হট্টাকট্টা মানুষ, গায়ে অসীম শক্তি ধরে। আমি আগেই তার নাম শুনেছিলুম, এখানকার স্থানীয় পুলিশবাহিনীতে দক্ষতার জন্যে তার ভারি সুনাম। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে, সহজে বিচলিত হয় না, সবসময় একটা-না-একটা ফন্দি বা রণকৌশল বার করছে-নিজের জীবন বিপন্ন করেও এর আগে বেশ কয়েকবার সে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। সম্পূর্ণ আলাদা একটা কাজ হাতে নিয়ে সে টলেডো এসেছিলো–কিন্তু দৈব তাকে বিভীষিকার পেছনে এনে হাজির করে দিয়েছে।
আমাদের ঘোড়ার গাড়ি দ্রুতবেগে লেক ইরির তীর ধরে ছুটে চলেছে, দক্ষিণ পশ্চিমে। এই মস্ত হৃদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর সীমায় প্রায় সমুদ্রের মতোই যেন বিশাল –তার একদিকে ক্যানাডা, অন্যদিকে ওহায়ো, পেনসিলভ্যানিয়া আর নিউইয়র্ক রাজ্য। আমি যদি এখানে একটু থেমে পড়ে এই লেক ইরির ভৌগোলিক অবস্থান, তার গভীরতা, তার বিশাল প্রসার এবং তার আশপাশে আর কী-কী জলধারা আছে, সে-কথা একটু একটু ফেনিয়ে বলি, তবে তা এই জন্যেই যে একটু পরেই যে-ঘটনাগুলো ঘটবে, তা বোঝাবার জন্যে এ-সব তথ্য জানা জরুরি।
লেক ইরি প্রায় দশহাজার বর্গমাইল ধরে ছড়িয়ে আছে। সমুদ্রতল থেকে তার অবস্থান প্রায় ছশো ফিট ওপরে। উত্তরপশ্চিমে, ডেট্রয়েট নদী মারফৎ, সে পশ্চিমের বিশালতর হ্রদগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত–তাদের কাছ থেকে অনবরত সে জল পায়। তার নিজেরও কতগুলো নদী আছে, তবে সেগুলো বেশ ছোটোই আর তাদের তেমন গুরুত্বও নেই–যেমন, রকি, কুইয়াহোগা, আর ব্ল্যাক রিভার। উত্তরপুবদিকে এই হ্রদ তার সব জল নায়াগ্রা নদী আর তার বিখ্যাত জলপ্রপাত মারফৎ সরাসরি ঢেলে দেয় লেক অন্টারিওতে।
এ-পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, লেক ইরি কোথাও-কোথাও একশো তিরিশ ফিট গভীর। তা থেকে নিশ্চয়ই এটাও বোঝা যাবে এখানে কী-পরিমাণ জল থইথই করছে। এই অঞ্চলটাই বিশাল সব হ্রদে ভর্তি। জমি যদিও উত্তর মুখে অবস্থিত নয়, তবু সে সুমেরুবৃত্তের ঠাণ্ডার কবলে পড়ে হি-হি করে কাঁপে। উত্তরদিকে যে-অঞ্চল, সেটা ঢালু হয়ে নিচে গড়িয়ে গেছে, আর শীতের হাওয়া দুরন্ত বেগে তার ওপর দিয়ে ঝেটিয়ে বয়ে যায়, সেইজন্যে মাঝে-মাঝে লেক ইরি এ-তীর থেকে ও-তীর জমাট বেঁধে যায়।
এই বিশাল হ্রদটার ধারে-ধারে যে-সব প্রধান শহর গজিয়ে উঠেছে তার একটা হলো, পুবদিকে, বাফেলো–সেটা নিউইয়র্ক রাজ্যের অন্তর্ভূত; টলেডো, ওহায়োর শহর–পশ্চিমে; তাছাড়া আছে ক্লীভল্যাণ্ড ও সানস্কি-এ-দুটোও ওহায়োরই শহর, তবে দক্ষিণে; আর তীর ধরে কত-যে ছোটো-ছোটো গ্রামশহর গড়ে উঠেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যানবাহন স্বভাবতই অবিশ্রাম আনাগোনা করছে এখানে, বার্ষিক প্রায় কুড়ি কোটি ডলার আয় হয়–শুধু এই বাবদেই।
আমাদের ঘোড়ার গাড়ি চলেছে, লেকের তীর ধরে, রুক্ষ উবড়োখাবড়ো একটা রাস্তা দিয়ে–এ-রাস্তায় যানবাহন কমই চলে। যেতে-যেতেই আর্থার ওয়েলস আমায় খুলে বলেছে সে এখানে এসে কী জেনেছে।
দু-দিনও কাটেনি তারপর, সাতাশে জুলাই অপরাহ্,ে ওয়েলস ঘোড়ায় চড়ে হার্লি শহরের দিকে যাচ্ছিলো। শহরটা থেকে মাইল পাঁচেক দূরে, সে একটা ছোট্ট বনের। মধ্য দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় দেখতে পেয়েছে, লেকের অনেকটা ভেতরে, মাঝখানেই প্রায়, একটা ডুবোজাহাজ জল থেকে হঠাৎ উঠে আসছে। দেখেই সে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে ঘোড়াটাকে একটা গাছের গায়ে বেঁধে রেখে সন্তর্পণে পায়ে-পায়ে লেকটার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে একটা মস্ত গাছের আড়াল থেকে উঁকি মেরে সে দেখতে পায়–নিজের চোখে দেখতে পায়–এই ডুবোজাহাজ তার দিকেই এগিয়ে আসছে, আর শেষে ব্ল্যাক রক ক্ৰীকের মুখে এসে নোঙর ফেলছে। এই কি তবে সেই অভূতপূর্ব যন্ত্রযান-সারা জগৎ যাকে ছুঁড়ে বেড়াচ্ছে–আর এখন কি না সেটা এসে থেমেছে প্রায় যেন তারই পদপ্রান্তে?
আমি তো একলা ছিলাম, ওয়েলস আমাদের বলেছে, ক্রীকের কিনার ঘেঁসে, একেবারে একা। যদি আপনি এবং আপনার দুজন সহকারী তখন আমার সঙ্গে থাকতেন, তাহলে ওদের দুজনের বিরুদ্ধে আমরা চারজন, আমরা অনায়াসেই ওদের ওপর চড়াও হয়ে ওরা ওদের ডুবোজাহাজে উঠে পালাবার আগেই ওদের ধরে ফেলতে পারতাম।
কেননা সে তার ঐ গাছের আড়াল থেকে দেখেছিলো, ডুবোজাহাজটা যখন তীরের পাথরগুলোর কাছে এসে হাজির হয়েছে, দুজন লোক জাহাজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে ডেকের ওপর, তারপর ডাঙায় এসে নেমেছে। এদের একজনই কি সেই কুখ্যাত দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড, সেই-যে বেশকিছুদিন আগে লেক সুপিরিয়রে যাকে দেখা গিয়েছিলো, এবং তারপর থেকে যার আর-কোনো হদিশ নেই? এ-ই কি তবে সেই রহস্যময় বিভীষিকা, যেটা এইমাত্র লেক ইরির গভীর থেকে উঠে এলো জলের ওপর?
হ্যাঁ, আমরা থাকলে হয়তো ওদের ওপর চড়াও হতে পারতুম, ওয়েলসের কথার জের টেনে আমি বলেছি, কিন্তু জাহাজে কি ওদের আর-কোনো সঙ্গীসাথী ছিলো না? তবু, যদি এই দুজনকেও পাকড়ানো যেতো, তবে অন্তত ঘোড়ার মুখ থেকেই জানা যেত। ওরা আসলে কারা।
আর ভেবে দেখুন, ওয়েলস জুড়ে দিয়েছে, যদি দুজনের একজন সত্যি-সত্যি বিভীষিকার কাপ্তেন হতোর।
আমার শুধু একটাই ভয়, ওয়েলস। এই ডুবোজাহাজ-আমরা তো এখনও জানি আমরা একেই হন্যে হয়ে ছুঁড়ে বেড়াচ্ছি কি না–তুমি ক্রীক ছেড়ে চলে আসার পর এখানে থেকে কেটে পড়েনি তো?
আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেটা হাতে-নাতে জেনে ফেলবো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন–ওরা যেন ওখানেই থাকে! তারপর যখন রাতের আঁধার নেমে আসবে
আচ্ছা, আমি তাকে জিগেস করেছি, তুমি কি রাত হওয়া অব্দি গাছের আড়াল থেকে ওদের ওপর নজর রেখেছিলে?
না। আমি ঘণ্টাখানেক ওদের হালচাল লক্ষ করেই, সোজা ঘোড়া ছুটিয়ে টলেডোর টেলিগ্রাফ আপিশে চলে আসি। সেখানে আমি গভীর রাতে পৌঁছেছিলাম–তক্ষুনি আমি ওয়াশিংটনে জরুরি বার্তাটা পাঠিয়ে দিই।
সে হলো পরশু রাতে। তারপর কি কাল তুমি আবার ব্ল্যাক রক ক্রীকে ফিরে এসেছিলে?
হ্যাঁ।
ডুবোজাহাজটা তখনও সেখানে ছিলো?
ঠিক একই জায়গায়।
আর লোক দুটো?
সেই একই লোক–দুজনকেই আমি পরশু ভালো করে দেখে এসেছি। দেখে শুনে মনে হচ্ছিলো ডুবোজাহাজটা বোধহয় কোনো দুর্ঘটনার পাল্লায় পড়েছিলো, তাই বেছে-বেছে এই নিরিবিলি জায়গায় এসে তারা মেরামত করছে তাকে–
হয়তো তা-ই হবে, আমি বলেছি, হয়তো এমন-কোনো ভাঙচুর হয়েছে জাহাজটার যেজন্যে তারা তাদের আসল আড্ডায় ফিরে যেতে পারেনি। ঈশ! এখনও যদি তারা ওখানে থেকে থাকে–
আমার দৃঢ় বিশ্বাস এখনও ওরা ওখানেই আছে–কারণ জাহাজের মধ্য থেকে অনেক মালপত্র বার করে এনে ওরা তীরে ঝুপ করে রেখেছিলো। দূর থেকে দেখে যতটা বুঝতে পেরেছি তাতে মনে হয়েছে ওরা জাহাজের ভেতরটা ফাঁকা করে নিয়ে ভেতরে কাজ করছে।
মাত্র দুজন লোক?
শুধু দুজন লোক।
কিন্তু, আমি আপত্তি তুলেছি, মাত্র দুজন লোকের পক্ষে কি এমন-একটা দুরন্তগতির ডুবোজাহাজ মেরামত করা সম্ভব–আর তার ওপর যন্ত্রটা জটিলও বটে, কেননা সে একে-তিন-তিনে-এক, একই সঙ্গে মোটর গাড়ি, স্টীমবোট এবং ডুবোজাহাজ!
তা হয়তো সম্ভব নয়, মিস্টার স্ট্রক, কিন্তু আমি শুধু সেই দুজন লোককেই বারে বারে দেখতে পেয়েছি। আমি যে-বনটার মধ্যে লুকিয়েছিলাম, কয়েকবার তারা তার কাছেও এসেছিলো-কাঠকুটো জড়ো করতে, তাই দিয়ে তীরে আগুন জ্বেলেছিলো। এ-জায়গাটা একেবারেই জনমানবহীন, তাছাড়া ক্ৰীকটাও এমনভাবে চারপাশের বনজঙ্গল দিয়ে ঢাকা যে কেউ-যে তাদের আচমকা দেখে ফেলবে এমন সম্ভাবনা আদপেই ছিলো না। মনে হচ্ছিলো, তারাও বুঝি এ-সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।
আবার দেখতে পেলে এই দুজনকে তুমি ঠিক-ঠিক চিনতে পারবে?
নিশ্চয়ই। একজন ছিলো মাঝারি চেহারার, ক্ষিপ্র, চটপটে, মুখে ঝোঁপের মতো ঘন দাড়ি । অন্যজন তুলনায় একটু বেঁটেখাটো। কিন্তু বহরে বড়ড়া, আর হট্টাকট্টা। আগের দিনের মতোই, কালও আমি পাঁচটা নাগাদ বন থেকে বেরিয়ে বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে টলেড়োয় ফিরে আসি। গিয়ে দেখি মিস্টার ওয়ার্ডের কাছ থেকে একটা তার এসেছে–তাতে জানিয়েছেন যে আপনারা আসছেন। তারপর আমি স্টেশনে গিয়ে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করি।
সারসংক্ষেপ করলে ব্যাপারটা, তাহলে, এইরকম দাঁড়ায় : গত চল্লিশ ঘণ্টা ধরে, একটি ডুবোজাহাজ-সম্ভবত সেটাকেই আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি–ব্ল্যাক রক ক্রীকে সংগোপনে মেরামতির কাজে ব্যস্ত আছে। হয়তো এতই জরুরি ছিলো যে এক্ষুনি। মেরামত করে না-নিলে চলতো না–আর তা যদি হয়, যদি গুরুতর জখমই হয়ে থাকে এই ডুবোজাহাজ, তাহলে এখন গিয়েও আমরা তাকে ওখানেই দেখতে পাবো। বিভীষিকা কী করে শেষটায় লেক ইরিতে এসে আস্তানা গেড়েছে, আর্থার ওয়েসের সঙ্গে আমি সে নিয়েও আলোচনা করেছি, শেষটায় একমত হয়েছি যে এটাই তার সম্ভাব্য আস্তানা হয়ে থাকতে পারে। শেষবার তাকে দেখা গিয়েছিলো লেক সুপিরিয়রে। সেখান থেকে লেক ইরি আসতে গিয়ে এই আশ্চর্য যানটি হয়তো মিশিগানের রাস্তা দিয়েই এসেছিলো, কিন্তু পুলিশ বা সাধারণ লোক-কারু চোখেই সে যখন পড়েনি, তাতে মনে হয় বিভীষিকা হয়তো জলপথেই এসেছে। গ্রেট লেকগুলো শেকলের মতো একটা আরেকটার সঙ্গে জড়ানো, নিশ্চয়ই সেই জলপথেই সে এসেছে–আর যেহেতু সে কাপ্তেন নেমোর নটিলাস-এর মতো জলের তলা দিয়েও আসতে পারে, তাই কেউই তাকে দেখতে পায়নি। এবং এখন, বিভীষিকা যদি এর মধ্যেই ক্রীক ছেড়ে চলে গিয়ে থাকে, কিংবা আমরা যখন সেটা দখল করে নেবার চেষ্টা করবো, তখন সে যদি পালিয়ে যায়–তাহলে সে কোনদিকে ফিরবে? তাকে অনুসরণ করার চেষ্টা তো অর্থহীন হবে। বাফেলোর বন্দরে দুটো টরপেডো-ডেস্ট্রয়ার আছে, লেক ইরির একেবারে অন্য প্রান্তে। ওয়াশিংটন ছেড়ে আসবার আগেই মিস্টার ওয়ার্ড আমাকে তাদের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন; যদি দরকার হয়, তাদের কম্যাণ্ডারের কাছে টেলিগ্রাম পাঠালে, তারা বিভীষিকার পেছনে ধাওয়া করতে পারে। কিন্তু যত উন্নত জাতের দ্রুতগামী জাহাজই তারা হোক না কেন, বিভীষিকার সঙ্গে তারা এঁটে উঠতে পারবে কেন? আর সে যদি একবার জলের তলায় ডুবে যায়, তবে তো এরা একেবারে অক্ষম ও অসহায় হয়ে পড়বে। তাছাড়া, আর্থার ওয়েস তার দৃঢ় বিশ্বাস খুলে বলেছে, জলযুদ্ধের সময় যতই কামানবন্দুক থাকুক, আর যতই নৌবাহিনীর লোক থাকুক, ডেস্ট্রয়ারগুলো কিন্তু কোনো সুবিধেই পাবে না। কাজেই, আজ রাতে যদি আমরা সফল হতে না-পারি, গোটা অভিযানটারই তবে ভরাডুবি হবে।
ব্ল্যাক রক ক্রীক জায়গাটা আর্থার ওয়েসের ভালোভাবে চেনা, কয়েকবার সে এখানে এসে শিকার করেছে। বেশির ভাগ জায়গাতেই উবড়োখবড়ো মস্ত সব পাথর দাঁড়িয়ে আছে, যার গায়ে এসে প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে হ্রদের জল। প্রণালীটা তিরিশ ফিটেরও বেশি গভীর, বিভীষিকা তাই জলের ওপরে যেমন, জলের তলাতেও তেমনি আশ্রয় নিতে পারে। দু-তিন জায়গায় খাড়াই পাড়গুলো শেষ হয়েছে বালি ভরা বেলাভূমিতে, তার মধ্য দিয়ে গেছে নয়ানজুলি, খাড়া, দু-তিনশো ফিট ওপরে বনে গিয়ে তা শেষ হয়েছে।
আমাদের ঘোড়ার গাড়ি যখন এই বনে এসে পৌঁছুলো, তখন সন্ধে সাতটা বাজে। আমার এইনে এসেই তখনও বেশ দিনের আলো ছিলো, তাতে এমনকী গাছের ছায়াতেও সবকিছু সহজেই দেখা যাচ্ছিলো। খোলাখুলি বেলাভূমি দিয়ে ক্রীকের দিকে এগুলে, বিভীষিকার মাল্লারা আমাদের দেখে ফেলবে আর অমনি পাততাড়ি গুটিয়ে পালাবে।
এখানেই আপাতত থেমে গেলে ভালো হয় না কি? বনের কাছে ঘোড়ার গাড়ি পৌঁছুতেই আমি ওয়েলসকে জিগেস করেছি।
না, মিস্টার স্ট্রক, ওয়েলস বলেছে, আমরা বরং গাড়িটা বনের ভেতরে গভীরে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখি, তাহলে সহজে কারু চোখে পড়ে যাবার আশঙ্কা থাকবে না।
গাছের তলা দিয়ে কি এই ঘোড়ার গাড়ি যেতে পারবে?
পারবে, আমাদর আশ্বস্ত করেছে ওয়েস। এই বনটা আমি আগেই ভালোভাবে দেখে গেছি। এখান থেকে পাঁচ-ছশো ফিট দূরে, ছোট্ট-একটা ফাঁকা জায়গা আছে, যেখানে আমরা গাছপালার সারির আড়ালে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যাবো, আর ঘোড়াগুলোও ইচ্ছেমতো চরে বেড়াতে পারবে। তারপর যেই অন্ধকার হবে, আমরা সন্তর্পণে বেলাভূমিতে চলে যাবো, ক্রীকের ঠিক মুখটার কাছে যেখানে উঁচু পাথরগুলো উঠেছে, সেখানে। তাহলে বিভীষিকা যদি এখনও সেখানে থেকে থাকে, আমরা তার আর তার পালাবার পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে লড়তে পারবো।
যদিও একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলবার জন্যে আমরা অধীর হয়ে উঠেছিলুম, তবু মনে হলো ওয়েলস যা বলছে সেইমতো কাজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে–রাত্রির জন্যে অপেক্ষা করাই ভালো। মাঝখানের সময়টা না-হয় সে যেভাবে বলছে, সেভাবেই কাটিয়ে দেয়া যাবে। ঘোড়াগুলোর লাগাম ধরে হেঁটেই এগিয়েছি আমরা, তারা শুধু ফাঁকা গাড়িটাকে টেনে এসেছে, আমরা ক্রমেই নিবিড় বনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। ঢ্যাঙা সব পাইনগাছ, বিশালবপু ওক বৃক্ষ, বিষাদবিধুর সাইপ্রেস ছড়িয়ে আছে এখানে সেখানে, মাথার পর সন্ধ্যাটাকে যেন আরো ছায়াচ্ছন্ন করে তুলেছে। আমাদের পায়ের নিচে ছড়িয়ে আছে কত-কত উদ্ভিদ ও লতা, পাইনঝুরি আর মরা পাতা। ওপরের পাতা এমন ঘন নিবিড় যে অস্ত সূর্যের শেষ রশ্মিগুলো ভেতরে ঢোকবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে যাচ্ছে। আমাদের যেন হাড়ে-হাড়ে এগুতে হচ্ছে। আর গাছপালার গায়ে কয়েকবার ধাক্কা খাবার পর অবশেষে আমাদের গাড়ি, প্রায় দশ মিনিট পরে, সেই ফাঁকা জায়গাটায় এসে পৌঁছেছে।
মাঝখানে একটা ফাঁকা মতো জায়গা, চারপাশে সব মহাবৃক্ষ, পুরু ঘাসের জাজিম বেছানো যেন ছোটো একটা খেলার মাঠ; এখানে এখনও দিনের আলো আছে–অন্তত আর একঘণ্টার মধ্যে অন্ধকার হবার সম্ভাবনা নেই। তাই এখানে একটা শিবির ফেলে একটু বিশ্রাম করে নেবার সুযোগ পাওয়া গেলোখানিক বাদেই তো রুক্ষ পাথুরে পথ ধরে আমাদের এগুতে হবে।
আমরা–বলাই বাহুল্য–ক্ৰীকটার মুখে যাবার জন্যে যেন মুখিয়ে ছিলুম, বিভীষিকা এখনও সেখানে নোঙর ফেলে রয়েছে কি না দেখবার জন্যে আর যেন তর সইছে না। একটু ধৈর্য চাই এখন, তাহলেই রাতের আঁধারে সকলের অগোচরেই আমরা রণক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছে যাবো। ওয়েলস বারেবারে এই কথাই আমাদের মাথায় ঢোকাতে চেয়েছে : আর সব অধীরতা সত্ত্বেও আমি তার কথার সারবত্তা বুঝতে পেরেছি।
ঘোড়াগুলোর জিনলাগাম খুলে দেয়া হয়েছে, যে-কোচোয়ান গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছে তারই তত্ত্বাবধানে তারা চরে বেড়াচ্ছে। রসদ সব নামানো হয়েছে–চমৎকার একটা সাইপ্রেস গাছের তলায় জন হার্ট আর ন্যাব ওয়াকার খাবারদাবার সাজিয়ে রেখেছে, বনের গন্ধে আমার কেন যেন বারেবারে মরগ্যানটন আর প্লেজেন্ট গার্ডেনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। খিদের সঙ্গে তৃষ্ণাও ছিলো আমাদের : আর খাদ্য বা পানীয়, কোনোটারই কোনো অভাব নেই। তারপর পাইপ জ্বেলে দু-একটা টান দিয়ে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আমরা আমাদের উত্তেজিত স্নায়ুগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা করেছি।
বনের মধ্যে বিরাজ করছে গভীর স্তব্ধতা। পাখিদের শেষ গানগুলো থেমে গিয়েছে এখন, রাত যত কাছে আসছে, হাওয়ার গতিও ততই ঝিমিয়ে আসছে–এমনকী উঁচু উঁচু গাছগুলোর মগডালেও কোনো পাতা নড়ছে না। সূর্য ডুবে যেতেই আকাশ চট করে অন্ধকার হয়ে এলো, প্রদোষ নিয়ে এলো আবছায়া, অস্পষ্টতা। আমি আমার ঘড়িটায় তাকিয়ে দেখলুম, সাড়ে-আটটা বাজে। সময় হলো, ওয়েস।
আপনি যখনই বলবেন–
তাহলে, এসো, রওনা দিই।
কোচোয়ানকে ডেকে হুঁশিয়ার করে দিলুম : ঘোড়াগুলো যেন কিছুতেই এই ফাঁকা জায়গাটার বাইরে না-যায়, তারপর আমরা রওনা হলুম। ওয়েলস গেলো সকলের আগে আগে, তার পেছনে আমি, জন হার্ট আর ন্যাব ওয়াকার সকলের পেছনে। এই ঘন। অন্ধকারে ওয়েলস না-থাকলে আমাদের বিষম মুশকিল হতো। শিগগিরই আমরা গিয়ে পৌঁছোলুম বনের অন্যধারে-আমাদের সামনে এখন ছড়িয়ে আছে ব্ল্যাক ক্রীক রকের তীরভূমি।
কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই, সব চুপচাপ। সব, মনে হয়, পরিত্যক্তও। কোনো অহেতুক ঝুঁকি না-নিয়েই আমরা এগুতে পারবো। বিভীষিকা যদি সেখানে থেকে থাকে, তবে সে নিশ্চয়ই ঐ বড়ো পাথরগুলোর পেছনেই নোঙর ফেলেছে। কিন্তু সে কি আছে। সেখানে? এখনও? সেইটেই লাখো ডলার দামের প্রশ্ন! আমরা যতই এই অদ্ভুত রহস্যের সমাধানের দিকে এগুচ্ছি, ততই মনে হচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন আমরা গলায় এসে আটকে গিয়েছে।
ওয়েলস ইঙ্গিতে আমাদের এগিয়ে যেতে বললে। আমাদের পায়ের তলায় তীরের বালি ডেবে যাচ্ছে। ক্রীকের মুখ থেকে আমরা এখন দুশো ফিট দূরে, পা টিপেটিপে জায়গাটা পেরিয়ে আমরা সোজা লেকের পাশে পাথরের কাছে এসে দাঁড়ালাম।
কিছুই নেই লেকের জলে! কিছুই নেই!
যে-জায়গাটায় ওয়েক্স চব্বিশ ঘন্টা আগেও বিভীষিকাকে রেখে গিয়েছিলো সেই জায়গাটায় ফাঁকা পড়ে আছে–আমাদের দেখে যেন হা-হা করে হাসছে সে, দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড এখন আর এই ব্ল্যাক রক ক্রীকে নেই। আবারও সে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে পড়েছে!
.
১২. ব্ল্যাক রক ক্রীক
মানুষের স্বভাবটাই এমন যে সে প্রায়ই বিভ্রমের ঘোরে পড়ে যায় । এ-সম্ভাবনা তো সবসময়েই ছিলো যে বিভীষিকা এই তল্লাট ছেড়ে কেটে পড়েছে–এমনকী ওয়েলস তাকে গতকাল স্বচক্ষে দেখে থাকলেও এ-সম্ভাবনাটা তো কিছুতেই উড়িয়ে দেয়া যেতো না। যদি তার তিনফেরতা মোটরটায় সত্যি কোনো চোটজখম হয়ে থাকে, যেজন্যে সে ডাঙায় বা জলে কিছুতেই তার গোপন আড্ডায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারেনি এবং সেইজন্যেই যদি ব্ল্যাক রক ক্রীকে এসে তাকে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতে হয়ে থাকে, তাহলে, এখন তাকে এখানে না-দেখতে পেয়ে কোন সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছুবো আমরা? স্পষ্টই ধরে নেবো যে তার মেরামতি শেষ হয়ে যেতেই সে তার নিজের পথে ফের রওনা হয়ে পড়েছে, এরই মধ্যে নিশ্চয়ই পেরিয়ে গিয়েছে লেক ইরির জল।
এই সমাপ্তিটা তো সবসময়েই সম্ভাব্য ছিলো, অথচ যতই আমরা অভিযানে বেরিয়ে এই ব্ল্যাক রক ক্ৰীকের কাছে এসে পড়েছি, ততই আমরা মন থেকে এই সম্ভাবনাটাকে হঠিয়ে দিয়েছি। আমরা প্রায় ধরেই নিয়েছি যে রাতের আঁধারে এখানে এসে হাজির হলেই বিভীষিকার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যাবে, যে আমরা দেখতে পাবো সে এখানকার জলে নোঙর ফেলে রাত্তিরের মোলায়েম হাওয়ায় দিব্বি দোল খাচ্ছে, যে ওয়ে তাকে যেখানে দেখে গিয়েছে সেখানেই সে শেকড় পুঁতে দাঁড়িয়ে আছে।
আর তাই, এখন কী-যে হতাশা! আমার মনে হচ্ছিলো, এই যেন শেষ হয়ে গেলো, আর-কখনও তাকে হাতে পাবার কোনো আশা নেই। আমাদের সব চেষ্টাই নিষ্ফল হয়েছে! এমনকী বিভীষিকা যদি কখনও এই লেকের জলে থেকে থাকে, তবে তাকে। খুঁজে পেয়ে, তার কাছে গিয়ে, তাকে দখল করে বসা অন্তত আমাদের সাধ্যে কুলোবে না–আর এও না-হয় কবুল করাই ভালো হয়তো তা সব মানুষেরই সাধ্যের বাইরে।
আমরা সেখানেই থম মেরে দাঁড়িয়েছিলুম, আমি আর ওয়েস যেন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, সম্পূর্ণ হতোদ্যম। জন হার্ট আর ন্যাব ওয়াকারও কম নিরাশ হয়নি, কিন্তু তবু তারা তীর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো–যদি বিভীষিকা কোনো চিহ্ন বা সূত্র ফেলে গিয়ে থাকে! ক্রীকের ঠিক মুখটায় হতভম্ব দাঁড়িয়ে, ওয়েলস আর আমি যেন মুখ ফুটে একটা কথাও আর বলতে পারছিলুম না। দুজনের যা মনের দশা এখন, তাতে কোনো কথা বলারই বা দরকার কী। আগ্রহ উত্তেজনার পর এখন এমন দপ করে নিভে-যাওয়া–এতেই যেন আমরা একেবারে অবসাদে ভরে গিয়েছিলুম। আমাদের এত সাধ্যের অভিযানের এমন শোচনীয় ভরাডুবি সত্ত্বেও আমরা একদিক থেকে যেমন হাল ছেড়ে দিতে রাজি ছিলুম না, তেমনি অন্যদিক থেকে কোনোভাবে অভিযানটা চালিয়ে-যাওয়াও সম্ভব ছিলো না।
প্রায় একটা ঘণ্টাই কেটে গেছে, অথচ তবু আমরা কিছুতেই যেন জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে পারছি না। আমাদের চোখগুলো যেন রাতের আঁধার ফুঁড়ে দূরে-দূরান্তরে দেখতে চাচ্ছিলো। মাঝে-মাঝে লেকের জলে তারার আলো ঝিকিমিকি করে ওঠে, তারপরেই ঢেউ ওঠে, কাঁপা-কাঁপা ক্ষীণ ঝিকিমিকির রেশ মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, আর তার সঙ্গে ধুক করে বুকের মধ্যে হঠাৎ-জাগা ক্ষীণ আশাও নিভে যায়। মাঝে-মাঝে মনে হচ্ছে আমরা যেন ছায়ার মতো কোনো জাহাজকে আসতে দেখছি, ছায়ার মতো আকাশের পটে যেন আঁকা আছে সেটা। ক্ৰীকের জল পাক খেয়ে আমাদের পায়ের কাছে এসে আছড়ে পড়ে, আর সেই ঘূর্ণিজলের আওয়াজে আমাদের বিভ্রমও কেটে যায়। আমাদের জখম মগজই আলেয়ার মতো এত-সব বিভ্রম তৈরি করে যাচ্ছে একের পর এক।
অবশেষে জন হার্ট আর ন্যাব ওয়াকার তাদের খোঁজাখুঁজি শেষ করে ফিরে এলো –আর তাদের দেখেই আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, নতুন-কিছু খবর আছে?
উঁহু, কিছু না, জন হার্টের উত্তর।
তোমরা এই খালটার দুই তীরই ভালো করে দেখে এসেছো?
হ্যাঁ, ন্যাব ওয়াকার উত্তর দিলে, ঐ ওপরে যেখানে অল্প ঘোলাজল পাক খাচ্ছে, সেই অব্দি গিয়েছিলাম। মিস্টার ওয়েলস যে বলেছিলেন জাহাজ মেরামতির জন্যে বিস্তর মালপত্র ডাঙায় নামানো হয়েছিলো, তার কোনো চিহ্নমাত্রও আমরা দেখতে পাইনি।
বনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিলো না আমার। আরেকটু না-হয় অপেক্ষা করেই দেখা যাক, এখানে।
ঠিক তক্ষুনি জলের মধ্যে আচমকা এমন আলোড়ন সৃষ্টি হলো, স্তম্ভের আকারে এমনভাবে জল ফুলে-ফেঁপে তীরে এসে আছড়ে পড়লো যে আমাদের সকলেরই মনোযোগ সেদিকে আকৃষ্ট হলো।
ওয়েলস বললে, মনে হচ্ছে কোনো জাহাজের চাকার ঘায়ে জলে ঢেউ উঠেছে।
হ্যাঁ, নিজের অজান্তেই বুঝি আমি আমার স্বর নামিয়ে ফেলেছিলুম, হঠাৎ এমন ঢেউয়ের কারণ কী? বাতাস তো প্রায় মরেই গিয়েছে। জলের ওপরে কিছু ভাসছে কি?
না কি কোনোকিছু জলের তলা দিয়ে বেগে ছুটেছে? ওয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বোঝবার চেষ্টা করলে, হঠাৎ কেন জলের মধ্যে এমন তোলপাড় হচ্ছে।
ঢেউয়ের আছড়ানি দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে কোনো জাহাজের চাকারই কাজ–তবে সেটা জলের তলা দিয়ে চলেছে, না ভেসেই এসে এই খালে ঢুকছে তা বোঝবার কোনো জো নেই।
চুপচাপ, নিশ্চল, আমরা চোখকান টান করে এই গভীর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলুম। খালের ওপাশে যে তীরে এসে ঢেউ আছড়ে পড়ছে, তার শব্দ স্পষ্ট কানে। আসছে। জন হার্ট আর ন্যাব ওয়াকার উঁচু একটা পাথরের ওপর উঠে দাঁড়ালে, যাতে ভালো করে দেখতে পারে। আমি ঝুঁকে পড়ে জলের সেই আলোড়ন লক্ষ করছি। না, এখনও সমানে তেমনি আলোড়ন চলেছে; না, তাও নয়, বরং এখন আরো বেড়ে উঠেছে জলের শব্দ। আর সেই সঙ্গে আমি যেন শুনতে পেলুম কী যেন একটা দপদপ করে আওয়াজ করছে-যেন কোনো চাকার শব্দ।
আর-কোনো সন্দেহই নেই, আমার দিকে হেলে পড়ে নিচু গলায় ওয়েলস বললে, আমাদের দিকে একটা জাহাজ এগিয়ে আসছে কোনো স্টীমবোট।
তা-ই হবে হয়তো, আমি তাকে ফিশফিশ করেই বলেছি, যদি-না লেক ইরির জলে বড়ো-বড়ো হাঙর বা তিমি থাকে।
না-না, এটা নির্ঘাৎ কোনো স্টীমবোট, ওয়েলস আবারও বলেছে, প্রশ্ন হচ্ছে।–সে কি খালটার মুখের দিকে যাচ্ছে, না সেদিক থেকে এদিকটায় আসছে।
আগে তুমি দু-দু-বার এখানেই জাহাজটাকে দেখেছিলে, তা-ই না?
হ্যাঁ, এখানেই।
তাহলে এটা সেই একই জাহাজ-সেটা ছাড়া আর-কোনো স্টীমবোটই হতে পারে –সম্ভবত সেই একই জায়গায় এসে সে থামবে।
ঐ-যে! ফিশফিশ করে বলেছে ওয়েলস, ক্ৰীকের মুখটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে।
হার্ট আর ওয়াকারও ততক্ষণে ফিরে এসেছে, আর আমরা চারজনে বেলাভূমির ওপর গুঁড়ি মেরে বসে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করছি ব্ল্যাক রক ক্ৰীকের মুখটাকে।
আবছায়ার মধ্যে দেখতে পেলুম, একটা বিশাল-কালো কিছু অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে। খুবই আস্তে এগুচ্ছে সেটা, এখনও খালের মধ্যে এসে ঢোকেনি, এখনও লেকের জলেই ভেসে আছে, উত্তরপুবে, সামান্য-একটু দূরে। তার এনজিনের ক্ষীণ দপদপ শব্দ আর কানে আসছে না, সম্ভবত এনজিনটা থামিয়ে দেয়া হয়েছে, জাহাজটা শুধু আগেকার গতির তাড়নাতেই ভেসে আসছে।
তখনই মনে হলো, এটা নিশ্চয়ই সেই ডুবোজাহাজ, ওয়েলস যাক আগে দু-বার দেখেছে; সে নিশ্চয়ই আবারও এখানে রাত কাটাতে ফিরে আসছে, খালের মধ্যেই বোধহয় সে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।
তা-ই যদি হবে, যদি ফিরেই আসে, তবে হঠাৎ নোঙর তুলে সে চলে গিয়েছিলো কেন? আবারও কি তার কলকজা নতুন করে বিগড়ে গেছে–ঠিকমতো সে-সব সারানো হয়নি? না কি কোনো কারণে মেরামতির কাজ অসমাপ্ত রেখেই তাকে আচমকা চলে যেতে হয়েছিলো? হঠাৎ তাকে বাধ্য হয়ে আবার এখানে ফিরে আসতে হলো কেন? এমন কি কিছু হয়েছে যার ফলে সে এখন আর স্বতশ্চল শকটের মতো ডাঙার ওপর দিয়ে যেতে পারছে না–তার ফলে ওহায়োর রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটে যেতে পারছে না আর তীরবেগে?
পর-পর এত-যে প্রশ্ন আমার মনে ভিড় করে এলো, তার কোনো উত্তরই আমার জানা ছিলো না। তাছাড়া ওয়ে আর আমি দুজনেই ধরে নিয়েছি যে এটাই হলো বিভীষিকা, দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড যার অধিনায়ক, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে অসীম স্পর্ধাভরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেছে। অথচ এটা তো এখনও নিছকই অনুমান যতই এর সত্য হবার সম্ভাবনা থাকুক না কেন, এটা এখনও তো অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়নি।
যে-জাহাজই এটা হোক না কেন, সেটা রাতের আঁধারে প্রায় চুপিসাড়েই এখন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই তার কাপ্তেন এখানকার জল আর ডাঙার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, ব্ল্যাক রক ক্রীক নিশ্চয়ই নিজের হাতের চেটোর মতোই তার চেনা, না-হলে সে এমন ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে এভাবে আসবার সাহস পেতো না। ক্যাবিনগুলো থেকে একফোঁটাও আলো পড়ছে না বাইরে–যেমন রাত্রি ঘুটঘুঁটে আঁধার, তার চেয়েও গভীর-কালো এই জাহাজটা।
মুহূর্ত পরেই আমরা কী-সব যন্ত্রপাতির ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পেলুম। ঢেউয়ের তোড় বেড়েছে আরো; আর কয়েক মুহূর্ত পরেই জাহাজটা তার ঘাটায় এসে ঠেকলো।
ঘাটা কথাটা দিয়েই হয়তো, যেখানটায় জাহাজটা ভিড়েছে, তাকে চেনানো যায়। আমাদের পায়ের নিচে পাথরগুলো একটা স্তর তৈরি করেছে, জল থেকে পাঁচ-ছ ফিট ওপরে, আর এমনভাবে ঢালু হয়ে জলে গিয়ে গড়িয়ে পড়েছে যে সেখানে অনায়াসেই কোনো নৌকো বাঁধা যায়।
আমার হাত ধরে টেনে ওয়েলস ফিশফিশ করে বললে, আর আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে না।
না, আমিও তার কথায় সায় দিয়েছি, ওরা আমাদের দেখে ফেলতে পারে। আমাদের হয় গুঁড়ি মেরে থাকতে হবে, নয়তো কোনো পাথরের ফাটলে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে।
আমরা আপনার পেছনেই থাকবো।
একটা মুহূর্তও নষ্ট করার নেই। সেই ঘনকালো প্রাচীর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আমার ওপর, আর তার ডেকের ওপর, জলের একটু ওপরে ডেকটা, আমরা দেখতে পাচ্ছি দুজনের ছায়ামূর্তি।
তাহলে কি মাত্র দুজন লোকই আছে এই জাহাজে?
আমরা চুপিসাড়ে তারপর চলে গেছি নয়ানজুলিটার দিকে, যার একদিকের ঢাল উঠে গেছে ওপরের বনটায়, পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে ছোটো-ছোটো কতগুলো কুলুঙ্গির মতন। ওয়ে আর আমি একটায় গুঁড়ি মেরে বসলুম, পাশেই কুঁজো হয়ে জবুথবু বসে রইলো আমরা দুই সহকারী । বিভীষিকা থেকে লোক দুটি যদি তীরে এসে নামে, তাহলে আমাদের সহজে দেখতে পাবে না–অথচ আমরা তাদের ওপর নজর রাখতে পারবো, আর সুযোগসুবিধেমতো কোনো ব্যবস্থা করতে পারবো।
জাহাজটা থেকে ক্ষীণভাবে ভেসে আসছে নানারকম আওয়াজ, ইংরেজিতেই কারা যেন কী-সব বলাবলি করছে। বোঝা যাচ্ছে যে জাহাজটা এখানেই নোঙর ফেলবার প্রস্তুতি করছে। তারপর একটা দড়ি ছুঁড়ে ফেলা হলো জাহাজ থেকে, ঠিক সেই ঘাটায়, একটু আগেই যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলুম।
সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে ওয়েস দেখতে পেলে জাহাজিদের একজন দড়িটা লুফে নিয়েছে–সে আগেই লাফিয়ে তীরে নেমে পড়েছিলো। তারপর আমরা শুনতে পেলুম মাটির ওপর লোহা ঘষটে নেবার শব্দ।
কয়েক মুহূর্ত পরেই, বালির ওপর পায়ের আওয়াজ শোনা গেলো। দুজন লোক হাঁটতে-হাঁটতে সোজা নয়ানজুলিটার কাছেই এসে পড়েছে, কিন্তু না-থেমে সরাসরি বনটার দিকেই এগিয়ে গেলো, একজনের হাতে জাহাজি লণ্ঠন, তার আলোয় পথ দেখে চলেছে তারা।
কোথায় তাদের গন্তব্য? তবে কি ব্ল্যাক রক ক্রীক এই বিভীষিকার একটা নিয়মিত আশ্রয়স্থল, তাদের অন্যতম গোপন আড়া? তার কাপ্তেন কি এখানে রসদপত্তরের একটা ভাড়ার কিংবা গুদোম বানিয়ে রেখেছে? তাহলে কি তারা এখানে এসেছে জাহাজটায় আবার সব রসদ মজুদ করে নেবার জন্যে–যখন কোনো খামখেয়ালির টানে এদিকে তারা এসেই পড়েছে, তখন নতুন করে জাহাজে মালপত্তর তুলে নেবে বলেই কি তারা ঠিক করেছে? তারা কি জনমনুষ্যবর্জিত এই পরিত্যক্ত-জায়গাটাকে এতই ভালোভাবে জানে যে ধরা পড়ে যাবার কোনো ভয়ই তাদের নেই?
কী করবো এখন? ফিশফিশ করে জিগেস করলে ওয়েলস।
তাদের ফিরে-আসা অব্দি সবুর করা যাক–তারপর–বিস্ময়ে আমার আর কোনো বাফুর্তি হয়নি। লোক দুটি আমাদের কাছ থেকে তখন বোধহয় তিরিশ ফিটও দূরে ছিলো না, যখন তাদের একজন হঠাৎ কেন যেন পেছন ফিরতেই তাদের লণ্ঠনের আলোটা তার মুখের ওপর এসে পড়লো।
লং স্ট্রিটে আমার বাড়ির ওপর যে-দুজন লোক কড়া নজর রেখেছিলো, এ তাদেরই একজন। উঁহু, মোটেই কোনো ভুল হয়নি আমার। আমার বুড়ি দাসী যেমন ভালো করে তাদের চিনে রেখেছিলো, আমিও তাদের তেমনি ভালো করে খেয়াল করেছিলুম। সে-ই বটে; সে-ই ঐ দুজন চরের একজন, পরে আমি আর যাদের কোনো হদিশ পাইনি। আর-কোনো সন্দেহই নেই : আমাকে হুমকি দিয়ে চিঠিটা পাঠিয়েছিলো এরাই। চিঠি তবেই সত্যি-সত্যি এই দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড এর কাছ থেকেই এসেছিলো–এই বিভীষিকাতে বসেই ঐ চিঠির মুসাবিদা করা হয়েছিলো! আবারও আমি নিজেকে খুঁচিয়ে জিগেস করলুম : গ্রেট আইরির সঙ্গে এই বিভীষিকার কী সম্বন্ধে রয়েছে!
ফিশফিশ করে ওয়েসকে আমি আবার আবিষ্কারটার কথা খুলে বললুম। সব শুনে সে শুধু বললে : এ-যে এক বিষম প্রহেলিকা!
এদিকে তোক দুটি ততক্ষণে বনের দিকে আরো এগিয়ে গেছে, গাছতলায় গিয়ে কাঠকুটো জড়ো করছে। ওরা যদি শেষটায় আমার শিবিরটাকে দেখে ফ্যালে? ওয়েলস একটু উৎকণ্ঠায় ভরে গিয়েই জিগেস করলে।
তারা যদি কাছের গাছপালাগুলো পেরিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে না-পড়ে তাহলে অবশ্যি কোনো ভয় নেই।
কিন্তু যদি সেটা তাদের চোখে পড়ে যায়?
তাহলে তারা নিশ্চয়ই হুড়মুড় করে গিয়ে তাদের জাহাজে উঠে পড়তে চাইবে–আর তখন আমরা তাদের পালাবার পথ আটকে দাঁড়াবো।
ক্রীকের মুখটায়, যেখানে তাদের জলপোত নোঙর ফেলেছে–সেখান থেকে আর কোনো আওয়াজ আসছে না। আমি আমার লুকোবার জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এলুম; নয়ানজুলির ঢাল বেয়ে আমি নেমে এলুম ঐ ঘাটার দিকে; ঠিক যে-জায়গাটায় আঁকশির মতো লোহার বেড়ি পাথরগুলোয় আটকানো, ঠিক সেখানটাতেই আমি দাঁড়িয়ে রইলুম।
ঐ-তো, ঐ-যে, বিভীষিকা, জলের ওপর ভাসছে। কোথাও কোনো আলো নেই। কাউকে দেখা যাচ্ছে না-না ডেকের ওপর, না এই বালিয়াড়িতে। এই কি তবে আমার চমৎকার সুযোগ নয়? আমি কি লাফিয়ে উঠবো বিভীষিকায়, তারপর ঘাপটি মেরে বসে থাকবো কখন ঐ লোক দুটি জাহাজে ফিরে আসে?
মিস্টার স্ট্রক! কাছে থেকেই নিচু গলায় ডাক দিয়েছে ওয়েস।
আমি হুড়মুড় করে পেছিয়ে এসে তার পাশে গুঁড়ি মেরে বসে পড়লুম। জাহাজটার দখল নেবার পক্ষে কি বড্ড-বেশি দেরি হয়ে গেছে? না কি চেষ্টাটা এমনিতেই ভণ্ডল হয়ে যেতো, জাহাজ থেকে যারা তীরের দিকে নজর রেখেছে তাদের হুঁশিয়ারিতে? লণ্ঠন হাতে লোক দুটি এদিকে তখন নয়ানজুলিটা দিয়ে ফিরে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে তারা ঘুণাক্ষরেও কোনোকিছু সন্দেহ করেনি। দুজনেই হাতে এক-এক বাণ্ডিল কাঠ নিয়েছে, এগিয়ে এসে তারা ঘাটায় এসে থামলে।
তারপর তাদের একজন গলা চড়িয়ে–যদিও খুব জোরে নয়–হাঁক দিলে :হ্যাল্লো! কাপ্তেন!
সব ঠিক আছে। জাহাজটা থেকে একটা গলার স্বর ভেসে এলো।
ওয়েস আমার কানে-কানে গুনগুন করলে : সবশুদ্ধ তাহলে তিনজন!
হয়তো চারজন আছে, আমি গুনগুন করেই বললুম, কিংবা পাঁচ-ছজনও থাকতে পারে।
পরিস্থিতিটা ক্রমশই ঘোরালো হয়ে উঠছে। অতজন জাহাজির বিরুদ্ধে, আমরা এই ক-জনা কী করবো এখন? বেশি বেপরোয়া হতে গেলে হয়তো সমস্তই বিশ্রীভাবে ভণ্ডুল হয়ে যাবে। এই দুজনা যখন এখন ফিরে এসেছে, তারা কি তাদের কাঠকুটো নিয়ে এখন জাহাজে গিয়ে উঠে পড়বে? তারপরই কি ছেড়ে দেবে তাদের জাহাজ, কি দিন ফোঁটা পর্যন্ত এখানেই নোঙর ফেলে থেকে যাবে? যদি এই ঘাঁটি ছেড়ে এখন সে রওনা হয়, তাহলে কি বিভীষিকা আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে না? লেক ইরির জল ছেড়ে, পাশের যে-কোনো রাজ্যে গিয়ে সে হাজির হতে পারে, স্থলপথেইকিংবা হয়তো ডেট্রয়েট নদী দিয়ে ভেসে চলে যাবে লেক হুরন-এ, তারপর গ্রেট লেকস-এ, আরো ওপরে । ব্ল্যাক রক ক্ৰীকের সংকীর্ণ খালের জলে যে-মওকা এসেছে, তা কি আর পাওয়া যাবে কখনও।
অন্তত, আমি ওয়েসকে গলা নামিয়েই বললুম, অন্তত আমরা আছি চারজন। তারা যেহেতু কোনো অতর্কিত হামলার প্রত্যাশা করছে না, তারা গোড়ায় ভড়কেই যাবে –ভ্যাবাচাকা খেয়ে যাবে। তারপর ফলাফল তো দৈবের হাতে।
আমি আমার সহকারী দুজনকে ডাকতে যাবো, যখন ওয়ে আবার আমার হাত চেপে ধরলে। ঐ শুনুন!
তীর থেকে একজন জাহাজটাকে কাছে আসতে বললে, আর অমনি জাহাজটা আরো এগিয়ে এলো পাথুরে তীরের কাছে। তীরের দুজনকে ডেকে সম্ভবত কাপ্তেনই জিগেস করলে : ওখানে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?
বিলকুল।
আরো দু-বাণ্ডিল কাঠ পড়ে আছে ওখানে?
হ্যাঁ, দুই।
তাহলে আরেকবার গেলেই তাদের বিভীষিকায় এনে তোলা যাবে।
বিভীষিকা! আর সন্দেহ নেই : সে-ই!
হ্যাঁ, আরেকবার গেলেই হবে।
বেশ, তাহলে ভোর হলেই আমরা বেরিয়ে পড়তে পারবো।
তাহলে কি জাহাজটায় কুললে তিনজন লোকই আছে? কাপ্তেন, অর্থাৎ দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড, আর তার এই দুই স্যাঙাৎ?
তারা তাদের সব কাঠকুটো জাহাজে নিয়ে গিয়ে তুলতে চাচ্ছে। তারপর জাহাজে উঠে তারা যে-যার বার্থে পড়ে-পড়ে ঘুমুবে। তাহলে তখনই অতর্কিতে তাদের ওপর চড়াও হলে হয় না–কাঁচা ঘুম থেকে উঠে তারা আত্মরক্ষা করার কোনো সুযোগই তখন পাবে না!
জাহাজের কাপ্তেন হুঁশিয়ার হয়ে সজাগ দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে যখন, তখন জাহাজে গিয়ে লাফিয়ে নেমে সেটা দখল করে নেবার বদলে, ওয়েলস আর আমি ঠিক করলুম, তীরে লোকদুটোকে মাঝপথে না-আটকে তাদের বরং নিরাপদেই জাহাজে ফিরে যেতে দেয়া ভালো তারপর সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে পর না-হয় আমাদের পালা আসবে।
এখন রাত সাড়ে-দশটা বাজে। আবারও বালিয়াড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেলো। লণ্ঠন-হাতে লোকটা আর তার সঙ্গী আবারও নয়ানজুলির ঢাল বেয়ে বনের দিকে উঠে গেলো। তারা যখন দূরে চলে গেছে, আমরা কিছু বললে আর শুনতে পাবে না, তখন ওয়েস গিয়ে হার্ট আর ওয়াকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে এলো, আর আমি চুপি-চুপি পা টিপে টিপে গিয়ে একেবারে জলের ধার ঘেঁসে দাঁড়ালুম।
একটা ছোট্ট মোটা তার দিয়ে বিভীষিকা বাঁধা। অন্ধকারে যতটা আন্দাজ করা গেলো, মনে হলো সে লম্বা, ছিপছিপে, একটা টকুর মতো দেখতে; তার কোনো চিমনি নেই, কোনো মাস্তুল নেই, দড়িদড়া খাটাবার জন্যে কোনো সটান-দাঁড়ানো খুঁটিও নেই : নিউ-ইংল্যাণ্ডের জলে যখন সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো, তখন এই আকৃতির কথাই বারে বারে বলা হয়েছে।
আবার আমি নিজের জায়গায় ফিরে এলুম, আমার সহকারীরা নয়ানজুলিতে তাদের কুলুঙ্গির ভেতর লুকিয়ে আছে। একবার হাত দিয়ে আমি আমার রিভলবারটা ছুঁয়ে নিলুম, এটা হয়তো একটু পরেই কাজে লাগবে।
লোক দুটি বনের মধ্যে চলে যাবার পর পাঁচ মিনিট কেটে গিয়েছে। এখন তারা যে-কোনো মুহূর্তে ফিরে আসবে। তারপর অন্তত একঘণ্টা সবুর করতে হবে আমাদের, এদের ঘুমিয়ে পড়বার সময় দিতে হবে–তারপর আমরা অতর্কিতে হামলা করবো। তারা যাতে কিছুতেই তাদের জাহাজ পুরোদমে চালিয়ে তীরবেগে লেক ইরি থেকে বেরিয়ে যেতে না-পারে, কিংবা যেন ভুউশ করে জলের তলায় ডুবে না-যায়-এ-দুটি জিনিশ আমাদের ঠেকাতেই হবে।
এতদিন ধরে পুলিশে কাজ করছি, অথচ এর আগে আমি কখনও এমন অস্থির বোধ করিনি। মনে হলো, লোক দুটো হঠাৎ যেন বনের মধ্যে আটকা পড়ে গেছে–কিছু-একটা যেন তাদের ফেরার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে।
হঠাৎ একটা জোর আওয়াজে রাতের স্তব্ধতা ছিঁড়ে গেলো। শোনা গেলো ঘোড়ার খুরের দাপাদাপি, টগবগ করে খ্যাপার মতো যেন কতগুলো ঘোড়া ছুটেছে তীর ধরে।
আমাদেরই ঘোড়া, ভয় পেয়ে, হঠাৎ আঁৎকে উঠে, ধারে হয়তো কোচোয়ান ছিলো না, বনের ওপাশটার ফাঁকা জায়গা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে–আর এখন তীর ধরে তুলকালাম ছুট লাগিয়েছে।
আর ঠিক তখনই, লোক দুটো ফিরে এলো, এবার তারা প্রাণপণে ছুটছে। অর্থাৎ, সন্দেহ নেই আর, তারা আমাদের শিবিরটা আবিষ্কার করে ফেলেছে, আর সঙ্গে-সঙ্গে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছে যে আশপাশে কোনো পুলিশবাহিনী ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। তারা টের পেয়ে গেছে যে তাদের ওপর সজাগ নজর আছে পুলিশের, তাদের এক্ষুনি পাকড়ে ফেলা হবে। কজেই তারা দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে নয়ানজুলি দিয়ে ছুটে আসছে, তারপর ঐ লোহার শেকলটা খুলে দিয়ে তারা লাফিয়ে গিয়ে উঠে পড়বে বিভীষিকায়। আর উল্কার মতো বিভীষিকা অদৃশ্য হয়ে যাবে মুহূর্তে, আমাদের সব চেষ্টারই এমনি বিদঘুঁটেভাবে সলিল সমাধি হবে!
এগিয়ে এসো! ফরওয়ার্ড! বলে চেঁচিয়েই আমি নয়ানজুলির অন্যধারটা দিয়ে এগিয়ে গেলুম : এই লোক দুটোর পথ আটকাতেই হবে!
যেই তারা আমাদের দেখতে পেলে, হাতের বাণ্ডিল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিভলভার তাগ করে পর-পর গুলি ছুঁড়লে। একটা গুলি এসে জন হার্টের পায়ে লাগলো।
আমরাও উলটে আমাদের রিভলভারের ঘোড়া টিপলুম, কিন্তু ছুটন্ত লোকদুটোর গায়ে কোনো আঁচড়ই লাগলো না। তারা তেমনি সমানে ছুটে চলেছে–একটুও থমকে যায়নি ভয়ে। খালের মুখটার কাছে এসে, লোহার শেকল বা দড়িটা খোলবার কোনো চেষ্টা না করেই তারা লাফিয়ে গিয়ে বিভীষিকায় উঠে পড়লো।
তাদের কাপ্তেন, লাফিয়ে এগিয়ে এসে, আমাদের তাগ করে পর-পর গুলি ছুঁড়লো। একটা গুলি ওয়েলসের গা ছড়ে চলে গেলো।
ন্যাব ওয়াকার আর আমি লোহার শেকলটা চেপে ধরে বিভীষিকাকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তীরে নিয়ে আসবার চেষ্টা করলুম। তারা কি দড়িদড়া খুলে আমাদের হাত থেকে পালিয়ে যাবে?
আচমকা লোহার শেকলটা যেন প্রচণ্ড একটা হ্যাঁচকা টানে পাথর ভেঙে ছত্রখান করে ছিটকে চলে গেলো। আর তার একটা আংটা আটকে গেলো আমার কোমরের বেলটে, আর অন্য-একটা আংটার দুরন্ত ঘা খেয়ে ওয়াকার ছিটকে পড়লো কয়েক হাত তফাতে। আংটাটা আমাকে আটকে রেখেছে, আর একটা দুরন্ত টানে আমাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে–
বিভীষিকা, তার এনজিন তখন পুরোদমে জেগে উঠেছে, যেন এক লাফেই ব্ল্যাক রক ক্ৰীকের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলো লেক ইরির জলে।
.
১৩. দুর্বারগতি বিভীষিকা
যখন আমার জ্ঞান ফিরে এলো, তখন দিনের আলো ফুটেছে। পুরু কাঁচের ঘুলঘুলি দিয়ে ক্ষীণ একটা আলোর ছটা এসে ঢুকেছে সংকীর্ণ ক্যাবিনটায়; কেউ-একজন নিশ্চয়ই এই কুঠুরিটায় আমাকে রেখেছে, সে-যে ঠিক কত ঘন্টা আগে, তা আমার জানা নেই। কিন্তু যে-রকম বাঁকাভাবে রোদ্দুর এসে ঢুকেছে ঘুলঘুলিটা দিয়ে, তাতে মনে হলো সূর্য নিশ্চয়ই দিগন্ত থেকে বেশি ওপরে ওঠেনি।
একটা সরু বাঙ্কের ওপর আমি শুয়ে আছি, গায়ে কম্বল ঢাকা। আমার জামাকাপড় কোণায় একটা আংটায় ঝুলছে, এখন শুকিয়ে গেছে। আমার বেল্টটা সেই আংটার বিকট টানে ছিঁড়েই গিয়েছে, পড়ে আছে মেঝেয়।
গায়ে কোথাও কোনো ক্ষত নেই, কোনো চোটজখমও লাগেনি, শুধু একটু দুর্বল বোধ করছি। আমি যদি চেতনা হারিয়ে থাকি, তবে সেটা কোনো আঘাত খেয়ে নয়। ঐ শেকল আর দড়িদড়ার সঙ্গে জড়াজড়ি করে আমি নিশ্চয়ই জলে পড়ে গিয়েছিলুম, হয়তো মাথাটা শুষ্টু জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছিলুম। কেউ যদি আমাকে টেনে না তুলতো তবে আমি দমবন্ধ হয়ে মরেই যেতুম।
কোথায় আছি আমি এখন? বিভীষিকায়? কাপ্তেন আর দুই স্যাঙাতের সঙ্গে আমি একাই কি আছি এই জাহাজে–আমার সঙ্গীরা কেউ এখানে আমার সঙ্গে নেই? তা-ই সম্ভবত ঘটেছে, সম্ভবত কেন, নিশ্চিতই ঘটেছে। জ্ঞান হারাবার আগে কী দেখেছিলুম, আবার তা আমার মনশ্চক্ষুতে ভেসে উঠলো : হার্ট পড়ে আছে বালিয়াড়িতে, রক্তাক্ত, জখম; ওয়েলস পাগলের মতো তার রিভলভার থেকে পর-পর গুলি ছুঁড়ে চলেছে; যে-মুহূর্তে আংটাটা আমার বেটে জড়িয়ে গেছে, সেই মুহূর্তেই শেকলের প্রচণ্ড ধাক্কায় ওয়াকার ছিটকে পড়েছে মটিতে! আমার সম্বন্ধে কী ভাবছে এখন আমার সঙ্গীরা? যে, আমি লেক ইরির জলে তলিয়ে গেছি।
বিভীষিকা এখন কোথায়–কীভাবেই বা কাজ করছে তার এনজিন? সে কি এখন রূপান্তরিত হয়েছে স্বতশ্চল শকটে, পাশের কোনো রাজ্যের রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে? তা যদি হয়, আর আমি যদি অনেক ঘণ্টা অজ্ঞান পড়ে থাকি, তাহলে এই দুর্দান্ত গতিওলা যান এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনেক দূরে চলে এসেছে। না কি, ডুবোজাহাজ হিশেবে, আমরা অন্যকোনো হ্রদের তলা দিয়ে চলেছি?
না, বিভীষিকা এখন বিশাল-চঞ্চল কোনো জলের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। আমার এই ছোট্ট ক্যাবিনের গবাক্ষ দিয়ে যখন ঘরের মধ্যে রোদ্দুর এসে পড়েছে, তখন বোঝাই যাচ্ছে আমরা জলের তলা দিয়ে চলছি না। এদিকে সবচেয়ে ভালো শানবাঁধানো রাস্তাতেও গাড়িতে করে গেলে যে-রকম ঝাঁকুনি লাগে, সে-রকম কোনো ঝাঁকুনিও লাগছে না। তার মানে বিভীষিকা এখন ডাঙার ওপর দিয়ে যাচ্ছে না।
তবে সে এখন লেক ইরির ওপর দিয়ে চলছে কিনা, সেটা আমার এই চিৎপাত অবস্থায় বোঝা দুষ্কর। কাপ্তেন কি এতক্ষণে ডেট্রয়েট নদীতে এসে পড়েনি, কিংবা সেটা পেরিয়ে লেক হুরনে–কিংবা হয়তো তাকেও পেরিয়ে চলে এসেছে লেক সুপিরিয়রে! বোঝা মুশকিল।
কিন্তু যেখান দিয়েই যাক, আমি ঠিক করলাম সটান ডেকে চলে যাবো। সেখান থেকে আশপাশে তাকিয়ে দেখে হয়তো আন্দাজ করতে পারবো কোথা দিয়ে চলেছি। বাঙ্কটা থেকে কোনোমতে হিঁচড়ে নামালুম নিজেকে, তারপর হাত বাড়িয়ে আমার জামাকাপড় তুলে নিয়ে পোশাক পরে নিলুম। এইটুকু কাজ করতেই কী-রকম হাঁফ ধরে যাচ্ছিলো, বড় ক্লান্ত লাগছে–অথচ এতক্ষণ ঘুমিয়ে বেশ ঝরঝরে লাগারই কথা। তারপর বেরুতে গিয়েই খটকা লাগলো : এই ক্যাবিনে আমায় বন্দী করে রাখা হয়নি তো? বেরুবার রাস্তা তো দেখছি একটা সিঁড়ি, সোজা ছাতে চলে গেছে, ঢাকনা আটকানো হ্যাঁচওয়েতে। আমি একটু ঠেলা দিতেই ঢাকনাটা উঠে গেলো, আমি ডেকের ওপর আদ্ধেকটা শরীর গলিয়ে দিলুম।
আমার প্রথম চেষ্টা হলো সামনে, পেছনে এবং দু-পাশে তাকিয়ে দেখা। সবখানেই বিশাল-সব ঢেউয়ের পরে ঢেউ! কোত্থাও ডাঙার কোনো নামগন্ধও দেখা যাচ্ছে না। শুধু আকাশ আর জল–দুয়ে মিলে দূরে দিগন্তের বঙ্কিম রেখা তৈরি করে দিয়েছে।
কোনো বিশাল হ্রদ, না সমুদ্র-তা হয়তো চট করেই বুঝে নিতে পারবো। তীরের মতো ছুটে চলেছে ধাতুর তৈরি এই লম্বা চুরুটটা, গলুই জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে তরতর করে, দু-পাশে ঢেউ উঠছে ক্ষিপ্ত, উৎক্ষিপ্ত, আর পিচকিরির ছিটের মতো জল এসে লাগছে আমার গায়ে।
একটু চেখেই দেখলুম ঐ জল। না, লোনা নয়, মিষ্টি জল, সম্ভবত লেক ইরিরই জল। সূর্য মধ্যগগনের পথে আধরাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে, তার মানে সবশুদু হয়তো সাত আট ঘণ্টা কেটেছে আমার ঐ অজ্ঞান অবস্থায়, সেইসময়েই ব্ল্যাক রক ক্রীক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলো বিভীষিকা।
আজ তাহলে নতুন দিন, একত্রিশে জুলাই।
লেক ইরি প্রায় আড়াইশো মাইল লম্বা আর পঞ্চাশ মাইল চওড়া। আমি যে আশপাশে কোথাও ডাঙা দেখছি না, তাতে তাই অবাক হবার কিছু নেই–দক্ষিণপূবে না দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জমি, না-দেখা যাচ্ছে উত্তরপশ্চিমে ক্যানাডার জমি।
ডেকের ওপর এখন দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, একজন গলুইয়ের কাছে, তাকিয়ে দেখছে দূরে; অন্যজন হালের কাছে, দিক ঠিক রাখছে জলযানের; সূর্যের অবস্থা দেখে। আমার মনে হলো বিভীষিকা এখন উত্তরপুবদিকে চলেছে। গলুইয়ের কাছে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে আমি চিনি, তাকেই আমি দেখেছিলুম ব্ল্যাক রকের নয়ানজুলিতে, সেই ওয়াশিংটনে আমার বাড়ির ওপর নজর রেখেছিলো। দ্বিতীয়জন তার সেই সঙ্গী, যার হাতে লণ্ঠন ছিলো। এরা যাকে কাপ্তেন বলে ডাকছিলো তাকে চাক্ষুষ দেখবার জন্যে মিথ্যেই আমি আশপাশে তাকালুম–তাকে দেখা যাচ্ছে না কোত্থাও।
এই দুর্ধর্ষ যানটার বাহাদুর নির্মাতার মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্যে আমি যে কী-রকম অধীর হয়ে পড়েছিলুম, তা নিশ্চয়ই না-বললেও চলে। কী-যে আশ্চর্য প্রতিভা সে, সারা পৃথিবীটাকেই সে চমকে দিয়েছে;-দুঃসাহসী, বেপরোয়া, স্পর্ধায় গরীয়ান–সারা জগতের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়াতে সে পেছ-পা হয়নি, যে কিনা নিজেকে বলে নিখিলের প্রভু জগতের প্রভু–দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড!
গলুইয়ের কাছে যে-লোকটা দাঁড়িয়েছিলো, আমি তার দিকে এগিয়ে গেলুম। কাপ্তেন কোথায়?
সে যেন অর্ধনিমীলিত স্তিমিত নয়নে আমার দিকে তাকালে, যেন আমার কথা সে আদপেই বুঝতে পারেনি। অথচ কাল রাতে আমি নিজের কানে শুনেছি, সে ইংরেজি বলতে পারে। তাছাড়া, আমি যে আমার ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে এসেছি তা দেখে সে মোটেই অবাক হয়নি। আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে সে আবার অনিমেষ লোচনে দিগন্তের দিকে তকিয়ে রইলো।
আমি হালের দিকে এগিয়ে গেলুম। এই লোকটাকেই না-হয় কাপ্তেনের কথা জিগেস করবো। কিন্তু তার দিকে দু-পা এগুতেই সে তার হাত নেড়ে আমাকে সরে যেতে বললে। তার কাছ থেকেও আর-কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না।
তাহলে এখন আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এই দুর্ধর্ষ যানটাকেই শুধু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারি, যার ওপর থেকে আমাদের তাগ করে গুলি ছোঁড়া হয়েছিলো, যখন আমরা তার দড়িদড়া ধরে প্রবল বেগে টান দিয়েছিলুম।
আমি তাই এই যন্ত্রটাকে কীভাবে তৈরি করা হয়েছে, তা-ই সময় নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথায় চলেছে এই বিভীষিকা, আমাকে নিয়ে? ডেক আর তার ওপরের সবকিছু এমন-এক ধাতু দিয়ে তৈরি, যেটা আমি চিনতে পারলুম না কিছুতেই। ডেকের ঠিক মাঝখানটায় আদ্ধেক-ওঠানো রয়েছে একটা মস্ত ঢাকনা, তার তলায় ছোটো একটা ঘর, তাতে কতরকম কলকজা বসানো, সেখানে এনজিন অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে, প্রায় নিঃশব্দেই। আগেই যেমন বলেছি, কোনো মাস্তুল নেই, দড়িদড়া বাঁধবার কোনো খুঁটি বা চাকা নেই! এমনকী গলুইয়ের কাছেই ঝাণ্ডা পোঁতবার কোনো খুঁটি নেই। গলুই থেকে বরং দেখা যাচ্ছে একটা পেরিস্কোপের চোখের ওপরটা–তার মধ্য দিয়ে তাকিয়েই নিশ্চয়ই জলের তলা দিয়ে চালানো হয় বিভীষিকাকে। দু-পাশে রয়েছে, ভাঁজ করা, দুটো গ্যাঙওয়ের মতো দেখতে, হালকা ধাতুর পাত, যেমন দেখা যায় কোনো কোনো ওলন্দাজ জাহাজে। এ-দুটো যে কী কাজে লাগে, তা আমার মাথায় ঢুকলো না। গলুইয়ের কাছে তৃতীয় একটা হ্যাঁচওয়ের ঢাকনা ওঠানো-বিভীষিকা যখন বিশ্রাম করে, তখন এই লোক দুটো নিশ্চয়ই ঐ ঘরে নেমে গিয়ে ঘুমোয়।
হালের কাছে আরেকটা ঢাকনা–এখন নামানো রয়েছে। সেটা সম্ভবত কাপ্তেনের ক্যাবিনে যাবার দরজা-তাকে অবিশ্যি এখনও চাক্ষুষ দেখার সৌভাগ্য–বা দুর্ভাগ্য–আমার হলো না। এই বিভিন্ন ঢাকনাগুলো যখন নামানো থাকে, তাদের ওপর পরানো হয় রবারের খোলশ, তাতে সবটাই জলহাওয়ানিরোধ করে শক্ত হয়ে এঁটে যায়, যাতে সমুদ্রের তলা দিয়ে যাবার সময় ভেতরে জল ঢুকে যেতে না-পারে।
আর মোটরটা? যেটা এই যন্ত্রটাকে এমন দুরন্ত গতি দেয়, আমি তার কিছুই দেখতে পেলুম না, এমনকী প্রপেলারও না। এই ক্ষিপ্রবেগে ছুটে-জলা জলযান এখন পেছনে ফেলে রেখে যাচ্ছে দীর্ঘমসৃণ ফেনিল জলের স্রোত। যানটার পাশগুলো এমন মসৃণ। যে প্রায় কোনো ঢেউই তৈরি করে না, শুধু হালকাভাবে তরতর করে এমনকী খ্যাপা ঢেউয়ের পিঠে চড়েও এগিয়ে যেতে সাহস করে।
আগেই আমরা জেনেছি, যে-শক্তি এ-যন্ত্রটাকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায় সেটা বাষ্পও নয় গ্যাসোলিনও নয়, কিংবা এমন-কোনো তরল পদার্থ নয় যার গন্ধ থেকে সেটাকে শনাক্ত করতে পারা যায়–সাধারণত যে-ধরনের তরল পদার্থের সাহায্যে কোনো স্বতশ্চল শকট বা ডুবোজাহাজ চলে। সন্দেহ নেই, যে, এখানে যে-শক্তি ব্যবহার করা হয় তা বিদ্যুৎ-রাশি-রাশি জ্বালানি থেকে, না কি সঞ্চয়কোষ থেকে, ব্যাটারি থেকে? কিছু এ সব জ্বালানি কোন অগ্নিকুণ্ডে জ্বলে? এ-সব ব্যাটারি চার্জ করে কীভাবে? যদিনা বিদ্যুৎ সরাসরি টেনে-আনা হয় আশপাশের হাওয়া বা জল থেকে–এমন-কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করে যার কথা কারুরই জানা নেই। আর আমি মনে-মনে ভেবে নিলুম একবার : একবার যখন এই জাহাজে এসে উঠেছি তখন কি এ-সব রহস্য জেনে নেবার কোন সুযোগই আমি পাবো না?
তারপরেই মনে পড়ে গেলো আমার সঙ্গীসাথীদের কথা, যাদের ব্ল্যাক রক ক্রীকের তীরে ফেলে রেখে এসেছি। আমি তো জানি, একজন জখম হয়ে পড়ে ছিলো; হয়তো অন্যরাও শেষে আহত হয়েছে। আমাকে জাহাজের কাছি টেনে নিয়ে জলে নিয়ে ফেলেছিলো–তা-ই দেখে এটা কি তারা ভেবে নিতে পারবে যে অবশেষে বিভীষিকাই আমাকে সলিলসমাধি থেকে উদ্ধার করেছে? না নিশ্চয়ই। সন্দেহ নেই, আমার অপঘাত মৃত্যুর কথা টলেডো থেকে টেলিগ্রাম করে মিস্টার ওয়ার্ডকে এতক্ষণে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন তাহলে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর বিরুদ্ধে কে আর নতুন অভিযানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে? ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে যখন কাপ্তেনের আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করছি তখন এইসব ভাবনাই আমাকে কুরে-কুরে খাচ্ছিলো। কিন্তু কাপ্তেনের কোনো পাত্তাই নেই।
এদিকে আবার প্রচণ্ড খিদে পাচ্ছে : সম্ভবত গত চব্বিশ ঘণ্টায় পেটে কোনো দানাপানি পড়েনি। বনের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে সেই-যে একটু নাস্তা খেয়েছিলাম, তারপর আর-কিছুই খাইনি।আর যদি তা কাল সন্ধের সময় হয়ে থাকে, তাহলেও অনেকটা সময় গেছে উপোশ করে। আর এখন আমার জঠরটা যেভাবে মোচড় দিচ্ছে, তাতে এমনটা হওয়াও বিচিত্র নয় যে আমাকে দু-দিন আগে টেনে তোলা হয়েছিলো বিভীষিকায় কিংবা হয়তো তারও আগে।
তারা কি আমাকে ক্ষুন্নিবৃত্তির সুযোগ দেবে, কেমন করেই বা খাওয়াবে আমায়–এই প্রশ্নের সদুত্তরটা কিন্তু তক্ষুনি মিলে গেলো। গলুইয়ের লোকটা তার পাহারার জায়গা ছেড়ে চলে গেলো, ঢাকনা তুলে নিচে নেমে গেলো কোথাও, এবং পরক্ষণেই ফিরে এলো আবার। তারপর, মুখে একটি কথাও না-বলে, সে আমার সামনে এসে কিছু খাবার রেখে দিয়ে ফের গলুইতে তার পাহারায় চলে গেলো। একটা পাত্রে কিছু মাংস, জারানো শুঁটকি মাছ, বিস্কুট আর এক পাত্র বিয়ার–যেটা এতই কড়া যে আমাকে তার সঙ্গে খানিকটা জল মিশিয়ে নিয়ে হালকা করে নিতে হলো। এই সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্যের প্রতি যথেষ্ট সুবিচারই করেছিলুম আমি। আমি ক্যাবিন থেকে বেরুবার আগে আমার সহযাত্রীরা নিশ্চয়ই খেয়ে নিয়েছিলো, তাই তারা আমার সঙ্গে ভোজে বসেনি।
ডেকের ওপর আর-কিছুই তেমনভাবে কৌতূহলযোগ্য বলে মনে হলো না। আমি বরং আবার আমার উত্তেজিত ভাবনাগুলোর মধ্যে তলিয়ে গেলুম। এই অ্যাডভেনচারের শেষ পরিণাম কী হবে? এই অদৃশ্য কাপ্তেনকে কি আমি চাক্ষুষ দেখতে পাবো কখনও? সে কি আমাকে ছেড়ে দেবে, মুক্তি দেবে? সে না-দিলেও, আমি কি নিজের চেষ্টাতেই। মুক্তি পেতে পারবো? সেটা অবশ্য নির্ভর করবে, পরিস্থিতি কতটা ঘোরালো হয়ে ওঠে, তার ওপর। কিন্তু বিভীষিকা যদি তীর থেকে এতখানি দূর দিয়েই চলতে থাকে, কিংবা কখনও ঠিক করে নেয় যে জলের তলা দিয়েই যাবে বাকি পথ, তাহলে এখান থেকে আমি পালাবো কী করে? যতক্ষণ-না ডাঙায় গিয়ে পৌঁছুই, আর এই যান রূপান্তরিত হয়ে যায় স্বতশ্চল শকটে, ততক্ষণ কি পালিয়ে যাবার সব আশা আমাকে ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে হতাশ বসে থাকতে হবে?
তাছাড়া, এটাই বা কবুল করবো না কেন? বিভীষিকার গোপন কথা কিছুই না। জেনে শুধু প্রাণটা বাঁচাবার জন্যে পালিয়ে যাওয়া–তাতে সবসময়েই আমার মনটা খচখচ করবে। যদিও আমার এই অভিযানের এই দশার জন্যে আত্মপ্রসাদ অনুভব করার কোনোই কারণ নেই, যদিও প্রায় এক চুলের জন্যে প্রাণে-মরা থেকে আমি বেঁচে গিয়েছি, আর যদিও ভবিষ্যৎ মনে হচ্ছে আরো-সমস্ত ভয়াবহ অলুক্ষুনে বিপদে ভরপুর–তবু, মানতেই হয় যে, কোনোরকমে তো এক-পা এগুনো গেছে। সত্যি-যে এখানে এ-অবস্থায় থাকলে, জগতের সঙ্গে আর-কোনোদিনই আমি কোনো যোগাযোগ করতে পারবো না, দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড যেমন স্বেচ্ছায় নিজেকে আইনকানুনের পরপারে স্থাপন করেছে, আমি স্বেচ্ছায় না-হোক দৈববশেই পড়ে আছি মনুষ্যজাতির নাগালের বাইরে–তা যদি না-হতো, আমি যে অন্তত বিভীষিকায় এসে উঠেছি, এই তথ্যটাকেও লোকে মূল্যবান বলে গণ্য করতো।
এই জলযান তেমনি সমানে একটানা উত্তর পুবদিকে চলেছে, লেক ইরির সবচেয়ে দীর্ঘ অক্ষটাকেই বেছে নিয়ে অর্ধগতিতে ছুটেছে । তার যে তেমন তাড়া দেখা যাচ্ছে, তা হয়তো এইজন্যেই সে সবকিছু ঠিকঠাক সারাই করিয়ে নিতে পারেনি, না-হলে এতক্ষণে তো তার হ্রদটার উত্তরপুর সীমান্তেই পৌঁছে যাবার কথা।
এদিকটায় নায়াগ্রা নদী ছাড়া লেক ইরি থেকে বাইরে বেরুবার আর-কোনো রাস্ত নেই। নায়াগ্রা মারফৎই তার জল গিয়ে পড়ে লেক অন্টারিওতে। বাফেলো থেকে মাইল পনেরো দূরে এই নদী একটা প্রচণ্ড প্রপাতের আকারে নদীতে গিয়ে পড়েছে। বিভীষিকা যেহেতু ডেট্রয়েট নদীতে পেছিয়ে আসেনি, যা দিয়ে সে ওপরের হ্রদগুলো থেকে এখানে এসে নেমেছিলো, কেমন করে তবে সে এই জলপ্রপাত থেকে রেহাই পাবে–যদি না অবশ্য শেষ মুহূর্তে সে ঠিক করে নেয় যে সে ডাঙা দিয়েই বাকি পথটা পেরুবে?
সূর্য একক্ষণে মধ্যগগন পেরিয়ে গেছে। চমৎকার টলটলে একটা দিন, উষ্ণ–তবে গরম নয়, কারণ একটা মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে হ্রদের ওপর। হ্রদের দু-তীর এখনও অগোচর : না দেখা যাচ্ছে মার্কিন তীর, না-বা ক্যানাডার সীমান্তরেখা।
কাপ্তেন কি মনে-মনে ঠিক করেই ফেলেছে আমার কাছে সে দেখা দেবে না? নিজেকে এ-রকম গোপন করে রাখবার বিশেষ-কোনো কারণ আছে কি তার? তার এই সতর্কতা দেখে মনে হয় সে হয়তো আমাকে সন্ধের সময় ছেড়ে দেবে–তখন। বিভীষিকা সকলের অগোচরে তীরের কাছে গিয়ে পৌঁছুতে পারবে।
দুটো নাগাদ–অবশ্য–ছোট্ট একটা আওয়াজ শুনতে পেলুম, দেখলুম মাঝখানের হ্যাঁচওয়ের ঢাকনাটা উঠে আসছে। যে-লোকটাকে চাক্ষুষ একবার দেখবার জন্যে আমি এমন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলুম, এতক্ষণে সে ডেকে এসে দাঁড়ালে।
কবুল করতেই হবে তার স্যাঙাত্র যেমন আমাকে কোনো পাত্তাই দেয়নি, সেও আমাকে তেমনিভাবেই কোনো পাত্তা দিলে না। হালের কাছে গিয়ে সে নিজেই এখন হালের চাকা ধরে বসলো। যে-লোকটাকে সে ছুটি দিলে তার সঙ্গে নিচু গলায় কী একটা বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করলে সে;লোকটা তারপর সামনের হ্যাঁচওয়ে দিয়ে নিচে নেমে গেলো। কাপ্তেন, দিগন্তের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে, কম্পাসটা লক্ষ করলে, তারপর জাহাজের মুখটা একটু বদলে দিলে। বিভীষিকার গতি ক্রমশ বেড়ে উঠলো।
কাপ্তেনের বয়েস সম্ভবত পঞ্চাশের ওপর। মাঝারি উচ্চতা, বৃষস্কন্ধ, মেরুদণ্ড সোজা; প্রকাণ্ড মাথা, কঁকড়া-ঝাকড়া চুল, শাদা নয়–ছাইরঙা, মসৃণ কামানো গাল, আর ছোট্ট একটুকু মুচমুচে দাড়ি। বিশাল চওড়া বুক, চোয়াল চোখা বেরিয়ে আছে, আর সারা শরীরটাতেই যেন টগবগ করে ফুটছে সুস্বাস্থ্য, ঝোঁপের মতো জোড়া ভুরু। যেন ইস্পাতে-গড়া তার কাঠামোটা, চমৎকার স্বাস্থ্যের দীপ্তি, আর তার রোদে-পোড়া চামড়ার নিচে উষ্ণ লাল রক্ত যেন ফুটছে। সঙ্গীদের মতো, কাপ্তেনও পরে আছে নাবিকের পোশাক, তার ওপরে চাপানো অয়েলক্লথের কামিজ, মাথায় একটা পশমি টুপি-ইচ্ছে করলে সে-টুপি হয়তো নাকের ডগা অব্দি নামিয়ে-আনা যায়।
এটা কি এখন বলে দেয়া উচিত, যে, লং স্ট্রিটে আমরা বাড়ির ওপর কিছুদিন আগে যে-দুজন তোক নজর রাখছিলো, এই কাপ্তেন ছিলো দুজনেরই একজন। তাছাড়া, আমি যদি তাকে চিনতে পেরে থাকি, তবে সেও নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছে যে আমিই হলুম চীফ-ইন্সপেক্টর স্ট্রক, যার ওপর ভার পড়েছিলো গ্রেট আইরির রহস্যভেদ করার!
প্রগাঢ় কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকালুম আমি। সে যদিও চোখ সরিয়ে নেয়নি, তবু তার জাহাজে যে একজন বাইরের লোক আছে সে-সম্বন্ধে তার চোখেমুখে একটা পরম ঔদাসীন্যের–না কি তাচ্ছিল্যের–ভাব। তাকে দেখতে-দেখতে হঠাৎ আমার কেমন যেন মনে হলো–না, ওয়াশিংটনে তাকে যে আগে বাড়ির সামনে দেখেছি, তা নয়–এর আগে কোথাও যেন এই চেহারা আমি আগেই দেখেছি। পুলিশের দফতরে যেসব ফোটোগ্রাফ আছে, তাদের মধ্যে কি? না কি তার ছবি দেখেছি আমি কোনো দোকানের জানলায়? আবছা যেন মনে পড়তে চাচ্ছে কোথায় এই মুখ আগে দেখেছি, অথচ ঠিক ধরতে পারছি না। হয়তো সবই আমার মনের ভুল।
তার স্যাঙারা অবশ্য আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো কোনো ভদ্রতা দেখায়নি, কিন্তু এর ব্যবহার হয়তো তাদের চেয়ে সভ্য ও শালীন হতে পারে। আমারই ভাষায় সে কথা বলে, যদিও সে কোনো মার্কিন কিনা সেটা ঠিক করে বলা মুশকিল। সে হয়তো আমার কথা বুঝতে না-পারার ভান করবে যাতে আমি যতক্ষণ তার বিভীষিকায় কয়েদ হয়ে আছি ততক্ষণ আমার সঙ্গে তার কোনো কথাবার্তা না-হয়।
তা যদি হয়, তবে সে আমাকে নিয়ে কী করতে চাচ্ছে? সে কি কোনো ভদ্রতার বালাই না-রেখেই আমার একটা সগতি করে ফেলতে চাচ্ছে? না কি সে অপেক্ষা করছে কখন রাত নামে–তারপর আমাকে নামিয়ে দেবে জাহাজ থেকে? না কি তার সম্বন্ধে অল্প যা-কিছু আমি জেনেছি–সামান্যই–তা-ই আমাকে তার কাছে এতটা বিপজ্জনক করে তুলেছে যে আমাকে খতম করে না-ফেলে তার কোনো স্বস্তি হবে না? কিন্তু তা-ই যদি তার ইচ্ছে ছিলো, তবে জল থেকে তুলে আমাকে না-বাঁচালেও তো পারতো। আবার ফিরে-একবার আমাকে জলে ডুবিয়ে মারার হাত থেকে নিজেকে তাহলে বাঁচাতে পারতো সে।
আমি ফিরে দাঁড়িয়ে, সোজা হালের দিকে এগিয়ে গিয়ে, ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়ালুম। তখন, অবশেষে, আমার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে না-তাকিয়ে সে পারলে না–কিন্তু তার চোখ দুটো যেন দপদপ করে জ্বলছিলো।
আপনিই এ-জাহাজের কাপ্তেন? আমি তাকে শুধোলুম।
তার মুখে টু শব্দটি নেই।
এই জাহাজ! এ কি সত্যি বিভীষিকা জাহাজ?
এই প্রশ্নের উত্তরে তার কাছ থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া গেলো না। তারপর আমি তার দিকে একটু ঝুঁকে পড়লুম, হয়তো তার হাতটা ধরতুম, কিন্তু গায়ের জোর–দেখিয়েই সে আমার হাতটা সরিয়ে দিলে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছিলো তার ঐ ভঙ্গিটার আড়ালে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে প্রচণ্ড দৈহিক শক্তি।
আবার তার সামনে নিজেকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়ে, আমি অপেক্ষাকৃত জোর গলায় জানতে চাইলাম : আমাকে নিয়ে আপনি কী করবেন বলে ভাবছেন?
তার মুখ থেকে যেন একরাশ কথা ফুটে বেরুতে গিয়েও থমকে গেলো, অনেক কষ্টে নিজেকে সে দমন করলে–কথা বলবে না। মুখটা সে একপাশে ফিরিয়ে নিলে। তার হাত সামনের যন্ত্রটার কী-একটা বোতামে চাপ দিলে, অমনি দুম করে বিভীষিকার গতি বিষম বেড়ে গেলো।
রাগে আমার পা থেকে মাথা অব্দি জ্বলে যাচ্ছিলো। চেঁচিয়ে বলতে চাচ্ছিলুম : ঠিক আছে! তা-ই হোক তবে! পুষে রাখো তোমার ঐ স্তব্ধতা! আমি জানি তুমি কে –যেমন জানি তোমার এই যন্ত্রটাকেও-লোকে যাকে দেখেছে ম্যাডিসনে, বস্টনে, লেক কিরডালে। হ্যাঁ, তুমি, তুমিই–যে-তুমি অমন খ্যাপার মতো ঝড়ের বেগে ছুটে গেছো আমাদের জলে-ডাঙায়! তোমার এই জাহাজের নাম বিভীষিকা, তুমিই তার মালিক, তুমিই সরকারকে অমন স্পর্ধিত চিঠি লিখেছিলে! তুমি ভেবেছো তোমার এই দুর্বারগতি বিভীষিকা নিয়ে আস্ত জগৎটার সঙ্গে লড়বে! নিজেকে তুমি কি না বলে নিখিলের প্রভু, জগতের প্রভু, দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড!
আর যদি তা বলতুম, কথাগুলো তবে সে অস্বীকার করতো কী করে! কেননা ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার চোখে পড়ে গেছে সারেঙের ঢাকার গায়ে লেখা
আদ্যক্ষরগুলো : মা, আ, ও.!
ভাগ্যিশ আমি নিজেকে সংযতই রেখেছিলুম; আর, কোনো কথারই কোনো উত্তর পাবো না বুঝতে পেরে, নিরাশ, ভগ্নোদ্যম, আমি ফিরে এলুম আমার ক্যাবিনে যাবার হ্যাঁচওয়েটার পাশের আসনে।
অনেক, অনেকক্ষণ ধরে, দীর্ঘ সুদীর্ঘ সব ঘণ্টা, বিলম্বিত সব প্রহর, আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলুম দিগন্তের দিকে–কখন ডাঙা চোখে পড়ে। হ্যাঁ, বসে-বসে অপেক্ষাই করছিলুম ডাঙার জন্যে। কেননা হ্রস্বীভূত হতে-হতে এখন আমি তা-ই হয়ে উঠেছি : মনুষ্যদেহের মধ্যে জলজ্যান্ত এক প্রতীক্ষা! দিন শেষ হবার আগে, বিভীষিকা যে লেক ইরির শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছুবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই–কেননা সে সামনে, একটানা, সেই উত্তরপুবদিকেই চলেছে।
.
১৪. প্রপাতের নাম নায়াগ্রা
ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলো অথচ পরিস্থিতিতে একফোঁটাও বদল নেই। অন্য স্যাঙাত্রা আবার ফিরে এসেছে ডেকে, আর কাপ্তেন, নেমে গিয়ে, এনজিনের কলকজা নিয়ে কী সব খুটখাট শুরু করেছে। গতি-বেড়ে-যাওয়া সত্ত্বেও যন্ত্র কিন্তু কোনো আওয়াজ না করেই নিঃশব্দে কাজ করে চলেছে–আর কী ছিমছাম মসৃণ সবকিছু। কোথাও একবারও কোনো ছেদ পড়ছে না, সাধারণত যেমন হয় সব মোটরেই, এক-আধবারে হয়তো পিস্টন দু-এক সেকেণ্ড থেমে যায়। আমার মনে হলো, বিভীষিকারযখন একেকটা রূপান্তর হয়, তখন সেটা ঘটায় কোনো রোটারি যন্ত্র। অবশ্য এটা আমার অনুমান, ঠিক করে যাচাই করে নেবার কোনো সুযোগই ছিলো না। এতক্ষণ ধরে একবারও দিক বদলায়নি বিভীষিকা। সারাক্ষণই আমরা শুধু হ্রদের উত্তরপুবদিকে চলেছি–তার মানে বাফেলোর দিকে।
কাপ্তেন যে কেন এই পথেই চলেছে, সেটাই আমি সারাক্ষণ অবাক হয়ে ভেবেছি। সে নিশ্চয়ই বাফেলোতে থামতে চাচ্ছে না, সেখানে তো সারাক্ষণই কত ধরনের নৌকোর ভিড় লেগেই আছে। যদি জলপথেই এই হ্রদ ছেড়ে সে চলে যেতে চায় তাহলে বাকি থাকে শুধু নায়াগ্রা নদী–আর তার জলপ্রপাত এমন-একটা আশ্চর্য যানের পক্ষেও অতিক্রম করা অসম্ভব। বেরুবার আরেকটা রাস্তা ছিলো ডেট্রয়েট নদী, অথচ বিভীষিকা তো সারাক্ষণই তাকে পেছনে ফেলে আসছে।
হয়তো কাপ্তেন আসলে রাত্তিরেরই অপেক্ষা করছে-হয়তো তখন অন্ধকারের গা ঢেকে সকলের অগোচরে জলযানকে স্বতশ্চল শকটে রূপান্তরিত করে শেষে চটপট পাশের রাজ্যগুলো পেরিয়ে যাবে। ডাঙার ওপর দিয়ে যখন যাবে, তখন যদি আমি পালাতে না-পারি, আমার মুক্তি পাবার সব আশাই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
এখনও-অব্দি কেউ যা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি, তা হয়তো আমি এর মধ্যে আবিষ্কার করে ফেলবো–অবশ্য সে যদি তার মধ্যেই আমাকে খতম করে না-ফ্যালে–কেননা তার মঙ্গলের পক্ষে বিপজ্জনক বড্ড-বেশি কথা আমি এর মধ্যেই জেনে। ফেলেছি।
লেক ইরির উত্তরপুর প্রান্তটা আমি ভালোই চিনি, কারণ অনেকবারই নিউইয়র্ক : রাজ্যের অ্যালবানি থেকে বাফেলো অব্দি আমাকে যাতায়াত করতে হয়েছে। তিন বছর আগে, কোনো-একটা পুলিশি তদন্তের কাজে আমাকে নায়াগ্রা নদীর দু-তীর ভালো করে পরীক্ষা করতে হয়েছিলো, জলপ্রপাতের দুই পাশেই, এমনকী সাসপেনশন ব্রিজের ওপরেও। বাফেলো আর ছোট্ট শহর নায়াগ্রা ফল্স-এর মধ্যকার বড়ো দুটি দ্বীপেও আমি গিয়েছি; ভালো করে দেখে এসেছি নেভি আইল্যাণ্ড আর গোট আইল্যাণ্ড–এই দুটো দ্বীপই মার্কিন প্রপাতটিকে ক্যানাডার প্রপাত থেকে আলাদা করে রেখেছে।
ফলে, পালিয়ে যাবার কোনো সুযোগ যদি এসেই পড়ে, একেবারে অচেনা কোনো বিজনবিভঁয়ে গিয়ে পড়বো না আমি। কিন্তু তেমন-কোনো সুযোগ কি সত্যি আসবে? আর আমার অন্তরের অন্তস্তলেও, আমি কি তা সত্যি-সত্যি কামনা করছি–কিংবা সুযোগ এলে সেটা কি আমি সত্যি গ্রহণ করবো? আর-কোন রহস্য ঘোরপ্যাঁচ তৈরি করে আছে ব্যাপারটায়, যা আমার সৌভাগ্য–না কি সে দুর্ভাগ্যই?–আমাকে এমনভাবে পাকে-পাকে জড়িয়ে ফেলেছে?
নায়াগ্রা নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছুবার সত্যি কোনো আশা আছে বলে অবশ্য আমার মনে হয় না। যেখান থেকে বেরুবার কোনো রাস্তাই নেই, সেখানে গিয়ে ঢোকবার মতো দুঃসাহস বিভীষিকার হবে কেন? হয়তো সে হ্রদটার শেষ প্রান্ত অব্দি যাবেই না।
আর এইসব উলটোপালটা ভাবনাই আমার মগজের মধ্যে অনবরত পাক খাচ্ছিলো–আর চোখ দুটো সারাক্ষণ চুম্বকের মতো আটকে ছিলো শূন্য দিগন্তের দিকে। আর সবসময়েই ছিলো নাছোড় একটা প্রশ্ন, যার মীমাংসা আমার জানা নেই। কাপ্তেন কেন নিজে আমাকে অমনভাবে হুমকি দিয়ে চিঠিটা লিখেছিলো? ওয়াশিংটনে আমার বাড়ির ওপর সে নজর রেখেছিলো কেন? সে-কোন বন্ধন তাকে গ্রেট আইরির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে? মাটির তলায় অজানা সুড়ঙ্গের মতো খাল হয়তো আছে লেক কিরডালে, যে-সুড়ঙ্গ দিয়ে সে গিয়ে ঢুকতে পেরেছিলো ঐ হ্রদে, কিন্তু কেমন করে সে গ্রেট আইরির অভেদ্য দুর্গপ্রাকার ভেদ করে ভেতরে ঢুকবে? না, না, সে যতই অদ্ভুতকর্মা মায়াবী পুরুষ হোক না কেন, এটা তার পক্ষেও অসাধ্য।
বিকেল চারটে নাগাদ, বিভীষিকার গতিবেগ দেখে আর যেদিকে চলেছে সেদিকে খেয়াল রেখে, আমি বুঝতে পারলুম আমরা নিশ্চয়ই বাফেলোর কাছে এসে পৌঁছেছি–আর, সত্যিই, প্রায় পনেরো মাইল আগে থাকতেই, দূর থেকে তার তীরের রেখা দেখা যেতে লাগলো। এতটা পথ চলবার সময় দূর থেকে জলে কয়েকটা নৌকো বা স্টীমবোট দেখা গেছে বটে, তবে সেগুলো এত দূর দিয়ে গেছে–কিংবা যদি নাও যেতো, এই কাপ্তেনই ইচ্ছে করে দূরত্ব বজায় রেখে দিতো–যে তাকে এ-সব পোতের সঙ্গে দেখা-হওয়া বলে না। তার ওপর, এই চুরুটের মতো লম্ব বিভীষিকা জলের থেকে বেশি ওপরে থাকে না কখনোই, নিচুই থাকে সে, তাতে এক মাইল দূর থেকে দেখলে সে আছে কি নেই তা-ই হয়তো বোঝা সম্ভব হতো না।
এখন অবশ্য, বাফেলো থেকেও দূরে, তার পরপারে, লেক ইরির শেষ প্রান্তটাকে ঘিরে যে-পাহাড়গুলো আছে সেগুলোকে দেখা যেতে লাগলো। একটা চোঙের মতো যেন, আর তারই মধ্য দিয়ে গিয়ে লেক ইরির জল পড়েছে নায়াগ্রা নদীতে। ডানদিকে উঠে গেছে কতগুলো বালিয়াড়ি, এখানে-সেখানে জড়াজড়ি করে আছে গাছপালা। দূরে, কতগুলো মালবওয়া স্টীমার আর জেলে-নৌকো ভেসে চলেছে। আকাশে কোথাও কোথাও ধোঁয়ার কুণ্ডলি, এ-সব স্টিমারের চোঙ দিয়ে সে-সব ধোঁয়া আকাশে উঠছে, তারপরেই হালকা ভেসে যাচ্ছে পূরবৈয়া হাওয়ায়।
এখনও বাফেলোর দিকেই এগিয়ে চলেছে বলে আমাদের কাপ্তেন যে কী ভাবছে, তা-ই বুঝতে পারলুম না। বিচক্ষণতা বলে তার যদি কিছু থেকে থাকে, সে কি তবে তাকে সাবধান করে দিচ্ছে না? প্রতি মুহূর্তেই আশা করছি, চাকা ঘুরিয়ে সে জলযানের দিক পালটে পশ্চিমমুখো চলে যাবে, আর নয়তো, সে প্রস্তুতি নেবে ভুউশ করে জলের মধ্যে ডুবে যাবার। কিন্তু জাহাজের গলুইটা সারাক্ষণ বাফেলোর দিকে জেদির মতো চালিয়ে সে-যে কী করতে চাচ্ছে, তা-ই বোঝা যাচ্ছিলো না।
অবশেষে–এতক্ষণ যাকে সারেঙ বলে মনে হচ্ছিলো–যার চোখদুটি উত্তরপুবের তীরে চুম্বকের মতো আটকে ছিলো, তার সাথীর দিকে তাকিয়ে কী-একটা ইঙ্গিত করলে। সাথীটি গলুই ছেড়ে সোজা চলে গেলো মধ্যেকার হ্যাঁচওয়ের দিকে আর এনজিন-ঘরে নেমে পড়লো। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কাপ্তেন এসে হাজির হলো ডেকে, আর সারেঙের কাছে গিয়ে নিচু গলায় তার সঙ্গে কী-এক আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়ে পড়লো।
সারেঙ, বাফেলোর দিকে হাত বাড়িয়ে, ছোটো-ছোটো দুটি কালো-কালো ফুটকির মতো কী যেন দেখালে-জাহাজ থেকে পাঁচ-ছ মাইল দূরে রয়েছে সেই কালো বিন্দুগুলি। কাপ্তেন গভীর মনোনিবেশ সহকারে সেগুলো নিরীক্ষণ করলে, তারপর তাচ্ছিল্যভরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে, সে চাকার হাতলের কাছে বসে পড়লো। বিলীষিকাকিন্তু সমানে সামনেই এগিয়ে চললো, তার চলার পথ পালটালো না।
মিনিট পনেরো পরে, আমি দেখতে পেলুম ঐ কালো-কালো ফুটকিগুলো আর কিছু নয়, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি। আস্তে আস্তে সেই ধূম্রকুণ্ডলির তলায় কালো জিনিশগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো, দুটো লম্বা নিচু স্টীমার, বাফেলোর বন্দর থেকে বেরিয়ে তারা দ্রুতবেগে বিভীষিকার দিকে ছুটে আসছে।
আচমকা আমার মনে হলো এই দুটো সেই টরপেডো-ডেস্ট্রয়ার নয় তো, একদিন প্রসঙ্গক্রমে মিস্টার ওয়ার্ড যাদের কথা বলেছিলেন! আরো বলেছিলেন, দরকার মনে হলে, আমি যেন তাদের খবর দিই।
এই ডেস্ট্রয়ারগুলো সর্বাধুনিক কারিগরিবিদ্যার নিদর্শন। এ-দেশে বানানো সবচেয়ে দ্রুতগামী স্টীমবোট। সর্বাধুনিক প্রকৌশলবিদ্যায় তৈরি অতীব-শক্তিশালী এনজিন এদের চালায়। এরা এর মধ্যেই ঘণ্টায় প্রায় তিরিশ মাইল পথ পেরিয়ে এসেছে। সত্যি-যে, বিভীষিকা আরো-দ্রুততর বেগে যেতে পারে, আর চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরলে সে ভুউশ করে ডুবে গিয়ে সকলের হাত এড়িয়ে যেতে পারে। বিভীষিকাকে যদি আক্রমণ করতেই হয়, তাহলে এই ডেস্ট্রয়ারগুলোকে ডুবোজাহাজও হতে হবে, না হলে সাফল্যের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। আর তৎসত্ত্বেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা সমানে সমানে হবে কি না, সে-বিষয়ে আমার সবিশেষ সন্দেহ ছিলো।
তবে হাবভাব দেখে মনে হলো এই দুই ডেস্ট্রয়ারের কম্যাণ্ডারদের নিশ্চয়ই হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে : হয়তো ওয়েলস চটপট টলেডো ফিরে গিয়ে টেলিগ্রাম করে আমাদের হারের কথা জানিয়ে দিয়েছে। এও মনে হলো, এই জাহাজগুলো বুঝি বিভীষিকাকে দেখতেও পেয়েছে, কেননা তারা পুরোদমে বিভীষিকাকে লক্ষ্য করেই ছুটে আসছে। অথচ বিভীষিকার কাপ্তেন তাদের কোনো পাত্তাই না-দিয়ে সোজা নায়াগ্রা নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে। এ-অবস্থায় এই ডেস্ট্রয়ারগুলো কী করবে? হয়তো তারা এমন। কৌশল করে হ্রদের সেই সরুপথটা আটকে দাঁড়াবে যেখান দিয়ে হ্রদের জল গিয়ে নায়াগ্রায় পড়েছে–যাতে বিভীষিকা কিছুতেই ঐ নদীতে গিয়ে পড়তে না-পারে।
বিভীষিকার কাপ্তেন স্বয়ং এবার হালে বসেছে, সারেঙের চাকায় তার হাত। একজন সাগরেদ লইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে, অন্যজন নিচে এনজিনঘরে। আমাকে কি তাহলে এখন হুকুম করা হবে নিচে আমার ক্যাবিনে চলে যেতে?
সে-রকম কোনো নির্দেশ এলো না দেখে আমি বরং খুব খুশিই হলুম। সত্যি-বলতে, আমাকে এরা কেউই গেননা পাত্তা দিচ্ছিলো না। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিলো, বুঝি আমি কখনও বিভীষিকায় এসে উঠিইনি। সেইজন্যেই আমি মিশ্র মনোভাব নিয়ে সেই ডেস্ট্রয়ার দুটির ধেয়ে-আসা লক্ষ করতে লাগলাম। ঠিক যখন এদের সঙ্গে বিভীষিকার দূরত্ব মাত্র দু-মাইলের মতো, তখন এরা দু-পাশে চলে পেলো, যাতে দু-পাশ থেকে বিভীষিকাকে তাগ করে কামান দাগতে পারে।
আর দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড? তার হাবভাবে প্রচণ্ড একটা তাচ্ছিল্য ফুটে বেরুচ্ছিলো। ভঙ্গিটা এমন, জানেই যে ডেস্ট্রয়ার দুটি তার বিরুদ্ধে কিছু করতে অক্ষম। তাদের গতি যা-ই হোক না কেন, একটা বোতাম টিপলেই সে তাদের পাল্লা থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবে। কিংবা হয়তো ডুবই মারবে হ্রদের জলে, আর কোনো নিক্ষিপ্ত অস্ত্রই তার আর নাগাল পাবে না জলের তলায়।
পাঁচ মিনিট পরে, ডেস্ট্রয়ার দুটির সঙ্গে দূরত্ব হ্রাস পেয়ে প্রায় একমাইল হয়ে এলো। দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড তাদের আরো এগুতে দিলে। তারপর যখন তারা কাছে এসে পড়েছে, অমনি একটা হাতল ধরে টান দিলে সে। বিভীষিকা প্রায় যেন দ্বিগুণ গতিতে আচমকা হ্রদের জলে লাফিয়ে এগিয়ে গেলো। ডেস্ট্রয়ারগুলোর সঙ্গে সে যেন ছেলেখেলা খেলছে, বেড়াল যেমন করে খেলে ইঁদুরদের সঙ্গে! ভয় পেয়ে কোথায় পালিয়ে যাবার চেষ্টা করবে, তা নয়, সে বরং সোজা আপন খেয়ালখুশি মতো নিজের পথেই চলেছে। কখনও কি সে তার বিষম দম্ভ আর ঔদ্ধত্য দেখিয়ে দুই দুশমনের মাঝখান দিয়ে তাচ্ছিল্য ভরে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করবে? টোপ যেন, লোভ দেখাবে তাদের, তার পেছন নিতে তাতিয়ে দেবে তাদের, তারপর ঘুটঘুঁটে আঁধার রাত নেমে এলে বাধ্য হয়ে নিজে থেকেই। ডেস্ট্রয়ারগুলো এই রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবে!
হ্রদের পাশে বাফেলো নগরী তখন স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। মস্ত-সব দালানকোঠা দেখতে পাচ্ছি আমি, বড়ো-বড়ো সব বিশাল-উঁচু অট্টালিকা, চার্চগুলোর গম্বুজ, শস্য মাড়াইয়ের কলের চাকা ঘুরে যাচ্ছে অবিরাম। মাত্র চার-পাঁচ মাইল সামনে, উত্তর দিকে, খুলে গিয়েছে নায়াগ্রার নদীর জলপথ।
এই অভিনব পরিস্থিতিতে আমার নিজের কী করা উচিত? যখন ডেস্ট্রয়ারগুলোর সামনে দিয়ে যাবো, আমি বিভীষিকা থেকে লাফিয়ে পড়বো জলে? আমি ভালো সাঁতার জানি, এবং এ-রকম সুযোগ হয়তো আর-কখনোই আসবে না। দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড নিশ্চয়ই থেমে পড়ে আমাকে ফের কয়েদ করবার চেষ্টা করবে না। ডুবসাঁতার দিয়ে গিয়ে আমি কি এদের বন্দুকের গুলিকে এড়িয়ে যেতে পারবো না? ডেস্ট্রয়ারগুলোর খালাশিরা নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পাবে জলে সাঁতার কাটছি, নিশ্চয়ই তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে আমি বিভীষিকায় বন্দী হয়ে আছি। আমাকে উদ্ধার করার জন্যে তারা কি কোনো নৌকো ভাসিয়ে দেবে না?
বিভীষিকা যদি নায়াগ্রা নদীর সরু খাতটায় ঢোকে, আমার পালাবার সম্ভাবনা, অনেকগুণ বেড়ে যাবে। নেভি আইল্যাণ্ডে আমি এমন শক্ত জমির ওপর পা রাখতে পিরবো, যার সব হাল-হদিশ আমার জানা। কিন্তু দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড ঢুকবে এই সরু নদীর খাতে, তাহলে যে বিশাল জলপ্রপাতটা থেকে তাকে নিচে আছড়ে পড়তে হবে! তা নিশ্চয়ই সে করবে না। আমার বরং অপেক্ষা করা উচিত ডেস্ট্রয়ার দুটো কখন সবচেয়ে কাছে আসে।
অথচ তবু আমার এই পালাবার ইচ্ছেটা আদৌ উদগ্র ছিলো না–কেমন-একটা অর্ধমনস্ক ভঙ্গিতেই আমি এ-সব কথা ভাবছিলুম। এই রহস্য ভেদ করার সমস্ত আশা জলাঞ্জলি দিতে কোথায় যেন বাধোবাধো ঠেকছিলো। পুলিশের গোয়েন্দা হিশেবে আমার সমস্ত অন্তরাত্মাই যেন পালাবার পরিকল্পনার বিপক্ষে রুখে উঠেছে। যে-লোকটাকে সরকার আইনকানুনের পরপারে বলে ঘোষণা করেছে, সমাজবিরোধী বলে চিহ্নিত করেছে, তাকে পাকড়ে ধরতে হলে শুধু একটা হাত বাড়ালেই হয়! আমি কি তাকে আমার কবল থেকে পালিয়ে যেতে দেবো? না, জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি আত্মরক্ষার চেষ্টা করবোই না! অথচ এটাও কি জানি, বিভীষিকা আমাকে কোথায় নিয়ে চলেছে, আর কী তোলা আছে আমার কপালে?
সোয়া-ছটা বাজে এখন। ডেস্ট্রয়ারগুলো এমনই পুরোদমে কাছে এগিয়ে আসছে। যে তারা থরথর করে কাঁপছে। সরাসরি সামনে এসে পড়েছে তারা এখন–দুটি ডেস্ট্রয়ার পরস্পরের মধ্যে মাত্র সামান্য দূরত্ব রেখেছে, যাতে মাঝখানে চেপে ধরতে পারে বিভীষিকাকে। আর বিভীষিকা, গতি বাড়াবার কোনো চেষ্টা না-করেই দেখতে পেলে, দু-দিক থেকে দুটো ডেস্ট্রয়ার তাকে কোণঠাশা করে ফেলবার চেষ্টা করছে।
আমি আমার জায়গা থেকে একপাও নড়িনি। গলুইয়ের লোকটা আমার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। সারেঙের চাকার সামনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে কুঞ্চিত জোড়াভুরুর তলায় দপদপ জ্বলন্ত চোখে, অপেক্ষা করে আছে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড। সে হয়তো আস্তিনে লুকিয়ে-রাখা কোনো শেষ চাল চেলে এক্ষুনি এই অনুসরণকারীদের ভড়কে দিয়ে পালিয়ে যাবে!
হঠাৎ, আমাদের বাঁ পাশের ডেস্ট্রয়ারটা থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে একঝলক ধোঁয়া উঠলো। একটা টরপেডো, জল প্রায় ছুঁয়েই, বিভীষিকার সামনে দিয়ে ছুটে চলে গেলো, ডান পাশের ডেস্ট্রয়ারটার কাছ দিয়ে।
উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে দেখি উঁচু টঙের ওপর লুকআউটের পাখির খোপ থেকে কে-একজন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আছে বিভীষিকার কাপ্তেনের কাছ থেকে কী ইঙ্গিত আসে। দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড এমনকী মুখ ঘুরিয়ে সেদিকটায় তাকায়নি পর্যন্ত : তখন তার মুখে যে-তাচ্ছিল্য আর ঘৃণা আমি দেখেছিলুম, তা আমি জীবনেও ভুলবো না।
আর ঠিক তক্ষুনি, আচমকা এক ধাক্কায় আমাকে আমার ক্যাবিনটার হ্যাঁচওয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হলো, তারপর যেই আমি ক্যাবিনে নেমেছি অমনি ওপরের ঢাকনাটা বন্ধ হয়ে গেলো। শব্দ শুনে বুঝতে পারলুম, অন্য হ্যাঁচওয়েগুলোও তখন এটে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ডেক এখন জল-নিরোধ-করা। কোথায় একটা এনজিনে একটা হালকা ধকধক আওয়াজ হলো, আর অমনি বিভীষিকা ডুবে গেলো জলের তলায়।
আমাদের মাথার ওপর তখনও কামান দাগার আওয়াজ উঠছে। তাদের প্রচণ্ড প্রতিধ্বনি কানে বাজলো কিছুক্ষণ, তারপর সব স্তব্ধ, চুপচাপ। আমার ক্যাবিনের গবাক্ষটা দিয়ে শুধু ক্ষীণ-একটু আলো ঢুকছে ভেতরে। ডুবোজাহাজ মসৃণ গতিতে পিছনে এগিয়ে যাচ্ছে জলের তলা দিয়ে। কী দ্রুতবেগে, কী অনায়াসে যে এই রূপান্তর ঘটেছিলো, তা আমি নিজের চোখেই দেখেছি। হয়তো যখন সে স্বতশ্চল শকটে রূপান্তরিত হবে, তখনও বদলটা হবে এমনি ক্ষিপ্র ও আয়াসহীন।
কী করবে এখন দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড? হয়তো ডুবোজাহাজের দিকবদল করবে সে, যদি-না সে ডাঙায় উঠে স্থলপথে রাজ্যের পর রাজ্য পেরিয়ে যেতে চায়। পশ্চিমে । জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে, ডেস্ট্রয়ারগুলোর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে, আবারও হয়তো গিয়ে পড়তে পারে ডেট্রয়েট নদীতে। শুধু হয়তো কামানের পাল্লা থেকে বেরিয়ে আসতে যতটুকু সময় লাগে, ততক্ষণই আমরা থাকবো জলের তলায়, কিংবা হয়তো ততক্ষণই ডুবে থাকবো, যতক্ষণ-না নেমে আসে রাতের আঁধার।
ভবিতব্য, অবশ্য, এই উত্তেজনায়-ভরা পেছন-ধাওয়ার অন্যরকম উপসংহারই স্থির করে রেখেছিলো। দশ মিনিটও কাটেনি, হঠাৎ মনে হলো ডুবোজাহাজের মধ্যে কী একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। এনজিন-ঘরে দ্রুত কী-সব কথা চালাচালি হচ্ছে। যে এনজিন এতক্ষণ নিঃশব্দে চলছিলো, এখন সেটা বিদঘুঁটে সব ছন্দহারা আওয়াজ করতে শুরু করেছে। কোনো দুর্ঘটনার জন্যে এখন বুঝি ডুবোজাহাজ তবে আবার ভেসে উঠবে জলের ওপর!
আমার ধারণা যে নির্ভুল, তার প্রমাণ হিশেবেই পরক্ষণে আমার ক্যাবিনের আবছায়া ভরে গেলো খটখটে দিনের আলোয়। বিভীষিকা আবার জলের ওপর ভেসে উঠেছে। ডেকের ওপর কাদের যেন পায়ের শব্দ। আবার ঢাকনা খুলে দেয়া হলো হ্যাঁচওয়েগুলোর, এমনকী আমারটার শুন্ধু। আমি লাফ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম ওপরে।
দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড আবারও সারেঙের চাকায় দাঁড়িয়ে, অন্য দুজন নিচে এনজিনঘরে ব্যস্তভাবে কী-সব খুটখাট করছে। ডেস্ট্রয়ারগুলো এখনও পেছন ছাড়েনি, তারা সম্ভবত মাত্র সিকি মাইল দূরে, এখন! বিভীষিকাকে দেখে তারা পুরোদমে ছুটে আসছে–আর বিভীষিকা আবারও ছুটে চলেছে নদী-নায়াগ্রার দিকে।
কবুল করি, এই রণকৌশলের মাথামুণ্ডু কিছুই আমি বুঝতে পারিনি। যেন একটা কানাগলির মধ্যে ঢুকে পড়েছে বিভীষিকা, কোনো অভাবিত যান্ত্রিক গোলযোগের জন্যে জলের তলা দিয়ে পালিয়ে যেতে পারছে না সে, ডুবোজাহাজ হিশেবে, আর তার ফেরবার রাস্তা ডেস্ট্রয়ারগুলোর জন্যে রুদ্ধ। তাহলে সে কি এখন ডাঙায় উঠে যেতে চাচ্ছে? আর তা যদি সে করে, পর-পর যে-সব টেলিগ্রাম চালাচালি হবে সারা মার্কিন মুলুকে, সব রাজ্যে পুলিশ যখন হুঁশিয়ার হয়ে যাবে, তখন সে তাদের হাত এড়িয়ে কোথায় পালাবে, কোথায় যাবে?
এমনকী মাত্র আধমাইলও আর আমরা এগিয়ে নেই। ডেস্ট্রয়াররা আমাদের পেছনে পুরোদমে ধেয়ে আসছে : এখন সরাসরি আমাদের পেছনে থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের কামান দাগবার মতো অবস্থায় নেই মোটেও। দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড শুধু এই ব্যবধানটুকু বজায় রেখেই খুশি, যদিও ইচ্ছে করলে সে বিভীষিকার গতি আরো বাড়িয়ে দিতে পারতো–তারপর রাত নেমে এলে ডেস্ট্রয়ারগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে তাদের হাত এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পারতো।
এরই মধ্যে আমাদের ডানদিকে বাফেলো হারিয়ে গেছে, আর সন্ধে সাতটার একটু পরই নদী নায়াগ্রার মুখটা আমাদের সামনে খুলে গেলো। যদি সে ওখানে ঢোকে, আর যে ফিরে যেতে পারবে না সেটা জেনেই; তাহলে বুঝতে হবে যে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর মাথাটা পুরোপুরি বিগড়ে গিয়েছে। আর, সত্যি-তো, পাগলই তো সে আসলে, নইলে কেউ নিজেকে অমনভাবে নিখিলের প্রভু জগতের প্রভু বলে ঘোষণা করে? আমি তাকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখলুম শুধু : শান্ত, উদাসীন, ছন্নছাড়া, একবারও ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে না পর্যন্ত ডেস্ট্রয়ারগুলো এখন কতটা এগিয়ে এসেছে। আমি লোকটাকে যত দেখছি, ততই তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি।
হ্রদের এ-প্রান্তটা ফাঁকা, পরিত্যক্ত। আপার-নায়াগ্রার তীরের শহরগুলোতে মালবোঝাই যে-সব স্টীমার যায়, চিরকালই তাদের সংখ্যা কম থাকে, যেহেতু এদিকটায় কোনো পোত চালানো দারুণ বিপজ্জনক। কাউকে কোথাও চোখে পড়ছে না এখন : এমন কোনো ছোট্ট জেলেডিঙিও এতক্ষণে বিভীষিকার পথে পড়েনি। ডেস্ট্রয়ার দুটোকে অব্দি একটু পরেই থমকে থেমে গিয়ে ভাবতে হবে আর তারা ধাওয়া করে আসবে কি না, যদি আমরা এমন খ্যাপার মতো প্রপাতটার দিকেই এগিয়ে যাই!
আগেই বলেছি, নদী-নায়াগ্রা নিউইয়র্ক রাজ্য আর ক্যানাডার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। চওড়ায় সে মোটমাট হয়তো পৌনে-এক মাইল হবে, যত প্রপাতটার দিকে এগিয়ে যায় ততই সংকীর্ণ হয়ে আসে। লেক ইরি থেকে লেক অনটারিও অব্দি ধরলে তার দৈর্ঘ্য হবে প্রায় পনেরো লিগ, যে বয়ে যায় উত্তরমুখো, যতক্ষণ-না সে লেক। সুপিরিয়র, মিশিগান, হুরন আর ইরির জল লেক অন্টারিওতে ঢেলে দেয়, এই বিশাল হ্রদগুলোর সবচেয়ে পশ্চিমে এই লেক। এই নদীটার ঠিক মাঝখানটায় সেই জগৎবিখ্যাত জলপ্রপাত, দেড়শো ফিট ওপর থেকে নিচে আছড়ে পড়ে জল, গ্যালন-গ্যালন, অনর্গল। কেউ-কেউ একে বলে হর্স ফক্স, কেননা ভেতর দিকে সে ঘোড়ার নালেরই মতো বেঁকে গিয়েছে। ইণ্ডিয়ানরা তার নাম দিয়েছে জলের বজ্র, আর সত্যি-বলতে বাজ ফাটার মতোই জল আছড়ে পড়ে নিচে, তার উচ্ছ্বাস আর প্রতিধ্বনি শোনা যায় কত-যে মাইল দূর থেকে।
লেক ইরি আর ছোট্ট নায়াগ্রা ফল্স শহরটার মাঝামাঝি নদীর তুলকালাম জলপ্রবাহকে দ্বিধাবিচ্ছিন্ন করে গেছে দুটি ছোটো দ্বীপ, প্রপাতটার এক লিগ ওপরে আছে নেভি আইল্যাণ্ড, আর গোট আইল্যাণ্ড-যে-অজদ্বীপ আমেরিকা আর ক্যানাডার প্রপাত দুটিকে আলাদা করে রেখেছে। এই দ্বীপের শেষমুখটায় একদা দাঁড়িয়েছিলো টেরাপিন টাওয়ার, যে-স্তম্ভটা দুঃসাহসী মিস্ত্রিরা তৈরি করেছিলো প্রপাতের জল আছড়ে পড়ার ঠিক মুখটাতে। অবিশ্রাম জলের ঘায়ে খয়ে যেতে-যেতে সেই স্তম্ভটা এখন ভেঙে পড়েছে।
ফোর্ট ইরি শহরটা দাঁড়িয়ে আছে ক্যানাডায়, ঠিক নদীর মুখটায়। প্রপাতের ওপরে, তীর ঘেঁসে আরো-দুটি শহর গড়ে উঠেছে, ডান তীরে–শ্লসার, বামতীরে–চিপেওয়া, নেভি আইল্যাণ্ডের দুই পাশে দুই ছোটো শহর। এইখানে এসেই খরস্রোত, সরু-একটা খাল দিয়ে বাঁধা, আরো-প্রচণ্ড বেগে ছুটতে শুরু করে। আর দু-মাইল এগিয়ে গিয়ে জলপ্রপাত হিশেবে দেড়শো ফিট উঁচু থেকে আছড়ে পড়ে।
বিভীষিকা এরই মাঝে ফোর্ট ইরিকে পেরিয়ে গেছে। পশ্চিমে, সূর্য গিয়ে ছুঁয়েছে ক্যানাডার দিগন্ত। ক্ষীণ দেখা যাচ্ছে চাঁদ, জলের ছিটেয় তৈরি বাষ্পের আড়ালে সে দক্ষিণে ওঠবার চেষ্টা করছে। আর একটি ঘণ্টা পরেই অন্ধকার আমাদের ঢেকে ফেলবে।
ডেস্ট্রয়ারগুলো তাদের চোঙ দিয়ে কালো ধোঁয়া ওগরাতে-ওগরাতে একমাইল পেছনে ধেয়ে আসছে। স্পষ্ট, বোঝাই যাচ্ছে, যে বিভীষিকা আর ফিরে যেতে পারবে না। ডেস্ট্রয়ারগুলো তার ফেরবার পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দিয়েছে। এটা ঠিক যে, আমি যেমন জানি যে কোনো যান্ত্রিক গোলযোগের দরুন বিভীষিকা এতক্ষণ ধরে জলের ওপরেই থাকতে বাধ্য হয়েছে, সে-কথা ডেস্ট্রয়ার দুটির কম্যাণ্ডাররা জানে না–ফলে তারা জানে না হঠাৎ কখনও বিভীষিকা ভুউশ করে ডুবে যাবে কি না জলে। তারা শুধু শেষ মুহূর্ত অব্দি তাকে ধাওয়া করে আসতে চাচ্ছে।
এই বিপজ্জনক জলের মধ্য দিয়ে তার যেভাবে একগুয়ের মতো এগুচ্ছে, তাতে আমি তাদের তারিফ না-করে পারলুম না। কিন্তু তার চাইতেও আমি তাজ্জব মানছি দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর ধরনধারণ দেখে। আর-তো মাত্রই আধঘণ্টা, তারপরই নায়াগ্রা জলপ্রপাত। যত মজবুতই হোক না কেন তার এই আশ্চর্য যান, এই বিশাল জলপ্রপাতের বিষম আক্রোশ সে এড়াবে কী করে? একবার যদি এই প্রচণ্ড স্রোত টান মারে বিভীষিকাকে, তাকে বাগে পেয়ে কাবু করে ফ্যালে, তবে তাকে নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে দুশো ফিট নিচে আছড়ে ফেলে দেবে। হয়তো এখনও বিভীষিকা ডাঙার গাড়ি হয়ে তীরে নেমে পড়ে স্থলপথে ছুট লাগাবার কথাই ভাবছে।
এই তুলকালাম উত্তেজনার মাঝে, আমি, স্ট্রক, পুলিশের গোয়েন্দা–আমি কী করবো? আমি কি লাফিয়ে নামবো নেভি আইল্যাণ্ডে, যদি আমরা তার ধার ঘেঁসে যাই? এ-সুযোগটা হেলায় হাতছাড়া হতে দিলে আর আমার মুক্তি নেই : বিভীষিকার এত সব রহস্য জেনে যাবার পর দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড কিছুতেই আমায় ছেড়ে দেবে না।
অবশ্য এখন বুঝি আর পালাবার চেষ্টা করার কোনোই মানে হয় না। যদি আমাকে ক্যাবিনে কয়েদ করে রাখা না-হয়ে থাকে, তাহলে আড়চোখে হলেও কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই আমার ওপর নজর রাখছে। কাপ্তেন সারেঙের চাকা ধরে দাঁড়িয়ে আছে বটে, তবে গলুইয়ের লোকটা এতক্ষণ একবারও আমার ওপর থেকে তার চোখ সরায়নি। একটু উলটোপালটা নড়লেই আমাকে পাকড়ে তারা ক্যাবিনটায় ঢুকিয়ে দিয়ে বন্দী করে রাখবে। অর্থাৎ, আমার নিয়তি আমাকে এখন বিভীষিকার সঙ্গেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।
ডেস্ট্রয়ার দুটির সঙ্গে আমাদের ব্যবধান এখন আরো হ্রাস পেয়েছে। একটু পরেই তারা সম্ভবত দড়িদড়ার নাগালেই এসে পড়বে। যান্ত্রিক গোলযোগের পর থেকে বিভীষিকার এনজিন কি আর পুরোদমে চলতে পারছে না? কাপ্তেনর চোখেমুখে, অথচ, উদ্বেগের কিছুমাত্র চিহ্ন নেই–ডাঙায় নামবার কোনো চেষ্টাই সে করছে না।
ডেস্ট্রয়ারগুলোর পুরোদমে-চালানো বাষ্পের এনজিনের হিসহিস শব্দটা অব্দি এখন কানে আসছে, আর চোঙ দিয়ে ভলকে-ভলকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তার চাইতেও জোরালো হয়ে কানে আসছে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের তুলকালাম গর্জন।
নেভি আইল্যাণ্ড পেরিয়ে যাবার সময় বিভীষিকা নদীটার বাম শাখা বেছে নিলে। এখান থেকে অনায়াসেই ডাঙায় গিয়ে নামা যায়–কিন্তু তবু সে ছুটেই চলেছে সামনে। পাঁচ মিনিট পরে আমরা গোট আইল্যাণ্ডের প্রথম গাছপালাগুলো দেখতে পেলুম। স্রোত ক্রমেই তীব্র, অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। বিভীষিকা যদি না-থামে, ডেস্ট্রয়ারগুলি এখন আর তাকে অনুসরণ করতে পারবে না। বিভীষিকার কাপ্তেন যদি প্রপাতের মরণঘূর্ণির মধ্যে গিয়েই ঝপ খেতে চায়, ডেস্ট্রয়ার দুটি অন্তত সেই বাসনা করবে না। করেওনি–পরক্ষণেই তারা পরস্পরকে সংকেত করে পশ্চাদ্ধাবন থামিয়ে দিলে। প্রপাত থেকে তারা বেশি হলে তখন মাত্র ছশো ফিট দূরে। তারপর যেন বাজ ফেটে পড়লো পর পর, বিভীষিকার গায়ে কোনো আঁচড়ই লাগলো না, তবু তারা আক্রোশ মেটাবার জন্যে পর-পর কয়েকবার তাকে তাগ করে কামান দাগলে।
সূর্য অস্ত গেছে, প্রদোষের ছায়ান্ধকারে দক্ষিণ থেকে ফুটি-ফুটি করছে চাঁদের আলো। প্রপাতের তুলকালাম স্রোতের টানে বিভীষিকা উম্মত্তের মতো ছুটে চলেছে। পরের মুহূর্তেই নিশ্চয়ই আমরা প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়বো জলের-ছিটে-লাগা কালো শূন্যতায়-পাতালে। আতঙ্কিত বিস্ফারিত চোখে আমি দেখলাম অজ দ্বীপ বিদ্যুদ্বেগে পেছনে চলে গেলো। তারপরেই এলো তিন বোনের দ্বীপ, পাতালের ফোয়ারায় জলাচ্ছন্ন।
আমি লাফিয়ে উঠে শেষ মরীয়া চেষ্টায় যেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছি, কে যেন পেছন থেকে আমাকে সজোরে জাপটে ধরলে।
আমাদের পোতের মধ্যে এতক্ষণ যে-এনজিনটা দপদপ করছিলো, হঠাৎ তার মধ্য থেকে তীক্ষ্ণ ধারালো একটা আওয়াজ বেরিয়ে এলো। বিভীষিকার দু-পাশে গ্যাঙওয়ের মতো ধাতুর যে-ফালি দুটো আটকানো ছিলো, তারা ফরফর করে ছড়িয়ে পড়লো বিশাল দুই পাখনার মতো, আর ঠিক যে-মুহূর্তে বিভীষিকা গিয়ে প্রপাতের মুখটা ছুঁয়েছে, তখনই সে সোজা উঠে পড়লো শূন্যে, আকাশে, চান্দ্র রামধনুর মায়ায় জড়ানো বজ্রগর্জনতোলা প্রপাত থেকে সে এখন উদ্ধার পেয়েছে আকাশে–এখন সে তার একে-তিন-তিনে এক নয়, তার চেয়েও বেশি, চার নম্বর যানও সে, অর্থাৎ উড়োজাহাজ, বিমান!!
.
১৫. ঈগল পাখির বাসা
পরদিন, যখন গভীর একটা ঘুম থেকে আমি উঠলুম, সতেজ, ঝরঝরে, আমাদের যান মনে হচ্ছিলো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যে ডাঙার ওপর দিয়ে যাচ্ছি না, সেটা অন্তত স্পষ্ট। আর জলের ওপর দিয়ে বা তলা দিয়েই যাচ্ছি না, উড়াল দিচ্ছি না এমনকী সপ্ততল বিমানেও। তবে কি এই অবিশ্বাস্য আবিষ্কারটি তার গোপন আড্ডায় ফিরে এসেছে–যেখানে তার আগে আর-কোনো মানুষই পা দেয়নি? আর এখন কি তবে তার সব গোপন কথাই আমি জেনে ফেলবো?
এখন ভাবলে তাজ্জব লাগে, যখন আকাশ দিয়ে উড়ে আসছি, তখন সারাটা পথই আমি কি না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি! একটু ভড়কে যাবার মতোই ব্যাপার : আমাকে তারা কোনো ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়নি তো? যাতে আমি বুঝে ফেলতে না-পারি কোথায় এসে এই আকাশযান নামলো? শুধু এইটুকু মনে আছে, কাল সন্ধেবেলা যখন বিভীষিকা দু দিকে তার দুই ডানা ছড়িয়ে প্রপাতের ওপর থেকে আকাশে উঠে গিয়েছিলো, তখন আমি কী-রকম স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম। না, হতভম্ব নয়, স্তম্ভিত!
তাহলে এই যান একের ভেতরে চার : স্বতশ্চল শকট, জলেভাসা জাহাজ, ডুবোজাহাজ আর আকাশযান–একই সঙ্গে চার রকম! মাটিপৃথিবী, বিশাল জল, সীমাহারা আকাশ-সব সে জয় করেছে। আর কেমন বিদ্যুৎগতিতে সে সম্পন্ন করে এক যান থেকে আরেকরকম যান হয়ে-ওঠা! একই এনজিন চলে জলে, ডাঙায়, অন্তরিক্ষে! আর আমি কিনা সাক্ষী ছিলাম এইসব রূপান্তরের! এখনও সেটা জানি না–ভবিষ্যতে কখনও হয়তো জানতে পারবো–তা হলো এই যানের এই বিপুল শক্তির উৎস কী। আর কেই-বা এই দুর্ধর্ষ বৈজ্ঞানিক, একা-একা পুরো ব্যাপারটা উদ্ভাবন করে যে বিপুল স্পর্ধায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করেছে সারা জগৎকেই! কী তার স্পর্ধা, কী দুঃসহ তার দন্ড!
বিভীষিকা যখন ক্যানাডার প্রপাতের ওপর থেকে উড়াল দিয়েছিলো, আমাকে তখন আমার ক্যাবিনের হ্যাঁচওয়ের সামনে চেপে ধরে রাখা হয়েছিলো। সন্ধ্যায় ফুট ফুটে স্বচ্ছ জ্যোৎস্নায় আমি এটা অন্তত দেখতে পেয়েছিলুম কোন দিক লক্ষ্য করে বিভীষিকা আকাশে উড়লো। নদীরই খাত ধরে সে উড়াল দিয়েছিলো, পেরিয়ে গিয়েছিলো সাসপেনশন ব্রিজ, যেখানটায় নায়াগ্রা নদী ক্ষিপ্র একটা মোচড় মেরে নেমে গিয়েছে লেক অন্টারিওর দিকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা
পুবদিকে মোড় ঘুরেছি। কাপ্তেন তেমনি সটান দাঁড়িয়েছিলো সারেঙের চাকা আর হাতলগুলোর সামনে। আমি তার সঙ্গে কোনো কথাই বলবার চেষ্টা করিনি তখন। কী লাভ হতো কিছু জিগেস করে-সে-তো কোনো উত্তরই দিতো না। তখন শুধু এটাই সবিস্ময়ে লক্ষ করেছিলাম বিভীষিকা অনায়াসেই আকাশে উড়ে যেতে পারে–যেন জল বা ডাঙার মতো আকাশের পথগুলোও তার অনেকদিনকার চেনা।
এমন আশ্চর্য একটা যানের উদ্ভাবক কেন-যে নিজেকে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড বলে সেটা আন্দাজ-করা এখন আর মোটেই কঠিন নয়। মানুষের হাতে এ-যাবৎ যত যান রচিত হয়েছে, তাদের সবার চাইতে এটা শতগুণে সেরা।-এর কাছে অন্যসব যান নেহাৎই তুচ্ছ, নগণ্য, সাধারণ! সত্যি-বলতে, তার এই পরম বিস্ময়ের রহস্যটা সে খামকা কাউকে বিক্রিই বা করবে কেন? ঐ দুশো কোটি ডলার তো তার কাছে খোলামকুচির মতোই তুচ্ছ। হ্যাঁ, এখন আমি পুরোপুরি বুঝতে পারি তার সীমাহীন আত্মবিশ্বাসের কারণ–যা প্রায় দম্ভের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছেছে। যদি তার নিজের উচ্চাশা তাকে উন্মত্ততার ওপারে নিয়ে না-যায়, তবে সে কোথায়-কতদূরে-গিয়েই না পৌঁছুতে পারবে!
বিভীষকা আকাশে ওড়বার আধঘণ্টা পরেই আমি এই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই–বুঝতেও পারিনি যে ঘুমে দু-চোখের পাতা বুজে আসছে। নিশ্চয়ই কোনো ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়া হয়েছিলো আমার খাবারে। নিশ্চয়ই তার ইচ্ছে ছিলো না বিভীষিকা কোনদিকে যায়, সেটা আমি লক্ষ করি।
কাজেই এটা আমি জানি না সে কি বৈমানিকই এতটা পথ পেরিয়েছে, না কি পাগল হে-নাবিক আবার ভেসে পড়েছে জলে, না কি শোাফেয়ার তার গাড়ি ছুটিয়েছে আমেরিকার রাস্তায়-রাস্তায়। একত্রিশে জুলাই রাত্রিবেলা সত্যি-যে কী ঘটেছিলো তার কোনো স্মৃতিই আমার নেই।
এখন, এই রগরগে, রোমাঞ্চকর, রুদ্ধশ্বাস অভিযান শেষ হবে কোথায়? আর আমার নিজেরই বা কী হবে?
আগেই বলেছি, ঘুম থেকে জাগবামাত্র আমার মনে হয়েছিলো যে বিভীষিকা কোথাও যেন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনড়। আমার ভুল হয়নি; তার চলার ধরন যা-ই হোক না কেন, আকাশে বা জলে, সবসময় আমি একটা মৃদু থর্থর কম্পন অনুভব করেছি। এখন সেই কম্পন আর নেই। এখন আমার প্রথম কাজ হলো ডেকে উঠে গিয়ে দেখা আমরা কোথায় আছি। বার্থ থেকে নেমে ক্যাবিনের সিঁড়ি বেয়ে হ্যাঁচওয়ের কাছে গিয়ে দেখি ঢাকনাটা বাইরে থেকে আটকানো। আহা! আমি ভেবেছি, বিভীষিকা ফের তার অস্থির চলা শুরু না-করা অব্দি আমাকে তাহলে এখানেই কয়েদ হয়ে থাকতে হবে! আর বন্দী হয়ে থাকবার কথা ভেবেই আমার কেমন যেন অস্থির লাগলো । উদ্বেগও কম ছিলো না। কী আছে ভবিষ্যতের গর্ভে? কী আমার ভবিতব্য?
জানতে অবশ্য পনেরো মিনিটও অপেক্ষা করতে হয়নি। ওপর থেকে হ্যাঁচওয়ের ওপরকার ঢাকনা সরাবার আওয়াজ কানে এলো আমার, পরক্ষণেই ক্যাবিনে এসে ঢুকলো প্রখর একঝলক আলো আর টাটকা হাওয়ার দমক! এক লাফেই আমি ডেকে উঠে এলাম। মুহূর্তের মধ্যে দিগন্ত ঝেটিয়ে এলো আমরা দৃষ্টি।
যা ভেবেছি, তা-ই। বিভীষিকা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে নিরেট জমির ওপর। পনেরোশো থেকে আঠারোশো ফিট বেড়-এর একটা পাথুরে নয়ানজুলিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। নিচে ছড়িয়ে আছে হলদে খোয়া আর কাকর, কোথাও কোনো উদ্ভিদের চিহ্নমাত্র নেই।
চারপাশের পাহাড়ের মাঝখানে এটা যেন ডিম্বাকার একটা কোটর-উত্তর-দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত লম্বা। চারপাশে যে-সটান-দাঁড়ানো পাথুরে দেয়াল সেটা কত উঁচু, চূড়াটাই বা কী-রকম, সেটা আমি কোনোভাবেই আন্দাজ করতে পারলুম না। মাথার ওপর ঘন হয়ে জমে আছে নিবিড় কুয়াশা, রোদ্দুরের বর্শাফলকগুলো হাজার চেষ্টা করেও যেন সেই কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে বেরুতে পারছে না। হলুদ বালির মেঝের ওপর পেঁজা-পেঁজা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। হয়তো এখনও বেশি বেলা হয়নি, পরে কখনও হয়তো এই কুয়াশা কেটে যাবে।
রীতিমতো ঠাণ্ডা পড়েছে এখানে, অথচ আজ কি না পয়লা আগস্ট! তাহলে এই জায়গাটা বুঝি গভীর-উত্তরে কোথাও, সমুদ্রতল থেকে অনেকটাই ওপরে। হয়তো এখনও আমরা আমেরিকারই কোথাও আছি, নতুন মহাদেশেই, কিন্তু ঠিক কোনখানে যে আছি সেটাই আন্দাজ করা মুশকিল।
হঠাৎ দেখতে পেলুম, বিভীষিকার কাপ্তেন নিচে একটা পাথরের খোঁড়লের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে সম্ভবত কোনো সুড়ঙ্গের মধ্য থেকেই, কেননা কুয়াশায় জায়গাটা কেমন ঝাপসা দেখাচ্ছিলো। মাঝে-মাঝে ওপরে, কুয়াশার পর্দার ওপর, বিশাল সব পাখির ছায়া ভাসে। এই গভীর স্তব্ধতা ছিঁড়ে-ছিড়ে মাঝে-মাঝে শুধু তাদেরই রুক্ষ কর্কশ চীৎকার শোনা যাচ্ছে। কে জানে, এই দুর্ধর্ষ অতিকায় পক্ষীদানবকে দেখে এই বিশাল পাখিগুলো হঠাৎ বিষম আঁৎকে উঠেছে কি না।
সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে তার যাত্রার ফাঁকে-ফাঁকে দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড এখানে এসেই আশ্রয় নেয়। এটাই সম্ভবত তার মোটরগাড়ির গ্যারাজ; তার জাহাজের বন্দর; তার আকাশযানের হ্যাঁঙার। আর এখন এই বিশাল পাহাড়ি কোটরের মধ্যে বিভীষিকা দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল। অবশেষে এখন আমি ধীরে-সুস্থে যানটাকে খুঁটিয়ে দেখতে পারবো। আর সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে এর মালিকরা আমাকে নিরস্ত করার
কথা আদপেই ভাবছে না। সত্যি-বলতে, বিভীষিকার কাপ্তেন যেন আগের মতোই আমাকে মোটেই আমল দিচ্ছে না। নিচে তার দুই স্যাঙাৎ তার সঙ্গে গিয়ে জুটেছে, তারপরে তিনজনেই ফের সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। যন্ত্রটাকে খুঁটিয়ে দেখবার এটাই সুবর্ণ সুযোগ, অন্তত তার বাইরেটা তো দেখা যাবে! ভেতরে কী-সব কলকজা আছে, খুঁটিয়ে দেখেও আমি তার কতটা কী বুঝতে পারবো কে জানে–হয়তো নিছক কতগুলো জল্পনা করাই সার হবে।
দেখতে পেলুম, আমার ক্যাবিনের হ্যাঁচওয়ে ছাড়া আর-সবগুলো হ্যাঁচওয়েই কুলুপ দিয়ে কষে আটকানো, আমার পক্ষে সেগুলো খোলবার চেষ্টা করা নিতান্তই পণ্ডশ্রম হবে! তার চেয়ে বরং এটা দেখাই লাভজনক হবে আমার পক্ষে-বিভীষিকাকে তার বিভিন্ন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সে-কোন প্রপেলার চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়।
আমি এক লাফ দিয়ে নিচে নেমে পড়লুম। কেউ কোথাও বাধা দেবার নেই–ফলে ধীরে-সুস্থেই দেখা যাবে সব।
যানটা–আগেই বলেছি–একটা টকুর মতো দেখতে। পুচ্ছের দিকটার চাইতে গলুইটা অনেক-বেশি তীক্ষ্ণ হয়ে এসেছে। যানটা অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে বানানো, কিন্তু পাখনা দুটো যে কোন ধাতুতে তৈরি, সেটা কিছুতেই আন্দাজ করতে পারলুম না। যানটা চারটে চাকার ওপর দাঁড়িয়ে আছে–একেকটা চাকার বেড় হবে প্রায় দু-ফিট। সেগুলোর গায়ে এমন পুরু টায়ার পরানো যে যে-কোনো বেগেই তারা অনায়াসে চলতে পারবে। চাকার একেকটা শিক অক্ষের গায়ে পরানো, সেগুলো দেখতে জেলেডিঙির বৈঠার মতো; জলে কিংবা ডাঙায়–যখনই বিভীষিকা ছোটে সেগুলো চক্রাকারে ঘুরে গিয়ে নিশ্চয়ই তার গতি বাড়িয়ে দেয়। তবে এই চাকাগুলো কিন্তু যানটার প্রধান প্রপেলার নয়। চালক পাখাগুলো আসলে দুটো বড়ো-বড়ো টারবাইন, যানটার তলির দু-দিকে বসানো। এনজিন চালিয়ে দিলে তীব্রবেগে এরা ঘুরতে থাকে, আর তার দুই পাঁচ-দিয়ে বসানো চাকা তাকে জলের মধ্যে দিয়ে যেন হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায়, সম্ভবত এরাই হাওয়াতেও উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে, এত জোরে ওরা নিজের অক্ষের ওপর পাক খেতে থাকে। আকাশে চলবার প্রধান সহায় অবশ্য ঐ দুই বিশাল পাখা, এখন যারা আবার গ্যাঙওয়ের মতো দু-পাশে ভাজ করে গুটিয়ে রাখা। কাজেই বাতাসের চাইতেও ভারি উড়নযানের তত্ত্বটাকেই ব্যবহার করেছে আবিষ্কারক, এমন-এক ব্যবস্থা এটা যে দ্রুততম পাখির চাইতেও ক্ষিপ্রবেগে এটা আকাশে ভেসে যেতে পারে। তবে, সে-কোন শক্তি, যা দিয়ে এই ভিন্ন-ভিন্ন কলকজা চলে, তা, আবারও আমার মনে হলো, তড়িৎপ্রবাহ ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু সে-কোন উৎস থেকে এই তড়িৎকোষগুলো তাদের শক্তি পায়, ফিরে ফিরে তাদের চার্জ করা যায়, তা আমি বুঝতে পারলাম না। কোথাও কি তবে তার কোনো বিদ্যুৎতৈরির কেন্দ্র আছে–যেখানে তাকে বারেবারে ফিরে আসতে হয়? এই পাহাড়ি কোটরটার কোনো খোঁদলে এখনও কি তার ডায়নামোগুলো গুঞ্জন করে চলেছে?
যন্ত্রটা যে চাকা আর টারবাইনের স্কু আর পাখা ব্যবহার করে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি-কিন্তু তার এনজিনটা কেমন দেখতে অথবা সে-কোন তুমুল শক্তি তাকে চালায়, তার কিছুই আমি এতক্ষণেও জানতে পারিনি। তবে জানলেই বা কী হতো? এই জ্ঞান ধুয়ে আমি কোন জীবনদায়ী জল পান করতুম? কিছু করতে হলে আমাকে তো আগে এখান থেকে–অথবা এদের খপ্পর থেকে পালাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আর যতটুকু আমি এতক্ষণে জেনেছি, তা যতই তুচ্ছ বা নগণ্য হোক না কেন, দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড তারপরে কিছুতেই আমাকে আর ছেড়ে দেবে না। পালাবার কোনো সুযোগ কি দৈবাৎ, আচমকা, অপ্রস্তুত অবস্থায় এসে হাজির হবে? যতক্ষণ বিভীষিকা অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে, ততক্ষণ তো কোনো সুযোগই পাইনি। এখন, এখানে, তার এই গোপন আড্ডায়, সত্যি কি আমি হঠাৎ পালিয়ে যাবার কোনো সুযোগ পাবো?
এই পার্বত্য কোটরটা ঠিক কোনখানে অবস্থিত, প্রথমে আমাকে সেটাই বার করতে হবে। আশপাশের অঞ্চলের সঙ্গে এখান থেকে যোগাযোগ করারই বা কী উপায়; আছে।–কোন মাধ্যম? এখান থেকে শুধু কি কোনো আকাশযানে করেই বেরুনো যায়? আর মার্কিন মুলুকের সে-কোন অঞ্চলে আমরা আছি–কেউ কি এর কোনো শুলুকসন্ধান জানে? আমি যখন ঘুমের ঘোরে অচৈতন্য, তখন বিভীষিকা যে ক-শো লিগ পথ পেরিয়ে এসেছে, তা-ই বা কে জানে?
একটি বিষয় নিয়ে আমার উত্তেজিত মন কিন্তু তখনই জল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছিলো। গ্রেট আইরি ছাড়া আর সে-কোন প্রকৃতিনির্মিত স্বাভাবিক বন্দর আছে বিভীষিকার? আমাদের এই বৈমানিকের পক্ষে কি চূড়া অব্দি উড়ে-আসা খুব কঠিন হবে? ঈগল বা কণ্ডর যেখানে উড়ে বেড়ায়, সেখানে কেন এই বিমান উড়ে যেতে পারবে না? গ্রেট আইরিই কি দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ডকে সেই অনধিগম্য আশ্রয় জোগায়নি, যেটা আমাদের সহস্রচক্ষু পুলিশের সজাগ দৃষ্টিকেও এড়িয়ে গেছে? তাছাড়া, নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে ব্লু রিজ শৈলশ্রেণীর এই অঞ্চলের দূরত্ব বস্তুত সাড়ে-চারশো মাইলের বেশি হবে না–যতটুকু পথ উড়াল দেয়া বিভীষিকার কাছে কিছুই-না।
হ্যাঁ, এই ভাবনাটা ক্রমেই আমাকে দখল করে বসতে লাগলো। অন্যসব অসমর্থিত অনুমানকে এই ভাবনাটা যেন ঝেটিয়ে বার করে দিচ্ছিলো। এতেই কি প্রমাণ হয় না, বিভীষিকার সঙ্গে গ্রেট আইরির কী সম্বন্ধ আর কেন আমি অমন একটা হুমকি দেয়া। চিঠি পেয়েছিলুম? স্পষ্ট শাসানি ছিলো তাতে : আবারও যদি আমি গ্রেট আইরিতে ওঠবার চেষ্টা করি, তবে আমাকে একহাত দেখে নেয়া হবে! সেই জন্যেই কি দিনের পর দিন আমার বাড়ির ওপর নজর রাখা হয়নি? আর গ্রেট আইরির ওপর ঐ অদ্ভুত শিখা, ঐ উৎকট আওয়াজ, ঐ তুলকালাম তুফান-তা কি এই বিভীষিকারই নাটমঞ্চের পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে যায়নি? হ্যাঁ, গ্রেট আইরিই। ঈগল পাখির এই বাসাই বিভীষিকার গোপন আচ্ছা!
কিন্তু একবার যখন বেদম চেষ্টা করেও এখানে ঢুকতে পারিনি, তখন এখান থেকে বেরিয়ে-যাওয়াও কি আমার পক্ষে একেবারে-অসম্ভব হবে না? আহ্, যদি কুয়াশা একবার সরত! হয়তো আমি তাহলে চিনতে পারতুম জায়গাটা। যেটা এখন নিছকই একটা জল্পনা মাত্র, সেটা যথার্থ বলে প্রমাণিত হতো তাহলে!
সে যা-ই হোক, এখানে যখন আমার চলে-ফিরে বেড়াবার স্বাধীনতা আছে, তখন পাহাড়ের মধ্যকার এই কোটরটাকেই না-হয় ভালো করে-তন্ন তন্ন করে–পরীক্ষা করে দেখা যাক। এই ডিম্বাকৃতি বিস্তারের উত্তরদিকের একটা সুড়ঙ্গে গিয়ে ঢুকছে তিনজনে। সেইজন্যে আমি আমার অনুসন্ধান শুরু করবো দক্ষিণ দিকে।
পাথুরে দেয়ালটার পাদদেশে গিয়ে, আমি তার গা ঘেঁসে চলতে-চলতে দেখতে পেলুম দেয়ালের গায়ে নানা জায়গায় অনেকগুলো ফাটল গজিয়েছে–কিন্তু তারপরেই আকাশ অব্দি যেন উঠে গেছে নিরেট পাথরের দেয়াল, আলেঘেনিতে যেমনতর পাথর দেখা যায়। কুয়াশা না-সরলে কিছুতেই বোঝা যাবে না এই নিরেট দেয়াল সটান কতটা ওপরে উঠে গিয়েছে। ফাটলগুলো দেখছি মোটেই গভীর নয়–সুড়ঙ্গের মতো দেয়ালের মধ্যে তা ঢুকে পড়েনি। কতগুলো গর্ত মানুষেরই হাতে-ফেলা জঞ্জালে ভর্তি। কাঠকুটো, শুকনো ঘাস। মাটির ওপর কাদের পায়ের ছাপ। সম্ভবত, কাপ্তেন আর তার স্যাঙাৎদের। আমার কারারক্ষকরা এখন নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গের মধ্যে মালপত্র জড়ো করে বাণ্ডিল বাঁধতে ব্যস্ত। তারা কি তবে বাণ্ডিলগুলো বিভীষিকায় নিয়ে গিয়ে তুলতে চাচ্ছে? তবে কি তারা চিরস্থায়ীভাবে এই আড্ডা ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে?
আধঘণ্টার মধ্যেই আমি আমার অনুসন্ধান শেষ করে আবার এই কোটরের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়ালুম। এখানে-সেখানে তূপ হয়ে আছে ছাইভস্ম-জল-হাওয়ার শিকার, বিবর্ণ, রংচটা। পোড়া কাঠ পড়ে আছে, তাদের কারু গায়ে-বা জংধরা লোহার পাত আটকানন, কিংবা মরচে-পড়া আংটা; ধাতুর পাত পড়ে আছে আশপাশে, প্রবল উত্তাপে বেঁকে দুমড়ে-যাওয়া। কোনো জটিল কারখানাকে যেন এখানে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,অনতিকাল আগে, দাউদাউ করে একদিন আগুন জ্বলেছিলো–ইচ্ছাকৃত, অথবা দৈবাৎ। তারই শিখা নিশ্চয়ই নিচে থেকে দেখেছে ভয়ার্ত মানুষ–প্লেজেন্ট গার্ডেনে, মরগ্যানটনে। কিন্তু সে-কোন যন্ত্রপাতির ধ্বংসাবশেষ এ-সব? কেনই বা এদের ধ্বংস-করা হয়েছে?
সেই মুহূর্তে হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেলো–পুবদিক থেকে আসা হাওয়া। আকাশ থেকে হঠে গেলো কুয়াশার আস্তর, দিগন্ত আর মধ্যগগন থেকে ঝলসে নেমেছে সূর্যের আলো, এই কোটরটা আলোয় ফটফটে হয়ে উঠেছে।
আপনা থেকেই আমার মুখ ফুটে একটা অস্ফুট বিস্ময়ধ্বনি বেরিয়ে এলো! পাথুরে দেয়ালের চূড়া উঠে গেছে একশো ফিট ওপরে। পুবদিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শিখরদেশ–উড়াল দিতে উদ্যত একটা ঈগলের মতো দেখতে বিশাল এক পাথরখণ্ড। এই চূড়াটাই মিস্টার এলিয়াস স্মিথ আর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো একদিন, যখন আমরা গ্রেট আইরির বাইরে থেকে তাকিয়েছিলুম চূড়ার দিকে।
আর-কোনো সন্দেহই নেই। রাত্তিরে, তার ঐ উড়ালের সময় আকাশযান লেক ইরি থেকে নর্থ-ক্যারোলাইনার দূরত্ব অতিক্রম করে এসেছে। এই ঈগল পাখির বাসাতেই আকাশযান তার আশ্রয় বানিয়ে নিয়েছে। এই সেই নীড়, এই আবিষ্কারকের অতিকায় ও বিপুল শক্তিশালী পাখির যোগ্য বাসাই এই ব্লু রিজের শিখর! এমন-এক দুর্গ যার দেয়াল বেয়ে উঠতে পারার সাধ্য এই আবিষ্কারক ছাড়া আর-কারু নেই। হয়তো কোনো সুড়ঙ্গও সে আবিষ্কার করেছে এখানে-যার মধ্য দিয়ে বিভীষিকাকে সে স্থলপথেই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে–হয়তো সবসময় যে আকাশপথেই এখানে আসতে হবে, তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা তার নেই।
অবশেষে সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে! সেইজন্যেই সে গ্রেট আইরি থেকে আমাকে হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলো। যদি আমরা আগের বারে এই কোটরটায় এসে পৌঁছুতে পারতুম, কে জানে!, তাহলে হয়তো দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড-এর গুপ্তকথা জগতের কাছে মোটেই গুপ্ত থাকতো না!
সেখানে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম, নিশ্চল, আবিষ্ট : আমার দৃষ্টি চুম্বকের মতো আটকে আছে শিখরের ঐ পাষাণ ঈগলের ওপর, মনের মধ্যে তীব্র-প্রচণ্ড আলোড়ন! আমার নিজের কপালে যা থাকে থাক, আমার কি এখন কর্তব্য নয় এই যন্ত্রটাকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়া, এক্ষুনি, এখানে, আবার সে আকাশে তার ঐ মারাত্মক উড়াল শুরু করার আগেই!
আমার পেছন থেকে কাদের পায়ের শব্দ এগিয়ে এলো। ঝটিতি, আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। বৈজ্ঞানিক স্বয়ং আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, থমকে থেমে তাকিয়েছে আমার মুখের পানে। আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আপনা থেকেই মুখ ফুটে নামটা বেরিয়ে এলো : গ্রেট আইরি! গ্রেট আইরি!
ঠিকই চিনেছেন, ইসপেক্টর স্ট্রক। গ্রেট আইরিই!
আর আপনি! আপনিই দ্য মাস্টার অভ দি ওয়ার্ল্ড?
সেই জগতের প্রভু, যার কাছে আমি এর মধ্যেই প্রমাণ করে দিয়েছি যে আমিই সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ- অতিমানুষ!
আপনি! স্তম্ভিত, আমি বোকার মতো আবার বললুম কথাটা।
হ্যাঁ, অহমিকায় সটান দাঁড়িয়ে সে বললে, হ্যাঁ, আমি, হ্রবু–দিগ্বিজয়ী হ্রবু!