অনেক ভেবে চিন্তে গান্টু বলল “আমি সারকাসে যাব না। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজে চাকরি নিয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াব।”
রামু বলে, “জাহাজে চাকরি পাওয়া অত সোজা নয়। তোকে নেবে কেন? তুই সাঁতার জানিস?”
“শিখে নেব। তোকে সারকাসে নিলে আমাকে জাহাজে নেবে।”
“তাহলে পালাবি?”
“পালাব। কিন্তু গাড়িভাড়ার কী হবে? রাস্তায় খাব কী?
“সে হয়ে যাবে। আমি তো সারকাসের দলের সঙ্গে যাচ্ছি আমাকে ওরাই খেতে-টেতে দেবে।”
“আমি যদি তোর সঙ্গে থাকি তো আমাকেও নেবে?”
“সেটা এখুনি বলতে পারছি না। কথা বলতে হবে।”
ক্লাসের ফাঁকে-ফাঁকে গান্টুর সঙ্গে নানারকম পরামর্শ করে রামু বাসার ফিরল। সারাদিন খাওয়া নেই। টিফিনে গান্টু একটু চিনেবাদামের ভাগ দিয়েছিল মাত্র। তাতে খিদেটা আরো চাগিয়ে উঠেছে। পেটের আগুনটা রাগের হকা হয়ে মাথায় উঠে আসছে। বইটই রেখে রামু নিঃসাড়ে গিয়ে বাগানে ঢুকল। বাগানের এক কোণে একটা কুলগাছ আছে। তাতে মত্ত-মত টোপাকুল খেয়ে খিদেটা চাপা দেবে।
কিন্তু গিয়ে দেখে, কুন্দ দারোগার দুই ছেলে আন্দামান আর নিকোবর চুরি করে বাগানের দেয়াল টপকে ঢুকে গাছে উঠে কুল সব সাফ করছে। একজনের হাতে আবার একটা বাঁশের চ্যাঙড়ি। সেটা টোপাকুলে টপটপে ভর্তি।
রামু হাঁক মারল, “অ্যাই! আমাদের গাছে উঠে কুল পাড়ছিস যে বড়!”
কুকুসুমের শাসন বড্ড কড়া। কুল চুরির কথা জানাজানি হলে আস্ত রাখবে না। ভয়ের ব্যাপার আরো আছে। রামুর ঢিল ছোঁড়ার হাত দারুণ পাকা। এখন নীচ থেকে সে যদি ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে তবে গাছের ওপর দুই ভাইয়ের বড়ই বিপদ। রামুর ঢিল বড় একটা ফশকায় না। তাই দুই ভাই ওপর থেকে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, “বলিস না, ভাই বলিস না। অন্যায় হয়ে গেছে। তোকে অর্ধেক দিচ্ছি। পায়ে পড়ছি, ঢিল মারিস না।”
খিদে-পেটে রামুর গাছে উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তাছাড়া এ বাড়ির ওপর তার এখন এমন রাগ যে, এই বাড়ির কোন ক্ষতি হলে সে গম্ভীর হয়ে বলল, “ঠিক আছে, নেমে আয়।”
আন্দামান আর নিকোবর পকেটে করে কাগজের পুরিয়ায় অনেকটা ঝাল নুন এনেছে। তাই নিয়ে গাছতলায় তিনজনে কুলের ভোজে বসে গেল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে তিনজন কুল খেয়ে গেল। পাকা, আধ-পাকা ডাঁশা কুল আর দুর্দান্ত ঝালের শোঁসানি শোনো যাচ্ছিল কেবল। তারপর নিকোবর বলল, “তুই নাকি সারকাসের দলে ভিড়ছিস?”
রামু কথাটা আর কাউকে বলেনি, গান্টু ছাড়া। তাই চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে বলেছে?”
“গান্টু। স্কুল থেকে ফেরার পথে বলল, রামু সারকাসের দলে চলে যাচ্ছে।”
আন্দামান মুখ থেকে একটা কুলের বিচি ফুড়ুক করে ফেলে বলল, ওই সারকাসে একটা সাঙ্ঘাতিক খুনি লোক আছে। দিনে-দুপুরে মানুষ খুন করে।”
রামু বলে “কে বল তো?”
“যে লোকটা আজকাল সাপের খেলা দেখায়। মাস্টার লখিন্দর।”
“লোকটা খুনি কী করে জানলি?”
“বাবা গতকাল ফন্তুবাবুকে বলছিল, আমি আড়াল থেকে শুনেছি।”
“ফন্তুবাবুটা কে?”
“পুলিসের ইনফর্মার।”
“কী বলছিল?”
“বলছিল লখিন্দরের নাম নাকি আসলে লখিন্দর নয়। এ হচ্ছে মাস্টার গোবিন্দ। কাশিমের চরে হরিহর পাড়ুই বলে একটা লোককে খুন করে জেলে যায়। তার ফাঁসির হুকুমও হয়েছিল। কিন্তু লোকটা জেল থেকে পালিয়ে এসেছে।”
“তবে তোর বাবা তাকে ধরছে না কেন?”
“ধরা যাচ্ছে না লোকটা মুখোশ পড়ে থাকে তো। আসল চেহারাটা কেউ দেখেনি। সারকাসওয়ালারা অন্য একটা লোককে দেখিয়ে বলছে, এই হচ্ছে মাস্টার লখিন্দর।”
“তাহলে তোর বাবা এখন কী করবে?”
“কিছু করবে না। শুধু ওয়াচ করা হবে। মাস্টার গোবিন্দর সব খোঁজ খবর চেয়ে পাঠানো হয়েছে। পুলিস ফোর্সও আসছে। শহরটা ঘিরে ফেলা হবে। এখন ইনফর্মার আর সেপাইরা চারদিকে নজর রাখছে। গতকাল থেকে সারকাসে সাপের খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। বিরাট নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে–মাস্টার লখিন্দর পেটের পীড়ায় আক্রান্ত। সাপের খেলা বন্ধ রইল। সব প্ল্যান করা।”
আর কয়েকটা কুল খেয়ে রামু উঠে পড়ল। আন্দামান আর নিকোবর তাকে অর্ধেক কুলের ভাগ দিতে চাইলে রামু ঠোঁট উল্টে বলল, “তোরা নিগে যা।”
সন্ধ্যেবেলা গবা পাগলার ঘরে গিয়ে তাকে ধরল রামু “গবাদা! শুনেছ হবিগঞ্জের সারকাসের সেই সাপ-খেলোয়াড় লখিন্দর নাকি আসলে খুনি?”
অন্যমনস্ক গবা বলল “হ্যাঁ, খুব গুণী।”
“গুণী নয় গো, সে নাকি খুনি।” গবা অবাক হয়ে বলে, “তোমাকে কে বলল?”
“আন্দামান আর নিকোবর। কুন্দ দারোগার যমজ ছেলেরা।”
“বটে!” বলে গবা আঙুল দিয়ে তার দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলে, “খুন একটা হয়েছিল বটে। সেই কাশিমের চরে। গেলবারের আগের বারে শীতকালে। জায়গাটা এখান থেকে খুব দূরেও নয়। বিশ-পঁচিশ ক্রোশ হবে। খুব জ্যোৎস্না ছিল সেই রাতে।”
“তুমি সেখানে ছিলে?”
“খানিকটা ছিলাম বই কী। কাশিমের চরেই যে সেই রাতে তেনাদের নামবার কথা।”
“কাঁদের?”
“আলফা সেনটরি হল সৌরলোকের সবচেয়ে কাছাকাছি নক্ষত্র। দূরত্ব হবে চার আলোবছর। সেখানকার একটা উন্নত গ্রহের সঙ্গে আমার অনেকদিনের যোগাযোগ। বহুকাল খবর-বার্তা দিইনি বলে চিন্তা করছিল তারা। আমাকে একদিন একটা ভাবসংকেত পাঠাল। যন্ত্রপাতি দিয়ে নয়, স্রেফ জোরালো মানসিক প্রক্রিয়ায়। জানান দিল, দিন-দুইয়ের মধ্যেই তারা এক পূর্ণিমার রাতে কাশিমের চরে নামবে। আমি যেন সেখানে হাজির থাকি।”
“গুল মারছ গবাদা!”
“গবা তো কেবল গুলই মারে। আর বলব না, যাও।”
“আচ্ছা আচ্ছা, গুল নয়। বলো।”
“শেষ পর্যন্ত অবশ্য সময়মতো তারা আসতে পারেনি। পরে শুনলাম ওদের মহাকাশযানের একটা মাস্তুল নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল।”
‘মাস্তুল তো নৌকায় থাকে।”
“আরে বাবা এ কি আর সাধারণ মাস্তুল! এই মাস্তুল হল আসলে একটা সুপারসেনসিটিভ স্ক্যানার।”
“যাকগে, তারপর কী হল?”
“সে এক কাণ্ড। আমি তো কাশিমের চরে জোৎস্নায় একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমে ঢুলে পড়ছি। কখন তেনারা আসবেন। কাশিমের চর জায়গাটা বড় ভাল নয়। একধারে ঘন জঙ্গল, মাঝখানে নদী। শীতকাল বলে জল প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। দু ধার দিয়ে তিরতির করে নালার মতো দুটো স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে মস্ত চর। তা সেই চরেও আবার কাশফুলের ঘন ঝোঁপ সব। মাঝখানে অবশ্য অনেকটা জায়াগ ফাঁকা। সন্ধ্যের পরই সোনার থালার মতো চাঁদ উঠল। জ্যোৎস্নায় একেবারে মাখামাখি। আর যা শীত পড়েছিল সেবার তা আর বলার নয়।”
“উঃ প্রকৃতি-বর্ণনা রেখে আসল গল্পটা বলবে তো!”
“তোমার বাপু বড় ধৈর্য কম। গল্পের আসল প্রাণই তো ঐ প্রকৃতি আর পরিবেশের ওপর। ওটা না হলে গল্পটা বড় ন্যাড়া-ন্যাড়া হয়ে যায় যে। সত্যি বলে মনে হয় না।”
“তারপর কী হল?”
“সে এক কাণ্ড। আমি তো সেই শীতে একেবারে জড়সড়ো হয়ে ঠাণ্ডা মেরে বসে আছি। চারদিকে বেশ কুয়াশা। কুয়াশার মধ্যে জ্যোৎস্নার একটা আলাদা রূপ আছে। গোটা জায়গাটাকে মনে হচ্ছিল পরীর রাজ্য। দেখতে দেখতে রাত বেড়ে উঠল। ঘুমে আমি ঢুলে পড়ছি। এমন সময় মনে হল একটা লোক যেন দূর থেকে দৌড়ে আসছে। বালির ওপর তো পায়ের শব্দ হয় না। কিন্তু আমি সেই মহাকাশের লোকগুলোর ভাবসংকেত পাওয়ার জন্য মনটাকে এমন চনমনে রেখেছিলাম যে, উঁচ পড়লেও শব্দ শুনতে পাব।”
“তবে এই যে বললে ঘুমে ঢুলে পড়ছিলে!”
“তা বটে। তবে কিনা সে-ঘুমও ভাবের ঘুম। চোখ বোজা থাকে বটে, কিন্তু কান, গায়ের চামড়া, নাক, চারদিকের খবর পায়।”
“লোকটা দৌড়ে কোথায় গেল?”
“গেল না। লোকটা আসছিল। আমি চোখ চেয়ে কুয়াশায় কাউকে দেখতে পেলাম না। তবে কয়েক সেকেণ্ড পরেই আরো চার-পাঁচজনের দৌড়ে আসার আওয়াজ পেলাম। তারপর বুঝলাম প্রথম লোকটা পালাচ্ছে, পরের লোকেরা তাকে তাড়া করছে। প্রথম পায়ের শব্দটা ঝোঁপের আড়ালে-আবডালে বেড়ালের মতো চুপি চুপি ঘুরে বেড়াচ্ছে গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অন্য লোকগুলো তাকে খুঁজছে।”
“তুমি কী করলে?”
“আমি একটা হাই তুললাম তখন।”
“মাত্র হাই তুললে?”
“না, দুটো তুড়িও দিয়েছিলাম মনে আছে।”
“ধুস, তারপর কী হল?”
“ওঃ, সে এক কাণ্ড!”
.
১২.
বিরক্ত হয়ে রামু বলে, “আঃ, বলোই না!”
ভাবলে আজও গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যায়। দ্যাখো না, আমার বোর )
গা দ্যাখো!” বলে গবা হাতে দাঁড়ানো রোঁয়া দেখাল রামুকে।
তারপর বলল, “কুয়াশা আর জ্যোৎস্নার মধ্যে ঝোপেঝাড়ে সেই লুকোচুরি খেলা চলছে, আর আমি বসে আছি। ব্যাপার কী তা বুঝতে পারছি না। একবার হঠাৎ একটা শেয়াল এক ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে লাফ মেরে সাঁ করে ছুটে পালাল।
“তারপর?”
তারপর সেই ঝোঁপের আড়াল থেকে ধুতি পরা একটা লোক ব্যাপারে মুখ ঢেকে কুঁজো হয়ে বেরিয়ে এসে অবিকল শেয়ালের মতোই দৌড়ে পালাচ্ছিল। তার চেহারাটা বিশাল। ছ’ফুটের ওপরে লম্বা, ইয়া কাঁধ, ইয়া বুকের ছাতি। সেই ঝুমকো আলোয় মুখটাকা লোকটাকেও কিন্তু আমি চোখের পলকে চিনে ফেললাম।”
“লোকটা কে?”
“সেই লোকটাই পাড়ুই। ওরকম লোক আমি জন্মে দুটো দেখিনি। হরিহর পাড়ুই না-পারে এমন কোনো কাজ নেই। লোকের ছেলেমেয়ে চুরি করে আড়কাঠিদের কাছে বেচে দিত, নয়তো মা-বাপের কাছ থেকে টাকা আদায় করত। ডাকাতি করত। চুরি করত। আর খুন করা ছিল তার জলভাত। ওই তল্লাটে তার দাপটে সবাই কঁপত।”
“লোকটা কী করল?”
“লোকটা তখন পালাচ্ছিল। খুব অদ্ভুত দৃশ্য। হরিহর পাড়ুইকে পালাতে দেখাটাও ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ সাধারণত তাকে দেখেই অন্যেরা পালায়। তাই তাকে পালাতে দেখে ভারী অবাক লাগল। কাশিমের চরে এমনিতে ঘরবাড়ি নেই, তবে বহুকাল আগেরকার একটা ভাঙা বাড়ি আছে, সাপখোপ শেয়াল তক্ষক বাদুড় আর পাচার আচ্ছা। চোরে-ডাকাতেও বড় একটা কেউ সেই বাড়িতে ঢোকে না। আমি যেখানে বসেছিলাম, সেখান থেকে একটু ডাইনে কোনাকুনি একটা ঝাউবন। তার আড়াল থেকে সেই ভাঙা বাড়িটার একটা গম্বুজ দেখা যাচ্ছিল। নিকষ্যি অন্ধকার। হরিহর পাড়ুই কোলকুঁজো হয়ে সেই ঝাউবনের মধ্যে ঢুকে বাড়িটার দিকে যাচ্ছে বলে মনে হল। এমন সময়ে দেখি, গম্বুজে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। কে যেন উঁচু থেকে একটা টর্চবাতি জ্বালছে আর নেভাচ্ছে। আমার মনে হল, ব্যাপারটা একটু দেখা দরকার।”
“তোমার ভয় কর না?”
“না, ভয়ের কী? দুনিয়াটাই তো নানা খারাপ জিনিসে ভরা। ভয় পেতে শুরু করলে তার আর শেষ নেই।”
“তুমি কী করলে?”
“উঠে হরিহরের পিছু পিছু এগোতে লাগলাম। সেটাও দুঃসাহসের কাজ। হরিহর যদি টের পায় তাহলে চোখের পলকে আমার ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দেবে কসাই-ছুরি দিয়ে। তার কাছে সব সময় অস্ত্রশস্ত্র থাকে। স্বভাবটাও কেমন পাগলা খুনির। তাই খুব ঠাহর করে দেখে-শুনে সাবধানে এগোতে হচ্ছিল। কিন্তু ঝাউবনের মধ্যে আলো আঁধারিতে আর তাকে দেখতে পেলাম না। গম্বুজের বাতিটাও আর জ্বলছে না তখন।”
রামু চোখ বড়-বড় করে বলে, “তখন কী করলে?”
“কিছু করার নেই। চারদিক ঠাহর করছি। লোকটা তো আর নেই হয়ে যেতে পারে না। ঝাউবনের প্রথম দিকটায় বেশ পরিষ্কার। ঝোঁপজঙ্গল তেমন নেই। কিন্তু ভিতর দিকটায় মেলা আগাছা হয়েছে, লুকিয়ে থাকার পক্ষে তোফা জায়গা। আমি একটা কাঁটাঝোঁপের কাছাকাছি ঘাপটি মেরে বসে চারদিকে দেখছি, এমন সময়
“এমন সময়? উঃ, বলো না!”
“বলছি দাঁড়াও। হাঁ করতেই গলায় একাট মশা চলে গেল যে!” খক খক করে কেশে গলা সাফ করে গবা বলে, “বেশ নিঃঝুম। আলোর চিকড়ি মিকড়ি। শীত। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ একটা লম্বা হাত কোত্থেকে বেরিয়ে
এসে ঘপাত করে আমার ঘাড়টা ধরল।”
“বলো কী?”
“ওরে বাবা, সে-কথা ভাবতে আজও গায়ে কাটা দেয়। এই দ্যাখো ফের গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।”
“তারপর কী হল?”
“আমি তো কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। আর হাতটাও পেল্লায়। এই মোটা-মোটা আঙুল, কুলোর মতো মক্ত পাঞ্জা। সেই হাতের একটু বেকায়দা বেশি চাপ পড়লে আমাদের মতো সাধারণ ঘাড় মট করে ভেঙে যাবে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, হাতটা আমার ঘাড় ধরল কিন্তু তেমন আঁট করে ধরল না। বরং মনে হচ্ছিল, মস্ত হাতটা আমার কাঁধে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিন্তু আমি সেই ভাবেই তখন কুঁই-কুঁই করছি। টের পেলাম হাতটা সামনের কাটাঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এসে আমার ঘাড় ধরেছে। হাতটা মানুষের না অন্য কিছুর তা তখন বুঝতে পারছি না।”
“মানুষ নয়?”
“তখন তা বুঝবার মতো মনের অবস্থা নয়। তবে হঠাৎ ঝোঁপের ভিতর থেকে একটা খসখসে শ্বাস টানা শব্দ পেলাম। আমি তখন ভয়ে একেবারে পাথর। হঠাৎ সেই পেল্লায় হাত আমার ঘাড়ে একাট ঝাঁকুনি দিয়ে, আস্তে আস্তে ঝোঁপটার মধ্যে টেনে নিতে লাগল। সাঙ্ঘাতিক কাটাঝোঁপে আমার গাল নাক কান ছড়ে যাচ্ছে। চোখেও কাঁটা ঢুকে যেতে পারে। আমি দুহাত দিয়ে চোখটা আড়াল করলাম। তারপর ডালপালা-সমেত মুখ থুবড়ে পড়লাম মাটিতে। দেখি কী, কাটাঝোঁপের মধ্যে একটা লোক শুয়ে আছে। চারদিকে রক্তে ভেজা।”
“ওঃ বাবা!”
“বাবা বলে বাবা! আমি তো তখন বাবা ছেড়ে ঠাকুর্দাকে ডাকতে লেগেছি।”
“হল কী বলো না!”
“তেমন কিছু নয়। লোকটার তখন প্রায় হয়ে গেছে। বুকে মত ক্ষত। তা থেকে বগবগ করে রক্ত পড়ছে। লোকটার গলায় ঘড়ঘড়ানি উঠে গেছে। লোকটা কোনোক্ৰমে বলল, পাখি জানে। পাখি সব জানে। এইটুকু বলেই লোকটা ঢলে পড়ল।”
“লোকটা কে?”
“আর কে? সেই হরিহর পাড়ুই। তখনো মরেনি, কিন্তু মরছে। কিন্তু আমার অবস্থা তখন সাঙ্ঘাতিক। মরার সময় কী করে জানি না পাড়ুইয়ের হাতটা আমার ঘাড়কে শক্ত করে ধরল। কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। ওদিকে কাছাকাছি অনেকগুলো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কারা যেন এগিয়ে আসছে। চারদিকে টর্চের বাতি ঝলসাচ্ছে ফটাফট। যারাই হোক, তারা লোক ভাল নয়। আমার পালানো দরকার। কিন্তু হরিহরের হাতখানা আমাকে অষ্টপাশে বেঁধে ফেলেছে। কার সাধ্য ছাড়ায়! তার ওপর আঙুলগুলো ক্রমে বেঁকে গলায় গজালের মতো ঢুকে যাচ্ছে। মরন্ত মানুষের গায়ে যে অত শক্তি হয় কে জানত বলো।”
“তারপর কী হল? তাড়াতাড়ি বলল।”
“ওদিকে সেই বদমাশগুলোও তেড়ে আসছে। চারদিকে টর্চের আলো ঝলসাচ্ছে। একটা লোক চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, সাতনা, ঠিকমতো বল্লম চালিয়েছিলি তো! অন্য একজন রাশভারী গলায় বলল, আমার বল্লম এদিক-ওদিক হয় না। ঝাউবনের ঢুকবার মুখেই লোকটাকে গেঁথেছি। তবে দানোটার গায়ে খুব জোর। বল্লমটা ধাঁ করে টেনে খুলেই দৌড়ে পালাল। কিন্তু মনে হয় না। বেশি দূর যেতে পারবে। চারদিকে রক্তের ছড়া দেখছ না!”
“তখন তুমি কী করলে?”
“আমি? আমি তখন কিছু করাকরির বাইরে। হরিহরের কজায় আমার পুটিমাছের পরাণ ধড়ফড় করছে। আস্তে-আস্তে চেতন ভাবটা চলে যাচ্ছে। শ্বাস প্রায় বন্ধ। ঠিক এই সময়ে লোকগুলো “ঐ যে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। পর মুহূর্তেই সবাই এসে ঘিরে ধরল আমাদের।”
“তুমি বেঁচে গেলে বুঝি!”
“আরে দূর! অত সহজ নাকি? লোকগুলো টর্চ জ্বেলে দৃশ্যটা দেখেই চেঁচিয়ে বলে উঠল, এখনো বেঁচে আছে! সর্বনাশ। শেষ করে দে। শেষ করে দে। বলতে বলতে একাট লোক মঙ দা বের করে প্রথম কোপটায় হরিহরের গলা নামিয়ে দিল।”
“বলো কী? আর তুমি?”
“আর যারা ছিল তারা বলল, এ লোকটা কে রে? আর একজন বলল, যেই হোক, সাক্ষী রেখে লাভ নেই। লোকটা বেঁচে আছে। গলাটা নামিয়ে দে। সঙ্গে-সঙ্গে আর একটা লোক ঘচাত করে আমার গলাটাও নামিয়ে দিল।”
“যাঃ, কী যে বলো!”
“যা বলছি শুনে যাও। একেবারে প্রত্যক্ষ ঘটনা, দুনিয়ার আর কোনো মানুষের এমন অভিজ্ঞতা নেই। স্পষ্ট নিজের কাটামুণ্ডু প্রত্যক্ষ করলাম। বুঝলে! গলা দিয়ে ফোয়ারার মতো রক্ত পড়ছে। ধড়টা একটু ছটফট করছে। কিন্তু মুখোনা দিব্যি হাসি-হাসি।”
“গুল মারছ গবাদা।”
“সত্যি না। তারপর হল কী শোনো। সে এক কাণ্ড।”
“বলো।”
“ওরা তো আমাদের বন্ধ করে রেখে পালিয়ে গলে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটা গাছে ঠেস দিয়ে বসলাম। বারবার গলায় হাত বোলাচ্ছি। কিন্তু সেটা তো আমার গলা নয়। শরীরটা তখন বাতাসের মতো হালকা পাতলা জিনিস হয়ে গেছে। দেখি ঝোঁপের ওপাশ থেকে হরিহর পাড়ুইও উঠে পড়ে চারদিকে কটমট করে চাইছে। তার চাউনি দেখে ভয় খেয়ে পালাতে গিয়ে মনে হল, এখন আর ওকে ভয় কী? আমিও একটু ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। হরিহর আমাকে পছন্দ করছিল না। কাছে যেতেই একটা হুংকার দিল, খবরদার! আমি খিক করে হেসে বললাম, তোমার আর সেই দিন নেই হে হরিহর। মাথা গরম কোরো না বাবা। তার চেয়ে চলো চাঁদের আলোয় চরে বেড়াতে-বেড়াতে দুটো সুখদুঃখের কথা কই। হরিহর প্রথমটায় একটু গোঁ ধরে বসে ছিল। তারপর যখন সত্যিই বুঝল যে, সে মরে গেছে, তখন আমার সঙ্গে মিশতে আপত্তি করল না তেমন।”
“মরে গিয়ে তুমি ফের বেঁচে উঠলে কী করে?”
“সে তো আর-এক গল্প। আলফা সেনটরির গ্রহ থেকে যাদের আসবার কথা ছিল, তারা ভোর-রাত্রে এসে আমার দশা দেখে চটপট মাথাটা জুড়ে দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলল যে।”
“যত সব গুল। কিন্তু পাখি কী জানে তোত বললে না?”
হাঁ। সেইটেই তো আসল গল্প। আর একদিন হবে’খন।”
.
১৩.
রামু সঙ্গে-সঙ্গে গবার হাত ধরে বলে, “না, না, বলো। বলতেই হবে।”
গবা মাথা চুলকে বলে, “আসলে কী জানো, বেশ কিছুদিন আগেকার কথা কিনা, ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। তার ওপর আমার মাথাটা কাটা গিয়েছিল তে, তাতেও বুদ্ধি একটু ঘুলিয়ে গেছে। জ্যোৎস্নায় কাশিমের চরে হরিহরের প্রেতাত্মার সঙ্গে আমার যে-সব কথা হয়েছিল তার মধ্যে পাখির কথাটা আসেনি। মনে আছে আমরা সেই গলা কাটনেওলা লোকগুলোর আক্কেল নিয়ে কথা বলছিলাম। হরিহর একবার ভুল করে একটা মশা মারতে গিয়েছিল তাও মনে আছে। হাওয়া হাত দিয়ে কি আর মশা মারা যায়? দুজনে খুব হেসেছিলাম। কী হয় জানো, মরলে পর আর পুরনো শত্রু, রাগ, হিংসা এ-সব থাকে না। বেঁচে থেকে মানুষ যে-কাণ্ডমাণ্ড করে সেগুলোকে ভারী ছেলেমানুষি মনে হয় তখন। বাঁচা অবস্থায় তো আমি হরিহরকে কতই না সমঝে চলছিলাম, মরার পর আবার সেই হরিহরের সঙ্গেই চাঁদের আলোয় গলা-ধরাধরি করে বালির ওপর কত ঘুরলাম।”
“পাখির কথাটা তুললে না?”
“ঐ যে বললাম, বাঁচা অবস্থায় কৌতূহলগুলো পর্যন্ত মরার সঙ্গে সঙ্গে মরে যায়।”
“পাখিটা তবে কি জানত?”
“সেটা ভেবে দেখতে হবে!”
“আর হরিহরকে সেদিন খুনই বা করল কারা? তাদের তুমি চেনো?”
“কস্মিনকালে না।”
“মাস্টার গোবিন্দকে তাহলে পুলিস ধরল কেন?”
“এমনি-এমনি ধরেনি। গোবিন্দরও দোষ আছে।”
“কী দোষ?” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গবা বলে, “সে আবার আর-এক গল্প।”
“তাহলে গল্পটা বলে ফেল।”
“সেটা একদিন গোবিন্দর কাছেই শুনে নিও। আজ মেলা বকবক করে ফেলেছি।”
“গোবিন্দর কাছে কবে আমাকে নিয়ে যাবে?”
“আমি এখন তার কাছেই যাচ্ছি। ইচ্ছে করলে তুমিও যেতে পারো। তবে খবর্দার, ঘুণাক্ষরেও কাউকে বোলো না যেন। জানাজানি হলেই পুলিস গবাকে ধরে নিয়ে গারদে পুরবে।”
শহর ছাড়িয়ে মাইলটাক মেঠোপথে হাঁটলে একটা বেশ সমৃদ্ধ গাঁ। সন্ধ্যের একটু আগে সেই গাঁয়ের এক সম্পন্ন গেরস্তবাড়িতে রামুকে নিয়ে হানা দিল গবা।
গবাকে দেখে বাড়ির সবাই তটস্থ। “আসুন, আসুন, বসতে আজ্ঞা হোক।”
নিকোনো উঠোনে জলচৌকি পেতে দেওয়া হল। ঘটির জলে হাতমুখ ধুয়ে এসে রামু আর গবা পাশাপাশি দুটো জলচৌকিতে বসতে না বসতেই দুটো ছোটো ধামায় টাটকা ভাজা মুড়ি, বাতাসা, নারকেল আর দুধ খেতে দেওয়া হল তাদের। সারা দিনে রামুর এই প্রথম সত্যিকারের কিছু খাওয়া। সে যখন হালুম-হুঁলুম করে খাচ্ছে তখন গবা খুব মুরব্রি চালে গেরস্তকে জিজ্ঞেস করল, “গরু রাখার জন্য যে বোবা কালা লোকটাকে দিয়েছিলাম সে কেমন কাজ-টাজ করছে?”
“আজ্ঞে কাজ ভালই করে। খায়ও কম। কিন্তু লোকটা ভারী রাগী।”
“খুব চোটপাট করে বুঝি?”
“গেরস্থ একটু অবাক হয়ে বলে, “বোবা লোক চোটপাট করবে কেমন করে? তা নয়, তবে চোখ দুখান দিয়ে মাঝে মাঝে এমনভাবে তাকায় যে, পেটের মধ্যে গুড়গুড়নি উঠে যায়।”
“ লোকটা কোথায়?”
“একটু আগে গোরু নিয়ে ফিরল। এখন গোয়ালে সাঁজাল দিচ্ছে। ডাকাচ্ছি।”
গেরস্তর ছেলে গিয়ে রাখালটাকে ডেকে আনল। পরনে আধময়লা হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা মোটা কাপড়ের পিরান, গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। চোখ দুটির দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ যে, তাকালে বুকের মধ্যে একটু ধুকুর পুকুর হয় বটে।
গবা জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছিস রে?”
লোকটা ‘ব ব ওয়াঁ’ গোছের কিছু দুর্বোধ শব্দ করল।
গবা মাথা নেড়ে বলে “বেশ বেশ বেশ। তুই তো আবার কানেও শুনিস। তবু বলি, এরা ভাল লোক। এদের কাছে ভাল হয়ে থাকবি। চল, একটু এগিয়ে দিবি আমাদের। আঁধার হয়ে এসেছে, লণ্ঠনটা নিয়ে সঙ্গে আয়।”
শুনে গেরস্তর ছেলেপুলেরা হৈ হৈ করে উঠল। এখুনি যাবে কী গবা জ্যাঠা। আমরা যে তোমার সেই মেছো-ভুতের গল্পটার শেষটুকু শুনব বলে কতদিন ধরে হা-পিত্যেশ করছি. সেই যে গো আন্নাপুরের বড় ঝিলে সেবার মাছ ধরতে গিয়ে জলে একটা বড় কড়াই ভাসতে দেখিছিলে। তারপর সেই ভাসন্ত কড়াইটা যেই কাছে এসেছে অমনি সেটাকে ধরতে গিয়ে হাতে গরম ছ্যাকা খেলে! তারপর দেখলে, কড়াইটা জলে ভাসছে বটে কিন্তু তাতে গরম তেল ফুটছে। তারপর কী হল?”
গবা উঠে পড়ে বলল, “সে আর একদিন হবে। বাবুর বাড়ির ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তাড়াতাড়ি না ফিরলে রক্ষে থাকবে না।”
রাখালটা লণ্ঠন আর লাঠি হাতে তাদের সঙ্গে এগিয়ে দিতে এল। মেঠোপথে পা দিয়েই বোবা রাখাল কথা কয়ে উঠল, “গবাদা, ওদিকে কী হচ্ছে?”
“ধুন্ধুমার। পুলিস চারদিকে তোমায় খুঁজছে।”
.
১৪.
একটা শক্ত মামলায় মক্কেলকে জিতিয়ে দিয়েছেন উদ্ধববাবু। বড়লোক মক্কেল সকালেই বিরাট ভেট নিয়ে হাজির। ফলের ঝুড়ি, মিষ্টির চ্যাঙারি, দৈয়ের হাঁড়ি, বারকোষে মস্ত রুইমাছ,
ধামাভর্তি শীতের সজি। এলাহি কাণ্ড।
মামলায় জিতে উদ্ধববাবুর মনটা আজ ভাল। অন্য একটা মামলায় সওয়ালের ফাঁকে গুনগুন করে ভৈরবী ভেঁজে নিচ্ছিলেন। আদালতে গান গাওয়া নিষিদ্ধ। হাকিমসাহেব গুনগুননি শুনে বারবার এধার-ওধার তাকান, কিন্তু কোত্থেকে গানটা আসছে তা বুঝতে পারেন না। বার দুই তিন হাতুড়ি ঠুকে “অর্ডার অর্ডার” হাঁক দিলেন। প্রতিবারই উদ্ধববাবু রুমালে মুখ ঢেকে জিব কাটলেন। কিন্তু গান জিনিসটা ভারী অবাধ্য। ভিতরে গানের ফোয়ারা খুলে গেলে তাকে ঠেকায় কার সাধ্য।
অবশেষে বিপক্ষের উকিল উঠে হাকিমকে বললেন, “আমাদের লার্নেড ফ্রেণ্ড উদ্ধববাবুর স্বভাব অনেকটা কোকিলের মতো। বসন্ত সমাসঃ দেখে ওঁর কণ্ঠ কুহু কুহু’ রবে চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কোকিল যেমন কাকের বাসায় ডিম পাড়ে, উনিও তেমনি ওঁর গানের ডিম এই আদালতে পেড়ে রেখে যাচ্ছেন।”
এই অদ্ভুত সওয়ালে হাকিম ভূ কোচকালেন, লজ্জিত উদ্ধববাবু ঘাড় চুলকোচ্ছেন। আর-এক হাতুড়ি মেরে আদালতকে চুপ করিয়ে উদ্ধববাবুকে বলেন, “আপনার হিয়ারিংয়ের জন্য একটা ডেট নিন। আজ বাড়ি চলে যান।”
হাঁফ ছেড়ে উদ্ধববাবু বেরিয়ে এলেন। বাস্তবিক এতক্ষণ তার হাঁফ ধরে আসছিল, আইঢাই করছিল। পাকা ফোঁড়ার মতো ভিতরে টনটন করছে গান। একটু টুশকি দিলেই বোমার মতো ফেটে পড়বে। সেই টুশকিটা এতক্ষণ দিতে পারছিলেন না।
এজলাসের চৌহদ্দি পার হয়ে রাস্তায় পড়েই গানের ফেঁড়াটায় টুশকি দিলেন উদ্ধববাবু। আর বাস্তবিক সেটা বোমার মতোই ফাটল। হাঁ করে প্রথম তানটা লাগাতেই এত জোর শব্দ হল যে, উদ্ধববাবু নিজেই হকচকিয়ে গেলেন।
শুধু তাই নয়। সেই শব্দে রাস্তার লোকজনও পালাতে লাগল। কাক কা-কা করে উড়ে উড়ে ঘুরতে লাগল। উদ্ধববাবু তাজ্জব হয়ে দেখলেন, তাঁর গানের কোঁড়াটা বোমার মতো ফেটে চারদিকে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে।
ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কেটে যেতে কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগল। তারপর উদ্ধববাবু হঠাৎ বুঝতে পারলেন শব্দটা তার গলা থেকে বেরোয়নি। অমন বোমার মতো আওয়াজ খুব বড় ওস্তাদের গলা থেকে বেরোবার কথা নয়। যুক্তি অনুসরণ করলে সন্দেহ থাকে না, বোমার মতো আওয়াজটা একটা বোমারই কাজ। আর সেটা ফেটেছে উদ্ধববাবুর মাত্র হাত দশেকের মধ্যে।
রাস্তার আর-পাঁচজনের মতো উদ্ধববাবুও দৌড়তে লাগলেন। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনার সময় নেই। গলায় গানটাও আর ঠেলাঠেলি করছে না।
বাড়িতে এসে নিজের ঘরে শুয়ে চোখ বুজে অনেকক্ষণ হাঁফ ছাড়লেন উদ্ধববাবু। ব্যাপারটা কী হল তা বুঝতে পারছিলেন না। বোমাটা এত কাছাকাছি ফেটেছে যে, সেই শব্দে তার মাথাটা এখনও ডোম্বল হয়ে আছে। এমন কী শুয়ে-শুয়ে কয়েকবার ভৈরবীতে তান লাগানোর চেষ্টাও করলেন উদ্ধববাবু। কিন্তু গলার স্বর ফুটল না।
ভিতরের বারান্দা থেকে কাকাতুয়াটা বলে উঠল “দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি। দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি।”
উদ্ধববাবু কাকাতুয়ার কথা শুনে উঠে বসলেন। মক্কেল যে অঢেল ভেট দিয়ে গেছে, তা ফেলে-ছড়িয়ে খেয়েও শেষ হওয়ার কথা নয়। তাই উঠে ভিতরবাড়ি থেকে একটা রসগোল্লার হাঁড়ি এনে কাকাতুয়াটাকে খাওয়াতে লেগে গেলেন।
কাকাতুয়াটা বেশ চেখে-চুখেই খাচ্ছিল। কয়দিনে পাখিটা উদ্ধববাবুকে খুব চিনেছে। খেতে-খেতে ঘাড় ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে উদ্ধববাবুকে দেখছিল। হঠাৎ একটু চাপা গলায় বলল, “কাউকে বোলো না। কাশিমের চরে অনেক মোহর আছে।”
উদ্ধববাবু হাঁ করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর বললেন, “বলিস কী রে?”
“বিশু জানে না। বিশু জানে না।”
“বিশুটা কে বলবি তো।”
পাখি তখন অন্য কথা বলতে লাগল, “রামু, তুমি ভীষণ দুষ্টু। পড়তে যাও। নইলে গোস্লা পাবে।” তারপর আবার স্বর পালটে বলে, “দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি।”
চারদিকে চেয়ে উদ্ধববাবু পাখির দাঁড়টা বারান্দা থেকে নিজের ঘরে এনে রাখলেন।
উদ্ধববাবু বিস্তর মামলা-মোকদ্দমা করেছেন। তিনি জানেন, যার কাছে কোনো গোপন খবর থাকে, তার জীবন সর্বদাই বিপদসংকুল। এই পাখিটা নিশ্চিত লুকোনো সম্পদের খবর জানে। এ পর্যন্ত পাখিটার ওপর হামলাও কিছু কম হয়নি। কিন্তু এতকাল কাকাতুয়াটা কাশিমের চরের কথা বলেনি। কেউ যদি কথাটা শুনতে পায়, তবে যেমন করেই হোক হন্যে হয়ে পাখিটাকে হাত করার চেষ্টা করবে। তার জন্য খুন পর্যন্ত করতে পিছপা হবে না।
উদ্ধববাবু আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বিছানায় গা ঢালতেই পিঠের নীচে কী একটা খচমচ করে উঠল। উঠে দেখলেন একটা খাম তাতে ভঁর নাম লেখা।
খাম খুলতেই একটা চিঠি।
মহাশয়, কাকাতুয়াটিকে ফেরত পাইবার জন্য যে প্রস্তাব দিয়াছিলাম তাহা আপনি কার্যত অগ্রাহ্য করিয়াছেন। বুঝিতেছি সহজ পথে আপনি পাখিটিকে ফেরত দেবেন না। তাহাতে অবশ্য আমাদের কিছুই না, বিপদ আপনারই। আজ আদালতের বাহিরে যা ঘটিল, তাহা একটি নমুনা মাত্র। বোমাটিতে কেবল আওয়াজের মশলা ছিল, ক্ষতিকারক কোনোকিছু ছিল না। আপনাকে আমাদের সম্পর্কে সচেতন করিয়া দিতেই এই কাজ করিতে বাধ্য হইলাম। ইহার পর যদি কখনো আমাদের বোমা প্রয়োগ করিতে হয়, তবে এবার তাহার মধ্যে মারাত্মক বস্তু সকলই থাকিবে। মনুষ্যজীবন অতীব মহার্ঘ বিবেচনা করিয়া ভালয়-ভালয় পাখিটিকে আমাদের হতে তুলিয়া দিবেন। বেশি কিছু করিতে হইবে না। আপনাদের বাহিরের বারান্দায় আজ রাতে পাখির দাঁড়টা (পাখি সমেত) ঝুলাইয়া রাখিবেন। কোনো পাহারা রাখিবেন না আমরা যথাসময়ে তাহা হস্তগত করিব। ক্ষতিপূরণ বাবদ যথেষ্ট অর্থও আপনি পাইবেন। ইতি।
এর আগের চিঠিতে ‘আমি আমি’ করে লেখা ছিল। এই চিঠিতে বহুবচনের ‘আমরা।
উদ্ধববাবু চারদিকে চেয়ে দেখলেন শোওয়ার ঘরের তিন দিকেই বড় বড় জানালা। দক্ষিণ দিকে বাগান, পূর্বদিকেও বাগান, উত্তরদিকে কলতলা। পত্রবাহক কোন দিক দিয়ে এসে টুক করে এই অল্প সময়ের মধ্যে জানালা গলিয়ে বিছানায় চিঠিটা ফেলে গেছে, তা অনুমান করা শক্ত। তবে এরা যে বেশ সংগঠিত দল তাতে সন্দেহ নেই।
উদ্ধববাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “হুঁ।” পাখিটাও তার হু শিখে গেছে। সেও বলল, “হুঁ।”
উদ্ধববাবু কাকাতুয়ার দিকে চেয়ে দেখলেন পাখিটাও তার দিকেই চেয়ে আছে। বড় মায়া পড়ে গেছে উদ্ধববাবুর। উঠে গিয়ে কাকাতুয়ার পালকে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন “কেন যে বাবা গোপন কথাগুলো শিখতে গেলি। এখন তোরও বিপদ, আমারও বিপদ।”
পাখিটা হঠাৎ আর্তস্বরে বলে উঠল, “বিশু, আমাকে মেরো না! মেয়র।”
উদ্ধববাবু চমকে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। না, কেউ কোথাও নেই। পাখিটা পুরনো মুখস্থ বুলিটা বলছে।
আলমারি খুলে উদ্ধববাবু তার বাবার আমলের দোনলা বন্দুকটা বের করলেন। বহুকাল কেউ বন্দুকটা চালায়নি। উদ্ধববাবু বন্দুকটা পরিষ্কার করতে বসে গেলেন।
ভয়ের চেয়ে ভালবাসা অনেক বড়। উদ্ধববাবু ভয়ের কাছ হার নামতে রাজি নন।
.
১৫.
এমনিতে দেখতে গেলে মাস্টার গোবিন্দ বেশ সুখেই আছে। সারাটা দিন গোরু চরান, গেরস্ত বাড়ির অজস্র কাজ মুখ বুজে করে, পেট ভরে খায় আর সন্ধের পর খড়ের গাদায় ঢুকে ঘুমোয়। বোবা কালা হয়ে থাকতে একটু কষ্ট হয় বটে, কিন্তু সেটা সইয়ে নিচ্ছে।
মাঝে-মাঝে বেমক্কা মুখ ফুটে এক-আধটা শব্দ বেরিয়ে আসে ঠিকই, কিন্তু ততটা ক্ষতি কিছু হয়নি।
সেদিন গেরস্তর ছেলের বউ এক গামলা ফুটন্ত ভাতের ফ্যান উঠোনের কোণে রেখে খার কাঁচতে গেছে, এমন সময় গেরস্তর ছোট্ট নাতি হামা টানতে টানতে গিয়ে সেই গামলার কান ধরে উঠতে গিয়েছে। গোবিন্দ গোরুগুলোকে মাঠ থেকে নিয়ে আসতে যাচ্ছিল দুপুর বেলা। এই দৃশ্য দেখে বেখেয়ালে ‘ইশ, গেল, ছেলেটা গেল’ বলে চেঁচিয়ে দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেয়। ভাগ্যিস কেউ শোনেনি।
আর একদিন গেরস্তর মেজো ছেলে সকালে তাকে ঘুম থেকে তুলে দিতে এসেছিল। তখন একেবারে কাকভোর। আগের রাত্রে যাত্রা শুনেছে বলে ঘুমটা ভোরে খুব গাঢ় হয়েছিল গোবিন্দর। ছেলেটার ডাকাডাকিতে উঠে বসে বলে ফেলেছিল “দুত্তোর, এমন ষাড়ের মতো কেন চেঁচায় লোকে!” ছেলেটা অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে বলল, “এ কী! তুমি যে বড় কথা বলতে পারো।” গোবিন্দ ফ্যাসাদে পড়ে অনেকক্ষণ বুবু করল বটে, কিন্তু ছেলেটার যেন প্রত্যয় হল না। পাছে লোক জানাজানি হয়ে যায়, সেই ভয়ে তখন। ছেলেটাকে কিছু-কিছু কথা খুলে বলল গোবিন্দ। রাজি করাল যাতে কাউকে বলে।
বেশ কাটছিল। কিন্তু একদিন সকালবেলা গোবিন্দ দেখল, একাট রোগা খুঁটকো মতো তোক গেরস্তর সঙ্গে উঠোনে বসে কথা বলছে লোকটার চাউনি টাউনিগুলো ভাল নয়। কথা বলতে-বলতে চারদিকে নজর রাখছে। বোঝ যায় কিছু বা কাউকে খুঁজছে।
লোকটা চলে যাওয়ার পর গোবিন্দ গেরস্তর মেজো ছেলেকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করল, “যে লোকটা এসেছিল সে কে বলো তো!”
“ও হল ফন্তুবাবু।”
“সে আবার কে?”
“দালালি-ফালালি করে। জমি বেচাকেনার কারবার আছে।”
“আর কিছু?”
“আর কিছু তো জানি না।”
“মানুষটা কেমন?”
“তা কে জানে! তবে বাবার কাছে মাঝে-মাঝে আসে।”
“আজ কেন এসেছিল একটু খোঁজ নেবে? যাও, তোমার বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো।”
ছেলেটা একটু বাদে ঘুরে এসে বলল, “কে একটা লোক জেলখানা থেকে পালিয়ে এদিকে এসেছে তার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল।
গোবিন্দ জেল পালানোর কথাটা ছেলেটাকে বলেনি। শুধু বদমাশ লোক তার পিছনে লেগেছে বলে সে লুকিয়ে আছে। গোবিন্দ জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা আমার কথা কিছু বলেননি তো?”
কিছু লোকের স্বভাব হল, বুদ্ধি থাকলেও তা খাটাবে না। ছেলেটা বলল, “দাঁড়াও, গিয়ে বাবাকে বাবাকে জিজ্ঞেস করে আসি।”
গোবিন্দ তাকে থামিয়ে বলল, “এখন ফের জিজ্ঞেস করলে তোমার বাবার সন্দেহ হবে। থাকগে।”
রামু মাঝে-মাঝে ছুটির দিনে গোরু চরানোর মাঠে খেলা শিখতে আসে। গোবিন্দ লক্ষ করেছে, ছেলেটা যেদিকে মন দেয় সেদিকটায় বেশ ধাঁ করে উন্নতি করে ফেলতে পারে। খালি মাঠে যন্ত্রপাতি ছাড়া রামুকে আর কীই বা শেখাতে পারে গোবিন্দ? তবু যে কয়েকটা মামুলি একসারসাইজ শিখিয়েছিল, তা চটপট শিখে নিল রামু। খেলা শেখার ফাঁকে-ফাঁকে দু-একটা খবরও দিত। সামন্ত বলে দিয়েছে, পুলিশ সারকাসের ওপর নজর রাখছে তো বটেই, কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হয় পুলিশ ছাড়া অন্যকিছু লোকও সারকাসের আশেপাশে ঘোরা-ফেরা করছে। আর একদিন এসে রামু জানিয়ে গেল, খুব শিগগিরই সারকাস এখান থেকে উঠে যাবে। গোবিন্দ যেন সারকাসের দলের সঙ্গে না যায়। এবার সারকাস যাবে অযযাধ্যার দিকে। পারলে গোবিন্দ যেন সেখানে গিয়ে দলে ভিড়ে যায়।
সারকাসের জন্য প্রাণটা বড় কাঁদে গোবিন্দর। চারদিক থেকে আলো এসে পড়ে, শূন্যে মাটিতে তার বা দড়ির ওপর হরেক রকম খেলা চলে, সঙ্গে অদ্ভুত ব্যাণ্ডের আওয়াজ–সে যেন এক স্বপ্নের জগৎ। তা ছাড়া সারকাস হল এক বৃহৎ পরিবার। সকলের জন্য সকলে। সেই সারকাসে আর ফিরে যাওয়া হবে কিনা কে জানে!
গোরু চরাতে-চরাতে এইসব ভাবে গোবিন্দ।
একদিন গোরু নিয়ে বিকেলবেলা ফিরছে, হঠাৎ দেখে গেরস্তর বাড়ির সামনে খুব লম্বা আর জোয়ান একটা লোক দাঁড়িয়ে গাঁয়ের আর-একটা লোকের সঙ্গে কী কথা বলছে, গোবিন্দ পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে শুনতে পেল গাঁয়ের লোকটা বলছে, “না, এ-গাঁয়ে খুনি গুণ্ডা বদমাশ আসবে কোথকে? সে সব শহরে থাকে।”
লম্বা লোকটা বলল, “হয়ত পালিয়ে আছে।”
“পালানোর জায়গা কোথায়?”
“আচ্ছা গবা বলে কাউকে চেনো?”
“খুব চিনি। গবা পাগলা হলেন স্বয়ং শিব।”
“তিনি কি এ-গাঁয়ে আসেন?”
“প্রায়ই আসেন। এই তো সেদিন আমার কেলে গোরটার কলেরার মতো হল। গবা পাগলটাকে ডেকে আনতে তিনি এসে এমন এক ভস্ম খাইয়ে দিলেন যে, পরদিন থেকে গোবর একেবারে ইটের মতো এঁটে গেল।”
এই পর্যন্ত শুনে গোবিন্দ বাড়িতে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু মুশকিল হল, এ-লোকটা পুলিশের লোক নয়। লম্বা এবং বিশাল চেহারার এই দানবকে গোবিন্দ চেনে। রয়্যাল সারকাসে লোকটা পাঁচ মন ভার তুলে রোজ লোককে তাক লাগিয়ে দিত। তারপর সে হঠাৎ একদিন সারকাস ছেড়ে উধাও হয়। গোবিন্দ কানা ঘুষো শুনেছে, এই লোকটা অর্থাৎ সাতনা একটা বাজে সঙ্গে পড়ে খুন-কারাপি করে বেড়ায়। কেন সাতনা খারাপ লোকদের দলে ভিড়ল তাও খানিকটা জানে গোবিন্দ। সাতনার সাত বছর বয়সের একটা মা-মরা মেয়ে ছিল। কে বা কারা সেই মেয়েটাকে চুরি করে সারকাস থেকে নিয়ে যায়, তারপর দশ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। সাতনার অত টাকা ছিল না। আদরের মেয়েকে প্রাণে বাঁচানোর জন্য সে রয়্যাল সারকাসের মালিকের হাতে পায়ে ধরে টাকাটা ধার হিসেবে চায়। কিন্তু সারকাসের মালিক টাকাটা দেয়নি। কিছুদিন পর কে মেয়েটিকে নাকি কাশীতে ভিক্ষে করতে দেখেছিল। তখন তার জিব কাটা, একটা চোখ কানা। সানা কাশীতে যায়, কিন্তু মেয়েকে পায়নি। সেই থেকে পাগলের মতো হয়ে যায়। কাশিমের চরের কাছে সুলতানপুরের মেয়েটি চুরি যায়। সাতনা নিজের সঙ্গে মেয়েটাকে নিয়ে সারকাসের দলে ঘুরে বেড়াত। মেয়েকে খেলা শেখাত। সেই মেয়ে নিখোঁজ হওয়ায় সে আবার সুলতানপুরে ফিরে আসে। তারপর কী হয়েছে তা আর গোবিন্দ স্পষ্ট জানে না।
এখন সাতনা তার খোঁজ করছে জেনে সে খুব অবাক হল। সাতনার সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। অবশ্য বন্ধুত্বও নেই। সাতনার সঙ্গে খুব সামান্য একটু চেনাজানা মাত্র ছিল তার।
রাতে খড়ের গাদায় শুয়ে অনেক ভেবেও সে কিছুতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। তবে সাতনার সঙ্গে হরিহর পাড়ুইয়ের খুব বন্ধুত্ব ছিল একসময়ে। হরিহর ছিল সুলতানপুরের সুলতান। তার কথায় গোটা গঞ্জ উঠত বসত। কিন্তু সেটা করত ভয়ে। ঐ রকম ভয়ংকর লোক দুটো দেখা যায় না।
গোবিন্দ ঘুমিয়ে পড়েছিল, মাঝরাতে আচমকা ধোঁয়ার গন্ধে উঠে বসল। চোখ কচলে চেয়ে কিছু বুঝবার আগেই হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল পুরো খড়ের গাদাটার চারপাশে দিয়ে বেড়াজালের মতো আগুনের শিখা উঠে আসছে। ভাল করে ব্যাপারটা বুঝবার আগেই আগুনের শিখা দাপিয়ে উঠল আকাশে।
চারদিকে রক্তাভ লেলিহান ভয়ংকর আগুন। গেরবাড়ি থেকে বিকট চেঁচামেচি আসছিল। লোকজন দৌড়ে আসছে।
গোবিন্দ কী করবে বুঝতে পারছিল না। চারদিক দিয়ে আগুন যে ভাবে ঘিরে ধরেছে তাতে পালানোরা কোনো স্বাভাবিক পথ নেই। কিন্তু আর কয়েক
সেকেণ্ডে থাকলেও আগুনে বেগুন-পোড়া হতে হবে।
গোবিন্দ উঠল। পায়ের নীচে নরম ঘড়। তার জন্য শরীরের ভারসাম্য রাখাই দায়। লাফ দেওয়ার জন্য পায়ের নীচে শক্ত মাটি দরকার।
গোবিন্দ কিছু না-ভেবেই মাথার ওপর থেকে টেনে এক পাঁজা খড় সরিয়ে ফেলল। মাঝখানের শক্ত খুঁটিটা দেখতে পেয়ে কাঠবেড়ালির মতো সেটা বেয়ে উঠে এল একদম ওপরে। খুঁটিটার মাথায় দাঁড়ানোর জায়গা নেই। কোনক্রমে পায়ের পাতা রাখা যায় মাত্র। কিন্তু সারকাসের খেলোয়াড়ের কাছে তা যথেষ্ট।
গোবিন্দ প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু খুঁটির মাথায় দাঁড়িয়ে ইষ্টদেবকে স্মরণ করে জীবনের সবেচেয় বড় লাফটা মারল।