১১-১৩. ছোটখাটো একটা সভা

রবিবার দুপুরে ছোটখাটো একটা সভা বসেছে মিতিনের ড্রয়িংরুমে। মিতিন, টুপুর, পার্থ ছাড়াও সেখানে কুশল হাজির আজ। কুশলকে কাল বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসার সময়েই আজ মধ্যাহ্নভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মিতিন। আর খ্যাঁটনের গন্ধ পেলে কুশল কি না এসে পারে! বাৰ্ডফ্লুর অজুহাতে সম্প্রতি বাড়িতে মুরগি আনছে না পাৰ্থ, তবে চিংড়ির মালাইকারি আর মাটনকোর্মা মিলিয়ে মেনু মন্দ হয়নি আজ। এখন ভরাপেটে শুরু হয়েছে ঝিয়েন হত্যার চুলচেরা বিশ্লেষণ। আর সম্ভাব্য আততায়ীর অনুসন্ধান।

পার্থ মন্তব্য করল, যাক, একটা ব্যাপারে অন্তত তো তোমরা নিশ্চিন্ত হয়েছ। খুনি কোনও চিনেম্যান নয়।

মিতিন বলল, এখনও পর্যন্ত তো তাই মনে হচ্ছে।

কুশল বলল, তা হলে রইল পড়ে চার। স্বপন দত্ত আর ওই তিন প্রোফেসর। থুড়ি, পাঁচ। স্বপন দত্তর দোকানের মন্টুকেও তো ধরতে হবে। যদিও আমার মনে হয় না, খুনটা সে করেছে। ভুল করে তাকে ধরেছে পুলিশ।

বটেই তো। টুপুর মুখে ভাজা মৌরি পুরল। চিবোতে চিবোতে বলল,  আমার মনে হয়, মন্টু বেচারাকে অযথা হ্যারাস করার কোনও মানেই হয় না। আঙ্কল ঝিয়েন জিনিসটা কেনার দিন সে তো কাজেই যায়নি।

পার্থ বলল, ওটাই হয়তো মন্টুর চাল। আগের দিন যখন স্বপন দত্ত জিনিসটাকে দশ হাজারে বেচতে রাজি হয়ে গেল, তখনই ও প্ল্যান ছকে নিয়েছে।

টুপুর বলল, তার মানে বলতে চাও মন্টু বুঝে গিয়েছিল জিনিসটা দামি?

আন্দাজ করেছিল। মিস্টার ঝিয়েন যেভাবে জিনিসটার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। প্লাস, আর-একজন ভদ্রলোকও তো এসেছিলেন জিনিসটার খোঁজে। …এইসব থেকেই মন্টু হয়তো ভেবেছিল, জিনিসটা হাতিয়ে অন্য কোথাও বেচতে পারলে অনেক অনেক বেশি টাকা পাবে। এখন তো যা শুনছি, জিনিসটার দাম বিশপঞ্চাশ লাখ হওয়াও বিচিত্র নয়। এর থেকে কত অল্প টাকার জন্য আজকাল মানুষ মানুষকে খুন করে দেয়।

মেসোর কথায় কিন্তু যুক্তি আছে রে টুপুর। কুশল পাৰ্থর দিকে হেলে গেল, দ্বিতীয় যে লোকটা জিনিসটার খোঁজে এসেছিল, সেই হয়তো মন্টুকে টোপ দিয়ে… মানে টাকার লোভ দেখিয়ে মন্টুকে দিয়েই করিয়েছে কাজটা।

চান্স খুব কম। টুপুর মাথা ঝাঁকাল, মন্টুর যদি জিনিসটা হাতানোরই ইচ্ছে থাকত, সহজেই তো দোকান থেকে নিয়ে পগারপার হত। খামোখা খুনের ঝুঁকি সে নেবে কেন?

তা হলে পুলিশ তাকে আদৌ ধরলই বা কেন?

অনেক সময়ই এরকম এক-আধজনকে ধরে পুলিশ। অনিশ্চয় আঙ্কল বলেন, কাউকে গ্রেপ্তার না করতে পারলে খবরের কাগজের লোকরা নাকি খুব বাঁকা বাঁকা কথা শোনায়। দেখে নিস, মন্টুকে দু- চার দিন পরে ছেড়েও দেবে।

তোদের মন্টু-গবেষণা থামাবি? হঠাৎই সরব হয়েছে মিতিন। সোফায় বাবু হয়ে বসে বলল, মন্টু ছাড়াও আর যে চারজন সন্দেহভাজন আছে, তাদের কথায় আয়।

পার্থ বলল, মন্টুকে যদি বাদ দাও, তা হলে তো নেক্সট সাসপেক্ট তোমার স্বপন দত্ত। সে তো স্বীকারই করেছে, সেদিন সে রেসের মাঠে গিয়েছিল। সেখান থেকে প্রিন্সেপ ঘাট আর কদ্দূর? আর-একটু চাপ দিলেই পেট থেকে বেরিয়ে আসবে, রেসের মাঠ নয়, সে সেদিন গিয়েছিল প্রিন্সেপ ঘাটেই। মিস্টার ঝিয়েনকে ফলো করে।

মিতিন হেসে ফেলল, বড় গোঁজামিল দিয়ে ফেলছ, পার্থ। মিস্টার ঝিয়েন জিনিসটা কিনে চলে যাওয়ার পর দোকান বন্ধ করতেও তো পাঁচ-দশ মিনিট সময় লাগে। যদি ধরেও নিই, স্বপন দত্ত সঙ্গে সঙ্গেই দোকানের শাটার নামিয়ে মিস্টার ঝিয়েনের পেছন-পেছন দৌড়েছে, তা হলেও ব্যাপারটা দাঁড়ায় কী? ডোন্ট ফরগেট, মিস্টার ঝিয়েনের জিনিসটা কেনা এবং খুন হওয়া, এর মাঝে প্রায় ঘণ্টা দু-আড়াইয়ের ব্যবধান।

সো? পার্থ হাত ওলটালো, দু-আড়াই ঘণ্টা ধরে একটা লোককে ফলো করা যায় না? আমিই তো তোমার ডিরেকশন মতো একজনকে ছঘণ্টা ফলো করেছিলাম। স্বপন দত্ত হয়তো ধাওয়া করতে করতে, ধাওয়া করতে করতে, জায়গামতো মিস্টার ঝিয়েনকে পেয়ে…

কুশল বলল, কিন্তু মেসো… স্বপন দত্ত তা হলে জিনিসটা আদৌ বেচল কেন?

ইনস্ট্যান্ট টাকার লোভে। এবং টাকাটা পেয়েই মনে হয়েছে বিক্রি করাটা গোখখুরি হয়ে গেল। আবার এও হতে পারে, জিনিসটা কেনার পর মিস্টার ঝিয়েনই হয়তো খুশির আতিশয্যে জিনিসটা যে কত মূল্যবান, সেটা বলে ফেলেছিলেন। তাতেই স্বপনের লোভ চাড়া দিয়ে ওঠে।

সব ঠিক আছে। টুপুর মাথা নাড়ল, তবে তুমি কিন্তু দুটো পয়েন্ট মিস করে যাচ্ছ পার্থমেসো। এক নম্বর, আঙ্কল ঝিয়েনকে মাথায় আঘাত করার পরে একটা গাড়ি কিন্তু সত্যি-সত্যিই তাঁকে চাপা দিয়েছিল। রাস্তার মধ্যিখানে নয়, একেবারে ফুটপাতের গা ঘেঁষে। তার মানে, গাড়ি চাপা দেওয়াটাও হয়েছিল প্ল্যানড ওয়েতে। যে-লোকটার মাথায় হঠাৎ জিনিসটা হাতানোর মতলব এসেছে, তার পক্ষে কি এত কিছু প্ল্যান করে ঘটানো সম্ভব? প্রথমে মাথায় ডান্ডা মেরে ফুটপাতের ধারে ফেলে রাখল, তারপর একটা গাড়ি জোগাড় করে এনে চাপা দিল… অত সোজা? সেকেন্ডলি, দ্য মিস্টিরিয়াস ফোন কল। আঙ্কল ঝিয়েনের সঙ্গে কারও একটা সাড়ে চারটেয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। কার সঙ্গে? কোথায়? কেন? নিশ্চয়ই সেই লোকটা স্বপন দত্ত নয়?

হয়তো ছিল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট। মিস্টার ঝিয়েন সেখানে যাননি!

অর্থাৎ অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেও সেটি রক্ষা না করে, নিজের বাড়িতেও না-ফিরে, মিস্টার ঝিয়েন মনের আনন্দে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে চলে গেলেন। মিতিন মুখ বাঁকাল, কী অকাট্য যুক্তি?

হতে পারে না?

হতে পারে কি পারে না, সেই গোলকধাঁধায় না-ঢুকে বরং দেখা যাক, কী কী হয়েছে। খুন। গাড়ি চাপা। ম্যাপ চুরি। মোবাইল মিসিং। যে-লোকটা খুন করেছে, ম্যাপ আর মোবাইল যদি সেই নিয়ে থাকে, তার থেকে আমরা একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারি। খুনি অবশ্যই ভেবেছে, মোবাইল ফোন থেকে তার পরিচয়টা জানাজানি হয়ে যেতে পারে, তাই ম্যাপের সঙ্গে সঙ্গে সেটাও সরাতে হয়েছে তাকে। এবং সেই অ্যাঙ্গল থেকে দেখলে স্কুলে মিস্টার ঝিয়েনের কাছে আসা ফোনটা কিন্তু সত্যিই খুব ভাইটাল। কলটাকে ডিটেক্ট করার জন্য আমি কালই ভবানী ভবনে আই জি সাহেবকে জানিয়েছি। অনিশ্চয়বাবু কাল দুপুরের মধ্যেই আমায় ডিটেলটা দিয়ে দেবেন।

তবে যে মাসি তুমি কাল বললে ওই ফোন থেকে কিছু প্রমাণ হয় না?

সে তো হয়ই না। কিন্তু আর-পাঁচটা এভিডেন্সের সঙ্গে মিলিয়ে … ধর, যদি দেখা যায়, যে ফোন করেছিল সে ম্যাপটার মূল্য সম্পর্কে জানে … ম্যাপটা পেতে সে আগ্রহী … তা হলে কলটাকে এভিডেন্স হিসেবে তো ব্যবহার করাই যায়। অবশ্য তার চেয়েও আগে যা জরুরি সেটা হল, আমাদের বের করতে হবে কীভাবে হত্যাকাণ্ডটা হয়েছে। এবং স্বপনবাবু কিংবা বাকি তিনজন সাসপেক্টের পক্ষে ওইভাবে খুন করাটা আদৌ সম্ভব, কি না।

পাৰ্থ চোখ বড় বড় করে বলল, তার মানে তুমি বলতে চাইছ, ওই তিন অধ্যাপকের একজন মিস্টার ঝিয়েনকে মারতে পারেন?

হতেই পারে। বাসববাবু অত্যন্ত রুক্ষ, বদমেজাজি লোক, কিন্তু আবার দরকারমতো মাথা ঠান্ডাও করে ফেলেন। ভান করেন মিস্টার ঝিয়েনের মৃত্যুর ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, আবার মিস্টার ঝিয়েনকে সমাধি দেওয়ার দিন তিনি সেখানে উপস্থিত হন। অপরাধ প্রবণতাও আছে। বইয়ের পাতা কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। অর্থাৎ বেশ জটিল চরিত্র। তরুণবাবু খুবই ভদ্র সভ্য মানুষ। কিন্তু মিস্টার ঝিয়েনের ব্যাপারে তাকে কি একটু বেশি শীতল মনে হল না? ওই আপাত উদাসীনতাটা এক ধরনের অভিনয় নয় তো? শিবতোষবাবু আবার অতি অমায়িক। মিস্টার ঝিয়েনকে যথেষ্ট ভালবাসতেন বলেও মনে হল। কিন্তু দুজনের গবেষণার বিষয় প্রায় কাছাকাছি। অর্থাৎ চোরা রেষারেষি থাকলেও থাকতে পারে। অবশ্য তরুণবাবুও প্রায় একই সাবজেক্টের উপর কাজ করছেন …

টুপুর কথা কেড়ে নিয়ে বলল, বুঝেছি। তুমি সবাইকে সমান সন্দেহের চোখে দেখছ।

তাই তো নিয়ম রে। প্রমাণ ছাড়া সন্দেহের বাড়া-কমা হবে কী করে?

পার্থ গোমড়া মুখে বলল, তা অধ্যাপক মশাইদের কেউ একজন খুনটা করলেন কীভাবে?

আমি বলব? কুশল হাত তুলল, তিনজন প্রোফেসরই ম্যাপটার কথা জানতেন। আমাদের সে কথা বলেছেন। এঁদের মধ্যেই একজন ম্যাপটা বাগানোর জন্য প্রিন্সেপ ঘাটের সামনে আঙ্কল ঝিয়েনকে আসতে বলেন … তারপর গাড়ি নিয়ে গিয়ে …

এক সেকেন্ড। টুপুর কুশলকে থামাল, গাড়ি চাপা দেওয়ার আগেই কিন্তু আঙ্কল ঝিয়েনের মাথায় আঘাত করা হয়েছে রে।

সে আর কী এমন কঠিন কাজ। আঙ্কল ঝিয়েন যখন আহ্লাদে আটখানা হয়ে ম্যাপটা দেখাচ্ছেন, তখনই হয়তো ..

তবু একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে রে কুশল। আঙ্কল ঝিয়েনের তো ন্যাশনাল লাইব্রেরিতেই অধ্যাপক বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হত। হঠাৎ একটা শুনশান জায়গায় … অড রুটে দেখা করতে বললে আঙ্কলের তো খটকা লাগা উচিত।

গুড পয়েন্ট। ভেরি গুড পয়েন্ট, মিতিন তারিফ করল, একটা অদ্ভুত জায়গায় মিট করতে চাইলে মিস্টার ঝিয়েনের তো অবাক হওয়ারই কথা। অ্যাটলিস্ট টেলিফোনে কেন টেন ধরনের একটা প্রশ্ন তো তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে। অথচ মিসেস ইউয়ানের স্টেটমেন্ট বলছে, মিস্টার ঝিয়েন সেদিন খুব স্বাভাবিক স্বরেই অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করেছিলেন।

তা হলে?

ভাবতে হবে। মোডাস অপারেন্ডিটা ভাবতে হবে। নিজেকে খুনির জায়গায় প্লেস করে বুঝতে হবে আমি হলে এ ক্ষেত্রে কীভাবে এগোতাম।

বলেই তড়াং করে উঠে দাঁড়িয়েছে মিতিন। পাশের ঘরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে মোবাইলে। স্বর কানে আসে, তবে সংলাপগুলো শোনা যায় না ঠিকমতো। মিনিট দশেক পর ফিরল ড্রয়িংরুমে। নাইটি-হাউসকোট বদলে সালোয়ার-কামিজ পরে নিয়েছে, চুল টানটান করে বাঁধা।

টুপুর অবাক মুখে বলল, এ কী? তুমি এখন বেরোচ্ছ নাকি?

ঘড়ির চেন বাঁধতে বাঁধতে মিতিন বলল, হুঁ, একটু ঘুরে আসি।

কোথায় যাবে?

স্বপন দত্তর কাছে।

হঠাৎ?

দরকার আছে।

কিন্তু কিউরিও শপ তো আজ বন্ধ!

স্বপন দত্তর বাড়িতে যাব। ভবানীপুর। কথা বলে নিয়েছি।

চটি গলিয়ে, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল মিতিন। কুশল, টুপুর, পাৰ্থ, তিনজনেই হতভম্ব

কুশল ভ্যাবলা মুখে বলল, মাসি তো স্বপন দত্তকে ক্লিন চিট দিয়ে দিয়েছিল! হঠাৎ আবার তাকে …?

কে জানে কী মতলব! পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, তোমাদের মাসির থই পাওয়া মুশকিল।

.

.

১২.

মিতিন সন্ধেবেলা ফেরার পর কুশলের সঙ্গে বাড়ি চলে এল টুপুর। মিতিনই বলল, টুপুরের আর রাতে থাকার দরকার নেই, সে বরং কাল বাড়ি থেকেই স্কুলে যাক। স্বপন দত্তর বাড়ি কেন গিয়েছিল, সেখানে কী হল, তা-ও জানা হল না টুপুরের, এটা-ওটা বলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল মিতিন।

মাসির উপর খুব অভিমান হচ্ছিল টুপুরের। নয় নয় করে বেশ কয়েকটা কেসে সে মাসির পাশে পাশে থেকেছে, এখনও যেন তার উপর মাসির সেভাবে আস্থা জন্মাল না! অথচ মাসির থট প্রসেসটা জানতে পারলে টুপুর তো নিজের চিন্তাভাবনাকেও সেই খাতে বইয়ে দিতে পারে। তা ছাড়া ঝিয়েন আঙ্কলের কেস তো টুপুরের দৌলতেই পেয়েছে মিতিনমাসি, সে সুবাদেও তো টুপুরের জানার অধিকার আছে সব কিছু। নয় কি? কুশলের সামনে কি আলোচনা করতে চায় না? উঁহু। তা হলে তো রাতে টুপুরকে থেকে যেতেই বলত।

না, মিতিনমাসি এখনও টুপুরকে এলেবেলেই ভাবে। সে যে একাই তদন্তটা শুরু করেছিল, সেটাকে পর্যন্ত আমল দিল না!

টুপুরের অভিমানটা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হল না। সোমবার স্কুল থেকে ফিরতেই মিতিনের ফোন, তোকে একটা ইনফরমেশন দেওয়ার ছিল রে।

মন খারাপটা লুকোতে পারল না টুপুর। ভার গলায় বলল, আমি জেনে কী করব?

তবু শুনে রাখ। মিতিন নির্বিকার, মিস্টার ঝিয়েনের মোবাইলে ওই সময়ে আসা কলটাকে ট্রেস করা গিয়েছে।

ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে টুপুরের উদাসীনতা উধাও। মুখ থেকে উত্তেজনা ছিটকে এল, কে? কার ফোন?

তা জানা যায়নি। তবে নম্বরটা একটা পাবলিক বুথের।

অ্যাঁ?

অ্যাঁ নয়, অঁহ্যাঁ। আলিপুর চিড়িয়াখানার সামনের এক বুথ থেকে করা হয়েছিল।

ও। … তা হলে কী হবে?

 কী আর হবে। আমি তো এরকমটাই গেস করেছিলাম। ঘটে এটুকু বুদ্ধিও না-থাকলে তেমন ক্রিমিনালের সঙ্গে লড়ে মজা কোথায়।

এখন কী করবে?

মাছের চার বানাব।

মানে?

দেখতেই পাবি।

হেঁয়ালি করছ কেন? আমাকে কি কিছুই বলা যায় না?

আহা, চটিস কেন? শার্লক হোমস কি প্রতিটি খুঁটিনাটি ওয়াটসনকে বলতেন? নাকি তোদের ফেলুদা বলেছেন তোপসেকে? … শোন, একটু সাসপেন্স থাকা ভাল। লাস্ট রাউন্ডের চমকটা তা হলে পুরোপুরি এনজয় করা যায়।

এর পর আর টুপুরের কী বলার থাকে। অগত্যা ফোন নামিয়ে রাখতেই হয়। মনের উৎকণ্ঠাটুকু রেখে দিতে হয় মনেই। এবং একাএকা ড়ুবে থাকতে হয় ভাবনার অকুল পাথারে।

পরদিনটা নিরামিষ কাটল। মিতিনমাসির দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই। বিকেলবেলা কুশল এসে খোঁচাখুঁচি করল খানিকক্ষণ, কেঠো হাসি ছাড়া তাকে আর কিছুই উপহার দিতে পারল না টুপুর।

বুধবার সকালে সহসা বিস্ফোরণ। মেঘলা মেঘলা আকাশ, টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, দিব্যি আরাম করে ঘুমোচ্ছিল টুপুর। অবনী ঠেলে তুলেছেন তাকে। উত্তেজিত স্বরে বলছেন, অ্যাই টুপুর, ওঠ। দ্যাখ দ্যাখ, খবরের কাগজে কী বেরিয়েছে।

টুপুর ঘুম-জড়ানো গলায় বলল, কী?

তোদের সেই ম্যাপ নিয়ে এক বিশাল সমাচার।

প্রভাতী আলস্য পলকে খানখান। টুপুর ঝাঁপিয়ে পড়ল খবরটার উপর। প্রথম পাতার নীচের দিকে বড়সড় হেডিং–

অবশেষে চিনাদের ঘরে ফিরছে দুষ্প্রাপ্য চৈনিক ম্যাপ
বেকবাগানের গ্র্যান্ড কিউরিও শপের মালিক স্বপন দত্ত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এক দুষ্প্রাপ্য চিনা ম্যাপ আছে তাঁর সংগ্রহে। প্রায় সাতশো বছর আগে মো-ই-টং নামের এক চিনা শিল্পী নাকি এই মানচিত্রটি বানিয়েছিলেন। মানচিত্রটি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের অনেক আগেই চিনারা পা রেখেছিল আমেরিকার মাটিতে। স্বপন দত্তর এক পূর্বপুরুষ, প্রায় দুশো বছর আগে, জনৈক চিনার কাছ থেকে পেয়েছিলেন ম্যাপখানা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, সম্প্রতি ওই ম্যাপটির আদলে আঁকা একটি ওয়ালহ্যাঙ্গিং দোকানে টাঙিয়েছিলেন স্বপনবাবু, সেটিকেই আসল মানচিত্র ভেবে নিয়ে দশ হাজার টাকায় কিনে ফেলেন চিনা ইতিহাসবিদ ঝাও ঝিয়েন। কিন্তু ম্যাপখানি নিয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছতে পারেননি তিনি, তার আগেই প্রিন্সেপ ঘাটে এক আততায়ীর হাতে তিনি নিহত হন, এবং নকল মানচিত্রটিও খোওয়া যায়। পুলিশ তড়িঘড়ি গ্র্যান্ড কিউরিও শপের এক কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে বটে, তবে নকল মানচিত্রটি এখনও উদ্ধার হয়নি। এই ঘটনার পর থেকে স্বপন দত্ত গভীর মর্মপীড়ায় ভুগছিলেন এবং অবশেষে তিনি স্থির করেছেন মানচিত্ৰখানা তিনি নিহত ঝাও ঝিয়েনের পরিবারকে দিয়ে দেবেন। কোনও মূল্য ছাড়াই। চিনাঅষ্টম চান্দ্রমাসের প্রথম দিনে, অর্থাৎ পাঁচ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, বেলা বারোটায় মানচিত্রটির হাতবদল ঘটবে। বজবজের অদূরে, অছিপুরে চিনা অভিযাত্রী আৎসুর যে সমাধি আছে, সেখানেই ঝাও ঝিয়েনের দাদার হাতে পারিবারিক সম্পদটি তুলে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চান স্বপন দত্ত।

টুপুর নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলে কী স্বপন দত্ত? যে ম্যাপের জন্য ঝিয়েন আঙ্কলকে প্ৰাণ দিতে হল, সেটা আদৌ আসল নয়? মুখ দিয়ে বেরিয়েও গেল, স্বপন দত্ত তো মহা শয়তান। একটা দুনম্বরি ম্যাপ টাঙিয়ে রেখেছিল!

অবনী খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বললেন, দুনম্বরি বলছিস কেন? সে একটা ম্যাপের নকল শোয়ের জন্য সাজিয়ে রেখেছিল মাত্র। কেউ যদি সেটাকে মহামূল্যবান ভাবে, তাতে স্বপন দত্তর কী করার আছে?

তবু বলে দেওয়া উচিত ছিল। দিব্যি দশ হাজার টাকা গুনে নিল।

ওরে, আর্ট অ্যান্টিক কিউরিও, এসব লাইনে দশ হাজার কিসসু না। আর এই নকল জিনিস বেচা তো হরবখত হচ্ছে। নকল মোনালিসা কতবার বিক্রি হয়েছে, জানিস? … তাও তো তোদের ঝিয়েন আঙ্কলের মৃত্যুতে তার অনুতাপ-টনুতাপ হয়েছে, বিনা পয়সায় দিয়ে দিতে চায় জিনিসটা।

টুপুর একটুও সান্ত্বনা পেল না। গুম হয়ে বসে রইল একটুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁত ব্রাশ করে এসেই মিতিনমাসিকে ফোন।

আজকের খবরের কাগজ দেখেছ?

হুম।

কী সব বেরিয়েছে, অ্যা? ম্যাপটা নাকি আসল নয়?

তাই তো দেখছি।

একটা কথা সত্যি করে বলো তো মিতিনমাসি? তুমি কি ব্যাপারটা আগেই সন্দেহ করেছিলে? স্বপন দত্তকে তাই ভয় দেখাতে গিয়েছিলে সেদিন?

ধরে নে তাই।

 তা হলে এখন আমাদের মার্ডার কেসটার কী হবে?

সেটা যেমন চলছিল চলবে। … আমরা তো কালপ্রিটের দিকে গুটিগুটি পায়ে এগোচ্ছি। যাক গে, কাজের কথা শোন। শুক্রবার তোকে স্কুলে যেতে হবে না। কুশলকেও ড়ুব মারতে বল। আমরা সেদিন দল বেঁধে অছিপুর যাচ্ছি।

ওখানে তো শুধু ম্যাপ দেওয়া-নেওয়া?

 সেটাই তো একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। আমরা তার সাক্ষী থাকব।

লিয়াংকে সঙ্গে নেব না?

লিয়াং তো যাবেই। বাবা-মা-বোনের সঙ্গে। আমরা আমাদের মতো যাব। ওরা ওদের মতো। ঠিক সাড়ে নটায় তুই আর কুশল শেয়ালদায় চলে আয়। সাউথ সেকশনে। আমি ইলেকট্রনিক ঘড়ির নীচে ওয়েট করব।

টেলিফোন নামিয়ে রেখে একটুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল টুপুর। আশ্চর্য, মিতিনমাসি টের পেল কী করে, স্বপন দত্ত নকল ম্যাপ বেচেছে? মিতিনমাসির দাবড়ানির চোটেই কি লোকটা আসল ম্যাপ হাতছাড়া করতে রাজি হয়ে গেল? স্টেটমেন্ট পর্যন্ত দিয়ে দিল কাগজে? কী বলে ভয় দেখিয়েছে মিতিনমাসি?

উহুঁ, কেমন যেন ধন্দ লাগছে। জরুর ডালমে কুছ কালা হ্যায়।

.

শুক্রবার টুপুররা অছিপুর পৌঁছোল বেলা সাড়ে এগারোটায়। বজবজ স্টেশনে নেমে একখানা ভ্যানরিকশা ধরে বাসরাস্তা বরাবর অছিপুরের বড়বটতলা, সেখান থেকে গঙ্গার দিকে খানিকটা গিয়ে চিনেম্যানতলা। অছিপুরের এই তল্লাটে এখন আর একটা চিনা পরিবারও বাস করে না, তবে একসময় তাদের বসতি ছিল বলে নামটা রয়েই গিয়েছে। অবশ্য কালের বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে টিকে আছে। এক চিনামন্দির, আর আৎসুর সমাধি।

মন্দিরের প্রকাণ্ড ফটকটার সামনে এসে ভ্যানরিকশা দাঁড় করাল মিতিন। আশপাশের পরিবেশের মাঝে ফটকটা যেন একটু বেমানান, বোঝাই যায় সম্প্রতি তৈরি হয়েছে। তবে নির্মাণশৈলী চিনা ধাঁচের। গেটের মাথায় থাকথাক কাঠের কারুকাজ। গেটের দুদিকের পাঁচিলে বড় বড় দুখানা রঙিন চক্র আঁকা, বোধহয় চিনাদের কোনও বিশেষ প্রতীক।

রিকশাভাড়া মিটিয়ে মিতিন বলল, আয়, চট করে মন্দিরটা দেখে আসি।

কুশলের চোখ এদিক-ওদিক ঘুরছে। কপাল কুঁচকে বলল, কিন্তু বাকি লোকরা সব কোথায়? চারদিক তো একেবারে শুনশান।

যারা আসার তারা ঠিক এসে যাবে। এখনও তো বারোটা বাজেনি। আয় আয়, দাঁড়িয়ে থাকিস না।

মন্দিরটা দ্রষ্টব্যস্থান হিসেবে এমন কিছু আহামরি নয়। মূল গেট পেরিয়ে ভিতরে গেলে সবুজ গাছপালার মাঝে আর-একখানা পাঁচিল, নিতান্ত সাদামাটা চেহারার। পাঁচিলের গায়ে আবার একখানা ছোট্ট গেট। এতই ছোট যে, কুঁজো হয়ে ঢুকতে হয় মূল প্রাঙ্গণে। মন্দিরটাও বেশ ছোট। জুতো খুলে টুপুররা দেখে এল এক জোড়া চিনা দেবদেবীর মূর্তি আছে অন্দরে। মিতিন তাদের নামও বলে দিল। খুদা আর খুদি।

টুপুর বলল, চাইনিজদেরও এমন ঠাকুর-দেবতা আছে আমার ধারণা ছিল না। আমি ভাবতাম চাইনিজ মাত্ৰই হয় বৌদ্ধ, নয় খ্রিস্টান।

মিতিন হেসে বলল, ভুলে যাস না টুপুর, চিনারা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্য জাতি। এদের ইতিহাস প্রায় সাত হাজার বছরের পুরনো। বুদ্ধদেব জন্মেছেন মাত্র আড়াই হাজার বছর আগে। আর যিশুখ্রিস্ট তো সেদিনের লোক, এই তো সবে দুহাজার পেরোলেন। এদের আগেও তো চিনে দেবদেবী ছিল, পুজোআচ্চার চল ছিল। তাদের সবাই পরে বৌদ্ধ খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছে ধরে নিচ্ছিস কেন?

কুশল ফুট কাটল, চিনে তো মুসলমানও আছে।

অবশ্যই। ইনফ্যাক্ট, যে-চিনা অভিযাত্রী কলম্বাসের আগে আমেরিকায় গিয়েছিলেন, অ্যাডমিরাল জেং, তিনিই তো মুসলিম ছিলেন। তাঁর মূল নাম মা-সান-পাও।

টুপুরের চোখ প্রায় কপালে, তুমি জানলে কী করে?

তোর পার্থমেসোর ইনফরমেশন। সে-ও এখন তোর বাবার মতো ইন্টারনেটে চিনা ইতিহাস ঘাঁটছে।

কথার মাঝেই বাইরে একটা গাড়ির আওয়াজ। টুপুর উৎকর্ণ হয়ে বলল, ওই বোধহয় লিয়াংরা এসে গেল। নাকি স্বপন দত্ত?

গাড়ির শব্দ মন্দির অতিক্রম করে গঙ্গার দিকে যাচ্ছে। টুপুর আর কুশল দৌড়ে দেখতে যাচ্ছিল, মিতিন বলল, দাঁড়া, ছটফট করিস না। গেটের সামনে যাই চল।

বড় ফটকটা থেকে গঙ্গার দিকে তাকালে চোখে পড়ে এক অর্ধচন্দ্রাকৃতি কাঠামো। লালচে ইটের। তারই পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে গাড়িটা। বিদেশি গাড়ি, সাদা রঙের।

কুশল জিজ্ঞেস করল, গাড়িটা ওখানে গিয়ে দাঁড়াল কেন?

মিতিন বলল, ওটাই তো আৎসুর সমাধি।

টুপুর বলল, গাড়িটা চেনা চেনা লাগছে না?

মিতিন গম্ভীর স্বরে বলল, লোকটাকেও চেনা লাগবে। হুটোপাটি না করে আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে আয়।

দুপাশে ইটভাঁটি, মধ্যিখান দিয়ে রাস্তা। দুচার পা এগোতে নাএগোতে দেখা গেল গাড়ি থেকে নামছে একটা লোক। সোজা ঢুকে গেল সমাধিক্ষেত্রের ভিতরে। পরক্ষণে হনহনিয়ে বেরিয়ে এসে উঠে পড়ছে গাড়িতে।

টুপুর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আরে, এ তো …!

 চুপ। শব্দ করি না, শুধু দ্যাখ, কী হয়।

আৎসুর সমাধিকে পাক খেয়ে, গঙ্গার ধারের বিশাল বটগাছটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়িটা। ফিরছে। রীতিমতো স্পিড তুলে।

টুপুর-কুশলকে হতবাক করে দিয়ে মিতিন আচমকা এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। রাস্তার একদম মাঝখানে গিয়ে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

ঘ্যাঁচ করে ব্ৰেক কষল গাড়ি। ড্রাইভারের সিটে পরিচিত মুখ। অধ্যাপক তরুণ বসু।

তরুণবাবু জানলা দিয়ে মাথা বাড়ালেন। আমতা আমতা করে বললেন, কী ব্যাপার? আপনারাও এখানে?

গাড়ির বনেটে ভর দিয়ে দাঁড়াল মিতিন। বাঁকা সুরে বলল, যাক, সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে তা হলে! আমার ওপর দিয়ে অন্তত গাড়িটা চালিয়ে দেননি।

তরুণবাবুর সৌম্য মুখে অমায়িক হাসি, এ কী কথা! চাপা দেব কেন?

কারণ, চাপা দেওয়ার অভ্যেসটা যে আপনার আছে। মিস্টার ঝিয়েনের ডেডবডির উপর দিয়ে গাড়ি চালাতে তো আপনার হাত কাঁপেনি।

এসব কী বলছেন আপনি? তরুণবাবু দরজা খুলে নামলেন। হতভম্ব স্বরে বললেন, আপনার কথার মাথামুন্ডু তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

শেষ পর্যন্ত ফাঁদে পা দিয়ে ফেললেন তো প্রোফেসর সাহেব? মিতিনের ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি, কাগজ পড়ে মিস্টার ঝিয়েনের কাছ থেকে হাতানো ম্যাপটার উপর আস্থা রাখতে পারলেন না তো? যাচাই করতে চলে এলেন?

কী যা-তা বলছেন! তরুণবাবুর মুখ লাল হয়ে গিয়েছে, আপনারা এখানে যে কারণে এসেছেন, আমিও সেই কারণেই এসেছি। একটা হিস্টোরিক্যাল ঘটনার সাক্ষী হতে। নাথিং মোর, নাথিং লেস। ম্যাপ হাতানো-ফাতানো…এসব আবার কী ধরনের অ্যালিগেশন?

কিছুই বুঝতে পারছেন না, তাই তো? তরতর পায়ে এগিয়ে গিয়ে গাড়ির দরজা আটকে দাঁড়াল মিতিন। হাত উলটে বলল, বেশ, থানায় চলুন তা হলে। ওখানে অভিযোগটার ফয়সালা হয়ে যাক।

ইউ আর গোয়িং টুউ ফার, তরুণবাবু গরগর করে উঠলেন, জানেন, আপনি কার সঙ্গে কথা বলছেন?

ভাল মতোই জানি, মিতিনের স্বরও রুক্ষ হল, একজন জঘন্য খুনির সঙ্গে। নিজেকে আরও বিখ্যাত করার জন্য মিস্টার ঝিয়েনের মতো সরল আলাভোলা বন্ধুকে যিনি অনায়াসে হত্যা করতে পারেন।

আআআমি খুন করেছি?

রেকর্ড তো তাই বলছে।

কীসের রেকর্ড?

আপনার কর্মকাণ্ডের। ওই দিন সাড়ে চারটের সময় আপনার গাড়ি এসে দাঁড়াল ন্যাশনাল লাইব্রেরির গেটে। আপনার অনুরোধে ম্যাপটা আপনাকে দেখানোর জন্য সেখানে তখন অপেক্ষা করছিলেন মিস্টার ঝিয়েন। তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আপনি সোজা চলে এলেন প্রিন্সেপ ঘাটে। গঙ্গার ধারে বসে ভাল করে দেখলেন ম্যাপটা। তারপর কথাবার্তা বলে বুঝে নিতে চাইলেন টাকার বিনিময়ে মিস্টার ঝিয়েন আপনাকে ম্যাপটি দেবেন, কি দেবেন না। যখন দেখলেন, মিস্টার ঝিয়েন কোনও প্রলোভনেই রাজি হবেন না, তখন আপনি চরম পন্থাটি বেছে নিলেন।

তরুণবাবু বিদ্রুপের স্বরে বললেন, কী রকম? লোহার রড মেরে ঝিয়েনের মাথা দুফাঁক করে দিয়ে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে এনে রাস্তায় ফেলে দিলাম? তারপর গাড়ির চাকায় তাকে পিষে দিলাম? এবং গঙ্গার ধারের কোনও জনপ্ৰাণীর সেটি চোখে পড়ল না? তাই তো? সরি। গল্পটা কিন্তু আপনার জমছে না।

না-জমাটাই তো স্বাভাবিক, মিতিন মৃদু হাসল, কারণ, ওই পদ্ধতিতে মার্ডার করে তো মোটা বুদ্ধির ক্রিমিনালরা। আপনার মোডাস অপারেন্ডিটা একটু সূক্ষ্ম।

কী রকম?

আপনি হাসিমুখেই ফিরলেন গাড়িতে। মিস্টার ঝিয়েনকে পাশে বসালেন। কিন্তু গাড়ি কিছুতেই স্টার্ট হল না। নেমে বনেট খুলে গাড়ির ইঞ্জিন পরীক্ষা করতে লাগলেন। মিস্টার ঝিয়েনকেও ডাকলেন পাশে। অথবা কৌতূহলবশতও মিস্টার ঝিয়েন নিজেও নেমে এসে থাকতে পারেন। আপনি মিস্টার ঝিয়েনকে বললেন, ঝুঁকে ইঞ্জিনের ভেতরের কিছু একটা দেখার জন্যে। মিস্টার ঝিয়েন নিচু হওয়ামাত্র গাড়ির টুলবক্সের স্প্যানার দিয়ে মিস্টার ঝিয়েনের মাথার পিছনে মোক্ষম আঘাত। চলন্ত গাড়ি বা দূরের কোনও পথচারীর সন্দেহ করার কোনও সুযোগই নেই এখানে। তার উপর তখন সন্ধে নেমেছে। মিস্টার ঝিয়েন মারা গেছেন কিনা নিশ্চিত হতে না পেরে দ্রুত তাঁর উপর দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অবশ্যই ম্যাপ আর মোবাইল তার আগেই আপনার কবজায় এসে গিয়েছে। ..এ গল্পটা জমছে কি?

ফালতু স্টোরি শোনার আমার সময় নেই। তরুণবাবুর স্বরে বিরক্তি ঝরে পড়ল, যত্ত সব আষাঢ়ে কল্পনা! আমার সঙ্গে ঝিয়েনের সেদিন দেখাই হয়নি।… সরুন, যেতে দিন।

দাঁড়ান। মিতিনের গলা অস্বাভাবিক রকমের কঠিন, আপনি যে সেদিন দুপুর দেড়টায় মিস্টার ঝিয়েনকে কল করেছিলেন, সেটা কিন্তু ডিটেক্ট করা গিয়েছে।

বাজে কথা। আমি ঝিয়েনকে সেদিন ফোনই করিনি।

আপনার মোবাইল থেকে আপনি ফোনটা করেননি। বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকেও না। মিতিনের ঠোঁটে ফের এক টুকরো হাসি, ফোনটা আপনি করেছিলেন চিড়িয়াখানার সামনের এক এসটিডি, আইএসডি বুথ থেকে।

মিথ্যে। মিথ্যে কথা।

মিথ্যে কি সত্যি সেটা বুথের ছেলেটাই বলবে। সে কিন্তু আপনার চেহারার বর্ণনা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে।

হতেই পারে না। বুথে তখন কোনও ছেলে ছিলই না। শুধু একজন মহিলা …

বেফাঁস কথাটা ঠিকরে বেরোতেই তরুণবাবুর বাকরোধ সহসা। মুখ পলকে ফ্যাকাশে। ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছেন।

মিতিন দুপা এগিয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, সো? … ফোনটা তা হলে করেছিলেন?

তরুণবাবুর ঘাড় আস্তে আস্তে নুয়ে পড়ল। মুখ তুলছেন না আর। বিড়বিড় করে বললেন, বিশ্বাস করুন, আমি ঝিয়েনকে অনেক টাকা অফার করেছিলাম। এমন গোঁয়ারতুমি করছিল, ঝপ করে মাথাটা গরম হয়ে গেল।

ম্যাপটা পেলে লাভ কী হত আপনার?

ওটা যে কত বড় আবিষ্কার। ইতিহাসের পাতায় আমার নাম লেখা থাকত।

শুধু নিজের নামের জন্য মিস্টার ঝিয়েনের মতো একজন ভালমানুষকে …? আপনি তো কিউরিও শপেও গিয়েছিলেন। দোকানের মালিককেই টাকাটা অফার করতে পারতেন।

তরুণবাবু চমকে চোখ তুলে তাকালেন। পরক্ষণেই নামিয়ে নিয়েছেন মাথা। নিস্তেজ গলায় বললেন, চিনা ভাষা তো পড়তে পারি না। ওটাই যে মো-ই-টংয়ের ম্যাপ, নিশ্চিত হব কী করে? বলতে বলতে পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। দুহাতে মুখ ঢেকে ভেঙে পড়লেন কান্নায়, অন্যায় হয়ে গিয়েছে। ঘোরতর অন্যায় করেছি। আমার পাপের কোনও ক্ষমা নেই।

দু-এক সেকেন্ড তাঁকে দেখে নিয়ে পায়ে পায়ে ইটভাঁটার দিকটায় গেল মিতিন। চেঁচিয়ে ডাকল, ওসি সাহেব, এবারে আসুন।

জনাপাঁচেক বন্দুকধারী পুলিশ বেরিয়ে এল ইটভাঁটার পিছন থেকে। মিতিনের ইশারায় ঘিরে ফেলেছে তরুণ বসুকে।

কুশলের চোখ ছানাবড়া। টুপুরও তথৈবচ।

.

১৩.

একটা প্রশ্ন করব, মিতিনমাসি?

একটা কেন, যটা খুশি কর।

তুমি গেস করলে কী করে তরুণবাবুর সঙ্গে ঝিয়েন আঙ্কলের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ন্যাশনাল লাইব্রেরির সামনেই হয়েছিল?

জলের মতো সোজা। ন্যাশনাল লাইব্রেরিই ছিল ওঁদের ইউজুয়াল মিটিং প্লেস। হঠাৎ অন্য কোথাও যেতে বললে মিস্টার ঝিয়েনের মনে সন্দেহ জাগত না?

কিন্তু … শুধু তরুণবাবুর স্বীকারোক্তিই তো সম্বল। পরে তরুণবাবু ডিনাইও তো করতে পারেন। খুনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ কোথায়?

সেটা জোগাড় করা কিছু এমন কঠিন নয়। প্রথমত, পুলিশ ওঁর বাড়ি থেকে ম্যাপটা পেয়ে গিয়েছে। আর জেরার মুখে মার্ডার ওয়েপনের সন্ধানও উনি দিয়ে দেবেন। আরে বাবা, যতই যা হোক, ভদ্রলোক হার্ডকোর ক্রিমিনাল তো নন, বেশি চাপ সহ্য করতে পারবেন না।

তা বটে। টুপুর মাথা দোলাল। মুচকি হেসে বলল, তবে যা-ই বলো, ফাঁদটা কিন্তু তুমি জব্বর পেতেছিলে!

অবনী ইজিচেয়ারে। চোখ কুঁচকে শুনছিলেন মাসি-বোনঝির সংলাপ। পুট করে লঘু মন্তব্য ছুঁড়লেন, জব্বর কী রে! বল, নাটকীয়। যবনিকা পতনের আগে চরম ক্লাইম্যাক্স।

এ ছাড়া যে আর উপায় ছিল না, অবনীদা। আমার তিন সাসপেক্টই অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁদের কারও সঙ্গেই এমন কিছু আচরণ করা সম্ভব ছিল না, যাতে তারা ক্ষুন্ন হন। অথচ আমাকে বেড়ালটাও ধরতে হবে। … তবে হ্যাঁ, কেসটা নিয়ে দুচার পা এগিয়েই টের পেলাম, সন্দেহটা এক জায়গায় ঘনীভূত হচ্ছে। তিনজনের মধ্যে একমাত্র তরুণবাবুই সেদিন দুপুর থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ছিলেন … যে বুথ থেকে ফোন করা হয়েছে, সেটাও ন্যাশনাল লাইব্রেরির খুবই কাছে … সুতরাং তরুণবাবুরই কল করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি .. মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকেও ইনফরমেশন পাচ্ছি, সেদিন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তরুণবাবু মোবাইল থেকে মিস্টার ঝিয়েনকে অন্তত তিনটে কল করেছিলেন … মিস্টার ঝিয়েনের শেষ আউটগোয়িং কলও তরুণবাবুর নাম্বারে … কিন্তু এসবই তো ক্লু, খুনের প্রমাণ নয়। হাজারটা খরগোশ জোড়া লাগিয়ে তো একটা ঘোড়া বানানো যায় না। অতএব ছলচাতুরি ছাড়া আর পন্থা কী?

পার্থ আর কুশল একমনে শিঙাড়া খাচ্ছিল। সহেলির হাতে বানানো। একটা গরম শিঙাড়ার কোণ ভাঙতে ভাঙতে পার্থ বলল, আর তাই স্বপন দত্তকে পটিয়েপাটিয়ে একটা আজগুবি গপ্পো বানিয়ে ফেললে এবং অনিশ্চয়বাবুকে জপিয়েজাপিয়ে সেটা খবরের কাগজে ছাপানোর বন্দোবস্তও হয়ে গেল।

সত্যি, আই জি সাহেব এই কেসটায় কিন্তু দারুণ সাহায্য করলেন। আমার প্ল্যান মাফিক মন্টুকে অ্যারেস্ট করা থেকে শুরু করে …

ও। কুশল লাফিয়ে উঠল, মন্টুকে গ্রেপ্তার করানোটা তবে তোমার চাল?

ইয়েস মাই ডিয়ার ইয়ংম্যান। কারণ তখনও তো আমি বুঝতে পারছি না খুনি কতটা ডেঞ্জারাস। মন্টু যে লোকটাকে দেখেছিল, সেই লোকটাই যদি আল্টিমেটলি খুনি হয়, তবে সে তো হবে খুব মূল্যবান সাক্ষী। অতএব খুনি তাকে টার্গেট করতেই পারে। তাই মন্টুর সিকিওরিটির কথা ভেবেই .. ইনফ্যাক্ট, নিরাপত্তার ব্যাপারটা আমি আগাগোড়াই মাথায় রেখেছি। যার জন্য স্বপন দত্ত বা লিয়াংদের আমি চিনেম্যানতলায় যেতে দিইনি।

তবু মন্টু বেচারাকে মিছিমিছি হাজতবাস করতে হল তো।

 দুর, পরদিনই তো ওকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মন্টু এখন মেদিনীপুরের গ্রামে, নিজের দেশে। খবর না-পাওয়া পর্যন্ত ওর কলকাতামুখো হওয়া মানা আছে।

সহেলি আরও এক প্লেট শিঙাড়া নিয়ে ঢুকেছেন ঘরে। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, হ্যারে, লিয়াংয়ের বাবা ম্যাপখানা শেষ পর্যন্ত হাতে পেলেন?

পেয়ে যাবেন। পুলিশ আর কোর্টের কিছু ফরম্যালিটি আছে, হয়ে গেলেই ওঁর জিন্মায় দিয়ে দেওয়া হবে।

আহা, ওঁদের মুন ফেস্টিভ্যালের আগে পেয়ে গেলে খুব ভাল হয়। লিয়াংয়ের কাকার ইচ্ছেটা পূরণ হয় তা হলে।

দেখা যাক। মিতিন শিঙাড়ায় কামড় দিল, তবে লিয়াংয়ের বাবা একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ম্যাপটা উনি নিজের কাছে রাখবেন না। কেসের ঝামেলা মিটলেই ম্যাপখানা উনি চিনা দূতাবাসে দিয়ে দেবেন।

খুব ভাল ডিসিশন। অবনী সোজা হলেন, ওই ম্যাপ তো চিনের জাতীয় সম্পত্তি। চিনের কোনও সংগ্রহশালাই ওর উপযুক্ত স্থান।

পার্থ বলল, ভাবতে খুব আশ্চর্য লাগে, তাই না? ওরকম একটা ইম্পৰ্ট্যান্ট জিনিস বজবজের কোন এক দত্ত পরিবারে দুশো বছর ধরে অবহেলায় পড়ে ছিল।

অবাক কাণ্ড তো বটেই। সেই কবে ফিফটিন্থ সেঞ্চুরির গোড়ায় অ্যাডমিরাল জেং রাজার হুকুমে নৌকোটৌকো সাজিয়ে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন … নৌকোয় বসে শিল্পী মো-ই-টং আঁকলেন পৃথিবীর ম্যাপখানা … রাজরোষে পড়ে সেই ম্যাপ চলে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে … তারপর ঘুরপাক খেতে খেতে, ঘুরপাক খেতে খেতে, প্রায় চারশো বছর পর ম্যাপ চলে এল আমাদের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বজবজে … সেখান থেকে এক বাঙালিবাবুর হাতে ..

পার্থ বলল, ভাগ্যিস বাঙালিবাবুটির বংশধর ওয়ালহ্যাঙ্গিং ভেবে ম্যাপটাকে দোকানে ঝুলিয়েছিল! জঞ্জাল মনে করে ফেলে দেয়নি। এবার ওই ম্যাপের দৌলতে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মিথের যে কী দশা হবে!

যাক গে যাক, আমেরিকা আবিষ্কার নিয়ে পণ্ডিতরা যত পারেন চুল ছিঁড়ুন এখন। মিতিন আর-একখানা শিঙাড়া তুলে নিল, মিস্টার ঝিয়েনের কেসটা থেকে আমার কিন্তু বেশ লাভ হল।

মোটা টাকা পেলি বুঝি? সহেলির প্রশ্ন ধেয়ে এল, কত রে?

টাকা নয়, দিদি। জ্ঞানভাণ্ডারটা বাড়ল। চিনাদের সম্পর্কে আরও কত কিছু জানলাম।

কী জানলে? পার্থর চোখ সরু, বলো তো, চিনাদের এখন কোন বছর চলছে?

ভেরি এলিমেন্টারি কোয়েশ্চেন। এটা কুকুরের বছর। গত বছরটা ছিল মোরগের। তার আগেরটা বাঁদরের। এ ছাড়াও আছে ইদুর, ষাঁড়, সাপ, বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, ভেড়া, শুয়োর, ঘোড়া। মোট বারোটা জন্তুর নামে বারোটা বছর। চাইনিজ ক্যালেন্ডারে বারো বছর পর পর সেম জস্তুর টার্ন আসে। কী ঠিক বলছি তো?

মিতিনের তুরন্ত জবাবে পার্থ থতমত। আমতা আমতা করে বলল, জানো তা হলে? বলো দেখি, ড্রাগন বোট উৎসব কবে হয়?

চিনাদের পঞ্চম চান্দ্রমাসের পঞ্চম দিনে।

আর লণ্ঠন উৎসব?

প্রথম চান্দ্রমাসের পূর্ণিমার দিন। মিতিন মিটিমিটি হাসছে, ইন্টারনেট ঘেঁটে খুব চিনবিশারদ হয়েছ দেখছি! এবার তুমি বলো তো, চিনারা কেন মৃতদেহ সমাধি দিতে যাওয়ার সময় চটের পোশাক পরে?

কেন বলো তো?

বিয়ের কনে কেন সাত রঙের সাতটা ফিতে গরম জলে ড়ুবিয়ে স্নান করে?

করে বুঝি?

স্নান সেরে বিয়ের কনে কেনই বা পান্তাভাত আর হাফবয়েল ডিম খায়?

খায়? সত্যি?

 কেন ড্রাগন উৎসবের দিন বাঁশপাতার বালিশের মধ্যে চাল-ডাল সেদ্ধ করে নদীতে ভাসিয়ে দেয় চিনারা?

জানি না তো!

আমিও জানি না। অথচ জানা আমাদের উচিত ছিল। কলকাতায় এত চাইনিজদের বাস … দু-চার দিনের নয়, সেই ওয়ারেন হেস্টিংসের আমল থেকে … অথচ তাদের সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের ইন্টারনেট ঘাঁটতে হয়।

অবনী বললেন, সত্যি, আমরা বাঙালিরা বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক। আমাদের মনের জানলাটা আরও খোলা দরকার।

মাসি-মেসো আর বাবা বকবকম করেই চলেছেন। সহেলি ফুট কাটছেন মাঝে মাঝে। কুশলও কথা বলছে টুকটাক। একমাত্র টুপুরই যা আনমনা। তার মন চলে গিয়েছে এই শহর পেরিয়ে অনেক অনেক দূরে। গাঢ় নীল মহাসাগরের বুকে। দুপাশে ঢেউ তুলে সমুদ্র ভেঙে তরতর এগিয়ে চলেছে সারসার নৌকো। প্রকাণ্ড নৌকোর পাটাতনে দাঁড়িয়ে আছেন এক চৈনিক যোদ্ধা। তাঁর মাথায় শিরস্ত্রাণ, বুকে বর্ম, কোমরে তলোয়ার। দূরের দিকে স্থির তাকিয়ে আছেন সেই যোদ্ধা। পাশে এক মগ্ন শিল্পী। তুলোট কাগজে ছবি আঁকছেন পৃথিবীর। ওই শিল্পী কি জানতেন, প্ৰায় দুশো বছর পর ওই ম্যাপখানার জন্য প্রাণ দিতে হবে এক গবেষককে?

আঙ্কল ঝিয়েনকে দেখেনি টুপুর। তবু তাঁর জন্য হঠাৎই খুব কষ্ট হচ্ছিল টুপুরের। কান্না পাচ্ছিল। কেন যে বেচারা ম্যাপটার কথা বন্ধুদের বলতে গেলেন। কোনও মানে হয়? কোনও মানে হয়?

সবার অলক্ষে চোখের কোলটা মুছে নিল টুপুর।