১১. রবিন আর তোবারকের অভিযান
পরদিন সকালে বেরোবার আগে রবিন আর তোবারককে এমনভাবে সাজগোজ করতে হলো যেন চট করে ওদের চেনা না যায়। তোবারকের জামা কাপড় সব ওর বাড়িতে, রবিনের পোষাকই পরতে হলো ওকে। রবিন ইটালিয়ান স্যুট পরলো, তোবারক ব্লু জিনস-এর প্যান্টের সঙ্গে পরলো হালকা বাদামী রঙের মোটা পুলওভার। রবিনের বাবা গত বছর প্যারিস থেকে এনেছিলেন ওটা। প্যান্টের সঙ্গে ম্যাচ করা টুপি আর মাফলার পরলো। দুজনকে দেখে মনে হচ্ছিলো গ্রীক অথবা ইটালিয়ান টুরিস্ট।
বাসে করেই ওরা বয়ানা এলো। আকাশ মেঘলা থাকলেও বাতাস তেমন ছিলো না। সারাটা পথ রবিনকে মনে হচ্ছিলো একজন বিদেশী টুরিস্ট আর তোবারক ওর বুলগেরিয়ান গাইড–কথা বলছিলো ইংরেজিতে। সোফিয়ায় টুরিস্ট সিজন তখনো শেষ হয় নি। বাসে আরও কয়েকজন টুরিস্ট দেখতে পেলো ওরা, যাদের সঙ্গে ওদের মত বুলগেরিয়ান দোভাষী আর গাইড ছিলো।
নীল যাওয়ার সময় তোবারককে আন্তনের রেস্টুরেন্টের কথা বলে গিয়েছিলো। জাদুঘরের পাশে একটাই রেস্টুরেন্ট, খুঁজতে ওদের সময় লাগলো না। তবে হতাশ হলো ওরা, যখন শুনলো আন্তন নেই। কখন আসবে কাউন্টারের লোকটা কিছুই বলতে পারলো না। মন খারাপ করে যখন ওরা বেরিয়ে আসবে তখন ভেতর থেকে আন্তনের কথা কে জিজ্ঞেস করে? বলতে বলতে একজন মাঝবয়সী মোটাসোটা মহিলা বেরিয়ে এলেন।
তোবারক এগিয়ে গিয়ে বললো, রিস্টোর বন্ধু নীলের ভাই আমরা। ওদের খোঁজে এসেছি।
উত্তেজিত গলায় মহিলা বললেন, আরে সে কথা বলবে তো! আন্তন তো একটু আগে রিস্টোর মামা বাড়িতেই গেলো। কী নাকি চিঠি পাঠিয়েছে রিস্টো, এক ছোকরা এসে আন্তনকে ডেকে নিয়ে গেছে।
বাড়িটা কোথায় মাদাম, দয়া করে বলবেন কি? জানতে চাইলে তোবারক।
এক মিনিট বাছা। গলা তুলে মহিলা ডাকলেন, কালিন, এদিকে একটু শুনে যা তো!
বারো তেরো বছরের চটপটে একটা ছেলে হাত মুছতে মুছতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। মহিলা বললেন, তোর আন্তন খুড়ো গেছে রিস্টোর মামা বাড়ি। এদের ওখানে পৌঁছে দিয়ে আয়।
চলুন যাই। এই বলে হাসিমুখে ছেলেটা ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো! পথে যেতে মোড়ের কাছে কয়েকজন লোকের জটলা দেখতে পেলো ওরা। জেরার ভঙ্গিতে একজন জানতে চাইলো–তোর সঙ্গে ওরা কারা যাচ্ছে কালিন?
কালিন জবাব দিলো–আন্তন খুড়োর অতিথি।
আরো এক জায়গায় কালিনকে কথা বলতে হলো।
তোবারক জানতে চাইলো এদিকে চোর ডাকাতের উৎপাত বেশি নাকি! অচেনা লোক দেখলেই জিজ্ঞেস করছে?
কালিন বললো, দু দিন আগে পুলিশ এসে ঘেরাও দিয়ে রিস্টো আর ওর বন্ধুকে ধরে নিয়ে গেলো না! গ্রামের সবাই ঠিক করেছে পুলিশ, মিলিশিয়া যেই গ্রামে ঢুকুক, পিটিয়ে ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে।
কালিনের কথাগুলো রবিনকে তর্জমা করে শোনালে তোবারক। গ্রামের মানুষের এই সচেতনতা ভালো লাগলো রবিনের। ভাবলো, কবে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ এভাবে রুখে দাঁড়াবে!
বন্ধ দরজায় কড়া নাড়তে বুড়ো আন্তন এসে দরজা খুললেন। কালিন বললো, আন্তন খুড়ো, এরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
ভেতরে আসুন। বলে ওদের নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন আন্তন।
তোবারক বললো, আমরা নীলের ভাই। জানতে এসেছি কিভাবে ও ধরা পড়লো।
ভালো হয়েছে আপনারা এসেছেন। উত্তেজিত গলায় আন্তন বললেন, নইলে আজই আমি নীলের বাবার সঙ্গে দেখা করতাম। জানেন একটু আগে ইতিমান থেকে এক স্কুল মাস্টার এসেছিলো। রিস্টোর লেখা একটা চিরকুট কুড়িয়ে পেয়েছে ও। ভেতরে চলুন, দেখাচ্ছি।
সিটিযেন কমিটির ইশতেহারের উল্টো দিকে লেখা রিস্টোর ছোট চিঠি পড়ে হতভম্ব হয়ে গেলে তোবারক। রবিনকে বললো ওতে কী লেখা আছে।
চাপা উত্তেজিত গলায় রবিন জানতে চাইলো, ঠিক কোন জায়গায় পাওয়া গেছে এটা?
মাস্টার বললো ইতিমান স্কুলের পাঁচিলের গায়ে। হাইওয়ের ওপর পড়েছে স্কুলটা। ভদিভ হয়ে রাস্তাটা ইস্তাম্বুল চলে গেছে।
পুভদিভ আর ইতিমানের মাঝামাঝি আর কোন লোকালয় আছে এ রাস্তার ওপর?
ছোট একটা লোকালয় আছে লেসতাহান-এ।
এখন থেকে ইতিমান কত দূর?
একশ কিলোমিটারের মত হবে।
সেখান থেকে পুভদিভ কতদূর?
তা ধরুন আরো চল্লিশ কিলোমিটার।
রবিনের দোভাষী হয়ে কাজ করছিলো তোবারক। এবার ও নিজে বললো, মনে হয় হাইওয়েতে খুঁজলে এ রকম আরো চিঠি পাওয়া যাবে।
আন্তন বললেন, মাস্টার এটা দিয়ে চলে গেছে। ওদের স্কুলের ছেলে মেয়েদের বলবে এরকম ভাঁজ করা ইশতেহার আরো পায় কিনা খুঁজে দেখতে। পেলে আমাদের জানাবে।
শুধু ওরা খুঁজবে কেন? আমরাও তো খুঁজতে পারি।
নিশ্চয়ই পারি।
এক কাজ করা যাক। আমরা একটা গাড়ি নিয়ে ফিরে আসছি। আন্তন খুড়ো আমাদের সঙ্গে যাবেন?
কেন যাবো না বাছা! খুড়ো বলে ডেকেছো তার ওপর আমাদের রিস্টোর বন্ধুর ভাই। একবার কেন দরকার হলে একশবার যাবো।
ঠিক আছে, এগারোটার মধ্যে আমরা আসবো। কথা না বাড়িয়ে তোবারক রবিনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলো শহরের দিকে।
বাসে যেতে যেতে রবিন বললো, এম্ব্যাসির গাড়ি দেখলে পেছনে গোয়েন্দা লাগবে না?
না, আমরা সিডি কার নিব না। কাউন্সিলার সাহেবের গাড়ি অর্ডিনারি নম্বরের। ওই গড়িতে আমরা প্লভদিভ পইর্যন্ত যাব।
আকাশের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। স্লেটের মত কালো ঘেঁড়া মেঘ ইতস্তত ভাসছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছে। রাস্তার দুপাশে বার্চ আর লিন্ডেন গাছগুলো প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেছে। বাসে যাত্রী কম ছিলো। রাস্তা ফাঁকা দেখে ড্রাইভার স্বাভাবিক গতির চেয়ে অনেক বেশি জোরে চালাচ্ছিলো। বয়ানা থেকে একষট্টি নম্বর বাস মিহালভ স্ট্রিটের এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্টপেজ পর্যন্ত যায়। ওখানে নেমে একটা ট্যাক্সি নিলো রবিনরা। রাকৌস্কি স্ট্রিটে দূতাবাসে আসতে সব মিলিয়ে ওদের পঞ্চাশ মিনিট সময় লাগলো।
দূতাবাসে গত সাত বছরের চাকরি জীবনে তোবারক প্রথমবার একটা নিয়ম ভাঙলো। রবিনকে নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সেক্রেটারির কাছে না গিয়ে সোজা তার ঘরে চলে গেলো।
নীলের বাবা মন খারাপ করে একা বসেছিলেন। রবিন বললো, চাচা, নীলদের একটা খবর পাওয়া গেছে।
তোবারক রিস্টোর লেখা চিঠি পড়ে শোনালো। নীলের বাবা আপন মনে বললেন, রিস্টো লিখেছে ওদের মিলিশিয়া ধরেছে।
রবিন বললো, রিস্টোও পোষাক দেখে ভুল করতে পারে। যেই ধরুক, আমি আর তোবারক এখনই কাউন্সিলার সাহেবের গাড়ি নিয়ে পুভদিভ যেতে চাই।
তোবারক বললো, বুড়া আন্তনও সঙ্গে যাইবে।
কেন পুভদিভ যাবে, আন্তন কে কিছুই জানতে চাইলেন না নীলের বাবা। ইন্টারকমে কাউন্সিলারের গাড়িটা ধার চাইলেন সারাদিনের জন্য। তারপর তোবারককে শুধু বললেন, গাড়ি নিয়ে যাও। রবিনের সব ভার তোমার।
আল্লা ভরসা, আপনি ঘাবড়াইবেন না স্যার। এই বলে তোবারক রবিনের হাত ধরে রাষ্ট্রদূতের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
সেক্রেটারি ইলিনা ওদের দেখতে পেয়ে তোবারককে ডেকে বুলগেরিয়ান ভাষায় কী যেন বললো। তোবারক ওর কথার জবাব না দিয়ে একবারে দুই তিন সিঁড়ি টপকে নিচে নামলো। কাউন্সিলারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে মুহূর্তের ভেতর বেরিয়ে এলো দূতাবাস থেকে।
শহরের ভেতর তোবারক একটু আস্তে চালিয়েছিলো গাড়ি। শহর থেকে বেরিয়ে সত্তর মাইল স্পীড তুললো। মাঝে মাঝে রাস্তা ভেজা না থাকলে আরও স্পীড তুলতে পারতো।
রবিন জিজ্ঞেস করলো, এম্বাসির ঐ মহিলা তখন তোমাকে কী বলছিলো তোবারক?
কে ইলিনা? জিজ্ঞাসা করছিলো নীলের কোনো খবর ফাওয়া গেছে কিনা। এই বেটি দেখতে সোন্দর হইলে কী হইবে, মতলব ভালো না।
কেন কি করেছে?
নানা উল্টাফাল্টা কথা কয়! বড় অসভ্য বেটি। আমি কই, তোর এত জানার কী দরকার, স্যারের বাসায় কখন কে আসে এসব খবরের?
তোমাকে বুঝি এসব জিজ্ঞেস করে?
আর কারে জিজ্ঞাসা কইরবো? ফাঁইছে তো এক আমারে।
তুমি চাচাকে বলে নি এসব?
নীল বাইরে কইছি। এতদিন কাউরে কিছু বলি নাই। ভাবতেছি স্যাররেও বলা দরকার।
তোবারক যে স্পীডে গাড়ি চালিয়েছে তাতে ওরা আধ ঘন্টার ভেতর বয়ানা পৌঁছে গেলো। আন্তন আন্তনভ এগিয়ে এসে বাস স্টপেজে দাঁড়িয়েছিলেন। তোবারক খেয়াল করে নি। রবিন ওঁর হাত নাড়ানো দেখে তোবারককে বললো, গাড়ি থামাও, আন্তন খুড়ো বাস স্টপেজে অপেক্ষা করছেন।
তোবারক গাড়ি থামাতেই ছুটে এলেন আন্তন–তাড়াতাড়ি এসে গেছে দেখছি। একটু আগে আর্মির একটা কনভয় যেতে দেখলাম পুভদিভের রাস্তায়।
রবিন পেছনের দরজা খুলে দিতেই আন্তন উঠে বসলেন। তোবারক আন্তনকে বললো, যদিও দুদিন হয়ে গেছে, আমরা একটা ভাঁজ করা ইশতেহার খুঁজবো রাস্তার দুপাশে। ঝোঁপের ভেতর, ঘসের ভেতর কিম্বা ড্রেনের ভেতর, যে কোন জায়গা পড়ে থাকতে পারে। রবিনকেও ওর নিজস্ব বাংলায় এ কথাগুলো বললো।
সামনে সতর্ক চোখ রেখে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে লাগলো তোবারক। রবিন আর আন্তন দুপাশের জানালা দিয়ে খুঁজতে লাগলো রিস্টোর ইশতেহার। নেহাৎ হাইওয়ে বলে এমন দৃশ্য কারো চোখে পড়লো না। কচ্ছপের মত আস্তে আস্তে চলছে গাড়ি, দু পাশের জানালা দিয়ে কচ্ছপের মত মাথা বের করে রেখেছে দুজন–এমন দৃশ্য লোকালয়ে দেখা গেলে ভিড় জমে যেতো।
রাস্তায় রিস্টোর লেখাওয়ালা দ্বিতীয় ইশতেহারটা পেতে ওদের ছত্রিশ মিনিট সময় লাগলো। এর ভেতর সাত আটবার কাগজের টুকরো দেখে গাড়ি থামিয়েছে তোবারক। কোনটা এমনি সাদা কাগজে, কোনটা সরকারি কোন প্রচার পত্র। একটাতে দেখলো দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। পড়ে তোবারকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
রিস্টোর ইশতেহারটা পেলো একটা বার্চ গাছের তলায়, পুরোটাই ঘাসের ভেতর, একটু কোণা শুধু বেরিয়েছিলো। তোবারক গাড়ি নামাতে রবিন বললো, দেখ এটা আবার কোন সরকারি নির্দেশ!
ফাইছি! কাগজের ভাজ খুলে চিৎকার করে উঠলো তোবারক। ওর খেয়ালই নেই সঙ্গে যে আন্তন রয়েছেন।
দেখি। ওটা ছিনিয়ে নিলো রবিন।
একই জিনিস। উত্তেজিত গলায় বললে তোবারক, সিটিযেন কমিটির লিফলেটের উল্টা দিকে রিস্টোর লেখা।
আন্তন বললেন, এতে প্রমাণ হচ্ছে রিস্টোরা অনেকগুলো ইশতেহার ফেলেছে। আমার মনে হয় ইতিমান পর্যন্ত আমরা ইশতেহার না খুঁজেই যেতে পারি। কারণ প্রথমটা ওখানে পাওয়া গেছে।
তোবারক বললো, আপনি ঠিক বলেছেন আন্তন খুড়ো। ইতিমান থেকে পুভদিভ পর্যন্ত ভালোভাবে খুঁজতে হবে।
রবিন আর আন্তন গাড়িতে ওঠার পর ষাট মাইল স্পীডে গাড়ি চালালো তোবারক। রবিন বললো, একটা কথা ভেবে দেখেছো তোবারক! রিস্টোর ইশতেহার যেভাবে আমাদের হাতে এসেছে, সরকারি গোয়েন্দাদের হাতেও তো সেভাবে পড়তে পারে। ওরা যদি নীলদের অন্য কোন জায়গায় সরিয়ে ফেলে?
হ্যাঁ, ভাবনার কথা রবিন। গম্ভীর হয়ে রবিনের আশঙ্কার কথা বুলগেরিয়ান ভাষায় আন্তনকে তর্জমা করে শোনালো তোবারক।
আন্তন বললেন, সরকারী গোয়েন্দারা এখন সোফিয়ার গোলমাল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। আমাদের মত শহরের বাইরে ইশতেহার খোঁজার সময় কোথায় ওদের!
আন্তনের কথা তোবারক আর রবিনকে পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে পারলো না।
বাইরে ঝড়ো বাতাসের দাপট ধীরে ধীরে বাড়ছে। আকাশের রঙ আরো কালো হয়ে এসেছে। তোবারক নিচু ভলিউমে গাড়ির রেডিও অন করে রেখেছিলো। আবহাওয়ার জরুরি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বললো, পশ্চিমের আড্রিয়াটিক সাগর থেকে উঠে আসা নিম্নচাপ আজ রাতে সোফিয়ার ওপর দিয়ে বয়ে যাবে ঘন্টায় একশ থেকে দেড়শ কিলোমিটার বেগে। রবিনকে খবরটা জানালো তোবারক।
রবিন বললো, পশ্চিম থেকে শুধু প্রাকৃতিক ঝড়ই আসে না তোবারক, রাজনৈতিক ঝড়ও আসে।
তার মানে? রবিনের কথাটা বুঝতে চাইলে তোবারক।
রবিন বললো, বুলগেরিয়ায় এই যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, শুধু বুলগেরিয়ায় কেন–হ্যাঁঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, জিডিআর সবখানে–পশ্চিমা হাওয়ার ইন্ধন না পেলে একসঙ্গে এত জায়গায় গোলমাল হতো বলে আমার মনে হয় না। ধনতন্ত্রটা পশ্চিমাদের মতবাদ। পুবের এরা মেঘ চেয়েছে, মেঘ এসেছে। ধনতন্ত্রের এই কালো মেঘ এদের অনেক ভালো জিনিসও ধ্বংস করে দেবে।
তুমি কি বলতে চাও, ঝিভকভের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন করাটা ঠিক না? প্রশ্ন করলো তোবারক।
ঝিভকভের দুর্নীতি আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে ঠিক আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এরা ঝিভকভকে সরাতে গিয়ে সমাজতন্ত্রকেই সরিয়ে দিতে চাইছে। আন্তনকে জিজ্ঞেস কর তো আমার ধারণা ঠিক কিনা?
তোবারকের কাছে রবিনের কথা শুনে আন্তন বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছো রবিন। ঝিভকভের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলেও এখন সেটা সমাজতন্ত্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। আমি এখনো পার্টির সদস্য। আমার মত অনেকে চায় ঝিভকভের বদলে পার্টিতে নেতৃত্ব বদলের একটা সুযোগ থাকুক। সৎ আর যোগ্য যারা তারা নেতৃত্বে আসুক। আমি চাই বুলগেরিযায় সমাজতন্ত্র থাকুক। আমাদের কাজের, থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা আর ছেলেমেয়ের পড়ার গ্যারান্টি থাকুক। সমাজতন্ত্রই পারে এসবের গ্যারান্টি দিতে। কিন্তু ভয় হচ্ছে যদি পোল্যাণ্ডের মত ভিন্নমতের লোকেরা এখানে ক্ষমতায় আসে, সমাজতন্ত্র যদি বাতিল করে দেয়, তখন গরিব মানুষ আরও গরিব হবে।
রবিন বললো, আপনার কি মনে হয় বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে নেতৃত্ব বদলের কোনো সম্ভাবনা আছে?
কাল রাত থেকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরি বৈঠক চলছে। আমার তো মনে হয় আজ না হয় আগামীকালের মধ্যেই পার্টি নেতৃত্বে বড় রকমের রদবদল হবে। সিটিযেন কমিটির আন্দোলন আমাদের সমর্থন ছাড়া কখনো এতটা শক্তিশালী হতে পারতো না।
আপনারা কেন সিটিযেন কমিটিকে সমর্থন করলেন? ওরা তো সমাজতন্ত্র চায় না।
ওদের সমর্থন ছাড়া ঝিভকভকে হটানো যাবে না। ঝিভকভ যতদিন থাকবে ততদিন এসব দুর্নীতি আর অত্যাচারও দেশ থেকে যাবে না।
প্রফেসর ইয়াভরভ কি আপনাদের মত সমর্থন করেন?
আগে করতেন। এখন তিনি মনে করেন সমাজতন্ত্র এসব দেশে আর চলবে না। সিটিযেন কমিটির একটা বড় অংশ পুরোপুরি সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তবে রিস্টোর বাবা মনে করেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা রেখেও বহুদলীয় গণতন্ত্র হতে পারে। গণতন্ত্র মানে কথা বলা আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা যদি হয়। রিস্টোর বাবা গিয়র্গির সঙ্গে এ নিয়ে আমাদের অনেক কথা হয়েছে। আমরা বলেছি গণতন্ত্র চাও ভালো কথা, এত বছর ধরে সমাজতন্ত্রের যে সুফল আমরা ভোগ করেছি সে সব কেড়ে নেয়া চলবে না।
বাতাসের তেজ দেখে তোবারক গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিলো। পেছনে মিলিশিয়ার গাড়ির হর্ণ শুনে ও সাইড দিলো। ওদের ওভারটেক করে চলে গেলো মিলিশিয়ার একটা জিপ আর প্রিজন ভ্যান। তোবারক বললো, মনে হয় বড় কোন নেতা এ্যারেস্ট হয়েছে।
আন্তন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বললেন, তোবারক, মিলিশিয়ার গাড়িটাকে ফলো করো। এরকম গাড়িতে করেই নীল আর রিস্টোকে নেয়া হয়েছিলো। আমার মনে হচ্ছে ওদের যেখানে রাখা হয়েছে এই বন্দিদেরও সেখানে নেয়া হচ্ছে।
আপনি ঠিক বলেছেন আন্তন খুড়ো। এই বলে তোবারক ওর গাড়ির স্পীড বাড়ালো। শুধু জিপ হলে মিলিশিয়ারা বুঝে ফেলতো ওদের অনুসরণ করা হচ্ছে, মাঝখানে চারদিক ঢাকা ভ্যান থাকাতে ওরা কিছু টের পেলোলা না।
তোবারকরা ভেবেছিলো মিলিশিয়ার ভ্যান পুভদিভ পর্যন্ত যাবে। যে স্পীডে যাচ্ছে পুভদিভ পৌঁছতে আরো ঘন্টা খানেক লাগার কথা। ঘড়িতে তখন দুপুর বারোটা। অবশ্য আকাশের অবস্থা দেখে তখন মনে হচ্ছিলো সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
ইতিমান পেরিয়ে লেসতাহানের কাছে এসে মিলিশিয়ার গাড়ি হাইওয়ে ছেড়ে বা দিকে কাঁচা রাস্তায় মোড় নিলো। তোবারক অবাক হয়ে বললো, এরা তো প্রভদিভ যাইতেছে না!
আন্তন বললেন, বুঝেছি। তুমি এদের পেছন ছেড়ো না। এরা আলাবিন-এর ঘাঁটিতে যাচ্ছে। তুর্কীদের হামলা ঠেকানোর জন্য এখান থেকে দুভদিভ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর অনেকগুলো গোপন ঘাঁটি আছে বনের ভেতর। এ ছাড়া এ পথ দিয়ে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।
রবিন বললো, আলাবিন কি শুধু সামরিক ঘাঁটি–না কোনও লোকালয় আছে?
আলাবিন একটা গ্রামের নাম। অনেক আগে কয়েক বার এসেছিলাম কাজে। তবে ঘাঁটিটা গ্রাম থেকে তিন চার মাইল দূরে।
আপনি চেনেন গ্রামের কাউকে?
শেষবার এসেছিলাম দশ বছর আগে, মার্কো কোঝিনকভের কাছে। এখনকার সমবায়ের পরিচালক। ভারি ভালো লোক।
আমরা তাহলে তার কাছেই যাবো। নীল আর রিস্টোকে উদ্ধারের জন্য গ্রামের মানুষের সাহায্য লাগবে।
ভালো বলেছে। তোবারক, সোজা গিয়ে ডান দিকে ঘুরবে। দেখা যাক কোঝিনকভের দেখা পাওয়া যায় কিনা।
কাঁচা উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে আলাবিন পৌঁছতে ওদের প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগলো। মার্কো কোঝিনকভ বাড়িতেই ছিলেন। আন্তন আন্তনভের বয়সী, শ্লাভ চেহারা, একগাল সাদা দাড়ি। গাড়ির শব্দ শুনে বেরিয়ে এলেন তিনি। আন্তন নামতেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন–আরে, এ যে দেখি পুরোনো সেই ধাড়ি খরগোস আন্তন আন্তনভ। নিশ্চয় ঝিভকভের পতনের সংবাদ এনেছো! বলে আন্তনের গালে চুমো খেলেন।
আন্তন হেসে বললেন, ঝিভকভের খবর কাল পাবে। আমরা বিপদে পড়ে এসেছি তোমার কাছে।
কোঝিনকভের নজর পড়লো রবিন আর তোবারকের ওপর। আন্তন বললেন, আমার দুই তরুণ বন্ধু। ভেতরে চলো, সব বলছি।
বুলগেরিয়ার গ্রামের সাধারণ বাড়ি যেমন হয়–পুরোটাই কাঠের, চিমনিটা শুধু পাথরের, ধোঁয়া উঠছে চিমনি থেকে। সদ্য রং করা হয়েছে, দেয়ালগুলো হালকা বাদামী রঙের, দোচালা ছাদের রঙ লাল। পেছনে সবজি বাগান তারপর বার্চ বন। ঝড়ের মাতামাতি কিছুটা কমলেও মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বন কাঁপিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
ওরা ভেতরে গিয়ে বসার একটু পরেই কোঝিনকভ গিন্নি কফির সঙ্গে পনির আর সবজির গরম পিঠা দিয়ে গেছেন। রিস্টো আর নীলের ধরা পড়া, ইশতেহারের চিরকুট দেখে এ পর্যন্ত আসা–সব কথা শুনে কোঝিনকভ বললেন, আমি কয়েকবার গেছি আর্মির ঘাঁটিতে। খোঁজ নেয়ার জন্য লোক পাঠাতে হবে। জানতে হবে ছেলেরা এ ঘাঁটিতে আছে কিনা, চার্জেই বা কে আছে! তোমরা বরং আজ এখানে থেকে যাও। বিপদের সময় এ বুড়োকে মনে রেখেছে, খালি হাতে তোমাদের ফেরাবো না।
থাকতে আমার কোন আপত্তি নেই। এই বলে আন্তন তোরকের দিকে তাকালেন–তোমাদের কোন অসুবিধে হবে?
তোবারক কথাটা রবিনকে বললো। রবিন আপত্তি করলো না একবার টেলিফোন করে জানিয়ে দিতে হবে, নইলে চাচা টেনশনে থাকবেন।
কোঝিনকভ বললেন, সারা গ্রামে একটাই টেলিফোন। সেটা আমার দফতরে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগেই চলো টেলিফোনটা সেরে ফেলি।
দূতাবাসে ফোন করলো তোবারক। নীলের বাবাকে ধরে লাইন দিলো রবিনকে। রবিন বাংলায় বললো, আমাদের কাজের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। আশা করছি কালই নীলকে নিয়ে ফিরবো। আপনি রাতে প্রফেসরকে বলুন, জেনারেল ভাসিলিনকে তিনি যেন বলেন ওরা আলাবিন-এর সামরিক ঘাঁটিতে আছে।
.
১২. জিভকভের পতন এবং…
প্রফেসর ইয়াভরভ ভার্না থেকে সোফিয়া ফিরেছেন রাত দশটার দিকে। ততক্ষণে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ভাগ্যিস দূতাবাসের শক্ত ল্যান্ড রোভারটা নিয়ে গিয়েছিলেন! নইলে রাতে আর ফেরা হতো না। ভার্না থেকে নীলের বাবার জন্য দারুণ খবর এনেছেন।
ঝিভকভকে সরাবার জন্য যে পার্টির বৈঠক চলছে এ খবর তিনি জানতেন। সিটিযেন কমিটির হাই কমান্ডের জরুরি বৈঠক বসেছিলো ভার্নায়। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পার্টি যদি ঝিভকভকে সরাতে না পারে তাহলে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। বৈঠকে কয়েকজন জেনারেলও ছিলেন। বৈঠক শেষ হওার ঘন্টা খানেক আগে এলেন জেনারেল চোলপানভ, ঝিভকভের গোয়েন্দা পুলিশের ডেপুটি চীফ। তাঁর আসার কথা ছিলো সকালে। না আসাতে অন্যরা বলাবলি করছিলেন চোপানভ বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না তো!
বৈঠকের ঘরে চোলপানভকে ঢুকতে দেখে কয়েকজন উঠে দাঁড়ালেন। রিস্টোর বাবা ইঞ্জিনিয়ার গিয়র্গি বললেন, জেনারেল চোলপানভ নিশ্চয় সুখবরটি আনার জন্য দেরি করেছেন?
গোল টেবিলের পাশে তার জন্য রাখা চেয়ারে বসে চোলপানভ বললেন, আংশিক সুখবর এ মুহূর্তে দিতে পারি। চূড়ান্ত খবরের জন্য কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আংশিকটাই আপাতত বলুন। কয়েকজন একসঙ্গে জানতে চাইলেন।
একটু আগে আমি ঝিভকভের গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান জেনারেল ভেলকভকে গ্রেফতার করে আমার নিজস্ব ঘাঁটিতে নিয়ে রেখে এসেছি।
টেবিল চাপড়ে সবাই অভিনন্দন জানালো চোলপানভকে। প্রফেসর ইয়াভরভ বললেন, ওকে যে আমার কিছু ব্যাপারে জেরা করা দরকার।
নিশ্চয় করবেন। জবাব দিলেন চোপান-কাল সকালে ওর কাছে আপনাকে আমি নিয়ে যাবে। এর পর চোলপানভ বললেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের সর্বশেষ পরিস্থিতি।
সিটিযেন কমিটির বৈঠক শেষ হয়েছে বিকেল চারটার দিকে। কয়েকজনকে জরুরি কাজে আজই সোফিয়া ফিরতে হবে। বৈঠকের পর প্রফেসর ইয়াভরভ রিস্টোর বাবাকে ডেকে বললেন, গিয়র্গি শোন, তোমার আর বাংলাদেশের এ্যাম্বাসাডরের ছেলেকে কালই আমি ছাড়াবার ব্যবস্থা করছি। শুনলে তো, গোয়েন্দা পুলিশের শয়তান চীফটাকে ধরা হয়েছে। ওই বলতে পারবে বাচ্চা দুটোকে কোথায় রেখেছে। জেনারেল ভাসিলিনকে নিয়ে যাবো আমি।
রিস্টোর বাবা বললেন, লিলিয়া আমাকে সকালেই বলেছে, মামা যখন এ কাজের ভার নিয়েছেন তখন আমাদের এ নিয়ে না ভাবলেও চলবে।
ভার তো নিতেই হবে বাছা। এ্যাম্বাসাডরের ছেলেটা যে আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে এ খবর তো জানোই। আর রিস্টো ছাড়া আমার আপন কে আছে বলো!
গভীর কৃতজ্ঞতায় প্রফেসরের হাত চেপে ধরলেন রিস্টোর বাবা। প্রফেসর বললেন, রিস্টোর মত ছেলের জন্য তুমি গর্ব করতে পারো গিয়র্গি।
রিস্টো আপনারও ছেলে দিমিতির ইয়াভরভ।
রিস্টোর বাবার কথা শুনে প্রফেসর ইয়াভরভের চোখে পানি এসে গেলো। ভাবলেন, আমেরিকায় নিজের কাছে রেখে ছেলেটাকে মনের মত করে গড়বেন।
বাড়িতে ফেরার পরই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত প্রফেসরকে বললেন, বাংলাদেশের এ্যাম্বাসাডর আপনাকে দুবার ফোন করেছিলেন। আমি বলেছি আপনি ফিরে এলে ওঁকে ফোন করবেন।
ফোন তো করতেই হবে। ওর জন্য ভালো খবর এনেছি আমি। এই বলে প্রফেসর নীলের বাবাকে ফোন করলেন। এক্সেলেন্সি, ভার্না থেকে আমি এখনই ফিরেছি। আপনার জন্য একটা খবর আছে গোয়েন্দা পুলিশের চীফকে গ্রেফতার করেছে আমাদের লোক। কাল ওকে আমি জেরা করে জেনে নেবো বাচ্চারা কোথায় আছে।
নীলের বাবা বললেন, রবিন আমাকে দুপুরে ফোন করেছিলো। বললো ছেলেরা নাকি আলাবিন-এর ঘাঁটিতে আছে। আজ রাতে রবিনরা ওখানেই থাকবে।
ঠিক আছে এক্সেলেন্সি, ওরা ওদের মত কাজ করুক। আমিও আমার মত করি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কালই আপনার ছেলে আপনি ফেরত পাবেন। ম্যাডামকে ভাবতে বারণ করুন।
ও আমার পাশে আছে। ওকে আপনিও বলুন।
প্রফেসর নীলের মাকেও একই কথা বললেন। শেষে বললেন, এরকম সাহসী ছেলের জন্য পৃথিবীর যে কোনও মা গর্ব অনুভব করবে।
ধন্যবাদ প্রফেসর। নীলের মা বললেন, আপনি ওদের জন্য যা করছেন আমরা সবাই সেজন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমি এখনো কিছুই করি নি ম্যাডাম। ছেলেকে আপনার হাতে তুলে দেয়ার পর বলবো সামান্য কিছু করেছি। তবে আপনার ছেলে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। যতদিন বেঁচে আছি মনে থাকবে।
প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলার পর নীলের বাবা মা দুজনই কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেন। বাবা রীনকে বললেন, দুদিন ধরে তো এক ফোঁটা ঘুমোস নি। এখন ঘুমোতে যা বুড়ি। তোর দাদা কালই এসে যাবে।
বাইরে তখন তুমুল ঝড়। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ থাকলেও ঝড়ো বাতাসে মাঝে মাঝে ফ্রিডম পার্কে গাছের ডাল ভাঙার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরই ভেতর আবার টেলিফোন বাজলো। দুবার বাজতেই ফোন ধরলেন নীলের বাবা। ও পাশের গলা শুনে চমকে উঠলেন। রবিনের বাবা ফোন করেছেন।
ভাইয়া তুমি কোত্থেকে ফোন করছো?
রোম থেকে। আজ বিকেলে এসেছি। নীলের খবর কী বল? নাফিসার ফোন পেয়ে আর থাকতে পারলাম না। রবিনের বাবার গলায় উদ্বেগ।
ওকে এদের গোয়েন্দা পুলিশ ধরে লুকিয়ে রেখেছে। আজই রবিনরা খবর পেয়েছে। ওকে কোথায় রাখা হয়েছে। ওপর মহলে এ নিয়ে কাজ হচ্ছে। কাল আশা করছি নীল ফিরে আসবে।
রবিন কেমন আছে?
ভালো আছে, ওর জন্য ভেবো না ভাইয়া।
শোন, কাল বিকেলের ফ্লাইটে সোফিয়া আসছি। আমার খুব অস্থির লাগছে।
চলে এসো ভাইয়া। নাফিসা আপাকেও বলল আসতে।
রবিনের বাবা টেলিফোন রাখার পর গত তিনদিনে নীলের বাবার মুখে প্রথম হাসি ফুটলো। নীলের মাকে বললেন, ভাইয়া কাল আসবেন। নাফিসা আপাও আসতে আসতে পারেন। ভালোই হবে, কি বলো?
মৃদু হেসে নীলের মা বললেন, ভালো হওয়ার অনেকটাই নির্ভর করবে রবিনের ওপর।
.
আলাবিন-এর সামরিক ঘাঁটির কারাগারের দেয়ালগুলো চব্বিশ ইঞ্চি পুরু পাথর দিয়ে বানানো হলেও ভেতর থেকে ঝড়ের তান্ডব শুনতে পাচ্ছিলো রিস্টো আর নীল। সিলিং-এর সঙ্গে লাগানো কম আলোর বাবটা সন্ধ্যার পর দুবার নিভে গিয়েছিলো। গত দু দিন একা থাকতে খুব খারাপ লেগেছিলো নীলের। রিস্টো আসার পর থেকে ভালো লাগছে ওর। যদিও রিস্টোর ওপর অত্যাচারের কথা শুনে ওর ভীষণ রাগ হয়েছিলো।
বিকেলে পালাবার প্ল্যান চূড়ান্ত করে ফেলেছিলো নীল। কোন এক বইতে পড়েছিলো–দুজন বন্দীর একজন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ার ভান করে খাটে শুয়ে চিৎকার করবে। প্রহরী ভেতরে ঢুকে যখন দেখতে যাবে তখন অপরজন ওকে মেরে অজ্ঞান করে বেরিয়ে যাবে। নীল লক্ষ্য করেছে রোজ রাতে রোগা পটকা একটা প্রহরী আসে খাবার দিতে। তাকে সামলানো এমন কোনো কঠিন কাজ হবে না ওর পক্ষে। আর অসুস্থ হওয়ার ভান করাটা রিস্টোর জন্যেও বেমানান হবে না। এখনো ওর শরীরে অসম্ভব ব্যথা।
রিস্টো এভাবে পালাবার পক্ষপাতী নয়। ওর ধারণা, একশর উপর চিরকুট ফেলেছে, কেউ না কেউ আসবেই ওদের উদ্ধার করতে। নীলকে বলেছে, এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? দুএক দিনের মধ্যেই আমাদের নেয়ার জন্য তোক আসবে। সিটিযেন কমিটির সমর্থক এখানেও যে নেই তোকে কে বললো।
দুই বন্ধুর অবস্থা এমন হয়েছে–একজন হতাশ হয়ে পড়লে আরেকজন সাহস জোগায়। রিস্টো এ ঘরে আসার পর নীল যেমন ওকে আশার কথা শুনিয়েছিলো।
ঝড় এসে নীলের প্ল্যান মাটি করে দিয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে যে ভীষণ ঝড় শুরু হয়েছে–নীল ভেবে দেখলো বেরিয়ে যাওয়াটা কম বিপজ্জনক হবে না। এই গভীর বনে ঝড়ের রাতে অন্ধকারে যাবেই বা কোথায়? রোগা পটকা প্রহরীটা যখন রাতের খাবার দিতে এলো তখন ওর দিকে কটমট করে তাকালো নীল। লোকটা ভাবলেশহীন মুখে রুটি আর খাবারের বাটি দুটো দরজার ফোকর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
এই ক দিনে কারাগারের খাবারে ওরা দুজনই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। রিস্টো অবশ্য বাড়িতেও এমন আহামরি কিছু খায় না, তবে নীলের কথা আলাদা।
খেতে খেতে নীল বললো, ঝিভকভের পর যখন তোদের সিটিযেন কমিটির সরকার হবে, তখন তুই কী করবি রিস্টো?
রিস্টো হেসে বললো, আমার সেল-এ থাকতেই এ নিয়ে ভেবেছি আমি। বুলডগের মত যে শয়তান অফিসারটা আমাকে জেরা করেছে, ওকে সত্যিকারের বুলডগের চেইন গলায় দিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে বেঁধে রাখবো। যে কদিন আমরা এখানে আটকা থাকবো সে কদিন ও বাঁধা থাকবে। মারধোর করবো না। শুধু চেইন বাঁধা বুলডগ হয়ে থাকতে হবে, ঘেউ ঘেউ না করলে খাবার পাবে না। এ ছাড়া বুলডগ আর যা যা করে সবই ওকে করতে হবে।
রিস্টোর কথা শুনে গলা খুলে হাসলো নীল। বললো, সব কিছু করাটা কি সম্ভব হবে রিস্টো?
কেন হবে না? হাসি চেপে নিরীহ গলায় বললো রিস্টো, বুঝেছি তুই কী বলতে চাইছিস। ঠিক আছে, ওকে একটা লাইটপোস্টোর সঙ্গেই বাঁধা হবে।
এবার হাসতে গিয়ে বিষম খেলো নীল। রিস্টোও ওর সঙ্গে গলা মেলালো। বাইরে বড় দরজার কাছে যে ষন্ডামত প্রহরীটা পাহারা দিচ্ছিলো, হাসির শব্দ ওরও কানে গেলো। উঠে এসে দরজার ফোকর দিয়ে দেখলো ছেলে দুটো হা হা হি হি করে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কড়া শাস্তি দেয়ার জন্য বন্দীদের এসব কারাগারে আনা হয়। ওর পঁচিশ বছরের চাকরি জীবনে এমন হাসির ঘটনা ঘটতে দেখে নি। ওর মনে হলো ছেলে দুটো বোধহয় বন্দী জীবন সহ্য করতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ও নিজের চোখে দেখেছে একটা ছেলেকে কী প্রচণ্ড মারই না মেরেছে! নীল আর রিস্টোর জন্য মোটাসোটা নিরীহ প্রহরীটার ভারি দুঃখ হলো। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ও নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো।
নীল বললো, তোর এই অভিনব শাস্তির কথাটা আমার ভাইকে বলতে হবে। ওরা আবার আমাদের দেশে আরেকটা ঝিভকভকে হটাবার জন্য লড়ছে কিনা! বুলডগ আমাদের দেশেও আছে।
হ্যাঁ সবগুলোকে এক সঙ্গে এক ধরনের শাস্তি দিতে পারলে ভালোই হয়। বলে আবার হেসে গড়িয়ে পড়লো রিস্টো। ভুলে গেলো ওর শরীরের ব্যথা আর বন্দি জীবনের অনিশ্চয়তার কথা।
অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করলো রিস্টো আর নীল। দেয়ালের ওপরে একটাই ছোট জানালা, সেটারও কাঁচ নামানো, তবু কোত্থেকে যেন কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আসছিলো। দুটো কম্বল গায়ে জড়িয়েও শীত তাড়াতে পারছিলো না ওরা।
সকালে যখন ঘুম ভাঙলো তখন বাইরে ঝড়ের চিহ্নমাত্র নেই। কুঠুরির ভেতর এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে। হেমন্তের বার্চপাতার মত সোনালী রঙের রোদ। সকালের খাবার কখন দেয়া হয়েছে ওরা টের পায়নি। ঘড়ি দেখে নীল লাফিয়ে উঠে বসলো–
সর্বনাশ আটটা বেজে গেছে। রিস্টো শিগগির খেয়ে নে। নইলে এখনই এসে খাবারগুলো নিয়ে যাবে।
নীলের কথা শুনে হাসলো রিস্টো–তুই এমনভাবে বলছিস যেন এ্যাণ্ড হোটেল থেকে দারুণ ব্রেকফাস্ট এসেছে?
কলের পানিতে মুখ হাত ধুয়ে ওরা খাবার নিয়ে বসেছে–তখনই প্রহরী এলো বাটি ফেরত নিতে। রিস্টো বললো, অপেক্ষা করতে হবে। খেয়ে নিই আগে। এমন ব্রেকফাস্ট বাপের জন্মেও খাই নি।
সকালের প্রহরীটাকে নীলের ভালোই লাগে। কোনরকম হম্বিতম্বি করে না। রিস্টোর কথা শুনে বললো, যতক্ষণ খুশি খাও। বাইরে যে ভীষণ কাণ্ড!
কী হয়েছে? জানতে চাইলো নীল।
আলাবিন থেকে কম করে হলেও হাজার খানেক মানুষ এসে আমাদের ঘাঁটি ঘিরে ফেলেছে। টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে। বলছে তোমাদের দুজনকে না ছাড়লে ওরা হামলা করবে।
খাবার ফেলে উঠে দাঁড়ালো নীল আর রিস্টো। দরজার কাছে এসে রিস্টো উত্তেজিত হয়ে বললো, আমরাই খবর পাঠিয়েছিলাম। ওরা সিটিযেন কমিটির সমর্থক।
ওদের সঙ্গে দুটো বিদেশী ছেলেও আছে। মনে হয় গ্রীক নয় ইটালিয়ান। একজন তো দারুণ বুলগেরিয়ান বলতে পারে।
নীল বললো, নিশ্চয় রবিন আর তোবারক।
রিস্টো জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের অফিসাররা কি করছে?
কি আর করবে! ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। বন্দি তো অনেক। মিটিং করছে। অপেক্ষা করছে সোফিয়া থেকে কেউ আসে কিনা। যাই ওদিকে, আবার কখন ডাক পড়ে! এই বলে চলে গেলো নিরীহ প্রহরী।
রিস্টো নীলের দিকে তাকালো মনে হচ্ছে ঝিভকভ আর গদিতে নেই।
নীল কোন কথা না বলে বুকে জড়িয়ে ধরলো রিস্টোকে।
ঘাঁটির সদর দরজা পুরু লোহার পাত দিয়ে বানানো। ভেতর থেকে বন্ধ করে ফটকের ওপর উঠে গ্রামের লোকদের সঙ্গে কথা বলছে একজন অফিসার। ওর কোনও কথাই শুনতে চাইছে না গ্রামের লোকরা। আন্তন আন্তনভ তো রীতিমত গালাগালি শুরু করেছেন–তোরা ভেবেছিস কি শুয়োরের ময়লা খাওয়া উকুনের দল! তোদের বাপের মরার খবর আসার জন্য অপেক্ষা করছিস নাকি রে নর্দমার পোকারা…..
কয়েকজন কুড়াল দিয়ে বার্চ আর পাইন গাছ কাটছে মই বানিয়ে দেয়াল টপকাবে বলে। সকাল তখন সাড়ে নটা। আকাশে মেঘের কোনও চিহ্ন নেই। হেমন্তের ঝলমলে রোদে চকচকে করছে বাঁচবন। গাছের নিচে ঝরাপাতার সোনালী কার্পেট বিছানো। সেই কার্পেটের ওপর দিয়ে দুটো গাড়ি আসতে দেখলো গ্রামের লোকেরা। দুটো গাড়িতেই পতাকা উড়ছে। একটাতে আমেরিকার পতাকা, আরেকটাতে বাংলাদেশের। সবাই একসঙ্গে হই হই করে ছুটলো সেদিকে।
সবার সঙ্গে ছুটে গেলো রবিন আর তোবারক। দুই রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে গাড়ি থেকে নামলেন প্রফেসর ইয়াভরভ, জেনারেল চোলপানভ আর জেনারেল ভাসিলিন। জেনারেল চোলপানভ পুরো ইউনিফর্ম পরা। তিনিই এগিয়ে এলেন সবার আগে। ফটকের কাছে এসে ধমকের গলায় বললেন, দরজা খোলো।
ফটকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারটি জেনারেলকে না চিনলেও কাঁপতে কাঁপতে এসে দরজা খুলে দিলো। জেনারেল বললেন, এখানকার দায়িত্বে কে আছে, ডাকো তাকে।
প্রফেসর ইয়াভরভ আন্তন আন্তনভকে বললেন, গ্রামের লোকদের আপনি সামলান। সব বন্দিকে এখনই আমরা মুক্ত করবো। এরপর তোবারক আর রবিনকে চোখ মটকে বললেন, আমি জানি এসব কাদের কাজ।
দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার জেনারেল চোলপানভকে চিনতো। ভয়ে তার মুখের রঙ বদলে গেছে। জেনারেল বললেন, বন্দিদের সবাইকে আমি নিয়ে যাবো। এক্ষুণি তালিকা তৈরি করো।
প্রফেসর ইয়াভরভ সবার আগে গেলেন রিস্টো আর নীলের সেল-এ। দরজা খুলে দিতেই তিনি দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
দুই রাষ্ট্রদূত অপেক্ষা করছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের দফতরে। দুই বগলে দুই বন্দীকে চেপে ঘরে ঢুকলেন প্রফেসর। নীল ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওর বাবাকে। ক্লান্ত গলায় বাবা শুধু বললেন, ভালো আছিস বুড়ো!
সবাই মিলে যখন বাইরে এলো নীল আর রিস্টো তখন গ্রামের মানুষদের কাঁধে। ভিড় ঠেলে ওদের উদ্ধার করতে গিয়ে হিমসিম খেলো রবিন, তোবারক আর আন্তন।
জেনারেল চোলপান থেকে গেলেন অন্য বন্দিদের সঙ্গে করে আনবেন বলে। বন্দিরা প্রায় সবাই সিটিযেন কমিটির নেতা। রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে চললেন জেনারেল ভাসিলিন আর প্রফেসর ইয়াভরভ। ওঁরা আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে উঠেছেন। আন্তন আন্তনভকে আসতে দেননি তাঁর পুরোনো বন্ধু কোঝিনকভ। নীলদের গাড়িতেই সোফিয়া এলো রিস্টো।
আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের গাড়ি নীলদের বাড়িতে প্রথম থামলো। রাষ্ট্রদূত নীলের বাবাকে বললেন, এক্সেলেন্সি, আশা করি আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।
প্রফেসর বললেন, ম্যাডামের কাছে একটা ভোজ পাওনা রইলো। আমাদের এক্ষুণি যেতে হবে এক জরুরি মিটিং-এ। রিস্টো, তুই নীলের কাছেই থাকিস। বাড়ি থেকে কোথাও বেরোবি না। শহরের অবস্থা ভালো নয়।
সোফিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ হতে পারতো, কিন্তু হয় নি। সেদিন দুপুরে রেডিওতে বুলগেরিয়ার প্রেসিডেন্ট টডর ঝিভকভের পদত্যাগের সংবাদ ঘোষণা করা হলো। নতুন প্রেসিডেন্ট হলেন কমিউনিস্ট পার্টিরই পিটার ম্লাদেন।
খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর, অফিস, দোকান সব কিছু ফেলে রাস্তায় নেমে এলো হাজার হাজার মানুষ। বয়সের কোনও সীমা নেই। সাত মাসের বাচ্চা থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বুড়োরাও শামিল হলো আনন্দ উৎসবে। ছেলে-ছোকরাদের সঙ্গে বুড়োবুড়িরাও মদ খেয়ে নাচলো, গাইলো, মাতাল হয়ে একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরলো, বেলুন ওড়ালো। আনন্দের স্রোতে সাইবেরিয়ান হাঁসের মত ভাসতে লাগলো সোফিয়ার মুক্ত মানুষ।
নীল আর রিস্টো বাড়িতে এসে এক ঘণ্টা কাটিয়েছে বাথরুমে। ওদের ধারণা তিন দিনে মণ খানেক ময়লা নাকি জমেছে ওদের শরীরে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে এম্ব্যাসির ডাক্তার অপেক্ষা করছেন রিস্টোকে দেখার জন্য। দেখে শুনে কিছু ওষুধ দিলেন তিনি। বললেন, দুজনের জন্য সবচেয়ে ভালো ওষুধ হচ্ছে দুগ্লাস দুধ খেয়ে লম্বা একটা ঘুম।
নীল গল্প করতে বসেছিলো। মা জোর করে ওকে পাঠিয়ে দিলেন ঘুমোতে। যাওয়ার আগে নীল ওর বাবাকে বললো, শিগগির তোমার সেক্রেটারিকে তাড়াও বাবা। ইলিনা মিরকোভাই হচ্ছে গুপ্ত পুলিশের গোয়েন্দা।
বিকেলে রবিনের জন্য আরেক বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো এয়ারপোর্টে। বাবাকে আনার জন্য চাচার সঙ্গে এয়ারপোর্ট এসেছে। বাবা সোফিয়া আসছেন শোনার পর থেকেই দারুণ উত্তেজিত ছিলো সে।
চাচা ওর জন্য বিশেষ অনুমতি নিয়ে চলে গেলেন এয়ারপোর্টের একেবারে ভেতরে। ঘোষণা করা হলে বলকান এয়ার রোম থেকে সোফিয়া এসে ল্যাণ্ড করেছে। ওরা ইমিগ্রেশন কাউন্টারের পাশে সোফায় বসে অপেক্ষা করছিলো। সঙ্গে তোবারকও রয়েছে। যাত্রীদের লাইনে প্রথমে বাবাকে দেখে ছুটে গেলো রবিন। বাবা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, দেখেছিস কে এসেছে!
পেছনে তাকিয়ে দেখে নাফিসা আন্টি। উচ্ছ্বসিত গলায় রবিন চিৎকার কলে উঠলো–আন্টি আপনি এসেছেন! আমি যে কী খুশি হয়েছি–
বাধা দিয়ে নাফিসা বললেন, একটু খুশি আর কারো জন্যে রাখো রবিন।
আরে এ কে! পলা তুমি!
রবিন ভেবেছিলো পলা হাত মেলাবে। হাসি মুখে হাত বাড়ালো সে। সবার সামনে ওকে জড়িয়ে ধরলো পলা ওহ রবিন! তোমার ভাই হারিয়ে গিয়েছিলো। তুমি ওকে খুঁজতে বেরিয়েছে। শোনার পর থেকে আমি ঘুমোত পারি নি।
নাফিসা বললেন, খুব খারাপ কথা রবিন, পলা এত কান্নাকাটি করেছে যে–না এনে পারলাম না।
রবিন কী বলবে! লজ্জায় ওর কানটান এরই মধ্যে লাল হয়ে গেছে। তোবারকের মুখ টিপে হাসা ওর নজরে পড়েছে। কি মিটমিটে শয়তান ও! বাবা, চাচা সবাই রয়েছেন–আবার চোখও টিপছে! ভাগ্যিস নীল আর রীন আসে নি! পলা যদি ওর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে–রবিনের কি দোষ!