১১-১২. নাকের হাড় ভেঙ্গেছে

১১.

“এজেন্ট।”

“ইয়েস স্যার।”

“তোমার নাকের হাড় কেমন করে ভেঙ্গেছে? সাথে সামনের একটা দাঁত। আমাদের এজেন্সির একজন এজেন্টের এরকম ইনজুরী হবার কথা নয়।”

“স্যার। এটা খুবই দুঃখজনক একটা ঘটনা। আমি লোকাল রিসোর্সের ওপর নির্ভর করেছিলাম তারা ঠিকমত ম্যানেজ করতে পারে নি। একেবারে শেষ মুহূর্তে একটা বিপর্যয় হয়ে গিয়েছিল।”

“কী বিপর্যয়?”

“আমি আমার রিপোর্টে সেটা ডিটেল্‌স লিখেছি।”

“আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।”

এজেন্ট অস্বস্তির সাথে বলল, “স্কুলের মেয়েরা ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়েছিল।”

“তারা কেমন করে জড়িয়ে পড়ল এজেন্ট?”

“সেটা একটা রহস্যময় ব্যাপার। আমি সেটা এখনো ভালো করে জানি না।”

“তুমি জানো এই গুবলেট প্রজেক্টে তুমি এজেন্সির কতো টাকা নষ্ট করেছ?”

“আই এম সরি স্যার। কিন্তু এটা ছিল একটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি পরের বার এটা হবে না।”

“পরের বার? এই প্রজেক্টের পরের বার আছে?”

“থাকা উচিৎ স্যার। আমি মেয়েটার শরীরে একটা ট্র্যাকিওশান ঢুকিয়ে এসেছি স্যার। সেটা নিয়মিত সিগন্যাল দিচ্ছে, আমরা মেয়েটাকে স্যাটালাইট দিয়ে ট্রাক করছি। আমরা জানি স্যার মেয়েটার শরীর থেকে ট্র্যাকিওশানটা বের করার চেষ্টা করেছে। পারে নাই। আমরা মেয়েটাকে চব্বিশ ঘন্টা ট্র্যাক করছি। স্যার।”

“তুমি এখন কী করতে চাও এজেন্ট?”

“আমি আবার চেষ্টা করতে চাই। লোকালদের ওপর নির্ভর না করে। এই মেয়েটা আমাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটির জন্যে কতো গুরুত্বপূর্ণ আমি জানি স্যার। আমি মেয়েটাকে নিয়ে আসব স্যার।”

“তুমি পারবে?”

“অবশ্যই পারব স্যার। এই প্রজেক্টটা আপনি পাস করে দিলেই পারব স্যার।”

“ঠিক আছে আমি দেখি।”

“আমি যাব স্যার?”

“দাঁড়াও। যাবার আগে বলে যাও–”

“কী বলব স্যার।”

“তোমার নাকের হাড় কেমন করে ভাঙল সেটা এখানো বল নাই।”

“একটা মেয়ে ঢিল ছুঁড়ে আমার নাকের হাড়টা ভেঙে দিয়েছে।”

কমান্ডার শুকনো স্বরে হা হা করে হেসে উঠল। বলল, “পৃথিবীর সেরা এজেন্সির কমান্ডোর নাকের হাড় ভেঙে দিয়েছে থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির ছোট একটা মেয়ে?”

“আমাকে সুযোগ দিন স্যার। এবারে মিশন হান্ড্রেড পার্সেন্ট সফল হবে স্যার।”

“যাও এজেন্ট। আমি ভেবে দেখি।”

.

১২.

রেস্টুরেন্টটা খুব সাদামাটা কিন্তু তারপরেও খুব সুন্দর। মনে হয় এখান থেকে পুরো সমুদ্রটা দেখা যায় তাই সাদামাটা হলেও এটাকে এতো সুন্দর দেখায়।

সেরিনা আর শামীম সামনা-সামনি বসে আছে। রাতের খাবার খেয়ে যখন তারা উঠে যাবে তখন সেরিনা শামীমের হাত ধরে বলেছে, “আব্বু, আরো একটু বস।”

শামীম বলল, “আরো একটু বসবি? ঠিক আছে।”

শামীম চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল “চা খাবি?”

সেরিনা মাথা নাড়ল বলল, “না, আব্বু চা খাব না।”

“আর কিছু খাবি?”

“না আলু আর কিছু খাব না। তুমি আমার সামনে বসে থাকো, আমি তোমাকে কাছে থেকে একটু ভালো করে দেখি।”

সেরিনার গলায় স্বরে কিছু একটা ছিল–হঠাৎ করে শামীম ভয়ানক চমকে উঠল, মুহূর্তে তার মুখ রক্তহীন হয়ে যায়। কাঁপা গলায় বলে, “তুই কি বলছিস সেরিনা?”

“হ্যাঁ আব্বু। ওরা এসে গেছে। তুমি পিছন দিকে তাকিও না। তাহলে সন্দেহ করবে। তোমার দুই টেবিল পিছনে একজন লোক বসেছে, বসে টেলিফোনে কথা বলছে। এই মানুষটাকে আজকে অনেকবার দেখেছি। আমাদের সাথে সাথে থাকছে।”

শামীম দুই হাতের উপর তার মাথা রাখল, মনে হল হঠাৎ করে তার শরীরের ভেতর থেকে পুরো জীবনীশক্তি বাতাসের মতো উবে গেছে।

সেরিনা হাত দিয়ে শামীমকে স্পর্শ করল। নিচু গলায় বলল, “আব্বু তুমি এতো মন খারাপ করো না। তুমিও জান আমিও জানি একদিন এই দিনটা আসবে। অনেকদিন থেকে জানি। আজকে এই দিনটা এসেছে।”

শামীম শূন্য দৃষ্টিতে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। দেখে মনে হলো সেরিনা কী বলছে বুঝতে পারছে না। সেরিনা নরম গলায় বলল, “আব্বু, তুমি আর আমি কতোদিন থেকে এই দিনটার জন্যে রেডি হয়েছি, মনে আছে?”

শামীম মাথা তুলে সেরিনার দিকে তাকাল, বলল, “এই দিনটার জন্যে কখনো রেডি হওয়া যায়?”

“যায় আব্বু। আমি হয়েছি। তুমি আমাকে রেডি করেছ। তুমি আমাকে সমুদ্রের কাছে এই সুন্দর দ্বীপটাতে নিয়ে এসেছ। যখন ওরা আমাকে ধরতে আসবে তখন আমি সমুদ্রের মাঝে লুকিয়ে যাব! পানির নিচে ওরা আমাকে খুঁজে পাবে না। বেশী দিন নয় আব্বু মাত্র এক বছর!”

“মাত্র এক বছর?” শামীম কেমন যেন হাহাকারের মতো শব্দ করল।

“হ্যাঁ, আব্বু এক বছর পর ট্রাকিওশানের ব্যাটারী ফুরিয়ে যাবে তখন আবার আমি ফিরে আসব। তখন তারা আর আমাকে ধরতে পারবে না।”

শামীম কিছু না বলে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটাকে সে রক্ষা করতে পারল না। পৃথিবীর দানবেরা তার এই ছোট মেয়েটিকে তার বুকের ভেতর থেকে কেড়ে নিল।

সেরিনা শামীমের দিকে একটু ঝুঁকে নিচু গলায় বলল, “আব্বু তুমি আমাকে রেডি করেছ। আকাশের সব নক্ষত্র চিনিয়ে দিয়েছ যেন আমি রাতের আকাশ দেখে সময় বলতে পারি। পৃথিবীর কোথায় আছি জানতে পারি। তুমি আমাকে পৃথিবীর সমুদ্রের স্রোত শিখিয়েছ, জাহাজের পথ শিখিয়েছ। তুমি আমকে সমুদ্রের সব প্রাণীদের চিনিয়েছ–আলু বিশ্বাস কর

আমি এখন খুব আগ্রহ নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার জন্যে অপেক্ষা করছি।”

শামীম জানে সেরিনা এই কথাগুলো বলছে তাকে শান্তনা দেবার জন্য কিন্তু তবুও সে কথাগুলো বিশ্বাস করতে চাইল। শামীম ফিস ফিস করে বলল, “আমি তোকে রক্ষা করতে পারলাম না মা। অনেক চেষ্টা করেছি মা–”

“আমি জানি তুমি কতো চেষ্টা করেছ–কিন্তু তুমি আমাকে রক্ষা করেছ আব্বু–তারা আমাকে ধরে নিতে পারবে না। আমি সমুদ্রের মাঝে লুকিয়ে যাব! আর আমাকে খুঁজে পাবে না।”

শামীম ফিসফিস করে বলল, “তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস মা–”

সেরিনা বলল, “তুমি এভাবে কথা বল না আব্বু। প্লীজ তুমি এভাবে কথা বল না। তাহলে আমি কিন্তু কাঁদতে আরম্ভ করব।”

শামীম বলল, “না। তুই কাদিস না।”

“আমার জন্যে তুমি একটুও চিন্তা করো না আব্বু। তুমি জান আমি মাটির ওপরে যতটুকু সহজে থাকতে পারি তার চাইতে অনেক সহজে পানির নিচে থাকতে পারি। একটা বিলের নিচেই কতো কী থাকে আর সমুদ্রের তলায় কতো কী থাকবে তুমি চিন্তা করতে পার আব্বু? তোমার জানতে ইচ্ছে করে না? এক বছর পর এসে আমি তোমাকে বলব! তখন তুমি আর আমি আবার একসাথে থাকব! মাত্র এক বছর আব্বু!”

শামীম কোনো কথা না বলে সেরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। আলেক্স তাকে বলেছিল সেরিনাকে যেন এক সাথে বেশীদিন পানির নিচে থাকতে না দেয় তাহলে ধীরে ধীরে সে ফুসফুস ব্যবহার করা ভুলে যাবে। এক বছর যদি পানির নিচে থাকে তাহলে কী সে আবার শুকনো মাটির ওপর ফিরে আসতে পারবে? শামীম জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল। কোনো কথা না বলে সেরিনার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল।

সেরিনা নিচু গলায় বলল, আলু, “এই মাত্র আরেকজন মানুষ ঢুকেছে। মানুষটা আগের জনের সাথে বসেছে। আমাদের এখন উঠে যেতে হবে, আর দেরী করা যাবে না।

শামীম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আয় যাই।”

দুজন যখন রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল তখন তাদের টেবিল থেকে দুই টেবিল পিছনে বসে থাকা মানুষ দুজনও উঠে দাঁড়াল। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে তারাও সেরিনা আর শামীমের পিছু পিছু হটতে থাকে।

এই দ্বীপটি নির্জন। শীতের কয়েক মাস অনেক পর্যটক এসে ভীড় করে তারপর হঠাৎ করে পর্যটকদের ভীড় কমে গিয়ে দ্বীপটা নির্জন হয়ে যায়। এখন দ্বীপটিতে বাইরের মানুষ বলতে গেলে কেউ নেই। বালু বেলায় যতদূর চোখ যায় কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। অনেক দূরে কয়েকটা জেলে নৌকা সমুদ্রের ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে। সূর্য ডুবে গেছে অনেক আগে কিন্তু পূর্ণিমার ভরা চাঁদ উঠেছে আকাশে, জোছনার আলোতে চারিদিক থই থই করছে।

বালুতে পা গেঁথে যাচ্ছিল, তখন সেরিনা পা থেকে স্যান্ডেল খুলে নিল, তার আর স্যান্ডেলের দরকার নেই। পায়ের তলায় বালুর অনুভূতিটা অন্যরকম, সেরিনার বুকের ভেতর অতীতের এক ধরণের স্মৃতি নিয়ে আসে কিন্তু সেই স্মৃতিটা কবেকার সে মনে করতে পারে না।

শামীম হাত দিয়ে সেরিনাকে ধরে রেখেছে, সেরিনাও তার হাত দিয়ে তার আবুকে ধরে রেখেছে। দুজনেই জানে একটু পর একজনের আরেকজনকে ছেড়ে দিতে হবে তারপর কেউ কাউকে দেখতে পারবে না, স্পর্শ করতে পারবে না। কোনো কথা না বলে হেঁটে হেঁটে দুজন সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ালো। জোয়ার শুরু হয়েছে, ঢেউগুলো একটু পর পর বালু বেলায় আছড়ে পড়তে শুরু করেছে।

শামীম আর সেরিনা দাঁড়িয়ে গেল, বড় একটা ঢেউ এসে দুজনের পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। শামীম মাথা ঘুরিয়ে পিছন দিকে তাকায়, দূরে কয়েকটা ছায়ামূর্তির মতো দেখা যাচ্ছে তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। অনেক দূরে একটা চাপা গুঞ্জন, মনে হয় একটা হেলিকপ্টার। সাথে সাথে শক্তিশালী কয়েকটা ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ছে কমছে, মনে হয় বেশ কয়েকটা স্পীড বোট

এদিকে আসছে। আসুক–এখন আর কিছুতেই কিছু আসে যায় না।

সেরিনা তার আব্বুকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “আব্বু, আমি যাই?”

শামীম বলল, “যাই বলতে হয় না মা। বলতে হয় আসি।”

সেরিনা বলল, “আবু আমি আসি?”

“আয় মা।” শামীম সেরিনাকে ছেড়ে দিল, হঠাৎ তার বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে কিন্তু সে সেরিনাকে বুঝতে দিল না। সেরিনা শেষবার তার আব্বুকে গভীরভাবে আলিঙ্গন করে ছেড়ে দেয়।

শামীম ফিসফিস করে বলল, “মনে আছে তো মা, যখন সূর্য ডোবার। পর কালপুরুষ নক্ষত্রটা ঠিক মাথার উপর থাকবে তখন যেদিন পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে তখন আমি ঠিক এই জায়গায় তোর জন্যে অপেক্ষা করব। চাঁদের আলোতে এখানে বসে থাকব।”

“মনে আছে আব্বু।”

পিছনে হঠাৎ অনেকগুলো মানুষের পায়ের ধুপ ধাপ শব্দ শুনতে পায়, কিছু মানুষ ছুটে আসছে। শামীম পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করল না, কারা আসছে, কতজন আসছে তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। হেলিকপ্টারের শব্দটা এখন খুব কাছে, স্পীড বোটের গর্জন আরো বেড়ে গেছে, সেগুলো এখন আবছা দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রের পানি কেটে তাদের দিকে ছুটে আসছে।

তার মাঝে সেরিনা এক পা এক পা করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই। বড় একটা ঢেউ এসে সেরিনাকে আড়াল করে দিল, ঢেউটা সরে যেতেই আবার সেরিনাকে দেখা গেল, জোছনায় আলোতে সেরিনা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। শামীম তাকিয়ে রইল, সেরিনা আবছা হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে আরো একটি বড় ঢেউ এল তারপর আর সেরিনাকে দেখা গেল না।

অনেকগুলো মানুষের গলায় আওয়াজ শুনতে পেল শামীম, কেউ একজন খপ করে তার ঘাড়ে ধরেছে, “কোথায়? কোথায় গেছে মেয়েটা।”

শামীম ঘাড় ধরে রাখা মানুষটার হাত সরিয়ে বলল “চলে গেছে।”

“কোথায়? কোথায় গেছে মেয়েটা?”

“সমুদ্রে।”

“কখন আসবে?”

“আর আসবে না।” বলে শামীম ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে থাকে। ঠিক তখন বিকট গর্জন করে একটা স্পীডবোট পানি থেকে প্রায় লাফিয়ে বালুবেলায় উঠে যায়। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ লাফিয়ে নেমে শামীমের দিকে ছুটে আসতে থাকে। একজন চিৎকার করে বলল, “থাম।”

শামীম থামল না। মানুষটা বলল, “না থামলে গুলি করে দেব।”

শামীম হাঁটতে হাঁটতে বলল, “দাও। গুলি করে দাও। আমি চাই তোমরা কেউ একজন আমাকে গুলি করে দাও। আমার আর ভালো লাগছে না।”

কেউ গুলি করল না। শামীম একবারও পিছনে না তাকিয়ে হেঁটে যেতে থাকল।

.

সেরিনা তখন সমুদ্রের গভীরে সাঁতরে যেতে থাকে। তার চোখের লোনা পানি সমুদ্রের লোনা পানির সাথে মিশে যাচ্ছিল।

পুরো সমুদ্রটাই কী তার মতো দুঃখী মানুষের চোখের পানিতে তৈরী হয়েছে?