১১.
টাইম ক্যাপসুলের ভেতরে বসে বাইরে কী ঘটছে সেটা সম্পর্কে রিটিনের বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা ছিল না। সে জানত তাকে স্পেস টাইমের ফেব্রিকের ফুটো দিয়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয়া হবে, এরপরের অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে সেটি পৃথিবীর কেউ জানে না। রিটিন সেটা দেখার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ রিটিনের মনে হলো সে পড়ে যেতে শুরু করেছে। যেরকম হঠাৎ করে এই অনুভূতিটি শুরু হয়েছে ঠিক সেভাবেই আবার মনে হলো সে কোথাও আটকে গেছে। সে সত্যিই টাইম ক্যাপসুল দিয়ে সময় পরিভ্রমণ করতে শুরু করেছে কি না বুঝতে পারল না। যদি সত্যিই সে পরিভ্রমণ শুরু করে থাকে তাহলে বুঝতে হবে অভিজ্ঞতাটুকু চমকপ্রদ কিছু নয়।
ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ রিটিনের মনে হলো তার সমস্ত শরীর বিস্ময়কর এক শক্তির আকর্ষণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সে সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল কিন্তু মনে হলো তার শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণু বুঝি শরীর থেকে খুলে বের হয়ে যেতে শুরু করেছে। চোখের সামনে লাল একটি পর্দা নেমে আসে, সে কিছু দেখতে পায় না, সে কিছু চিন্তা করতে পারে না, কিছু শুনতে পায় না। রিটিনের সমস্ত অনুভূতি লোপ পেয়ে গেল। কিন্তু আশ্চর্য তারপরও রিটিনের নিজের অস্তিত্বের অনুভূতিটি লোপ পেল না। তার ভেতরে কোথা থেকে কে জানি তাকে মনে করিয়ে দিতে থাকে, আমি আছি। আমি আছি। আমি আছি।
ধীরে ধীরে রিটিনের সময়ের অনুভূতি লোপ পেতে থাকে। এই টাইম ক্যাপসুলে সে কী এক মুহূর্তের জন্যে আছে না এক সহস্র বছরের জন্যে আছে সে বুঝতে পারে না। তার মনে হতে থাকে সময় বলে কিছু নেই, কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না।
রিটিনের মনে হতে থাকে সবকিছু স্থির হতে শুরু করেছে, তার হৃৎস্পন্দন যেন ধীরে ধীরে থেমে আসতে শুরু করেছে। একটি হৃৎস্পন্দন থেকে অন্য হৃৎস্পন্দনের ভেতর অনন্তকাল সময় পার হয়ে যেতে থাকে কিন্তু তবু তার মনে হতে থাকে সে বেঁচে আছে। তার অস্তিত্ব বেঁচে আছে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় আছে সে জানে না কিন্তু সে যে আছে সেটি সে জানে।
এভাবে কতকাল কেটে গেছে রিটিন জানে না। তার মনে হতে থাকে সেটি জানা না জানার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো কিছুতে তার আর কিছু আসে যায় না। তাকে শুধু অনন্তকাল এভাবে বেঁচে থাকতে হবে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে শেষকাল সে এভাবে স্থির সময়ে ভেসে থাকবে। যার কোনো শুরু নেই। যার কোনো শেষ নেই।
.
১২.
রিটিন চোখ খুলে তাকাল। তীব্র আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে আবার তার চোখ বন্ধ করে ফেলে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। সে কোথায়। খুব ধীরে ধীরে তার মনে পড়তে থাকে সে সময় পরিভ্রমণের জন্যে একটা টাইম ক্যাপসুলে করে রওনা দিয়েছিল। সে কি তাহলে তার গন্তব্যে পৌঁছে গেছে?
রিটিন আবার চোখ খুলে তাকাল, তীব্র আলোতে চোখ অভ্যন্ত হয়ে যাবার পর সে টাইম ক্যাপসুলটি চিনতে পারে। সিলিন্ডারের মতো একটা খুপরির মাঝে সে শুয়ে আছে। শরীরের অনেকগুলো জায়গা স্ট্যাপ দিয়ে বাঁধা। রিটিন তার মাথাটা একটু নাড়ল, মাথার ভেতরে কোথায় জানি দপ দপ করে ওঠে। সে নিজের শরীরটা নাড়ানোর চেষ্টা করে, সাথে সাথে কোথায় জানি তীক্ষ্ণ ব্যথার একটি স্পন্দন অনুভব করে। রিটিন দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথার অনুভূতিটি কমে যাবার জন্যে অপেক্ষা করে তারপর আবার চারদিকে তাকাল।
রিটিন বুঝতে পারল তার টাইম ক্যাপসুলটি কোথাও আঘাত করেছে, সেই আঘাতের কারণে তার নিজের শরীরে এই যন্ত্রণার অনুভূতি। কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি থাকবে না। তার ডান হাতের চামড়ার নিচে যে ছোট ডিস্কটি রয়েছে সেটি তার শরীরের সকল যন্ত্রণা কিংবা রোগশোকের চিকিৎসা করবে, তাকে সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না।
রিটিন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে শুয়ে রইল। সত্যি সত্যি তার শরীরের ব্যথার অনুভূতি কমতে কমতে একসময় সারা শরীরে আরামের এক ধরনের কোমল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রিটিন তখন তার কুঠুরির ভেতর উঠে বসে হাত-পা এবং শরীরের স্ট্যাপগুলো খুলে নেয়। তারপর সে তার নির্ধারিত কাজগুলো করতে শুরু করে। টাইম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে একটি অণু বা পরমাণুও বের হতে পারবে না, ভেতর থেকে বাইরে কিছু দেখারও কোনো উপায় নেই। এখন সে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, এখন বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে। টাইম ক্যাপসুলের দেয়ালে ভেতর থেকে কাঁপন সৃষ্টি করে সেই কম্পনের প্রতিধ্বনি শুনে বাইরে কী আছে সেটা অনুমান করার একটা ছোট যন্ত্র দেয়া হয়েছে, রিটিন এখন সেটা ব্যবহার করতে শুরু করল।
সে দেখতে পেল তার ডানে, বামে, সামনে, পেছনে এবং নিচে বহুদূর পর্যন্ত কোনো এক ধরনের কঠিন পদার্থ, ঘনত্ব দেখে মনে হয় মাটি। উপরেও সেই একই পদার্থ তবে কয়েক মিটারের বেশি নয়। অর্থাৎ সে সম্ভবত, কোনো একটি জায়গায় মাটির নিচে এসে উপস্থিত হয়েছে। এটা নিয়ে অনুমান করার চেষ্টা না করে তার এর ভেতর থেকে বের হওয়া উচিত। সে সাবধানে টাইম ক্যাপসুলের ঢাকনাটি খুলতে শুরু করল।
উপরে অনেকখানি মাটি, টাইম ক্যাপসুলের হাইড্রোলিক সিস্টেম ঠেলে ঢাকনাটা খুলতে থাকে। বাইরে কী আছে সে জানে না, প্রথমেই তার বের হওয়া ঠিক হবে না। রিটিন মাটি ফুটো করে উপরে একটি প্রোব পাঠাল এবং সেটার ভেতর দিয়ে প্রথমবার চারপাশের পৃথিবীটা দেখতে পেল। জায়গাটি নির্জন, আশেপাশে কোনো মানুষ নেই। ঝোঁপঝাড় আছে এবং কয়েকটা বড় বড় গাছ আছে। রিটিন একটা প্রজাপতিকে উড়ে যেতে দেখলো। বাতাসে গাছের পাতা নড়তে দেখল এবং তার একটি শিরশির শব্দ শুনতে পেল।
জায়গাটি নিরাপদ, রিটিন ইচ্ছে করলে বের হতে পারে। তাকে পাঁচশ বছর আগের মানুষের পোশাক দেয়া হয়েছে, এই সময়ের টাকার নোট, কিছু ছোট খাটো যন্ত্রপাতিও আছে। রিটিন পোশাক পাল্টে একটা ছোট ব্যাগে কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে, ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বাইরে বের হওয়ার কাজ শুরু করে দিল।
খানিকটা মাটি সরিয়ে একটা গর্তের মতো করা হয়েছে, রিটিন সেই গর্ত দিয়ে বের হয়ে আসে। শরীরে মাটি লেগে গিয়েছিল। সে হাত দিয়ে পরিষ্কার করে গর্তের মাঝে পা ঝুলিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। একবার সে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল, বাতাসে বিচিত্র এক ধরনের সজীবতা, সাথে একধরনের বুনো ফুলের গন্ধ। রিটিন আকাশের দিকে তাকাল, নীল আকাশে সাদা মেঘ, সময়টা মনে হয় শরৎকাল। সূর্য ঢলে পড়েছে মনে হয়, একটু পরেই অন্ধকার নেমে আসবে।
রিটিন উঠে দাঁড়াল, সে কোথায় আছে জানতে হবে। মানুষের জনবসতি খুঁজে বের করতে হবে। পৃথিবীতে এখন কত সাল সেটি জানতে হবে সবার আগে। তার কাছে এগুলো বের করার যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোকে এই সময়ের উপযোগী যন্ত্রপাতির মতো একটা রূপও দেয়া হয়েছে, হঠাৎ করে কেউ দেখলে সন্দেহ করবে না। কিন্তু রিটিন এখনই সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হতে চাইছে না–তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই, বলা যেতে পারে, তার হাতে অফুরন্ত সময়।
এখানে তার কালো চুলের হাসিখুশি একটা মেয়ের সাথে দেখা হওয়ার কথা। মেয়েটাকে সে কেমন করে খুঁজে বের করবে জানে না। সেটি নিয়ে রিটিন অবশ্যি চিন্তিত নয়, প্রকৃতি নিশ্চয়ই তাদের দুজনের দেখা করিয়ে দেবে।
রিটিন তার ছোট ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে। জায়গাটা সুন্দর, সবুজ বড় বড় ঘাস, ঝোঁপঝাড় এবং মাঝে মাঝে বড় গাছ। এগুলো কী গাছ কে জানে, তার নিজের পৃথিবীতে যতদিন তার ট্র্যাকিওশান ছিল সেটা ব্যবহার করে মুহূর্তের মাঝে সব তথ্য বের ১০৪
করে ফেলতে পারত। ট্র্যাকিওশান ফেলে দেয়ার পর সে আর কোনো তথ্য যখন খুশি জানতে পারত না। পাঁচশ বছর আগের পৃথিবীটা তার কাছে এখন ট্র্যাকিওশানহীন পৃথিবীর মতো। একটা গাছ দেখলেও সেটি কী গাছ সে নিজে নিজে কখনো জানতে পারবে না।
হাঁটতে হাঁটতে রিটিনের মনে হলো সে একটা জলধারার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। রিটিন কোনো দিন একটা প্রাকৃতিক পরিবেশে কোনো জলধারা বয়ে যেতে দেখেনি। এই পৃথিবীতে হয়তো সে প্রথমবার সেটি দেখতে পাবে। রিটিন জলধারার সেই ক্ষীণ শব্দ অনুসরণ করে হাঁটতে থাকে।
ধীরে ধীরে শব্দটি আরো স্পষ্ট হলো এবং রিটিন আবিষ্কার করল সামনে হঠাৎ করে মাটি নিচে নেমে গিয়েছে। নিচে পাথর এবং সেই পাথরের উপর দিয়ে একটা জলধারা অনেকটা নিজের মনে বয়ে যাচ্ছে। পানির স্রোত বেশ প্রবল এবং পাথরে ধাক্কা খেয়ে পানির একটি বিচিত্র শব্দ এলাকাটিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
পুরো এলাকাটি আশ্চর্য রকম নির্জন, পানির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রিটিন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। পাথরে ভর করে নিচে নেমে পানিটাকে তার হাত দিয়ে স্পর্শ করার প্রবল ইচ্ছা হলো! ঠিক কোন দিক দিয়ে নামা সবচেয়ে সহজ হবে বোঝার জন্যে সে ডানে বামে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল। নিচে একটা বড় পাথরের পাশে একটি শিশু পড়ে আছে। শিশুটি নড়ছে না, বেঁচে আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
রিটিন তার ব্যাগ থেকে স্পেস ভিউয়ার বের করে চোখে লাগিয়ে শিশুটিকে দেখার চেষ্টা করল। শিশুটি বেঁচে আছে, তবে জ্ঞান নেই। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক, পাঁজর এবং পায়ের হাড় ভেঙে গেছে, সাথে সাথে মাথায়ও আঘাত পেয়েছে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এই মুহূর্তে উদ্ধার করে চিকিৎসা করা দরকার। রিটিনের পৃথিবীতে এই শিশুটিকে বাঁচানো সম্ভব, এই পাঁচশ বছর আগের এই পৃথিবীতে সম্ভব কি না রিটিন সেটি জানে না।
রিটিন সময় নষ্ট না করে পাথরের উপর পা দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে থাকে। নিচে নেমে সে ছোট নদীটির পাশে ছোট-বড় পাথরে পা দিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে শিশুটির কাছে পৌঁছাল। রিটিন তার জীবনে গুরুতর আহত কোনো মানুষকে কখনো দেখেনি, তাদেরকে কীভাবে দেখতে হয় সে জানে না। শিশুটি উপর থেকে গড়িয়ে নিচে এসে পড়েছে, শরীর ক্ষত-বিক্ষত। শরীরের হাড় ভেঙেছে কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে মাথার আঘাত। করোটির হাড় ভেঙে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রিটিন আবার তার স্পেস ভিউয়ার বের করে সেটার ভেতর দিয়ে শিশুটিকে দেখল, স্পেস ভিউয়ারে সে লালরঙের একটি অ্যালার্ম দেখতে পায়। শিশুটিকে দ্রুত চিকিৎসা দিতে হবে, তা না হলে তাকে বাঁচানো যাবে না। কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে, সেটাও রিটিন স্পেস ভিউয়ারে দেখতে পেল। দুই সিসি ট্র্যাকিনল তার শরীরের রক্তে মিশিয়ে দিতে হবে। তার কাছে কিছু ট্র্যাকিনলের এম্পুল আছে, সেগুলো দেয়ার সময় তাকে অনেকবার সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এগুলো কোনোভাবেই অর্ধসহস্র বছর আগের কোনো মানুষকে চিকিৎসা করার জন্যে ব্যবহার করা যাবে না। এগুলো একান্তভাবেই রিটিনের নিজের জন্যে, যদি সে কখনো গুরুতর আহত হয় তখন যেন সে নিজের জন্যে ব্যবহার করে–অন্য কারো জন্যে নয়।
রিটিন আপাতত নিয়ম-কানুনের মাঝে গেল না। ব্যাগ থেকে ট্র্যাকিনলের একটা এম্পুল নিয়ে সেখান থেকে দুই সিসি স্বচ্ছ তরল সিরিঞ্জ দিয়ে বের করে শিশুটির গলার কাছে একটা আর্টারিতে ঢুকিয়ে দিল। তারপর সাবধানে শিশুটিকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। দুই পা অগ্রসর হতেই সে দেখল একটা খেলনা ডাইনোসর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নিশ্চয়ই এই শিশুটির ডাইনোসর, সম্ভবত উপর থেকে সেটি নিচে পড়ে গেছে। শিশুটি তার প্রিয় খেলনাটিকে উদ্ধার করার জন্যে পাথর বেয়ে নামতে চেষ্টা করেছে–মাঝখানে পা পিছলে নিচে এসে পড়ছে।
রিটিন নিচু হয়ে এক হাতে খেলনাটি তুলে নিল। যে খেলনার জন্যে এত বড় বিপর্যয়, সেটি এভাবে এখানে ফেলে রেখে যাওয়া যাবে না।
শিশুটিকে পাঁজকোলা করে রিটিন সাবধানে উপরে উঠে এল, এখন তার বাবা-মাকে খুঁজে বের করতে হবে। এত ছোট শিশু নিশ্চয়ই একা একা এই নির্জন এলাকায় চলে আসেনি। তার বাবা-মা নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে। স্পেস ভিউয়ারের সেটিং পাল্টে সে ইচ্ছে করলে আশপাশে জনবসতি খুঁজে বের করতে পারে, কিন্তু তাহলে শিশুটিকে প্রথমে নিচে নামিয়ে রাখতে হবে। রিটিন তাকে এখন মাটিতে শোয়াতে চাইল না, শিশুটিকে পাঁজকোলা করে ধরে সামনে এগোতে লাগল।
এমন সময় সে দূর থেকে একটা নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেল, কণ্ঠস্বরে একধরনের আতঙ্ক, প্রাণপণ চিৎকার করে সে কাউকে ডাকছে। রিটিন বুঝতে পারল নিশ্চয়ই এই শিশুটির মা, তার সন্তানকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
রিটিন গলার স্বর লক্ষ করে ছুটে যেতে থাকে এবং কয়েক মিনিটের মাঝেই সে মেয়েটির দেখা পেল। নীল জিনসের একটা ট্রাউজার আর হাতকাটা গোলাপি একটা গেঞ্জি পরে আছে। মাথায় একটা লালরঙের রুমাল বেঁধে রেখেছে। রিটিনকে পাজকোলা করে শিশুটিকে নিয়ে আসতে দেখে মেয়েটি একটা আর্তচিৎকার করে ছুটে এল। শিশুটিকে খপ করে ধরে চিৎকার করে ডাকল, “নীল! নীল–বাবা আমার।”
রিটিন মেয়েটির কথা বুঝতে পারছে, রওনা দেবার আগে তাকে এই প্রাচীন ভাষাটি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে। রিটিন সাবধানে যতটুকু সম্ভব সঠিক উচ্চারণ করে বলল, “একে হাসপাতালে নিতে হবে। এক্ষুনি।”
“হাসপাতাল?” মেয়েটা একধরনের অসহায় ব্যাকুল দৃষ্টিতে রিটিনের দিকে তাকাল, মনে হলো সে রিটিনের কথা বুঝতে পারছে না।
“হ্যাঁ। হাসপাতাল। উপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে অনেক ব্যথা পেয়েছে।”
মেয়েটা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল, শিশুটিকে জাপটে ধরে বলতে লাগল, “নীল! আমার নীল। বাবা আমার
রিটিন সাবধানে শিশুটিকে ধরে রেখে শান্ত গলায় বলল, “তুমি এখন একটু শান্ত হও। কীভাবে একে হাসপাতালে নেয়া যায় সেটি বলো। প্লিজ। সময় নেই আমাদের হাতে।”
“মেয়েটি চোখ মুছে ভাঙা গলায় বলল, আমার বাসার সামনে গাড়ি আছে।”
“চলো তাহলে। কোনদিকে যাব?”
মেয়েটা তখন কাঁদতে কাঁদতে ছুটতে থাকে। রিটিন তার পিছু পিছু শিশুটিকে নিয়ে যেতে থাকে। একটু সামনেই হঠাৎ করে একটা কাঠের বাসা দেখা গেল, তার সামনে একটা সাদা রঙের ভ্যান।
মেয়েটা ছুটে গিয়ে ভ্যানের দরজা খুলে রিটিনের দিকে তাকাল। রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি গাড়ি চালাতে পারবে?”
“পারব।”
“চমৎকার। তুমি গাড়ি চালাও। আমি পেছনে তোমার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসছি।”
রিটিন শিশুটিকে কোলে নিয়ে গাড়ির পেছনে বসল। শিশুটির মাথা থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে রিটিনের ট্রাউজার ভিজে যেতে থাকে।
মেয়েটি গাড়ি স্টার্ট করে প্রায় গুলির মতো সেটাকে ছুটিয়ে নিতে থাকে। স্টিয়ারিং হুইল শক্ত হাতে ধরে ভাঙা গলায় বলতে থাকে, “ছেলেটা এত দুষ্টু, ঘরে থাকতে চায় না, কখন যে বের হয়েছে জানি
–তুমি না থাকলে খুঁজে পেতে কতক্ষণ লাগত কে জানে! তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব–”
রিটিন বলল, “আমাকে তোমার ধন্যবাদ দিতে হবে না।”
মেয়েটি বলল, “কী মনে হয় তোমার? নীল কি খুব বেশি ব্যথা পেয়েছে? ভালো হয়ে যাবে না? সুস্থ হয়ে যাবে না?”
রিটিন নরম গলায় বলল, “নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে।”
“হায় ঈশ্বর! বাপ-মরা ছেলেটার কপালে তুমি আর কত কষ্ট দেবে?”
মেয়েটি অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালাতে থাকে। সরু একটা রাস্তা, আঁকাবাঁকা পথ, মাঝেমধ্যে অন্যদিক থেকে কোনো একটা গাড়ি আসছে। একসময় একটা শহরতলির মাঝে গাড়ি ঢুকল। কিছু মানুষজন দেখা গেল। দোকানপাট রেস্টুরেন্ট নাইট ক্লাব পার হয়ে গাড়িটি হাসপাতালের সামনে দাঁড়াল। মেয়েটা গাড়ি থামিয়ে ছুটে এসে রিটিনের জন্যে দরজা খুলে দেয়। রিটিন শিশুটিকে পাঁজাকোলা করে গাড়ি থেকে নামল। হাসপাতালের ভেতর থেকে একজন একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসে, রিটিন সাবধানে শিশুটিকে সেখানে শুইয়ে দিতেই স্ট্রেচার ঠেলে তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। মেয়েটি স্ট্রেচারের সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে গেল।
রিটিন এখন কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না। এখানে কোথায় অপেক্ষা করতে হয় সে ঠিক ভালো করে জানে না। পাঁচশ বছর আগের পৃথিবীটা তার পরিচিত পৃথিবী থেকে এত ভিন্ন যে রিটিন কেমন জানি অসহায় অনুভব করে। চারপাশে অনেক মানুষ, রিটিন একধরনের বিস্ময় নিয়ে এই মানুষগুলোকে দেখে। এদের মাঝে সব ধরনের মানুষ আছে। রিটিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তার পৃথিবী থেকে এই পৃথিবীর মানুষের বৈচিত্র্য অনেক বেশি।
রিটিন ঠিক কী করবে বুঝতে পারছিল না। শিশুটির এমনিতে বেঁচে যাবার কোনো উপায় ছিল না। দুই সিসি ট্র্যাকিনল শিশুটির শরীরে দিয়ে দেয়ার কারণে সম্ভবত বেঁচে যাবে। ট্র্যাকিনল তার শরীরের ক্ষতস্থানগুলোতে নতুন কোষ তৈরি করা শুরু করবে। এই সময়ের ডাক্তাররা যদি ভালো করে পরীক্ষা করে তাহলে কী ঘটছে সেটা দেখে হতবাক হয়ে যাবে। কিন্তু ডাক্তারেরা নিশ্চয়ই পরীক্ষা করবে না, ধরে নেবে আঘাতটা নিশ্চয়ই গুরুতর ছিল না, মনে হয়েছিল গুরুতর।
রিটিন অপেক্ষা করার জায়গাটিতে পায়চারি করতে থাকে। চারপাশের পরিবেশটুকু তার কাছে প্রায় সুররিয়াল মনে হয়। মানুষগুলো বিচিত্র, কথা বলার ভঙ্গি বিস্ময়কর-পাঁচশ বছরে মানুষের কি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন হয়েছে। যারা চারপাশে আছে তারা যদি কোনোভাবে বুঝতে পারে সে সুদূর ভবিষ্যৎ থেকে এসেছে তাহলে তাদের ভেতর কী রকম একটা প্রতিক্রিয়া হবে সে কল্পনাও করতে পারে না।
রিটিন কতক্ষণ পায়চারি করেছিল নিজেও বলতে পারবে না, হঠাৎ করে দেখতে পেল একটা দরজা খুলে মেয়েটি বের হয়ে আসছে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই রিটিন বুঝতে পারল শিশুটির শরীরে ট্র্যাকিনল কাজ করেছে। মেয়েটির মুখে হাসি, পুরো চেহারাটি আনন্দে ঝলমল করছে। প্রায় ছুটে রিটিনের কাছে এসে বলল, “নীল ভালো আছে।”
রিটিন বলল, “বাহ! কী চমৎকার।”
মেয়েটি বলল, “একটু বেশিই ভালো আছে।”
রিটিন বলল, “বেশি ভালো?”
“হ্যাঁ। তুমি যখন তাকে কোলে করে আনছিলে আমার মনে হচ্ছিল মাথায় অনেক ব্যথা হয়েছে, মনে হচ্ছিল করোটি ভেঙে গেছে, আসলে কিছু হয় নি। শুধু চামড়া একটু কেটে গেছে।”
“সত্যি?”
মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। হাত-পা কেটে গিয়েছিল মনে আছে?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ মনে আছে।”
“এখন কোনো কাটা নেই। আশ্চর্য না?”
রিটিন মাথা নাড়ল, বলল, “আশ্চর্য।”
“ডাক্তারেরা দৌড়াদৌড়ি করে অস্ত্রোপচার করার জন্যে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে গেছে, একটু পরে দেখে নীল অপারেশন থিয়েটারে পা তুলে বসে আছে!”
“সত্যি?”
“সত্যি। চারপাশে ডাক্তার নার্স দেখে ভয় পেয়ে কাঁদছিল, তখন আমাকে ডেকে নিয়ে গেছে।”
রিটিন জিজ্ঞেস করল, “তারপর?”
“আমাকে দেখে তার ভয় কেটে গেল, তখন ডাক্তার নার্সের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে!”
রিটিন হাসল, বলল, “কী চমৎকার।”
মেয়েটা বলল, “আমি কি ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল নীল বুঝি মরেই যাবে।”
রিটিন কিছু বলল না। মেয়েটির মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, সে নিচু গলায় বলল, “তুমি একটি জিনিস জানো?”
“কী জিনিস?”
“নীল কিন্তু আসলেই খুব গুরুতর আঘাত পেয়েছিল। আমি জানি। মায়ের মন কখনো মিথ্যা বলে না।”
রিটিন বলল, “কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ–”
“আমি যেটা দেখছি সেটা একটা স্বপ্নের মতো। সেটা হওয়া সম্ভব ছিল না–”
“কিন্তু হয়েছে।”
“হ্যাঁ হয়েছে। সে জন্যে আমি এটাকে প্রশ্ন করব না—কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
মেয়েটা হঠাৎ কথা না বলে রিটিনের মুখের দিকে তাকাল, তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”
রিটিন হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমার নাম রিটিন। রিটি রিটিন। তোমার ছেলে নিয়ে আমরা এত ব্যস্ত ছিলাম যে পরিচয় করার কথা মনে পড়েনি।”
মেয়েটি তার হাতটা সামনে বাড়িয়ে বলল, “আমার নাম তানুস্কা।”
রিটিন বলল “তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম তানুস্কা।”
তানুস্কা নামের মেয়েটা বলল, “সত্যি করে বলো দেখি তুমি কে?”
“বলেছি।” রিটিন একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “আমি রিটিন।”
তানুস্কা হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়, তারপর মাথা ঘুরিয়ে রিটিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই যে তুমি বিচিত্র একটা উচ্চারণে কথা বলছ, আমার কেন জানি মনে হয়, এটা আমার খুব পরিচিত। এই যে তুমি বলছ তোমার নাম রিটিন, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নামটাও আমি জানি। আর–”
“আর কী?”
“কেন জানি মনে হচ্ছে তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি। মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার আগে দেখা হয়েছে!”
রিটিনের মনে হলো সে বলে যে, হ্যাঁ, আমার সাথে তোমার দেখা হয়েছে। তোমার সাথে আর নীলের সাথে আমার একটা ছবি আছে। সেই ছবিটাকে সত্যি করার জন্যে আমি পাঁচশ বছর ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি। আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে হবে। আমি সে জন্যে এই পৃথিবীতে এসেছি।
রিটিন অবশ্য তার কিছুই বলল না, সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মানুষের মস্তিষ্ক খুবই বিচিত্র! এটা কখন কীভাবে কাজ করবে কেউ বলতে পারে না।”
তানুস্কা কোনো কথা না বলে এক দৃষ্টে রিটিনের দিকে তাকিয়ে রইল।