১১-১২. ইরফান হাবিবের ম্যাপ চুরি

১১. ইরফান হাবিবের ম্যাপ চুরি

বিকেলে চা খেয়ে আমরা আর কোথাও যাই নি। রাতে মেহমান আসবেন–নেলী খালার ড্রইংরুম গোছালাম সবাই মিলে। বইগুলো সব তিনটা বড়ো কাঠের বাসে বোঝাই ছিলো। সেগুলো বের করে ঝেড়ে-মুঝে দেয়ালজোড়া বুক শেলফে সাজিয়ে রাখলাম। সোফার কুশনগুলোর কাপড় বদলালাম। ফুল এনে দুটো ফুলদানি সাজালাম। সব দেখে নানু পর্যন্ত বললেন, চমৎকার হয়েছে।

সাজানোর ব্যাপারে বাবুর কৃতিত্বটাই বেশি। হবে না কেন, ওর মতো আমরা কেউ তো ইনটেরিয়র ডেকোরেশেনের ক্লাশ করি নি। যদিও ও খুঁত খুঁত করছিলো মাপ মতো একটা পেইন্টিং-এর জন্য। নেলী খালা বললেন, কিসসু ভেবো না বাবু। আর্ট কলেজে হাশেম খান আছেন, তোমাদের জাহেদ মামার সঙ্গে এক স্কুলে পড়েছেন। গতবার আমাদের নুলিয়াছড়িতে বেড়াতে গিয়ে বলেছেন, বিয়েতে ওঁর একটা অয়েল পেইন্টিং উপহার দেবেন। জাহেদ ঠিকই ম্যানেজ করে ফেলবে।

রাতে প্রফেসর ইরফান হাবিবকে নিয়ে জাহেদ মামা অন্য দিনের চেয়ে একটু আগেই এলেন। সবার সঙ্গে প্রফেসরকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা তখন ড্রইংরুমে বসেছিলাম। প্রফেসরকে দেখে মনে হয় বয়স প্রায় ষাটের কাছে। ছোট খাট গড়ন, গোল গাল মুখ ভরা দাড়ি, পুরু লেন্সের চশমা চোখে। মাথা জোড়া টাক, ঘরে ঢোকার আগে অবশ্য ওটার ওপরে একটা ক্যাপ ছিলো। ক্যাপটা খুলতেই লাইটের আলো পড়ে গোল মাথাটা চকচক করে উঠলো। কথা বলতে বলতে আনমনে মাথার অদৃশ্য চুলগুলো হাত দিয়ে পরিপাটি করে দিচ্ছিলেন। বলাই বাহুল্য হাসি চাপতে আমাদের চারজনের খুব কষ্ট হচ্ছিলো। আমাদের নুলিয়াছড়ির কথা তিনি আগেই শুনেছিলেন জাহেদ মামার কাছে। সেজন্যে কিনা জানি না, আমাদের ওপর ওঁদের সার্ভে টীমের একটা কাজ চাপিয়ে দিলেন। বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই পাথারিয়া বেড়াতে এসে সারাদিন ঘরে বসে চাটাও না?

কি যে বলেন স্যার, জবাব দিলেন জাহেদ মামা–পখাওয়ার সময় ছাড়া ওদের দেখা পাওয়া ভার।

ওভাবে বললে কথাটা তোমার জন্যেও প্রযোজ্য। নাকি বৌমা? মুখ টিপে হেসে প্রফেসর তাকালেন নেলী খালার দিকে।

নেলী খালা শুধু লাজুক হাসলেন।

শোন ছেলেমেয়েরা, বাইরে যখন ঘুরতে যাও তখন এই বুড়োর একটা জিনিস কোথাও চোখে পড়ে কিনা দেখবে। এই বলে প্রফেসর রহস্য ভরা চোখে তাকালেন মামার দিকে।

কি জিনিস স্যার? জাহেদ মামার দেখাদেখি আমরাও প্রফেসরকে স্যার ডাকা শুরু করেছি।

পাথর। প্রফেসর মৃদু হেসে বললেন, কোনো অচেনা অদ্ভুত গড়নের বা রঙের পাথর পেলে তুলে নিও। শুধু খেয়াল রেখো পাথরটা কোথায় পেলে।

পাথর দিয়ে কি হবে স্যার? অবাক হয়ে জানতে চাইলো বাবু।

জানো না বুঝি, আমরা যে তেল খুঁজতে এসেছি। আমাদের অনুসন্ধানের কজে লাগবে। এই বলে কী যেন ভাবলেন। তারপর জাহেদ মামাকে বললেন, এ জায়গাটার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা বাংলাদেশের অন্য যে সব জায়গায় গ্যাস পাওয়া গেছে বা তেল পাওয়া যাবে বলে ভাবছি, সে সব জায়গায় দেখা যায় না।

টুনি বললো, মণিপুরি দিদিমা বলেছেন এ জায়গাটার ওপর নাকি অভিশাপ আছে। কি সব অতৃপ্ত আত্মারা অমাবস্যার রাতে ঘুরে বেড়ায়।

নেলী খালা মৃদু গলায় বললেন, আবার আজেবাজে কথা বলছো টুনি?

মণিপুরি দিদিমা কে? প্রফেসর আমাকে প্রশ্ন করলেন।

এই এলাকার সবচেয়ে পুরনো মানুষ। একশর ওপর বয়স।

এসব আজেবাজে কথা বলে বুড়িটা আশ্রম খুলে ভালো ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। নেলী খালার গলায় বিরক্তির ছোঁয়া।

সব কিছু আজেবাজে বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না বৌমা। প্রফেসর খুব শান্ত গলায় বললেন, সার্ভে করতে গিয়ে আমি পৃথিবীর হেন দেশ নেই যে যাই নি। সব জায়গায় দেখেছি, বইয়ের চেয়ে অনেক সময় দরকারি তথ্য পাওয়া যায় স্থানীয় লোকজনের কাছে।

অতৃপ্ত আত্মা আর অভিশাপ নিশ্চয়ই কোনো দরকারি তথ্য হতে পারে না।

পারে বৌমা, পারে। কথাটা প্রফেসর এমনভাবে বললেন, যেন কোনো বাচ্চাকে বোঝাচ্ছেন-আবিরদের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে এখানে থার্টিজে যে অয়েল একসপিডিশন হয়েছিলো মণিপুরি বুড়ি সেটা জানে। তুমি কি ও বিষয়ে কিছু শুনেছো বৌমা? জানো এখানে কী ঘটেছিলো?

না তো! অবাক হয়ে বললেন নেলী খালা।

তাহলে? মুখ টিপে হেসে প্রফেসর বললেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে শেল অয়েল এখানে তেল আবিষ্কার করেছিলো। রিগ বসাতে গিয়ে তেলের প্রচণ্ড চাপে ওটা ভেঙে যায়। মুহূর্তের ভেতর পাহাড় থেকে বন্যার মতো তেলের স্রোত নেমে এসে কাছাকাছি একটা চা বাগানে ঢুকে সব সয়লাব করে দিয়েছিলো। অনেক লোক মারা গিয়েছিলো। বুড়ি হয়তো তাদের অভিশাপের কথা বলেছে।

আপনি বুড়ির আত্মার গল্প বিশ্বাস করেন?

বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করবো কিনা এ নিয়ে ভাববার সময় কখনো পাই নি। তবে আমার জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পাই নি।

নানু এতোক্ষণ চুপচাপ ছিলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর বললেন, প্রফেসর হাবিবের যদি ফেরার তাড়া না থাকে কিছুক্ষণ বসে কফি খেতে খেতে আপনার কিছু অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে পারি।

বিলক্ষণ! হেসে বললেন প্রফেসর, আপনার জামাই যদি আমাকে ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, তাহলে মাঝরাত অব্দি আড্ডা মারতে আমার আপত্তি নেই। তবে কফিটা জরুরি।

মৃদু হেসে নেলী খালা কফি আনতে গেলেন। আমরা সবাই ড্রইং রুমে গিয়ে বসলাম। প্রফেসর নানুকে জিজ্ঞেস করলেন, কি শুনতে চান বলুন।

নানু বললেন, সেই যে বলছিলেন, বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা খুঁজে পান নি।

একটু ভেবে প্রফেসর বললেন, আমি লক্ষ্য করেছি খনি এলাকার মানুষের ভয় আর কুসংস্কারের পরিমাণটা একটু বেশি। সেকেণ্ড ওয়ার্ড ওয়ারের ঠিক আগের কথা বলছি। আমি তখন ধানবাদের এক কয়লা খনিতে কাজ করি। তখনও কলেজে জয়েন করি নি। নতুন একটা জায়গা সার্ভে করে মনে হলো গ্যাস পাওয়া যাবে। সে সময় সার্ভের যন্ত্রপাতি এখনকার মতো সফিসটিকেটেড ছিলো না। জোরে সোরে কাজ করছি। যন্ত্রের অভাব মস্তিষ্ক আর শ্রম দিয়ে পূরণ করছি। আমাদের একটা এলাকা ছিলো ক্যাম্প থেকে মাইল খানেক দূরে। একদিন শুনি কুলিরা কাজ করবে না। খোঁজ নিয়ে দেখি এইসব অতৃপ্ত আত্মার ব্যাপার। ওরা বললো, রাতে পাহাড়ের ভেতর কারা নাকি কাঁদে। তখন ছিলো শীতকাল। আমার দুজন সহকর্মীকে নিয়ে পাহাড়ের কাছে তাঁবু গাড়লাম। রাতে খেয়ে দেয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে তাঁবুর পাশে আগুন জ্বেলে বসে গল্প করছি। কান খাড়া করে রেখেছি যদি কিছু শোনা যায়। কোথাও কোনো শব্দ নেই। অবাক হয়ে গেলাম, কোথাও ঝিঁঝি পোকার শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিলো না। আমার এক বন্ধু বললো, কুলিরা এত দূরে এসে কাজ করবে না, তাই কী সব বানিয়ে বলেছে আর তুমিও বিশ্বাস করে চলে এলে। ঠিক তখনই শুনলাম সেই শব্দ। মনে হলো বহু দূর থেকে আসছে চাপা একটা গোঙানির শব্দ। একটানা নয়, থেমে থেমে।

আমরা সবাই গোগ্রাসে গিলছিলাম প্রফেসরের ভূত দেখার গল্প। এক ফাঁকে। তাকিয়ে দেখি টুনি ভয়ে গোল হয়ে ললির গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে! মুখটা ঝুলে গেছে। বাবু ছিলো পাশে, ওর একটা হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। ভয় ছিলো বাবু আর ললির চোখেও। তবে নেলী খালা, জাহেদ মামা আর নানুর চোখে ছিলো কৌতূহল।

প্রফেসর বললেন, প্রথম দিকে মনে হচ্ছিলো গলা টিপে ধরলে যেরকম শব্দ বেরোয় সেরকম। একজন দুজন নয়, যেন কয়েকশ মানুষকে একসঙ্গে কোনো দানবীয় শক্তি গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছে। একটানা নয়, মাঝে মাঝে শব্দটা থেমে যাচ্ছিলো। তারপর শুরু হলো চাপা কান্নার শব্দ। এবার একটানা–হুঁ হু করে কাঁদছিলো কয়েকশ মানুষ। আমরা সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে গেছি। কখন যে আগুন নিভে গেছে টেরও পাই নি। অনেকক্ষণ শোনা গেলো সেই কান্নার শব্দ। তারপর এক সময় কান্নার শব্দ থেমে গেলো। ভোর হলো। পুরোনো তাবুতে ফিরে গেলাম। দুদিন ধরে দলবল নিয়ে পাহাড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। অস্বাভাবিক তেমন কিছু চোখে পড়লো না। বাইরে থেকে যা চোখে পড়ে–চারপাশে ঘন ঝোঁপঝাড়, জঙ্গল, পাহাড়ে কোনো গাছপালা নেই। মাটিও তেমন পাথুরে নয় যে গাছপালা গজাবে না। কিন্তু সেই পাহাড়টার এখানে বুনো ঘাসের শুকিয়ে যাওয়ার চিহ্ন ছাড়া আর কিছু ছিলো না। পরে শুনেছি ওখানে অনেক আগে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাহাড়ের ধ্বস নেমে কয়েকশ মানুষের জ্যান্ত কবর হয়েছিলো।

আমাদের আরো শোনার ইচ্ছে ছিলো প্রফেসরের এইসব অদ্ভুত অভিজ্ঞতার গল্প। নানু বললেন, রাত অনেক হয়েছে। জাহেদ, প্রফেসর হাবিবকে পৌঁছে দিয়ে এসো।

প্রফেসর উঠে মাথায় ক্যাপ পরলেন, হাতব্যাগ থেকে মাফলার বের করে গলায় জড়ালেন। আমাদের বললেন, জাহেদকে বলে কাজের এলাকায় সাধারণের প্রবেশ নিষেধ লিখে দিয়েছি। তবে তোমাদের জন্য সেটা প্রযোজ্য নয়। আশা করি আমার কাজের কথাটা মনে রাখবে।

প্রফেসরকে নিয়ে জাহেদ মামা বেরিয়ে গেলেন। নানুও উঠে গেলেন ওঁর ঘরে। নেলী খালা বললেন, তোমরা যে পাহাড়ে কিসের শব্দ শুনেছো বলছিলে সেটা কি সত্যি ললি?

ললি যে মিথ্যে কথা বলে না ওর উপর নেলী খালার এতটুকু বিশ্বাস ছিলো। ললি আস্তে আস্তে বললো, সত্যি শুনেছি নেলী খালা।

শব্দটা কি হার্টবিটের মতো?

হ্যাঁ নেলী খালা। ভারি একটা গমগমে শব্দ।

বুঝতে পারো নি কিসের শব্দ?

আমার একবার মনে হয়েছিলো সার্ভে টীমের কোনো মেশিনের শব্দ। জাহেদ মামা বললেন, ওরা নাকি নিজেদের এলাকার বাইরে কোথাও যায় নি। মণিপুরি দিদিমার আশ্রমে যাওয়ার পথে কথটা সেদিনই বলেছিলেন জাহেদ মামা।

ললির কথা শুনে বেশ চিন্তিত মনে হলো নেলী খালাকে। শুকনো গলায় বললেন, তোমরা শুতে যাও।

পরদিন সকালে জাহেদ মামা নাশতা খেয়ে বেরিয়ে গেছেন–একটু পরেই পুরোনো একটা জীপ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে প্রফেসর ইরফান হাবিব এলেন। কোথায়, মেজর কোথায়, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই বলে ধপ করে তিনি ড্রইংরুমের সোফায় বসে পড়লেন।

নেলী খালা ব্যস্ত গলায় বললেন, ও তো বড়লেখার দিকে গেছে। কী হয়েছে স্যার?

নেলী, আমার সর্বনাশ হয়েছে। ভাঙা গলায় প্রফেসর বললেন, যে সার্ভে ম্যাপটার বেসিসে কাজ করছিলাম, এক বছর ধরে যেটা তৈরি করেছিলাম সেই ম্যাপটা কাল রাতে কেউ চুরি করেছে।

সে কী! ম্যাপ চুরি করবে কে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন নেলী খালা–ভুলে কোথাও রাখেন নি তো।

না বৌমা। সব তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। আমার মনে হয় যখন তোমাদের এখানে ছিলাম তখনই কেউ এটা করেছে। আমার কত দিনের পরিশ্রম সব বরবাদ হয়ে গেলো। হাহাকার করে উঠলেন প্রফেসর।

আপনার দলের কেউ সরায় নি তো?

কী সব বোকার মতো কথা বলো মেয়ে! কর্কশ গলায় ধমকে উঠলেন প্রফেসর–দলের কেউ ওটা সরাতে যাবে কেন! আর ওদের সরাবার দরকারই-বা কি! ইচ্ছে করলে ওরা ট্রেস করে নিতে পারতো, চুরি করবে কেন?

আমি বুঝতে পারি না স্যার। নেলী খালাকে একটু বিব্রত মনে হলো–কী করবেন কিছু ঠিক করেছেন?

আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ভেবেছিলাম জাহেদের সঙ্গে পরামর্শ করবো।

নানু বললেন, আপনি মাথা ঠাণ্ডা রাখুন প্রফেসর হাবিব। জাহেদের অফিসে খবর পাঠাচ্ছি। ও ফিরে এসেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।

ঠিক আছে। বলে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেলেন প্রফেসর। ওঁর জন্য খুব খারাপ লাগলো। কাল ওঁকে দেখেই মনে হয়েছিলো সারা জীবন পড়াশোনা করেছেন, আর মাটির নিচে কোথায় মূল্যবান কী লুকিয়ে আছে, খুঁজে বেড়িয়েছেন। এরকম কিছু মানুষ আছে বলে বিজ্ঞান আর সভ্যতা এতোটা এগুতে পেরেছে।

প্রফেসর চলে যাওয়ার পর আমরা চারজন লনে এসে বসলাম। বাবু বললো, কাল মণিপুরি দিদিমা যখন বলেছিলেন অঘটন ঘটবে, তখন কথাটাকে পাত্তা দিই নি। অথচ সত্যিই একটা অঘটন ঘটে গেলো।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, ম্যাপটা যে-কোনো রাতে চুরি যেতে পারতো।

টুনি বললো, প্রফেসরের ম্যাপ যদি অতৃপ্ত আত্মারা চুরি করে?

ললি ওকে চাপা গলায় ধমক দিলো–বোকার মতো কথা বলো না টুনি। আত্মা কেন ম্যাপ চুরি করতে যাবে?

বাবু বললো, টুনি যদি বোকার মতো কথা বলে, তাহলে বলতে হবে কাল রাতে প্রফেসরও বোকার মতো কথা বলেছেন।

টুনির জন্য বাবুর টান দেখে মৃদু হাসলাম–টুনির কথায় আবার প্রফেসরকে টানছো কেন?

যেন ডিবেটের ক্লাসে বলছে–এভাবে শুরু করলো বাবু, আত্মা বলে কিছু নেই এ কথা যদি ধরে নাও তাহলে এ বিষয়ে কথা বলার দরকার নেই। তবে এও বলি, সায়েন্সের প্রফেসর ইরফান হাবিব কিন্তু আত্মার কথা উড়িয়ে দেন নি। কাল তিনি আর মনিপুরি দিদিমা যা বলেছেন, কথাগুলো নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। পাথারিয়া থেকে তেল তুলতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো, বহু লোক মারা গিয়েছিলো। যারা মারা গিয়েছিলো তাদের আত্মা যদি না চায় এখানে আবার তেলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি হোক, তাহলে প্রফেসরের ম্যাপ চুরি যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক মনে হবে কেন?

আমি আস্তে আস্তে বললাম, তুমি তাহলে আত্মা আছে বিশ্বাস করো?

আগে এ নিয়ে ভাবি নি।

বাবু বললো, কাল প্রফেসরের কথা শুনে মনে হয়েছে, আমি যা জানি না কিম্বা দেখি নি তার অর্থ এই নয় যে, সেসব পৃথিবীতে নেই। বাবুর কথা বলার ধরন দেখে মনে হলো একজন বয়স্ক মানুষ বুঝি কথা বলছে। প্রফেসরের প্রভাব ওর ওপর ভালোভাবেই পড়েছে।

স্ক্যাটরা বসে ছিলো আমাদের পাশে। হঠাৎ ও ছুটে গেলো গেটের দিকে। তাকিয়ে দেখি কিশোরদা আসছেন।

তোমরা বুঝি আজ কোথাও ঘুরতে বের হও নি? সামনের খালি চেয়ারে বসে প্রশ্ন করলেন কিশোরদা।

ভীষণ একটা কাণ্ড হয়েছে কিশোরদা। টুনি চাপা উত্তেজিত গলায় বললো, প্রফেসরের ম্যাপ চুরি হয়েছে।

কোন প্রফেসর? কিসের ম্যাপ? টুনির কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন কিশোরদা।

আপনি কিছুই জানেন না! অসহিষ্ণু গলায় টুনি বললো, সার্ভে টীমের প্রফেসর তেলের খনি খুঁজতে এসেছেন এখানে। কাল রাতে আমাদের এখানে এসেছিলেন। একটু আগে এসে বলে গেলেন, ওঁর একটা ভীষণ দরকারি ম্যাপ কাল রাতে চুরি হয়েছে।

পুরো ঘটনাটা আত্মস্থ করতে একটু সময় লাগলো কিশোরদার। বললেন, একটু জল খাবো।

টুনি ছুটে গিয়ে পানি আনলো। ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে গ্লাসটা খালি করে টেবিলে রেখে কিশোরদা বললেন, কে চুরি করেছে প্রফেসরের ম্যাপ?

বাবু বললো, এতোক্ষণ এ নিয়েই আমরা কথা বলছিলাম। আমাদের ধারণা এর সঙ্গে পাথারিয়ার অভিশাপের একটা সম্পর্ক আছে। বাবু ওর ধারণার সবটুকু খুলে বললো কিশোরদাকে।

বাবুর কথা শুনতে শুনতে কিশোরদার চেহারাটা গম্ভীর হয়ে গেলো। সব শুনে বললেন, আমরাও মনে হচ্ছে ও জায়গায় এমন কিছু আছে যা চোখে দেখা যায় না। সেদিন তোমরা পাহাড়ের হার্টবিট শোনার কথা বলেছিলে। আমি হেসেছিলাম। কাল নিজের কানে শুনে এসেছি। অদ্ভুত একটা ফিলিং হয়েছে পাহাড়টার কাছে গিয়ে। ভীষণ সাফোকেটিং, একটা আনক্যানি ফিলিং–ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হয়েছে জায়গাটা ঠিক পৃথিবীর বাইরের কোনো জায়গা, যেখানে মানুষের যাওয়া নিষেধ।

আমি বললাম, আপনি তাহলে বলতে চাইছেন পাথারিয়ার অতৃপ্ত আত্মারা সার্ভে ম্যাপ চুরি করেছে?

কথাটা আমি ঠিক ওভাবে বলতে চাই না। বাবুর সঙ্গে এ বিষয়ে আমি একমত যে, কেউ হয়তো চাইছে না এখানে তেলের জন্য খোঁড়াখুড়ি হোক।

কে চাইছে না? জানতে চাইলো ললি।

হতে পারে কোনো মানুষ কিম্বা মানুষ নাও হতে পারে। কাল পাহাড়ে গিয়ে মনে হয়েছে, আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে কত কী রয়ে গেছে–মনে অবিশ্বাস নিয়ে কিছু জানা যায় না।

টুনি বললো, তাহলে কি আপনি ছবি করবেন না?

কেন করবো না? এতোক্ষণে কিশোরদার মুখে হাসি ফুটলো–সে কথা বলতেই তো এলাম। আমি আজ দুপুরে ঢাকা যাচ্ছি। কিছু জিনিসপত্র আনতে হবে। এ্যসিসটেন্ট আর ক্যারেক্টার রোলের জন্য আর্টিস্ট লাগবে কিছু।

ফিরবেন কবে? প্রশ্ন করলাম আমি।

কাল দিনটা থাকবো। পরশু বিকেলে ফিরে আসবো। তুমি গল্পের লাইন-আপটা কী হবে ভেবে রেখো। ফিরে এসেই স্ক্রিপ্টটা শেষ করে ফেলবো।

কিশোরদা বেশিক্ষণ বসলেন না। যাওয়ার সময় জানতে চাইলেন ঢাকা থেকে আমাদের জন্য কিছু আনতে হবে কিনা। আমি শুধু বাড়ির টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে বললাম, মাকে বলবেন, আমরা ভালো আছি।

কিশোরদা চলে যাওয়ার একটু পরে নানু এসে বললেন, তোমরা কি জাহেদের অফিসে খবর দিতে পারবে, ও যেন ফেরামাত্র প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করে?

একশ বার পারবো। বলে আমরা চারজন বেরিয়ে পড়লাম। স্ক্যাটরাকে ধমক দিয়েও ফেরানো গেলো না। আর্মি ক্যাম্পে কে কি ভাববে–সে জন্য ওকে নেয়ার ইচ্ছে ছিলো না।

জাহেদ মামাকে ওঁর অফিসেই পাওয়া গেলো। আমাদের দেখে একটু অবাক হলেন। প্রফেসরের ম্যাপ চুরি যাওয়ার কথা শুনে–মাই গড! আমি ঠিক এ ভয়টাই করছিলাম। বলেই যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। একজন জুনিয়র অফিসারকে ডেকে বললেন, আমি প্রফেসর হাবিবের ওখানে যাচ্ছি। স্টেশনে কারা যাওয়া আসা করছে কড়া নজর রাখুন।

কয়েকটা ফাইল আলমারিতে বন্ধ করে জাহেদ মামা আমাদের বললেন তোমরা খেয়াল রেখো, সন্দেহজনক কোনো লোকজন চোখে পড়ে কিনা।

আমি বললাম, আমরা আপনার সঙ্গে আসবো জাহেদ মামা?

এসো, বলে বেরিয়ে পড়লেন জাহেদ মামা। আমরা হুড়মুড় করে জীপের পেছনে উঠলাম।

আর্মি ক্যাম্প থেকে সার্ভে টিমের জায়গাটা বেশ কিছুটা দূরে। উঁচু-নিচু মাটির রাস্তা। যেতে প্রায় মিনিট পনেরোর মতো লাগলো।

তিন দিকে পাহাড়, মাঝখানে খানিকটা সমতল জমির ওপর গোটা দশেক তাঁবু। দূর থেকেই প্রফেসরকে দেখলাম খোলা জায়গা একটা টেবিলের ওপর ঝুঁকে কী যেন দেখছেন। অল্প দূরে কয়েকজন মাপজোখের কাজে ব্যস্ত।

জাহেদ মামার জীপ দেখে ছুটে এলেন প্রফেসর। আমার কী হবে মেজর! এতোদিনের পরিশ্রম, সব বরবাদ হয়ে গেলো! গলা শুনে মনে হলো একেবারে ভেঙে পড়েছেন তিনি।

আপনি বিচলিত হবেন না স্যার। সান্ত্বনার গলায় জাহেদ মামা বললেন, আমার যতটুকু শক্তি আছে সব আপনার জন্য। এখান থেকে ম্যাপ চুরি করে কেউ পালাতে পারবে না।

তুমি আমার একমাত্র ভরসা। এই ম্যাপ যদি কোনোভাবে ইণ্ডিয়ার হাতে যায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ইণ্ডিয়া কি করবে আপনার ম্যাপ নিয়ে?

কিছুই জানো না দেখছি? অসহিষ্ণু গলায় প্রফেসর বললেন, পাথারিয়া বেসিনটা–আমার অনুমান এর অর্ধেক পড়েছে ইণ্ডিয়াতে। বর্ডারের ওদিকে জায়গাটা খুবই দুর্গম, কখনো কোনো সার্ভে হয় নি। কাজ হয়েছে এখানে। ইণ্ডিয়া যদি জানতে পারে এখানে তেল আছে, তাহলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে হিট করবে। জানোই তো ইন্টারন্যাশনাল ল অনুযায়ী–একবার ওরা যদি হিট করতে পারে, তাহলে আমাদের এলাকার তেলও ওরা নিয়ে যাবে। কমন বেসিনে যে আগে হিট করে তেল তারই হবে। শেষের দিকে প্রফেসরের গলাটা করুণ শোনালো।

কী সর্বনাশ! আপন মনে বললেন জাহেদ মামা, আমি ভাবতেই পারি নি ব্যাপারটা এতো সিরিয়াস। আগে জানলে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করতাম।

যা করার করো। অসহায়ভাবে প্রফেসর বললেন, এ নিয়ে আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।

আমরা কেউ জীপ থেকে নামি নি। জাহেদ মামা জীপে উঠে প্রফেসরকে বললেন, স্যার আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। যা করার আমরা সব কিছু করবো।

ফেরার পথে জাহেদ মামাকে রাতে দেখা আলোর সংকেতের কথা বললাম। জাহেদ মামা বললেন, আগে বলো নি কেন? চেক করে দেখতাম।

টুনি অভিমান করে বললো, আমরা কিছু বললেই যে নেলী খালা বলেন বানিয়ে গল্পো বলছি। কাল তো কিশোরদাও গিয়ে দেখে এসেছেন পাহাড়ের ভেতর যে শব্দ হয়।

কিসের শব্দ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন জাহেদ মামা।

ওঁকে পাহাড়ের শব্দের কথাও বললাম। স্ট্রেঞ্জ! বলে জাহেদ মামা গুম হয়ে গেলেন।

.

১২. আবার আলোর সংকেত

ম্যাপ চুরির আসল বিপদের কথা জানার পর আমরা সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমরা থাকতে প্রফেসর ইরফান হাবিবের মতো একজন বৈজ্ঞানিকের এত বড়ো সর্বনাশ হয়ে যাবে, ভাবতেই পারছিলাম না। সর্বনাশ তো তার একার নয়, সারা দেশের। কে জানে কত শত হাজার কোটি টাকার তেল পাথারিয়ার মাটির নিচে। সকাল থেকে বাবু টুনির খুনসুটি বন্ধ হয়ে গেছে; ললিকে নিয়ে আমার একা ঘুরে বেড়ানোর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। দুপুরের পর সবাই লনে বসে ভাবছিলাম, কী করা যায়।

কথাটা যদিও আমিই প্রথম ভেবেছিলাম, বললো ললি–একবার লাল পাহাড়ের ওখান থেকে ঘুরে এলে কেমন হয়?

টুনি আঁতকে উঠলো–ওখানে গিয়ে কী করবে ললিপা?

মনে হচ্ছে রহস্যজনক কিছু আছে ওখানে।

আমারও তাই মনে হয়। ললিকে সমর্থন করলাম আমি। চলো, বেরিয়ে পড়ি। এখন মাত্র দুটো বাজে!

টুনির মোটেই যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না, তবু কিছু বললো না। জানে, আমি যখন বলেছি তখন যাবোই। নেলী খালাকে ঘুরতে যাচ্ছি বলে আমরা স্ক্যাটরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

বড়লেখার পরে এদিকে তেমন কোনো লোকালয় নেই। ছড়ানো-ছিটানো গোটা দুই গ্রাম, মণিদাদের চা বাগান, জাহেদ মামাদের ক্যাম্প আর হালে প্রফেসরের সার্ভে টীম–এই মাত্র জনবসতি। গোটা এলাকাটা ছোট বড়ো পাহাড়ে ভরা। লাল পাহাড়ে যাওয়ার পথে একটা লোকও চোখে পড়লো না।

জঙ্গলের ভেতর ধুপ-ধুপ শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমরা যতোই লাল পাহাড়ের কাছে যাচ্ছিলাম, অশুভ সেই শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগালো। স্ক্যাটরাকে আগের মতোই যথেষ্ট ভীত মনে হলো।

আমরা চারজন গভীর নালাটার কিনারে দাঁড়ালাম। হঠাৎ স্ক্যাটরা গরগর করে উঠলো। চারদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না। একটানা ধুপ-ধুপ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। নালার ভেজা ভেজা মাটি পোড়া মাংশের মতো দগ দগ করছে। স্ক্যাটরা আবার গরগর করে আমাদের মুখের দিকে তাকালো। বুঝলাম ও কিছু করার অনুমতি চাইছে। আলতোভাবে ওর পিঠ চাপড়ে সম্মতি দিলাম।

মাটি শুঁকতে শুঁকতে স্ক্যাটরা পায়ে পায়ে নালার দিকে এগিয়ে গেলো। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ওকে অনুসরণ করলাম। যে জায়গায় কিনারাটা খাড়া কম–সেখান দিয়ে আমরা নালার ভেতর নামলাম। নামার সময় ললি সারাক্ষণ আমার হাত ধরে রেখেছিলো।

নালার ভেতর কিছুটা এগিয়ে গিয়ে স্ক্যাটরা দাঁড়ালো। চারপাশে এঁকে সামনের পায়ের নখ দিয়ে এক জায়গায় মাটি আঁচড়াতে লাগলো। আসার পথে বাবু একটা ডাল ভেঙে লাঠির মতো করে নিয়েছিলো। সেটার মাথা দিয়ে স্ক্যাটরাকে মাটি খুঁড়তে সাহায্য করলো।

সামান্য খুঁড়তেই মাটির তলা থেকে সাদা যে বস্তুটি বেরুলো দেখে আমরা ভয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। আমাদের চোখের সামনে মানুষের কঙ্কালের একটা মাথার খুলি দাঁত বের করে হাসছে। স্ক্যাটারা সামনের পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওটাকে গর্তের বাইরে এনে গড়িয়ে দিলো। কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো টুনির চেহারা। কোনো রকমে বললো, ললিপা, শিগগির চলো।

হঠাৎ বাবু চাপা গলায় বললো, এদিকে তাকিয়ে দেখো। জুতো পরা পায়ের ছাপ।

তাকিয়ে দেখি সত্যিই তাই। দুজোড়া জুতো, দুটোর তলা দুরকম–এলোমেলো কিছু ছাপ ফেলে কিছুদূর গিয়ে শুকনো ঘাসের ভেতর হারিয়ে গেছে। জুতোর ছাপ দেখে সাহস ফিরে পেলাম। অতৃপ্ত আত্মারা নিশ্চয়ই জুতো পায়ে ঘুরে বেড়ায় না। এই বলে কঙ্কালের মাথাটা আমি তুলে নিলাম।

টুনি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমার ভীষণ ভয় করছে ললিপা। প্লীজ আবির, আমি বাসায় যাবো।

পকেট থেকে রুমাল বের করে খুলিটা মুড়িয়ে নিয়ে বললাম, চলো তাহলে, একটা দরকারি সূত্র পাওয়া গেলো।

যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই আমরা ফিরে চললাম। জঙ্গলের সীমানা পেরিয়ে খোলা মাঠে নামার পর টুনি স্বাভাবিক হলো। আমাকে বললো, এই ঘেন্নার জিনিসটা আপনি বাসায় নিয়ে যাবেন?

আমি মৃদু হেসে বললাম, এটা আমাদের একটা ক্লু।

বাবু বললো, তুমি কেন ভয় পাচ্ছো টুনি? এটা আমাদের ঘরে থাকবে।

টুনি মুখ কালো করে বললো, জানি, আমাদের ভয় দেখাবার জন্য ওটা নিয়েছে। নেলী খালাকে সব বলে দেবো।

নির্বিকার গলায় বাবু বললো, বলতে পারো, যদি আমাদের দল থেকে বাদ পড়তে চাও।

আমি আর ললিপা আলাদা ঘুরবো। টুনির গলায় চাপা অভিমান।

ললি বললো, টুনি তুমি মিছেমিছি ভয় পাচ্ছো। ওরা কেউ তোমাকে ভয় দেখাবে না। নেলী খালাকে কিছু বললে তিনি সবার বাইরে ঘোরা বন্ধ করে দেবেন।

বাবু কী যেন বলতে যাবে, হঠাৎ গরগর করে উঠলো স্ক্যাটরা। আশেপাশে বাতাসে কি যেন শুকলো। তারপর তীরবেগে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লো। আমরা হতভম্ভ হয়ে একে অপরের দিকে তাকালাম। পরক্ষণেই স্ক্যাটরার গর্জনের সঙ্গেওরে আল্লারে, আমারে খাইলাইছে রে, বলে সেদিনের সেই লিকপিকে লোকটা ছুটে এলো আমাদের কাছে।

আমাদের আফনারা জুতা দিয়া মারুক্কা। আমার কুন দোষ নাই। তারার কতা না হুনলে আমার বৌ বাচ্চারে জানে মারি ফালাইব।

লোকটাকে দেখে স্ক্যাটরা খুবই রেগে গিয়েছিলো। মৃদু গলায় ধমক দেওয়ার পর ওর গরগর করা থামলো। আমি শক্ত গলায় বললাম, সেদিন পালিয়েছিলে কেন?

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো লোকটা–আমি গরিব মানুষ। খয়দিন ধরিয়া কোনো কাম কাজ ফাঁইরাম না। আমারে খইছে আফনার খই খই যাইন খার লগে মাতেন সব তারারে গিয়ে খইতাম।

তারা কে? সত্যি কথা না বললে তোমার বিপদ আছে।

আমারে মাফ করিয়া দিলাউক্কা। কাঁদতে কাঁদতে লোকটা বললো, তারার নাম আমি জানি না। অনেক দিন ধরিয়া ফাথারিয়া ঘুরাফিরা খরের দেখি।

তোমার নাম কী, বাড়ি কোথায়, সত্যি করে বলো। নইলে এটার হাতে ছেড়ে দেবো। বলে স্ক্যাটরার দিকে ইঙ্গিত করলাম।

স্ক্যাটরা ভারি গলায় বললো, ঘেউ।

আঁতকে উঠে লোকটা বললো, আমার নাম আফাজুদ্দিন। বাফর নাম কলিমুদ্দিন। বাড়ি গোলাফগঞ্জে। ইটাগঞ্জ বাগানে আমার ভাইর লগে থাখি। আমার বৌ ব্যাটা তারার ঘরে খাম করে।

ওরা কোথায় থাকে?

লোকটা পুব দিকে আঙুল দিয়ে দেখালো–হউ জঙ্গলের ভিতর ঘর বানাইয়া তারা চাইর জন থাখে আর খয়েকজন মাঝে মাঝে তারার কাছে আয়।

তুমি রাতে কোথায় থাকো?

খুনদিন আমার ভাইর বাসাত, কুনদিন তারার বাসাত।

তাদের কাজটা কী?

জায়গা জমি মাপে আর ল্যাখাপড়া করে।

তারা কী এখানকার স্থানীয় লোক?

তারা খেউ এখানকার মানুষ না। সিলটি মানুষ অত খরাপ হয় না।

ওরা খারাপ কেন?

আমারে তারা খইছে, তারার খথা মতন খাম না খরলে আমার বৌ ব্যাটারে মারি ফালাইবো। আফনারা কউক্কা আমি এখন খিতা খরি।

লোকটার কথা শুনে মনে হলো শক্তিশালী কোনো দল বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের ওপর নজর রাখছে। লোকটাকে আর হাতছাড়া করা যাবে না। বললাম, চলো আমাদের সঙ্গে। জাহেদ মামা ঠিক করবেন, তোমাকে নিয়ে কী করা যায়।

আল্লার দোয়াই আমারে আফনারা ছাড়ি দেউকা। তারা আমার বৌ পোয়া পুয়ি মারি ফালাইবো। বলে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলো শুটকো লোকটা। ওর কান্না দেখে স্ক্যাটরা পর্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলে।

ললি বললো, তুমি কাঁদছো কেন? জাহেদ মামা তোমাকে কিছুই করবেন না। তুমি যদি ভালো লোক হও তোমার বৌ ছেলেকে তিনিই ওদের হাত থেকে উদ্ধার করে দেবেন।

ললির কথায় কান্না থামালো লোকটা। ওকে আগে আগে হাঁটতে বলে আমরা জাহেদ মামার ক্যাম্পের পথে এগুলাম।

লোকটা যাতে না বোঝে বাবু ইংরেজিতে বললো, লোকটাকে দেখে যতো নিরীহ মনে হয় আসলে কিন্তু তা নয়।

টুনি বললো, ইচ্ছে করছে শয়তানকে একটা থাপ্পড় মারি।

লোকটা একবার হঠাৎ এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন দেখলো। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্যাটরার ঘেউ শুনে সোজা হয়ে গেলো।

জাহেদ মামার ক্যাম্পে পৌঁছতে পাঁচটা বেজে গেলো। বিকেলের সূর্য এরই মধ্যে পশ্চিমের পাহাড়ের আড়ালে চলে গেছে। জাহেদ মামা বারান্দায় দাঁড়িয়ে একজন অফিসারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাদের সঙ্গে লোকটাকে দেখে অবাক হলেন–এটাকে কোথায় পেলে?

জঙ্গলের ধারে। কারা নাকি ওকে বলেছে আমাদের ওপর নজর রাখার জন্য। মনে হচ্ছে বড় কোনো গ্যাং আছে। এটাকে ছাড়া ঠিক হবে না।

আমার কথা শুনে সঙ্গের অফিসারটিকে ডেকে তিনি বললেন, একে জেরা করতে হবে। তারপর আমাদের বললেন, ভালো কাজ করেছে। সন্ধ্যে হতে চলেছে। এবার ঘরে ফিরে যাও।

বিকেলের চা নিয়ে নেলী খালা আর নানু লনে বসে গল্প করছিলেন। দূর থেকে নানুকে দেখেই আমি রুমালে বাঁধা মড়ার খুলিটা বুড়ো ছাতিম গাছটার খাজের ভেতর লুকিয়ে ফেললাম। টুনি মুখ টিপে হেসে বললো, কেমন জব্দ!

আমাদের দেখে নেলী খালা মৃদু হাসলেন–বাইরে ঘুরতে বেরুলে বুঝি আর ফেরার কথা মনে থাকে না!

আমরা ওই উচ্চিংড়িটাকে খুঁজে পেয়েছি। তড়বড় করে বললো টুনি। জাহেদ মামারা ওটাকে জেরা করবেন।

উচ্চিংড়ি কে? অবাক হয়ে জানতে চাইলেন নেলী খালা।

বাবু বললো, পিকনিকের দিন যে শয়তানটাকে ধরেছিলাম। আজও আমাদের ওয়াচ করছিলো। টের পেয়ে স্ক্যাটরা ধরে ফেলেছে।

স্ক্যাটরা নানুর পাশে বসেছিলো। আহ্লাদে ওর জিবের অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে। নানু ওর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, পাকড়াশী আবার পাথারিয়া পর্যন্ত আসে নি। তো?

আসতে পারে। জবাব দিলেন নেলী খালা। তবে এখানকার স্থানীয় লোকেরা ওকে পাত্তা দেবে বলে মনে হয় না।

ওরা টাকার অভাব নেই। প্রতিপত্তিও কম নয়।

আমরা এখানে নুলিয়াছড়ির মতো অসহায় নই।

হঠাৎ নানুর মনে হলো আমাদের সামনে এসব আলোচনা করা ঠিক হচ্ছে না। ছেলেমেয়েদের খেতে দাও নেলী। এই বলে তিনি উঠে ঘরে গেলেন।

নেলী খালা ঘরে বানানো কেক কাটতে কাটতে মৃদু হেসে বললেন, তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে নুলিয়াছড়ির মতো এ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাকে আবার পাথারিয়া ছাড়তে হবে না তো?

একটু আগে নেলী খালা যে কথাটা নানুকে বলেছিলেন বাবু ঠিক সে কথাটাই আবার বললো, আমরা এখানে নুলিয়াছড়ির মতো অসহায় নই নেলী খালা।

দেবো এক থাপ্পড়, পাজি ছেলে! বলে হেসে ফেললেন নেলী খালা। আমরা সবাই ওঁর সঙ্গে গলা মেলালাম।

রাতে খাবার টেবিলে জাহেদ মামা ভীষণ এক খারাপ খবর শোনালেন। আমরা আগেই খেতে বসেছিলাম। জাহেদ মামা মুখ হাত ধুয়ে এসে টেবিলে বসে বললেন, আফাজউদ্দিন আবার পালিয়েছেন।

সে কি! বলতে গিয়ে বিষম খেলাম আমি।

নানু বললেন, এসব কথা খাওয়ার পরে হবে।

নেলী খালার এতো সব উপাদেয় রান্না কিছুই মুখে রুচলো না। উচ্চিংড়ি পালিয়েছে শুনে আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে গেছে। কোনোরকমে খেয়ে উঠে ড্রইং রুমে বসে জাহেদ মামার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। নানু আর জাহেদ মামা খাওয়া শেষ করে এক সঙ্গে উঠলেন।

সোফায় বসে পাইপ ধরিয়ে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে নানু বললেন, আফাজউদ্দিন পালালো কিভাবে?

আমাদের একজন অফিসার ওকে জেরা করে জনা তিনেক জওয়ান আর একজন হাবিলদারকে ওর সঙ্গে পাঠিয়েছিলো আসল কালপ্রিটগুলোকে ধরার জন্য। জঙ্গলের বাইরে জীপ রেখে ওরা ভেতরে ঢুকেছে। একটু পরে আফাজউদ্দিন বললো, সঙ্গে সেপাই দেখলে ওরা সন্দেহ করতে পারে, তাই ও আগে গিয়ে দেখে আসতে চায় ওরা কে কিভাবে আছে। যেভাবে ও পথ দেখিয়ে ওদের নিয়ে যাচ্ছিলো ওরা ভেবেছিলো এ বুঝি আমাদের কোনো ইনফর্মার। তাই ওর কথা শুনে ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লোকটা যখন ফিরে এলো না তখন আর কিছু করার ছিলো না।

নানু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, কিছু মনে কোরো না জাহেদ, উর্দিপরা লোকদের মাথা মোটা বলে জানি, কিন্তু এতোটা গর্দভ কখনও ভাবি নি।

জাহেদ মামা কাঁচুমাচু করে বললেন, আসলে একটু কম্যুনিকেশন গ্যাপ হয়ে গেছিলো।

নেলী খালা হেসে বললেন, লোকটার বুদ্ধিরও প্রশংসা করা উচিত আব্দু। আর্মির চারটা লোককে কিভাবে বোকা বানালো।

বেকুবদের বোকা বানানোর ভেতর বাহাদুরি কোথায়? এই বলে নানু উঠে চলে গেলেন। মনে হলো বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন তিনি।

দুদিনের বাসি খবরের কাগজে একটু চোখ বুলিয়ে জাহেদ মামাও গম্ভীর মুখে ঘরে চলে গেলেন। তার সঙ্গে নেলী খালাও।

আমরা চারজন বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বাবু বললো, উচ্চিংড়ি পালানোতে মনে হচ্ছে আমাদের তদন্ত আবার শুরু থেকে করতে হবে।

কিসের তদন্ত? অবাক হয়ে জানতে চাইলো টুনি।

উচ্চিংড়িকে কারা আমাদের পেছনে লাগিয়েছে। রাতের অন্ধকারে বর্ডারের পাহাড়ে কারা আলো জ্বেলে সিগন্যাল দেয়। প্রফেসরের ম্যাপ কে চুরি করেছে।

বাবুর সঙ্গে আমি যোগ করলাম–লাল পাহাড়ের ভেতর কারা ধুপ-ধুপ শব্দ রে, নালার ভেতর পায়ের ছাপ কাদের, মড়ার খুলিটাই-বা কার, এসবই জানা দরকার।

টুনি বললো, মড়ার খুলি আর কার হবে। যারা পঞ্চাশ বছর আগে খনির তেল তুলতে গিয়ে মারা গিয়েছিলো। নিশ্চয় ওদের কারো হবে।

না টুনি। আমি বললাম, খুলিটা মোটেই পঞ্চাশ বছরের পুরোনো নয়। বেশি হলে দুতিন বছরের হবে। আমি ভালো করে দেখেছি, একেবারে তাজা।

তাহলে অতৃপ্ত আত্মারা কাউকে মেরে নালার ভেতর পুঁতে রেখেছিলো। ভয়ে ভয়ে কথাটা বললো টুনি।

ললি আস্তে আস্তে বললো, আমার মনে হচ্ছে কেউ বোধ হয় চায় না আমরা লাল পাহাড়ের কাছে যাই। তাই মড়ার খুলিটা ওখানে লুকিয়ে রেখেছিলো!

বাবু বললো, অন্য উদ্দেশ্যেও রাখতে পারে। হয়তো খুলিটা ওদের কোনো মেসেজ। ওটার ভেতর কোনো সংকেত আছে কিনা দেখা দরকার। চলো আবির, নিয়ে এসে দেখি।

টুনি বাবুর হাত আঁকড়ে ধরে কঁকিয়ে উঠলোনা, ওটা এখানে আনতে পারবে না।

আমি মৃদু হেসে বললাম, এখন থাক বাবু। আমাদের ঠিক করতে হবে তদন্ত কোত্থেকে শুরু করবো।

একটা জায়গায় এখনো আমরা যাই নি। ললি আমার দিকে তাকালো। কোথায়? প্রশ্ন করলাম ললিকে।

যেখান থেকে সিগন্যাল পাঠানো হচ্ছে। কাল আমরা ওদিকটায় গিয়ে দেখতে পারি।

ওখানে যেতে গেলে লাল পাহাড় পেরিয়ে যেতে হবে।

ওই দেখো, আবার। উত্তেজিত হয়ে বললো বাবু। তাকিয়ে দেখি রোজকার মতো আলোর সংকেত। ব্যতিক্রম হচ্ছে–দুবার নয়, পাঁচবার দেখানো হলো উত্তর থেকে দক্ষিণ আকাশে সার্চ লাইটের তীব্র আলো। বাবু বললো, কালই খুঁজে বের করবো। এ কাজ কাদের!