১১.
হেলেনকে স্যান বারনাডিনো হাসপাতালে রেখে তিনদিন পর লস-এঞ্জেলস-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হেলেনকে একা রেখে যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু ফেরার মতো শারীরিক অবস্থা না থাকায় অগত্যা নিরুপায় হয়েই আমাকে কাজে একা ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে হল।
স্থানীয় পুলিসের করণীয় যা থাকে অর্থাৎ আমাকে জেরায় উদব্যক্ত করে তুলেছিল, কিন্তু আসলে ঘটনাটা আমি তাদের কাছে পুরোপুরি জানাইনি। কেসটার আসল রহস্য এখনও উন্মোচন করতে পারিনি, আমার মনোগত ইচ্ছে নয় যে আমি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হবার আগে ওরা এটা নিয়ে হাঙ্গামা বাঁধিয়ে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিক। আমি তাদের জানিয়েছি, এক বন্দুকধারীর আক্রমণের কবল থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ঐ মুহূর্তে কুটিরে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আমাদের করণীয় কিছু ছিল না। ওদের মনে এই বিশ্বাসও ঢোকাতে সফল হয়েছি যে সাপটা আগে থাকতেই ওখানে মরে পড়েছিল।
পুলিসের লোকটা জানিয়েছে, গুলির শব্দ শুনে সে ওখানে তদন্তের জন্য ছুটে আসে। বন্দুক ধারীকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য তার হয়নি তবে গাড়ি নিয়ে পালাবার সময় গাড়ির শব্দ সে শুনতে পেয়েছে। লোকটা যে কনি এবিষয়ে আমি স্থির নিশ্চিত। গোখরো সাপটাই তার প্রমাণ কিন্তু তবু আমি তার পরিচয়টা নিজের কাছেই চেপে রেখেছি।
হোটেলে ফিরে এসে প্রথমেই আমার নামে কোন চিঠি-পত্র এসেছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নিলাম। শেরিফ পিটার্স তার কথা রেখেছেন। যে ছবিটা তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন তাতে ওটা নিঃসন্দেহে কোরিন কনি। জড়লটা খুব পরিষ্কার ভাবে ছবিতে ধরা পড়েছে।
ছবিটা কয়েকমিনিট ধরে ভালোভাবে পরীক্ষা করার পর আমি নিজের মনকে এটাই বোঝাতে সচেষ্ট হলাম যে মেয়েটা কোরিন ভিন্ন অন্য কেউ নয়, কিন্তু কেন জানিনা আমার বারবার সুসানের কথাই মনে হচ্ছিল।
ইতিমধ্যে কেউ আবার টাকা দাবি করেছে কিনা জানার জন্য ফ্যান’শর দপ্তরে ছুটলাম। ফ্যান’শ একা ছিল না, সঙ্গে ম্যাডক্সও আছে। আমাকে দেখেই তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল, কী মনে করে, কোন দরকার আছে? এখানে তোমার কোন প্রয়োজন থাকার কথা তো নয়, কারণ তোমাকে আমরা এখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি।
আমি জানতাম অফিসটা ফ্যান’শর, দরজা বন্ধ করতে করতেই আমি জবাব ছুঁড়লাম। ও মুখ ফুটে বললেই আমি এক্ষুণি চলে যাব। ফ্যান’শ হাসছে। এসো, স্টিভ। তারপর আছো কেমন?
ভালো, তারপর জ্যাকসন কী বলছে? এখন পর্যন্ত জল যে তিমিরে আছে সেই তিমিরেই, সেরকম কিছু ঘটেনি,ফ্যান’শ জবাব দেয়। ইতিমধ্যে বিরাট শব্দ তুলে নাকটাক সিটকে ম্যাডক্স কিছু কাগজপত্র টেবিল থেকে ফেলেও দিয়েছে।
আমি তোমাদের কাছে সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে ছুটে এসেছি, বসতে বসতে বলে ফেলি।
অবশ্য এর দরুণ আমায় আগের থেকে অনেক বেশি টাকা তোমাদের দিতে হবে।
এই পৃথিবীতে তুমি একমাত্র গোয়েন্দা হিসেবে বেঁচে থাকলেও তোমার দ্বারস্থ হবো না, আর তোমাকেও ভুল করে ডাকবো না, ম্যাডক্স ঘোঁত ঘোঁত করে বলে ওঠে। বেরিয়ে যাও এই মুহূর্তে!
ফ্যান’শ আমার দিকে প্রত্যাশার দৃষ্টি মেলে তাকাল। তাকে প্রশ্ন করলাম, সবশেষ খবর কি? কেউ টাকা দাবি করেছে?
হ্যাঁ, মিসেস কনি গতকাল সকালের দিকে এসে দাবি জানিয়ে গেছেন। এই লাইনের সব চাইতে ধুরন্ধর উকিল এড বায়ান তার হয়ে লড়বে। তাই আমাদের আশা আর নেই বললেই হয়।
তোমরা কী চাইছ ওরা মামলা করুক,
আজ তোমার কৃপায় কোর্টে দাঁড়াবার সব রাস্তাই আমাদের বন্ধ, টেবিলে সজোরে এক ঘুসি মেরে গর্জে ওঠে ম্যাডক্স। মৃতদেহ সনাক্ত করতে গিয়ে তুমি আমাদের পুরো কেসটাই ওদের হাতে তুলে দিয়েছে।
তাহলে অবস্থা সত্যিই শোচনীয় কি বলেন, আমি মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠি। যাকগে, আমার একটা প্রস্তাব আছে। কেসটা যদি আমি বাঁচিয়ে দিই তাহলে আমার ভাগ্যে কত জুটবে?
ম্যাডক্স আর ফ্যান’শ-এর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে, দুজনেই হতভম্বের মতো তাকাল আমার দিকে।
কী বলতে চাও তুমি? হুঙ্কার দিয়ে উঠল ম্যাডক্স।
আমি যা বলেছি তা সহজ-প্রল ভাষাতেই বলেছি। আমি কেসটা আমার মতন করে নাড়াচাড়া করতে গিয়েছিলাম যা আপনাদের পছন্দ হয়নি। এই কারণেই কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে গিয়েছিলাম। স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার কিন্তু আমার আছে। মাল-কড়ি ভালো পেলে আমি এখনও এই কেসে কাজ করতে রাজি।
তোমাকে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই,ম্যাডক্স আর গর্জে ওঠে। এই সহজ কথাটা তুমি বুঝতে পারছ না কেন। তুমি এখন যেতে পার।
বেশ, আপনাদের যা ইচ্ছা। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আপনারাই তাহলে ব্যবস্থা করুন।
এক মিনিট,ফ্যান’শ তাড়াতাড়ি বলে উঠল। এই কেসটা কী তুমি সমাধান করতে পারবে, স্টিভ?
মাত্র দু-ঘণ্টার মধ্যে আমি এই খেলার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করতে পারি।
ম্যাডক্স এমনভাবে ঝুঁকে বসলো যেন একটা ষাঁড় গোত্তা মারার প্রস্তুতি করছে। তুমি কী আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করছে।
না, আপনারা আর বাকিটা কোম্পানি যদি আমায় খুশি করতে পারে, আমি কেসটা সমাধান করতে এক পায়ে খাড়া। হাসার দিন আমার, এই ভেবে হেসে ফেললাম।
দশলক্ষ ডলারের প্রশ্ন–আর এই মাত্র আপনারা বলেছেন, ক্ষীণ আশা পর্যন্ত নেই। একজন স্বাধীনচেতা গোয়েন্দা তার এই কাজের জন্য প্রাপ্য টাকা যা নিতে তা যদি আমাকে দিতে আপনারা রাজি থাকেন, তাহলে এই দশলক্ষ ডলার বাঁচিয়ে দেবার ক্ষমতা আমি রাখি।
ম্যাডক্স মনে মনে চটপট একটা হিসেব কষে নিয়ে বলে উঠল, দাঁড়াও, অতত তাড়াহুড়ো করো না। বেশ, তোমার কথামতো আমি মেনে নিচ্ছি যে স্বাধীন ভাবে কাজ করলে তোমার কিছু টাকা পকেটে আসবে। কিন্তু সে টাকা কদ্দিন তুমি ধরে রাখতে পারবে? যা হবার ছিল তা হয়ে গেছে, এখন ব ভুলে গিয়ে বরং আবার আগের মতো কাজে ফিরে এসো। নিজের ভবিষ্যত সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করার কর্তব্য তোমার।
থাক, অসীম দয়া আপনার। যে কিছু টাকার কথা আপনি এই মাত্র উচ্চারণ করেছেন ওটার দাম বর্তমানে দশ হাজার ডলার। আমার বহুদিনের বাসনা নিজে একটা একটা কাজ আরম্ভ করার। আপনার হম্বিতম্বি বহুবার আমি শুনেছি, আর নয়। হয় আমাকে আলাদা কাজ করতে দিন, আর নয়তো আমি কেটে পড়ছি, আপনারা যাহোক একটা ব্যবস্থা করুন।
উত্তেজনায় ম্যাডক্সের প্রায় ফেটে পড়ার দশা, কিন্তু ফ্যান’শ তাকে কিছু বলতে দিল না। সে বলল, তুমি যদি এই কেসটা সমাধান করতে পারো স্টিভ, তাহলে কমিশন পাবে এক পারসেন্ট, তার ওপর কাজে যদি ফিরে আসতে প্রস্তুত থাক, তোমাকে বিমুখ করা হবে না। মিঃ ম্যাডক্সের যদি এব্যাপারে কোন আপত্তি থাকে, আমি সোজা বড় সাহেবের দারস্থ হতে বাধ্য হবো।
সহাস্য ম্যাডক্স পূর্বের রূপ পরিবর্তন করে শেয়ালের মতো হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকাল।বেশ, চালিয়ে যাও। তোমাকে ভাড়া করা হলো। কাজ ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি এই মুহূর্তে দিতে পারছি না তবে এটা কারসাজি প্রমাণ করতে পার, তাহলে আমি খেয়াল রাখবো কমিশনের টাকা যাতে তুমি ঠিক সময়ে পেয়ে যাও।
এক পারসেন্ট কমিশনে?
হা হা, এক পারসেন্ট কমিশনে।
ঠিক আছে, আপনারা আজকের মতো রায়ানকে ঠেকিয়ে রাখুন। ভাগ্য যদি সদয় হয় তবে আগামী কালই আমি কাজ মিটিয়ে ফেলবো। আমি মাথা নাড়লাম। একবার যদি প্রমাণ করে দিতে পারি, মৃতা মেয়েটা কোরিন কনি, সুসান গেলার্ট নয়, তাহলেই সব ঝামেলার এখানে ইতি ঘটছে।
তোমার মাথায় কী এখন ঐ ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছে? ম্যাডক্স বলল। তোমার কথা মতো তাই যদি হয়েও থাকে, সারা জীবনেও এই কেসের সমাধান করা তোমার ক্ষমতা নয়।
আপনি সেই ভেবেই নিশ্চিন্ত থাকুন। ফ্যান’শর দিকে চোখ টিপে আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে এলাম।
বাইরে এলে ফ্যান’শর সেক্রেটারি মিস ফেভারশ্যামের টেবিলের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লাম, আমাদের অফিস স্টাফদের পার্সোনাল ফাইলগুলো একবার বার করুনতো দেখি। আমার কয়েকটা জিনিস একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার।
ফাইলগুলো ওর হাত থেকে নিয়ে বলে উঠলাম, যদি ভেবে থাকেন, আপনার ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আছে, তাহলে নিজের ফাইলটা সরিয়ে রাখতে পারেন। কারণ আমি একজন ভদ্রলোক, তার ওপর বিবাহিত।
লজ্জায় রক্তিম আভা ফুটে ওঠে মিস ফেভারশ্যামের মুখে। আধঘণ্টা পরে মসি ফিলিপসের স্টুডিওর সামনে গাড়ি করে হাজির হলাম। দশটা বেজে গেছে, দোকানটা তখন ও খোলেনি। গাড়ি থেকে নেমে দরজার কাছে এসে বন্ধ লোহার জাফরিটা দেখার পর অস্বস্তিকর এক অনুভূতি মনের মধ্যে পাক খেতে শুরু করে দিল। ব্যবসা মন্দ চললেও মসি ফিলিপসের মতো লোক দোকানের সামনে কোন নোটিস না লাগিয়েই ঘুমিয়ে থাকবে বা কোথাও বেড়াতে যাবে বলে তো আমার মনে হয় না।
উল্টো দিকের পাশ-পথ থেকে একটা পুলিস আমাকে তখন থেকে লক্ষ্য করছিল। হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে ডাকলাম।
হাতের লাঠিটা দোলাতে দোলাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়ে এল সে, তারপর আমার গাড়িটাকে দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠল, এখানে কিন্তু সারাদিন গাড়ি রাখার অনুমতি দেবো না।
আমার প্রয়োজনও নেই, এই বলে নিজের পরিচয় কার্ডটা ওর থ্যাবড়া নাকটার দিকে উঁচিয়ে ধরলাম।
কার্ডটা পড়ার পর চোখ দুটো কুঁচকে তাকাল লোকটা। তা আমার কী করতে হবে? ঝুঁকে সেলাম ঠুকবো, না আপনার অপরূপ দেহটা দর্শন করে বিভোর হয়ে জ্ঞান হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবো?
এ দোকানটা ভেঙে ঢোকার অধিকার যে আমার আছে আপনাকে সেটা বুঝিয়ে দিলাম, আপনার সাহায্যও আমার চাই।
কী? কী বললেন? লাল নাকটা আরও লাল হয়ে উঠল।
আস্তে দাদা, আস্তে, আমি দোকানটার পেছনে গিয়ে একবার দেখতে চাই ফিলিপসের ব্যাপারটা কী?
কি আবার হবে তার?
এত বেলা হয়ে গেল সে এখনও দোকান খোলেনি, অথচ সেই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল আজ। সে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা একবার দেখতে চাই, এইটুকু বলেই তার জবাবের অপেক্ষা না করে ডানদিকের একটা ছোট গলি দিয়ে সোজা দোকানের পেছন দিকটায় চলে এলাম। পুলিসটাও আমাকে অনুসরণ করল, হয়তো সে বুঝতে পারছিল না আমি ঠাট্টা করছি কিনা।
দেখি, দোকানের পেছনের দরজাটা হাট করে খোলা। কাঠ থেকে তালাটা উপড়ে ফেলা হয়েছে। একবার দেখে যান এখানে এসে, আমি পুলিসটার উদ্দেশ্যে বলে উঠি।
ভাঙা দরজাটার দিকে একপলক তাকিয়ে সে পকেট থেকে পিস্তল বের করলো, তারপর থমথমে মুখ নিয়ে সন্তর্পণে পা রাখল ভেতরে। ওকে অনুসরণ করে আমি স্টুডিওতে প্রবেশ করলাম। জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছিল এইমাত্র এখান দিয়ে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে। হাজার হাজার ছবি আর মসি ফিলিপসের যত্নে রাখা ফাইলগুলো ছড়িয়ে ছিল সারা মেঝে জুড়ে। লোহার আলমারির দেরাজগুলো চাড় মেরে খুলে ফেলা হয়েছে। তাপচুল্লীতে বিরাট একটা পাকার ছাইয়ের গাদা। কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম, রাশিকৃত ছবি জ্বালিয়ে ফেলেছে কেউ।
এখানে কীসের খোঁজে এসেছিল জানোয়ারের দল। পুলিশটা তার আসল মূর্তি ধরল।
ও মক্কেলের কাছে তো ফুটো কড়ি পর্যন্ত নেই।
তার কী হাল হয়েছে এবার দেখা যাক বলা শেষ হলে আমি স্টুডিও থেকে দোকানের দিকে পা বাড়ালাম।
কাউন্টারের ওপর শায়িত ছিল মসি ফিলিপস।
পেছন থেকে আঘাতটা এসেছে, মাথাটা এই আঘাত সামলাতে না পেরে একেবারে থেতো হয়ে গেছে। বৃদ্ধ নিগ্রোটির হাত স্পর্শ করে দেখালাম। উত্তাপ এখন আছে। বললাম, খুব বেশিক্ষণ নয়, পনেরো মিনিটের মধ্যেই একে সাবাড় করা হয়েছে।
অ্যাঁ! পুলিসটা আঁতকে উঠল। আমি তো সেই সময় দোকানের বাইরেই উপস্থিত ছিলাম।
আপনি দাঁড়ান এখানে, বলে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেল সে।
কুড়ি মিনিটের মধ্যেই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী হাজির হয়ে গেল। ওদের সঙ্গে ছিল পুলিস ক্যাপেটেন হ্যাকেট।
সবাই কাজে নেমে পড়ার পর হ্যাকেট আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলে উঠল, আপনি এখানে কীভাবে এলেন? জানেন কিছু?
আমার আসার কারণটা তার কাছে খুলে বললাম। বোঝনোর চেষ্টা করলাম যে, চুরি দেখে মসি ফিলিপস নিশ্চয়ই প্রমাণ করতে পারত, মৃতা মেয়েটি কোরিন কনি, সুসীন গেলার্ট বহাল তবিয়তে আছে। কোরিনের জন্মচিহ্নটার কথা জানিয়ে, সবশেষে বললাম। আমার ধারণা, আমি এখানে আসব কনি টের পেয়ে গিয়েছিল, ফিলিপসের মুখ বন্ধ করার জন্য এখানে হাজির হয়েছিল।
এইসব শোনার পর হ্যাকেটকেও উদ্বিগ্ন দেখালো। সাধারণ চুরির ঘটনাও তত হতে পারে। দেখা যাক ওরা কী পায়?
সিগারেট ধরিয়ে আমরা হ্যাকেটের সহকারীদের কাজকর্ম দেখতে লাগলাম। এখনও মনে হয় ওদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যায়নি।
জোইস শ্যারম্যানের কোন সন্ধান পাওয়া গেল? আমি জানতে চাইলাম। ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়াল হ্যাকেট। নাঃ। আমরা আমাদের দিক থেকে সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তাকে আর পাওয়া যাবে না।
জ্যাক কনির নাম পুলিসের খাতায় আছে এটা শুনেছি। আপনারা তার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে পারেন। পাঁচ-ছয় বছর আগে স্যান বারনাডিনোতে সে অ্যারেস্ট হয়, তারপর জেলেই তার জীবন কাটে চার বছর। আমার বদ্ধমূল ধারণা ফিলিপসকে যদি কেউ মেরে থাকে তবে সে কনি।
ঠিক আছে আমি দেখছি। ফিলিপস মারা যাবার সময় তার উপস্থিতি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হবে।
সিগারেটটা পায়ে চেপে নিভিয়ে দিয়ে বলে উঠি, তাই করুন। আমাকে যদি আর প্রয়োজন না লাগে তাহলে আমি এখন যাবো। হাতে অনেক কাজও আছে।
ঠিক আছে, যান–তবে বেশি দূরে যাবেন না। আপনাকে আমাদের দরকার পড়লেও পড়তে পারে।
চিন্তাচ্ছন্ন মন নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম। বিদ্যুৎ চমকের মতো এক কথা হঠাৎ করে মনে এল। জানি না একথাটা আমার আগে কেন খেয়াল হয়নি। তা হল, কোরিনের কেশ কালো, তাই মৃতা মেয়েটি কোরিন হলে নিশ্চয়ই তার কেশে রঙের প্রলেপ লাগানো হয়েছে, সকলের সামনে সুসানরূপে তাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা।
কথাটা মনে আসতেই আমি এক লাফে গাড়িতে উঠে একটা ওষুধের দোকান থেকে শেরিফ পিটার্সের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলাম।
আমার নামটা শোনা মাত্র লোকটার হাব-ভাব দেখে মনে হল ও খুশি হয়েছে।
বললাম, শেরিফ, আমার হাতে এখন কতগুলো প্রমাণ এসে পৌঁছেছে, যাতে করে বোঝায় মৃতা মেয়েটি কোরিন কনি হবার সমস্ত সম্ভাবনা অটুট। দয়া করে দেহটা দেখে আমায় বলবেন, ওর চুলের গোড়াগুলো কালো কিনা!
তোমার এই চিন্তা মাথায় এল কী করে দেহটা এতক্ষণ আমার কাছে থাকবে? জ্যাক কনি ওটা নিয়ে গেছে। সরেজমিন তদন্তের দুদিন পরে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়াও সম্পন্ন হয়ে গেছে।
অন্ত্যেষ্টি যে হয়ে গেছে আপনি জানেন ঠিক?
নিশ্চয়ই। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বলে করোনোর ঘোষণা করার পর আমার করণীয় কিছুই ছিল না। কনির মৃতদেহ দাবি করার যথেষ্ট যুক্তি ছিল। তবে মেয়েটার আঙুলের ছাপ আমি নিয়ে রেখেছি। কনিই আমাকে এই কাজটা করার জন্য বলেছিল এবং ওটা ফাইলেও রাখার জন্য তার নির্দেশ ছিল। ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কাছে অকারণে অযথা ঝামেলার সম্মুখীন হতে না হয়।
আঙুলের ছাপ আমার কোন কাজেই আসবে না। কারণ ওটা আমার কাছেই আছে। ঠিক আছে, ধন্যবাদ, শেরিফ। রিসিভার নামিয়ে রাখলাম।
টেলিফোন খুপরি থেকে বেরিয়ে বার-দুই ওষুধের দোকানের হাওয়া খুব দ্রুত গতিতে জোরে জোরে ফুসফুসে টেনে নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রমের ছক মনে মনে কষে ফেললাম। সুসান যে কোরিন সেজেছিল এই সত্য যখন প্রমাণ করা সম্ভব হলোই না, তখন কোরিনকে সুসান প্রমাণ করার সর্বশেষ চেষ্টা আমায় করতেই হবে।
আবার খুপরিতে ঢুকে পড়ে ফ্যান’শকে ফোন করলাম। হারমাস বলছি। মিসেসকনিকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পার?
বলতে পারছি না, রায়ানকে জিজ্ঞাসা করলে সে হয়তো কিছু জানতে পারে। তবে সেকারণটা জানতে চাইবে।
তা চাইবে। আচ্ছা যাক, ওকে জিজ্ঞাসা করার কোন দরকার নেই। ওকে কোন হোটেলে। পাওয়া যেতে পারে কি?
তাও বলা সম্ভব নয়। শোনো স্টিভ! আশা করি তুমি তোমার লক্ষ্যে কিছুটা এগিয়েছে। রায়ান আধঘণ্টা আগে এসে খুব চেঁচামেচি করে গেছে। সে আয় আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না।
হ্যাঁ, তা এগিয়েছে কিছুটা,ডাহামিথ্যে বললাম। আজ রাত্রেই কেসটার একটা কিনারা করতে চাই।
ফ্যান’শর সঙ্গে কথা শেষ করে ডায়াল ঘুরিয়ে পুলিস দপ্তরে হ্যাকেটের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম।
ফিলিপসের হত্যাকারীর কোন খোঁজ পাওয়া গেল?
জ্যাক কনি হতে পারে। আমরা একজন সাক্ষীর খোঁজ পেয়েছি, সে দশটা নাগাদ একটা লোককে দোকানের পেছন থেকে বেরোতে দেখেছে। তার বর্ণনা কনির সঙ্গে বহু মিলে যাচ্ছে। আমরা এখন তার সন্ধানেই পাগলের মতো ঘুরে ফিরছি।
ডেড লেকটা একবার দেখুন না, সেখানেও সে চলে যেতে পারে।
শেরিফ পিটার্সের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। তিনি এক্ষুনি লোজন নিয়ে সেখানে হাজির হচ্ছেন।
মিসেস কনির সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে। কোথায় গেলে তার দর্শন মিলবে বলতে পারেন?
কেন—তাকে নিয়ে কী কাজে লাগবে?
ফোনে এসব কথা বলা সম্ভব নয়। তবে ভাগ্য সহায় থাকলে বোধহয় শ্যারম্যান অন্তর্ধান রহস্যটাও ভেদ করার ক্ষমতা আমার আছে।
ঠাট্টা করছেন নাকি?
না ঠাট্টা নয়। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, মিসেস কনির সন্ধান একবার পেলেই সমস্ত ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সেই সঙ্গে শ্যারম্যানেরটাও হয়ে যাবে।
তা, আমাকে কী করতে বলছেন?
মিসেস কনিকে খুঁজে বার করুন। এসব কাজ আমার থেকেও আপনার পক্ষে অনেক তাড়াতাড়ি করে ফেলতে পারবেন–আর তা করতে হবে। কিছু লোককে টেলিফোনে রেখে শহরের প্রত্যেকটা হোটেল আর অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে খোঁজ নিন। রায়ান দাবি নিয়ে আলোচনা করতে পারে ভেবে তিনি হয়তো বেশি দূর এগোবেন না। এটুকু পারবেন তো?
হ্যাকেট সম্মতি জানাল।
আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আবার আপনাকে ফোন করবো। আর হ্যাঁ, শুনুন ক্যাপ্টেন, আমি কথা বলার আগে আপনারা ওঁর সঙ্গে কোন রকম আলোচনা করতে যাবেন না যেন-কেমন?
জ্যাক কনিকে ওর কাছে পেয়ে যেতে পারেন।
তার কোন সম্ভাবনা নেই। তর্ক আর না বাড়িয়ে সংযোগ নিজে থাকতেই বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।
খুপরির বাইরে এসে খানিকটা তরতাজা বাতাস বুকে ভরে সেবন করে আমি আবার ডায়াল ঘোরালাম, এবার যার উদ্দেশ্যে করা, তিনি গুডইয়ার। স্টিভ বলছি। তোর বাড়ি থেকে একটু দূরে মাত্র তিন-মিনিটের হাঁটা পথ। আসবো, নাকি তোর কাছে?
হ্যাঁ, চলে আসতে পারিসগুডইয়ার জবাব দেয়। আমি কাজটা ছেড়ে দিয়েছি, শুনে থাকবি।
শুনলাম। আমিও ছেড়ে দিয়েছি।
তুইও? কখন?
তুই দেবার পরে পরেই। বলবো তোকে সব। আমি আসছি।
চলে আয় তাহলে।
সানসেট বুলেভার্দের কাছে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে গুডইয়ার। বাড়িটার প্রবেশপথ যে কোন লাখপতির নজর কাড়ার পক্ষে যথেষ্ট।
স্বয়ংক্রিয় লিফটে চড়ে দশতলায় উঠে দেখতে পেলাম ফ্ল্যাটের বাইরে দাঁড়িয়েই অপেক্ষা করছে গুডইয়ার।
ডেরাখানা জব্বর তোর, লিফটের দরজা বন্ধ করতে করতে বলে উঠলাম।
তা বটে। তবে এখন যা খরচ বেড়ে গেছে আর পোষাতে পারছি না। ভাবছি, এসপ্তার শেষাশেষি এটা ছেড়ে দেবো। কোথায় তুই ছিলি বতো? তিনদিন ধরে আমি তোর খোঁজ করছি।
ম্যাডক্সের সাথে ঝামেলা হতে কেটে পড়েছিলাম। স্যান বারনাডিনোতে হেলেনের কাছে ছিলাম কদিন। তুই যে কথা বলতে চেয়েছিলি একথাটা স্মরণেই ছিল না।
বিরাট বৈঠকখানায় আমায় নিয়ে ঢোকাল গুডইয়ার। ঘরটার চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠলাম, বাবাঃ! এই জায়গা তুই ছেড়ে দিচ্ছিস?
গুডইয়ার দরজা বন্ধ করল। হ্যাঁ, কি আর করা যাবে, বল। তাহলে তুই ঐ কাজ ছেড়ে দিলি?
একটা বিরাট আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিলাম। হ্যাঁ। ম্যাডক্স ওলে জ্যাকসনকে আমার জায়গায় লাগাতেই রিজাইন দিলাম।
আঁ?…বোঝ তাহলে। এবার তুই কি করবি বলে ভেবেছিস? অন্য কোম্পানিতে চেষ্টা করবি?
আমি মাথা নাড়ালাম। না, আমায় বেশ কিছু টাকা কামাতে হবে। এই কেসটা উদ্ধার করতে পারলে পুরোটাকার এক পারসেন্ট আমার ভাগ্যে জুটবে। দশ লক্ষ ডলারের এক পারসেন্ট নেহাৎ মন্দ তো নয়।
গুডইয়ার হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। ফ্যাকাশে মুখ জুড়ে চিন্তার রেখা। কিন্তু তুই একলা পারবি কি?
নিশ্চয়ই।
একটা সিগারেট বার করে স্থির চোখে আমার দিকে তাকাল গুড়ইয়ার। তোর একথা বলার অর্থ এই দাঁড়ায় সে এই ব্যাপারটা যে ভুয়ো তা প্রমাণ করার ক্ষমতা তুই রাখিস? মেয়েটাকে মেরে ফেলা হয়েছে?
আমার তো তাই বিশ্বাস, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিই। এই খুনের সঙ্গে সঙ্গে শারম্যানের অন্তর্ধাণরহস্যটাও আমার ভেদ করা হয়ে গেছে, বাকি শুধু উন্মোচন। গুডইয়ার আমার সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসলো। বল্ তো আমায়, ব্যাপারটা কি!
হফম্যান মারা যাবার পর থেকেই আমি তোর বিষয়ে চিন্তা করছি অ্যালান। তুই আর আমি ছাড়া আর তৃতীয় ব্যক্তি কেউ জানতো না যে, আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। আমি রওনা হবার পরই তুইই কনিকে ফোন করে হফম্যানের মুখ বন্ধ করতে চিরদিনের মতো ঠাণ্ডা করে দিতে বলেছিলি–তাই না?
শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল গুডইয়ার। তুই কি বকছিস, স্টিভ?
অনর্থক ভাঁওতা দেবার চেষ্টা তুই যার সঙ্গে ইচ্ছে হয় করিস, কিন্তু আমার সঙ্গে করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করিস না, সুবিধে হবে না, অ্যালান। জোইস শ্যারম্যানকে কিডন্যাপ আর কোরিনকে হত্যা, এই দুটোর পেছনেই তোর হাত আছে। ব্যাপারটা এখন দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ। তাছাড়া ম্যাডক্সকে তুই বলেছিলি, ডেনির সঙ্গে তোর সাক্ষাৎ হঠাৎ-ই–আসলটা একটু অন্যরকম। এ ব্যবস্থাটা তোর হয়েছিল সুসান গেলারে সঙ্গে এটা সূত্র হিসেবে নিতান্ত সূক্ষ্ম হলেও এটাই তোর বিরুদ্ধে প্রথম সন্দেহ আমার মনে দানাবাঁধে। মাঝে মাঝেই হুট হাট করে আমার কাছে হাজির হয়ে আমার থেকে সব খবর সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছিলিস। তোকে শর্ট ওয়েভ রেডিও সেটটার কথা বলে আমি আর একটু হলেও নিজের পায়ে কুড়ুল মেরে জান দিতে বসেছিলাম। খবরটা যদি কেউ পাচার করে থাকে সে তুই। সুসানের আঙুলের ছাপটা যে পলিসির ওপর দুর্ঘটনা ক্রমে পড়ে গেছে–এ তথ্যটাও তোর মুখ থেকে আমাদের সেই প্রথম শোনা। ও ছাপটা কোনদিনই সুসানের ছিল না, ওটা ছিল ওর বোনের।
তুই বোধহয় আমার সঙ্গে ঠাট্টা তামাসা করতেই এসেছিস। গুডইয়ার মুখে এই কথা বলছিল কিন্তু চোখ দিয়ে ঝরছিল আগুন। না হলে আমাকে ধরে নিতে হবে তোর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে।
দ্বীপের মধ্যে মেয়েটাকে কী ভাবে খুন করা হয়েছিল তাও আমার জানা হয়ে গেছে। জোচ্চুরি যদি একটা করতিস তাহলে হয়তো ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না তোর, কিন্তু দুটো এক করতে গিয়েই তুই ভুল করে ফেললি। জোইস শারম্যানের কিডন্যাপটা কেউ ধরতে পারতো না, কিন্তু অন্যটার ক্ষেত্রে তুই একটু বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলিস।
এসব শোনার আমার কোন দরকার নেই, গুডইয়ার শান্তকণ্ঠে বলে উঠল।
সেটা তোর ইচ্ছে।উঠে দাঁড়াই। আমি ভেবেছিলাম, আমার মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর তোকে খুশি করতে পারব। এখনও পর্যন্ত আমি কারো কাছে মুখ খুলিনি। ঠিক আছে, চলি তাহলে। তুই ভাবিস না, এর থেকে রেহাই তোর সহজে মিলবে অ্যালান। তা একেবারেই অসম্ভব। গুডইয়ারের কাছ থেকে কোন উত্তর আসছে না দেখে আমি দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। আমি দরজা খুলতে যাব ঠিক এই সময়ে উত্তর এল, দাঁড়া! আমি ঘুরে দাঁড়ালাম।
বেশ, আমি ভাবছিলাম ব্যাপারটা বোধহয় আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু ব্যবস্থাটা এখনও করা যায়। এর মধ্যে দশলক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলারের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। টাকার অঙ্কটাও বিরাট। তুই এক পারসেন্টের কথা বলছিলি, আমি তোকে এর তিন ভাগের এক ভাগ দিতেও প্রস্তুত।
বখরার টাকা আধাআধি করলে কেমন হয়? আমি আবার গিয়ে আরাম কেদারায় বসে পড়লাম।
তিন ভাগের এক ভাগ। তুই, আমি আর ঐ মেয়েটা এক ভাগ করে প্রত্যেকে।
আর কনি?
ওকে আমাদের সরাতে হবে। লোকটা সত্যিই ভীষণ ভয়ঙ্কর। আমার যা মনে হয়, টাকাটা, এক হাতে এসে গেলেই যে আমাকেও শেষ করে ফেলতেও দ্বিধা বোধ করবেনা। খুন করাটা ওর কাছে নেহাৎ-ই এক ছেলেখেলা।
তুই রাইসের কথাটা ভুলে যাচ্ছিস। তাকে টাকা দিতে হবে না?
তাকে নিয়ে আমার নতুন কোন সমস্যা দেখা দেয়নি। পুলিস তাকে জড়িয়ে নিয়েছে, কিছু করার সাহস তার হবে না। টাকার ব্যাপারটা ফয়শালা হলেই, তুই, আমি আর মেয়েটা–অবশ্য তোরও যদি ইচ্ছে থাকে–এখান থেকে কেটে পড়বো। রাইস নিজেকে না জড়িয়ে আমাদের ধরাতে পারবে না?
শ্যারম্যানের দরুণ তুই পঞ্চাশ হাজার পেয়ে যাচ্ছিস।
হ্যাঁ। এক হপ্তার মধ্যেই রায়ান তার দাবি পেশ করবে। আমি তোর মুখ বন্ধ করতে পুরো– টাকা তিন ভাগের এক ভাগ দিতেও প্রস্তুত আছি, স্টিভ।
আমার কাছ থেকে তুই ওইটুকু পেয়ে গেলেই সন্তুষ্ট?
গুডইয়ার মুহূর্তের জন্য ইতস্ততঃ করল। ওই আর…কনিকে সরাতে আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
যতদিন ও বেঁচে থাকবে আমরা শান্তিতে দু-চোখের পাতা এক করতে পারবনা।
মসি ফিলিপসের স্টুডিও থেকে তাকে বেরোতে দেখা গেছে। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।
ওকে তারা কোনদিনই খুঁজে পাবে না। এর আগেও সে বহুবার পুলিসের চোখকে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে।
তুই জানিস সে এখন কোথায়?গুডইয়ার মাথা নেড়ে জানায় সে জানে।
হাত বাড়িয়ে আমি সিগারেটটা ছাইদানিতে গুঁজে দিলাম।
তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, অ্যালান আচ্ছা, কে তোকে এসব বুদ্ধি যোগালো বল তো? এজেন্টগিরি করে তুই তো বেশ ভালোই পকেট ভারি করছিলি। হঠাৎ করে রাতারাতি রাজা হবার এই উদ্ভট খেয়াল তোর মাথায় ঢুকলো কেন?
কে বলেছিল আমি ভালো ছিলাম? গুডইয়ার ফোঁস করে ওঠে। আয়ের দ্বিগুণ খরচা হয়ে যাচ্ছিল। গলা পর্যন্ত ধারে আমি বিকিয়ে গেছি। কিছুনা কিছু একটা করা ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। দশলক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলারের অঙ্কটা মন্দ নয়, তখন কনির সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না। খুন-টুন আমার ধাতে সয়না মোটেই।
আমি স্থির চোখে ওর দিকে তাকালাম। তাই নাকি? কোরিন-কনিকে কিন্তু তুই খুন করেছিস।
মুহূর্তের মধ্যে গুডইয়ারের বদন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মিথ্যে কথা! কনি তাকে মেরেছে।
কনি মারবে কী করে, কনি তখন সেখানে ছিলনা। স্প্রিংভিলেতে চিঠি নিতে গিয়েছিল। খুনটা তুই ছাড়া আর কেউ করেনি, অ্যালান।
বহু কষ্টে গুডইয়ার নিজেকে সংযত রাখল। ওকলে তখন দ্বীপটার ওপর নজর রাখছিল। সে আমাকে যেতেও দেখেনি, আর ফিরে আসা প্রশ্ন তো উঠছেই না। খুনটা যে আমার কীর্তি তুই প্রমাণ করবি কীভাবে?
আজ সকালে তোর ব্যক্তিগত ফাইল স্বচক্ষে দেখার আগে পর্যন্ত আমি এটা জানতাম না। কিন্তু যখন দেখলাম, যুদ্ধের সময় সাবমেরিনে তুই কাজ করতিস, তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝে গেলাম। আমি জোর গলায় বলতে পারি, তোর ডুবুরির-পোষাকটা লেকের ধারে কোথাও না। কোথাও পাওয়া যাবে। ওটা পরে, সবার অলক্ষ্যে জলের তলা দিয়ে সাঁতরে সেখানে উপস্থিত হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে, আবার ফিরে আসা তোর পক্ষে কঠিন ছিল না। সত্যি প্রশংসা না করে পারছি না, চমৎকার কৌশল, অসাধারণ তোর বুদ্ধি অ্যালান, কিন্তু অফিসের ব্যক্তিগত ফাইলটার কথা তুই ভুলে গিয়েছিলি।
গুডইয়ার উঠে দাঁড়াল। ওর চোখ মুখ গ্রানাইট পাথরের মতো কঠিন। আমার সঙ্গে থাকার কোন ইচ্ছে তোর আছে? টাকা যদি পাওয়া যায় আমি তিন ভাগের এক ভাগ তোর হাতে তুলে দেব।
টাকা পাওয়ার সব রাস্তা এখন বন্ধ, অ্যালান তুই ধরা পড়ে গেছিস। মেয়েটাকে খুন না করলে তোকে পালানোর একটা সুযোগ আমি দিতাম, এখন আর এসব ভেবে কোন লাভ নেই, উপায়ও নেই। আমি দুঃখিত, ও কাজটা যখন করেছিস তার শাস্তি তোকে মাথা পেতেই নিতে হবে।
সহসা সে জানলার ধারে সরে গিয়ে টেবিলের দেরাজ থেকে একটা রিভালভার বার করে আমার দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াল।
আমি এটা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি,ওর গলার স্বর কর্কশ, কেমন কাঁপা কাঁপা। পঞ্চাশ হাজার ডলার আমার নিজের কাছেই আছে। বাকি টাকাগুলো যদি কপালে নাও জোটে, যেটুকু সম্বল আমার আছে তাই নিয়েই গা ঢাকা দেবো।দুনিয়ার এমন কেউ নেই যে আমার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
বোকার মতো কাজ করিস না। আমাকে মেরে তোর সমস্যার কোন সমাধান হবেনা। তুই যে তিমিরে ছিলিস, সেই তিমিরেই থেকে যাবি। এরকম একটা নাম করা জায়গায় গুলি চালালেই চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে যাবে–তাই তখন কিছুতেই পালাতে পারবিনা। উঠে দাঁড়ালাম।
আমি পুলিশের কাছে যাচ্ছি, অ্যালান। ভাবার জন্য তোর কাছে কুড়ি মিনিট সময় দিয়ে গেলাম, এটুকু সময় তোর পক্ষে যথেষ্ট। তবে যাই করি, বাঁচার সব রাস্তাই আজ তোর কাছে বন্ধ, পালিয়ে তুই বাঁচতে পারবিনা। ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে গুটিগুটি পায়ে এগোতে থাকলাম। দাঁড়া! সেফটি ক্যাচের ক্লিক ক্লিক শব্দ কানে এল।
ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে উঠি, চলি, অ্যালান। আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। দরজা খুলে বাইরে পা বাড়ালাম।
লিফটে পা রাখতে গিয়ে গুডইয়ারের মুখটা ভেসে উঠতেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বীমাকোম্পানিতে যোগ দেবার সময় থেকে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। এতোদিন আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি।
তাছাড়া ও আমার বরাবরই প্রিয় ছিল, ভীষণ পছন্দ করতাম।
সহসা গুলির শব্দটা হাওয়ায় ভেসে আসতেই মনে হল, কেউ যেন আমার পাঁজরে সজোরে মোম লাথি কষিয়েছে।….
.
গোলকধাঁধার অন্তিম শেষ চক্রটা মিলল ঐ দিনের বেলায় পাঁচটায়। হয়তো সময় আর একটু বেশি লাগত যদি না পেরি রাইসের বান্ধবী মীরা ল্যাসটিসের সঙ্গে দেখা করার অনুপ্রেরণার তাগিদ অনুভব করতাম।
পুরো চক্রান্তটা খুলে বলতেই মেয়েটা ঘাবড়ে গিয়ে গলগল করে আমার কাছে ফাস করে দিল সব, যতটুকু ও জানত। ওর কথা থেকে যা বুঝলাম, জোইস শ্যারম্যানের অন্তর্ধাণ বা বীমা কোম্পানির টাকা খিচে নেওয়ার চক্রান্ত–কোনটার সঙ্গেই ও যুক্ত ছিল না।
রাইস খুনের দায়ে জড়িয়ে পড়বে শুনে ও আমার দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আমার ভিন্ন ধর্মী প্রশ্নের একে একে উত্তর দেবার পর জোইস শ্যারম্যানের কক্ষে ঢোকার অনুমতি ওর থেকে অবশেষে পেলাম।
ওর কাছে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করার পর মনে হলো, এবার আমি কেসটাকে অনায়াসেই সমাধান করতে পারি। প্রথমে আমি পুলিস সদর দপ্তরে পৌঁছলাম। ওখানে হ্যাকেটকে ব্যাপারটা খুলে বলতে আমার আধঘণ্টা সময় বেড়িয়ে গেল। তাকে আশ্বস্ত করার পর টেলিফোনে ম্যাডক্সকে ডেকে পাঠালাম।
দশ মিনিটের মধ্যে হাজির হয়ে গেল ম্যাডক্স। বীর বিক্রমে পা ফেলতে ফেলতে হ্যাকেটের দপ্তরে প্রবেশ করল। আমি যখন গুডইয়ারের সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত হ্যাকেটের লোকেরা। ক্যানিওন ড্রাইভের কাছে একটা অ্যাপার্টমেন্টে কোরিন কনির সন্ধান পেয়ে যায়।
আপনার কাছে পনেরো হাজার ডলার পাওনা রইল আমার, ম্যাডক্স এসে বসতেই তার উদ্দেশ্যে বলে উঠি। কেসটা আমি সমাধান করেছি আর এবার অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি। তাই লেনদেনের ব্যাপারটা এরকম পরিস্থিতিতে চুকিয়ে ফেলাই যুক্তিসঙ্গত।
সত্যি বলছো? ম্যাডক্সের কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর। তা যদি হয় তবে আমার টাকা দিতেও কোন আপত্তি নেই। রায়ান আমায় সারাদিন ধরে জ্বালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা কি এখন বেরোতে পারি? হ্যাকেট অধৈর্যের সুরে বলে ওঠে।
হা। ম্যাডক্সকে বলে উঠলাম, আমরা এখন মিসেস কনির সঙ্গে একবার সাক্ষাত করতে যাবো। আমরা তিনজন আর সঙ্গে দুই জন পুলিস। যদি কোন ঝামেলায় পড়তে হয় তবে ওরা ব্যাপারটা সামলে নেবে। ওদের এই কারণেই সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
আগে ব্যাপারটা শোনাও দেখি, ম্যাডক্স দপ্তরের বাইরে আমাদের অনুসরণ করে চলল। বলল, কীভাবে এততা সব জানলে?
হুকুম অমান্য করার পরেও।আমি দন্ত বিকশিত করে হেসে ফেললাম। আপনার কথা শুনে আমি যদি স্প্রিংভিলেতে না গিয়ে পড়তাম, তাহলে এ কেসটার ঘোলাটে রহস্য কোনদিনই উন্মোচন করা সম্ভব হতো না। আর এর জন্যই পনেরো হাজার ডলার আপনার পকেট থেকে খসতে হচ্ছে।
অত ন্যাকামি না করলেও চলবে, ম্যাডক্স খেঁকিয়ে ওঠে।কে ছিল আর কারই বা হাত ছিল এর পেছনে? ওকে গাড়িতে ওঠার প্রথম সুযোগটা দিতে আমি একটু পাশে সরে দাঁড়ালাম। তারপর দুজন পুলিস অফিসারের সঙ্গে সামনের সীটে গিয়ে বলে পড়লাম, আর জবাবে বললাম, আমাদেরই একজন, অ্যালান গুডইয়ার। অপ্রত্যাশিত এক নীরবতা ক্যানিওন ড্রাইভের অ্যাপার্টমেন্ট হাউসটা পর্যন্ত স্থায়ী রইল।
গাড়িটা কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে আমরা সদলবলে বাড়িতে প্রবেশ করলাম। বাড়ির মালকিনকে আগে থাকতেই খবর দেওয়া হয়েছিল। তিনি দরজা খুলেই রেখে ছিলেন। আমরা ঢুকতেই শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এসে উত্তেজনার সঙ্গে ফিসফিস করে বলে উঠলেন, দোতলায় নিজের ঘরেই আছে। আজ সারাদিন একবারও ঘরের বাইরে পা দেয়নি।
হ্যাকেট একজন পুলিসকে হলঘরে দাঁড় করিয়ে আর অন্যজনকে বাড়ির পেছন দিকটায় যাবার নির্দেশ দিল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলে উঠল, আপনি না হয় নক করুন। আমি সময় মতো যোগ দেবো।
এসব হচ্ছেটা কি? ম্যাডক্স গজগজ করতে করতে বলে ওঠে। ওখান থেকে বেরোনোর আগের মুহূর্তে আমাকে কী সব জানানো হয়েছিল?
হাতে তখন সময় ছিল না আমাদের? এই বলেই আমি অতো আগে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করলাম।
নির্দিষ্ট দরজার দোরগোড়ায় পৌঁছে আঙুলের গাঁট দিয়ে সজোরে কয়েকটা টোকা মারলাম। কয়েক মুহূর্ত পর যে মেয়েটা দরজা খুলে আমার সামনে সশরীরে এসে উপস্থিত হল তাকে দেখতে অনেকটা কোরিন কনির মতো। আতঙ্কে ওর নীল চোখের মণি দুটো বিস্ফোরিত।
ব্যাপার কি, মিঃ হারমাস…?
এইতো! ভেতরে আসার অনুমতি পেলে আমরা ঢুকতে পারি?
ইয়ে…মানে, তা বোধহয় সম্ভব হচ্ছে না। ঘরটা এমন বিশ্রী ভাবে অগোছালো আছে..।
এঁদের ঠিক চিনতে পারলাম না, এঁরা কারা?
বাঁ দিক থেকেই শুরু করছি। মিঃ ম্যাডক্সন্যাশনাল ফাঁই দলটির বড়সাহেব আর পুলিস ক্যাপ্টেন মিঃ হ্যাকেট। আপনি যে টাকাটা ইনসিওর কোম্পানির কাছে দাবি করেছেন আমরা সেই ব্যাপারেই কথা বলতে এখানে এসেছি।
মাথা নাড়ল আবার।
আমি দুঃখিত। আপনারা বরং মিঃ রায়ানের সঙ্গে আগে একবার কথা বলুন। উনি আমার অ্যাটর্নি।
আমরা তার সঙ্গে কথা বলার পরই এখানে আসছি। উনি আপনার কেস আর চালাবেন না, মিসেস কনি-নাকি মিস গেলার্ট, কোনটা বলে সম্বোধন করবে আপনাকে? অনুমতির অপেক্ষা না করেই বৈঠক খানায় পা রাখলাম।
হ্যাকেট আর ম্যাডক্সও আমাকে অনুসরণ করল। ভেতরে ঢুকেই ম্যাডক্স নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। পিছু হাঁটল মেয়েটি, সারা মুখ রক্তশূন্য। আমরা সকলেই বসলাম।
আমি প্রথম আমার বক্তব্য শুরু করলাম, আমি যা জানি সংক্ষেপে জানানোর চেষ্টা করবো। মিঃ ম্যাডেক্সের কানে এখনও কিছু পৌঁছয় নি, তাই তাকেও এবিষয়ে শোনানো দরকার। আশা করি খুঁটিনাটি বিবরণে আপনি বিরক্ত হবেন না।
আমি একটা কথাও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাইনা। আমি আমার অ্যাটর্নির সঙ্গে আগে কথা বলবো।
আপনার অ্যাটর্নি সরে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু মনে হয় না উনি আপনার কোন উপকারে লাগতে পারবেন। গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলাম, গুডইয়ার আর বেঁচে নেই তবে অন্তিম কালে যে আমাদের একটা উপকার করে গেছে। শেষ মুহূর্তে সে সবকিছু নিজের মুখেই ফাঁস করে গেছে।
রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে স্তব্ধ হয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে পড়ল। সিগারেট ধরিয়ে পরম নিশ্চিন্তে আরাম করে হেলান দিয়ে আমি আবার বলতে শুরু করলাম, ঘটনার সূত্রপাত হয় পাঁচ বছর আগে স্যান বারনাডিনোতে। আপনি আর আপনার বোন তখন নাইট ক্লাবে কাজ করতেন। কোরিন বিবাহ করে বসে কনি নামের এক গুণ্ডাকে–লুঠত রাজ করেই যার জীবনের একটা একটা দিন কেটে যাচ্ছিল। ঘটনাচক্রে কোরিনের সঙ্গে পেরি রাইসের আলাপ হয়ে যায়। রাইস তখন মরিয়া হয়ে সিনেমায় নামানোর মতো একটা মেয়েকে পাগলের মতো অনুসন্ধান করে ঘুরে ফিরছে। নাইট ক্লাবে ঢোকার আগে কোরিন অভিনয় ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়েছিল, তাই সিনেমায় নামার এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার কোন বাসনা তার ছিল না। রাইসকে ও স্বভাবগুণে সহজেই প্রভাবিত করল।
রূপের সঙ্গে সঙ্গে গুণও ছিল সমপরিমাণে কিন্তু প্রতিবন্ধকের সৃষ্টি করল ওর ব্যক্তিগত পরিচয়।
ও এমন একজনের স্ত্রী যে এর মধ্যেই দশ বছর জেল খেটেছে। তার ওপর ও নিজেও ছোট খাটো একটা নাইট ক্লাবে অশালীন দেহ প্রদর্শনের জন্য কয়েকবার জেলের হাওয়া খেয়ে এসেছে। এই পরিচয় সম্বল করে নামকরা অভিনেত্রী হতে পারে না কেউই। বাজার মন্দা, দেনায় তার গলা পর্যন্ত ডুবে আছে। নিজের মোটা মূল্যের উপার্জন সঙ্গতি রেখে এক চমকপ্রদ অভিনেত্রী জোটাতে না পারলে তার চাকরি চলে যাবে। তাই সে কোরিনকে নতুন চেহারায়, নতুন নামে, নতুন পরিচয় দেবার ব্যাপারে মনস্থ করে ফেলে। এর প্রথম পদক্ষেপ ছিল কনিকে যে কোন উপায়ে সরানো। কোরিন এমনিতেই কনির ওপর তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল, তাই ওকে দিয়ে পুলিশকে কনির ঠিকানায় খবর পাঠাতে রাইসকে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু কোরিন বোকার মতো আপনার কাছেও নিশ্চিন্ত মনে উপড়ে দিল কারণ সে জানতনা, আপনার আর কনির মধ্যে দহরম মহরম আছে যথেষ্ট। একটু থেমে জিজ্ঞাসা করি, লাগছে কেমন? গল্পটা অবশ্য পরে আরও রসালো হয়ে ওঠে।
কোন উত্তর না দিয়ে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নিশ্চল হয়ে চুপচাপ বসে রইল। সুসান। ওর মুখটা এখন পাথরের মতো কঠিন।
আপনি কনিকে সতর্ক করার চেষ্টা করবেন, আমি.বলে উঠলাম। কিন্তু তখন আর সময় নেই, অনেক দেরী হয়ে গেছে। কনি গ্রেপ্তার হলো আর আপনার মেরে ফেলার শাসানির চোটে ভয় পেয়ে কোরিন গা ঢাকা দিল। গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হলো, কোরিন বুয়েনস এয়ারসে গেছে, কিন্তু আসলেও তখন রাইসের সংরক্ষণে নিজের ভোল পাল্টাতে সদাই ব্যস্ত। ওর ঘন কালো চুলের রঙ পাল্টে ফেলে লাল করে। রাইস এক প্লাস্টিক সার্গানের সাহায্য নিয়ে ওর চোখ দুটো ও রূপ বদলে আয়তকার হয়ে গেল। খুব সামান্য হলেও এই দুটো পরিবর্তন কোরিনকে এক নতুন রূপ এনে দিল।… রাইস ওকে নিয়ে হাজির হল হলিউডে। সেখানে ওর পরিচয় স্যান বারনাডিনোতে এক হোটেল পরিচারিকা রূপে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো যাকে রাইস এক প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী বলে সংগ্রহ করে এনেছে। আর এটাই হলো জোইস শ্যারম্যানের জীবনের ইতিবৃত্ত।
মানে জোইস শারম্যানই আসলে ছিল কোরিন কনি? বিস্ময়ে ম্যাডক্সের চোখ দুটো এখন আর আগের মতো নেই, ভোল পাল্টে ছানা বড়া হয়ে গেছে।
হ্যাঁ–অবশ্য আপনি ছিলোকথাটা জুড়ে দিতে পারেন। জোইস শ্যারম্যান বা কোরিন কনি বর্তমানে মৃতের তালিকায়। আর স্ব-মহিমায় যিনি আমাদের সামনে ঘর আলো করে বসে আছেন তিনি এর বোন–সুসান।
ফ্যাকাশে মুখে সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকে মাথা নাড়লাম। হেলেনের মনে অদল বদলের এই সম্ভাবনা প্রথমে এসেছিল। সেই তার মনের কথা আমাকে খুলে বলে। এখন দেখছি ওর চিন্তাধারা সম্পূর্ণ নির্ভুল। আসলে রাইস কোরিনের কাছ থেকে এরকম চমকপ্রদ সাফল্য আশা করেনি। কিন্তু রাতারাতি ও হলিউডের সবচেয়ে নামী অভিনেত্রী হয়ে উঠতে সে কোরিনের ওপর নিজের অধিকার স্থায়ী করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। সে কোরিনকে এই বোঝায় যে কনি কোনদিনই ওর সন্ধান পাবে না আর রাইসকে বিবাহ করলে ওর কাজে আরও সুবিধে হবে।
রাইস আর কোরিনের বিয়ে হলে পরবর্তী দুবছর বেশ ভালো ভাবেই কেটে যায়। কিন্তু টাকার গরম কোরিনের সহ্য হলোনা। মদে ডুবে থাকতে শুরু করে দিল। রাইস ওকে বহুবার চেষ্টা করেছে এই মদের নেশা থেকে বার করতে, কিন্তু সফল হওয়ার পরিবর্তে বিফল হল। তখন ওর মদ খাওয়া কাজের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। আর ঠিক এই সময়ে জেল থেকে বেড়িয়ে আসে কনি, এই নাটকে তার ভূমিকা ছিল একদম আলাদা।
সুসান গেলার্টের দিকে আঙুল নেড়ে বলে উঠলাম, আপনি আর সে একত্রে মিলিত হয়ে হাত মেলায়, জোট বেঁধে পুলিসে সংবাদ দিয়ে, কনিকে পুলিসের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য কোরিনকে শিক্ষা দেবার নতুন মতলব কষলেন।
জোইস শ্যারম্যানকে নিয়ে আপনার মনে আবছা এক সন্দেহের বীজ ছিল, তাই সে বিষয়ে খোঁজ নিতে কনি হলিউডে হাজির হলো।
সে কোরিনকে সহজেই চিনে ফেলে, রাইসের কথা, বিবাহের কথা জানতেও তার বেশি সময় লাগেনি।
ব্যস, ব্ল্যাক মেল করার এক মোক্ষম সুযোগ পেয়ে যায় কনি। রাইসের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে মুখ বন্ধ রাখার জন্যে টাকার দাবি জানালো। রাইস কিন্তু কোরিনকে নিয়ে অন্যরকম মতলব কষেছিল। সে তখন ভালোভাবেই বুঝে গেছে, মাস কয়েকের মধ্যে কোরিন ফিল্ম লাইন থেকে শাচনীয় ভাবে বিতাড়িত হবে। ওর মদ পানের নেশা দিনকে দিন এতো বেশি মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল যে, বেশির ভাগ সময়ই তার হুঁশ থাকনা। নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো সর্বক্ষণ নিজের পাট মুখস্থ করার ক্ষমতা পর্যন্ত তার ছিলনা। সময় সময় স্টুডিওর মধ্যেও ওকে মাতাল অবস্থায় চোখে পড়তো। হাওয়ার্ড লয়েডও ওকে তাড়ানোর জন্য চুক্তির মেয়াদ সমাপ্তের প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়েছিল।
ঠিক এই সময় এক ইনসিওরেন্স এজেন্ট রাইসকে এক দুর্ঘটনা বীমা করাবার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। রাইসের মনে হল, লোকটাকে টাকার লোভ দেখিয়ে কিনে নেওয়া খুব সহজ ব্যাপার এই এজেন্টের নাম ছিল, অ্যালান গুডইয়ার। এক নাগাড়ে কথা বলতে বলতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণ দম নেবার পর আবার বলে উঠলাম। রাইস কনিকে নিজের পরিকল্পনার কৌশল জানিয়ে তাতে যোগ দেবার জন্য আহ্বান জানানো হল। পরিকল্পনাটা কনির মনে ধরল, কারণ কাজ হাসিল করার পর রাইসকে অনায়াসেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলে পুরো টাকাটা হাতিয়ে নিতে কোন অসুবিধে হবে বলে তার মনে হলো না। ব্ল্যাকমেলের চিন্তা ছেড়ে সে রাইসের সঙ্গে হাত মেলালো।
ভাগ্যদেবীর কৃপাদৃষ্টি তখন রাইসের ওপর। বেহিসেবী খরচের দরুণ গুডইয়ারের তখন দেনায় ভরাডুবি। রাইসের কাছ থেকে আসা এরকম লোভনীয় প্রস্তাব সে এড়াতে পারল না। পরিকল্পনাটা দুঃসাহসিক হলেও ভীষণ লাভজনক ছিল। কাজ ঠিক মতো সমাধান করতে পারলে তাতে করে দশ লক্ষ ডলারের সরাসরি আমদানি আর তার ওপর ছিল কোরিনের শেষ নিষ্পত্তি। আর এটা যদি হয়ে যায় রাইসের মীরা ল্যাসটিসকে বিয়ে করার পথে কোন অসুবিধেও দেখা দেবে না। আপনার আর কনির উদ্দেশ্যও পূরণের পথে পা বাড়িয়েছিল।
পরিকল্পনাটা ছিল সংক্ষেপে ঠিক এইরকম : আপনি যততটা কম সম্ভব প্রিমিয়ামে দশ লাখ ডলার মূল্যের দশটা দুর্ঘটনা বীমা করাবেন। ওদিকে রাইস কোরিনকে দিয়ে পঞ্চাশ হাজার ডলারের অপহরণ বীমাও এই সুযোগে করিয়ে নেবে।
পলিসি করাবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে কোরিনকে অপহরণ করে দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে চুলের রঙ পাল্টে এমন পদ্ধতিতে ওকে মেরে ফেলবে, যেটার উল্লেখ ইনসিওরেন্স পলিসিতে। থাকবে না। তারপর নিজের চুল রঙ করে, (কালো করে), কোরিন সেজে আপনি ইনসিওরের টাকাটা তুলে নেবেন।
গুডইয়ার ছিল এক দক্ষ সেলসম্যান। কোরিনকে পলিসির জন্য রাজি করাতে তাকে বেগ বিশেষ পেতে হয়নি।মিঃ ম্যাডক্স যখন কাজের অজুহাতে শহরের বাইরে গেলেন, সে বুদ্ধি খাটিয়ে আমাদের বড়কত্তার কাছ থেকে আপনার নামের অ্যাক্সিডেন্ট পলিসিটা কায়দা করে করিয়ে নেয়।
আপনার জায়গায় মারা যাওয়ার কথা ছিল কোরিনের, তার লাশ সনাক্ত করণের জন্য ইনসিওর কোম্পানিগুলো সন্দেহ প্রকাশ করতে পারবে ভেবে, পলিসিগুলোতে কোরিনের আঙুলের ছাপ লাগাবার ব্যবস্থা করে ফেললেন। রাইস একসময় মদ্যপে ডুবে থাকা মাতাল কোরিনকে দিয়ে এ কাজটা সেরে ফেলে। কিন্তু যতটা সে ভেবেছিল কোরিন তখন ততটা বেঁহুশ ছিল না। পলিসিগুলো একবার স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য তার ভাগ্যে জুটেছিল।
কোরিনের মনে সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে লাগল। হফম্যান নামের এক গোয়েন্দাকে ও রাইসের পেছনে লাগিয়ে দেয়। হফম্যানের কাছে রাইসের সঙ্গে কনি আর আপনার যোগাযোগের খবর পেয়ে রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়ে কোরিন। হফম্যানকে পলিসিগুলোর কাজে সে লাগিয়ে দেয়।
অনুসন্ধানে লেগে পড়ে হফম্যান। তারপর ড্যানির অফিসে পলিসিগুলোর খোঁজ পেয়ে হফম্যান একদিন ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল। আর ঠিক তখনই কোরিন জানতে পারল দশ লক্ষ ডলারের অ্যাক্সিডেন্ট পলিসি আপনি করিয়েছেন।
দুর্ভাগ্যবশত ড্যানির অফিস থেকে ফেরার সময় কোরিন বাড়ির দারোয়ান ম্যাসনের সামনে আছড়ে পড়ে–সে ওকে বিখ্যাত অভিনেত্রী জোইস শারম্যান বলে সহজেই চিনে ফেলে। অপ্রত্যাশিত এই বাধায় কোরিন ঘাবড়ে যায় আর নেশার ঘোরে উন্মত্ত ঘটিয়ে হারিয়ে ম্যাসনের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়।
এই ঘরের মধ্যে গুডইয়ার আমাদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবো শুনে সে আগে থাকতেই আপনাকে সাবধান করে দেয়। আপনি তখন রাইসের কাছ থেকে কোরিনের হাতের ছাপের আয়না আনিয়ে হুবহু একরকম আমার হাতে তুলে দেন সযত্নে। কনি আপনার ইনসিওর করার আগের মুহূর্তে দ্বীপটা ভাড়া করে রেখেছিল, আপনি কালো পরচুলা মাথায় চাপিয়ে মাঝে মধ্যে ওখানে গিয়ে থাকতেন। কোরিন যে ওখানেই থাকে এটা লোককে জানিয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল আপনার। স্ত্রীকে নিয়ে আমি যখন উইলিংটনে রাত কাটাচ্ছিলাম, আপনি গাড়িতে উঠে ডেড লেকে চলে যান আর পরের দিন কালো পরচুলা পরে কোরিন সেজে আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে হাজির ছিলেন? আর একটা সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞাসা করি, কী বলা ঠিক হচ্ছে তো?
ডাহা মিথ্যে! ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুসান। আপনি যা বলে গেলেন এর একটাও প্রমাণ করার ক্ষমতা আপনার নেই।
নিশ্চয়ই পিরবো, ঠাণ্ডা মাথায় জবাব দিয়ে সিগারেটে পরপর কয়েকটা টান দিলাম। যাইহোক, এবার কোরিন প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক।…ম্যাসনের অকাল মৃত্যুতে ও চিন্তিত হয়ে পড়ে। ওর এখনও স্থির বিশ্বাস, রাইস ওকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টায় সদা ব্যস্ত। কোরিন মনে মনে গা ঢাকা দিয়ে পালাবার কথাও ভাবতে লাগল। ঠিক এই মুহূর্তে হাজির হল হফম্যান, তবেউদ্দেশ্য ভালো ছিলনা। ব্ল্যাকমেলের পরিক্রমা তার শুরু হয়ে গেল।
একবার যে ঘটনাটা ঘটল; সেই ঘটনার সঙ্গেই চক্রান্তের মিল থাকলেও এটা কিন্তু পরিকল্পিত ছকে ফেলা ঘটনা নয়, এটা একেবারেই কাকতলীয়। কোরিনের সঙ্গে হফম্যানের যেদিন দেখা করে হিসেব মিটিয়ে ফেলার কথা পাকাপাকি হয়েছিল–সেই দিনেই আপনি আর কনি ওকে কিডন্যাপ করার ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
কোরিন বাড়ির বাইরে পা রাখতেই কনি ওকে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর-জবরদস্তি করে তুলে নিয়ে যায়।
হফম্যান ব্যাপারটা দেখার পরও নিজের মুখ বন্ধ রাখে–ওর আশা ছিল এঘটনা থেকে তার ভাগ্যে কিছু হয়তো অর্থ লাভ হবে।
যাই হোক কনি আর আপনি কোরিনকে দ্বীপে নিয়ে গেলেন। মুক্তিপণের টাকা পাওয়া না পর্যন্ত ওকে ওখানে আটকে রাখাই স্থির হলো। আমরা যখন দ্বীপে যাই তখন ও ওখানেই ছিল। যে বীভৎস চিৎকার আমাদের কানে সে পৌঁছেছিল, যেটাকে আপনি স্বচ্ছন্দে কাকাতুয়ারা ডাক বলে চালিয়ে দেন, আসলেও ডাকটা কাকাতুয়ার নয়, ছিল কোরিনেরই আর্ত চিৎকার। আমি খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, কস্মিনকালেও কাকাতুয়া পোর প্রবৃত্তি আপনার ছিল না।
এরপর আবার দেখা এয়ার পোর্টে, কোরিনের বেশ ধরে আপনি আমার সঙ্গে সাক্ষাতে, জানালেন, আপনি এখন বুয়েনস এয়ারস যাচ্ছেন। কারণ সুসানের মৃতদেহ আবিষ্কারের সময় অনেক দূরে থাকাই আপনার পক্ষে শ্রেয় ছিল।
কোরিনকে হত্যার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় গুডইয়ারকে। যুদ্ধে সে নৌবাহিনী ডুবুরির কাজ করত। এখানেও তার কাজ ছিল ডুবুরির, অর্থাৎ ডুবুরির পোষাকে জলের ভেতর দিয়ে সাঁতরে দ্বীপে ওঠা, কোরিনকে খতম করা আর লেকে ছিপ ফেলে মাছের টোপ গেলায় প্রতীক্ষারত বসে থাকা ওকলেকে কিছু বোঝার বিন্দুমাত্র অবকাশ না দিয়ে আবার এক পদ্ধতিতে ফিরে আসা।
পরিকল্পনাটা নিখুঁত ছিল কিন্তু তাও একটা অসুবিধে দেখা দিল। কোরিনের বুকে ছিল একটা জডুল।কথাটা পৃথিবীর দুজন মানুষ জানতোএক, মিসেস পেইসলে যাঁকে নিয়ে আপনারা মাথা ঘামাননি, কারণ সাক্ষী হিসেবে কোন দিনই কোর্টে যাবার ক্ষমতা তার ছিলনা। তবে অন্যজন, মসি ফিলিপস যে স্ট্রিপ নাচের জন্য কোরিনের নগ্ন ফটো তুলেছিল।
আমি লাশ সনাক্ত করতে স্প্রিংভিলেতে গিয়ে আক্রান্ত হই, আবার কনির হাতে। ভাগ্য ভালো সে অপ্রত্যাশিত বাধা পেয়ে পালিয়ে যায়, না হলে সেই দিনই আমার ঘাড় মটকে দিতো। মিসেস পেইসলের সঙ্গে কথা বলার পর আবার আমাকে তার আক্রমণের কবলে পড়তে হয়, ফল স্বরূপ তার গুলিতে আমার স্ত্রী আহত হয়ে শয্যা নেয়। এবারও বরাত জোরে এ যাত্রায় বেঁচে যাই কারণ কাণ্ডারী হিসেবে তখন সেখানে পুলিস এসে হাজির হয়।কনি তখন ফিলিপসকে হত্যা করে কোরিনের ছবিটা সমেত ফাইলটা পুড়িয়ে ফেলে।…আর সবশেষে গুডইয়ার, টাকার লোত দেখিয়ে আমাকে দলে টানার চেষ্টা করে, আর আমি সরাসরি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তার বাঁচার আর কোন উপায় থাকে না। সে নিজেই আত্মহননের পথটা বেছে নেয়।
কিন্তু এতো কিছু করার পরেও এমন একজন আছে যে জানে কোরিনের বুকে জডুল চিহ্নটার কথা। সে হল, মীরা ল্যাসটিস। সে কোর্টে গিয়ে এ বিষয়ে সাক্ষী দিতেও প্রস্তুত। আমিও জোইস শ্যারম্যানের ঘর তল্লাসী করে তার আঙুলের ছাপ তুলে এনেছি। পলিসিতে লাগানো আঙুলের ছাপের সঙ্গে সেগুলো হুবহু মিলে যাচ্ছে। এবার একটা কাজ এখনও বাকি তা হল আপনার চুল যে সোনালী এটা প্রমাণ করা–আশা করি তাতে কোন অসুবিধে হবেনা। হ্যাকেটের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম আমি।
ক্যাপ্টেন, আমার আর কিছু করাই নেই, এবার কেসটা আমি আপনার হাতে তুলে দিচ্ছি। যা যা করণীয় আপনি স্বচ্ছন্দে তা করতে পারেন?
কিন্তু হ্যাকেট উঠে দাঁড়াবার আগেই সুসানের পেছনের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল, ঘরে প্রবেশ করল কনি, হাতে ধরা ৩৮ পিস্তল একটা।
নড়ার চেষ্টা করেছে কি প্রত্যেকের মাথার খুলি উড়িয়ে দেবো!
সুসান সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। আমার সঙ্গে শুভদৃষ্টি হতেই দপ করে জ্বলে উঠল ওর চোখ দুটো। আমরা কেউই নড়া-চড়ার চেষ্টা করলাম না।
ওদের রিভালভারগুলো বার করে নাও, সুসানকে বলল কনি।
প্রথমে ম্যাডক্সের দিকে দু-পা এগিয়ে গেল সুসান। উঠে দাঁড়ান।
বিভ্রান্ত ম্যাডেক্স কাঁপতে কাঁপতে কোনরকমে উঠে দাঁড়াল।
ওর কাছে কিছু না পেয়ে এবার আমার সামনে এসে দাঁড়াল। এবার আপনি।
আমি ওকে বাধা দিলাম না। আড়চোখে একবার দেখে নিলাম, কনির পিস্তলের লক্ষ্য আমার হ্যাঁকটের মাঝামাঝি স্থির হয়ে আছে। কাঁধে ঝোলানো খাপ থেকে বের করে আনল আমার রিভলভারটা।
ভাবলেশহীন মুখে হ্যাকেট চেয়ে চেয়ে দেখল, এবার পালা তার। সুসান তার কাছেই থাকল। তার একটা হাত জানুতে রাখা টুপির তলায় চাপা পড়েছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে উঠে দাঁড়াল।
সুসান কোটের বোম খুলতে যেতেই ওর রিভালভার ধরা হাতে সজোরে এক বাড়ি বসাল হ্যাকেট। আমার রিভালভারটা দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ওর হাত থেকে ছিটকে মেঝেতে এসে পড়ল। আর সেই মুহূর্তেই হ্যাকেট ঘরে গিয়ে সুসানকে আড়াল করে দাঁড়াল।
হ্যাকেটের টুপিটা গড়িয়ে পড়ায় এবার ওর হাতে ধরা রিভালভারটা আমরা সবাই একসঙ্গে দেখতে পেলাম।
দুটো রিভালবারই একই সঙ্গে গর্জে উঠল। হ্যাকেটের গুলিটা সরাসরি গিয়ে বিদ্ধ করল কনির কপালে। সজোরে এক আঘাত খেতেই ছিটকে ঘরের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটি স্পর্শ করলাম।
কনির গুলিটা খেয়ে সুসানি দুহাতে পেট চেপে এমনভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল যেন ওর পিঠে কড়া লাগানো। হাঁটু খুড়তে লাগল ধীরে ধীরে। তারপর ফোপানির মতো এক দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে হ্যাকেটের পায়ে ও লুটিয়ে পড়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল।
.
ঘণ্টাখানেক পরে ম্যাডক্সের সঙ্গে আমি ফ্যান’শর দপ্তরে প্রবেশ করলাম। আমাদের প্রতীক্ষাতেই অধৈর্য মন নিয়ে বসে ছিল ফ্যান’শ। কিন্তু ম্যাডক্সের হাসিতে উজ্জ্বল মুখের দিকে চোখ পড়তেই বুঝে গেল কাজটা হাসিল করেই আমরা ফিরেছি।
শালাদের একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিলাম,দুহাত রগড়াতে রগড়াতে বলে উঠল ম্যাডেক্স। ঐ কুত্তিটাকে গুলি খেয়ে মরতে দেখে আনন্দে মনটা ভরে গেছে। হারামজাদি আমায় এই কয়েক হপ্তা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। আমি প্রথম থেকেই জানতাম এই পলিসিটার মধ্যে কোন ফন্দি আছে, আর ঐ হারামজাদা আমাদের গুডইয়ার কোন বদ মতলবে আছে। আকর্ণ হাসি মুখ নিয়ে চেয়ারে বসল ম্যাডল। হারমাস, আজ পর্যন্ত আমরা যতোগুলো কাজে হাত দিয়েছি বা সমাপ্ত করেছি তার মধ্যে এটাই সব থেকে শ্রেষ্ঠ আর নিখুঁত হয়েছে, কি বলো?
ফ্যান’শর দিকে তাকালাম। হাতে আড়াল করে তার মুখেও মুচকি হাসির ঝিলিক।
কিন্তু আপনাদের কোম্পানিতে আমার আর কোন ভূমিকা নেই কারণ কোম্পানির চাকুরি করি না, আমি বলে উঠলাম। আমি ইস্তফা দিচ্ছি–মনে আছে? আর একাজটা করার জন্য আমার কিছু দাবিও আছে। আপনাদের কাছ থেকে কিছু ডলার পাওনা আমার। আপনি যদি আপনার কথা থেকে একচুলও নড়েন আমি সোজা বড়কত্তার দ্বারস্থ হতে বাধ্য হবো।
ম্যাডক্স বেছে বেছে একটা চুরুট বার করে তাতে অগ্নিসংযোগ করলো। তারপর একগাল ধোঁয়া আমার দিকে মুখ করে ছেড়ে বলে উঠল, তোমার যদি বাসনা সেরকম থাকে, টাকা তুমি পেয়ে যাবে। কিন্তু নিজের ভালো যদি চাও সব কিছু ভুলে আমার কাছে ফিরে এসো। ভবিষ্যত তোমার উজ্জ্বল, হারমাস। আমি তোমার মাইনে একশো ডলার বাড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। কি মনঃপূত হলো?
আমি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। পাওনা পনেরো হাজার আমার চাই।
তুমি কি সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে কাজ করতে উৎসাহী নও? বড় বড় চোখে প্রশ্ন করল ম্যাডক্স।
মাসখানেক ছুটি কাটালে আমি এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে পারি, একটু নরম সুরে কঁদুনি গাইলাম। কিন্তু এই একটা মাস আমি মাতালের মতো দুহাতে অফুরন্ত খরচা করে মজা লুটবো। এবার তাড়াতাড়ি চেকটা লিখে ফেলুন দেখি! আমি আজই স্যান বারনাডিনোতে হেলেনকে খবরটা দিতে চাই।
আমার কথাটা একবার শোনো, হারমাস। আমি তোমায় পাঁচ হাজার ডলার আর ছহপ্তার সবেতন ছুটি দিয়ে, ফেরার পর একশো ডলার মাইনে বেশি দিয়ে চাকরিতে বহাল করতেও রাজি আছি।কপটগাম্ভীর্যের সঙ্গে ম্যাডক্স বলে উঠল, এর থেকে ভালো প্রস্তাব আর কি বা হতে পারে, তুমি বলো তো আমাকে?
অসম্ভব চাতুর্য জানেন আপনি, এবার মেজাজ দেখাবার পালা আমার। বেশ, আপনি যদি এক্ষুনি পাঁচ হাজার ডলার পাইয়ে দেন, আর বিনা প্রিমিয়ামে পাঁচ হাজারের ডলারের সন্তান শিক্ষা বীমা করিয়ে দেবার কথা আমায় দেন, তাহলে আপনার প্রস্তাবে আমি রাজি।
চমৎকার! মেলাও হাত। টেবিলে ঝুঁকে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ম্যাডক্স।
কেশিয়ারের কাছে পাঁচ হাজার ডলারের চিরকুট লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে হঠাৎ ম্যাডক্স বলে উঠল আর এক মিনিট দাঁড়াও। সন্তান শিক্ষা বীমা না কি একটা বলছিলে যেন? আমি যতদূর জানি তোমার কোন ছেলে মেয়েই নেই!
তা নেই, তবে এবার হয়ে যাবে, চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে জবাব দিই। এতোদিন ওসব খরচায় পোযাচ্ছিল না। এবার হারমাস বংশে প্রদীপ জ্বালানোর জন্যে এক জনের প্রয়োজন খুবই। তাছাড়া বৃদ্ধ বয়সে সেবাযত্ন পাওয়ার জন্যেও আমায় একটা ছেলে মানুষ করতেই হবে।
দরজা বরাবর এসেছি, আকর্ণ দন্ত বিকশিত করে ফ্যান’শ ফোড়ন কেটে বলল, দেখো যমজ তৈরী করে ফেলো না যেন!