১১. সারারাত এপাশ-ওপাশ

১১.

সারারাত এপাশ-ওপাশ করলাম বিছানায়। ঘুম আসছে না কিছুতেই, শেষে সান্ত্বনা পাবার আশায় ইভের কাছে যাব বলে স্থির করলাম।

হল ঘরের ঘড়িটা ঢং ঢং করে বেজে রাত তিনটে নির্দেশ করল। আমি দরজা খুলে মুখ বাড়ালাম। কেউ নেই দেখে বাইরে বেরিয়ে দরজায় নিঃশব্দে তালা লাগালাম। সোজা ইভের। ঘরের সামনে। দরজার হাতলটা আস্তে করে চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল।দরজাটা বন্ধ করবার শব্দ হতেই ইভ জেগে গেল।

কে? ভয়ার্ত গলায় ইভ প্রশ্ন করে!–আমি।চুপকথাবলোনা–আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম ইভের বিছানার দিকে।

সে প্রথমে আমাকে দেখে ক্ষেপে গেল। চাপা গলায় বলল–সেদিন ভাগ্য জোরে বেঁচে গেছ। আবার আজ! বেরিয়ে যাও আমার ঘর থেকে।

আমি যথাসম্ভব কোমল গলায় ইভকে নানান কথা দিয়ে বুঝিয়ে শান্ত করলাম। তাকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিলাম। সে বলল–তা কি করে সম্ভব? আমি তো একজনের বিবাহিত স্ত্রী।

আমি ব্যঙ্গের সঙ্গে বললাম–ছ কোটি ডলার আমার পকেটে ঝলমল করলে ঐ রকম স্বামীকে ফুটিয়ে দিতে কতক্ষণ? মাত্র বছরখানেক। সে সময়টাইওরোপে ঘুরে বেড়াব তারপর বিচ্ছেদ পেয়ে গেলেই আমরা বিয়ে করে ফেলব।

ইভ বলল–কিন্তু মিসেস ভেস্তাল! আমি ইভকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম–আমি আর কোন সম্ভাবনা নিয়ে বসে থাকতে পারব না। এমন কিছু ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ভেস্তাল মারা যায়। আর তখনি ছ কোটি ডলার আমার হাতের মুঠোয়।

অবিশ্বাসের গলায় ইভ বলল–তার মানে?

মৃদু হেসে বললাম–আমি ভেস্তালকে খুন করব।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল ইভ। তারপর চাপা গলায় বলল–খুন করবে? কি ভাবে?

বুঝতে পারলাম ইভকে বস মানানো গেছে। তবুও তাকে আমি সারাটা রাত ভাববার সময় দিলাম।

ইভ বলল–ভাববার কিছু নেই। আমি তোমাকে বিয়ে করব। আমি তোমাকে চাই, কেবল কাজটা যেন নিরাপদে হয়।

আমি আবেগে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম, ওর শরীরের স্পর্শে আমি উষ্ণতা বোধ করলাম।

আমি গত রাত্রে ফেরবার পর যা ঘটনা ঘটেছে, ভেস্তালের কথা, লেগোর সাবধানবানী সবই একেএকে গুছিয়ে বললাম। আমি সেদিনই খুনের পরিকল্পনাটা ওকে জানিয়ে দিলাম। পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপ ইভকে ভাল করে বুঝিয়ে দিলাম।

ইভ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব পেয়ে খানিকটা গভীরভাবে চিন্তা করল। সে ভয় পেয়ে গেল।

আমি তাকে মনে সাহস দিয়ে বললাম–কোন চিন্তা নেই, মনে জোর আনন। তাহলে আমাদের মুক্তি।

তাকে গভীরভাবে চুম্বন দিয়ে বললাম–দুজনে একসঙ্গে এতবড় সম্পত্তির মালিক। ইভ ভেস্তালের টাকার চেয়ে তোমাকে আমি বেশী করে পেতে চাই।

তুমি সবই পাবে, শেড ডার্লিং–ইভ দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে চুম খেল। ওর নরম নরম উদ্ধত বুক দুটো আমার বুকের সঙ্গে লেপটে গেল–সাবধানে কাজ কর শেড।

ঘড়িতে চারটে বাজে।–কিছু ভেবো না ইভ। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিকল্পনাটার মধ্যে কোন খুঁত থেকে গেল কিনা একবার ভেবে দেখ। ওর গালে আদুরে টোকা মেরে ওর কাছ থেকে বিদায় নিলাম।

সেদিন অনেক বেলা করে উঠলাম। স্নান করবার সময় আমার খেয়াল হল ভেস্তালের কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। তা না হলে ভেস্তাল শান্ত হবে না, আর আমার পরিকল্পনাও সফল হবে না। ভাবামাত্রই ওর ঘরে ফোন করলাম।

কে? কর্কশ গলা ভেসে এল ভেস্তালের–কি চাই?

তোমার কাছে আমার দোষ স্বীকার করবার একটা সুযোগ দাও, ভেস্তাল। আমার কণ্ঠে ঝরে পড়ছে ক্ষমা চাওয়ার সুর।

ভেস্তাল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল–বেশ, আধঘণ্টা পরে এস।

 মুখখানায় দুঃখের ভাব এনে কাচুমাচু করে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটা ছক আগে থেকেই কষে ফেলেছিলাম।

আমি খুবই দুঃখিত ভেস্তাল। জিম আর আমি অতিমাত্রায় পান করে ফেলেছিলাম। তারপর ওর পাল্লায় পড়ে বেশ্যাবাড়ি যেতে হল। ভেস্তাল আমাকে ক্ষমা করো, আর কখনও এরকম হবে না–বলতে বলতে ওর হাতদুটো জড়িয়ে ধরলাম।

এতেই কাজ হয়ে গেল। ভেস্তাল আমাকে জড়িয়ে ধরল, বলল–ওহ শেড ডার্লিং, আমি নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করব। আমাকে তুমি ভুল বুঝো না। পুরুষমানুষ এক–আধবার বেশ্যাবাড়ি গেলে কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু আর কখনও যেও না।–গালে গাল ঘষতে লাগল।

ভেস্তাল ভেবেছিল ও আমাকে হারাতে বসেছে। ওর মধ্য থেকে রাগ বা হিংসে যেন দূর হয়ে গেছে। আমি হয়ত অন্য মেয়ের পাল্লায় পড়েছি–এটা আন্দাজ করেছিল সে।

দেখুন মিঃ অ্যাটর্নী সাহেব কত সহজে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।

.

১২.

 কয়েকদিন পরের কথা।

আমি অফিসে যাবার আগে কয়েকটা দরকারী চিঠিপত্র দেখছিলাম। ইভ আমার ঘরে ঢুকল একগাদা চিঠিপত্র নিয়ে। একটা চিরকুট আলাদা বের করে আমার সামনে রেখে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

আমি চিঠিটা পড়লাম। তাতে লেখা ছিল–এইমাত্র ভেস্তাল মিসেস এলিস–এর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন। আঠাশে সপ্টেম্বর শুক্রবার রাত সাড়ে নটায়। বেহালাবাদক স্টোয়েনস্কির সঙ্গে ভেস্তাল দেখা করতে যাবেন।

আর হাতে তিনটে দিন সময় আছে। একদিকে মুক্তি পাবার আনন্দ অপরদিকে ভেস্তালকে খুন করবার এক অজানা অনুভূতিতে বুকটা ধড়াস করে উঠল।

কাগজটা পুড়িয়ে দিয়ে ভাবতে থাকলাম সামান্য ভুল হলেই সব শেষ। মিসেস এলিস ভেস্তালের নিকটতম বান্ধবী আর স্টোয়েনস্কি একটা ভণ্ড, তবে ধনী কুমারী মেয়েদের বা বউদের পটাতে ওস্তাদ।

একটা আশঙ্কা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঘোরা–ফেরা করছে। একবার যে ব্যাপারগুলো ইভের সঙ্গে আলোচনা করে নেব, তার কোন সুযোগ নেই।

এখন প্রতিদিন ভেস্তালের সঙ্গে শুতে হচ্ছে, নব বিবাহিত স্ত্রীর মতই সারাটা রাত ধরে ওকে খুশী করতে হচ্ছে। যাক্ আর তো কটা দিন।

অফিসে বেরোবার সময় দেখলাম ইভ পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ইঙ্গিতে ওকে বললাম–বৃহস্পতিবার বেলা দুটোর সময়। সমুদ্রপাড়ের কুঁড়ে ঘর।

ও মাথা নেড়ে জানাল যে ও বুঝেছে।

অফিসে গিয়ে পরিকল্পনামত কয়েকটা চিঠি বেছে নিয়ে টেপরেকর্ডারের নম্বর অনুযায়ী সময় দেখে ডিকটেশান দিলাম। মনে বেশ ভয় লাগল কিন্তু ফেরারও যে কোন উপায় নেই।

বৃহস্পতিবার অফিসে গিয়ে রায়ান ব্ল্যাকস্টেনকে ফোন করলাম।–ভেস্তালকে একটা সারপ্রাইজ দেব। তাছাড়া অনেক দরকার আছে। তুমি ঠিক নটা পনের মিনিটে আমার বাড়িতে আসবে।

তারপর মিস গুডচাইল্ডকে ফোন করলাম। তাকে জানিয়ে দিলাম–লাঞ্চের পর অফিসে ফিরব না। গলফ খেলতে যাব।

লিটল ইডেনে ছটা মাঠ রয়েছে। ভেস্তাল যদি ফোন করে আমার খোঁজ করে, সে কখনোই খুঁজে পাবে না আমাকে।

লাঞ্চ সেরে সোজা সমুদ্রের পাশের কুঁড়েঘরটাতে চলে এলাম।

এটা ভেস্তালের ঘর হলেও এই ঘরে সে আসে না। বাড়ির সুইমিং পুলেই সে সাঁতার কাটে। এক প্রান্তে নির্জন পরিবেশে এই কুঁড়ে ঘরটা আমার বেশ ভাল লাগে। এখানে অনেক আড়াল, গাড়ি লুকিয়ে রাখবার জায়গাও রয়েছে। আমি ঘরের দরজা, জানালা খুলে দিলাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ইভ চলে এল।

ইভ ঘরে ঢুকতে দেখলাম ওর মুখটা বিবর্ণ। বুঝতে পারলাম আমার মত ইভের মনও সংকুচিত ও উত্তেজনাপূর্ণ।

ইভকে আমার একটা মূর্তি গড়ে ফেলবার কথা বলেছিলাম। দেখলাম ইভ তার দিয়ে তৈরী একটা লম্বা মত চোঙ্গা, টেবিলের একপাশে রাখল। বলল–এটা কাল রাতে তৈরী করেছি, দেখ এটাতে কাজ হবে কি না।

আমার সামনের টেবিলের উপর টেপরেকর্ডার ছিল। আমি ইভের উদ্দেশ্যে বললাম–প্রথমে আমরা মঞ্চটা একটু সাজিয়ে দেখি। ইভ সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে এল।

প্রথমে চোঙাটাকে চেয়ারের ওপর বসিয়ে দিলাম। আমার কোটটা খুলে কায়দা করে চোঙাটাকে পরিয়ে দিলাম। একটা জ্বলন্ত সিগারেটও তার মধ্যে গুঁজে দিলাম। তারপর টেপরেকর্ডারটা চালু করে দিলাম।

আমি ও ইভ ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। শুনলাম কোন খুঁত আছে কিনা ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করলাম।

চেয়ারের উপর আমার হাতের অংশ দেখা যাচ্ছে। সিগারেটের ধোঁয়া উঠছেকুণ্ডলী আকারে। টেপে আমার গলা নিখুঁতভাবে শোনা যাচ্ছে। টেপের মাঝামাঝি অংশে এসে ডিকটেশান বন্ধ হল। সামান্য জোরে আমার গলার স্বরে শোনা গেল–রায়ান, তোমাকে বসিয়ে রাখবার জন্য দুঃখিত। আর বিশেষ দেরী নেই।

পুরো ব্যাপারটা একেবারে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। নিখুঁত, একেবারে অচিন্ত্যনীয়। অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ায় আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। কিন্তু হাসতে গিয়েও হাসতে পারলাম না। দুজনের শরীর মৃদু কেঁপে চলেছে। টেপটা শুনলাম–শেষ পর্যন্ত।

টেপ বন্ধ করে দিলাম–তুমি যদি ভয় পেয়ে গিয়ে কোন ভুল না করে বস, তাহলে আমরা সফল হব। যে চিঠিগুলো রেকর্ড করেছি সেগুলো ইভকে দিলাম। রায়ানের সঙ্গে কখন কথা বলব। টেপের নম্বরগুলো সময় অনুযায়ী মিলিয়ে মুখস্থ করে নিতে বললাম।

ঘণ্টাদুয়েক পরে আমাদের নাটকের মহড়া শেষ হল। তারপর ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম–জোর পাচ্ছ তো মনে ইভ? আমাদের দুজনেরই জীবন তোমার হাতে। এখনও যদি বল তাহলে ফেরবার সময় আছে।

ইভ সঙ্গে সঙ্গে বললনা, না, আমি ভয় পাচ্ছি না শেড। কাজটা করতে পারব ঠিক করে।

বেশ। তাহলে আসল নাটকের মহড়া দেবার জন্য প্রস্তুত হও।

পরের দিন আঠাশে সেপ্টেম্বর। শুক্রবার। ভেস্তালের জীবনে অভিশপ্ত দিন, আমার জীবনেও বটে।

পাঁচটার আগেই অফিস থেকে ফিরে এলাম। বাড়িতে এসে দেখলাম ভেস্তা নেই। অ্যাপ্রন আর দুটো হ্যান্ড গ্লাভস এনে আমার ডেস্কের ড্রয়ারের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম। চাকা পাল্টানোর সময় এগুলো আমাকে পরতে হবে, নইলে কালিঝুলি মেখে ব্ল্যাকস্টেনের সামনে আসা যাবে না।

ইভকে ফোন করে জানতে পারলাম–ভেন্তাল সিনেমায় গেছে। ছটার সময় ফিরবে। আমি তার ঘরে যাচ্ছি বলে দিলাম।

সে আপত্তি করেছিল, তবুও গেলাম। ইভকে কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। তাকে পুনরায় মনে সাহস দিলাম।

সে জানাল–তার গাড়িটা সে জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে এসেছে। আস্তে চালাও সাইনবোর্ডটা যেখানে আছে, সেখানেই রাখা আছে। এটা আমাদের পূর্ব পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। সময়ের সামঞ্জস্য আনবার জন্য এটা খুবই জরুরী।

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেঘ জমেছে, বোধহয় বৃষ্টি হবে। চাকা পাল্টাবার সময়ে বৃষ্টি হলে বেশ অসুবিধে হবে–আমি বললাম।

ইভ ভয় পেয়ে গেল। বৃষ্টি হলেও কাজটা করবে?

আমি জোর দিয়ে বললামবৃষ্টি কেন, ভূমিকম্প হলেও করব।

ড্রাইভার নিয়ে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম আমার নির্দেশ মত ইভ ওকে চায়ের সঙ্গে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে।

ঘড়িতে তখন ছটা বাজে। ইভকে বললাম–টেপ রেকর্ডটা আমার ঘরে রেখে এস। আর সাড়ে তিনঘন্টা পরে আমরা মুক্ত। ইভ! ভেবে দেখ, এখনও সময় আছে, পিছিয়ে আসার।

তুমি কি পিছিয়ে আসতে চাও? ইভ বলল। আমি মন শক্ত করে বললাম না। এরপর আমি বাগানে গিয়ে ভেস্তালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ছটার কিছু পরে ভেস্তাল রোলস রয়েস চালিয়ে এল। আমরা সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি উঠছি। আমার সঙ্গ পেয়ে ভেস্তাল খুব খুশী। ভেস্তাল অনবরত বকবক করে চলেছে। ভালবাসার উজ্জ্বল জ্যোতি ওর চোখে মুখে সুস্পষ্ট।

আর মাত্র তিন ঘণ্টা পরে এই মেয়েটাকে আমি খুন করতে চলেছি। বিশ্বাস করতে পারছি না যেন নিজেকে।

ভেস্তাল বলল–শে ডার্লিং। আমি পোষাক পাল্টাব। তুমি আমার পাশে বসে গল্প করবে।

আমি মিষ্টি করে ননী মাখানো আদুরে গলায় বললাম আমার বিশেষ কটা কাজ রয়েছে। তুমি যাও। আমি একটু পরেই আসছি।

ভেস্তাল রাগ করবার ভান করে বলল–তুমি বেশী খাটাখাটুনীকরছ। এত চিন্তা করবার কোন দরকার নেই। বলেই একটা চুমু খেল। গাটা ঘিন ঘিন করে উঠল, অতি কষ্টে মুখের ভাবটা ঠিক রাখলাম।

নিজের ঘরে এসে ডেস্কের ড্রয়ারটা খুলে দেখলাম জিনিসগুলো সব ঠিকঠিক আছে। দেখে চাবি দিয়ে ড্রয়ারটা বন্ধ করে দিলাম।

এক অজানা আশঙ্কা যেন বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা মারছে।

শূন্য মনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানলার কাঁচে বৃষ্টির ঝাঁপটা আছড়ে পড়ছে। এমন সময় দরজা নক্ করে অর্গিস ভেতরে ঢুকল। মাপ করবেন, স্যার! জো খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাতে মিসেস উইন্টার্সের গাড়িটা লাগবে।

কিছু খেয়েছে হয়তো। পেটে সয়নি।

আমি বললাম–আচ্ছা মিসেস উইন্টার্স নীচে এলে আমি বলে দেব।

অর্গিস দরজা বন্ধ করে চলে গেল।

.

১৩.

আর কয়েক ঘণ্টা পরেই একটা তাজা প্রাণ আমি নষ্ট করতে চলেছি। হাত–পা ক্রমশঃই ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ডিনার খেতে বসে ভেন্তাল অন্যান্য বারের মত এবারেও তার সঙ্গে যাবার জন্য আমাকে অনুরোধ করল। কিন্তু আমি জানালাম, রায়ান আসবে, ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলতে হবে। কোন মেয়ের সঙ্গে কাটাব না জেনে ও আমাকে আর জোর করল না।

ডিনার পর্ব শেষ আর হতেই চাইছেনা। মুখে জোর করে কিছু গুঁজে দিচ্ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম, যদি ভেস্তাল কিছু আন্দাজ করে ফেলে।

বাইরে ঘোর অন্ধকার। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ভেস্তাল ডিনার শেষ করে বলল–দেখ, এতদিন বৃষ্টি নেই, আর ঠিক আমার বেরোবার সময়েই বৃষ্টি।

সে উঠে গিয়ে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেখল।–এরকম বৃষ্টি হলে যেতে পারব বলে মনে হয় না।

আমি মনে মনে এই আশঙ্কা করছিলাম। তাকে একটু বাজিয়ে দেখবার জন্য বললাম–বৃষ্টিতে ঘরে বসে থাকলে আরো মন খারাপ হয়ে যাবে। যা আজ টিভির প্রোগ্রাম দেখেই সময় কাটাবে। মিসেস এলিসকে বলে দাও, তুমি যেতে পারবে না।

স্টোয়েনস্কির সঙ্গে দেখা করবার ভীষণ ইচ্ছা আমার, পরে ঠিক সময় নাও হতে পারে। অথচ বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাতে আমার ভয়ও লাগে।

অর্গিস কফি ঢালছিল। ভেস্তালের নির্দেশে সে দেখতে গেল ড্রাইভার জো সুস্থ হয়েছে কিনা।

ভেস্তাল বলল–দরকারের সময় না পেলে তবে ড্রাইভারের প্রয়োজন কিসের?

আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম–ওর কি ইচ্ছে করে অসুখ হয়েছে, হঠাৎ করেই হয়েছে। আমি বলে ফেললাম, বৃষ্টির মধ্যে তোমার গাড়ি চালাতে যে কি অসুবিধা, আমি তাও বুঝি না।

ভেস্তাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, বলল–তুমি যেন আজ কেমন অদ্ভুত ধরনের আচরণ করছ সন্ধ্যাবেলা থেকে।

আবার সেই বোকামী। তার কথাটা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম,দূর ছাই। তুমি কিযে বল? আমি ঠিক আছি। অদ্ভুত আচরণ তুমি আমার মধ্যে কি দেখলে?

এমন সময় অর্গিস এসে জানাল–সরি ম্যাডাম, জো খুবই অসুস্থ। আবারও বমি করেছে।

আমি একটা সুযোগ নিলাম–তবে বরং তোমার আজ গিয়ে কাজ নেই। ওই বেহালাবাদক স্তাবকদের ভিড়ে তোমার খেয়াল অত রাখবে না।

আমার কথা শুনে ভেস্তালের জেদ আরো বেড়ে গেল। মেজাজের সঙ্গে বলে উঠল–আমার পথ চেয়েই সে বসে আছে, আমি নিশ্চিত জানি। আমার জন্যই এলিসের নিমন্ত্রণ নিয়েছে স্টোয়েনস্কি।

ঠিক আছে, তোমার যাবার ইচ্ছা হয় তো যাও। রেডী হয়ে নাও, নটা প্রায় বাজে।

হ্যাঁ, আমি এখনি তৈরী হয়ে নিচ্ছি–ভেস্তাল আবার অনুরোধ করল তার সঙ্গে আমাকে যাবার জন্য।

ডার্লিং, আমাকে মাপ করো আমি ক্ষমা চাওয়ার সুরে বললাম ব্ল্যাকস্টেন এসে ফিরে যাবে। সেটা কি ভাল হবে?

ভেস্তালকে সন্দেহ মুক্ত করবার জন্য আমি জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। আর তাতেই ভেস্তালের চোখে কামনার উত্তেজনা জেগে উঠল। বলল–আজ রাতে গিয়ে আর কাজ নেই। দুজনে এক সঙ্গে রাত কাটাব। কেমন?

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম–এখন রাত এগারোটা পর্যন্ত ব্ল্যাকস্টেন তো থাকবেই। তার আগে তো তুমি আমাকে পাবে না।

বেশ, তাহলে, আজ রাতে–শে।কথাটা সম্পূর্ণ না করেই ও বেরিয়ে গেল।

ভেস্তালের প্রশ্নের উত্তরে অর্গিস বললনা, এখন সেরকম বৃষ্টি নেই। আপনি ঠিক মত যেতে পারবেন তো?

–হ্যাঁ পারব, ভেস্তাল বলল–তবে ফিরতে আমার দেরী হতে পারে। সাড়ে বারোটা হবে হয়তো।

ভেস্তাল চলে গেল। সদর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ইভ আমার পড়ার ঘরে এসে ঢুকল। চোখে মুখে ভয়ের চিহ্ন। মুখটা ফ্যাকাশে লাগছিল।

সে আমার হাতে একটা টুপী দিয়ে বলল–মাথা ভেজা অবস্থায় মিঃ রায়ানের সামনে হাজির হলে সন্দেহের কারণ ঘটতে পারে।

আমি ইভকে পুনরায় মনে সাহস দিয়ে বললাম–এবার সব দায়িত্ব তোমার, ঠিক যেমনভাবে বলেছি।

আচ্ছা, বলে ইভ ড্রয়ার টেনে অ্যাপ্রন, গ্লাভস দুটো বার করে দিল। বালি ভর্তি ব্যাগটা হঠাৎ যেন বাস্তব পরিস্থিতিকে জীবন্ত করে তুলল।

আমি সেগুলো নিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম।ইভের দিকে ফিরে বললাম–গুড লাক, ইভ। মনে জোর এনে কাজ কর। আধঘণ্টার মধ্যে আমি ফিরে আসব।

ইভ মাথা নাড়ল। জানালা গলে নীচে নেমে পড়লাম। ইভ জানালা বন্ধ করে দিল।

 বৃষ্টি নেই বললেই চলে কিন্তু বাতাস বেশ জোরে বইছে। আমি গ্যারেজের দিকে বেশ দ্রুত এগিয়ে গেলাম। যাতে ভিজে না যায় সেজন্য ঘুরপথে আসতে ভেস্তালের একটু বেশী সময় লাগবে। আমাকে শুধুমাত্র লনটুকু পার হতে হবে।

কয়লার মত কালো অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে রয়েছে। থমকে লনটা ছুটে পার হয়ে গিয়ে এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। গ্যারেজটা ভূতের অন্ধকারের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওটার কাছে গেলেই অটোমেটিক আলো জ্বলে উঠবে। অন্ধকারের মধ্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ভেস্তাল আসছে, অন্ধকারের মধ্যে তার সাদা বর্ষাতিটা চোখে পড়ল। বুকটা ধক ধক করতে লাগল। ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। বালি ভর্তি ব্যাগটা শক্ত হাতে ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ভেস্তাল হাঁটতে হাঁটতে গুন গুন করে গান গাইছিল। ওর মুখটা যেন চিন্তান্বিত। ও গ্যারেজের কাছে আসতেই আলো জ্বলে উঠল, দরজাও খুলে গেল। ও ভেতরে ঢুকল।

ক্রেসপাতের জুতো পড়েছিলাম। নিঃশব্দে ভেস্তালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

ভেস্তাল গাড়ির দরজা খুলছে। ও বোধহয় অমঙ্গল কিছু আশঙ্কা করেছিল। হয়তো ওর সহজাত প্রবৃত্তি ওকে সাবধান করে দিল আর তাই সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে দেখার চেষ্টা করল। ওর মুখটা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আর আমার বুকের ভেতরটাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

এই সুযোগে বালিভর্তি থলেটা দিয়ে ওর মাথার ঠিক মাঝখানে আঘাত করলাম। হাঁটু দুমড়ে গেল, গাড়ির দরজা থেকে হাতটা খসে পড়ল।

আমার চাপা ঠোঁট ভেদ করে নিঃশ্বাস হিসহিস শব্দে ছিটকে বেরিয়ে এল।

আবার ব্যাগটা ঘুরিয়ে দ্বিতীয় বার আঘাত করলামসর্বশক্তি দিয়ে। ওর মাথাটা দুলে উঠেঝাঁকুনি দিয়ে একপাশে কাত হয়ে গেল। ও ঢলে পড়তে চাইল। আমি বালির ব্যাগটা ফেলে দিয়ে ওর শরীরটা ধরে ফেললাম।

আমার গায়ের সঙ্গে ওকে চেপে ধরে নিলাম ন্যাকড়ার পুতুলের মত। গাড়ির দরজা খুলে ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে সামনের আসনে বসিয়ে দিলাম, ডানদিকের দরজায় হেলান দিয়ে রাখলাম।

বালি ভর্তি ব্যাগটা তুলে স্টীয়ারিং–এর নীচে রাখলাম। তখনই হঠাৎ মনে হল–গাড়ির চাবি কোথায়? ইঞ্জিন চালু করব কি করে? শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। হাত দুটো কাঁপছে, ওর ব্যাগটা ওলট–পালট করে ঘাটলাম কিন্তু কই চাবি কোথায়! আতঙ্কে কিছু মনে করতে পারছি না। সর্বনাশ! কি হবে? সময় যে বয়ে যাচ্ছে। ড্যাশ বোর্ডের ঘড়িটাতে সময় দেখলামনটা বেজে সাত।

নিজের বোকামীর জন্যে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলাম, গাড়ি থেকে নেমে গ্যারেজের মাঝে, চারপাশে খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে গাড়ির নিচে চাবিটা পেলাম। কখন ভেস্তালের হাত থেকে ঠিকরে গিয়ে নীচে পড়েছে।

চাবিটা নিয়ে ইঞ্জিন চালু করে ফিরে দেখলাম একবার। কাত হয়ে গাড়ির দরজায় ঠেস দিয়ে ও বসে আছে। মাথাটা পেছনের দিকে হেলান। মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে রয়েছে, চোখ দুটো বোজা। ধীরে ধীরে বুকটা ওঠা–নামা করছে, মাথা থেকে একটা সরু রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে।

প্রথমে খুব আস্তে, তারপর রাস্তায় পড়ে গাড়ি জোরে ছুটিয়ে দিলাম ক্লিক রোডের মাথায় আসতে তিন মিনিট সময় লাগল। বাতাসের জোর অনেক বেশী। গাড়ির কাঁচে বৃষ্টির পশলা আছড়ে পড়ছে। ওয়াইপার দুটো চালিয়ে দিলাম। গাড়ির আলো নিভিয়ে দিলাম। বাঁকের কাছে গিয়ে গাড়ি থামাতে দেখলাম সামনের বাঁকের মুখে মাইলখানেকনীচে একটা গাড়ির আলো এগিয়ে আসছে। নিশ্চিত রায়ানের গাড়ি।

ভেস্তালকে পুরো আমার কোলে বসিয়ে নিলাম। মাথাটা টেনে সোজা করে রাখলাম। হাত দুটোকে স্টীয়ারিং হুইলের সঙ্গে আটকে রাখলাম।

ওর মাথাটা পিছন দিকে হেলে যাচ্ছে। আমার গালের সঙ্গে ওর মাথাটা ঠেকিয়ে নিয়ে আমার নিজের শরীরটা দুমড়ে নিয়ে একেবারে সীটের সঙ্গে মিশিয়ে দিলাম। গীয়ারটা চেঞ্জ করে ইঞ্জিন চালু করে দিলাম। বাঁক ঘোরবার আগে সামনের হেডলাইট জ্বালিয়ে দিলাম।

ব্ল্যাকস্টেন খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল কিন্তু আমার গাড়ি দেখেই সে গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। আমি গাড়ির স্পীডটা বাড়াতে যাব, এমন সময় ভেস্তালের চাপা গোঙানির শব্দ শোনা গেল, এত ভয় আমি কোনদিনও পাইনি। গাড়িটা আমার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল। আমি আঁতকে উঠলাম।

রাস্তা ছেড়ে ঘাসের উপর উঠে গেল গাড়ির চাকা। সামনেই সাদা বেড়া। ধাক্কা খেলেই একেবারে নশশো ফুট নীচে পড়বে।

কোনরকমে স্টয়ারিং ঘুরিয়ে নিতে পারলাম। রাগেদাঁত কিড়মিড় করে ভেস্তালের ঘাড়টা ধরে ওর মুখখানা ড্যাশ বোর্ডের উপর ঠুকে দিলাম। আঘাতটা জোরে না হলেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ভেস্তাল।

 ব্ল্যাকস্টেন কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দিলাম। সে হর্ন বাজাল কিন্তু আমি কোন প্রত্যুত্তর দিতে পারলাম না। বাঁকটার মুখে এসে আমি গাড়ির ব্রেক কষলাম। দৃষ্টির বাইরে এসে গাড়িটা থামালাম। ব্ল্যাকস্টেনের গাড়ির পেছনের লাল আলোটা যতক্ষণ না অদৃশ্য হল, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি গাড়ির মধ্যে বসে রইলাম।

তারপর গাড়ি থেকে নেমে এলাম। ভেস্তালকে গাড়ির মধ্যে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রাখলাম।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ব্ল্যাকস্টেনবাড়ি পৌঁছে যাবে। তাকে কিছুতেই কুড়ি মিনিটের বেশীবসিয়ে রাখা যাবে না। সুতরাং পঁচিশ মিনিটের মধ্যে চাকা বদল করে গাড়িটা খাদে ফেলতে হবে।

তাড়াতাড়ি সব কাজ করে ফেলতে হবে, নয়ত ইভ ভয় পেয়ে গেলে মন ভেঙ্গে যাবে আর সে সব গণ্ডগোল করে দেবে। ব্ল্যাকস্টেনেরও সন্দেহ বাড়বে। শরীর ঘামছে। বৃষ্টির মধ্যে গাড়ির কাছে এসে পেছনের খোল থেকে চাকাটা বার করলাম। ভয় হচ্ছিল, জো ফাটা চাকাটা পাল্টে রাখেনি তো। ইস্ আর আমার ভেবে দেখার উপায় নেই।

টায়ারের বেড় ঘুরে হাত দিয়ে কাটা জায়গাটা পেতে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। রেঞ্জ আর স্ক্র ড্রাইভার নিয়ে আন্দাজে চাকা পাল্টাবার কাজ শুরু করলাম। অন্ধকার চতুর্দিকে কিন্তু আলো জ্বালাতে সাহস পাচ্ছি না। একে তো কাজটা দুঃসাধ্য, তার উপর বৃষ্টিতে বার বার নাটবল্টগুলো পিছলে যাচ্ছে পরাতে গিয়ে। সাত মিনিটের প্রচেষ্টায় শেষে চাকা খুলল। তাড়াতাড়ি করতে পেরেছি।

এবার কাটা চাকাটা বসাতে হবে। খাপে খাপে বসানোর গর্তগুলো ঠিকমত খুঁজে পাচ্ছি না। হাতড়ে হাতড়ে অবশেষে ছটা নাটের মধ্যে পাঁচটা নাট লাগিয়ে চাকাটা পরিয়ে দিলাম। আর হাতে সময় রয়েছে মাত্র দশ মিনিট। এর মধ্যেই সব কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।

দৌড়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে স্টার্ট করার জন্য বোতাম টিপতে গিয়ে দেখলাম ভেস্তাল নেই। আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। কাঠের মত শক্ত হয়ে গেলাম।

ততক্ষণে বৃষ্টি আবার জোরে শুরু হল। নিশ্চয়ই ভেস্তাল পালিয়েছে। চাকা বদল করবার সময় ও জ্ঞান ফিরে পেয়েছে কিন্তু দমকা বাতাস বইছে, সে কি গর্জন। গাড়ির হেডলাইট জ্বেলে দিলাম। ঠিক তখনি অন্ধকার খাদের মধ্যে ওকে দেখতে পেলাম। যেন অন্ধকারে কাউকে অচেনা পথে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ভেন্তাল তেমন ভাবে টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে খাদটার দিকে।

এরই মধ্যে সে গাড়ি থেকে একশ গজ দূরত্বে চলে গেছে। আমি ভেবে পেলাম না, এখন কি করব? গাড়ি থেকে নেমে আমি তার দিকে ছুটতে শুরু করলাম। হেডলাইটের সামনে আমার দীর্ঘ ছায়া মূর্তি দেখে ভেস্তাল আমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এল,

ওহ শেড! তুমি এসেছ? বেঁচে গেছি। জান শেড আমার মাথায় খুব লেগেছে।

ও কথা বলতে বলতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে গা এলিয়ে দিল। আমি জোর করে ওর হাত ছাড়িয়ে দিতে ও ভয় পেয়ে গেল–শেড, কি হয়েছে? আমাকে ব্যথা দিচ্ছ কেন?

আমার মনে হল এখনি যেন ওর গলাটা টিপে মেরে ফেলে দি। কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হল তাহলে খুব ভুল করা হবে।

ভেস্তাল যেন আমার মতলবটা বুঝে ফেলেছে। সে ভয়ে চীৎকার করে উঠল, গাড়িটা লক্ষ্য করে দৌড়তে শুরু করল। আমিও তার পেছন পেছন ছুটলাম। একটা বড় পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিলাম। ভেস্তাল ছুটবার সময় একবার সামনে, একবার পিছনে দেখতে গিয়ে হোঁচট খেল। হাত পা দুমড়ে পড়ে গেল। রক্ত শূন্য ফ্যাকাশে মুখে মৃত্যুর ভয়।

চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে ভেস্তাল আমাকে দেখছে। আমি তার কাছে যেতেই ও আর্তনাদ করে বলে উঠল–শেড, দয়া করো, মেরো না। আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দেব। আমাকে বাঁচতে দাও শেড।

আমি ওর ডান হাতের কব্জিটা মুচড়ে ধরলাম। পাথরটার ভার যেন আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে।

ভেস্তাল শেষবারের মত প্রাণফাটা ব্যাকুল আর্তনাদ করল–শেড তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে মেরো না।

আমি ততক্ষণে পাথরটার উঁচাল দিকটা ওর মাথার উপর তুলে দিতেই ও ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেলল। নিশ্চিত মৃত্যু যেন, সে আর পালাল না। মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করল।

আর ইতিমধ্যে আমার হাতের পাথরটা ওর মাথার মাঝখানে আছড়ে পড়ল।

রাস্তার উপরই ও ছটফট করতে করতে ঢলে পড়ল। মরে যাচ্ছে ভেস্তাল! কিন্তু তখন আর কিছুই করবার নেই।

জানেন অ্যাটর্নী সাহেব, ভেস্তালের সেই করুন আর্তনাদ আমি এখনও শুনতে পাচ্ছি। এখনও আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে কি রকম নিষ্ঠুর ভাবে আমি সেদিন তাকে খুন করেছিলাম। তার করুণ মুখখানা

এই সময় ছেলেবেলার একটা ঘটনা আমার মনে পড়ছে। আমাদের একটা পোষা কুকুর ছিল, সেটা পাগল হয়ে গিয়ে আমার হাতে কামড়াল। বাবা তাকে তিনটে গুলি করে মেরে ফেলল। কুকুরটা ছটফট করতে করতে মারা গেল। তার সেই ছটফটানির নির্মম দৃশ্যটা ঘুমের মাঝে স্বপ্নে আমি দেখেছি, কেঁদে উঠেছি।

আর ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আজ আমি আমার নিজের স্ত্রীকে কি নৃশংস ভাবে হত্যা করলাম। একজন নারীকে আর টাকা পাবার লোভে।যাক্ মৃত্যুপথযাত্রী ভেস্তাল তখন কাতরাচ্ছে। সেই অবস্থায় তার একটা হাত ধরে বস্তার মত রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে এনে গাড়িতে তুলে দিলাম।

একমুহূর্তে সব ব্যাপারটা ভেবে নিলাম। পাথরটার কথা মনে হতেই ছুটে গিয়ে নীচের উপত্যকায় ছুঁড়ে দিলাম।

সময় খুব কম। কাজও প্রায় সারা। ফিরে এসে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে ঠেলতে ঠেলতে ঢালু রাস্তায় নিয়ে এলাম।

হেডলাইটের আলোতে সাদা বেড়াটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভেস্তালের দেহটা তখনও থির থির করে কাঁপছে।

গাড়ির স্টিয়ারিং চালু করে ঘুরিয়ে দিলাম সাদা বেড়াটার দিকে। গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে উঠে গেল ঘাসে। তারপর দড়াম করে ধাক্কা মারল বেড়ার গায়ে, বেড়া ভেঙ্গে গাড়িটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গাছপালার ডাল ভাঙ্গার পট পট শব্দ।

তারপর ধাক্কা খেতে খেতে উল্টেপাল্টে আরও সব পাথরের টুকরো সঙ্গে নিয়ে প্রায় দুশো ফুট নীচে গিয়ে পাথরের গায়েই আটকে গেল গাড়িটা।

পরক্ষণেই গুডুম শব্দ। গাড়িটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য।

জানলাতে পা রেখে শুনলাম আমার গলার স্বর এখনো চিঠির ডিকটেশান দিচ্ছে।

আহ, প্রাণ ফিরে পেলাম। আমি প্রায় ঠিক সময়ে এসেছি। কিন্তু আমার অ্যাপ্রনটা ভেজা,জুতো কাদায় মাখামাখি আর হাতদুটো নোংরা।

ইভ আমাকে দেখতে পেয়ে একটা তোয়ালে আর স্পঞ্জ ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। চাপা গলায় বলল–মিঃ ব্ল্যাকস্টেন আধঘণ্টার উপর বসে আছে। আর টেপ চলবে মাত্র দুমিনিট, তাড়াতাড়ি নিজেকে ঠিক করে নাও।

আমি চুলে চিরুণী বুলিয়ে নিলাম। কোট পরে নিলাম।

 আধ গেলাস হুইস্কি খেয়ে নিলাম। বুকপেট জ্বালিয়ে দিল কিন্তু ভাল লাগল।

ভাল করে মুখ মুছে, ইভের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে লাউঞ্জের দিকে, এগিয়ে গেলাম।

ইভ তোয়ালে, স্পঞ্জ, অ্যাপ্রন, টুপী ডেস্কের নীচের টানাতে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দিল। টেপ বন্ধ হয়ে গেল।

দুঃখিত রায়ান। তোমাকে অনেকক্ষণ বসতে হল–সহাস্যে তার পাশে বসলাম,আরেকটু হুইস্কি চলবে নাকি রায়ান?

দাও। রায়ান বলল, তুমি আজকাল বড্ড বেশী কাজ করছ। ও ভাল কথা, তোমার স্ত্রীকে দেখলাম।

আমি বললাম–ও তাই নাকি? তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

মিসেস উইন্টার্স ভীষণ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।ঝড় বৃষ্টিতে ঐরকমগতিতে গাড়ি চালালে যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম–আরে না, না, ওর সব রাস্তা ঘাট জানা। ভয়ের কিছু নেই।

কথাটা ঘুরিয়ে নেবার জন্য বললাম–বাইল্যান্ড অ্যাপ্লায়েন্সেসের খবর কিছু জান?

জানি বইকি, আমিও তো একজন ছোটখাট শেয়ার হোল্ডার। রায়ান উত্তর দিল।

আমার মনে হয় ওরা বাজার ধরে নেবে। তুমি আমি যদি

আমার কথায় ছেদ পড়ল একটা টেলিফোন বেজে ওঠাতে। চমকে উঠলাম আমি। রায়ানকে। বসতে বলে আমি ফোনের কাছে এগিয়ে এলাম। ইভ বলল মিসেস এলিস ফোন করছেন।

হঠাৎ করে ভেঙালের মুখটা আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ফোনে, মিসেস এলিসের গলামিঃ উইন্টার্স? মিস ডোলানের কাছ থেকে জানলাম ভেস্তাল আধঘণ্টা আগে বেরিয়েছে, অথচ এখনও এখানে আসে নি।

দেখলাম ব্ল্যাকস্টেন এদিকে তাকিয়ে আছে, আমাদের কথা শুনছে।

আমি মিসেস এলিসকে বললাম–দেখুন, হয়ত আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে, এখনি হয়ত পৌঁছে যাবে। আমি এখন খুব ব্যস্ত। কিছু মনে করবেন না, পরে না হয় ফোন করব। ছাড়ছি।

রায়ানের উদ্দেশ্যে বললাম–যতসব ঝামেলা। মিসেস এলিসের ওখানে পৌঁছতে দেরী হচ্ছে দেখে ওরা আশঙ্কা করছে যদি ওর কোন বিপদ হয়ে থাকে।

আরে বাবা, ও মত পাল্টে সিনেমাতেও চলে যেতে পারে।

ব্ল্যাকস্টেন আমার কথা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠল, বলল–শেড রাস্তাটা খুব খারাপ। তাছাড়া উনি যা জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।

আরে বাবা ঝুঁকি নেবার মেয়ে ভেস্তাল নয়। বোধহয় ও সিনেমাতেই গেছে। বাদ দাও ওসব ফালতু কথা। কাজ শুরু করা যাক। হিসাবটা একেবারে করে দেখাও।

আমার কথা শুনে ব্ল্যাকস্টেন হতাশ হয়ে বলল–তোমার বউ, তুমিই বোঝ।

তারপর আমরা ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনাতে কাটালাম। কুড়ি মিনিট বাদে আবার ফোন এল।

ফোন ধরলাম, লেফটেন্যান্ট লেগোর কণ্ঠস্বর। আমার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। বুঝলাম, রায়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে।

লেগো মিসেস এলিসের বাড়ি থেকে বলছে। চল্লিশ মিনিট কেটে গেছে, ভেস্তাল এখনও পৌঁছায় নি। লেগো আমাদের বাড়িতে আসবে বলল।

আমি বাধা দিয়ে বললাম–আপনি কেন কষ্ট করে আসবেন? আমি বরং এখনি যাচ্ছি।

ব্ল্যাকস্টেকে বললাম–এখনি আমাদের বাড়িতে পুলিশ আসবে।

রায়ান চমকে উঠে বলল–পুলিস কেন?

–আজকের পার্টিতে ভেস্তালের বন্ধু লেফটেন্যান্ট লেগে আছে। ভেস্তাল এখনও পৌঁছায় নি।

রায়ান আমি দুঃখিত। আজকের মত আলোচনা থাক আমাদের। গাড়ি নিয়ে বরং একবার বেরিয়ে দেখি কি হল?

রায়ানকে সঙ্গে নিয়ে যখন লাউঞ্জ থেকে বেরোচ্ছি, তখনি ইভের সামনাসামনি হলাম।

ইভের উদ্দেশ্যে বললাম–দেখি কি হল?মিস ডোলান আপনি পড়ার ঘরটা গুছিয়ে রাখবেন। অনেক কাগজপত্র ফাইল করা দরকার।

ইভ বুঝে গেল ডেস্কের মধ্যে রাখা সব জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে।

আমি আস্তে করে বললাম–গাড়িটা ভিজে আছে, ব্যবস্থা করো।

.

১৪.

অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। জনা দশেক পুলিস অফিসার, জনা কুড়ি দমকল কর্মী, দুটো বড় সার্চ লাইট জ্বেলে ভেস্তালের প্রাণহীন দেহটা তুলে আনল।

ব্ল্যাকস্টেনের গাড়িতে আমি বসেছিলাম। আমার শরীরটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। থর থর করে কাঁপছে। ভাবছি কোন ভুল করে ফেলেছি কিনা?

ইভও আমাদের পেছন পেছন এসেছিল। গাড়িটা যে কাদামাখা আর ভিজে গিয়েছিল, তা কেউ আর বুঝতে পারবে না। ইভ বেশ বুদ্ধিমতী বটে!

একসময় মিঃ লেগো গাড়ির সামনে এসে বলল–ভেস্তালের দেহ পাওয়া গেছে। আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলল।

আমার সঙ্গে কথা বলবার সময় ব্ল্যাকস্টেনের দিকে তার নজর পড়াতে জিজ্ঞাসা করল–ইনি কে?

ইনি রায়ান ব্ল্যাকস্টেন, আমার এজেন্ট। রাতে ইনিই আমার সঙ্গে ছিলেন।কথাটা বলে নিজেকে ধিক্কার জানালাম। গাল বাড়িয়ে চড় খাবার কোন দরকার ছিল না। এতে তো সন্দেহ জন্মাতে পারে।

মিঃ লেগো আগামীকাল সকালবেলায় আমার সঙ্গে দেখা করবে, জানাল। তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে আমি ব্ল্যাকস্টেনের গাড়িতেই বাড়ি ফিরে এলাম। ব্ল্যাকস্টে আমাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেল।

পড়ার ঘরে ফিরে এসে খানিকটা হুইস্কি গলাধঃকরণ করলাম। সব যেন কেমন গোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।

ইভ এল। দরজা বন্ধ করে দেবার পর আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, সব ঠিকমত হয়েছে

হ্যাঁ,সব ঠিকমতই হয়েছে। চেয়ারের উপর চোঙাটা বসিয়ে তার উপর তোমার কোট চাপিয়ে দিয়ে নকল হাতটার মধ্যে একটা সিগারেট গুঁজে দিলাম। দশ মিনিট পরেই অর্গিসকে ডেকে পাঠালাম। পড়ার ঘর খুলে আমি বেরিয়ে গেলাম। টেপরেকর্ডারের চিঠির ডিকটেশান শুনে অর্গিস মনে করল তুমি ঘরেই আছ। সে কফি আনল, টেবিলে রাখল। হাতলে রাখা তোমার নকল হাতটা সে দেখতে পেল। তারপর ব্ল্যাকস্টেন এলে অর্গিসকে নির্দেশ দিলাম লাউঞ্জে বসাবার জন্য।

আমিও দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বললাম–আধঘণ্টা তুমি ভীষণ ব্যস্ত। অর্গিস যখন ঘরে এসেছিল আমি তোমার চেয়ার আগলে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

ব্ল্যাকস্টেনকে বসতে বলে তার কাছ থেকে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। সব ব্যাপারটা ঠিক আছে তো?

আমি ওকে অভিবাদন জানালাম, ইভ বলল–এত নিখুঁতভাবে সব কাজগুলো হয়েছে ঘটনাটা যে সাজান, তা মনেই হবে না।

আমি ইভকে বললাম, তুমি অর্গিসকে খবরটা দাও। কেমন? বলতে বলতে প্রায় টলতে টলতে এসে ইভকে জড়িয়ে ধরলাম। আমরা মুক্ত হয়ে গেছি ইভ, বুঝেছ। আমরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করব কি বল?

ইভ বেশ রুক্ষভাবে আমাকে ঠেলে দিয়ে বলল–তুমি আমার কাছ থেকে এখন দূরে থাক। এখনও আমরা নিরাপদ নই। মিঃ লেগো ভীষণ চতুর। উনি বুঝে ফেলতে পারেন যে পুরোটাই আমাদের ষড়যন্ত্র। তুমি আমার কাছে এখন এস না। বিপদ আরো বাড়বে।

আমি সরলভাবে বললাম–তুমি কমাসের মধ্যে আমাকে বিয়ে করবে ইভ?

তার চোখ দুটো স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে উঠল,তুমি পাগল হয়েছ? এর পরও বলছ তোমাকে বিয়ে করতে? তুমি আমাকে মুক্তি দাও। পুলিস যদি আমাদের সম্পর্ক জানতে পারে, তাহলে আইনের কাছে আমরা ধরা পড়ব। আমি খুব তাড়াতাড়ি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। তোমার সঙ্গে আমার দেখা করবার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।

রাগে আমার হাত পা জ্বালা করছে। বললাম–এত সহজে তুমি আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না। আমাকে যদি বিয়ে না কর তাহলে আমি তো পুলিসের কাছে আত্মসমর্পণ করব আর তোমাকেও ফাসাব।

তোমার হিম্মত যদি থাকে, তাহলে পুলিসের কাছে স্বীকার করবে তুমি খুন করেছ। পরিকল্পনা তোমার, আমি কেবলমাত্র তোমার সঙ্গে ছিলাম। আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করবে না শেড–তফাতে থাক।

কথা শেষ করে শরীরে একটা পাক খাইয়ে দর্পিত ভঙ্গীতে ইভ আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বুঝে উঠতে পারলাম না ইভের হঠাৎ কি হল! ল্যারীর পরামর্শেই কি ওর মনটা ঘুরে গেল? যাক্, ইভকে পরে ঠিক হাতের মুঠোয় নিয়ে আসব। এই মুহূর্তেই নিজের জন্য বেশী চিন্তা হচ্ছে।

কি বীভৎসভাবে মরতে হল ভেস্তালকে। কোন ভুল করিনি, তাহলে পুলিসের হাতে ধরা পড়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে আমাকে প্রাণ দিতে হবে! ভাবতে গা–টা শিউরে উঠল। সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।

সময় যেন আর কাটতে চাইছে না। প্রাতঃরাশ দেবার সময় লক্ষ্য করলাম দাস–দাসীরা সবাই কাঁদছে। মিঃ লেগো বলেছিল, এগারোটার সময় আসবে। কিন্তু তার আগমনের কোন লক্ষ্মণ তো, দেখতে পাচ্ছি না। অফিসে বেরোব বলে ভাবছি, এমন সময় ফোন এলব্ল্যাকস্টেনের ফোন।

মিঃ লেগো এতক্ষণ তার অফিসে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কেবল বার বার এক কথা। কাল নটা থেকে দশটার সময় আমি কোথায় ছিলাম!

মিঃ উইন্টার্স বা মিস ডোলান এসময় কি করছিল–এরকম নানান প্রশ্ন।

আমি তাকে বলেছি, এটা নিছকই দুর্ঘটনা মাত্র কারণ মিসেস উইন্টার্স খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি আমার কথা মানতে চাইছে না।

ব্ল্যাকস্টেনের কথা শুনে আমার হাত পা কাঁপছে।

ব্ল্যাকস্টেন আবার বলল–উইন্টার্স, তোমাকে একটা কথা বলি গোপনে। আমার মনে হয় মিঃ লেগো তোমাকে পছন্দ করেন না।

গলার স্বর সংযত রেখে বললাম–স্বাভাবিক। মিঃ লেগো ভেস্তালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তুমি আমার হয়ে যা বলেছ, তা তো আর ভুল বল নি।

তুমি নিজে জান যে, ভেস্তালের মৃত্যু একটা দুর্ঘটনা মাত্র। তোমার সঙ্গে কথা বলার পর মিঃ লেগোর ধারণা হয়ত পাল্টে যাবে। তুমি সব সত্যি কথা বলেছ, এজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

ব্ল্যাকস্টেন বলল–না, না, এটা তো আমার চোখে দেখা। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পার। আমি সর্বদা তোমার পাশে থাকব।

ফোন রেখে দিয়ে ভাবলাম এবার অফিসে যাই।

লেফটেন্যান্ট লেগো আমাকে সন্দেহ করছে। লোকটার অনুমান শক্তি যে প্রখর তা মানতেই হবে। আমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। ভাবতে ভাবতে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাগানের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আর তার ভেতরে একজন পুলিস অফিসার বসে রয়েছে। তার মানে এখন লেগো আসবে।

আমি তাড়াতাড়ি টেবিলে গিয়ে বসলাম। ঘড়িতে তখন এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট।

 এক গাদা চিঠিপত্র নিয়ে বসলাম। এমন ভাব দেখালাম যেন আমি কত ব্যস্ত।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে আমার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে দেখলাম মিঃ লেগো।বললাম–গুড মনিং, লেফটেন্যান্ট!আসুন!হুইস্কি ঢালি? গলার স্বর পুরোপুরি স্বাভাবিক।

মিঃ লেগো একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল না, ধন্যবাদ।

আমি নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম, আমি ছ কোটি ডলারের মালিক। আমি একে ভয় পেতে যাব কেন? আমি এবারেও স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করলাম–কিছু কিনারা করতে পারলেন নাকি? কি করে দুর্ঘটনাটা ঘটল?

শান্তস্বরে মিঃ লেগো বললেন–গাড়ির সামনের চাকাটা ফেটে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল–আচ্ছা, মিঃ উইন্টার্স?

রাত নটা থেকে দশটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন? কি করছিলেন?

আমি চটপট তাকে জানালাম–আমি এই ঘরেই ছিলাম। কয়েকটা চিঠির ডিকটেশান দিচ্ছিলাম।

পাল্টা প্রশ্ন ডিকটেশান কি রেকর্ডে টেপ করছিলেন?

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেই জিজ্ঞাসা করলাম–এর সঙ্গে দুর্ঘটনার কি সম্পর্ক আছে?

 মিঃ লেগো কঠোর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল–এটা মোটেও দুর্ঘটনা নয়।

আমার রক্ত যেন তীব্র বেগে শিরা উপশিরা দিয়ে দৌড়তে আরম্ভ করল। বুকের মধ্যে ধক ধক করতে শুরু করল

আপনি কি বলছেন? এটা দুর্ঘটনা নয় তো কি?

খুন। পরিকল্পিত খুন।