[লণ্ডনে প্রদত্ত বক্তৃতা, ২৭শে অক্টোবর, ১৮৯৬]
আমরা দেখিয়াছি, আমরা দুঃখ দূর করিতে যতই চেষ্টা করি না কেন, আমাদের জীবনের বেশীর ভাগই অবশ্য দুঃখপূর্ণ থাকিবে। আর এই দুঃখরাশি আমাদের পক্ষে একরূপ সীমাহীন। আমরা অনাদি কাল হইতে এই দুঃখ প্রতিকারের চেষ্টা করিতেছি, কিন্তু বাস্তবিক উহা যেমন তেমনই রহিয়াছে। আমরা যতই দু্ঃখ-প্রতিকারের উপায় বাহির করি, ততই আমরা নিজেদের সূক্ষ্মতর দুঃখরাশি দ্বারা পরিবেষ্টিত দেখিতে পাই। আমরা আরও দেখিয়াছি,সকল ধর্মই বলিয়া থাকে, এই দুঃখ-চক্রের বাহিরে যাইবার একমাত্র উপায় ঈশ্বর। সকল ধর্মই বলিয়া থাকে—আধুনিক কর্মকুশল লোকদের উপদেশমত জগৎকে যেমন দেখিতেছ, তেমনি গ্রহণ করিলে আমাদের ভাগ্যে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই থাকিবে না। কিন্তু সকল ধর্মই বলে—এই জগতের অতীত আরও কিছু আছে। এই পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য জীবনই সবটুকু নয়, উহা প্রকৃত জীবনের অতি সামান্য অংশ মাত্র, বাস্তবিক উহা অতি স্থূল ব্যাপার। উহার পশ্চাতে, উহার অতীত প্রদেশে সেই অনন্ত রহিয়াছেন, যেখানে দুঃখের লেশমাত্র নাই—উহাকে কেহ গড্, কেহ আল্লা, কেহ জিহোভা, কেহ জোভ্, কেহ বা আর কিছু বলিয়া থাকেন। বেদান্তীরা উহাকে ‘ব্রহ্ম’ বলিয়া থাকেন।
কিন্তু জগতের অতীত প্রদেশে যাইতে হইবে, এ-কথা সত্য হইলেও আমাদিগকে এই জগতে জীবনধারণ করিতে তো হইবে? এখন ইহার মীমাংসা কোথায়?
জগতের বাহিরে যাইতে হইবে—সকল ধর্মের এই উপদেশ হইতে আপাততঃ এই ভাবই মনে উদিত হয় যে, আত্মহত্যা করাই বুঝি শ্রেয়ঃ। প্রশ্ন এই—জীবনের দুঃখরাশির প্রতিকার কি? আর তাহার যে উত্তর দেওয়া হয়, তাহাতে আপাততঃ মনে হয়—জীবনটাকে ত্যাগ করাই ইহার একমাত্র প্রতিকার। ইহার উত্তরে আমাদের একটি প্রাচীন গল্পের কথা মনে পড়ে। একজনের মাথার উপরে একটা মশা বসিয়াছিল, তাহার এক বন্ধু ঐ মশাটাকে মারিতে গিয়া তাহার মস্তকে এমন তীব্র আঘাত করিল যে, সেই লোকটি মারা গেল, মশাটিও মরিল। দুঃখ প্রতিকারের যে উপায়ের কথা ধর্ম বলে, তাহা এইরূপই।
জীবন যে দুঃখপূর্ণ, জগৎ যে দুঃখপূর্ণ—তাহা জগৎকে যে বিশেষরূপে জানিয়াছে, সে আর অস্বীকার করিতে পারে না। কিন্তু সকল ধর্ম ইহার প্রতিকারের কি উপায় বলে? ধর্মগুলি বলে, জগৎ কিছুই নয়; এই জগতের বাহিরে এমন কিছু আছে, যাহা প্রকৃত সত্য। এই খানেই বিবাদ। উপায়টি যেন আমাদের যাহা কিছু আছে, সবই নষ্ট করিয়া ফেলিতে উপদেশ দিতেছে। তবে কি করিয়া উহার প্রতিকারের উপায় হইবে? তবে কি কোনই উপায় নাই? প্রতিকারের অন্ততঃ আর একটি উপায় প্রস্তাবিত হইয়াছে। বেদান্ত বলে, বিভিন্ন ধর্ম যাহা বলিতেছে, তাহা সম্পূর্ণ সত্য, কিন্তু ঐ কথার যথার্থ তাৎপর্য কি, তাহা বুঝিতে হইবে। অনেক সময় লোকে বিভিন্ন ধর্মের উপদেশ সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে বুঝিয়া থাকে, ধর্মগুলিও ঐ বিষয়ে খুব স্পষ্ট করিয়া কিছু বলে না। আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্ক উভয়ই প্রয়োজন। হৃদয় অবশ্য খুব বড় জিনিস—হৃদয়ের ভিতর দিয়াই জীবনের মহৎ প্রেরণাগুলির স্ফুরণ হয়। হৃদয়শূন্য কেবল মস্তিষ্ক অপেক্ষা যদি আমার মস্তিষ্ক না-ই থাকে, শুধু একটু হৃদয় থাকে, তাহা আমি শতবার পছন্দ করিব। যাহার হৃদয় আছে, তাহারই যথার্থ জীবন—তাহারই উন্নতি সম্ভব; কিন্তু যাহার এতটুকু হৃদয় নাই, কেবল মস্তিষ্ক আছে, সে শুষ্কতায় মরিয়া যায়।
কিন্তু আমরা ইহাও জানি, যিনি কেবল নিজের হৃদয় দ্বারা পরিচালিত হন, তাঁহাকে অনেক দুঃখ ভোগ করিতে হয়, কারণ তাঁহার প্রায়ই ভ্রমে পড়িবার সম্ভাবনা। আমরা চাই—হৃদয় ও মস্তিষ্কের মিলন। আমার কথার তাৎপর্য ইহা নহে যে, কিছুটা হৃদয় ও কিছুটা মস্তিষ্কের মধ্যে আপস করিতে হইবে, কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তিরই অনন্ত হৃদয়ানুভূতি থাকুক এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে অনন্ত পরিমাণ বিচারবুদ্ধিও থাকুক।
এই জগতে আমরা যাহা কিছু চাই, তাহার কি কোন সীমা আছে? জগৎ কি অনন্ত নয়? জগতে অনন্তপরিমান ভাববিকাশের এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে অনন্তপরিমাণ শিক্ষানুশীলন ও বিচারের অবকাশ আছে। অব্যাহতভাবে ঐ দুই ভাবই একসঙ্গে আসুক—উভয়েই সমান্তরালভাবে চলিতে থাকুক।
অধিকাংশ ধর্মই, জগতে যে দুঃখরাশি বিদ্যমান—এ ব্যাপারটি বুঝেন এবং স্পষ্ট ভাষাতেই উহার উল্লেখ করিয়া থাকেন বটে, কিন্তু সকলেই বোধ হয় একই ভ্রমে পড়িয়াছেন, তাঁহারা সকলেই হৃদয়ের দ্বারা, ভাবের দ্বারা পরিচালিত হইয়া থাকেন। জগতে দুঃখ আছে, অতএব সংসারত্যাগ কর—ইহা খুব বড় উপদেশ এবং একমাত্র উপদেশ, সন্দেহ নাই। ‘সংসারত্যাগ কর’—সত্য জানিতে হইলে অসত্য ত্যাগ করিতে হইবে—ভালো পাইতে হইলে মন্দ ত্যাগ করিতে হইবে, জীবন পাইতে হইলে মৃত্যু ত্যাগ করিতে হইবে—এ সম্বন্ধে কোন মতদ্বৈধ হইতে পারে না।
কিন্তু যদি এই মতবাদের তাৎপর্য এই হয় যে, পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য জীবন—আমরা যাহাকে জীবন বলিয়া জানি, আমরা জীবন বলিতে যাহা বুঝি, তাহা ত্যাগ করিতে হইবে, তবে আর আমাদের থাকে কি? যদি আমরা উহা ত্যাগ করি, তবে তো আমাদের কিছুই থাকে না।
যখন আমরা বেদান্তের দার্শনিক অংশের আলোচনা করিব, তখন আমরা এই তত্ত্ব আরও ভালভাবে বুঝিব, কিন্তু আপাততঃ আমি কেবল ইহাই বলিতে চাই যে, বেদান্তেই কেবল এই সমস্যার যুক্তিসঙ্গত মীমাংসা পাওয়া যায়। এখানে কেবল বেদান্তের প্রকৃত উপদেশ কি, তাহাই বলিব—বেদান্ত শিক্ষা দেয় জগৎকে ব্রহ্মভাবে দর্শন করিতে।
বেদান্ত প্রকৃতপক্ষে জগৎকে একেবারে উড়াইয়া দিতে চায় না। বেদান্তে যেমন চূড়ান্ত বৈরাগ্যের উপদেশ আছে, তেমন আর কোথাও নাই, কিন্তু ঐ বৈরাগ্যের অর্থ আত্মহত্যা নহে—নিজেকে শুকাইয়া ফেলা নহে। বেদান্তে বৈরাগ্যের অর্থ জগতের ব্রহ্মভাব—জগৎকে আমরা যেভাবে দেখি, উহাকে আমরা যেমন জানি, উহা যেভাবে প্রতিভাত হইতেছে, তাহা ত্যাগ কর এবং উহার প্রকৃত স্বরূপ অবগত হও। জগৎকে ব্রহ্মভাবে দেখ—বাস্তবিকও উহা ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই নহে; এই কারণেই আমরা প্রাচীনতম উপনিষদে—বেদান্ত সম্বন্ধে লিখিত প্রথম পুস্তকে—দেখিতে পাই, ‘ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ’১—জগতে যাহা কিছু আছে, তাহা ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত করিতে হইবে।
———-
১ ঈশ উপ.,—১ম শ্লোক
সমুদয় জগৎকে ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছাদিত করিতে হইবে—জগতে যে অশুভ দুঃখ আছে তাহার দিকে না চাহিয়া, মিছিমিছি সবই মঙ্গলময়—সবই সুখময় বা সবই ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্য—এরূপ ভ্রান্ত সুখবাদ অবলম্বন করিয়া নহে, কিন্তু বাস্তবিক প্রত্যেক বস্তুর ভিতরে ঈশ্বর দর্শন করিয়া। এই ভাবে আমাদিগকে ‘সংসার’ ত্যাগ করিতে হইবে—আর যখন সংসারত্যাগ হয়, তখন অবশিষ্ট থাকে কি?—ঈশ্বর। এই উপদেশের তাৎপর্য কি? তাৎপর্য এই—তোমার স্ত্রী থাকুক, তাহাতে কোন ক্ষতি নাই, তাহাদিগকে ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে হইবে, তাহা নয়; কিন্তু ঐ স্ত্রীর মধ্যে তোমাকে ঈশ্বর দর্শন করিতে হইবে। সন্তান-সন্ততিকে ত্যাগ কর—ইহার অর্থ কি? ছেলেগুলিকে লইয়া কি রাস্তায় ফেলিয়া দিতে হইবে—যেমন সকল দেশে নর-পশুরা করিয়া থাকে? কখনই নয়; উহা তো পৈশাচিক কাণ্ড—উহা তো ধর্ম নহে। তবে কি? সন্তান-সন্ততিগণের মধ্যে ঈশ্বর দর্শন কর। এইরূপ সকল বস্তুতেই, জীবনে-মরণে, সুখে-দুঃখে—সকল অবস্থাতেই সমুদয় জগৎ ঈশ্বরপূর্ণ; কেবল নয়ন উন্মীলন করিয়া তাঁহাকে দর্শন কর। বেদান্ত ইহাই বলে; তুমি জগৎকে যেরূপ অনুমান করিয়াছ, তাহা ত্যাগ কর; কারণ তোমার অনুমান আংশিক অনুভূতির উপর—খুব সামান্য যুক্তির উপর—মোট কথা, তোমার নিজের দুর্বলতার উপর প্রতিষ্ঠিত। ঐ আনুমানিক জ্ঞান ত্যাগ কর—আমরা এতদিন জগৎকে যেরূপ ভাবিতেছিলাম, এতদিন যে-জগতে আসক্ত ছিলাম, তাহা আমাদের নিজেদের সৃষ্ট মিথ্যা জগৎ মাত্র; উহা ত্যাগ কর। নয়ন উন্মীলন করিয়া দেখ, আমরা যেভাবে এতদিন জগৎকে দেখিতেছিলাম, প্রকৃত পক্ষে কখনই উহার সেরূপ অস্তিত্ব ছিল না—আমরা স্বপ্নে ঐরূপ দেখিতেছিলাম—মায়ায় আচ্ছন্ন হইয়া আমাদের ঐরূপ ভ্রম হইতেছিল, অনন্তকাল ধরিয়া সেই প্রভুই একমাত্র বিদ্যমান। তিনিই সন্তান-সন্ততির ভিতরে, তিনিই স্ত্রীর মধ্যে, তিনিই স্বামীতে, তিনিই ভালয় মন্দে, তিনিই পাপে ও পাপীতে, তিনিই হত্যাকারীতে, তিনিই জীবনে এবং মরণেও তিনিই রহিয়াছেন।
বিষম প্রস্তাব বটে! কিন্তু বেদান্ত ইহাই প্রমান করিতে, শিক্ষা দিতে ও প্রচার করিতে চায়। ইহা তো শুধু বেদান্তের আরম্ভ!
আমরা এইভাবে সর্বত্র ব্রহ্মদর্শন করিয়াই জীবনের বিপদ ও দুঃখরাশি এড়াইতে পারি। কিছু চাহিও না। আমাদিগকে অসুখী করে কিসে? আমরা যে-সকল দুঃখভোগ করিয়া থাকি, বাসনা হইতেই সেগুলির উৎপত্তি। তোমার কিছু অভাব আছে, আর সেই অভাব পূর্ণ হইতেছে না, ফল—দুঃখ। অভাব যদি না থাকে, তবে দুঃখও থাকিবে না। যখন আমরা সকল বাসনা ত্যাগ করিব, তখন কি হইবে? দেয়ালের কোন বাসনা নাই, উহা কখন দুঃখ ভোগ করে না। ইহা সত্য, কিন্তু দেওয়ালের কোনরূপ উন্নতিও হয় না। এই চেয়ারের কোন বাসনা নাই, কোন কষ্টও নাই কিন্তু উহা যে চেয়ার, সেই চেয়ারই থাকে। সুখভোগের ভিতরেও এক মহান্ ভাব আছে, দুঃখভোগের ভিতরেও আছে। যদি সাহস করিয়া বলা যায়, তাহা হইলে ইহাও বলিতে পারি যে, দুঃখেরও উপকারিতা আছে। আমরা সকলেই জানি, দুঃখ হইতে কি মহৎ শিক্ষা হয়। জীবনে শত শত কাজ করিয়াছি; পরে বোধ হয়, না করিলেই ছিল ভাল, কিন্তু তাহা হইলেও ঐ-সকল কাজ আমাদের মহান্ শিক্ষকের কাজ করিয়াছে। নিজের সম্বন্ধে বলিতে পারি, কিছু ভাল করিয়াছি বলিয়া আমি আনন্দিত, আবার অনেক খারাপ কাজ করিয়াছি বলিয়াও সুখী—আমি কিছু সৎকার্য করিয়াছি বলিয়া আনন্দিত, আবার অনেক ভ্রমে পড়িয়াছি বলিয়াও সুখী, কারণ উহাদের প্রত্যেকটিই আমাকে মহৎ শিক্ষা দিয়াছে।
আমি এখন যাহা, তাহা আমার পূর্ব কর্ম ও চিন্তাসমষ্টির ফলস্বরূপ। প্রত্যেক কার্য ও চিন্তারই একটি না একটি ফল আছে, এবং এই ফলগুলির সমষ্টি আমার এই অগ্রগতি-এই উন্নতি। তবেই এখন সমস্যা কঠিন হইয়া পড়িল। আমরা সকলেই বুঝি—বাসনা বড় খারাপ জিনিস, কিন্তু বাসনা-ত্যাগের অর্থ কি? বাসনা ত্যাগ করিলে দেহযাত্রানির্বাহ হইবে কিরূপে? ইহাও কি সেই মশা মারার জন্য মানুষ মারা নয়? বাসনাকে সংহার কর, তাহার সঙ্গে বাসনাযুক্ত মানুষটাকেও মারিয়া ফেলো! তবে শোন ইহার উত্তর কি : তোমার যে বিষয়-সম্পত্তি থাকিবে না, তাহা নহে; প্রয়োজনীয় জিনিস, এমন কি বিলাসের জিনিস পর্যন্ত রাখিবে না, তাহা নহে। যাহা কিছু তোমার আবশ্যক, এমন কি তদতিরিক্ত জিনিস পর্যন্ত তুমি রাখিতে পারো—তাহাতে কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। কিন্তু তোমার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য এই যে, সত্যকে জানিতে হইবে—প্রত্যক্ষ করিতে হইবে।
এই ধন—ইহা কাহারও নয়। কোন পদার্থে স্বামিত্বের ভাব রাখিও না। তুমি তো কেহ নও, আমিও কেহ নহি, কেহই কিছু নহে। সবই সেই প্রভুর বস্তু; ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকে বলা হইয়াছে—ঈশ্বরকে সর্ববস্তুর ভিতরে স্থাপন কর। ঈশ্বর তোমার ভোগ্য ধনে রহিয়াছেন, তোমার মনে যে-সকল বাসনা উঠিতেছে, তাহাতে রহিয়াছেন; তোমার বাসনা থাকাতে তুমি যে যে দ্রব্য ক্রয় করিতেছ, সেগুলির মধ্যেও তিনি, তোমার সুন্দর বস্ত্রের মধ্যেও তিনি, তোমার সুন্দর অলঙ্কারেও তিনি। এইরূপে চিন্তা করিতে হইবে। এইভাবে সকল জিনিস দেখিতে আরম্ভ করিলে তোমার দৃষ্টিতে সকলই পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। যদি তোমার প্রত্যেক চালচলনে, তোমার বস্ত্রে, তোমার কথাবার্তায়, তোমার শরীরে—আকৃতিতে, সকল জিনিসে ভগবানকে স্থাপন কর, তবে তোমার চক্ষে সকল দৃশ্য বদলাইয়া যাইবে এবং জগৎ দুঃখরূপে প্রতিভাত না হইয়া স্বর্গরূপে পরিণত হইবে।
যীশু বলিয়াছিলেন, ‘স্বর্গরাজ্য তোমার ভিতরে’। বেদান্তও বলে, উহা পূর্ব হইতেই তোমার অভ্যন্তরে অবস্থিত। সকল ধর্মই এই কথা বলিয়া থাকে, সকল মহাপুরুষই ইহা বলিয়া থাকেন। ‘যাহার দেখিবার চক্ষু আছে, সে দেখুক; যাহার শুনিবার কর্ণ আছে, সে শুনুক।’ আমরা যে-সত্য এতদিন অন্বেষণ করিতেছি, তাহা পূর্ব হইতেই আমাদের অন্তরে বর্তমান, আর বেদান্ত শুধু যে উহার উল্লেখমাত্র করে তাহা নহে, ইহা যুক্তিবলে প্রমাণ করিতেও প্রস্তুত। অজ্ঞানবশতঃ আমরা মনে করি, আমরা সত্য হারাইয়া ফেলিয়াছি এবং উহা পাইবার জন্য কেবল কাঁদিয়া, কষ্টে ভুগিয়া সমগ্র জগতে ঘুরিতেছিলাম, কিন্তু উহা সর্বদাই আমাদের নিজেদের অন্তরের অন্তস্তলে বর্তমান ছিল। এই তত্ত্বদৃষ্টি-সহায়ে জগতে জীবনযাপন করিতে হইবে।
‘সংসার ত্যাগ কর’—এই উপদেশ যদি সত্য হয়, আর যদি স্থূল এবং প্রতীয়মান অর্থে ইহা গ্রহণ করা যায়, তবে এই দাঁড়ায়—আমাদের কোন কাজ করিবার আবশ্যকতা নাই, অলস হইয়া মাটির ঢিপির মতো বসিয়া থাকিলেই হইল, কিছু চিন্তা করিবার বা কোন কাজ করিবার কিছুমাত্র আবশ্যকতা নাই; অদৃষ্টবাদী হইয়া, ঘটনাচক্রে তাড়িত হইয়া, প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হইয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করিলেই হইল। ইহাই ফল দাঁড়াইবে। কিন্তু পূর্বোক্ত উপদেশের অর্থ বাস্তবিক তাহা নহে। আমাদিগকে অবশ্য কার্য করিতে হইবে। সাধারণ মানুষ, যাহারা বৃথা বাসনায় ইতস্ততঃ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তাহারা কাজের কি জানে? যে-ব্যক্তি নিজের ভাবরাশি ও ইন্দ্রিয়গণ দ্বারা পরিচালিত, সে কাজের কি বুঝে? তিনিই কাজ করিতে পারেন, যিনি কোনরূপ বাসনা দ্বারা, কোনরূপ স্বার্থপরতা দ্বারা পরিচালিত নন। তিনিই কাজ করিতে পারেন, যাঁহার অন্য কোন কামনা নাই। তিনিই কাজ করিতে পারেন, যাঁহার কোন লাভের প্রত্যাশা নাই।
একখানি চিত্র কে বেশী উপভোগ করে? চিত্র-বিক্রেতা, না চিত্রদ্রষ্টা? বিক্রেতা তাহার হিসাব-কেতাব লইয়াই ব্যস্ত, তাহার কত লাভ হইবে ইত্যাদি চিন্তাতেই মগ্ন। ঐ-সকল বিষয়ই তাহার মাথায় ঘুরিতেছে। সে কেবল নিলামের হাতুড়ির দিকে লক্ষ্য করিতেছে এবং দর কত চড়িল, তাহা শুনিতেছে। দর কিরূপ তাড়াতাড়ি উঠিতেছে, তাহা শুনিতেই সে ব্যস্ত। চিত্র দেখিয়া সে আনন্দ উপভোগ করিবে কখন? তিনিই চিত্র সম্ভোগ করিতে পারেন, যাঁহার বেচা-কেনার কোন মতলব নাই। তিনি ছবিখানির দিকে চাহিয়া থাকেন, আর অতুল আনন্দ উপভোগ করেন। এইভাবে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডই একটি চিত্র স্বরূপ; যখন বাসনা একেবারে চলিয়া যাইবে, তখনই মানুষ জগৎকে উপভোগ করিবে, তখন আর এই কেনা-বেচার ভাব, এই ভ্রমাত্মক অধিকার-বোধ থাকিবে না। তখন ঋণদাতা নাই, ক্রেতা নাই, বিক্রেতাও নাই, জগৎ তখন একখানি সুন্দর চিত্রের মতো। ঈশ্বর সম্বন্ধে নিম্নোক্ত কথার মতো সুন্দর কথা আমি আর কোথাও পাই নাই : তিনিই মহৎ কবি, প্রাচীন কবি—সমগ্র জগৎ তাঁহার কবিতা, উহা অনন্ত আনন্দোচ্ছ্বাসে লিখিত, এবং নানা শ্লোকে নানা ছন্দে, নানা তালে প্রকাশিত। বাসনা-ত্যাগ হইলেই আমরা ঈশ্বরের এই বিশ্ব-কবিতা পাঠ করিয়া সম্ভোগ করিতে পারিব। তখন সবই ব্রহ্মভাব ধারণ করিবে। আনাচ-কানাচ, গলি-ঘুজি, অন্ধকার স্থান—যাহা আমরা পূর্বে এত অপবিত্র ভাবিয়াছিলাম, উহাদের উপর যে-সকল দাগ এত কালো বোধ হইয়াছিল, সবই ব্রহ্মভাব ধারণ করিবে। তাহারা সকলেই তাহাদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করিবে। তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের পূর্ব আচরণের কথা ভাবিয়া হাসিয়া উঠিব—এই-সকল কান্না-চীৎকার কেবল ছেলেখেলা মাত্র, আর আমরা জননীর মতো বরাবর কাছে দাঁড়াইয়া ঐ খেলা দেখিতেছিলাম।
বেদান্ত বলে, এইরূপ ভাব আশ্রয় করিলেই আমরা ঠিক ঠিক কার্য করিতে সক্ষম হইব। বেদান্ত আমাদিগকে কার্য করিতে নিষেধ করে না, তবে ইহাও বলে যে, প্রথমে ‘সংসার’ ত্যাগ করিতে হইবে, এই আপাতপ্রতীয়মান মায়ার জগৎ ত্যাগ করিতে হইবে। এই ত্যাগের অর্থ কি? পূর্বে বলা হইয়াছে, ত্যাগের প্রকৃত তাৎপর্য—সর্বত্র ঈশ্বরদর্শন। সর্বত্র ঈশ্বরবুদ্ধি করিতে পারিলেই প্রকৃতপক্ষে কার্য করিতে সক্ষম হইবে। যদি ইচ্ছা হয়, শতবর্ষ বাঁচিবার ইচ্ছা কর, যত কিছু সাংসারিক বাসনা আছে ভোগ করিয়া লও, কেবল ঐ গুলিকে ব্রহ্মরূপে দর্শন কর ,স্বর্গীয় ভাবে পরিণত করিয়া লও, তারপর শতবর্ষ জীবনযাপন কর। এই জগতে দীর্ঘকাল আনন্দে পূর্ণ হইয়া কার্য করিয়া জীবন সম্ভোগ করিবার ইচ্ছা কর। এইরূপে কার্য করিলে তুমি প্রকৃত পথ পাইবে। ইহা ব্যতীত অন্য কোন পথ নাই। যে-ব্যাক্তি সত্য কি, না জানিয়া নির্বোধের ন্যায় সংসারের বিলাস-বিভ্রমে নিমগ্ন হয়, বুঝিতে হইবে সে প্রকৃত পথ পায় নাই, তাহার পা পিছলাইয়া গিয়াছে। অপরদিকে যে-ব্যক্তি জগৎকে অভিসম্পাত করিয়া বনে গিয়া নিজের শরীরকে কষ্ট দিতে থাকে, ধীরে ধীরে শুকাইয়া আপনাকে মারিয়া ফেলে, নিজের হৃদয় একটি শুষ্ক মরুভূমি করিয়া ফেলে, নিজের সকল ভাব মারিয়া ফেলে, কঠোর বীভৎস শুষ্ক হইয়া যায়, সেও পথ ভুলিয়াছে—বুঝিতে হইবে। এই দুইটি বাড়াবাড়ি—দুইটিই ভ্রম, এদিক আর ওদিক । উভয়েই লক্ষভ্রষ্ট—উভয়েই পথভ্রষ্ট।
বেদান্ত বলে, এইভাবে কার্য কর—সকল বস্তুতে ঈশ্বরবুদ্ধি কর, সর্বভূতেই তিনি আছেন জানো, নিজের জীবনকেও ঈশ্বরানুপ্রাণিত, এমন কি ঈশ্বর-স্বরূপ চিন্তা কর—জানিয়া রাখো, ইহাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য, ইহাই আমাদের একমাত্র জিজ্ঞাস্য, কারণ ঈশ্বর সকল বস্তুতেই বিদ্যমান, তাঁহাকে লাভ করিবার জন্য আবার কোথায় যাইবে? প্রত্যেক কার্যে, প্রত্যেক চিন্তায়, প্রত্যেক ভাবে তিনি পূর্ব হইতেই অবস্থিত। এইরূপ জানিয়া আমাদিগকে অবশ্য কার্য করিয়া যাইতে হইবে। ইহাই একমাত্র পথ—আর কোন পথ নাই। এইরূপ করিলে কর্মফল আমাদিগকে আবদ্ধ করিতে পারিবে না। কর্মফল আর আমাদের কোন অনিষ্ট করিতে পারিবে না। আমরা দেখিয়াছি, আমরা যত কিছু দুঃখ-কষ্ট ভোগ করি, তাহার কারণ এই-সকল বৃথা বাসনা। কিন্তু যখন এই বাসনাগুলি ঈশ্বরবুদ্ধি দ্বারা বিশুদ্ধ ভাব ধারণ করে, ঈশ্বর-স্বরূপ হইয়া যায়, তখন উহারা আর কোন অনিষ্ট করে না। যাহারা এই রহস্য জানে নাই, তাহাদিগকে ইহা না জানা পর্যন্ত এই আসুরিক জগতে বাস করিতে হইবে। লোকে জানে না, এখানে তাহাদের চতুর্দিকে সর্বত্র কি অনন্ত আনন্দের খনি রহিয়াছে, কিন্তু তাহারা এখনও আবিষ্কার করিতে পারে নাই। আসুরিক জগতের অর্থ কি? বেদান্ত বলে—অজ্ঞান।
বেদান্ত বলে, আমরা বিশাল স্রোতস্বতীর তীরে বসিয়া তৃষ্ণায় মরিতেছি। রাশীকৃত খাদ্যের সম্মুখে বসিয়া আমরা ক্ষুধায় মরিতেছি। এইখানেই আনন্দময় জগৎ রহিয়াছে, আমরা উহা খুঁজিয়া পাইতেছি না। আমরা উহার মধ্যে রহিয়াছি, উহা সর্বদাই আমাদের চতুর্দিকে রহিয়াছে, কিন্তু আমরা সর্বদাই উহাকে অন্য কিছু বলিয়া ভুল করিতেছি। বিভিন্ন ধর্ম আমাদিগকে সেই আনন্দময় জগৎ দেখাইয়া দিতে অগ্রসর। সকল হৃদয়ই এই আনন্দময় জগতের অন্বেষণ করিয়াছে। সকল জাতিই ইহার অন্বেষণ করিয়াছে, ইহাই ধর্মের একমাত্র লক্ষ্য, আর এই আদর্শই বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে; বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে সামান্য মতভেদ আছে, সেগুলি ভাষার বিভিন্নতা মাত্র—বাস্তবিক কিছু নয়। একজন একটি ভাব একরূপে প্রকাশ করিতেছে, আর একজন একটু অন্যভাবে প্রকাশ করিতেছে, কিন্তু আমি যাহা বলিতেছি, তুমি হয়তো অন্য ভাষায় ঠিক তাহাই বলিতেছ। কেহ হয়তো সুখ্যাতি-লাভের আশায় অথবা সবকিছু নিজের মনের মতো করিতে চায় বলিয়া বলে, ‘এ আমার মৌলিক মত।’ ইহা হইতেই আমাদের জীবনে দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের উৎপত্তি।
এ-সম্বন্ধে আবার এখন নানা তর্ক উঠিতেছে। যাহা বলা হইল, তাহা মুখে বলা তো খুব সহজ। ছেলেবেলা হইতেই শুনিয়া আসিতেছি : সর্বত্র ব্রহ্মবুদ্ধি কর—সব ব্রহ্মময় দেখ, তবেই ঠিকঠিক এ সংসার সম্ভোগ করিতে পারিবে। কিন্তু যখনই সংসারক্ষেত্রে নামিয়া কয়েকটি ধাক্কা খাই, অমনি ব্রহ্মবুদ্ধি উড়িয়া যায়। আমি রাস্তায় ভাবিতে ভাবিতে চলিয়াছি, সকল মানুষেই ঈশ্বর বিরাজমান—একজন বলবান লোক আসিয়া আমায় ধাক্কা দিল, অমনি চিৎপাত হইয়া পড়িয়া গেলাম, চটপট উঠিলাম, রক্ত মাথায় চড়িয়া গেল—মুষ্টি বদ্ধ হইল—বিচারশক্তি হারাইলাম, একেবারে উন্মত্ত হইয়া উঠিলাম, স্মৃতিভ্রংশ হইল—সেই ব্যক্তির ভিতর ঈশ্বর না দেখিয়া শয়তান দেখিলাম। জন্মিবামাত্র উপদেশ পাইতেছি, সর্বত্র ঈশ্বর দর্শন কর। সকল ধর্মই ইহা শিখাইয়াছে—সর্ববস্তুতে, সর্বপ্রাণীর ভিতরে সর্বত্র ঈশ্বর দর্শন কর। নিউ টেস্টামেন্টে যীশুখ্রীষ্টও এ-বিষয়ে স্পষ্ট উপদেশ দিয়াছেন। সকলেই আমরা এই উপদেশ পড়িয়াছি, কিন্তু কাজের বেলাতেই আমাদের অসুবিধা শুরু হয়।
ঈশপ-রচিত একটি গল্পে আছে: এক বৃহৎ সুন্দর হরিণ হ্রদে নিজ প্রতিবিম্ব দেখিয়া তাহার শাবককে বলিতেছিল, ‘দেখ, আমি কেমন বলবান্, আমার মাথা দেখ—কেমন চমৎকার! আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখ—কেমন দৃঢ় ও মাংসল! আমি কত শীঘ্র দৌড়াইতে পারি!’ সে এ-কথা বলিতেছিল, এমন সময়ে দূর হইতে কুকুরের ডাক শুনিতে পাইল। যাই শোনা, অমতি দ্রুতপদে পলায়ন। অনেক দূরে দৌড়িয়া গিয়া আবার হাঁপাইতে হাঁপাইতে শাবকের নিকট ফিরিয়া আসিল। হরিণশাবক বলিল, ‘এইমাত্র বলিতেছিলে, তুমি খুব বলবান্—তবে কুকুরের ডাকে পলাইলে কেন?’ উত্তরে হরিণ বলিল, ‘তাই তো, কুকুর ডাকিলেই আমার আর কিছু জ্ঞান থাকে না।’ আমরাও সারাজীবন এরূপ করিতেছি। আমরা দুর্বল মনুষ্যজাতি সম্বন্ধে কত উচ্চ আশা পোষণ করিতেছি, কিন্তু কুকুর ডাকিলেই হরিণের মতো পলাইয়া যাই। তাই যদি হইল, তবে এ-সকল শিক্ষার কি প্রয়োজন? বিশেষ প্রয়োজন আছে। বুঝিয়া রাখা উচিত, একদিনে কিছু হয় না।
‘আত্মা বা অরে শ্রোতব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যঃ।’১—আত্মা সম্বন্ধে প্রথমে শুনিতে হইবে, পরে মনন অর্থাৎ চিন্তা করিতে হইবে, পরে ক্রমাগত ধ্যান করিতে হইবে। সকলেই আকাশ দেখিতে পায়, এমন কি, যে সামান্য কীট ভূমিতে বিচরণ করে, সেও উপরের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে নীলবর্ণ আকাশ দেখিতে পায়, কিন্তু উহা আমাদের নিকট হইতে কত—কত দূরে রহিয়াছে, বলো দেখি! ইচ্ছা করিলে তো মন সর্বস্থানে গমন করিতে পারে, কিন্তু এই শরীরের পক্ষে হামাগুড়ি দিয়া চলিতে শিখিতেই কত সময় অতিবাহিত হয়! আমাদের সমুদয় আদর্শ সম্বন্ধেও এইরূপ। আদর্শগুলি আমাদের অনেক দূরে রহিয়াছে, আর আমরা কত নীচে পড়িয়া রহিয়াছি। তথাপি আমরা জানি, আমাদের একটি আদর্শ থাকা আবশ্যক। শুধু তাহাই নহে, আমাদের সর্বোচ্চ আদর্শ থাকাই আবশ্যক। দুর্ভাগ্যবশতঃ অধিকাংশ ব্যক্তি এই জগতে কোনরূপ আদর্শ ছাড়াই জীবনের অন্ধকারে পথ হাতড়াইয়া বেড়াইতেছে। যাহার একটি নির্দিষ্ট আদর্শ আছে, সে যদি হাজারটি ভ্রমে পতিত হয়, যাহার কোনরূপ আদর্শ নাই, সে তবে পঞ্চাশ হাজার ভ্রমে পতিত হইবে, ইহা নিশ্চয়। অতএব একটি আদর্শ থাকা ভাল। এই আদর্শ সম্বন্ধে যত বেশী পারা যায়, শুনিতে হইবে; ততদিন শুনিতে হইবে—যতদিন না উহা আমাদের অন্তরে প্রবেশ করে,আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে,যতদিন না আমাদের রক্তের ভিতর প্রবেশ করে, যতদিন না উহা আমাদের প্রতি শোণিতবিন্দুতে ধ্বনিত হয়, যতদিন না উহা আমাদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাপ্ত হইয়া যায়। অতএব আমাদিগকে প্রথমে এই আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করিতে হইবে। কথিত আছে যে, ‘হৃদয় পূর্ণ হইলেই মুখ কথা বলে’, সেইরূপ হৃদয় পূর্ণ হইলে হাতও কাজ করিয়া থাকে।
———-
১ বৃহ. উপ., ২/৪/৫; ৪/৫/৬
চিন্তাই আমাদের কর্মপ্রবৃত্তির প্রেরণাশক্তি। মনকে সর্বোচ্চ চিন্তা দ্বারা পূর্ণ করিয়া রাখো, দিনের পর দিন ঐ-সকল ভাব শুনিতে থাকো, মাসের পর মাস উহা চিন্তা করিতে থাকো। প্রথম প্রথম সফল না হও, ক্ষতি নাই, এই বিফলতা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, ইহা মানব জীবনের সৌন্দর্য। এরূপ বিফলতা না থাকিলে জীবনটা কি হইত? যদি জীবনে এই বিফলতাকে জয় করিবার চেষ্টা না থাকিত, তবে জীবন ধারণ করিবার কোন মূল্য থাকিত না। উহা না থাকিলে জীবনে কবিত্ব কোথায় থাকিত? এই বিফলতা, এই ভ্রম থাকিলই বা; গরুকে কখন মিথ্যা কথা বলিতে শুনি নাই, কিন্তু উহা চিরকাল গরুই থাকে , কখনই মানুষ হয় না। অতএব বার বার বিফল হও, কিছুমাত্র ক্ষতি নাই; সহস্রবার ঐ আদর্শ হৃদয়ে ধারণ কর, আর যদি সহস্রবার অকৃতকার্য হও, আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখ। সর্বভূতে ব্রহ্মদর্শনই মানুষের আদর্শ—উদ্দেশ্য। যদি সকল বস্তুতে তাঁহাকে দেখিতে না পারো, অন্ততঃ যাহাকে সর্বাপেক্ষা ভালবাসো, এমন এক ব্যক্তির মধ্যে তাঁহাকে দর্শন করিতে চেষ্টা কর—তারপর আর এক ব্যক্তির মধ্যে; এইরূপে অগ্রসর হইতে পারো। আত্মার সম্মুখে তো অনন্ত জীবন পড়িয়া রহিয়াছে,—অধ্যবসায়ের সহিত চেষ্টা করিলে তোমার শুভ বাসনা পূর্ণ হইবে।
‘অনেকজদেকং মনসো জবীয়ো নৈনদ্দেবা আপ্নুবন্ পূর্বমর্ষৎ।
তদ্বাবতোহন্যানত্যেতি নিষ্ঠৎ তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি।।
তদেজতি তন্নৈজতি তদ্দুরে তদ্বন্তিকে।
তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ।।
যস্তু সর্বাণি ভূতানি আত্নন্যেবানুপশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিজুগুপ্সতে।।
যস্মিন্ সর্বাণি ভূতানি আত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ।
তত্র কো মোহঃ কঃ শোক একত্বমনুপশ্যতঃ।।’১
—তিনি অচল, এক,মন অপেক্ষাও দ্রুত কম্পনশীল! ইন্দ্রিয়গণ পূর্বে গমন করিয়াও তাঁহাকে প্রাপ্ত হয় নাই। তিনি স্থির থাকিয়াও অন্যান্য দ্রুত গামী পদার্থের অগ্রবর্তী। তাঁহাতে থাকিয়াই হিরণ্যগর্ভ সকলের কর্মফল বিধান করিতেছেন। তিনি সচল, তিনি স্থির; তিনি দূরে, তিনি নিকটে; তিনি এই সকলের ভিতরে, আবার তিনি এই সকলের বাহিরে। যিনি আত্মার মধ্যে সর্বভূতকে দর্শন করেন, আবার সর্বভূতে আত্মাকে দর্শন করেন, তিনি কিছু গোপন করিতে ইচ্ছা করেন না। যে অবস্থায় জ্ঞানী ব্যক্তির পক্ষে সর্বভূত আত্মস্বরূপ হইয়া যায়, সেই একত্বদর্শী পুরুষের সেই অবস্থায় শোক বা মোহের বিষয় কি থাকে?
সর্ব পদার্থের এই একত্ব বেদান্তের আর একটি প্রধান বিষয়। আমরা পরে দেখিব, বেদান্ত কিরূপে প্রমাণ করে যে, আমাদের সমুদয় দুঃখ অজ্ঞান-প্রসূত; অজ্ঞান আর কিছুই নয়—এই বহুত্বের ধারণা—এই ধারণা যে, মানুষে মানুষে ভিন্ন, নর নারী ভিন্ন, যুবা ও শিশু ভিন্ন, জাতি হইতে জাতি পৃথক্, চন্দ্র হইতে পৃথিবী পৃথক্, সূর্য হইতে চন্দ্র পৃহক্, একটি পরমাণু হইতে আর একটি পরমাণু পৃথক্। এই পৃথক্ জ্ঞানই সকল দুঃখের কারণ। বেদান্ত বলেন, এই প্রভেদ বাস্তবিক নাই। এই প্রভেদ প্রাতিভাসিক, উপরে উপরে দেখা যায় মাত্র। বস্তুর অন্তস্তলে সেই একত্ব এখনও বিরাজমান। যদি ভিতরে চলিয়া যাও, তবে এই একত্ব দেখিতে পাইবে—মানুষে মানুষে একত্ব, নরনারীতে একত্ব, জাতিতে জাতিতে একত্ব, উচ্চনীচে একত্ব, ধনী-দরিদ্রে একত্ব, দেবতা- মনুষ্যে একত্ব, সকলেই এক; যদি আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ কর—দেখিবে ইতর জীবজন্তু—সবই এক। যিনি এইরূপ একত্বদর্শী হইয়াছেন, তাঁহার আর মোহ থাকে না। তিনি তখন সেই একত্বে পৌঁছিয়াছেন, ধর্মবিজ্ঞানে যাহাকে ‘ঈশ্বর’ বলিয়া থাকে। তাঁহার আর মোহ কিরূপে থাকিবে? কিসে তাঁহার মোহ জন্মাইতে পারে?তিনি সকল বস্তুর আভ্যন্তরিক সত্য জানিয়াছেন, তিনি সকল বস্তুর রহস্য জানিয়াছেন। তাঁহার পক্ষে আর দুঃখ থাকিবে কিরূপে? তিনি আর কি বাসনা করিবেন? তিনি সকল বস্তুর মধ্যে প্রকৃত সত্য অন্বেষণ করিয়া জগতের কেন্দ্রস্বরূপ ঈশ্বরে পৌঁছিয়াছেন, তিনি সকল বস্তুর একত্ব-স্বরূপ; তিনিই অনন্ত সত্তা, অনন্ত জ্ঞান ও অনন্ত আনন্দ। সেখানে মৃত্যু নাই, রোগ নাই, দুঃখ নাই, শোক নাই, অশান্তি নাই। আছে কেবল পূর্ণ একত্ব—পূর্ণ আনন্দ। তখন তিনি কাহার জন্য শোক করিবেন? বাস্তবিক সেই কেন্দ্রে, সেই পরম সত্যে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু নাই, দুঃখ নাই, কাহারও জন্য শোক করিবার নাই, কাহারও জন্য দুঃখ করিবার নাই।
———-
১ ঈশোপনিষৎ, ৪,৭
‘স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণমস্নাবিরং শুদ্ধমপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূর্যাথাতথ্যতোহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।’১
—তিনি চতুর্দিক বেষ্টন করিয়া আছেন, তিনি উজ্জ্বল দেহশূন্য ব্রণশূন্য স্নায়ুশূন্য পবিত্র ও নিষ্পাপ, তিনি কবি, মনের নিয়ন্তা, সকলের, সকলের শ্রেষ্ঠ ও স্বয়ম্ভূ; তিনিই চিরকাল যথাযোগ্যরূপে সকলের কাম্যবস্তু বিধান করিতেছেন।
যাহারা এই অবিদ্যাময় জগতের উপাসনা করে, তাহারা অন্ধকারে প্রবেশ করে। যাহারা এই জগৎকে ব্রহ্মের ন্যায় সত্যজ্ঞান করিয়া উহার উপাসনা করে, তাহারাও অন্ধকারে ভ্রমণ করিতেছে, কিন্তু যাহারা চিরজীবন এই সংসারের উপসনা করে, উহা হইতে উচ্চতর আর কিছুই লাভ করিতে পারে না, তাহারা আরও গভীরতর অন্ধকারে প্রবেশ করে।২ যিনি এই পরমসুন্দর প্রকৃতির রহস্য জ্ঞাত হইয়াছেন, যিনি প্রকৃতির সাহায্যে দৈবী প্রকৃতির চিন্তা করেন, তিনি মৃত্যু অতিক্রম করেন এবং দৈবী প্রকৃতির সাহায্যে অমৃতত্ব সম্ভোগ করেন।
———-
১ ঈশ উপ., ৮
২ ঈশ উপ., ৯-১২
‘হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপোহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
…তেজো যত্তে রূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি
যোহসাবসৌ পুরুষঃ সোহহমস্মি।।’১
—হে সূর্য, হিরণ্ময় পাত্র দ্বারা তুমি সত্যের মুখ আবৃত করিয়াছ। সত্যধর্মা আমি যাহাতে তাহা দেখিতে পারি, এই জন্য আবরণ অপসারিত কর। …আমি তোমার পরম রমণীয় রূপ দেখিতেছি—তোমার মধ্যে ঐ যে পুরুষ রহিয়াছেন, তাহা আমিই।
———-
১ ঈশ উপ., ১৫,১৬