সমাজ দপ্তরের প্রধান একটু অবাক হয়ে তার যোগযোগ মডিউলের দিকে তাকিয়ে রইল, সেখানে একটা অবিশ্বাস্য তথ্য, কোয়াকম্প তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে! এর আগে কখনোই কোয়াকম্প সরাসরি কোনো মানুষের সাথে যোগাযোগ করে নি। সমাজ দপ্তরের প্রধান একটুখানি অবাক এবং অনেকখানি আতঙ্কিত হয়ে যোগাযোগ মডিউলটা স্পর্শ করে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোয়াকস্পের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, তুমি এটা কী করেছ?
কী হয়েছে?
নগরকেন্দ্রে জলমানবকে নিয়ে অনুষ্ঠানটির কথা বলছি। এটি নৃতন প্রজন্মের উদ্দেশে একটি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। জলমানবকে একটি অসভ্য বন্য প্রজাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা ছিল। হাঙর মাছের হাতে তার মৃত্যুদৃশ্যটি নূতন প্রজন্মের উপভোগ করার কথা ছিল।
সমাজ দপ্তরের প্রধান একটু অধৈর্য গলায় বলল, আমরা তার ব্যবস্থা করেছিলাম। বিষয়টা নিশ্চিত করার জন্য একটির জায়গায় দুটি হাঙর মাছ দিয়েছিলাম। জলমানবকে দেখে যেন সবার ভেতরে এক ধরনের ঘৃণা হয় সেজন্য তাকে কুৎসিত একটা মুখোশ পরিয়েছিলাম। আমরা বুঝতে পারি নি সে নিজের মুখোশ খুলে ফেলবে। বুঝতে পারি নি। জলমানবটি দুই-দুইটা হাঙর মাছকে হত্যা করে বের হয়ে আসবে।।
কোয়াকম্প ভাবলেশহীন গলায় বলল, জলমানবের হাতে একটা ধারালো চাকু দেওয়ার সিদ্ধান্তটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
একেবারে খালি হাতে দুটি ক্ষুধার্ত হাঙর মাছের মাঝখানে ফেলে দেওয়াটা অমানবিক বলে মনে হয়েছিল। বিষয়টা আরো নাটকীয় করার জন্য তাকে ছোট একটা চাকু দেওয়া হয়েছিল। আমরা বিষয়টি তোমার সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছিলাম, তুমি অনুমতি দিয়েছিলে।
হ্যাঁ। তখন অনুমতি দিয়েছিলাম, কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তটা সঠিক ছিল।
সমাজ দপ্তরের প্রধান চমকে উঠে বলল, তুমি এর আগে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নাও নি। এই প্রথম তুমি একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছ, কোয়াকম্প।
কোয়াকম্প দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বলল, ভুলগুলো সংশোধনের সময় এসেছে। কথা ছিল এই ঘটনা দেখে জলমানবের জন্য এক ধরনের ঘৃণার জন্ম নেবে। হাঙর মাছের হাতে তার এক ধরনের নিষ্ঠুর মৃত্যু হলে সকল দর্শকের মাঝে জলমানবের জন্য ঘৃণা জন্ম নিত। উল্টো জলমানবটি সবার সামনে একজন সাহসী বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সবার সমবেদনা এবং ভালবাসা ছিল এই জলমানবের জন্য। এটি খুব বড় ভুল হয়েছে।
আমাদের কিছু করার ছিল না।
কোয়াকম্প বলল, কাটুস্কা নামের মেয়েটি পুরো বিষয়টাকে অনেক জটিল করে দিয়েছে। তাকে কিছুতেই মঞ্চে আসতে দেওয়া উচিত হয় নি। কিছুতেই জলমানবের কাছে পৌঁছাতে দেওয়া উচিত হয় নি।
নিরাপত্তাকর্মীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে বাধা উপেক্ষা করে মঞ্চে উঠে গেছে।
কোয়াকম্প শুষ্ক গলায় বলল, পুরো বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার এখন একটি মাত্র উপায়।
কী উপায়?
জলমানবকে দিয়ে কাটুস্কাকে খুন করানো
সমাজ দপ্তরের প্রধান চমকে উঠে বলল, কাটুস্কা প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওনের মেয়ে। রিওন তার মেয়েকে অসম্ভব ভালবাসে।
তাতে কিছু আসে যায় না। আমি ভালবাসা বুঝি না। আমি তোমাদের ভবিষ্যৎ বুঝি। আমার ওপর দায়িত্ব তোমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া
তা ছাড়া কী?
প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধানের মধ্যে আমি এক ধরনের দুর্বলতা লক্ষ করছি। এই দুর্বলতা থাকলে সে প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান হতে পারবে না। তাকে আরো শক্ত হতে হবে। সে এই ঘটনায় শক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে।
সমাজ দপ্তরের প্রধান চুপ করে রইল, হঠাৎ করে সে অসহায় বোধ করতে থাকে। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আমরা কেমন করে জলমানবকে দিয়ে কাটুঙ্কাকে খুন করার? জলমানব কাটুস্কাকে নিরাপত্তাকর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করছে। কাটুস্কার জন্য তার এক ধরনের মায়া রয়েছে।
তোমরা সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। জলমানবের বুদ্ধিবৃত্তি অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর। সঠিক কম্পনের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেজোনেন্স তৈরি করে দিতে পারলেই সে খুনি হয়ে যাবে। তখন সামনে যাকেই পাবে তাকেই খুন করবে।
ও। সমাজ দপ্তরের প্রধান মৃদুস্বরে বলল, ঠিক আছে। বুঝতে পারছি।
তুমি শুধু কাটুস্কা আর জলমানবকে একঘরে বন্ধ কর। ঘরটির যেন ধাতব দেয়াল হয়।
ঠিক আছে।
কোয়াকম্প বলল, আর শোনো।
কী?
তোমার সঙ্গে আমার এই কথোপকথনটি কারো জানার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু
এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই।
সমাজ দপ্তরের প্রধান একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। ঠিক কী কারণ জানা নেই। হঠাৎ করে সে নিজের ভেতরে ভয়ের একটা কাপুনি অনুভব করে।
.
ছোট একটা ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা গোলটেবিল এবং সেই টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার টেবিলে কিছু শুকনো খাবার এবং একটা পানীয়ের বোতল। একটি চেয়ারে কাটুস্কা বসে আছে। নিহন তার পাশে ঘরের মোটামুটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কাটুস্কা ঘরের চারদিকে একবার তাকিয়ে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না এখানে কী হচ্ছে?
নিহন জিজ্ঞেস করল, কেন, কী হয়েছে?
আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধানের মেয়ে। আমাকে এভাবে ছোট একটা ঘরে আটকে রাখার কথা না। আমাকে নেওয়ার জন্য এখন প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে বড় বড় মানুষের চলে আসার কথা।
নিহন কোনো কথা বলল না। কাটুস্কা বলল, আমি তোমাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য হেলিকপ্টার আনিয়েছিলাম, কিন্তু হেলিকপ্টার কেন তোমাকে ছেড়ে দেয় নি, কেন এখানে নিয়ে এসেছে–আমি সেটাও বুঝতে পারছি না।
নিহন এবারো কোনো কথা বলল না। কাটুস্কা পকেট থেকে তার যোগাযোগ মডিউলটা বের করে বলল, আর কী আশ্চর্য, দেখ আমার যোগাযোগ মডিউলটা দিয়ে আমি আমার বাবার সাথে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছি না।
নিহন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, আমি তোমাদের সমাজকে বুঝতে পারি। তোমাদের সমাজটা অন্য রকম।
কী রকম?
সে আমার ধারণা ছিল তোমরা হয়তো স্বার্থপরের মতো আমাদের সমুদ্রের পানিতে ঠেলে দিয়েছ, কিন্তু তোমরা হয়তো নিজেদের সর্বনাশ করবে না।
আমরা নিজেদের সর্বনাশ করছি?
হ্যাঁ।
এ কথা কেন বলছ?
তোমার বয়সী একটা মেয়ে কেন টিকিট কিনে হাঙর মাছ দিয়ে একটা মানুষকে খেয়ে ফেলার দৃশ্য দেখতে আসে? এটা কী রকম সমাজ? তোমরা কী রকম মানুষ?
কাটুস্কা কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। নিহন জিজ্ঞেস করল, কী হল? থেমে গেলে কেন? বল।
না, বলব না। বলে লাভ নেই। আমাদের যুক্তিগুলো তুমি বুঝবে না।
নিহন মাথা নাড়ল, আমি বুঝতে চাই না। আমাদের অনেক কষ্ট, কিন্তু তোমাদের এই জীবনের জন্য আমি কখনো আমার কষ্ট ছেড়ে আসব না।
কাটুস্কা স্থির দৃষ্টিতে নিহনের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন? এ কথা কেন বলছ?
তোমাদের ল্যাবরেটরিতে আমাকে হাজার হাজার যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করেছে। কত চমৎকার যন্ত্রপাতি, যেটা আমরা জীবনে দেখি নি, শুধু ছবি দেখেছি। কিন্তু অবাক ব্যাপার কী জান?
কী?
তোমাদের কোনো মানুষ সেই যন্ত্রপাতি কীভাবে কাজ করে সেটা জানে না। তোমাদের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে কোয়াকম্প, একটা কোয়ান্টাম কম্পিউটার! সে তোমাদের আদেশ দেয় তোমরা তার আদেশে ওঠ, তার আদেশে বস।
কাটুস্কা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঠোঁটের আঙুল দিয়ে বলল, শ-স-স-স।
নিহন অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
কোয়াকম্প নিয়ে এখানে কোনো কথা বোলা না।
নিহন অবাক হয়ে বলল, কেন?
মানুষের বুদ্ধিমত্তা মস্তিষ্কের ভেতরে যে রকম থাকতে পারে, বাইরেও থাকতে পারে। কোয়াকম্প সে রকম আমাদের সবার মস্তিষ্কের বাইরের বুদ্ধিমত্তা। আমাদের সবার অস্তিত্ব-
হঠাৎ করে ঘরের ভেতর একটা ভোঁতা শব্দ হল, তার সঙ্গে এক ধরনের সূকম্পন। নিহন অবাক হয়ে বলল, কিসের শব্দ?
কাটুস্কা ওপরের দিকে তাকাল, তারপর ফিসফিস করে বলল, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেজোনেন্স।
কী হয় এই রেজোনেন্স দিয়ে?
মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন দেওয়া হয়। অনুভূতির পরিবর্তন করা হয়।
নিহন অবাক হয়ে বলল, এখন কেউ আমাদের অনুভূতি পাল্টে দেবে?
কাটুস্কা ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, হ্যাঁ। মনে হয় আমাদের অনুভূতি পাল্টে দেবে।
নিহন হঠাৎ নিজের ভেতরে গভীর এক ধরনের বিষাদ অনুভব করে। তার মনে হতে থাকে এই জীবন অর্থহীন। বুকের ভেতর সে চাপা একটি হাহাকার অনুভব করে। ঘরের ভেতর তোতা শব্দটি হঠাৎ একটু তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। নিহন তার মস্তিষ্কের ভেতর এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করে, ভোঁতা যন্ত্রণায় মাথার ভেতর দপদপ করতে থাকে এবং যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতর বিচিত্র একটা ক্রোধ দানা বাঁধতে থাকে। নিহন ফিসফিস করে নিজেকে বলল, আমাকে ওরা রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার কিছুতেই রেগে ওঠা চলবে না। কিছুতেই না।
তারপরও সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। কাটুঙ্কার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ভেতর ভয়ঙ্কর একটি ক্রোধ বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ে। এই মেয়েটি আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। নিহন দাঁতে দাঁত ঘষে নিজেকে বলে, এই মেয়েটি আমাকে ধরিয়ে এনেছে। এই মেয়েটির জন্য আমাকে ভয়ঙ্কর দুটি হাঙর মাছের মুখে পড়তে হয়েছিল। আমার এই হতভাগিনী মেয়েটিকে খুন করে ফেলা উচিত। ধারালো চাকু দিয়ে ফালা ফালা করে ফেলা উচিত।
নিহন অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এক ধরনের অমানবিক ক্রোধ তার ভেতর পাক খেয়ে উঠতে থাকে। নিজের অজান্তেই সে তার পায়ে বেঁধে রাখা চাকুটা হাতে তুলে নেয়। ধারালো চাকুটা দিয়ে কাটুস্কাকে ফালা ফালা। করার এক ধরনের অমানবিক ইচ্ছা তাকে অস্থির করে তোলে।
তুমি কাটুস্কার চিৎকার শুনে নিহন তার চোখের দিকে তাকাল।
কাটুস্কা হাত তুলে নিহনের দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে বলে, তুমি এই সর্বনাশের শুরু করেছ। তোমার জন্য আজ আমার এই অবস্থা! তোমাকে আমি খুন করে ফেলব!
নিহন পরিষ্কারভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছিল না। ভয়ঙ্কর ক্রোধের ভেতর সে আবছাভাবে বুঝতে পারে ঠিক তার মতোই এই মেয়েটির মাথায় ভয়ঙ্কর ক্রোধ এসে তর করেছে। ঠিক তার মতোই এই ক্রোধ পুরোপুরি অযৌক্তিকভাবে তার সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে।
কাটুস্কা চিৎকার করে বলল, তুমি একটি হিংস্র জলমানব। তুমি কেন এসেছ আমাদের কাছে? কেন? যাও। তুমি যাও। তুমি চলে যাও এখান থেকে। তুমি জাহান্নামে যাও। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও।
নিহন অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, বিড়বিড় করে বলে, আমাকে একটু ধৈর্য দাও। একটু শক্তি দাও। এই হতভাগিনী মেয়েটাকে আমি নিশ্চয়ই খুন করে। ফেলব-কিন্তু তবুও আমাকে আর একটু সহ্য করতে দাও।
বাইরের তীক্ষ্ণ শব্দটির কম্পন হঠাৎ আরো বেড়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে কাটুস্কা হিংস্র মুখে নিহনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার নখ দিয়ে মুখ খামচে ধরে চিৎকার করে বলে, তোমার ওই নোংরা চোখ দুটো আমি খুবলে তুলে ফেলব। খামচি দিয়ে মুখের চামড়া তুলে ফেলব।
নিহন আর কিছু চিন্তা করতে পারছিল না। তার সমস্ত চেতনা অবলুপ্ত হয়ে সেখানে ভয়ঙ্কর অন্ধ এক ধরনের ক্রোধ এসে ভর করেছে। নিজের অজান্তে ধারালো চাকুটা হাতে নিয়ে সে খুব ধীরে ধীরে তার হাত ওপরে তুলেছে। ঠিক তখন কাটুস্কা আবার তাকে আঘাত করল। নিহন প্রস্তুত ছিল না, তাল সামলাতে না পেরে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। হাত দিয়ে নিজেকে কোনোভাবে সামলে নিয়ে নিহন আবার উঠে দাঁড়াতে গিয়ে থেমে গেল। তার। ভেতরকার অন্ধ ক্রোধটি নেই, তার বদলে সেখানে এক ধরনের বিস্ময়! নিহন কাটুঙ্কার দিকে তাকাল, কাটুস্কার সমস্ত মুখ ভয়ঙ্কর ক্রোধে বিকৃত হয়ে আছে। একটি চেয়ার তুলে এনে সে সেটা দিয়ে নিহনকে আঘাত করার চেষ্টা করল। নিহন কোনোভাবে হাত তুলে নিজেকে রক্ষা করে ঘরটার দিকে তাকাল, এটা একটা রেজোনেন্ট কেভিটি। ঘরের মেঝেতে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড নেই, ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ঘরের মাঝখানে সেটা সর্বোচ্চ। সে মেঝেতে শুয়ে আছে বলে তার মস্তিষ্কে কোনো স্টিমুলেশন নেই, তাই অন্ধ ক্রোধটিও নেই। কাটুস্কা দাঁড়িয়ে আছে, তীব্র ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তার মস্তিষ্ককে দলিত-মথিত করে ফেলছে, তাই তার ভেতরে ভয়ঙ্কর অন্ধ ক্রোধ। সেই অন্ধ ক্রোধকে দমাতে হলে কাটুস্কাকেও মেঝেতে শুইয়ে ফেলতে হবে।
নিহন গড়িয়ে কাটুস্কার কাছে এগিয়ে যায়, কিছু বোঝার আগে তার পা দুটি জাপটে ধরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয়-ছাড় আমাকে, ছাড়, ছেড়ে দাও বলে চিৎকার করতে করতে কাটুস্কা হঠাৎ থেমে যায়। সে শুনতে পায় নিহন তাকে মেঝেতে চেপে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলছে, শান্ত হও। শান্ত হও, কাটুস্কা।
কাটুস্কা বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কী হল? হঠাৎ করে আমার রাগটা কমে গেল কেন?
শুয়ে থাক, তা হলেই হবে।
কেন?
এই ঘরটা আসলে একটা রেজোনেন্ট কেভিটি। এর ভেতরে স্ট্যান্ডিং ওয়েভ তৈরি করা হয়েছে। প্রচণ্ড শক্তিশালী স্ট্যান্ডিং ওয়েভ। ঘরের মাঝখানে সবচেয়ে বেশি, মেঝেতে কমতে কমতে শূন্য হয়ে গেছে। তাই শুয়ে থাকলে তোমার মস্তিষ্কে সেই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ কোনো স্টিমুলেশন দিতে পারবে না।
কাটুস্কা অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে জান?
পড়েছি।
তোমাদের এসব পড়তে হয়?
হ্যাঁ। আমাদের কোয়াকম্পের মতো কোয়ান্টাম কম্পিউটার নেই, তাই অন্য কিছু আমাদের জন্য চিন্তা করে না। আমাদের নিজেদের চিন্তা নিজেদের করতে হয়!
কী আশ্চর্য!
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। তোমরা যেটা কর, সেটা হচ্ছে আশ্চর্য।
কাটুস্কা মেঝেতে মাথা লাগিয়ে শুয়ে থেকে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমি খুব দুঃখিত, নিহন। খুব দুঃখিত।
কেন?
খামচি দিয়ে তোমার চোখ দুটো খুবলে তোলার চেষ্টা করেছিলাম বলে।
নিহন হেসে ফেলল, এই প্রথম সে হেসেছে এবং তার মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁত দেখে কাটুস্কা অবাক হয়ে যায়, একটা মানুষ কেমন করে এত সুদর্শন হতে পারে সে ভেবে পায় না। কাটুস্কা নিচু গলায় বলল, এটা হাসির ব্যাপার না-তুমি হাসছ কেন?
আমি হাসছি কারণ আর একটু হলে আমি আমার চাকুটা দিয়ে তোমাকে ফালা ফালা করে দিতাম। তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে খুব বড় উপকার করেছ।
এখন আমরা কী করব? সারাক্ষণ কি এভাবে শুয়েই থাকব?
না, বের হব।
কাটুস্কা বলল, কীভাবে বের হবে? এই ঘরটা বাইরে থেকে তালা মারা।
এটা নম্বর তালা। ভেতর থেকে সঠিক নম্বরটি দেওয়া হলে তালাটি খুলে যাবে না?
হ্যাঁ। খুলে যাবে। কিন্তু নম্বরটি তো তুমি জান না। তা ছাড়া তুমি শুয়ে শুয়ে তালাটি খুলতে পারবে না। খোলার জন্য তোমাকে দাঁড়াতে হবে।
আমি দাঁড়াব।
কেমন করে দাঁড়াবে?
টেবিলের উপর যে টেবিল ক্লথটা আছে সেটার উপর অ্যালুমিনিয়ামের একটা আস্তরণ আছে। আমি এটা আমার মাথায় বেঁধে নেব। সেটা তখন ফ্যারাডে কেজের মতো কাজ করবে।
তার মানে কী?
তার মানে এই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকতে পারবে না।
সত্যি?
নিহন বলল, হ্যাঁ, এই দেখ।
নিহন টেবিলের উপর থেকে টেবিল ক্লথটা টেনে নামিয়ে এনে মাথায় বেঁধে নিয়ে সাবধানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। টেবিল ক্লথটায় এক ধরনের উষ্ণতা অনুভব করে কিন্তু তার বেশিকিছু নয়। নিহন দরজাটার কাছে এগিয়ে গেল।
বাইরে থেকে ঘরটি তালা মেরে রেখেছে। নিহন অনুমান ভর করে একটা সংখ্যা ঢোকাতেই তালাটা খুট করে খুলে গেল। কাটুস্কা অবাক হয়ে বলল, তুমি কেমন করে খুললে?
জানি না। আন্দাজে।
কীভাবে আন্দাজ করলে?
যেহেতু এগুলো সব তোমাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে তাই সংখ্যাটা নিশ্চয়ই সাধারণ সংখ্যা হবে না। নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো সংখ্যা হবে। তাই চার অঙ্কের বিশেষ একটা সংখ্যা দিয়ে চেষ্টা করেছি। প্রথম চেষ্টাতেই মিলে গেছে। তোমাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসলে খুব সাদাসিধে টাইপের।
কী আশ্চর্য!
আশ্চর্য হবার অনেক সময় পাবে। এখন চল বের হয়ে যাই।
চল।
দরজা খুলে দুজন বের হয়ে যায়। দূরে কোথাও অ্যালার্ম বাজতে থাকে। তার মধ্যে দুজন একজন আরেকজনের হাত ধরে ছুটতে থাকে।