১১. রিশান ছোট ঘরটিতে চুপচাপ

রিশান ছোট ঘরটিতে চুপচাপ বসে আছে। ঘরটি বাইরে থেকে বন্ধ, সম্ভবত একটা রবোটকে বাইরে পাহারা হিসেবেও রাখা আছে। তার এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, সে বের হতে চাইছেও না। বের হয়ে তার কিছু করার নেই। ষুন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করে প্রত্যেকটা কাজ করছে, কোথাও কোনো ফাঁকি নেই। সে এই ঘরে বসে যোগাযোগ চ্যানেলে কান পেতে নানা ধরনের সংবাদের আদান প্রদান থেকে সব খবরাখবর পেয়েছে। মহাকাশযানের মূল সরবরাহ থেকে আটত্রিশটা নিক্সিরল গ্যাসের ট্যাংক এই গ্রহটিতে পাঠানো হয়েছে। ট্যাংকগুলো গ্রহটির বিভিন্ন জায়গায় ভাসমান অবস্থায় আছে। নির্দিষ্ট সময়ে ট্যাংকগুলো ফেটে নিক্সিরল গ্যাস বের হয়ে গ্রহটিতে ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের জন্যে গ্যাসটি ক্ষতিকর নয়। এক ধরনের ঝাঁজালো গন্ধ রয়েছে এবং দীর্ঘ সময় নিশ্বাসের সাথে শরীরে প্রবেশ করে এক ধরনের সাময়িক অবসাদ ঘটাতে পারে, কিন্তু গ্রুনি জীবাণুর জন্যে এই গ্যাসটি ভয়ঙ্কর। গুনি জীবাণুটির বেশ অনেকগুলো শুড়ের মতো অংশ রয়েছে, এই গ্যাসটির স্পর্শে সেগুলো সাথে সাথে অকেজো হয়ে যায়, তার ত্বকের ভিতর দিয়ে গ্যাসটি ভিতরে প্রবেশ করে। জীবাণুটির মূল অংশটি তখন মিলি সেকেন্ডের মাঝে ফেটে যায়। ভিতর থেকে যে সমস্ত জৈব অণু বের হয়ে আসে সেগুলো তখন অন্য গ্রুনিকে আক্রমণ করে এবং কিছুক্ষণের মাঝে বিশাল গ্রুনির কলোনি ধ্বংস হয়ে যায়। অত্যন্ত কার্যকরী একটি পদ্ধতি, মানুষ দীর্ঘকাল গবেষণা করে এটি বের করেছে। গ্রহটি বেশি বড় নয়, তার বায়ুমণ্ডলে নির্দিষ্ট পরিমাণ নিক্সিরল গ্যাস সৃষ্টি করার জন্যে আটত্রিশটা ট্যাংকই যথেষ্ট। নিক্সিরল গ্যাস অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে সহজে অক্সিডাইজ হয়ে অকেজো হয়ে যায়। এই গ্রহে অক্সিজেন খুব কম, বলতে গেলে নেই। যেটুকু আছে সেটাই নিক্সিরলকে ধীরে ধীরে অক্সিডাইজ করে প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। ছয় ঘণ্টা অনেক সময় এর পর এই গ্রহটিতে গ্রুনির কোনো চিহ্ন থাকার কথা নয়।

পুরো ব্যাপারটি চিন্তা করে রিশান ভিতরে এক ধরনের অসহ্য ক্ষোভ অনুভব করে। পৃথিবীর বাইরে একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী অথচ তার একমাত্র যোগসূত্রটিকে কী সহজে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। মানুষের কাছে কি এর থেকে বেশি কিছু আশা করা যেত না?

রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে পুরো ব্যাপারটি ভুলে যাবার চেষ্টা করে। তার পক্ষে যেটুকু চেষ্টা করা সম্ভব সে করেছে। পৃথিবীতেও এর আগে নানা ধরনের অমানবিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, এই গ্রহে কেন নেয়া হবে না? সিদ্ধান্তটি তো হঠাৎ করে নেয়া হচ্ছে না, অনেক চিন্তাভাবনা করে নেয়া হয়েছে। এই গ্রহের প্রত্যেকটা তথ্যকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য দীর্ঘদিন থেকে পর্যালোচনা করা হয়েছে, তারপর সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের পাঠানো হয়েছে। বিশাল মহাকাশযানে আটত্রিশ ট্যাংক নিক্সিরল থাকা কি একটা দুর্ঘটনা? কিছুতেই নয়।

রিশান সবকিছু ভুলে যেতে চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা সহজ নয়। মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত বিচিত্র একটি জিনিস, সেটি কখন কীভাবে কাজ করবে সেটি বোঝা খুব মুশকিল। পুরো ব্যাপারটি মাথা থেকে সরিয়ে রাখার একটি মাত্র উপায়, অন্য কিছুতে মনোযোগ দেয়া। ষুন তাকে এই ছোট ঘরটিতে বন্দি করে রেখেছে সত্যি কিন্তু তার যোগাযোগ মডিউলটি অকেজো করে দেয় নি। সে ইচ্ছে করলে মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে খবরাখবর নিতে পারে, কোনো একটা কিছু নিয়ে পড়াশোনা করতে পারে। যে জীবাণুটি কিছুক্ষণ পর এই গ্রহ থেকে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে সে সেই গ্রুনি জীবাণু নিয়েই সময় কাটাবার সিদ্ধান্ত নিল।

গ্রুনি জীবাণুটি অত্যন্ত নিম্নস্তরের জীবাণু। এককোষী একটা প্রাণী, কোষের মাঝখানে একটি সাধারণ নিউক্লিয়াস এবং তার চারপাশ দিয়ে শুড়ের মতো কিছু একটা বের হয়ে আছে। এমনিতে দীর্ঘ সময় সেটি সম্পূর্ণ জড় পদার্থের মতো বেঁচে থাকে, নির্দিষ্ট তাপ এবং রাসায়নিক পরিস্থিতিতে সেটা ভাগ হয়ে নিজের সংখ্যা বাড়াতে শুরু করে।

রিশান দীর্ঘ সময় নিয়ে এই জীবাণুটির বংশ বিস্তার পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করল, পৃথিবীর জৈবিক প্রাণী থেকে পদ্ধতিটি ভিন্ন কিন্তু সেরকম বৈচিত্র্যময় কিছু নয়, কিছুক্ষণের মাঝেই সে সেটা নিয়ে সময় ব্যয় করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। রিশান একটা নিশ্বাস ফেলে যোগাযোগটি বন্ধ করার আগে নি জীবাণুর কিছু ছবি দেখে খানিকক্ষণ সময় কাটাবে বলে ঠিক করল। এককোষী প্রাণীর ছবি খুব বেশি চিত্তাকর্ষক হতে পারে না, সে মিনিট পাঁচেক এই জীবাণুটির নানা ভঙ্গিমায় কিছু ছবি দেখে পুরো ফাইলটুকু বন্ধ করার আগে হঠাৎ একটি ছবি দেখে থমকে গেল। দুটি গ্রুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে, তারা একে অন্যের শুড় স্পর্শ করে আছে। ছবিটি খুব সাধারণ একটা ছবি কিন্তু এর মাঝে কী একটা জিনিস তার খুব পরিচিত মনে হয় যেটা সে আগে কোথাও দেখেছে। সেটা কী হতে পারে?

রিশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না। রিশান সাবধানে আরো কয়েকটি ছবি দেখে, একসাথে বেশ কয়েকটি গ্রুনি জীবাণু একে অন্যের শুড় স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছবিটি তার আরো বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে, কোথায় সে দেখেছে এই ছবি?

রিশান ছবিগুলোর নিচে লেখা তথ্যগুলো পড়তে থাকে। মাঝে মাঝে গ্রুনি জীবাণু একে অন্যের গঁড় স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন এই শুড়ের মাঝে দিয়ে এক ধরনের সঙ্কেত আদান প্রদান হয় বলে মনে করা হয়–

হঠাৎ রিশান বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, নিউরন সেল! এই গুনি জীবাণু দেখতে হুবহু মানুষের মস্তিষ্কের নিউরন সেলের মতো! লম্বা শুড়গুলো হচ্ছে নিউরন সেলের এক্সন আর ডেন্ড্রাইটস। মানুষের মস্তিষ্কে অসংখ্য নিউরন সেলের ডেণ্ড্রাইটস একটি অন্য একটির সাথে সিনাপস দিয়ে জুড়ে থাকে, সেখান থেকে আসে মানুষের বুদ্ধিমত্তা–মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতা, চিন্তা করার অনুভূতি! একটি নিউরন সেল পুরোপুরি অর্থহীন কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কে যখন এক শ বিলিয়ন নিউরন সেল পাশাপাশি সজ্জিত হয়ে থাকে, ডেন্ড্রাইটস দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় তখন সেটা হয়ে যায় এক বিস্ময়কর রহস্য! এই গ্রুনি জীবাণুও নিশ্চয়ই সেরকম। একটি বা অসংখ্য জীবাণু আলাদাভাবে পুরোপুরি বুদ্ধিহীন নিম্ন–শ্রেণীর একটা প্রাণী, কিন্তু যখন এগুলো কোথাও মানুষের মস্তিষ্কের মতো সাজানো হয়ে যায় সেটা হয়ে যায় ঠিক মানুষের মতো বুদ্ধিমান একটা প্রাণী।

রিশান লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, নিশ্চয়ই তাই হচ্ছে এখানে। তাই মানুষ কখনো বুদ্ধিমান। প্রাণীগুলোকে খুঁজে পায় নি, যখনই জোর চেষ্টা করেছে শুধু গ্রুনিকে পেয়েছে। গ্রুনিই হচ্ছে বুদ্ধিমান প্রাণী। গ্রুনিকে ধ্বংস করে দেয়ার অর্থ হচ্ছে এই বুদ্ধিমান প্রাণীকে ধ্বংস করে দেয়া। শুধু তাই নয়, হঠাৎ করে রিশানের আরেকটা জিনিস মনে হল, গ্রুনি যখন কোনো মানুষকে আক্রমণ করে সেটা সোজাসুজি মানুষের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে–একটা করে গ্রুনি জীবাণু একটা করে নিউরনকে ধ্বংস করে। সেই নিগুলো তখন গিয়ে সেই মস্তিষ্ককে অনুকরণ করে কিছু একটা তৈরি করে। সেটা হয়তো সেই মানুষের মস্তিষ্কের মতো হয়, হয়তো সেই মানুষের বুদ্ধিমত্তা জন্ম নেয়, সেই মানুষের স্মৃতি।

রিশান উত্তেজিত হয়ে মাথা নাড়ল, নিশ্চয়ই তাই হয়–তাই সানির মা মারা যাবার পরও সানির জন্যে তার ভালবাসা এখনো গ্রুনিদের মাঝে বেঁচে আছে। তাই ঘুরেফিরে তার প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, তাই অন্য সবাই মারা গেলেও নিরা সানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। স্কাউটশিপ অকেজো করার কৌশলগুলো তাই মানুষের আশ্চর্য বুদ্ধিপ্রসূত! সানি নিশ্চয়ই এসব জানে। তাই লি–রয়কে দিয়ে অন্যদের কাছে খবর পাঠিয়েছিল! রিশান তাড়াতাড়ি তার কমিউনিকেশান মডিউল স্পর্শ করে ষুনের সাথে যোগাযোগ করল ষুন ব্যস্তভাবে করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিল, রিশানের আহ্বানে খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি কিছু বলবে?

হ্যাঁ, ষুন। আমার মনে হয় আমি এখানকার বুদ্ধিমান প্রাণীদের রহস্য ভেদ করেছি।

তুমি রহস্য ভেদ করেছ?

হ্যাঁ।

আমি জানি কেন এখানে বুদ্ধিমান প্রাণী আছে আর কেন আমরা সেই প্রাণীদের খুঁজে পাই না। আমি এখন জানি কেন গ্রুনিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

ষুন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, রিশান, আমি জানি তুমি অসম্ভব বুদ্ধিমান, আমি জানি তুমি সত্যিই রহস্য ভেদ করেছ। কিন্তু ধরে নাও তার জন্যে দেরি হয়ে গেছে।

দেরি হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, আমি আমার পরিকল্পনার কোনো পরিবর্তন করব না। এর মাঝে নিক্সিরল গ্যাস এই গ্রহে পৌঁছে গেছে, গ্যাসের ট্যাংকগুলোর তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বাড়ানো হচ্ছে, আর ঘণ্টাখানেকের মাঝে সেগুলো এই গ্রহে ছড়িয়ে দেয়া হবে। আমি আমার পরিকল্পনামতো এগিয়ে যাব।

কিন্তু ষুন–

আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। ষুন মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে শারীরিকভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আমি এখন তোমাকে মানসিকভাবে বন্দি করব। তুমি এখন আর। কারো সাথে কথা বলতে পারবে না।

ষুন তার হাতে কী একটা সুইচ স্পর্শ করতেই রিশানের চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করে এক ধরনের ভয়ঙ্কর নীরবতা নেমে এল রিশানকে ঘিরে। রিশান মাথা ঘুরে তাকাল এবং যেন প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করল সে একটা ছোট ঘরে বন্দি হয়ে আছে। বাইরে বের হওয়া দূরে থাকুক, সে কারো সাথে মুখের কথা পর্যন্ত বলতে পারবে না।

অসহ্য ক্রোধে হঠাৎ তার সবকিছু ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।