যজ্ঞানুষ্ঠানের নবতর ব্যাখ্যা (উপনিষদ)
এই ধারণা করা সম্পূর্ণ ভুল হবে যে, এই স্তরে যজ্ঞ অপ্রচলিত হয়ে পড়েছিল,- তা একেবারেই হয় নি। পূর্ববর্তী যুগে যেমন হচ্ছিল, এখনো প্ৰায় সমপরিমাণ এবং প্রায় তেমনই সাড়ম্বরে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল; শুধু যজ্ঞ সম্পর্কে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। অগ্নিচয়নেব মতো কিছু কিছু যজ্ঞানুষ্ঠান এই পর্যায়ে পরোক্ষভাবে প্রশংশিত হচ্ছিল, কিন্তু স্পষ্টতই তাতে নূতন কালোপযোগী ও নূতন প্রয়োজনের আলোকে যজ্ঞানুষ্ঠানগুলি পুনর্বিশ্লেষণ করার প্রয়াস প্রতিফলিত হয়েছে। যজ্ঞসম্পর্কে উপনিষদের ঋষিদের দোলাচলবৃত্তি মুণ্ডক উপনিষদে (১ : ২) অভিব্যক্তি হয়েছে। এখানে বলা প্রয়োজন, অস্তিত্বের পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ পুনর্জন্ম সম্পর্কে প্রাচীনতম উল্লেখে তাকে ‘বারংবার জীবনধারণ’ না-বলে ‘অসংখ্যবার মৃত্যু’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে; কারণ, মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রণা উদ্বেগের অভিজ্ঞতাই মানুষকে জীবনের গভীর তাৎপর্য অনুশীলনে অনুপ্ৰাণিত করেছে—আর, মানুষ তাকেই চূড়ান্ত সত্যরূপে গ্ৰহণ করেছ।
আমরা লক্ষ্য করি যে, অধিকাংশ উপনিষদ সংহিতা থেকে বিশেষ কোনো উদ্ধৃতি দেয় নি। এতে প্রাচীন ধমীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে আসন্ন বিচ্ছেদ সুচিত হয়েছে; কেননা, গবেষকরা ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্নতা প্রমাণিত করার জন্য চেষ্টা করলেও বৈদিক ধর্মের দুটি প্রধান প্রবণতাকে কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড রূপে চিহ্নিত করার মধ্যে এই বিচ্ছেদ অভিব্যক্ত হয়েছে–এই তথ্যই স্বীকৃত হয়েছে যে নব্য ধর্মচিন্তা ধীরে-ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে প্রাধান্য অর্জন করছে। এই যুগের ধর্ম হ’ল দেবকাহিনী, যজ্ঞানুষ্ঠান, অধ্যাত্মবিদ্যা, ঐন্দ্ৰজালিক ক্রিয়া, লোকায়ত কুসংস্কার, ধর্মানুষ্ঠানে সচেতনভাবে আরোপিত রহস্য, ভাবী শুভাশুভ গণনার তত্ত্ব, ভবিষ্যদবাণী, ঝাড়ফুক, সর্বপ্ৰাণবাদী বিশ্বাস, জাদুপুরোহিতের কার্যকলাপ ও প্রেততত্ত্ব সম্পর্কে জল্পনা ইত্যাদি। কিছু নতুন মাত্ৰাও যুক্ত হয়েছে : কর্মবাদ, জন্মাস্তরবাদ; জীবন মূলতই অমঙ্গলজনক এমন ধারণা, পুনর্জন্ম থেকে মুক্তিলাভের প্রত্যাশায় পরমাত্মা ও ব্রহ্মের স্বরাপ-বিষয়ক জ্ঞান অর্জন ইত্যাদি। ভিন্ন মাপের সৎকর্মের দ্বারা আনন্দময় লোেকর বিভিন্ন স্তর জয় করার বিশ্বাসও ব্যক্ত হয়েছে। সপ্তলোক এভাবে বর্ণিত হয়েছে : নর, পিতৃ, গন্ধৰ্ব, কর্ম, অজন, প্রজাপতি ও ব্ৰহ্মা (বৃহদারণ্যক ৪ : ৩ : ৩৩)। পৃথিবীর সঙ্গে অন্যান্য উন্নততর লোকের দূরত্বের উপলব্ধি অনুযায়ী ব্ৰহ্মাণ্ড-সৃষ্টি বিষয়ে নূতন ভাবাদর্শগুলিও এ-সময় দেখা দিতে থাকে।
যদিও প্রত্নকথা ও যজ্ঞানুষ্ঠান—এই উভয়ের মৌলিক চরিত্র এ-সময় যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছিল তবু নব্য চিন্তাধারার উদ্ভবের যুগে যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রাসঙ্গিকতা কতকটা অস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় যজ্ঞের পুনর্ব্যাখ্যা প্রয়োজনীয় হযে পড়ে। আমরা দেখেছি যে আরণ্যকে নূতন ভাবগত আন্দোলনের সূত্রপাত হয়; যজ্ঞের যথার্থ তাৎপৰ্য অনুধাবন করতে পারলে তা যে কোনো নূতন সমস্যার সমাধান করতে সমৰ্থ-এটা প্রমাণের জন্য আপ্ৰাণ প্রচেষ্টা সেই আন্দোলনে প্রতিফলিত হয়েছিল। এস্তরে বলা হচ্ছে নিহিতার্থ অনুধাবনের জন্য আক্ষরিকভাবে যজ্ঞকে গ্ৰহণ না ক’রে গভীরতর অতীন্দ্ৰিয়, প্ৰতীকী ও অতিজাগতিক তাৎপর্যের মধ্যে অবগাহন আবশ্যক; সেইসঙ্গে বস্তুজগতের সামগ্ৰী দিয়ে অনুষ্ঠিত নিছক পার্থিব ক্রিয়া হিসাবে যজ্ঞকে গ্ৰহণ না করে, আধ্যাত্মিক ও আত্মিক উপকরণ দিয়ে প্রতীকীভাবে অনুষ্ঠিত অতিজাগতিক কর্ম হিসাবে গ্ৰহণ করা প্রয়োজন–এ-ধরনের ভাবনা অভিব্যক্তি লাভ করে। তাই, তিনটি যজ্ঞাগ্নি দেহের ত্ৰিবিধ প্রানবায়ুর সঙ্গে উপমিত হয়েছে (প্রশ্ন ৪ : ৩, ৪); চতুর্বিধ আনুষ্ঠানিক ব্যাহৃতি আহ্বানকে অগ্নি, বায়ু, সূর্য ও চন্দ্রের সঙ্গে, তিন বেদকে ত্ৰিবিধ প্ৰাণবায়ুর সঙ্গে এবং ব্ৰহ্মাকে অন্নের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয়েছে (তৈত্তিরীয়, ১ : ৫ : ১)। তেমনি ছান্দোগ্য উপনিষদে বাক ও প্ৰাণ যথাক্ৰমে ঋক ও সামের সঙ্গে উপমিত হয়েছে (১ : ১ : ৫)। এ-ধরনের বহু দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে |
অথর্ববেদের পুরোহিত ব্ৰহ্মা, যিনি বিলম্বে রক্ষণশীল যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবেশাধিকার লাভ করেছিলেন—এই পর্যায়ে তাঁর ভূমিকা অতীন্দ্ৰিয়ভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কে নতুন আগ্রহের ফলে আনুষ্ঠানিক উপকরণগুলি বারবার বিভিন্ন অতিজাগতিক উপাদানের সঙ্গে উপমিত হয়েছে। তাই, ইহলোক অগ্নি এবং সূর্য তার ইন্ধন, রশ্মি ধূম, দিন শিখা, চন্দ্ৰ অঙ্গার ও নক্ষত্ৰ স্ফূলিঙ্গ রূপে বৰ্ণিত (ছান্দোগ্য, ৫ : ৪ : ১)। বৃহদারণ্যক উপনিষদে অশ্বমেধ যজ্ঞে বলিপ্রদত্ত অশ্বের বিভিন্ন অঙ্গকে অতিজাগতিক উপাদানের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয়েছে (১ : ১ : ১, ২)। এভাবে উপনিষদের যুগে প্রচলিত নিগুঢ় রহস্যবাদী প্রবণতার ফলে অণুবিশ্ব ও ব্ৰহ্মাণ্ডের মধ্যে যে বহুবিধ পরস্পর-সম্পূক্ত বস্তু-শৃঙ্খলা নির্মিত হয়-মুখ্যত তাদের প্রভাবে অসম্বন্ধ ও বিশৃঙ্খল চিন্তাধারায় দ্রুত প্রসারণ, লক্ষ্যহীন ছদ্ম-আধ্যাত্মিক আলোকদৃষ্টির উৎপত্তি এবং অনিযান্ত্রিত দিব্যদৃষ্টির আবাহন ঘটে। এর সাহিত্যিক প্রকাশ প্রায়ই অসন্তোষজনক এবং আমরা প্রকৃত দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির জন্য অস্পষ্ট ও অনিশ্চিত অনুসন্ধান রূপেই এ-সব গ্রহণ করতে পারি। অন্বেষণের ঐকান্তিকতা ও আন্তরিকতার মধ্যে এগুলির সর্বাধিক মূল্য নিহিত; এরূপ নিবিড় আন্তরিকতার মুহুর্তে কখনো কখনো চমৎকার কাব্যিক অভিব্যক্তি দেখা গেছে। যজ্ঞানুষ্ঠানের পুনর্বিশ্লেষণের এই স্তরে পরবর্তী দিক-পরিবর্তনের পূর্বাভাস সূচিত, যখন অধ্যাত্মবিদ্যা অবশিষ্ট প্রত্নকথার আবেষ্টনী থেকে মুক্ত হয়ে যথার্থভাবে প্রত্নদার্শনিক পৰ্যায়ে উন্নীত হয়।
এভাবে উপনিষদের যুগে জ্ঞান নতুন গীেরব অর্জন করে; গুঢ় শক্তিমত্তা ও ফলোৎপাদক ক্ষমতার দিক দিয়ে ক্রমশ তা যজ্ঞানুষ্ঠানের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এই পর্যায়ে জ্ঞান শুধু আধ্যাত্মিক ছিল না, আরো বহুবিধ জ্ঞানের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। ছান্দোগ্য উপনিষদের একটি পাঠ্যসূচীতে (৭ : ১ : ২) তার প্রমাণ রয়েছে : চার বেদ, ইতিহাস, উপাখ্যান, পুরাণ, পিতৃপুরুষের কাহিনী, গণিত শাস্ত্ৰ, শুভাশুভ গণনার বিদ্যা, অর্থনীতি, তৰ্কশাস্ত্ৰ, নীতিশাস্ত্ৰ, বেদান্ত, নিরুক্ত, ব্রহ্মবিদ্যা, জীববিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও সাপবিদ্যা। লক্ষণীয় যে, প্রাগুক্ত উপনিষদের অন্যত্র (৫ : ১ : ১-৫) জ্ঞানকে জয় বা প্ৰাপ্তির সঙ্গে একাত্ম করা হয়েছে। বৃহদারণ্যকে জ্ঞানকে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদরূপে মহিমান্বিত করা হয়েছে (১ : ৪ : ১০) শ্বেতাশ্বতরে বলা হয়েছে যে প্রাচীন জ্ঞান দেবশ্রেষ্ঠ শিব থেকে উৎসারিত হয়েছিল (৪ : ১৮)। বস্তুত এ-যুগে অভিব্যক্ত ‘জ্ঞান’-এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি যে, জ্ঞান কেবল যজ্ঞের বিকল্প নয়। অর্থাৎ তা শুধু নির্দিষ্ট কিছু প্ৰাপ্তির অঙ্গীকারই দেয় না, আরো কিছুর সন্ধান দেয়। সংহিতার যুগে জীবনের সারাৎসা এবং লক্ষ্য ছিল দীর্ঘ ও কল্যাণময় জীবনলাভ; কিন্তু উপনিষদের যুগে এই জীবন ও তার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ অমঙ্গলজনক ও অবাঞ্ছনীয় বলে মনে করা হয়েছে। পুনর্জন্ম-সম্ভাবনা অতিক্রমের লক্ষ্য যখন গুরুত্ব লাভ করল, যজ্ঞ তখন তার উপযোগিতা সম্পূর্ণ হারাল এবং জ্ঞান-ই হয়ে উঠলো একমাত্র যুক্তিসিদ্ধ উপায়। কিন্তু জ্ঞানের লক্ষ্য আবার পরিবর্তিত হয়; বস্তুনিষ্ঠ জগতের জ্ঞান পর্যাপ্ত নয়; শুধু আত্মার প্রকৃত পরিচয় সন্ধান করে এবং জীবাত্মা যে পরমাত্মা থেকে ভিন্ন নয়এই উপলব্ধিতে উত্তীর্ণ হয়ে পুনর্জন্মের অভিশাপ অতিক্রম করা সম্ভব।