১১. মানুষের চরিত্র সত্যিই আশ্চর্য

সুদৰ্শন বাসাতে বসে পরের দিন সন্ধ্যায় সি. আই. টি. র ফ্ল্যাটের হত্যা-ব্যাপারটা নিয়েই কিরীটী আলোচনা করছিল। সামনে পাশাপাশি একটা সোফায় বসে সাবিত্রী ও সুদৰ্শন।

একসময় সুদৰ্শন বললে, প্রথম থেকেই কি আপনার মণিশঙ্করের ওপরে সন্দেহ পড়েছিল দাদা?

কিরীটী বললে, বলতে পার তোমার মুখে সব কথা শোনবার পরই মণিশঙ্করের ওপর আমার সন্দেহ জাগে মনে–

কেন?

প্রথমতঃ মণিশঙ্করের অতগুলো চাবিসমেত চাবির রিংটাই রীতিমত একটা খট্‌কা জাগায় আমার মনে, যেটা তার পকেট থেকে বের হয় ও সে বলে সেটা একটা ড়ুপলিকেট চাবির রিং। ঐ চাবির রিংয়ের মধ্যেই ছিল দুটো চাবি অর্থাৎ একটা আলমারির ও অন্যটা সদর দরজার। মনে করে দেখ–

হ্যাঁ, মনে পড়ছে–

মণিশঙ্কর বলেছিল, চাবি তার স্ত্রীর কাছেই থাকত। কথাটা হয়তো মিথ্যা নয়—সেটাই স্বাভাবিক। এবং ড়ুপলিকেট চাবি থাকলেও একমাত্র সদর দরজার চাবিই থাকত, তাই বলে রিংয়ের মধ্যে অন্যান্য চাবিও থাকবে কেন, বিশেষ করে ঘরের আলমারির চাবি-কাজেই ঐ চাবির রিং মণিশঙ্করের সঙ্গে করে অফিসে নিয়ে যাবার কোন যুক্তিও নেই। সেদিন অর্থাৎ দুর্ঘটনার দিন দ্বিপ্রহরে মণিশঙ্কর আসে তার ফ্ল্যাটে তার পূর্ব-পরিকল্পনা মত—বিজিতা দেবীর মনে তার ঐভাবে হঠাৎ আসার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নিশ্চয় জাগেনি এবং সে কল্পনাও করতে পারেনি যে তার স্বামী তাকে হত্যা করবার জন্যেই এসেছে, বিশেষ করে ঐ সময়, নিষ্ঠুর একটা সংকল্প নিয়ে। মণিশঙ্কর অতর্কিতে বিজিতাকে আঘাত করে হত্যা করে হয়তো পিছন থেকে—তারপর শিশুটি পাছে সব কথা প্রকাশ করে দেয়। সেই ভয়ে তাকেও হত্যা করে। হত্যার পর সে বেশ বদলিয়ে রক্তাক্ত জামা-কাপড় সুটকেসটায় নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে যায়। সে স্বামীনাথনের গাড়িটা আগেই গ্যারেজ থেকে delivery নিয়েছিল— সব দোষটা তার ঘাড়ে চাপানোর জন্য—এবং তা না হলে সমীরণের ঘাড়ে চাপানোর জন্য সে সুটকেসটা তার ফ্ল্যাটে রেখে এসেছিল; কিন্তু একটা মারাত্মক ভুল সে করল যেটা আমার তাকে দ্বিতীয় সন্দেহের কারণ—

ভুল!

হ্যাঁ, চাবির রিংটা সঙ্গে নিয়ে গিয়ে! চাবির রিংটা যদি সে সঙ্গে না নিয়ে যেত, হয়তো ব্যাপারটা এত শীঘ্ৰ আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠত না। এবং ব্যাপারটা যে কোনরকম বার্গালারি নয় যখনই বুঝতে পারলাম তোমার কথায়, তখুনি বুঝেছিলাম এটা স্পষ্ট একটা নিষ্ঠুর হত্যার ব্যাপার। তোমারও সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল, অবিশ্যি—

সন্দেহ যে একেবারে হয়নি তা নয়, হয়েছিল-কিন্তু—

তুমি ভাবতে পারনি যে স্বামী হয়ে নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করতে পারে কেউ, তাই না!

তাই, দাদা।

কিন্তু সন্দেহের মত বিষ আর নেই ভাই, বিশেষ করে স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের ব্যাপারে এ দুনিয়ায়। মনের মধ্যে একবার সন্দেহ জাগলে কোন একজনের, তার বিষ সমস্ত মনকে বিষাক্ত করে তোলে-তাই যখন মণিশঙ্কর হত্যা করেছিল তার নিজের স্ত্রী ও কন্যাকে তখন তার সমস্ত শুভবুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা লোপ পেয়েছিল। যার ফলে তার মধ্যে momentary insanity dovelop করেছিল—তারপরই সে ঐ নিষ্ঠুর কাজে লিপ্ত হয়।

কি জান ভাই, মানুষের শুভবুদ্ধি যখন তাকে ত্যাগ করে তখন সে কোনটা ন্যায়— কোনটা অন্যায় সে-বিবেচনাটুকুও হারিয়ে ফেলে। আর তার ফলে যে মানুষ তখন কোন স্তরে গিয়ে দাঁড়ায় আজকের দিনে তারও প্রমাণের অভাব নেই তোমার চারপাশে। কিন্তু আর ঐ প্রসঙ্গ নয়, মণিশঙ্কর তার পাপের মাসূল নিজেই হাত পেতে নিয়েছে সেই একজনের অলঙঘ্য বিচারে ও নির্দেশে—

সাবিত্রী এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, দু চোখে তার জল, স্নান কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য!

কিরীটী মৃদু হেসে বলল, মানুষের চরিত্র সত্যিই আশ্চর্য সাবিত্রী! আরো যত বয়স হবে দেখবে—আরো জানবে—আরো

দাদা! সাবিত্রী ডাকে।

বল? কিরীটী জবাব দেয়।

চা আনি?

নিশ্চয়ই। অবিলম্বে।-গলাটা শুকিয়ে গিয়েছে।

সাবিত্রী উঠে গেল।