ব্রাত্য সূক্ত
তাণ্ড্য মহাব্ৰাহ্মণে ব্রাত্যদের সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে–ব্রাত্য কালো পোশাক (কখনও কখনও সাদা পশমের পোশাক) ও পাগড়ি (বা শিরস্ত্ৰাণ) পরে, অমসৃন রথে আরোহন করে এবং যজ্ঞের জন্যে পৃথকভাবে সংরক্ষিত আৰ্যদের খাদ্য অপহরণ করে। সুললিত বাগভলী করে ‘ব্রাত্য’ তার এই অপকার্যের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। যজ্ঞের জন্যে উপযুক্তভাবে দীক্ষিত না হয়েও ‘ব্রাত্য’রা আর্যভাষায় কথা বলে, তবে বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রতি সামান্যতম মনোযোগও তাদের নেই। ‘ব্রাত্য’ শব্দটি সাধারণত ‘ব্ৰত’ শব্দ থেকে নিম্পন্ন এবং এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ ধরা হয় ‘ব্রত’ থেকে পতিত অৰ্থাৎ বৈদিক ধর্মের পরিধি-বহির্ভূত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, ব্রাত্য শব্দ থেকেই পরবর্তীকালে প্ৰাণ্ডাক্ত অর্থটি নিষ্কাশন করা হয়েছিল। শব্দটির মূল তাৎপর্য হ’ল ‘বিধিবিরোধী গোষ্ঠী’। অন্য একটি ব্যুৎপত্তি অনুসারে এটি ‘ব্রাত’ (অর্থাৎ ‘দল’) শব্দ থেকে নিম্পন্ন হতে পারে; এই ব্যুৎপত্তিটিকেই অধিকতর যুক্তিসংগত বলে মনে হয়, যেহেতু ব্রাত্যরা আর্যদের কাছে শৃঙ্খলাবিহীন উম্মাৰ্গগামী বা উচ্ছঙ্খল একটি দল’ রূপেই প্ৰতিভাত হত। তাণ্ড্য-মহাব্ৰাহ্মণ অনুযায়ী এরা আর্যভাষী ছিল, তাই অনুমান করা যায় যে, ব্রাত্যরা সম্ভবত ইন্দো-ইউরোপীয় জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সেই প্রাচীনতর অবৈদিক জনগোষ্ঠী, যারা কয়েক শতাব্দী পূর্বে ভারতবর্ষে প্ৰবেশ করে আদিম অধিবাসীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে প্ৰাচীনতর। ‘যোগ” জাতীয় ধর্মচর্য অবলম্বন করেছিল, যারা বৈদিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করত না। পরে যখন এবং একই ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত বৈদিক আৰ্যদের সংস্পর্শে এল তখন তারা সহজেই আৰ্যসমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে সম্মত হ’ল। ততদিনে তারা একটি শিবকেন্দ্ৰিক ধর্মচৰ্যার অভ্যন্ত হয়ে গিয়েছে। এই ভয়ংকর দেবতা যেহেতু নিজেই যোগী ব’লে পরিচিত, তাই সহজেই তিনি ভ্ৰমণশীল সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের একান্ত দেবতায় পরিণত হলেন। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এই শিবের হয়তো ভিন্ন ভিন্ন নামও ছিল, ও তৎসংক্রান্ত ভিন্ন ভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানও প্রচলিত ছিল; ব্রাত্য-সূক্তগুলির সংকলনে এই দেবতার সমস্ত আঞ্চলিক নাম ও চর্য বৈশিষ্ট্যর অগভীর ও পরীক্ষামূলক আপাত সমন্বয়ে একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। শিবের বিভিন্ন নামের মধ্যে ভব’, ‘শর্ব’, ‘ম্বড়’, ‘ঈশান’, ‘পশুপতি’, ‘উগ্রদেব’ ও ‘মহাদেব’ নামগুলি ব্রাত্যসূক্তে প্রাধান্য পেয়েছে; পরবর্তী সাহিত্যে শিবের জনপ্রিয় বিশেষণ হলো নীললোহিত, এ নাম ব্রাত্যদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে, ব্রাত্যরা জীবিকার জন্যে তখনো কৃষিজীবী হয়ে ওঠেনি, বরং বহু সাহিত্য নিদর্শন থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তখনো তারা কতকটা যাযাবর জীবনযাপন করত। অবশ্য, সমাজে তাদের জন্য সম্মানিত আসন নির্দিষ্ট ছিল; ভিক্ষাজীবী ব্রাত্যদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রাজা বা গৃহস্থ নিজেদের কল্যাণ ও সমৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করতেন, এমন আভাসও ব্রাত্যসূক্তে আছে। ব্রাত্যের আধ্যাত্মিক ও নিগূঢ় রহস্যাবৃত পরিচয় সম্পর্কে আর্যরা যে সচেতন ছিলেন, তার প্ৰমাণ রয়ে গেছে সামাজিক, ধর্মীয় ও দার্শনিক জীবনে তার ওপরে গুরুত্ব আরোপের চেষ্টার মধ্যে। আমাদের কাছে যে জ্ঞানী ‘যতি’র ভাবমূর্তি পরিস্ফুট হয়, সেই ব্যক্তির সঙ্গে কোনো উৎপাদক শ্রমের সম্পর্ক নেই বলে জীবনধারণের জন্যে তাকে ভিক্ষা করতে হয়; পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে পরিলক্ষিত বিবিধ ভ্ৰমমাণ ‘যোগী’ সম্প্রদায়ের আদিমূর্তি আমরা যেন ব্রাত্যের মধ্যে খুঁজে পাই। পরিধান, ভাষা, জ্ঞান, তত্ত্ববিদ্যা এবং যোগীর অনুরূপ জীবনযাপনের জন্যেই তারা সমাজে সম্মানিত। বৈদিক আৰ্যদের এদেশে আগমনের পরেই তাদের পূর্বাগত আত্মীয়গণ মূল ধারার সঙ্গে মিশে যাবার কথা ভেবেছিলেন। পূর্বাগত জনগোষ্ঠীগুলি যদিও বা বৈদিক ধর্মমতের অনুসরণ করতেন, তবু ভারতবর্ষে তারা আক্রমণকারীরূপে প্ৰবেশ না করে নিছক আগন্তুক রূপেই এসেছিলেন। সম্ভবত, অমোঘ লৌহনির্মিত অস্ত্ৰ নিয়ে আসেননি বলেই তাদের এদেশের আদিম অধিবাসীদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি; বৈদিক আৰ্যদের তুলনায় সংখ্যায় অপেক্ষাকৃত হীন ছিলেন বলে, তারা সিন্ধু উপত্যকার জনসাধারণের নিকট কোনো প্রকৃত আশঙ্কার কারণরূপে প্ৰতিভাত হ’ন নি। এদেশে প্রবেশ করে তারা উত্তর ভারতের কৃষিজীবী অধিবাসীদের মধ্যে যাযাবর ভিক্ষাজীবী জনগোষ্ঠীরূপে বসবাস করে জ্ঞান ও৭ তত্ত্ববিদ্যার জন্যে যথেষ্ট সম্রাম অর্জন করেছিলেন। প্ৰাচ্য ও নিষাদ সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীপতিদের সমাজে গ্রহণ করার জন্যে যে সমস্ত অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল, তাদের সাহায্যে আর্য রাজারা সমাজের নিম্নবর্গীয় জনসাধারণের বিরুদ্ধে শাসনোপযোগী সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সেই আচার অনুষ্ঠান যেসব ব্ৰাহ্মণ পুরোহিত ও ক্ষত্রিয় রাজাদের পক্ষে লাভজনক ছিল, তারা বৈশ্য শূদ্ৰদের বিরুদ্ধে যেন সামাজিক প্রতিরোধের দুর্গ গঠন করেছিলেন। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, অথর্ববেদে রাজপুরোহিতদের প্রাধান্য একটা নতুন রাজনৈতিক দিক পরিবর্তন অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যসমূহের গঠনের প্রতি তৰ্জনীসংকেতু করছে।