১১. বিজ্ঞানী লিংলির শহরে এসে

তৃতীয়পর্ব

১১.

বিজ্ঞানী লিংলির শহরে এসে অনেক দিন পর আমি আর টিশা আবার স্বাধীন মানুষ হয়ে থাকার আনন্দটা উপভোগ করতে লাগলাম। গলা থেকে শিকল ঝুলছে না, কেউ সেই শিকল ধরে রাখছে না, কিছু একটা উনিশ-বিশ হতেই কেউ কুৎসিত একটা গালি দিয়ে পেছন থেকে একটা দড়ি দিয়ে মারছে না। তার চাইতে বড় কথা দস্যুদলের মাঝে যে সারাক্ষণ একটা অপমান সহ্য করতে হয়েছে সেই অপমানটুকু নেই, অন্য সবার মতো মানুষের একটা সম্মান নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারছি, বিষয়টি বিশ্বাস করতেই আমাদের প্রথম প্রথম কষ্ট হতো।

আমাদেরকে একটা বড় হোস্টেলে রাখা হয়েছে। নিজেদের জন্য আলাদা ছোট ছোট ঘর, নিচে খাবার জায়গা। পুরো হোস্টেলে অনেকে থাকে, কে কী করে, কেন এখানে থাকে সেটি পরিষ্কার নয়। আমাদের দুজনকে বলে দেওয়া হয়েছে আমরা যেন নিজেদের সম্পর্কে একটা কথাও না বলি–সে রকম অন্য সবাইকেই নিশ্চয়ই একই কথা বলা হয়েছে, তাই কেউ কারো সাথে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলে না। প্রতিদিন ভোরে নিজেদের ব্যবহারের জন্য আমাদের জন্য তৈরি করা আইডি কার্ডে কিছু ইউনিট ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমরা যখন শহরে ঘুরে বেড়াই তখন নিজেদের ছোটখাটো প্রয়োজনে ইউনিটগুলো খরচ করতে পারি। আমাদের আইডি কার্ডগুলো নিরীহ আইডি কার্ড নয়, এটি প্রতি মুহূর্তে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আমাদের সম্পর্কে তথ্য পাঠাতে থাকে, আমরা মুক্ত মানুষের মতো সারা শহরে ঘুরে বেড়ালেও সারাক্ষণ যে আমাদের উপর নজর রাখা হচ্ছে আমরা সেটি টের পাই। এটাও এক ধরনের শেকল, মায়ী মায়ীর শেকলের মতো অশালীন শেকল নয়, খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের অদৃশ্য শেকল।

বিজ্ঞানী লিংলির শহরটি খুব সুন্দর। আমাদের শহরের মতো খাপছাড়া নয়, আমাদের শহরের মতো ছোট নয়, এটা অনেক বড়। আমরা ইচ্ছে করলেই আমাদের পুরো শহরটা একদিনে ঘুরে আসতে পারতাম, এই শহরটার এক মাথা থেকে অন্য মাথা দিনে দিনে ঘুরে আসা সম্ভব নয়। শহরের মাঝখান দিয়ে ট্রাম লাইন আছে, জায়গায় জায়গায় পার্ক, পার্কে ফুলের বাগান এবং বসার জায়গা। শহরের এক পাশ দিয়ে অপূর্ব একটা খাল, খালের দুই পাশে ছায়াঢাকা বড় বড় গাছ, সেখানে বসার জন্য একটু পরপর কাঠের বেঞ্চ। বিকেল বেলা তরুণ-তরুণীরা রঙিন পোশাক পরে সেখানে ভিড় করে আসে।

দিনের বেলা মানুষজন শহরে ঘুরে বেড়ায়। যারা বয়স্ক তাদের সবার মাথার মাঝে ক্রেনিয়াল, তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন। তাদের চলাফেরায় কোনো ব্যস্ততা নেই। কমবয়সী তরুণ-তরুণীরা যাদের মাথায় এখনো ক্রেনিয়াল লাগানো হয়নি তাদের চেহারায় মাঝে মাঝে অস্থিরতার ছাপ দেখা যায়। মাঝে মাঝেই দেখা যায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অকারণে হি হি করে হাসছে। কিংবা উচ্চ স্বরে কোনো কিছু নিয়ে তর্ক করছে। শক্ত সমর্থ দুজন তরুণকে একদিন ঘুষোঘুষিও করতে দেখেছি। মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর পর সবাই শান্ত হয়ে যাবে, সবাই সভ্য ভব্য কাজের মানুষ হয়ে যাবে।

আমি আর টিশা শহরটি ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে একদিন লিংলির ল্যাবরেটরিটা আবিষ্কার করে ফেলোম। শহরের এক পাশে বিরাট এলাকা নিয়ে ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্স, উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা হলেও বড় বিল্ডিংগুলো বাইরে থেকে দেখা যায়। প্রতিদিন ভোরে দলে দলে মানুষ সাদা অ্যাপ্রোন পরে ল্যাবরেটরিতে ঢোকে–দুপুর বেলা একদল বের হয়ে অন্য এক দল ঢোকে, বিকেলেও একই অবস্থা। ল্যাবরেটরি কখনো বিশ্রাম নেয় না–গভীর রাতেও সেখানে অনেক মানুষ থাকে।

ল্যাবরেটরির কমপ্লেক্সের একটি মাত্র গেট, সেই গেট দিয়ে সব মানুষকে ঢুকতে হয় আবার বের হতে হয়। তাদের গলায় ঝোলানো ব্যাজ থাকে, চোখের রেটিনা স্ক্যান করে ব্যাজের সাথে মিলিয়ে সবাইকে ভেতরে ঢোকানো হয়। সবকিছু স্বয়ংক্রিয়, কোনো মানুষের প্রয়োজন নেই, তারপরও কয়েকজন বড় মানুষ হাতে ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা করে। আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিষয়টা দেখছিলাম, তখন পাহাড়ের মতো একজন আমাদের ধমক দিয়ে বলল, “এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? ভাগো এখান থেকে।”

আমি আর টিশা সাথে সাথে সরে এসেছি।

.

সপ্তাহ দুয়েক পর ভোরবেলা নাশতা করে আমি আর টিশা যখন হোস্টেল থেকে বের হচ্ছি, তখন হোস্টেলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি আমাদের থামাল, বলল, “কোথায় যাও?

এর আগে আমাদের কখনো কেউ থামায়নি। তাই আমরা একটু অবাক হলাম, ইতস্তত করে বললাম, “এই তো, বাইরে, একটু শহরটা ঘুরে দেখছি।”

“যেখানেই যাও সন্ধের আগে ফিরে আসবে।”

আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, “ফিরে আসব।”

টিশা জিজ্ঞেস করল, “কেন? আজকে কী হবে?”

“আমি জানি না। কিন্তু তোমাদের ফিরে আসতে হবে। আইডি কার্ডে সব দেখতে পাবে।”

.

আজকে আমাদের শহরের লাইব্রেরিটি খুঁজে বের করার কথা। বেশ আগ্রহ নিয়ে দুজনেই সেটা খুঁজে বের করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মহিলাটির কথা শুনে আমাদের উৎসাহে একটু টান পড়ল, তারপরেও দুজনে বের হয়ে গেলাম।

খুঁজে খুঁজে শহরের শেষ প্রান্তে আমরা লাইব্রেরিটা আবিষ্কার করলাম, বেশ বড় আলোঝলমল একটা দালান। ভেতরে লোকজন যাচ্ছে এবং বের হচ্ছে, আমরা দুজনও ভেতরে ঢুকে গেলাম। গেটে আইডি কার্ডটা স্পর্শ করতেই একটা কর্কশ শব্দ হলো এবং কোথা থেকে জানি একজন বয়স্ক মানুষ বের হয়ে এল। আমাদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী চাও?”

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “লাইব্রেরিতে যাব।”

মানুষটি শব্দ করে হেসে উঠল, বলল, “তোমরা লাইব্রেরিতে গিয়ে কী করবে? তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল কোথায়?”

টিশা বলল, “ক্রেনিয়াল না থাকলে লাইব্রেরি যাওয়া যায় না?”

“না।”

“ও!” টিশা বলল, “আমরা ভেবেছিলাম ভিডি টিউবে ক্রিস্টাল দিয়ে বই পড়া যায়।”

টিশার কথা শুনে মানুষটি আবার হাসতে থাকে, মনে হলো রীতিমতো কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বলল, “ভিডি টিউব আর ক্রিস্টাল দেখতে হলে তোমাদের মিউজিয়ামে যেতে হবে! তোমরা কারা? মনে হয় অন্য জগৎ থেকে এসেছ!”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “ঠিকই বলেছ! আমরা মোটামুটি অন্য জগৎ থেকে এসেছি।”

আমরা বের হয়ে আসার আগে ভেতরে একবার উঁকি দিলাম। ছোট ছোট অসংখ্য খুপরি। প্রত্যেকটা খুপরিতে একটা করে মানুষ। দেয়াল থেকে একটা তার এসে তাদের ক্রেনিয়ালে ঢুকে গেছে। দস্যুদলে আমরা যে রকম ক্রেনিয়াল টিউব দেখেছিলাম এটা সে রকম নয়। কোনো এক ধরনের ক্যাবল দিয়ে সরাসরি ক্রেনিয়ালে তথ্য ঢোকানো হচ্ছে। মানুষগুলো চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে বসে আছে।

আমরা সন্ধে হওয়ার অনেক আগেই আমাদের হোস্টেলে অপেক্ষা করতে থাকি। ভেতরে এক ধরনের চাপা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল, বিজ্ঞানী লিংলি কী মূল্য দিয়ে মায়ী মায়ীর কাছ থেকে আমাদের কিনেছে আমরা জানি না, কেন কিনেছে তাও জানি না। ভাসাভাসা ভাবে মায়ী মায়ীর কাছে যেটা শুনেছিলাম সেটাও ভালো কিছু নয়–তবে তার কথা কতটুকু বিশ্বাস করা যায় কে জানে।

সন্ধের একটু আগে একজন মানুষ এসে আমাদের দুজনকে হোস্টেল থেকে বাইরে এনে একটা গাড়িতে বসাল। গাড়ির ভেতরে আবছা অন্ধকার, চোখটা একটু সয়ে এলে দেখলাম, সেখানে সেজেগুঁজে থাকা একজন মহিলা আগে থেকে বসে আছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে একধরনের মাপা হাসি দিয়ে বলল, “তোমরা রিহি এবং টিশা?”

আমরা দুজন মাথা নাড়ালাম।

“দুর্ধর্ষ দস্যুদল মায়ী মায়ীর হাতে বন্দি ছিলে?”

আমরা আবার মাথা নাড়লাম।

“বন্দি জীবন থেকে মুক্ত হয়েছ সে জন্য অভিনন্দন।”

আমরা নিচু গলায় বললাম, “ধন্যবাদ।”

মহিলাটি তখন চুপ করে গেল এবং জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?”

“কমিউনের মিটিংয়ে।”

আমরা দুজনেই খুব অবাক হলাম। আমি আর টিশা কেউই এই শহরের মানুষ নই। এই শহরের কমিউনিটি মিটিংয়ে আমাদের দুজনের কারোরই কোনো কিছু জানার নেই, কোনো কিছু বলারও নেই। তাহলে আমাদের সেখানে কেন নেয়া হচ্ছে?

গাড়িটি আমাদের শহরের মাঝামাঝি নিয়ে গেল, সেখানে একটা বিশাল হলঘরে আমাদের দুজনকে নিয়ে মহিলাটি ঢুকে গেল। মিটিং শুরু হতে এখনো দেরি আছে, চেয়ারগুলো বেশির ভাগই ফাঁকা। মহিলাটি আমাদের দুজনকে নিয়ে মাঝামাঝি এক জায়গায় বসিয়ে নিচু গলায় বলল, “তোমরা দুজন নিজে থেকে কারো সাথে একটি কথা বলবে না। ঠিক আছে?”

আমি আর টিশা মাথা নাড়লাম, নিজে থেকে কোনো কথা বলা যাবে না কিন্তু অন্যেরা চাইলে কি কথা বলা যাবে? আমরা অবশ্য ব্যাপারটার আর কোনো ব্যাখ্যা চাইলাম না।

ধীরে ধীরে হলঘরটা ভর্তি হতে লাগল। যারা আসছে তাদের বেশির ভাগই একটু বয়স্ক মানুষ, আমার আর টিশার বয়সী মানুষ খুব কম। পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা প্রায় সমান সমান। সামনে স্টেজে একজন মানুষ সবাইকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা পিয়ানো বাজাতে লাগল, খুবই একঘেয়ে সুর কিন্তু প্রত্যেকটার একটা অংশ শেষ করার সাথে সাথে সবাই এমনভাবে উচ্ছাস প্রকাশ করতে লাগল যে আমার সন্দেহ হতে লাগল ক্রেনিয়ালে করে এদের মাথায় এই পিয়ানো সংগীতের জন্য আলাদাভাবে ভালোবাসা তৈরি করে রাখা আছে।

একসময় পিয়ানো বন্ধ হয়ে গেল এবং মঞ্চে এই শহরের কমান্ড্যান্ট এসে ঢুকল। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাততালি দিতে থাকে। কমান্ড্যান্ট মানুষটি মাঝবয়সী এবং দেখতে প্রায় আমাদের শহরের কমান্ড্যান্টের মতো, মানুষটি যখন মাইক্রোফোনে কথা বলতে থাকে, তখন আবিষ্কার করলাম তার কথা বলার ধরনটুকুও হুবহু আমাদের শহরের কমান্ড্যান্টের মতো। কমান্ড্যান্ট বলতে শুরু করল, “আমার প্রিয় শহরবাসী, কমিউনের সভায় তোমাদের আমন্ত্রণ।”

কমান্ড্যান্ট একটু থামল এবং সবাই জোরে জোরে হাততালি দিতে লাগল। আমাদের কমান্ড্যান্টের মতো এই কমান্ড্যান্টের কথার মাঝখানেও একটু পরে পরে হাততালি দিতে হয়।

কমান্ড্যান্ট বলল, “আজকে আমাদের খুব আনন্দের দিন। আজকে প্রথমবার আমাদের প্রিয় শহরের নিয়ন্ত্রণের পুরোটুকু করা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব যান্ত্রিক ক্রেনিপিউটারে।”

সব মানুষ এবারে আরো জোরে হাততালি দিতে শুরু করে। আমি পাশে বসা সেজেগুঁজে থাকা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ক্রেনিপিউটারটা কোথায়?”

মহিলাটি বলল, “বিজ্ঞানী লিংলির ল্যাবরেটরিতে।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এটা কী দেখতে যাওয়া যাবে?”

মহিলাটি বিরক্ত হয়ে বলল, “এখন আমার সাথে কথা না বলে কমান্ড্যান্ট কী বলছে সেটা শোনো।”

কমান্ড্যান্ট বলল, “এই ক্রেনিপিউটার আমাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া সভ্যতাকে আবার নতুন করে দাঁড়া করাবে। একবিংশ শতাব্দীতে কম্পিউটার যে ভূমিকা রেখেছিল এই শতাব্দীতে ক্রেনিপিউটার সেই একই ভূমিকা রাখবে। পৃথিবীর সব প্রযুক্তি হয় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল না হয় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে মহাবিজ্ঞানী লিংলি একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে দাঁড়া করিয়েছে এই নতুন যুগের ক্রেনিপিউটার।”

হলঘরের সব মানুষ রীতিমতো চিৎকার করে হাততালি দিতে থাকে। কমান্ডেন্ট হাততালি থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, “আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার এই মহাবিজ্ঞানী লিংলি আমাদের শহরের একজন মানুষ। আমাদের এই শহরে বসে গবেষণা করে সে এই ক্রেনিপিউটার গড়ে তুলেছে। সেই ক্রেনিপিউটার এখন এই শহরকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নেটওয়ার্কের সাহায্যে সেটা ইতোমধ্যে আশেপাশের শহরের সাথে যোগাযোগ করছে। একসময় সেই শহরগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করবে। এভাবে ধীরে ধীরে একসময় নিশ্চয়ই সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে।”

এই শহরের একটা ক্রেনিপিউটার সারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবে শুনে হলঘরের মানুষেরা রীতিমত উত্তেজিত হয়ে হাততালি দিতে শুরু করে। কমান্ডেন্ট হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে, বাঁধাধরা কথা। এরকম কথা আমরা আমাদের শহরে আমাদের কমান্ড্যান্টের মুখে অনেকবার শুনেছি। কথা শুনতে শুনতে আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।

কতক্ষণ কমান্ড্যান্ট কথা বলেছে আমি জানি না। হঠাৎ করে হলঘরের সব মানুষ একেবারে পাগলের মতো চিৎকার করে হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেল। কমান্ড্যান্টের ঠিক কোন কথাটি শুনে হলঘরের সব মানুষ এ রকম উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে আমি লক্ষ করিনি। নিচু হয়ে টিশাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে টিশা? কমান্ডেন্ট কী বলেছে?”

“বলেছে, বিজ্ঞানী লিংলি এখন এখানে আসবে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। সত্যি।”

এবারে আমিও একটু উত্তেজিত হয়ে গেলাম। এতবার বিজ্ঞানী লিংলির এত কথা শুনেছি, তাই মানুষটাকে আমার দেখার খুব আগ্রহ ছিল। আমিও এবারে হাততালি দিতে দিতে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

কমান্ড্যান্ট স্টেজের এক পাশে এগিয়ে গেল এবং আমি দেখলাম সে একজন কমবয়সী মানুষকে স্টেজের মাঝখানে নিয়ে এল। খুবই সাদামাটা ধরনের মানুষ, সাদামাটা পোশাক পরে আছে। গায়ের রং রোদে পোড়া, চুলগুলো বেশ লম্বা কাঁধ পর্যন্ত নেমে আছে, চোখগুলো জ্বলজ্বলে।

কমান্ড্যান্ট বলল, “মহাবিজ্ঞানী লিংলি, তুমি আমাদের আমন্ত্রণ রক্ষা করে আজকে কমিউনের এই মিটিংয়ের এসেছ সে জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। আমি আমার শহরের মানুষদের সাথে কথা বলতেই পারি, এটা এমন কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা নয়।”

কমান্ড্যান্ট বলল, “তোমার কাছে এটা ঐতিহাসিক ঘটনা নাও হতে পারে কিন্তু আমাদের জন্য এটি অনেক বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। যাই হোক, মহামান্য বিজ্ঞানী লিংলি, তোমার আবিষ্কার করা ক্রেনিপিউটার আজ থেকে এই পুরো শহরকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা দেখে তোমার কেমন লাগছে?”

বিজ্ঞানী লিংলি হাসি হাসি মুখে বলল, “নিয়ন্ত্রণ করছে বলা হলে সেটা একটু অন্যরকম শোনায়, আমার মনে হয় বলা উচিত শহরের সকল দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করছে।”

কমান্ড্যান্টের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো, সে বলল, “তোমার জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টির উপর এই শহরের সকল মানুষের অনেক বেশি বিশ্বাস। তুমি যদি তোমার আবিষ্কৃত ক্রেনিপিউটার দিয়ে এই শহরকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণও কর, সবাই সেটা খুব আনন্দের সাথে গ্রহণ করবে।”

হলঘরের সব মানুষ আনন্দের শব্দ করে কমান্ড্যান্টের কথার প্রতি সমর্থন জানাল। বিজ্ঞানী লিংলি তার মাথার এলোমেলো লম্বা চুলকে পেছনে সরিয়ে বলল, “শুনে খুশি হলাম। তবে আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, একটা শহর দূরে থাকুক আমি একটা মানুষকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। প্রত্যেকটা মানুষ আসলে এই পৃথিবীর একটা সম্পদ, কারণ প্রত্যেকে একটা মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মেছে। সেই মস্তিষ্কের একশ বিলিয়ন নিউরন নিয়ে সে এই পৃথিবীর একটি অনেক বড় সম্ভাবনা। ক্রেনিয়াল দিয়ে সেখানে আমরা নতুন তথ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান প্রবেশ করিয়ে তাকে আরো বিকশিত হতে দিতে চাই, কিন্তু কোনোভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না, কোনোভাবে তার স্বাধীন সত্তাকে নষ্ট হতে দিতে চাই না।”

কমান্ড্যান্টের একটা সাধারণ কথা শুনেই হলঘরের মানুষেরা হাততালি দিচ্ছিল, লিংলির মতো এত বড় একজন বিজ্ঞানীর কথা শুনে দর্শকেরা মনে হয় একেবারে অভিভূত হয়ে গেল। তারা সবাই দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে থাকে।

বিজ্ঞানী লিংলি হাসি হাসি মুখে স্টেজে দাঁড়িয়ে সবাইকে এক নজর দেখে বলল, “সত্যি কথা বলতে কী একজন মানুষের স্বাধীনতা আমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ যে, কয়েক দিন আগে আমি জানতে পেরেছিলাম একটি অসভ্য বর্বর বন্য দস্যুদল দুজন কিশোর কিশোরীকে বন্দি করে রেখেছে। আমি সেই দস্যুদলের সাথে যোগাযোগ করে দস্যুদলকে প্রয়োজনীয় মুক্তিপণ দিয়ে সেই দুজন কিশোর-কিশোরীকে মুক্ত করিয়ে এনেছি।”

আমি আর টিশা চমকে উঠলাম। বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের কথা বলছে! আমরা দুজনেই চোখ বড় বড় করে কথাগুলো ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম।

বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “আমি যতদূর জানি সেই কিশোর কিশোরী দুজনকে এই হলঘরে আনা হয়েছে। তারা কোথায়? তোমরা দুজন কি একটু দাঁড়াবে?”

আমি আর টিশা উঠে দাঁড়ালাম এবং হলঘরের সবাই কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আবার আনন্দের শব্দ করে হাততালি দিতে লাগল।

বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তোমরা দুজন স্টেজে চলে এসো। তোমাদেরকে একটু সামনাসামনি দেখি। একটু কথা বলি।”

আমার আর টিশার বুক ধক ধক শব্দ করতে লাগল। দুজন সাবধানে সারি সারি চেয়ারের মাঝখানে রাখা জায়গা দিয়ে স্টেজের দিকে এগোতে লাগলাম।

স্টেজে ওঠার পর বিজ্ঞানী লিংলি আমাদেরকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেল, আমরাও তাকে ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। দূর থেকে তাকে সাদামাটা একজন মানুষ মনে হচ্ছিল, কাছে থেকে তাকে দেখে বোঝা যায় মানুষটি সাদামাটা নয়, তার চোখগুলোর দৃষ্টি এত তীব্র যে সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না।

বিজ্ঞানী লিংলি জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের দুজনের নাম?”

আমরা আমাদের নাম বললাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, বুঝতেই পারছি বয়স এখনো ষোলো হয়নি। এই কম বয়সে পৃথিবীর কোনো বিষয়ে তোমাদের কোনো তথ্য নেই, জ্ঞান নেই, অভিজ্ঞতা নেই–তখন একটা দস্যুদলের হাতে বন্দি! তোমাদের তখন কেমন লাগত?”

আমি বললাম, “খুব খারাপ লাগত। মরে যেতে ইচ্ছে করত।”

বিজ্ঞানী লিংলি মাথা নেড়ে বলল, “না, না। কখনো মারা যাবার কথা বলবে না। একজন মানুষ অনেক বড় একটি ব্যাপার, সে কখনো মরে যাবার কথা বলতে পারে না।”

আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “দস্যুদল তোমাদের কী রকম অত্যাচার করত, একটু বলবে?”

আমি টিশার দিকে তাকালাম। টিশা মাথা নাড়ল, ফিসফিস করে বলল, “আমি বলতে চাই না। তুমিই বলো।”

আমি তখন মায়ী মায়ীর কিছু অত্যাচারের কথা বললাম এবং আমার কথা শুনে হলঘরের মানুষ কেমন শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। আমার কথা শেষ হবার পর সবাই নিঃশব্দে বসে রইল। বিজ্ঞানী লিংলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ছেলে। তোমাদের দুঃখের এবং কষ্টের দিন শেষ হয়েছে। আমি তোমাদের মুক্ত করে এনেছি। এই শহরে তোমরা এখন মুক্ত মানুষের মতো থাকো। জীবন। উপভোগ করো।”

আমি নিচু গলায় বললাম, “করব। জীবন উপভোগ করব।”

বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “তোমরা দুজন এখন এখানে কী ধরনের জীবন চাও?”

আমি আর টিশা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। এই প্রশ্নটির কী উত্তর দেওয়া যায়? সত্যি কথা বলতে হলে বলতে হবে যে, আমরা স্বাধীন একটা জীবন চাই। কিছুই করতে চাই না, কোনো গাছের ছায়ায় বসে ভিডি টিউবে বই পড়তে চাই। কিন্তু মনে হলো সেটা বলা ঠিক হবে না।

আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে বিজ্ঞানী লিংলি নিজে থেকে বলল, “তোমরা কি আমার ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে চাও?”

আমরা কিছু বলার আগেই হলঘরের সব মানুষ আমাদের এত বড় সৌভাগ্যের কথা শুনে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বোঝাই যাচ্ছে, এই শহরের খুব সৌভাগ্যবান অল্প কিছু মানুষ লিংলির মতো এত বড় একজন বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সুযোগ পায়।

কমান্ড্যান্ট এতক্ষণ কোনো কথা বলছিল না, এবারে আমাদের পিঠে হাত দিয়ে বলল, “অভিনন্দন রিহি এবং টিশা! এই শহরের খুব অল্প কিছু তরুণ-তরুণী বিজ্ঞানী লিংলির সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে।”

আমি আর টিশা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “আমার ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সে থাকার জন্য হোস্টেল আছে, ডরমিটরি আছে। আমি তোমাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেব।”

আমি বললাম, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মহামান্য লিংলি।”

টিশা কোনো কথা না বলে বিচিত্র এক ধরনের দৃষ্টিতে বিজ্ঞানী লিংলির দিকে তাকিয়ে রইল।