বাথরুম দুটির মধ্যে একটি বড় বেগম সাহেবা রৌশেনারা বেগম সাহেবার ব্যবহারের জন্য, অন্যটি তাঁর নিজস্ব ব্যবহারের।
নবাব সাহেব লোকটি যে কেবল সংগীতপিপাসুই তা নয়–রীতিমত শিক্ষিতও।
মানিক চাটুয্যেই বলছিল কিরীটীকে–নবাব সাহেবের ঘরের দিকে যেতে যেতে। বলছিল, স্কুল কলেজে লেখাপড়া যদিও বেশী করেন নি, তাহলেও পড়াশুনা যথেষ্ট করেছেন এবং এখনো করেন।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, এবং সেই নেশাতেই নিজস্ব একটি লাইব্রেরী গড়ে তুলেছেন।
লাইব্রেরী!
হ্যাঁ—ইংরাজী—বাংলা—হিন্দী–উর্দু—সব ভাষাতেই তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি। কাজে কাজেই সব রকম বইয়েরই সংগ্রহ রয়েছে ঐ লাইব্রেরীতে।
লম্বা টানা বারান্দা। পর পর দশটি ঘর ঐ বারান্দায়।
লাইব্রেরী-ঘরের পাশে যে ছোট ঘরটি অর্থাৎ ৬নং ঘর—সেই ঘরের মধ্যে বসেই এতক্ষণ ওরা কথাবার্তা চালিয়েছিল।
১নং ঘর ছিল নিহত জাহানারা বেগমের—২নং ঘর ভাগ্নে নাসিরহোসেন সাহেবের এবং ৩নং হলঘর, যে ঘরের মধ্যে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।
৪নং ঘর ইদানীং নবাব সাহেবের বৃদ্ধা পিসি অর্থাৎ ফুপুর মৃত্যুর পর খালিই পড়ে আছে।
৫নং ঘরে মানিক বেগম থাকেন—তাঁরই ঘর।
৭নং ঘর হচ্ছে লাইব্রেরী।
৮ ও ৯নং ঘর দুটো নিয়ে থাকেন নবাব সাহেব।
১০ নং ঘর প্রধানা ও জ্যেষ্ঠা বেগম রৌশনারা বেগম সাহেবার ঘর।
দুজনে এসে নবাব সাহেবের বসবার ঘরে প্রবেশ করল—কিরীটী ও মানিক চাটুয্যে।
ঘরের মধ্যে একটা আবছা আলোছায়া। সমস্ত জানলা দরজা বন্ধ—তার উপরে ভারী পর্দা টাঙানো এবং জানলা দরজা সব বন্ধ বলেই ঘরের মধ্যে স্বল্প শক্তির নীলাভ গোটা দুই বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছিল। সেই নীলাভ আলোই ঘরের মধ্যে একটা আলো-ছায়ার সৃষ্টি করছিল।
ঘরের মেঝেতে পুরু দামী কার্পেট বিছানো। ঘরের মধ্যে গোটাকয়েক পুরাতন আমলের ভারী ও কারুকার্য করা সোফা কৌচ ছিল।
ওদের সাড়া পেয়ে সুশীল মুখার্জী থানার অফিসার ইনচার্জতাড়াতাড়ি উঠেদাঁড়ায় ভদ্রলোক ঘরের মধ্যে বসে নবাব সাহেবের জবানবন্দি নিচ্ছিল বোধ হয়।
সুশীল মুখার্জী বলে, আসুন স্যার—
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই প্রথম কথা কিরীটী বললে, ঘরে এ ছাড়া আর আলো নেই?
আছে—
ভরাট পুরুষ গলায় শোনা গেল।
তারপর সেই কণ্ঠস্বরই বললে, মেহের–বড় আলোটা জ্বালিয়ে দাও।
খুট করে একটু পরে একটা শব্দ হলো ও সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল আলোয় সমস্ত কক্ষটা উদ্ভাসিত ও দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
আর আলোটা জ্বালিয়ে দিয়েইএকবোরখা-পরিহিতা নারীমূর্তিঘরছেড়েমধ্যবর্তীদরজা-পথে পদা ঠেলে অন্তর্হিত হয়ে গেল নিঃশব্দে। নারীমূর্তিকে যেন ভাল করে দেখা গেল না।
তারপর চোখ ফেরাতেই দেখা গেল–সামনে সোফায় আর একজন পুরুষ বসে আছেন। বয়েস হয়েছে পরণে তাঁর পায়জামা ও চুড়িদার পাঞ্জাবি। উঁচু লম্বা বেশ বলিষ্ঠ গড়ন। গায়ের রঙ একেবারেটটকে গৌর। চোখে কালো কাঁচের চশমা। মাথার চুল লালচে কোঁকড়া কোঁকড়া।
মানিক চাটুয্যে বলে, মিঃ রায়, ইনিই নবাব সাহেব—
কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানাল নবাব সাহেবকে, নবাব সাহেব প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললেন, বসুন।
পরিষ্কার বাংলায় কথা বললেন নবাব সাহেব।
কিরীটী সামনেই একটা খালি কৌচের উপর উপবেশন করে।
তার দু চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কিন্তু তখন নবাব সাহেবের উপরেই স্থির-নিবদ্ধ।
মানিক চাটুয্যে বলেছিল, নবাব সাহেবের বয়স সত্তর-বাহাত্তরের নীচে নয় কিন্তু শরীরের বাঁধুনি এবং মুখের চামড়ার মসৃণতা দেখলে মনে হবে বুঝি বয়স এখনো ষাটের কোঠায় যায়নি।
মোটা মোটা হাতের আঙুল। দুহাতের আঙুলে গোটাচারেক আংটি—তার মধ্যে বাম হাতের অনামিকার আংটিটা হীরার বোধ হয়। ঘরের আলোয় হীরাটা ঝিলমিল করছিল। বেশ বড় আকারের হীরাটা। একটা বড় কাবুলী মটরের চাইতেও আকারে বড় হবে।
নবাব সাহেব কিরীটীকে বসুন বলে আহ্বান জানানোর পর হঠাৎ যেন ঘরের মধ্যে আকস্মিক স্তব্ধতা নেমে এসেছিল।
সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ হলো আবার নবাব সাহেবেরই সেই ভরাট পুরুষ-গলায়।
চ্যাটার্জী সাহেব, মৃতদেহটা আর কতক্ষণ বাড়ির মধ্যে ফেলে রাখবেন—নিয়ে গিয়ে আপনাদের যা করণীয় করা হয়ে গেলে জাহানের শেষ কাজটা আমি শেষ করে ফেলতে চাই—
কথাগুলো বলতে বলতে নবাব সাহেবের চোখের দৃষ্টি মনে হলো যেন তাঁর চোখের চশমার কালো কাঁচ ভেদ করে কিরীটীর উপরে গিয়ে মুহূর্তের জন্য পতিত হলো—তারপরই যেন একটু অস্বোয়াস্তি ভাব
ডান হাতটা কোলের উপর তুলে নিয়ে প্রথমে পরিধেয় জামার ভাঁজটা ঠিক করতে লাগলেন, তারপর পকেটে হাতটা চালিয়ে যেন কি খুঁজতে লাগলেন।
আর ঠিক ঐ সময় ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা যেখানে একটা ভারীদামী পর্দা ঝুলছিল সেই পদাটা ঠেলে বোরখা-পরিহিতা এক নারীমূর্তি হাতে রূপার ট্রে তার উপরে একটা কাঁচের গ্লাস বসানোঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।