বরফের ঝড়টা চলতে লাগল সারা রাত ধরে।
গম্বুজের ভেতরটা যেন ধোঁয়ায় ভরে গেছে। ওপরের জানলাটা ভাল করে বন্ধ করা যায়নি। পুরো বন্ধ করলেও ভেতরে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশ্বাসের কষ্ট হবে। খোলা জানলা দিয়ে ঝড়ের হাওয়ার ঝাপটা ঢুকছে সেইজন্য একেবারে অসহ্য শীত।
সন্তুর মনে হল, আজকের রাতটা যেন কাটবে না। এরকম তীব্র বরফের ঝড় এখানে আগে আর একবারও সে দেখেনি। এখানে পৌঁছবার দিনই ব্লিজার্ড উঠেছিল, কিন্তু তা চলেছিল মাত্র দু ঘন্টা।
শীতের জন্য সন্তু ক্লিপিং ব্যাগের মধ্যে গোটা শরীরটাই ঢুকিয়ে নাকটা শুধু বাইরে রেখেছে। কাকাবাবু, কিন্তু বিছানার ওপর বসে আছেন সোজা হয়ে। যেন তিনি ধ্যান করছেন।
এক সময় তিনি বললেন, তুই আর শুধু শুধু জেগে আছিস কেন, সন্তু? তুই ঘুমো।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুমি ঘুমেবে না?
কাকাবাবু বললেন, না, আমি একটু দেখি, যদি হেলিকপটার আসে। কিংবা অন্য কেউ দরজা খুলে ঢোকার চেষ্টা করলেও আমাদের তৈরি থাকতে হবে।
সন্তুর ঘুম আসে না। সে খুব মনোযোগ দিয়ে বাইরের আওয়াজ শোনবার চেষ্টা করে। যদি কোনও হেলিকপটারের আওয়াজ শোনা যায়। সেই হেলিকপটারে আসবে তাদের উদ্ধারকারীরা। অবশ্য, হেলিকপটার আসবে কি না, ওয়্যারলেসে কাকাবাবুর সঙ্গে সে রকম পাকা কথা কিছু হয়নি। তাছাড়া, এ রকম ঝড়ের মধ্যে কি হেলিকপটার ওড়ে? উদ্ধারকারীদেরও তো প্ৰাণের ভয় আছে?
এক সময় রাত্রি শেষ হয়ে ভোর হল। এখানে ভোরবেলা পাখি ডাকে না। আকাশে জমাট মেঘ কিংবা বরফের ঝড় থাকলে ভোরের আলোও দেখা যায় না। দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকে।
ভোরের একটু আগেই ঝড় থেমেছে। ওপরের জানলার কাছে দেখা যাচ্ছে খানিকটা ফ্যাকাসে আলো। সন্তু প্ৰাণপণে জেগে থাকার চেষ্টা করেও ঘুমিয়ে পড়েছিল এক সময়। চোখ মেলেই দেখল, কাকাবাবু তাঁর খাটের ওপর ঠিক একই জায়গায় একই রকমভাবে ঠায় বসে আছেন।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখন কটা বাজে, কাকাবাবু?
কাকাবাবু বললেন, সকাল হয়ে গেছে, সাড়ে আটটা বাজে, এবার উঠে পড়। ঝড়টাও থেমে গেছে মনে হচ্ছে।
সন্তু ক্লিপিং ব্যাগের জিপ টেনে খুলে বেরিয়ে এল বাইরে। হঠাৎ যেন শীত কমে গেছে অনেকখানি। দুদিকে হাত ছড়িয়ে সে শরীরের আড়মোড়া ভাঙল। তখন সন্তুর মনেই নেই যে তারা গম্বুজের মধ্যে বন্দী।
কাকাবাবু বললেন, রাত্তিরে আর কিছু হয়নি। হেলিকপটারটাও এল না। কী জানি ওরা কী করছে?
অমনি সন্তুর আবার মনে পড়ে গেল সব। তাদের কেউ উদ্ধার করতে না এলে এই গম্বুজের মধ্যে তাদের মরতে হবে। এখান থেকে বেরুবার আর কোনও উপায় নেই।
সন্তু গিয়ে বাইরের দরজাটা একবার ঠেলে দেখল। সেটা আগের মতনই বন্ধ। সন্তু কিংবা কাকাবাবুর সাধ্য নেই সেটা খোলার।
কাকাবাবু বললেন, ফ্র্যিাস্কের মধ্যে চা করে রেখেছি। দু-একটা বিস্কুট আর চা খেয়ে নে। তারপর তুই বসে বসে পাহারা দিবি। আমি ঘুমোব। অপেক্ষা করা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই এখন।
চা খাওয়ার আগেই সন্তু-একবার ওপরে উঠে গেল জানলার কাছে। ঝড় থেমে গেছে অনেকক্ষণ, বাইরেটা একেবারে ধপ-ধপ করছে, এমন সাদা। নতুন বরফের ওপর রোদ পড়লে যেন আলো ঠিকরে বেরোয়। দূরের বরফঢাকা প্রান্তরকে মনে হয় আয়নার মতন। চারদিক এখন এমন সুন্দর, অথচ এর মধ্যেও যে কত রকম বিপদ রয়েছে, তা বোঝাই যায় না।
নীচে নেমে এসে সন্তু চা আর চারখানা বিস্কুট খেয়ে নিল। কিন্তু তার আরও খিদে পাচ্ছে। অথচ খাবারও বেশি নেই। স্টকে। এমন বন্দী হয়ে কতদিন থাকতে হবে কে জানে! দু তিন দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে যাবে সব খাবার।
কাকাবাবু বিছানায় শুয়ে পড়লেন টান টান হয়ে। চোখ বুজে বললেন, রিভলভারটা আমার পাশেই রইল। কেউ যদি আচমকা দরজা খুলে ফেলে, কোনও কথা না বলে সোজা গুলি চালাবি। পারবি, তো?
সন্তু ঘাড় নাড়ল।
কাকাবাবু একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লেন। সন্তু দরজাটার দিকে চেয়ে বসে রইল চুপ করে। কিন্তু এরকমভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়! কাল দুপুরের পর থেকেই তারা এই গম্বুজের মধ্যে বন্দী। পুরো একটা দিনও কাটেনি, তবু যেন মনে হচ্ছে কতকাল ধরে তারা এখানে আছে। সন্তু ভাবল, জেলখানায় যারা বন্দী থাকে, তাদের কী অবস্থা হয়? অবশ্য, জেলখানার বন্দীরাও অন্য মানুষজন দেখতে পায় কিংবা গলার আওয়াজ শুনতে পায়। এ জায়গাটা যে সাঙ্ঘাতিক নিস্তব্ধ, তাই সময়কেও এখানে লম্বা মনে হয়।
সময় কাটাবার জন্য সন্তু তার মাকে একটা চিঠি লিখতে শুরু করল। সিয়াংবোচি থেকে মাকে শেষ চিঠি লিখেছিল সন্তু। এখান থেকে চিঠি পাঠাবার কোনও উপায় নেই। এই গম্বুজ থেকে জীবন্ত অবস্থায় বেরুতে পারবে কি না, তারও তো ঠিক নেই। তবু চিঠি লেখা যাক। কোনও-না-কোনওদিন এখানে কেউ আসবে নিশ্চয়ই, তখন চিঠিটা পেয়ে মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে।
চিঠিখানা অর্ধেক মাত্র লেখা হয়েছে, এই সময় দরজায় দুম করে একটা শব্দ হল।
শব্দটা যত জোরে হল, সন্তুর বুকের মধ্যেও যেন তত জোরে আওয়াজ হল একটা। হাত থেকে পড়ে গেল। কলমটা।
আবার দুবার শব্দ।
সন্তু তাকিয়ে দেখল, সেই শব্দেও কাকাবাবু জাগেননি। সে টপ করে রিভলভারটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
তখন বাইরে থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, এনিবডি ইনসাইড দেয়ার?
মানুষের গলার আওয়াজ পেয়েই যেন সন্তুর বুকে প্রাণ ফিরে এল। সে অসম্ভব উৎসাহের সঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, ইয়েস! উই আর হিয়ার!
বাইরে থেকে কেউ জিজ্ঞেস করল, কোড নাম্বার? এনি কোড নাম্বার?
সন্তু বলল, ওয়েট, প্লিজ ওয়েট! আই অ্যাম কলিং মাই আংকল।
ততক্ষণে কাকাবাবু জেগে উঠেছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে?
সন্তু বলল, বাইরে-লোক এই মাত্র এল…কী জিজ্ঞেস করছে।
কাকাবাবু ক্ৰাচ ছাড়াই এক পায়ে লাফাতে লাফাতে চলে এলেন দরজার কাছে। সন্তুর হাত থেকে রিভলভারটা নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হু ইজ দেয়ার?
বাইরে থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, মিঃ রায়চৌধুরী?
প্লীজ ওপন দা ডোর।
সঙ্গে সঙ্গে দরজার ওপর আওয়াজ হতে লাগল দমাস দমাস করে। তারপর বাইরে থেকে ওরা কিছু বলতেই কাকাবাবু সন্তুর ঘাড় ধরে বললেন, পিছিয়ে
সন্তুরা ততক্ষণে সরে এসেছে। কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, ওরা গুলি করে তালা ভাঙছে! ওরা কখন এল, হেলিকপটারের আওয়াজ শুনতে পেলাম না।
কাকাবাবু তো ঘুমিয়ে ছিলেন, সন্তু জেগে থেকেও শুনতে পায়নি। চিঠি লেখায় সে এমনই মগ্ন ছিল।
বাইরে থেকে ওরা এবার দরজাটা ঠেলছে। সন্তুর মনে পড়ল এদিক থেকেও ছিটিকিনি বন্ধ। সে ছুটে গিয়ে ছিটিকিনিটা খুলে দিতেই দরজা খুলে গেল!
পুরো সামরিক পোশাক পরা দুজন লোক ঢুকলেন ভেতরে। একজন নেপালি। অন্যজন ভারতীয়! দুজনেরই হাতে ছোট মেশিনগানের মতন অস্ত্ৰ।
নেপালি অফিসারটি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, মিঃ রায়চৌধুরী?
কাকাবাবু বললেন, কারা আমাদের আটক করে রেখেছিল। আমাদের প্রাণে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। অনেক গুরুতর কথা আছে।
সন্তু আর কিছু না শুনে ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে। তার এখন নাচতে ইচ্ছে করছে। সে প্রথমেই বরফের মধ্যে ডিগবাজি দিল দুবার। তারপর দুহাত তুলে বৈষ্ণবদের ভঙ্গিতে নাচ শুরু করল।
খানিকটা দূরে থেমে আছে একটা হেলিকপটার। তার সামনের পাখাটা এখনও ঘুরছে। চালকের আসনে বসে আছে। একজন নেপালি।
যে-দুজন মিলিটারি অফিসার গম্বুজের মধ্যে ঢুকেছেন, তাঁদের একজন নেপাল সরকারের প্রতিনিধি, অন্যজন ভারত সরকারের। একজনের নাম জং বাহাদুর রানা, অন্যজন গুরুদত্ত ভামা। দুজনেই কাকাবাবুর দুহাত ধরে ঝাঁকুনি দিলেন। তারপর রানা বললেন, আপনার কিছু হয়নি তো, মিঃ রায়চৌধুরী! আমরা যে ঠিক সময়ে আসতে পেরেছি, সে জন্য আমরা আনন্দিত। কী হয়েছিল বলুন তো ব্যাপারটা।
কাকাবাবু বললেন, বলছি, অনেকটা সময় লাগবে। সত্যিই আপনারা ঠিক সময় এসেছেন। আসুন, বাসা যাক।
ভার্মা বললেন, বাইরের লোকটি কে? কাকাবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাইরের লোক? বাইরের আবার কোন লোক? আর তো কেউ ছিল না?
ভার্মা বললেন, ঐ লোকটাই কি তাহলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল? কিন্তু বেচারি নিজেই শেষটায়-
কাকাবাবু বললেন, কিছুই বুঝতে পারছি না তো? চলুন তো দেখি বাইরের কোন লোক?
কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে।
গম্বুজের দরজাটা খোলার পর বাইরে যে জায়গাটা দরজায় ঢাকা পড়ে গেছে, সেখানে বরফের মধ্যে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। একজন মানুষ। এক নজর দেখলেই বোঝা যায়, লোকটি মরে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে।
লোকটি একজন চীনা, বছর পয়তিরিশের মতন বয়েস, পরনে প্যান্টশার্ট। কাকাবাবু হাঁটু গেড়ে বসে দেহটা উল্টে দিলেন। কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই। লোকটির মৃত্যু হল কী ভাবে? অবশ্য বরফের ঝড়ের মধ্যে সারারাত বাইরে থাকলে কারুর পক্ষেই বাঁচা সম্ভব নয়।
রানা বললেন, ঐ লোকটি বোধ হয় গম্বুজে আশ্রয় নিতে এসেছিল। আপনারা দরজায় যে ধাক্কার শব্দ শুনেছেন, সেটা এরই।
ভার্মা বললেন, তা হলে দরজাটা বন্ধ করল কে?
রানা বললেন, তা হলে এই লোকটিই কি দরজা বন্ধ করতে এসেছিল, তারপর ব্লিজার্ডের মুখে পড়ে আর ফিরতে পারেনি?
ভার্মা বললেন, একজন চীনা এখানে আসবে কী করে? আর গম্বুজের দরজাটা বা বন্ধ করবে। কেন?
কাকাবাবু ততক্ষণে মন দিয়ে মৃত লোকটির শরীর পরীক্ষা করছেন। চেষ্টা করছেন লোকটির হাতের কনুই এবং পায়ের হাঁটুর কাছে মোড়বার। কিন্তু লোকটির শরীর একেবারে শক্ত। কাকাবাবুর খানিকটা ডাক্তারি বিদ্যেও আছে। তিনি অবাকভাবে মাথা নাড়তে লাগলেন।
খানিকবাদে মুখ তুলে তিনি বললেন, আশ্চর্যের ব্যাপার, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার
রানা এবং ভার্মা দুজনেই এক সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, কী?
কাকাবাবু বললেন, কাল আমরা গম্বুজের মধ্যে ঢুকেছি। দুপুরের দিকে। এখনও চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি। কিন্তু আমি যেটুকু ডাক্তারি জানি, তাতে বলতে পারি যে, এই লোকটির মৃত্যু হয়েছে। অন্তত আটচল্লিশ ঘন্টা আগে। রাইগর মর্টিস অনেক আগেই সেট করে গেছে! তাহলে এই লোকটি এখানে এল কী করে?
রানা বললেন, বলেন কী, আটচল্লিশ ঘন্টা আগে? তাহলে কাল আপনারা একে দেখেননি?
কাকাবাবু বললেন, না। শুধু তো আমি এক নই, কাল দুপুর পর্যন্ত এখানে শেরপা আর মালবাহকরাও ছিল। কেউ দেখেনি। এখানে ফাঁকা জায়গায় কোনও লোক লুকিয়েও থাকতে পারে না।
ভার্মা বললেন, এ যে অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে। আপনার তাহলে নিশ্চয়ই কোনও ভুল হচ্ছে, মিঃ রায়চৌধুরী!
কাকাবাবু বললেন, তা হতে পারে। কী ভাবে লোকটি এখানে এল তা আমি জানি না। তবে, এই লোকটি যে কাল রাতে বা আজ সকালে মারা যায়নি, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। দুদিন কেন তিন-চারদিন আগেও এর মৃত্যু হতে পারে
সন্তু হেলিকপটারটা দেখবার জন্য ঐ দিকে যাচ্ছিল মনের আনন্দে। একবার পেছন ফিরে দেখল, কাকাবাবু আর অন্য দুজন লোকই গম্বুজের বাইরে হাঁটু গেড়ে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছেন। অমনি তার কৌতূহল হল। সে আবার ফিরে এল গম্বুজের দিকে।
কাছাকাছি এসে সে থমকে গেল। একটি সম্পূর্ণ অচেনা লোকের মৃতদেহ। মুখটা হাঁ করা, চোখ দুটো খোলা। যেন সন্তুর দিকেই তাকিয়ে আছে।
সন্তুর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। অতি কষ্টে ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এ কে?
কাকাবাবু বললেন, আমরাও তো সেই কথাই ভাবছি।