১১.
গায়ের জামাকাপড় থেকে বরফের কুচো ঝাড়তে ঝাড়তে অর্জুন সিং, স্মিথ এবং কাইবুলুস্কি ঘরে ঢুকল। ঘরের মধ্যে কেউ কেউ তাস খেলছে, কেউ বা দাবা পাশা নিয়ে মেতেছে, আবার কেউ বা মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। একটা স্লেজ গাড়ি সারাতে ব্যস্ত গোলাম মহম্মদ। বিশ্বনাথ কুমার চৌম্বক ধর্মের বিভিন্ন তথ্যে নিমগ্ন।
ডাক্তার লিমের বাঙ্ক থেকে নাক ডাকার মৃদু আওয়াজ ভেসে আসছে। কতকগুলো জটিল বেতার তরঙ্গ সম্বন্ধে গবেষণায় ব্যস্ত ডক্টর রায়। কসমিক চার্ট তৈরি করছে সৌরেন। সুন্দরমের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মাঝে মাঝে। স্টোভের ওপর একটা বড় কেটলি বসাল লিওন। কাইবুলুস্কি এগিয়ে এল ওকে সাহায্য করার জন্যে।
রান্নাটা যে এত গোলমেলে ব্যাপার, সেটা কে জানত আগে? বিরক্ত হয়ে বলল লিওন, উঃ, কী চিৎকার করছে সুন্দরম। আচ্ছা। ওকে তো কসমিক তাঁবুতে নিয়ে গেলেই হয়?
না, কসমিক তাঁবুতে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। নানান যন্ত্রপাতি আছে ওখানে। কখন যে কী করে বসে কে জানে? অবশ্য অজ্ঞান করে রাখা যায়। কিন্তু বেশি মরফিয়ার স্টক নেই আমাদের।
সবই তো বুঝলাম। একজন একজন করে হারাচ্ছি আমরা। কিন্তু যাক সে কথা। আপনার সম্বন্ধেও কথা উঠছে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে বেশিক্ষণ একলা থাকা নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু পুরো দেড় ঘণ্টা বাইরে ছিলেন আপনি। তাই অনেকে…
অবাক হয়ে লিওনের মুখের দিকে তাকালেন ডক্টর রায়। মুহূর্তের জন্যে কাইবুলুস্কির হাত পা যেন ঝিমঝিম করে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলেন।
খুকখুক করে কেশে উঠলেন ডক্টর রায়। বললেন সকলকে, এভাবে সন্দেহ করা অন্যায়। সন্দেহের বিষ বড় মারাত্মক। কিন্তু কাইবুলুস্কিকে সন্দেহ করার কোনও মানেই হয় না। আর কাইবলুস্কি, একটা অনুরোধ করব তোমাকে, যে রকম করেই হোক একটা উপায় বার করো তুমি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সজোরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন কাইবুলুস্কি, ভালো কথা বলেছ লিওন৷ কেন বাইরে গিয়েছিলাম বলছি শোনো। দরজাটাকে এমন আটকেছে মাকডেভিড, যে বাইরে থেকে কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। তাই ওকে বুঝিয়ে দরজা খোলবার জন্যেই গিয়েছিলাম। তাতে যদি…
বাধা দিয়ে বললেন ডক্টর রায়, ওসব কথা এখন রেখে দাও তুমি। একটা ভালো উপায় বার করো। আমি নিজেও যেন কেমন হয়ে পড়ছি মাঝে মাঝে। কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। নিজেকে।
সবই তো বুঝলাম। কিন্তু সিরাম পাই কোথা থেকে? কোনও জন্তুই তো আর নেই।
কেমিক্যাল এগজামিনে কোনও কিছু ধরা পড়ে না?
না, পরীক্ষা করার মতো কোনও কিছুই নেই এখানে। তা ছাড়া আপনি তো জানেন যে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনও ফল হয়নি।
হ্যাঁ, সে তো জানি। আসল নকলের মধ্যে কোনও পার্থক্য ধরা পড়েনি। কিন্তু একটা উপায় তো বার করতেই হবে। আচ্ছা, রাত্রে খাবার পর কী করব আমরা?
কাইবুলুস্কির হয়ে উত্তর দিল অর্জুন সিং, পালা করে ঘুমুলে মন্দ হয় না। কিন্তু আমি তো ভেবে পাচ্ছি না আর কতজন দৈত্য আছে আমাদের মধ্যে। জন্তুগুলো তো এখন নেই। মনে হল এবার বোধহয় বেঁচে গেলাম। কিন্তু আপনারা দুজনই ভাবিয়ে তুলেছেন। আবার অনেক সময় মনে হয় আমি ছাড়া বোধহয় আর কেউ মানুষ নয়!
তুমিও যে দেখছি বিশ্বনাথের মতো কথা বলছ! ব্যঙ্গের সুরে বললেন কাইবুলুস্কি।
না, আমি তা বলছি না। তবে সবাই যখন চেয়ে থাকে তখন নিজেকেই সন্দেহ হয়। সত্যি, কী মারাত্মক চাউনি।
ডক্টর রায় বললেন, তবুও তো পুরো চার ঘণ্টা ধরে এখানে বসে থাকতে হয়নি তোমাকে। তাহলে বুঝতে, এক নাগাড়ে কতকগুলো মারাত্মক চোখ চেয়ে থাকে। সকলের চোখের ভাষাই এক!
হঠাৎ লিওন চিৎকার করে উঠল, উঃ, অসহ্য! অসহ্য! যে রকম করেই হোক চুপ করান সুন্দরমকে! নয়তো পাগল হয়ে যাব!
কই, এমন আর কী বেশি চেঁচাচ্ছে! কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন কাইবুলুস্কি।
শুনতে পাচ্ছেন না? ওই তো এখনও চেঁচাচ্ছে! শুধু চিৎকার নয়। কখনও গাইছে, প্রার্থনা করছে, আবার কখনও বা দুর্বোধ্য ভাষায় গালাগালি করছে। ঠিক বলেছিলেন আপনি৷ গুলি করে পরীক্ষা করতে হয়। আর গুলি করার চেয়ে মাথাটা কেটে ফেললেই তো…
না, না, অত চিন্তা করতে হবে না! দেখি কী করতে পারি আমি। ইতিমধ্যে খেয়ে নাও তোমরা। ওই ক্যাবিনেটটা একবার দেখতে হবে। ঘরের একপাশে ওষুধ রাখার আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেলেন কাইবুলুস্কি। তিনটে বড় বড় ক্যাবিনেট আছে। দুটোতে তালা দেওয়া।
আজ থেকে বারো বছর আগে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন কাইবুলুস্কি। তারপর ডক্টরেটের জন্যে তৈরি হবার সময় হঠাৎ আবহাওয়া বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক পড়েছিল তার। আর তার ফলেই একজন দক্ষ আবহাওয়াবিদ কাইবুলুস্কি। ডাক্তার লিম সেদিক দিয়ে পাকা লোক। সমস্ত ডাক্তারি শাস্ত্রটা নখদর্পণে।
বেশির ভাগ ওষুধই অজানা মনে হল। অনেক ওষুধের ব্যবহারও মনে পড়ছে না এখন। তা ছাড়া কোনও রেফারেন্স বই নেই এখানে। নেই কোনও মেডিক্যাল জার্নাল। ডাক্তার লিমের কাছে যা সহজ সরল, তা-ই জটিল দুর্বোধ্য ঠেকছে।
ডাক্তারি কিটব্যাগটা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেলেন কাইবুলুস্কি। স্মিথ আর অর্জুন সিংও চলল সঙ্গে সঙ্গে।
ইতিমধ্যে স্লেজ গাড়িটাকে সারিয়ে ফেলেছে গোলাম মহম্মদ। একসঙ্গে সকলে খেতে বসল। কাঁটা চামচের টুং টাং আওয়াজ উঠছে।
কিছুক্ষণ পরে ওরা তিনজনে ঘরে ঢুকল। কেউ কোনও কথা বলল না। একবার ওদের দিকে তাকিয়ে যে যার খাওয়াতে মন দিল।
থমকে দাঁড়ালেন কাইবুলুস্কি। কর্কশ স্বরে গালাগালি দিয়ে উঠল সুন্দরম। অর্জুন সিংয়ের দিকে ফিরে বললেন, সত্যি, অসহ্য করে তুলল দেখছি!
এত শক্তিও থাকে মানুষের! বিরক্তির সুরে বলল অর্জুন সিং। আবার সব চুপচাপ। হঠাৎ সৌরেন লাফিয়ে উঠল খাবার টেবিল থেকে। রাগে চিৎকার করে উঠল, বোবার মত খেয়ে যাচ্ছ! একটা কথাও বলছ না কেন তোমরা? সবাই কেন তাকাচ্ছ আমার দিকে! উঃ, কী ভীষণ সন্দেহ তোমাদের চোখে! শুনুন কাইবুলুস্কি, আপনি তো এখন আমাদের লিডার। অন্তত একটা কিছু করুন। এরকম বুকচাপা উত্তেজনায় বোধহয় মরে যাব আমি! আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়! আমি বলি কী, বাকি রাতটুকু সিনেমা দেখানো হোক। দুটো রিল তো এখনও বাকি আছে। শেষ দিনের জন্যে রেখে কী হবে? শেষ দিন তো এসেই গেছে। কিছুক্ষণ অন্তত সন্দেহের হাত থেকে বাঁচা যাবে।
কাইবুলুস্কি বললেন, খুব ভালো কথা বলেছ, সৌরেন! আমি ভেবেছি এ কথা। সত্যি এই থমথমে আবহাওয়া অসহ্য!
চালাও চালাও। সিনেমা চালাও। একসঙ্গে হইহই করে উঠল সবাই।
কাইবুলুস্কি বললেন, বেশ, তাহলে কার্টুনগুলো দেখানো হোক এখন।
সেই ভালো। বেশ হাসা যাবে কিছুক্ষণ।
প্রোজেকটার আর শব্দ-নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া হল পিটার গোমেশ, স্মিথ আর জিতেনের ওপর। অর্জুন সিংয়ের পাশে সরে এলেন কাইবুলুস্কি। ওরা দু-জনে মরফিয়ায় আচ্ছন্ন ডাক্তারকে ধরাধরি করে পাশের বাঙ্কের ওপর শুইয়ে দিল। একে একে নিবে গেল আলোগুলো। চাপচাপ অন্ধকারে সব একাকার হয়ে গেল। চিন্তায় আচ্ছন্ন কাইবুলুস্কি। পথ একটা বের করতেই হবে। সুন্দরমের চিৎকার ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। সিনেমার পর্দার আলোয় অন্ধকার অনেকটা তরল হয়ে এল। সিনেমার শব্দ বেশ বাড়িয়ে দিল পিটার গোমেশ। দরজার পাশের বাঙ্কের ওপর শুয়ে পড়লেন কাইবুলুস্কি। সাঁৎ করে কেউ বেরিয়ে গেল না? চমকে উঠলেন কাইবুলুস্কি। ভালো করে লক্ষ করে দেখলেন। না, কেউ নেই আশপাশে। কিন্তু কী আশ্চর্য, সুন্দরমের চিৎকার থেমে গেল কেন? ভালো করে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন। না, সত্যি চুপ করেছে সুন্দরম।
কিছুক্ষণ ভাবলেন কাইবুলুস্কি। তারপর চিৎকার করে উঠলেন, পিটার, পিটার। সিনেমা বন্ধ করো!
সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার পর্দায় ছবি মুছে গেল। পট পট, করে আলোগুলো জ্বলে উঠল।
সুন্দরমের চিৎকার থেমে গেছে!
বিশ্বনাথ কুমার তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, চালাও চালাও। তাড়াতাড়ি চালাও সিনেমা। সুন্দরম নিশ্চয়ই চুপ করে সিনেমার কথাবার্তা শুনছে।
কোনও কথা না বলে স্মিথ এবং অর্জুন সিংকে আসতে বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন কাইবুলুস্কি।
দরজার সামনে পাহারায় রইলেন বিশ্বনাথ কুমার। হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সৌরেন। আর অদ্ভুত একটা কবিতা আওড়াতে আওড়াতে ঘরের মধ্যে পায়চারী করতে আরম্ভ করল।
তুমিও কি পাগল হলে নাকি? চুপ করবে না বন্দী করে রাখব তোমাকে? ধমকে উঠল লিওন।
মুহূর্তের মধ্যে চুপ হয়ে গেল সৌরেন। বাইরে ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া সঙ্গে সঙ্গে অনেক মুহূর্তও খসে পড়ল মহাকালের কোলে।
অনেকক্ষণ পরে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকলেন কাইবুলুস্কি। এক দুঃসংবাদ আছে। আমাদের মধ্যে কেউ একজন মারাত্মক এক পরীক্ষা করেছে। ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ সুন্দরমের গলাটা কেটে ফেলেছে, আর সেই জন্যেই বন্ধ হয়েছে ওর চিৎকার। দুঃখ করবার মতো সময় নেই আমাদের। আমাদের মধ্যে দৈত্য ছিল। এবার তার সঙ্গে শুধু আর একটা যোগ হল-খুনি!
.
১২.
ম্যাকডেভিড কি ছাড়া পেয়েছে? নয়তো খুন করবে কে?
না, ছাড়া পায়নি ম্যাকডেভিড। আর খুন করা হয়েছে এই ছুরি দিয়ে। এক ফুট লম্বা ধারালো চকচকে একটা ছুরি তুলে ধরল অর্জুন সিং। কাঠের বাঁটটা কালো হয়ে গেছে।
ছুরিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে লাফিয়ে উঠল লিওন। আরে এই ছুরি দিয়ে কালকেও তো আমি আলু কেটেছিলাম। স্টোভের পাশেই তো রাখা ছিল ছুরিটা।
তুমি না বললেও আমি জানি। অর্জুন সিংয়ের ঠোঁটের কোণে বিচিত্র এক হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।
ভয় মেশানো চোখে ছুরিটার দিকে তাকিয়ে জিতেন বলল, আশ্চর্য! আর কত দৈত্য আছে কে জানে? সিনেমার পর্দার পেছন থেকে নিশ্চয়ই কেউ ছুরিটা নিয়ে বাইরে গেছল। কিন্তু এত লোকের চোখ এড়াল কী করে!
ডক্টর রায় বললেন, ভিনগ্রহের জীবটার কাছে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।
জোর দিয়ে বললেন অর্জুন সিং, না, ভিনগ্রহের জীবের কাজ নয় এটা। আমাদের মধ্যেই কেউ করেছে এ কাজ।
কাইবুলুস্কি বললেন, ওসব থাক এখন স্মিথ, ইলেকট্রোকিউটার নিয়ে এস তো আমার সঙ্গে। ভালো করে দেখাতে হবে সুন্দরমের ঘরটা।
দরজার বাইরে থেকে ইলেকট্রোকিউটারটা হাতে তুলে নিল স্মিথ। অর্জুন সিংকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন কাইবুলুস্কি। স্বর্গপুরী থেকে বেরিয়েই বেঁকে গেছে সুড়ঙ্গপথটা। ইলেকট্রোকিউটার হাতে বাঁকের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেল স্মিথ।
বাঁচাও! বাঁচাও! বাঁচাও!
কাইবুলুস্কির আর্তচিৎকারে চমকে উঠল সকলে। দ্রুম দ্রুম আওয়াজ ভেসে এল। স্মিথ স্মিথ–তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি! আবার শোনা গেল কাইবুলুস্কির গলা। একটা পার্থিব চাক্ চাক্ থপ থপ শব্দে সুড়ঙ্গপথ গমগম করে উঠল। পরক্ষণেই একটা তীক্ষ্ণ মিউমিউ আওয়াজ শোনা গেল। শব্দ লক্ষ করে দৌড়ে গেলেন বিশ্বনাথ কুমার।
এ কী সুন্দরম! মাটিতে পড়ে ছটফট করছে! সুন্দরমের দেহটা কেটে দু-খানা হয়ে গেছে। ঘরের এক কোণে বড় ছুরি হাতে হাঁপাচ্ছেন কাইবুলুস্কি। রক্তে লাল হয়ে গেছে হাতের গ্লাভস দুটো। এখনও টপটপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে ছুরি দিয়ে। মেঝের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন বিশ্বনাথ কুমার। স্মিথ পাগলের মতো ইলেকট্রোকিউটার দিয়ে দেহ দুটোকে খোঁচাচ্ছে। ইলেকট্রোকিউটারের সামনে লাগানো শক্ত ধাতুর পাতটা জ্বলে জ্বলে উঠছে। মাংস পোড়া দুর্গন্ধে ভরে গেল সমস্ত ঘর।
এক অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে সুন্দরমের ডান হাতটায়। বড় বড় লোমে ঢেকে গেছে সারা হাত। লোমের তলা থেকে বড় বড় আঁশ দেখা যাচ্ছে। দেহের মাংসগুলো এখনও লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ছোট হয়ে গেছে হাতের আঙুলগুলো। বিরাট লম্বা লম্বা ধারালো অস্ত্রের মতো আক্রমণের জন্যে ইতস্তত দুলছে বড় বড় নখওলা হাতটা।
রক্তমাখা ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন কাইবুলুস্কি। এখন বলো কে খুন করেছিল। এ কাজ যেই করে থাকুক না কেন, সে মানুষ খুন করেনি। খুন করেছিল এই দৈত্যটাকে। ঘরে ঢুকেই কী দেখলাম জানো? গলা কাটা অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে সুন্দরম। গলার নালীটা কেটে হাঁ হয়ে আছে! রক্ত ঝরছে দরদর করে। কী বীভৎস চোখের দৃষ্টি! রক্ত মাখা হাত দুটো বারে বারে চোখের সামনে তুলে ধরছিল সুন্দরম। খুব তাড়াতাড়ি পাল্টে যাচ্ছিল চেহারাটা। উঃ, কী ভয়ানক দৃশ্য!
ওঃ, কী প্রচণ্ড ক্ষমতা ওই ভিনগ্রহের জীবটার! আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছিল সুন্দরম। উঃ, ভাবতেও কেমন যেন ভয় হয়! কথা বলতে বলতে ইলেকট্রোকিউটার দিয়ে খুঁচিয়ে চলল স্মিথ।
সকলের মুখের দিকে তাকালেন কাইবুলুস্কি। বলো, বলো, কে এ কাজ করেছে? তার কাছে আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটোকে ভিজিয়ে নিল নিওন। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, সিনেমার মধ্যেও ওর চিৎকার পাগল করে তুলেছিলে আমাকে। দৈত্য না হলে এত জোর পাবে কোত্থেকে?
ওঃ, এতক্ষণে বুঝলাম। লিওনের দিকে তাকিয়ে বলল অর্জুন সিং। তুমি তো দরজার ঠিক বাঁ-ধারে বসে ছিলে, তাই না?
চিৎকার করে উঠল লিওন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি, আমিই খুন করেছি। দৈত্যকে খুন করেছি আমি।
লিওনের কাছে গিয়ে কাইবুলুস্কি বললেন, এখন লিওনকে তোমরা বিশ্বাস করতে পার। খুন করে সে প্রমাণ করেছে যে সে মানুষ। তবে একটা কথা, আর যেন কেউ এমন করে নিজেকে মানুষ বলে প্রমাণ না করে। একটা উপায় মাথায় এসেছে আমার।
বিরক্তিভরা স্বরে সৌরেন বলল, আবার পরীক্ষা। পরীক্ষা ছাড়া কি কিছুই নেই!
না, অন্য কিছু নেই। তবে এবার আর ব্যর্থ হবে না। কিন্তু খুব সতর্ক থাকতে হবে সকলকে। স্মিথ, ইলেকট্রোকিউটারটা নিয়ে স্বর্গপুরীতে চলো।
কাইবুলুস্কির পেছন পেছন আবার সবাই স্বর্গপুরীতে ঢুকল।
কারুর মুখে কোনও কথা নেই।
কাইবুলুস্কি বললেন, এইখানে দাঁড়াও, স্মিথ। পিটার, ঠিক ওর পেছনে থাকো তুমি। স্মিথ ঠিকমতো কাজ করছে কি না এটা দেখাই হবে তোমার কাজ। সকলে সাবধান এবার। টেলিপ্যাথিতে হয়তো সব জেনে ফেলতে পারে দৈত্যটা। আর তক্ষুনি মারাত্মক হিংস্র হয়ে উঠবে সে।
লোহার মতো শক্ত হয়ে উঠল প্রত্যেকের শরীর। সকলে সকলের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল। সাপের মতো হিংস্র হয়ে উঠল সবাই। পাশের মানুষটা হয়তো মানুষ নয় –দৈত্য।
হঠাৎ ব্যঙ্গ করে উঠলেন ডক্টর রায়, এটা আবার কী পরীক্ষা! আর এত ভনিতাই বা কেন?
ধমক দিয়ে উঠলেন কাইবুলুস্কি, আপনি চুপ করুন তো। খুব সহজ পরীক্ষা। কিন্তু আসল নকলের তফাত ধরা পড়তে বাধ্য। এ পরীক্ষা ব্যর্থ হবে না, হতে পারে না। সুন্দরমের মৃত্যুই এই পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
হ্যাঁ বাবা, এবার আর পালাতে হবে না। এই বলে হাতসুষ্ঠু ইলেকট্রোকিউটারটা ওপরে তুলে ধরল স্মিথ। আধ ইঞ্চি ফাঁক করা মোটা তামার পাত দুটো ঝকঝক করে উঠল। পাওয়ার প্ল্যান্টটা ঠিক চলছে তো? কারেন্ট ফেল করলেই সব ভেস্তে যাবে কিন্তু!
পিটার গোমেশ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। একবার হাত দিয়েই দেখো না। মরে ভূত হয়ে যাবে।
বাঙ্কের ওপর উঠে বসলেন ডাক্তার লিম।
সকলের দিকে তাকিয়ে কাইবুলুস্কি বললেন, ডাক্তারের কথাগুলো নিশ্চয় সকলের মনে আছে। ভিনগ্রহের জীবটার প্রতিটি অংশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক ফোঁটা রক্তও নিজস্ব ইচ্ছামতো জীবন ধারণ করতে পারে। আর আমার পরীক্ষাও হবে এই সূত্রকে ভিত্তি করে। সাধারণত জীবন্ত দেহ ছাড়া রক্তকণিকা বাঁচতে পারে না। আবার রক্ত জীবন্ত সেল বা কোষ দিয়ে তৈরি।
কিন্তু এত সূক্ষ্ম জ্ঞানগর্ভ লেকচার দিয়ে কী প্রমাণ করতে চাও কাইবুলুস্কি? আর এ তো অজানা কিছু নয়। আবার ব্যঙ্গ করে উঠলেন ডক্টর রায়।
হ্যাঁ, এই জানা কথাটাই আবার নতুন করে জানতে হবে। ভিনগ্রহের দৈত্যটাকে বোঝাতে হবে যে, আমরা মানুষ। ওর চেয়েও আমাদের বুদ্ধি বেশি। বহু প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয় আমাদের।
কাইবুলুস্কির চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করে উঠল। আর কোনও কথা নয়। এবার আসল কাজ হবে দৈত্য, তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছি। তুমি নাকি মনের কথা জানতে পার। এবার সামলাও নিজেকে। হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন কাইবুলুস্কি।
লাইন করে দাঁড়াও সবাই। মনে থাকে যেন রক্তও জীবন্ত। কেটে গেলে দৈত্যদের শরীর থেকে রক্ত পড়তে বাধ্য। এক ফোঁটা রক্তও পূর্ণের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ। এক ফোঁটা রক্তই এক নতুন দৈত্যের জন্ম দিতে পারে।
টেবিল থেকে ধারালো স্ক্যালপেলটা তুলে নিলেন কাইবুলুস্কি। আলমারির ভেতর থেকে কতকগুলো টেস্ট টিউব, একটা অ্যালকোহল ল্যাম্প এবং প্লাটিনামের তার লাফানো কাচের একটা ছোট রড টেবিলের ওপর রাখলেন। ঠিক পেছনেই দাঁড়াল স্মিথ আর পিটার।
অর্জুন সিং, তুমিই প্রথম।
ফ্যাকাশে মুখে এগিয়ে গেল অর্জুন সিং। নির্বিকারভাবে বুড়ো আঙুলের নিচে একটা শিরা কেটে দিলেন কাইবুলুস্কি। যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে ধরল অর্জুন সিং। টপটপ করে রক্ত পড়তে লাগল টেস্ট টিউবে। ক্ষতস্থানে একটু ফটকিরি দিয়ে চেপে ধরতে বললেন অর্জুন সিংকে।
স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইল অর্জুন সিং। অ্যালকোহল ল্যাম্পে প্লাটিনামের তারটা গনগনে লাল হয়ে উঠল। রক্তে ভরা টেস্ট টিউবটার মধ্যে তারটাকে ডুবিয়ে দিলেন কাইবুলুস্কি। হিস্ করে একটা আওয়াজ উঠল টেস্ট টিউব থেকে। পাঁচ পাঁচবার তারটাকে গরম করে ডোবানো হল।
মানুষ! আমি বলছি সত্যিকারের মানুষ অর্জুন সিং। দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করলেন কাইবুলুস্কি। অর্জুন, স্মিথের হাত থেকে ইলেকট্রোকিউটারটা নাও এবার। শুকিয়ে গেল স্মিথের মুখটা। ক্ষুরধার স্ক্যালপেলটার দিকে তাকাল একবার। তারপর এগিয়ে গেল অর্জুন সিংয়ের দিকে।
হঠাৎ এক তীক্ষ্ণ চিৎকারে সকলে চমকে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে বারোজন ঝাঁপিয়ে পড়ল পিটার গেমসের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে পিটারের চেহারাও পালটে গেল। দাঁতগুলো তীক্ষ্ণ বড় বড় হয়ে উঠল। হাতের নখগুলো ধারালো ছুরির মতো হয়ে গেল। কিন্তু আক্রমণ করার আগেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল পিটারের দেহটা।
স্মিথের কাজ আরম্ভ হয়ে গেল। মাংসপোড়া চামসে গন্ধে ভরে উঠল স্বর্গপুরী। প্রতিটির রক্তবিন্দুকে পুড়িয়ে ফেলতে লাগল স্মিথ। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করতে লাগল।
কাইবুলুস্কি বললেন, এখনও ভিনগ্রহের জীবের বোঝা উচিত যে মানুষের প্রতিহিংসার হাত থেকে কোনওদিনই বাঁচতে পারবে না সে। পৃথিবী থেকে শেষ বিন্দুটা পর্যন্ত মুছে দেব।
সৌরেন বলল, কী আশ্চর্য! পিটার যে মানুষ নয় কে ভেবেছিল এ কথা?
ভাবাভাবির আর কোনও প্রশ্ন নয়। ওরকম হবেই। এ পরীক্ষায় ধরা পড়তেই হবে। যাক, এবার আমার পালা। স্কালপেলটা অ্যালকোহলে ডুবিয়ে অকম্পিত হাতে নিজের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের গোড়াটা কেটে ফেললেন কাইবুলুস্কি।
সৌরেনের ডাক পড়ল মিনিট কুড়ি পরে। এবারও স্মিথের যাওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল সৌরেনরূপী ভিনগ্রহের জীবটা।
ডক্টর রায় আপন মনে বললেন, পাঁচ মিনিট আগেও আমাদের মতো মানুষ ছিল সৌরেন। কিন্তু…
পুরো একঘণ্টা পরে ডাক পড়ল ডক্টর রায়ের। টেস্ট টিউবের মধ্যে ডক্টর রায়ের রক্ত কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল। টেস্ট টিউব উপচে পড়ে পালাবার চেষ্টা করল রক্তটা। তৃতীয়বার প্লাটিনামের গরম তারটা ডোবাবার সঙ্গে সঙ্গে টেস্ট টিউব থেকে অপার্থিব এক মিউ মিউ আওয়াজ উঠল।
বিকট চিৎকার করে দৌড়ে বাইরে পালাবার চেষ্টা করলেন ডক্টর রায়। কিন্তু চারদিক থেকে ঘিরে ফেললল সকলে। ডক্টর রায় যে মানুষ নন এ যেন স্বপ্নেরও অগোচর। ফ্যাকাশে মুখে ইলেকট্রোকিউটার নিয়ে এগিয়ে এল স্মিথ। ঠকঠক করে কাঁপছে দু-হাত।এখনও রক্তটুকু কাঁদছে মিউ মিউ করে জ্বলন্ত স্টোভের দিকে টিউবটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন কাইবুলুস্কি।
.
১৩.
ক-জন হল? সব শেষ কি? বাঙ্কের ওপর হতে রক্তলাল চোখে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার লিম।
কুড়িজন। কিন্তু বংশবৃদ্ধির আগেই একদম শেষ করে দিতে হবে। আর কোনও সুযোগই দোব না ওদের। একে একে সকলে ধরা পড়েছে। ডক্টর রায়, সৌরেন, পিটার…
স্ট্রেচারে করে কী নিয়ে যাচ্ছে ওরা?
কুড়িটি মৃতদেহকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। এই দেহগুলো বরফের ওপর রেখে একটন কয়লা আর দশ গ্যালন পেট্রোল ঢেলে পোড়ানো হবে। অবশ্য বেশ কয়েক বোতল সালফিউরিক অ্যাসিড ঢেলেছি ওর ওপর।
বাঙ্কের ওপর থেকে নেমে এলেন ডাক্তার লিম। কাইবুলুস্কির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ম্যাকডেভিডকে দেখছি না কেন? কী হল ওর?
চমকে উঠলেন কাইবুলুস্কি। ঠিক বলেছেন। একেবারেই মনে ছিল না ওর কথা। কিন্তু ডাক্তার ওকে কি এখনও ভালো করা যাবে না?
হ্যাঁ, যদি না… কথা শেষ না করেই ডাক্তার এক বিচিত্র ভঙ্গি করলেন।
সত্যি কথা। পাগলও সাজতে পারে জীবটা। অর্জুন, একবার ম্যাকডেভিডের তাঁবুর দিকে যেতে হবে যে।
যন্ত্রের মত দাঁড়িয়ে পড়ল অর্জুন সিং। বলল, আমি প্রস্তুত। স্মিথও চলুক আমাদের সঙ্গে।
বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি। মাথার ওপর মধ্য রাতের সূর্য বিচিত্র বর্ণশোভায় বিকশিত। পুরো বারো ঘণ্টা ধরে এই আলোয় স্নান করবে দক্ষিণ মেরু। হু-হুঁ করে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তুষারে সাদা হয়ে গেছে ম্যাকডেভিডের তাঁবুটা। কোনও ধোঁয়া বেরুচ্ছে না তাঁবুর ভেতর থেকে। আশ্চর্য হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল চারজন।
তাঁবু থেকে ওদের দূরত্ব এখন একশো গজ মাত্র। স্মিথ চিৎকার করে উঠল, ম্যাকডেভিড, ম্যাক-ডে-ভি-ড!
চেঁচিয়ে কোনও লাভ হবে না। মনে হয় কোনওরকমে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ছে ও। তাড়াতাড়ি গেলে হয়তো ধরতে পারা যাবে।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল স্মিথ। ইশারায় কাইবুলুস্কিকে মাথার ওপর তাকাতে বলল। আবছা আলোয় দূরে আকাশের গায়ে একটা বিরাট পাখি চক্রাকারে ঘুরছে। সাদা বড় বড় পাখাগুলো চকচক করছে।
পেঙ্গুইন! কানে কানে বলল স্মিথ। এই ঋতুতে এটাই বোধহয় প্রথম। নামবার জন্যে জায়গা খুঁজছে। এখনই যদি ভিনগ্রহের জীবটা খোঁজ পায়…
তৎক্ষণাৎ বরফের ওপর ঝুঁকে পড়ে ভারী জামার মধ্যে থেকে একটা রিভলভার টেনে বার করলেন বিশ্বনাথ কুমার। দ্রুম-দ্রুম-দ্রুম। দক্ষিণ মেরুর শুভ্র নিস্তব্ধতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল রিভলভারের শব্দে।
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল পাখিটা। কয়েকটা পালক ঘুরতে ঘুরতে নেমে এল বরফের ওপর। সামনের বরফ-পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল পেঙ্গুইনটা।
সামনের দিকে ইশারা করে সকলকে সাবধান করে দিল স্মিথ, চুপ চুপ। ম্যাকডেভিডের তাঁবুর কাটা দরজা দিয়ে এক অস্বাভাবিক উজ্জ্বল নীলাভা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত গুন গুন শব্দ উঠছে তাঁবু থেকে। মনে হয় বিশেষ এক কোডে কেউ যেন বেতার বার্তা পাঠাচ্ছে!
স্মিথের কাঁধটা শক্ত করে চেপে ধরলেন কাইবুলুস্কি। বিড়বিড় করে বললেন, ভগবান আমাদের সহায় হোন।
তার-কাটা যন্ত্রটা নিয়ে দরজার সামনে বসে পড়ল স্মিথ। কটাং করে একটা ধাতব আওয়াজ উঠল। তাঁবুর মধ্যে থেকে ক্লিক ক্লিক আওয়াজ ভেসে এল।
দরজার ফাটা অংশে চোখ রাখলেন কাইবুলুস্কি। নিজের অজ্ঞাতে এক অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। চাপা গলায় বললেন, ম্যাকডেভিড নেই ঘরের মধ্যে। ভিনগ্রহের জীবটা ব্যাঙ্কের ওপর রাখা একটা বিচিত্র যন্ত্রের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। ঠিক যেন শূন্যে আসছে।
বিশ্বনাথ, তুমি একটু দূরে থাক। স্মিথ, ইলেকট্রোকিউটারটা নিয়ে আমার সঙ্গে এস। খুব হুশিয়ার!
কাইবুলুস্কি আর স্মিথ একসঙ্গে সজোরে দরজায় ধাক্কা মারল। ভেতরের বাঙ্কের সঙ্গে দরজাটার প্রচণ্ড ধাক্কা লাগল। আর তার ফলে নিমেষে চুরমার হয়ে গেল দরজার পাল্লা দুটো।
সেই মুহূর্তে নীল রবারের বড় বলের মতো কী একটা লাফিয়ে বেরিয়ে এল ঘরের বাইরে। সরু লিকলিকে সাপের মতো চারটে হাত কিলবিল করে উঠল। ছয় আঙুলওলা একটা হাত চকচকে পেনসিলের মতো কিছু একটা তুলে ধরল। পাতলা ঠোঁটের ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ দাঁত বের করে কিছু কিছু আওয়াজ করে উঠল দৈত্যটা। রক্তলাল চোখগুলোতে যেন ধকধক করে নরকের আগুন জ্বলছে।
বিশ্বনাথ কুমারের রিভলভার গর্জে উঠল। বীভৎস হিংস্র মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে কুঁকড়ে গেল লিকলিকে হাতগুলো। ধ্রুম-ধ্রুম-দ্রুম৷ পেনসিলের মতো অস্ত্রটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। দুই আঙুলওয়ালা একটা হাত ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। টপটপ করে ফিকে সবুজ রঙের রক্ত পড়তে লাগল বরফের ওপর। সাপের মতো একটা হাত এগিয়ে গেল কাইবুলুস্কির দিকে। আবার গর্জে উঠল রিভলভার। বারুদের তীব্র গন্ধে চোখমুখ জ্বালা জ্বালা করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তিনটে লাল চোখের মধ্যে কালো কালো তিনটে গর্ত হয়ে গেল। গুলিশূন্য রিভলভারটা জীবটাকে লক্ষ করে ছুঁড়ে মারলেন বিশ্বনাথ কুমার।
রক্ত-জমানো অমানুষিক আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভরে উঠল। দুটো লিকলিকে হাত দিয়ে চোখ তিনটেকে চেপে ধরল জীবটা। চোখের কালো গর্ত দিয়ে দরদর করে সবুজ রক্তের ধারা নামল। অসহ্য যন্ত্রণায় ঠান্ডা বরফের ওপর গড়াগড়ি দিতে লাগল সে। কঠিন বরফের উপর চাবুকের মতো আছড়াতে লাগলো হাতগুলো। থেকে থেকে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে সমস্ত দেহটা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আবার উঠে দাঁড়াল দৈত্যটা। তিনটে কালো কালো চোখের গর্তে যেন শেষবারের মতো আগুন ঝলসে উঠল। থপথপ করে সামনের দিকে এগিয়ে এল সে।
কাইবুলুস্কিকে পেছনে ঠেলে বরফ কাটার কুঠার হাতে এগিয়ে এল স্মিথ। কুঠারের পেছন দিক দিয়ে সজোরে ঘা মারল দৈত্যটার মাথায়। কিছুটা মাংস থেঁতলে উঠে এল কুঠারের সঙ্গে। তা সত্ত্বেও ভিনগ্রহের জীব গড়াতে গড়াতে এগিয়ে আসতে লাগল। হঠাৎ স্প্রিং-এর মতো একটা হাত এগিয়ে এল সামনের দিকে। মুহূর্তের মধ্যে জড়িয়ে ধরল স্মিথের গ্লাভস পরা ডান হাতটা। জ্যান্ত সাপের মতো যেন চেপে বসল। গ্লাভস-এর আবরণ থাকা সত্ত্বেও আগুনের মতো গরম লাগল। হাতের আবরণ সরিয়ে চামড়ার স্পর্শ খুঁজছে দৈত্যটা। শুধু জীবন্ত দেহের একটু মাত্র নিরাভরণ অংশ দরকার। একটু স্পর্শ মাত্র। তাহলেই আবার নবজন্ম পাবে ভিনগ্রহের জীবটা! সজীব একটু মাংসের স্পর্শ পেলেই নিজের দেহের অন্তত এক সামান্যতম অংশও মিশিয়ে দেবে সে। আর তারপর…।
প্রচণ্ড এক ঝটকায় স্মিথকে মুক্ত করলেন বিশ্বনাথ কুমার। আরও দুটো হাত এগিয়ে এল সামনের দিকে। ক্ষুধার্ত নেকড়ে যেন রক্তের স্বাদ পেয়েছে। শুধু একটু মাত্র জীবন্ত মাংস।
ঠিক সেই মুহূর্তে কাইবুলুস্কির ব্লো টর্চ জ্বলে উল। লকলকে আগুন-জিভের স্পর্শে কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল দৈত্যটা। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। ঠিক মুখের ওপর ব্লো টর্চটাকে ধরলেন কাইবুলুস্কি। মাংসপোড়া দুর্গন্ধে ভরে উঠল সমস্ত জায়গাটা।
সরু একটা হাত আগুনের হল্কা ধরার চেষ্টা করল একবার। একটু পাশে সরে গেলেন কাইবুলুস্কি। সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে কালো হয়ে গেল হাতটা। সাপের মতো সরু জিভটা বরফের ওপর ঘষতে লাগল বার বার। একবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেই শেষ বারের মতো কঠিন বরফের ওপর পড়ে গেল সে। ব্লো টর্চে আগুনে ধোঁয়া হয়ে পুড়ে যেতে লাগল বীভৎস দেহটা।
এবার ঘরের মধ্যে ঢুকলেন কাইবুলুস্কি। স্মিথ বলল, আর কেউ নেই তো?
না, সব শেষ! আচ্ছা, আগুনের মতো কী জ্বলছিল এখানে?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগলেন কাইবুলুস্কি। অস্বাভাবিক গরম ঘরের মধ্যে। অথচ হু হু করে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া বইছে বাইরে। এ কী, ওটা কী? সামনের টেবিলের ওপর একটা তারের কয়েল, সেটা ম্যাগনেট, একটা কাচের টিউব আর রেডিয়ো ভালব দিয়ে তৈরি এক বিচিত্রদর্শন যন্ত্র পড়ে আছে। যন্ত্রের ঠিক মাঝখানে কালো রঙের একটা পাথর। পাথরটার একটা কোণ থেকে উজ্জ্বল নীল আলোয় ভরে উঠেছে ঘরটা। চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল নীল আলো। হাই ভোল্টের ইলেকট্রিক স্পার্কের চেয়েও তীব্র। আর গুন গুন করে আওয়াজ উঠছে ওই যন্ত্রটা থেকে। যন্ত্রটার ডানদিকে একটা সুন্দর ক্রিস্টাল গ্লাস। গ্লাসের ওপর একটা তামার পাত বসানো।
এটা কী? একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ল কাইবুলুস্কির স্বরে, না না, এখন হাত দেবেন না। ভালো করে দেখতে হবে। হু, আমার অনুমানই ঠিক। এটা একটা ছোট অ্যাটমিক পাওয়ার স্টেশন। এক অদ্ভুত আশ্চর্য সৃষ্টি ডানদিকে ওই সুন্দর ক্রিস্টাল গ্লাসটা। এটাই তৈরি করার জন্যে সাইক্লোট্রন নিয়ে চেষ্টা করি আমরা। এর কী কাজ জানেন? ভারী জল (Heavy Water) থেকে নিউট্রনকে আলাদা করাই এর কাজ। আর এই বরফের রাজত্বে ভারী জল পাওয়া অতি সহজ।
কিন্তু এ সব দিয়ে কী করছিল দৈত্যটা? বুঝতে পারছি এই ঘরে রাখার ফলে সুবিধাই হয়েছিল ওর। ঘরের মধ্যেই পেয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। কী অপূর্ব বৈজ্ঞানিক প্রতিভা! কাইবুলুস্কি ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলেন যন্ত্রগুলিকে।
জানেন, এটা একটা ফোর্স ফিল্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। যে কোনও বস্তুকে ভেদ করার ক্ষমতা রাখে নিউট্রন। অবিরাম নিউট্রন সরবরাহের প্রয়োজন ছিল দৈত্যটার। আর সিলিকা, ক্যালসিয়াম, বেরিলিয়াম বা যে কোনও পদার্থের মধ্যে দিয়ে নিউট্রনকে প্রবাহিত করতে পারলে অ্যাটমিক এনার্জি পাওয়া যায়। সেদিক দিয়ে এটা একটা অ্যাটমিক জেনারেটার।
কোটের পকেট থেকে একটা থার্মোমিটার বার করলেন কাইবুলুস্কি। থার্মোমিটারের পারা চড়চড় করে একশো কুড়ি ডিগ্রিতে উঠে গেল। বাইরে দরজা খোলা। তবুও দরদর করে ঘাম বেরুচ্ছে শরীর দিয়ে।
বিশ্বনাথ কুমার বললেন, গরম হচ্ছে সত্যি কথা কিন্তু খুব ঠান্ডা আলোটা। ওই কয়েলটাই গরম করে তুলছে ঘরটাকে। নিজের বাঁচার জন্যেই গরম করে তুলেছিল জীবটা। আচ্ছা, আলোটা ভালো করে লক্ষ করেছেন কী? কী অদ্ভুত রং!
সব বুঝতে পারছি এখন। দূর নক্ষত্রের মধ্যেই এর উত্তর খুঁজতে হবে। সুদূর এক নক্ষত্রলোকের বাসিন্দা এই জীবটা। আমাদের চেয়েও অনেক বেশি উত্তপ্ত ওর গ্রহ। নীল– উজ্জ্বল নীল এক অজানা সূর্যের চারপাশে পাক দিয়ে ঘুরছে ওর গ্রহটা।
বাইরের দিকে তাকালেন কাইবুলুস্কি। এখনও ছটফট করছে আধপোড়া দেহটা।
কে জানে আর কেউ আসবে কি না? দু-কোটি বছর আগের এক নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটল! কিন্তু কী করতে চেয়েছিল জীবটা?
মৃদু হেসে উঠল স্মিথ। আমাদের আসার সময় কী কাজে ব্যস্ত ছিল তা দেখেছেন কী? দেখুন তো ওপরের দিকে।
চার চৌকো একটা বড় বাক্স ভেসে রয়েছে সিলিং এর কাছে। চারটে চামড়ার বেল্ট ঝুলছে চার কোণ থেকে। বাক্স থেকে সূক্ষ্ম ছুরির মতো এক আলোকরশ্মি ধীরে ধীরে পুড়িয়ে ফেলেছে তাঁবুর মোটা কাপড়টাকে। বেল্টগুলো ধরে টান মারতেই বেল্টসুষ্ঠু শূন্যে ভেসে উঠল স্মিথ। অ্যান্টিগ্র্যাভিটি! অ্যান্টিগ্র্যাভিটি! চিৎকার করে উঠলেন কাইবুলুস্কি।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। অ্যান্টিগ্র্যাভিটি। সায় দিলেন বিশ্বনাথ কুমার। এবার বুঝতে পারছেন যে, প্লেন নিয়েও ওকে ধরতে পারতাম না। অন্য কোনও রূপে এই অ্যান্টিগ্র্যাভিটি আর অ্যাটমিক জেনারেটারের সাহায্যে সহজেই শূন্যে পাড়ি দিত দৈত্যটা। এক লাফে অনায়াসে ভারতবর্ষে চলে যেতে পারত! তারপর…
উঃ, ভগবানের অসীম দয়া। আর কিছুক্ষণ দেরি হলেই আর পেতাম না ওকে। তারপর পৃথিবীর কাউকেই মানুষ বলে বিশ্বাস করতাম না আমরা। পৃথিবীর কেউ কি মানুষ থাকত তখন?
[জন ক্যাম্পবেলের ‘হু গোজ দেয়ার’ অবলম্বনে।
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, ডিসেম্বর ১৯৬৬]