একাদশ পরিচ্ছেদ – বন্ধনহীন গ্রন্থি
উত্তরাস্য নগরদ্বার অতিক্রম করিয়া রট্টা দলবলসহ বাহিরে আসিলেন। এখান হইতে রাজপথ মৃগয়া-কানন বেষ্টন করিয়া ভূজঙ্গপ্রয়াত ছন্দে আঁকিয়া বাঁকিয়া, কখনও উচ্চে উঠিয়া কখনও নিম্নে নামিয়া যেন নিরুদ্দেশের অভিমুখে চলিয়া গিয়াছে। প্রভাতের নবীন সূর্যালোকে এই দৃশ্য চিত্রাঙ্কিতবৎ মনোরম দেখাইতেছে।
এই নৈসর্গিক দৃশ্যের উপর ক্ষণেক দৃষ্টি বুলাইয়া রট্টা অশ্ব স্থগিত করিলেন; সেনানীকে কাছে ডাকিয়া বলিলেন— ‘নকুল, তুমি রক্ষীদের লইয়া আগে যাও; আমরা মন্থর গমনে তোমাদের পশ্চাতে যাইব।’
নকুল ঈষৎ উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল— ‘কিন্তু—’ রট্টা বলিলেন— ‘সঙ্গে আর্য চিত্রক বর্মা থাকিবেন, আমার অন্য রক্ষীর প্রয়োজন নাই। তোমরা যাও, দ্রুত অশ্ব চালাইলে দ্বিপ্রহরের মধ্যে পান্থশালায় পৌঁছিতে পারিবে। সেখানে মধ্যাহ্ন-ভোজন করিয়া চষ্টন দুর্গের পথে যাত্রা করিও।’
এখানে নকুল আবার বাধা দিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু রট্টা অগ্রাহ্য করিয়া বলিয়া চলিলেন— ‘রাত্রি এক প্রহরের মধ্যে চষ্টন দুর্গে পৌঁছিবে। মহারাজকে বলিও আমি কাল আসিব। মহারাজ অসুস্থ, আমি আসিতেছি জানিলে সুখী হইবেন।’
ইহার পরও নকুল আপত্তি করিতে যাইতেছিল। কিন্তু রট্টা তাহার মুখের পানে চাহিয়া এমন মধুর হাস্য করিলেন যে নকুলের জ্ঞান বুদ্ধি স্তম্ভিত হইল। সে সম্মোহিতের ন্যায় ‘দেবদুহিতার যেরূপ আজ্ঞা’ বলিয়া সঙ্গীদের লইয়া দ্রুতবেগে অশ্ব চালাইয়া দিল। মন্ত্রী চতুর ভট্টের আদেশ যদি বা উপেক্ষা করা যায়, রাজনন্দিনীর সহাস্য নির্বন্ধের প্রতিবাদ অসম্ভব।
রক্ষীর দল ও তাহাদের অশ্বক্ষুরধ্বনি ক্রমশ দূর হইতে আরও দূরে মিলাইয়া গেল। রট্টাও আয়াসহীন মন্দগতিতে অশ্বচালনা করিলেন। চিত্রক তাঁহার পাশে রহিল।
রট্টার মুখ উৎফুল্ল, চক্ষু চঞ্চল। তিনি কখনও উজ্জ্বল নিষ্কলুষ আকাশের পানে চক্ষু উৎক্ষিপ্ত করিতেছেন, কখনও মৃগয়া-কাননের অভ্যন্তরে কৌতূহলী দৃষ্টি প্রেরণ করিতেছেন; অশ্বের কণ্ঠ-কিঙ্কিণী পদক্ষেপের তালে তালে শিঞ্জনধ্বনি করিয়া তাহার কর্ণে অমৃত-বৃষ্টি করিতেছে।
চিত্রকের মুখ কিন্তু গম্ভীর, ভ্রূ কুঞ্চিত। সে তার অশ্বের নিভৃতোর্ধ্ব কর্ণের পানে চাহিয়া বসিয়া আছে। ভাবিতেছে, নিয়তি বারবার তাহাকে প্রতিহিংসার সুযোগ দিতেছে। অদৃষ্টের এ কোন্ ইঙ্গিত? প্রতিশোধের সুযোগ হাতে পাইয়া সে ছাড়িয়া দিবে? হিংসার উত্তরে প্রতিহিংসা লওয়া ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম। তবে কেন সে লইবে না?
চারিদিক নির্জন; কোথাও জনমানব নাই। কদাচিৎ দুই একটা শশক পথপার্শ্ব হইতে সন্তর্পণে উঠিয়া আসিতেছে, আবার অশ্বক্ষুরশব্দে ভীত হইয়া প্লুত গতিতে পলায়ন করিতেছে। পথের উপর দীর্ঘ প্রলম্বিত তরুচ্ছায়া ক্রমে হ্রস্ব হইয়া আসিতেছে।
দুইটি অশ্ব পাশাপাশি চলিয়াছে। সুগোপার জলসত্র পিছনে পড়িয়া রহিল। সুগোপা আজ আসে নাই। প্রপা শূন্য।
রট্টা এতক্ষণ চিত্রকের পানে পূর্ণভাবে দৃষ্টিপাত করেন নাই; মনের মধ্যে ঈষৎ সঙ্কোচ অনুভব করিতেছিলেন। আশা করিয়াছিলেন চিত্রক নিজেই বাক্যালাপ করিবে। কিন্তু চিত্রক যখন কথা কহিল না তখন তিনি মনকে সম্বৃত করিয়া চিত্রকের পানে স্মিতমুখ ফিরাইলেন। বলিলেন— ‘আর্য চিত্রক, আপনি নীরব কেন? সুন্দরী প্রকৃতির এই নবীন শোভা কি আপনাকে আনন্দ দিতে পারিতেছে না?’
চিত্রক রট্টার পানে চক্ষু ফিরাইল। ক্ষণেকের জন্য তাহার চক্ষু ধাঁধিয়া গেল। কী অপূর্ব রূপবতী এই রাজকন্যা! একটি দেহের মধ্যে কাঠিন্য ও কোমলতা, দৃঢ়তা ও সরসতার কি অপরূপ সমাবেশ! চিত্রক পূর্বেও একবার রাজকন্যাকে পুরুষবেশে দেখিয়াছিল; কিন্তু আজিকার পুরুষবেশ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বেশভূষার পৌরুষ দেহের অনবদ্য নারীত্বকে অলঙ্কৃত করিয়াছে, আবৃত করিতে পারে নাই। পুষ্পবৃন্তের ন্যায় কটিদেশ ঊর্ধ্বে ক্রমশ পরিসর হইয়া যেন কেশর কুসুমের শোভায় বিকশিত হইয়াছে; আপীন বক্ষের উপর দৃঢ়পিনদ্ধ সুবর্ণ জালিক যৌবনের উন্মাদনাকে স্বর্ণ শৃঙ্খলে বাঁধিয়া রাখিয়াছে। সর্বোপরি তীক্ষ্ণ-মধুর মুখখানি! এ মুখ কেবল রক্ত মাংসের সমাবেশে সুন্দর নয়, শুধুই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুষ্ঠু সমর্পণ নয়; মনে হয় মুখের অন্তরালে মানুষটিও বড় সুন্দর, তাই তাহার সৌন্দর্যের নিরুদ্ধ ছটা মুখেও প্রতিবিম্বিত হইয়াছে।
চিত্রকের অশান্ত মন কিন্তু শান্ত হইল না; বরং আরও বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। কেন এই রাজকন্যা তাহার সহিত এত মিষ্ট এত সদয় ব্যবহার করিতেছে? ইহা অপেক্ষা যদি নিজ পদগৌরবে গর্বিত হইয়া তাহাকে তুচ্ছজ্ঞান করিত সেও ভাল হইত। রাজকন্যা তাহার সত্য পরিচয় জানে না বলিয়াই এমন স্নিগ্ধ ব্যবহার করিতেছে। যদি জানিত তাহা হইলে কী করিত?
চিত্রক যখন কথা কহিল তখন তাহার কণ্ঠে এই প্রশ্নেরই প্রচ্ছন্ন প্রতিধ্বনি হইল; সে রট্টার দিক হইতে চক্ষু ফিরাইয়া ধাবমান অশ্বের নিষ্কম্প চামর শিখার উপর দৃষ্টি স্থাপন করিয়া গম্ভীরমুখে বলিল— ‘রক্ষীদের আগে যাইতে দিয়া আপনি ভাল করেন নাই।’
ভ্রূ বঙ্কিম করিয়া রট্টা বলিলেন— ‘তাহাতে কী দোষ হইয়াছে?’
চিত্রক বলিয়া উঠিল— ‘আপনি আমার কতটুকু জানেন? আমি যদি তস্কর দুর্বৃত্ত হই, আপনার অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করি, কে আপনাকে রক্ষা করিবে? জানি, দেবদুহিতা বীর্যবতী, আত্মরক্ষায় সমর্থ; তবু তিনি নারী। অজ্ঞাতকুলশীলকে অধিক বিশ্বাস করিতে নাই।’
অধরোষ্ঠ সঙ্কুচিত করিয়া রট্টা সম্মুখ দিকে চাহিলেন; তাঁহার মুকুলিত মুখের হাসিটি ফুটি ফুটি করিয়া ফুটিল না। ক্ষণেক পরে চিত্রকের পানে দৃষ্টি না ফিরাইয়াই তিনি মৃদুকণ্ঠে বলিলেন— ‘আপনি কি অজ্ঞাতকুলশীল?’ চিত্রক চকিতে তাঁহার পানে চাহিল।
রট্টা বলিয়া চলিলেন— ‘আসমূদ্র আর্যভূমির একচ্ছত্র অধীশ্বর স্কন্দগুপ্তের দূতকে অজ্ঞাতকুলশীল বলিলে স্কন্দগুপ্তের অবমাননা করা হয় না? কিন্তু এ সকল বৃথা তর্ক। আপনি যদি তস্কর দুর্বৃত্ত হইতেন তাহা হইলে এখনি যে কথা বলিলেন তাহা বলিতে পারিতেন কি? তস্কর কি নিজের বিরুদ্ধে অন্যকে সাবধান করিয়া দেয়?’
বলিয়া রট্টা উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। চিত্রকের ইচ্ছা হইল, সে রট্টাকে নিজের পূর্ণ পরিচয় জানাইয়া দিয়া তাহার মুখভাব নিরীক্ষণ করে। ঐ হাসিটি তখন কি অগ্নিদগ্ধ ফুলের মতই শুকাইয়া যাইবে না? অকুণ্ঠ বিশ্বাস-ভরা চোখে ত্রাস ফুটিয়া উঠিবে না?
কিন্তু চিত্রকের মনের ইচ্ছা বাক্যে পরিণত হইল না। তৎপরিবর্তে অধরপ্রান্তে একটি ক্ষীণ নিপীড়িত হাসি ফুটিয়া উঠিল।
রট্টা বলিলেন— ‘ও কথা থাক। — আর্য চিত্রক, আপনি নিশ্চয় অনেক দেশ দেখিয়াছেন? অনেক যুদ্ধ করিয়াছেন?’
চিত্রক সতর্কভাবে বলিল— ‘হাঁ। দূতীয়ালী আমার জীবনে এই প্রথম।’
রট্টা বলিলেন— ‘আপনি গল্প বলুন, আমার বড় শুনিবার ইচ্ছা হইতেছে।’
‘কী গল্প বলিব?’
‘আপনার যাহা ইচ্ছা। যুদ্ধের গল্প, দেশবিদেশের গল্প। পাটলিপুত্র কি খুব সুন্দর নগর?’
‘অতি সুন্দর নগর। এমন নগর আর্যাবর্তে নাই।’
‘কপোতকূট অপেক্ষাও সুন্দর?’
চিত্রক হাসিল; রট্টার এই বালিকাসূলভ সরলতা তাহার বড় মিষ্ট লাগিল। সে একটু ঘুরাইয়া বলিল— ‘কপোতকূটও সুন্দর নগর। কিন্তু কপোতকূট আকারে ক্ষুদ্র, পাটলিপুত্র বৃহৎ; ময়ূরের সঙ্গে কি পারাবতের তুলনা হয়?’
‘আর স্কন্দগুপ্ত? তিনি কিরূপ মানুষ?’
‘আমি সামান্য দূত, স্কন্দগুপ্তের নিকটে কখনও যাই নাই। দূর হইতে দেখিয়াছি, অতি সুন্দর পুরুষ। আর শুনিয়াছি, তিনি ভাবুক— অদৃষ্টবাদী—’
রট্টা রমণীসুলভ প্রশ্ন করিলেন— ‘তাঁহার কয়টি মহিষী?’
চিত্রক বলিল— ‘স্কন্দ কুমারব্রতধারী, বিবাহ করেন নাই।’
রট্টা বিস্ফারিত নেত্রে বলিলেন— ‘আশ্চর্য।’
চিত্রক নিজের কথা ভাবিতে ভাবিতে বলিল— ‘আশ্চর্য বটে! কিন্তু এরূপ আশ্চর্য ঘটনা পৃথিবীতে অনেক ঘটিয়া থাকে। আমার যোদ্ধৃজীবনে অনেক দেখিয়াছি।’
‘তবে সেই সব কাহিনী বলুন। আমি শুনিব।’
রট্টার আগ্রহ দেখিয়া চিত্রক একটু হাসিল। অজানিতভাবে তাহার মনের তিক্ততা দূর হইতেছিল। মনের মধ্যে অনেক বিরুদ্ধ ভাবনা জমা হইলে মানুষ হৃদয়ভার লাঘব করিতে চাহে, আত্মকথা বলিবার সুযোগ পাইলে সুখী হয়। চিত্রক ধীরে ধীরে নিজ জীবনের অনেক কাহিনী বলিতে লাগিল। কেবল আত্ম-পরিচয়টি গোপন করিয়া আর সব সত্য কথা বলিল। যুদ্ধের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানা দেশের নানা মানুষের অদ্ভুত আচার ব্যবহার, তাহাদের বেশবাস কথাবার্তা—
এদিকে ঘোড়া দুইটি চলিয়াছে; পথেরও বিরাম নাই। উপত্যকায় ছায়াশীতল হইয়া, অধিত্যকায় রবিতপ্ত হইয়া, কদাচিৎ গিরি নির্ঝরিণীর জলে অঙ্গ ডুবাইয়া পথ চলিয়াছে। কিন্তু পথের দিকে কাহারও লক্ষ্য নাই! রট্টা তন্ময় হইয়া গল্প শুনিতেছেন।
যে গল্প বলে এবং যে গল্প শোনে তাহাদের মধ্যে ক্রমশ মনোগত ঐক্য স্থাপিত হয়, দুইটি মন এক সুরে বাঁধা হইয়া যায়। চিত্রক গল্প বলিতে বলিতে কদাচিৎ সচেতন হইয়া ভাবিতেছিল— কী আশ্চর্য, মনে হইতেছে আমি একান্ত আপনার জনকে আপনার জীবন-কথা শুনাইতেছি! আর রট্টা— তিনি বোধহয় কিছুই ভাবিতেছিলেন না, শুধু এই জল্পকের সত্তার মধ্যে নিমগ্ন হইয়া গিয়াছিলেন।
দীর্ঘকাল নানা কাহিনী বলিবার পর চিত্রক যেন চমকিয়া সজাগ হইয়া উঠিল, অপ্রতিভভাবে বলিল— ‘আর না, নিজের কথা অনেক বলিয়াছি।’
রট্টা বলিলেন— ‘আরও বলুন।’
চিত্রক হাসিল; একটু পরিহাস করিয়া বলিল— ‘রাজকন্যাদের কি ক্ষুধা তৃষ্ণার বালাই নাই? ওদিকে বেলা কত হইয়াছে তাহার সংবাদ রাখেন কি?’
রট্টা চকিতে ঊর্ধ্বে চাহিলেন। সূর্য মধ্য গগনে। কখন কোন দিক দিয়া সময় কাটিয়া গিয়াছে তিনি জানিতে পারেন নাই।
রট্টা বলিলেন— ‘ছি ছি, এত গল্প বলিয়া নিশ্চয় আপনার ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছে।’
চিত্রক বলিল— ‘তা হইয়াছে। আপনার?’
রট্টা সলজ্জে হাসিলেন— ‘আমারও। এতক্ষণ জানিতে পারি নাই। কিন্তু উপায় কি? সঙ্গে তো খাদ্যদ্রব্য নাই।’
‘উপায় আছে। ঐ দেখুন—’ বলিয়া চিত্রক পার্শ্বের দিকে অঙ্গুলি তুলিয়া দেখাইল।
পাশাপাশি দুই শ্রেণী পাহাড়ের মাঝখানে অপরিসর উপত্যকা, পথটি তাহার উপর দিয়া গিয়াছে। বাম পার্শ্বের পাহাড়ে কিছু উচ্চে পাষাণগাত্রে সারি সারি কয়েকটি চতুষ্কোণ রন্ধ্র দেখা যায়; পাথর কাটিয়া মানুষের বাসস্থান রচিত হইয়াছে। চিত্রকের অঙ্গুলি নির্দেশ অনুসরণ করিয়া রট্টা দেখিলেন— একটি দেবায়তন; সম্ভবত বুদ্ধের সংঘ। এখানে যে মনুষ্য বাস করে তাহার প্রমাণ, একটি গবাক্ষ হইতে পীতবর্ণ বস্ত্র লম্বিত হইয়া অলস বাতাসে দুলিতেছে।
চিত্রক বলিল— ‘যখন বস্ত্র আছে তখন মানুষ অবশ্য আছে; মানুষ থাকিলেই খাদ্য থাকিবে। সুতরাং আর বিলম্ব না করিয়া ঐ দিকে যাওয়াই কর্তব্য।’
রট্টা হাসিয়া সম্মতি দিলেন। কিন্তু ঘোড়ার পিঠে ওখানে ওঠা যাইবে না। ঘোড়া দু’টিকে একটি শম্পাকীর্ণ স্থানে ছাড়িয়া দিয়া উভয়ে পাহাড়ের চড়াই ধরিলেন।
স্থানটি উচ্চ হইলেও দুরধিগম্য নয়; উপরন্তু মনুষ্যপদচিহ্নিত একটি ক্ষীণ পথরেখা আছে। শিলাবন্ধুর অসমতল পর্বতগাত্র বাহিয়া চিত্রক অগ্রে চলিল; রট্টা তাহার পশ্চাতে রহিলেন।
অর্ধদণ্ড পরে উপরে উঠিয়া রট্টা দেখিলেন, সংঘই বটে; পাষাণে উৎকীর্ণ কয়েকটি কক্ষ, সম্মুখে সমতল চত্বর। চত্বরের মধ্যস্থলে তথ্যগতের শিলামূর্তি। উপত্যকা হইতে যে গবাক্ষগুলি দেখা গিয়াছিল তাহা সংঘের পশ্চাৎভাগ।
রট্টা প্রথমে বুদ্ধের ধ্যানাসীন মূর্তির সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন। চিত্রকও পাশে দাঁড়াইল।
রট্টা জোড়হস্তে ভক্তিনম্র কণ্ঠে বলিলেন— ‘নমো তস্স ভগবতো অরহতো সম্মা সম্বুদ্ধস্স।’ যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করিয়া রট্টা চিত্রককে বলিলেন— ‘আপনিও ভগবানকে প্রণাম করুন। বলুন, নমো তস্স ভগবতো অরহতো সম্মা সম্বুদ্ধস্স—’
রট্টার অনুসরণ করিয়া চিত্রক ভগবান তথাগতকে প্রণতি জানাইল; তারপর ঈষৎ বিস্ময়ে রট্টার দিকে ফিরিয়া প্রশ্ন করিল— ‘আপনি এ মন্ত্র কোথায় শিখিলেন?’
রট্টা বলিলেন— ‘আমার পিতার কাছে।’
প্রাঙ্গণে এতক্ষণ অন্য কেহ ছিল না; এখন প্রকোষ্ঠের ভিতর হইতে একটি পীতবেশধারী শ্রমণ বাহির হইয়া আসিলেন। মুণ্ডিত মস্তক, শীর্ণ কলেবর, মুখে প্রসন্ন বৈরাগ্য। সহাস্যে দুই হস্ত তুলিয়া বলিলেন— ‘আরোগ্য।’
রট্টা বদ্ধাঞ্জলি হইয়া বলিলেন— ‘আর্য, আমরা দুইজনে ক্ষুধার্ত পান্থ; বুদ্ধের প্রসাদ ভিক্ষা করি।’
ভিক্ষু বলিলেন— ‘রট্টা যশোধরা, বুদ্ধ তোমার প্রতি প্রসন্ন। এস, তোমরা ভিতরে এস।’ ভিক্ষু তাহাকে চিনিয়াছেন দেখিয়া রট্টার মুখ আনন্দে উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন— ‘আর্য, আমাকে চিনিলেন কি করিয়া? পূর্বে কি দেখিয়াছেন?’
ভিক্ষু বলিলেন— ‘দেখি নাই, তোমার বেশভূষা হইতে অনুমান করিয়াছি। মহারাজ ধর্মাদিত্যের কাছে যাইতেছ?’
‘আজ্ঞা। ইনি আমার সহচর, মগধের রাজদূত।’
ভিক্ষু একবার চিত্রকের প্রতি স্মিতদৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন; কিছু বলিলেন না।
অতঃপর সংঘচ্ছায়ায় প্রবেশ করিয়া হস্তমুখ প্রক্ষালনপূর্বক পথিক দুইজন একটি প্রকোষ্ঠে বসিলেন। ভিক্ষু তাহাদের জন্য খাদ্য আনিয়া দিলেন; কিছু দ্বিদল সিদ্ধ, কিছু সিক্ত চিপিটক, কয়েকটি শুষ্ক দ্রাক্ষাফল ও খর্জুর। ক্ষুধার সময়; উভয়ে পরম তৃপ্তির সহিত তাহাই অমৃতজ্ঞানে আহার করিতে লাগিলেন।
আহারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু কথোপকথন হইতে লাগিল।
রট্টা জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘দেব, এখানে আপনারা কয়জন আছেন? আর কাহাকেও দেখিতেছি না।’
ভিক্ষু বলিলেন— ‘আমরা চারিজন আছি। দুইজন রন্ধ্রে জল ভরিতে গিয়াছেন। একজন পীড়িত।’
রট্টা মুখ তুলিলেন— ‘পীড়িত? কী পীড়া?’
ভিক্ষু ঈষৎ হাসিলেন— ‘সংসার-পীড়া। সংঘে থাকিলেও মারের হস্ত হইতে নিস্তার নাই।’
চিত্রক প্রশ্ন করিল— ‘আপনারা এখানে নিঃসঙ্গ থাকেন? দিবারাত্র কি করেন?’
ভিক্ষু বলিলেন— ‘সংসার ভুলিবার চেষ্টা করি।’
আহারান্তে আচমন করিয়া রট্টা আবার আসিয়া বসিলেন, বলিলেন— ‘আর্য কিছু উপদেশ দিন।’
ভিক্ষু হাসিলেন— ‘আমি আর কী উপদেশ দিব? সহস্র বৎসর পূর্বে শাক্যমুনির শ্রীমুখ হইতে যে বাণী নিঃসৃত হইয়াছিল তাহাই শুন। — ‘মন হইতে প্রবৃত্তির উৎপত্তি; মন যদি নিষ্কলুষ থাকে, সুখ ছায়ার মত তোমার পিছনে থাকিবে।”
রট্টা প্রণাম করিয়া বলিলেন— ‘আমি ধন্য।’— ভিক্ষুর পদপ্রান্তে একটি স্বর্ণদীনার রাখিয়া বলিলেন— ‘সংঘের অর্ঘ্য।’
ভিক্ষু বলিলেন— ‘স্বর্ণের প্রয়োজন নাই। কল্যাণি, যদি সংঘকে দান করিতে ইচ্ছা কর, এক আঢ়ক গোধূম দিও। দীর্ঘকাল আমরা গোধূম দেখি নাই। যে শ্রমণটি অসুস্থ তিনি গোধূমের জন্য কিছু কাতর হইয়াছেন।’ বলিয়া মৃদু হাসিলেন।
‘সত্বর পাঠাইব’— বলিয়া রট্টা গাত্রোত্থান করিলেন।
চিত্রক দণ্ডায়মান ছিল; সে শুষ্কস্বরে বলিল— ‘মহাশয়, আমাকেও কিছু উপদেশ করুন।’
ভিক্ষু প্রশান্ত চক্ষু তাহার পানে তুলিয়া গভীরকণ্ঠে বলিলেন— ‘শাক্যমুনির উপদেশ শ্রবণ কর: ‘সে আমাকে গালি দিয়াছে, আমাকে প্রহার করিয়াছে, নিঃস্ব করিয়াছে’ — এই কথা যে চিন্তা করে তাহার ক্রোধ কখনও শান্ত হয় না। বৈরভাব কেবল অবৈরভাব দ্বারা শান্ত হয় ইহাই চিরন্তন ধর্ম।’
দুই অশ্বারোহী আবার চলিয়াছেন। সূর্য তাঁহাদের বামে ঢলিয়া পড়িয়াছে। তির্যক অংশু তেমন তীক্ষ্ণ নয়।
দুই অশ্বারোহী নিজ নিজ অন্তরে নিমগ্ন; বাক্যালাপ অধিক হইতেছে না। চিত্রক গল্প বলিবার কালে রট্টার প্রতি যে অন্তরঙ্গতা অনুভব করিয়াছিল, তাহা আবার সংশয়ের কুজ্ঝটিকায় আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে।
ভিক্ষু যে-কথা বলিলেন তাহার অর্থ কি? বৈরভাবের পরিবর্তে বৈরভাব পোষণ করাই স্বাভাবিক, অবৈরভাব কি করিয়া পোষণ করা যায়? ইহা ভিক্ষুর ধর্ম হইতে পারে, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম কদাচ নয়। প্রতিহিংসা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। শুধু তাহাই নয়, ইহা চিত্রকের প্রকৃতিগত স্বধর্ম। ইহা তাহার ধাতু।
অথচ— এত সুযোগ পাইয়াও সে রট্টার উপর প্রতিহিংসা সাধন করিতে পারিতেছে না কেন? রট্টা সুন্দরী যৌবনবতী নারী— এই জন্য? সুন্দরী নারীর মোহে সে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম বিস্মৃত হইবে? পিতৃহত্যার প্রতিশোধ লইবে না?
সহসা মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বিদ্যুচ্চমকের ন্যায় একটি চিন্তা চিত্রকের মনে খেলিয়া গেল। সে উচ্চকিত হইয়া বিস্ফারিত নেত্রে আকাশের পানে চাহিল। কোন্ মূঢ়তার জালে তাহার মন এতক্ষণ জড়াইয়া ছিল? একথা তাহার মনে উদয় হয় নাই কেন?
সে মনে মনে বলিল— আমি ক্ষত্রিয়, বৈরতা আমার স্বধর্ম; কিন্তু রট্টার সহিত বৈরতা করিব কেন? সে আমার অনিষ্ট করে নাই। তাহার পিতার অপরাধে তাহাকে দণ্ড দেওয়া ক্ষত্রিয়ধর্ম নয়! যদি প্রতিশোধ লইতে হয় তাহার পিতার উপর লইব।
দারুণ সমস্যার সমাধান হইলে হৃদয় লঘু হয়। মুহূর্তে চিত্রকের অন্তরের কুজ্ঝটিকা কাটিয়া গিয়া আনন্দের দিব্য জ্যোতি ফুটিয়া উঠিল। সে উৎফুল্ল নেত্রে রট্টার পানে চাহিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল।
চকিতে স্মিত নেত্র তুলিয়া রট্টা বলিলেন— ‘কি হইল?’
চিত্রক বলিল— ‘ভিক্ষু বলিয়াছিলেন, সুখ ছায়ার মত আপনার সঙ্গে সঙ্গে থাকিবে। ঐ দেখুন সেই ছায়া।’
রট্টা ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেন, সঞ্চরমাণ অশ্বারূঢ় ছায়া নাচিতে নাচিতে তাঁহার সঙ্গে চলিয়াছে।
উভয়ে একসঙ্গে হাসিয়া উঠিলেন।
চারিদিকে বিস্তীর্ণ তরঙ্গায়িত উপত্যকা। পাহাড় দূরে সরিয়া গিয়াছে। দূর হইতে তাঁহাদের হাসির গদ্গদ প্রতিধ্বনি ফিরিয়া আসিল। যেন মিলন মুহূর্তের সলজ্জ চুপিচুপি হাসি। কানে কানে হাসি।