পাহাড়চুড়োর মানব
আমার প্রাইভেট ডায়ারির কিছু অংশ উদ্ধৃত করে গত পরিচ্ছেদ শেষ করেছি। কাহিনি ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই সময় থেকেই ভয়ংকর পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে বিচিত্র ঘটনার পর ঘটনা। পরের কয়েকদিনের ব্যাপার অবিশ্বাস্যভাবে স্মৃতিপটে দাগ কেটে বসে গেছে। ডায়ারির সাহায্য না-নিয়েই লিখতে পারব। দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যেদিন আবিষ্কার করলাম, কাহিনির জের তুলে নেওয়া যাক তার পরের দিন থেকে। প্রথম ঘটনা হল, যে-জায়গায় এবং যে-সময়ে স্যার চার্লস মারা গেছেন, ঠিক সেই জায়গায় এবং সেই সময়ে তার সঙ্গে দেখা করার জন্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন কুমবে ট্রেসি নিবাসিনী মিসেস লরা লায়ন্স। দ্বিতীয় ঘটনাটা, পাহাড়ের গায়ে যে প্রস্তুর-কুটির, বাদার রহস্যজনক আততায়ী ওত পেতে আছে তার মধ্যে। এহেন দুটো ঘটনা জানবার পর ভেবে দেখলাম অন্ধকারাচ্ছন্ন এই দুই ক্ষেত্রে যদি আলোকপাত করতে না-পারি, তাহলে বুঝতে হবে, হয় বুদ্ধি অথবা সাহস এই দুটোর একটায় ঘাটতি আছে আমার মধ্যে।
মিসেস লায়ন্স সম্বন্ধে আগের দিন সন্ধ্যায় কী খবর সংগ্রহ করেছি, স্যার হেনরিকে তা বলবার সুযোগ পাইনি। কেননা, অনেক রাত পর্যন্ত তাসের আড্ডায় মেতে ছিলেন উনি ডক্টর মর্টিমারের সঙ্গে। প্রাতরাশ খেতে বসে বললাম আমার আবিষ্কার কাহিনি। জিজ্ঞেস করলাম, কুমবে-ট্রেসিতে আমার সঙ্গে আসতে পারবেন কি না। প্রথমে দারুণ উৎসাহ দেখালেন। পরে দু-জনেই ভেবে দেখলাম, আমি একা গেলেই বরং ফলটা ভালো হতে পারে। সাক্ষাৎকার যত শিষ্টাচারসংগত হবে, খবর ততই কম পাব। স্যার হেনরিকে তাই বাড়িতে রেখে একাই রওনা হলাম তদন্তে। একলা রেখে যাওয়ার জন্যে বিবেকের দংশন অনুভব করলাম অবশ্য, কিন্তু উপায় কী।
কুমবে-ট্রেসিতে পৌঁছে পার্কিন্সকে বললাম ঘোড়া খুলে রাখতে। তারপর বেরোলাম যাকে জেরা করব বলে এসেছি, সেই মহিলাটির খোঁজখবর নিতে। অনায়াসেই খুঁজে পেলাম মিসেস লায়ন্সের সাজানো গোজানো আস্তানা। বিনা ভূমিকায় একজন পরিচারিকা ভেতরে নিয়ে গেল আমাকে। বসবার ঘরে একটা রেমিংটন টাইপ রাইটারের সামনে বসে ছিল এক মহিলা। আমি ঢুকতেই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল স্মিত স্বাগত মুখে। আমার অচেনা মুখ দেখে অবশ্য হাসি মিলিয়ে গেল পরক্ষণেই। ফের বসল চেয়ারে। জিজ্ঞেস করল কী অভিপ্রায় আমার।
মিসেস লায়ন্স সম্পর্কে প্রথমেই যে-ছাপটা আমার মনে দাগ কেটে বসে গেল, তা হল তার অসামান্য সৌন্দর্য। চুল আর চোখ দুটোই হ্যাজেল বাদামের মতন উজ্জ্বল পিঙ্গলবর্ণ। গালে যদিও অজস্র ফুট ফুট দাগ, কিন্তু শ্যামা সুন্দরীর অতুলনীয় গণ্ডরাগের মতোই তা রক্তিমাভগন্ধক-গোলাপের মাঝে সূক্ষ্ম গোলাপের আভার মতন। আবার বলছি, এ-রূপ দেখলেই রূপের তারিফটাই আগে জেগে ওঠে মনের মধ্যে। তারপরেই জাগ্রত হয় সমালোচনার ইচ্ছে। মুখটার মধ্যে কোথায় যেন একটা ত্রুটি থেকে গিয়েছে যার ফলে অমন সৌন্দর্যও মাঠে মারা গিয়েছে। খুটা সূক্ষ্মভাবে লুকিয়েই আছে মুখের কোথাও, হয়তো স্থূল মুখভাবের মধ্যে, অথবা হয়তো চোখের কাঠিন্যের মধ্যে, অথবা শিথিল ঠোঁটের মধ্যে। এসব চিন্তা অবশ্য পরে মাথায় এসেছিল। সেই মুহূর্তে সচেতন ছিলাম শুধু একটা ব্যাপারে অত্যন্ত রূপসী এক মহিলার সামনে এসেছি আমি এবং আমার আসার কারণটা সে জানতে চাইছে। কী কঠিন কাজ নিয়ে যে এসেছি, আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।
বললাম, আপনার বাবাকে আমি চিনি।
খুবই কৌশলহীন পরিচয়-পর্ব। ভদ্রমহিলা অচিরাৎ তা সমঝে দিল আমাকে।
বললে, বাবা আর আমার মধ্যে তিলমাত্র মিল কোথাও নেই। আমি তার ধার ধারি না। বাবার বন্ধুরাও আমার বন্ধু নয়। স্যার চার্লস বাস্কারভিল এবং আরও কয়েকজন সহৃদয় ব্যক্তি দয়া না-করলে অনাহারে মরতে হত আমাকে বাবার ইচ্ছেও ছিল তাই।
স্যার চার্লস বাস্কারভিলের ব্যাপারেই আপনার কাছে আমি এসেছি।
ফুট ফুট দাগগুলো প্রকট হয়ে ওঠে ভদ্রমহিলার গালে।
টাইপরাইটারের উপর স্নায়ুদুর্বল আঙুল কেঁপে ওঠে ভদ্রমহিলার। নার্ভাস হয়েছে। বললে, ওঁর সম্বন্ধে আমি কী বলব বলুন?
ওঁকে আপনি চিনতেন, নয় কি?
আগেই বলেছি তার ঋণ শোধ করতে পারব না। তিনি কৃপা না-করলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতাম না।
চিঠি লিখতেন ওঁকে?
চকিতে চোখ তোলেন ভদ্রমহিলা, পিঙ্গল চোখে জাগে ক্রুদ্ধ চাহনি।
শুধোয় তীক্ষ্ণ্ম কণ্ঠে, এসব প্রশ্নের উদ্দেশ্য কী?
উদ্দেশ্য প্রকাশ্য কেলেঙ্কারি এড়ানো। বিষয়টা হাতের বাইরে যাওয়ার আগে তাই এখানে জিজ্ঞেস করে নেওয়াই মঙ্গল।
চুপ করে রইল মিসেস লায়ন্স। দারুণ ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুখ। তারপর কিছুটা মরিয়া এবং উদ্ধতভাবে তাকাল আমার পানে।
বললে, ঠিক আছে, জবাব দেব। বলুন, কী জিজ্ঞেস করবেন?
স্যার চার্লসকে চিঠি লিখতেন?
ওঁর বদান্যতা, অন্যের প্রতি দরদ যে আমাকে কতখানি স্পর্শ করেছে, তা বোঝানোর জন্যে দু-একবার লিখেছি।
চিঠিগুলোর তারিখ মনে আছে?
না। দেখাসাক্ষাৎ কখনো হয়েছে?
দু-একবার হয়েছে। কুমবে-ট্রেসিতে যখন এসেছিলেন, তখন। উনি অবসর জীবন যাপন করতেন। যা করতেন, গোপনে করতেন ঢাকঢোল পিটিয়ে লোকের উপকার করা পছন্দ করতেন না।
দেখাসাক্ষাৎ আর চিঠি লেখালেখি যদি এতই কম হত তো আপনার সম্বন্ধে এত খবর উনি পেলেন কী করে যে এতখানি উপকার করে বসলেন?
কঠিন পরিস্থিতি। কিন্তু জবাব যেন তৈরি ছিল।
আমার খারাপ অবস্থার খবর কয়েকজন ভদ্রলোক রাখতেন। এঁদের একজন মি. স্টেপলটন। আমার প্রতিবেশী এবং স্যার চার্লসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি। স্যার চার্লস এঁর মুখেই আমার দুঃখের ইতিহাস শুনেছিলেন।
বেশ কয়েক ক্ষেত্রে দান-খয়রাতটা স্টেপলটনের হাত দিয়েই সারতেন স্যার চার্লস, সে-খবর আমি পেয়েছিলাম। তাই ভদ্রমহিলার কথার মধ্যে সত্যের ছোঁয়াচ পেলাম।
প্রশ্নবর্ষণ কিন্তু চালিয়ে গেলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে স্যার চার্লসকে কখনো লিখেছিলেন?
আবার জ্বলে উঠল মিসেস লায়ন্স।
দেখুন মশায়, এ তো বড়ো অস্বাভাবিক প্রশ্ন করছেন।
দুঃখিত, ম্যাডাম, কিন্তু আবার একই প্রশ্ন করছি।
তাহলে জবাব দিচ্ছি–নিশ্চয় না। স্যার চার্লস যেদিন মারা যান সেদিনও না?
মুহূর্তের মধ্যে মড়ার মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল ক্রোধারুণ মুখখানা। শুষ্ক ঠোঁট নেড়ে বলল কোনোমতে, না। শুধু ঠোঁটই নড়ল শব্দ বেরুলো না। চোখ দিয়ে দেখলাম না বলাটা কান দিয়ে শুনলাম না।
বললাম, নিশ্চয় স্মৃতি প্রতারণা করছে আপনাকে। আপনার লেখা চিঠির একটা লাইন পর্যন্ত শুনিয়ে দিতে পারি জানবেন। শুনবেন? আপনি প্রকৃত ভদ্রলোক বলেই মিনতি করছি দয়া করে এই চিঠি পুড়িয়ে ফেলবেন এবং ঠিক দশটার সময়ে গেটে হাজির থাকবেন।
ভাবলাম বুঝি অজ্ঞান হয়ে গেল মিসেস লায়ন্স। কিন্তু প্রবল চেষ্টায় সামলে নিল নিজেকে।
বললে সঘন নিশ্বাসে, ভদ্রতা বস্তুটা কি একেবারেই নেই?
অবিচার করছেন স্যার চার্লসের ওপর। চিঠিটা উনি পুড়িয়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু পোড়া চিঠি কখনো পড়া যায়। চিঠি লিখেছিলেন তাহলে মানছেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, লিখেছিলাম, অন্তরাত্মাকে যেন বাক্য প্রপাতের মধ্যে মিশিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললে মিসেস লায়ন্স, হ্যাঁ, আমিই লিখেছিলাম। অস্বীকার করব কোন দুঃখে? লিখেছি বলে লজ্জাই-বা কীসের? ওঁর সাহায্য আমি চেয়েছিলাম। দেখা করতে চেয়েছিলাম সেই কারণে। সাক্ষাতে বুঝিয়ে বলতাম–সাহায্য ঠিক পেতাম।
কিন্তু ওইরকম সময়ে কেন?
কেননা পরের দিন সকালেই উনি লন্ডন যাচ্ছিলেন শুনেছিলাম–মাস-কয়েকের আগে ফিরবেনও না। কারণ ছিল বলেই আগেভাগে দেখা করে উঠতে পারিনি।
কিন্তু বাড়ির মধ্যে দেখা না-করে বাগানের মধ্যে কেন?
ব্যাচেলারের বাড়িতে ওই সময়ে কোনো মহিলা একা যেতে পারে?
আপনি যাওয়ার পর কী হল?
আমি যাই-ই নি।
মিসেস লায়ন্স! হলপ করে বলছি, আমি যাইনি। বাইবেল-টাইবেল যা পারেন নিয়ে আসুন–ছুঁয়ে বলব আমি যাইনি। হঠাৎ একটা বাধা পড়েছিল বলে যাইনি।
কী বাধা?
ব্যক্তিগত ব্যাপার। বলতে পারব না।
আপনি তাহলে স্বীকার করছেন, স্যার চার্লস যে-জায়গায় সে সময়ে মারা যান, আপনি সেই সময়ে সেই জায়গায় তার সঙ্গে দেখা করব বলেছিলাম–কিন্তু যাননি?
কথাটা সত্যি।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক জেরা করলাম, কিন্তু এর বেশি এগোতে পারলাম না।
শেষকালে সুদীর্ঘ কিন্তু অসম্পূর্ণ সাক্ষাৎকার স্থগিত রেখে উঠে পড়লাম আমি। বললাম, মিসেস লায়ন্স, যা জানেন তা খুলে না-বলে আপনি বিরাট ঝুঁকি নিচ্ছেন এবং নিজের অবস্থা সঙিন করে তুলছেন। পুলিশের শরণ নিলে কিন্তু মহা ফাঁপরে পড়বেন। নিরাপদ বলে যদিই মনে করেন নিজেকে তো ওই তারিখেই স্যার চার্লসের সঙ্গে চিঠি লেখার কথা প্রথমে অস্বীকার করলেন কেন?
পাছে এ থেকে যা নয় তা ভেবে নেওয়া হয়, শেষ পর্যন্ত হয়তো কেলেঙ্কারিতে ফাঁসিয়ে দেওয়া হতে পারে আমাকে এই ভয়ে বলিনি।
চিঠিখানা পুড়িয়ে ফেলার জন্যে স্যার চার্লসের ওপর এত চাপ দিয়েছিলেন কেন?
চিঠিখানা পড়া থাকলে বুঝতেন, কেন।
পুরো চিঠি পড়েছি তো বলিনি।
কিছুটা অংশ তো বললেন।
শুধু পুনশ্চটুকু বললাম। চিঠি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল বলেই সব জায়গা পড়া যায়নি। প্রশ্নটা আবার করছি। যেদিন মারা যান স্যার চার্লস, সেইদিনই যে চিঠি উনি হাতে পেয়েছিলেন–তা পুড়িয়ে ফেলার জন্যে কেন এত জেদ ধরেছিলেন?
ব্যাপারটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত।
প্রকাশ্য তদন্ত দেখছি এড়াতে পারবেন না।
তাহলে বলছি শুনুন। আমার দুঃখের ইতিহাস যদি শুনে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় জানেন হুট করে বিয়ে করে ফেলে পরে আমাকে পস্তাতে হয়েছে?
ওইটুকুই শুনেছি।
এ-জীবনে ক্রমাগত নিগ্রহই পেয়ে আসছি স্বামীর কাছ থেকে যে-স্বামীকে আমি ঘৃণ। করি মনেপ্রাণে। আইন তার পক্ষে, যেকোনো দিন জোর করে তার সঙ্গে ঘর করতে বাধ্য করতে পারে আমাকে। স্যার চার্লসকে চিঠিখানা যখন লিখি, তখন একটা খবর কানে এসেছিল। একটু টাকাপয়সা খরচা করলে এ-জীবনের মতো ওর হাত থেকে নিস্কৃতি পেয়ে যাব। আমার কাছে এর চাইতে বড়ো কাম্য আর নেই–স্বাধীনতা পেলেই পাব সুখ, শান্তি, আত্মসম্মান—সমস্ত। স্যার চার্লসের বদান্যতার খবর কে না-জানে বলুন। আমার মুখের এ-কাহিনি যদি শোনেন, সাহায্য না-করে পারবেন না। তাই চিঠি লিখে পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলাম।
তবে গেলেন না কেন?
তার আগেই হঠাৎ এক জায়গা থেকে সাহায্য পেয়ে গেলাম বলে।
সঙ্গেসঙ্গে স্যার চার্লসকে লিখে জানালেন না কেন?
তাই জানাতাম। কিন্তু পরের দিন সকালে পড়লাম ওঁর মৃত্যুসংবাদ।
ভদ্রমহিলার গল্পে বাঁধুনি আছে। এত জেরা করেও আলগা করতে পারলাম না। যাচাই করার রাস্তা এখন একটাই। স্যার চার্লস যখন মারা যান, সেই সময়ে কি তার আগে পরে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা সত্যিই রুজু করা হয়েছে কিনা, খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
সত্যিই যদি বাস্কারভিল হলে গিয়ে থাকত, অস্বীকার করার সাহস হত না। কেননা, দু-চাকায় টানা হালকা ঘোড়ার গাড়ি না-নিলে যাওয়া সম্ভব হত না এবং রাত একটা দুটো বেজে যেত কুমবে-ট্রেসি ফিরতে। এহেন অভিযান গোপন রাখা যায় না। তাহলে ভদ্রমহিলা হয় পুরো সত্যি বলছে, না হয় আংশিক সত্য বলছে। যুগপৎ হতাশ এবং হতবুদ্ধি হয়ে ফিরে এলাম। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোনোর সব রাস্তাই আবার যেন রুদ্ধ মনে হল–যে-পথ ধরেছি, সেই পথই দেখছি পাঁচিল তুলে বন্ধ করা। অথচ ভদ্রমহিলার মুখ আর কথার ধরন যেন কেমনতরো। যত ভাবছি, ততই মনে হচ্ছে, কী যেন লুকিয়ে গেল আমার সামনে। এত ফ্যাকাশেই-বা হল কেন? জোর করে স্বীকারোক্তি বার করতে হয়েছে পেট থেকে তার আগে সব কথাই-বা অস্বীকার করতে গেল কেন? মৃত্যু যখন ঘনিয়ে এল স্যার চার্লসের জীবনে, ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ তার না-যাওয়ার অনীহা জাগ্রত হল কেন? কারণগুলো নির্দোষ, এইটাই সে বিশ্বাস করাতে চায় আমাকে আমার কিন্তু মোটেই বিশ্বাস হয় না। আপাতত এই নিয়ে আর এগোতে পারছি না ঠিকই, কিন্তু আর একটা সূত্র হাতে রয়েছে। এইবার তাই নিয়ে পড়া যাক। বাদার বুকে প্রস্তর-কুটিরে হানা দিয়ে দেখা যাক।
সেটাও একটা অতীব অস্পষ্ট ব্যাপার। গাড়িতে চেপে ফেরবার পথে তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। দেখলাম সারি সারি অগুনতি পাথরের কুটির সুদূর অতীতে প্রাচীন মানবরা একদা এখানেই বসবাস করেছে। ব্যারিমুর কেবল বলেছে, এইরকমই একটা কুটিরে সেই আগন্তুক থাকে। কিন্তু কুটির তত রয়েছে শয়ে শয়ে–সমস্ত বাদার বুকে ছড়ানো। অবশ্য পথের নির্দেশ সংগ্রহ করব আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। লোকটাকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি কালো পাহাড়ের চূড়ায়। সেই জায়গাকে কেন্দ্র করেই তল্লাশি চালাতে হবে। এখান থেকে আরম্ভ করে জলার প্রত্যেকটা কুটিরে আমি অভিযান চালাব–সঠিক কুটির না-পাওয়া পর্যন্ত। যদি তাকে দেখতে পাই, দরকার হলে রিভলবার সামনে ধরে সোজা জিজ্ঞেস করব, কে সে, কেনই-বা এতদিন ফেউয়ের মতন লেগে আছে পেছনে। রিজেন্ট স্ট্রিটের ভিড়ে চোখে ধুলো দিতে পারে, কিন্তু জনহীন বাদায় ঘাবড়ে যাবে। যদি কুটিরের সন্ধান পাওয়ার পরেও দেখি লোকটা ভিতরে নেই–ওত পেতে বসে থাকব যতক্ষণ না সে ফেরে। হোমস তাকে লন্ডনে ধরতে পারেনি। গুরু যা পারেনি, আমি যদি তা পারি এখানে, তাহলে বিজয় গর্বে বুক দশ হাত হবে।
এ-তদন্তে গোড়া থেকেই ভাগ্য বিরূপ হয়েছে আমাদের প্রতি, এবার কিন্তু তা সহায় হল। সাহায্যটা এল মি. ফ্রাঙ্কল্যান্ডের মাধ্যমে। হাইরোডের ওপরেই ওঁর বাগানের ফটকের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম। মুখ লাল, গালপাট্টা সাদা।
গাড়ির মধ্যে আমাকে দেখেই অনভ্যস্ত উল্লসিত কণ্ঠে বললেন, শুভদিন ডক্টর ওয়াটসন। ঘোড়াটাকে একটু জিরেন দিন। ভেতরে আসুন। এক গেলাস সুরাপান করুন এবং আমাকে
অভিনন্দন জানিয়ে যান।
নিজের মেয়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের ওইরকম দুর্ব্যবহারের বৃত্তান্ত শোনবার পর থেকেই ভদ্রলোকের উপর মেজাজ খিচড়ে ছিল আমার। কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি সমেত পার্কিন্সকে বললাম, স্যার, হেনরিকে যেন বলে আমি হেঁটে বাড়ি ফিরব ডিনার খাওয়ার আগেই! তারপর ফ্রাঙ্কল্যান্ডের পেছন পেছন গেলাম তার খাওয়ার ঘরে।
অকারণে খিকখিক করে বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে বললেন বুড়ো, মশাই, আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরণীয়! বিরাট কাণ্ড করেছি আজকে। একসঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটিয়ে বসে আছি। এ-তল্লাটের লোকগুলোকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেব আইন কাকে বলে এবং টের পাইয়ে দেব অন্তত একজন এখনও আছে যে আইনের শরণ নিতে ডরায় না। বুড়ো মিডলটনের বাগানের মধ্যে দিয়ে রাস্তার অধিকার আজ বার করছি–ওরই সদর দরজার এক-শো গজের মধ্য দিয়ে যাবে রাস্তাটা। দারুণ ব্যাপার, নয় কি? সাধারণের অধিকার কেড়ে নেওয়া যে মুখের কথা নয়, তালেবর লোকগুলো বুঝুক! আরও শুনবেন? ফার্নওয়ার্দি থেকে লোকে পিকনিক করতে যেত একটা বনে। আমি ওদের যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি ওখানে আর পিকনিক চলবে না। জঘন্য লোক মশাই। অন্যের সম্পত্তির তোয়াক্কা রাখে না। বোতল আর ছেড়া কাগজ ফেলে এলেই হল? কাতারে কাতারে অন্য লোকের জায়গায় ঢুকে পড়লেই হল? দুটো মামলাতেই আমি জিতেছি, ডক্টর ওয়াটসন। এ-রকম শুভদিন অনেকদিন আমার জীবনে আসেনি। স্যার জন মরল্যান্ড গুলি চালাতেন নিজেরই এক্তিয়ারে–খরগোশ মারতেন, আমি তাকে অপরের জমিতে অবৈধ প্রবেশের মামলায় ফেলে দিয়েছিলাম। সেই মামলায় জেতবার পর এই প্রথম একটা সত্যিকারের বিরাট কাজ করলাম।
করলেন কীভাবে?
বই খুলেই দেখুন না মশাই। পড়ে লাভ বই ক্ষতি নেই। ফ্রাঙ্কল্যান্ড বনাম মরল্যান্ড কোর্ট কুইন্স বেঞ্চ। দুই পাউন্ড খরচ হয়ে গেছিল বটে, কিন্তু জিতে তত গেলাম।
তাতে কি আপনার লাভ কিছু হয়েছে?
কিস্সু না মশায়, কিচ্ছু না। অহংকার করে বলতে পারি তিলমাত্র স্বার্থ নেই এসব কেসে। জনসাধারণেরও একটা কর্তব্য আছে! যা কিছু করেছি জানবেন সেই কর্তব্যের তাড়নাতেই করেছি। আমি জানি আজ রাতেই ফার্নওয়ার্দির লোকেরা আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করবে। গতবার এ-কাণ্ড ওরা করেছিল, পুলিশকে বলেছিলাম এসব প্রকাশ্য নোংরামি যেন বন্ধ করা হয়। দেশের কলঙ্ক এ-অঞ্চলের পুলিশবাহিনী পুলিশ সাহায্য আমার প্রাপ্য অথচ আমাকে তা দেয়নি। ফ্রাঙ্কল্যান্ড বনাম রেজিনা মামলা এবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে জনসাধারণের। তখনই বলেছিলাম, আমার ওপর এ-ব্যবহার করা হলে তার জন্যে পস্তাতে হবে কিন্তু কথাটা ফলতে আরম্ভ করেছে।
কীভাবে? শুধোই আমি।
এমন একটা ভান করল বুড়ো যেন অনেক খবরই জেনে বসে আছে।
যা জানবার জন্যে ওরা ছটফটিয়ে মরছে, আমি তা ওদের জানাতে পারি। কিন্তু হাজার লোভ দেখালেও বলব না রাসকেলদের।
ছলছুতো করে সরে পড়বার তালে ছিলাম, এই কথা শুনে কিন্তু ইচ্ছে হল গোপন খবরটা শুনে যাই। বুড়োর মতিগতি জানা হয়ে গিয়েছে বলেই ঠিক করলাম বেশি আগ্রহ দেখাব না–দেখালেই আর মুখ আলগা করবেন না।
উদাসীনভাবে তাই বললাম, গোরু ভেড়া চুরির কেস বোধ হয়?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আরে তার চাইতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার? বাদার সেই কয়েদির কথা খেয়াল আছে?
চমকে উঠলাম। বললাম, জানেন সে কোথায়?
ঠিক কোথায় আছে জানি না বটে, কিন্তু পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার মতো খবর রাখি। খাবারটা জোগাড় করে কোখেকে, সেটা বার করতে পারলেই কিন্তু খাবারের পেছন পেছন গিয়ে আস্তানার সন্ধান পাওয়া যাবে–সোজা এই ব্যাপারটা কখনো ভেবেছেন?
বুড়ো দেখছি হাটে হাঁড়ি ভাঙতে চলেছে! মহা অস্বস্তিতে পড়লাম আমি। বললাম, তা ঠিক। কিন্তু সে বাদার মধ্যেই আছে জানছেন কী করে?
খাবার যে নিয়ে যায়, নিজের চোখে তাকে দেখেছি বলেই জানি।
ব্যারিমুরের কথা ভেবে বুকটা ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। অনধিকার চর্চাকারী মহাকুচুটে এই বুড়ো যদি সব জেনে বসে থাকে, তাহলে তো ব্যাপারটা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে! বুড়োর পরের মন্তব্যটা শুনেই কিন্তু বুকটা হালকা হয়ে গেল আমার।
শুনলে অবাক হবেন, লোকটার কাছে খাবার নিয়ে যায় একটা বাচ্চাছেলে। প্রত্যেক দিন ছাদে বসে টেলিস্কোপের মধ্যে দিয়ে দেখি তাকে। একই রাস্তা দিয়ে একই সময়ে যায় রোজ। কয়েদি ছাড়া আর কার কাছে যায় বলতে পারেন?
কী কপাল আমার! প্রাণপণ চেষ্টায় মুখখানা নির্বিকার রাখলাম ভিতরের প্রচণ্ড কৌতূহলকে বাইরে আসতে দিলাম না। বাচ্চা ছেলে। ব্যারিমুরও বলেছিল, বাদায় আগন্তুকের খাবার জোগান দেয় একটা ছেলে! ফ্রাঙ্কল্যান্ড তাহলে এর পেছনে চোখ দিয়ে বসে আছেন, কয়েদির পেছনে নয়। বুড়োর পেট থেকে আরও খবর বার করতে পারলে অনেক সহজ হয়ে আসে আমার কাজ–টো টো করে আর খুঁজতে হয় না বাদায়। তবে অবিশ্বাস আর ঔদাসীন্য–দুটো জব্বর অস্ত্র দিয়ে কাজ উদ্ধার করতে হবে আমায়।
আমার তো মনে হয় বাদার কোনো মেষপালকের ছেলে বাপের কাছে খানা নিয়ে যায়।
এতটুকু প্রতিবন্ধক সইতে পারেন না বুড়ো স্বেচ্ছাচারী আগুন ছিটকে আসে ভেতরে থেকে। বিষাক্ত চোখে চাইলেন আমার পানে–ক্রুদ্ধ বেড়ালের গোঁফের মতন খাড়া হয়ে গেল ধূসর জুলপি।
তাই নাকি মশাই? ধু-ধু বিস্তৃত জলাভূমির দিকে আঙুল তুলে বলেন বৃদ্ধ। দূরে ওই কালো পাহাড়টা চোখে পড়ছে? তার ওদিকে নীচু পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছেন?–ওপরে কাটাঝোপ? সারা বাদায় এর চাইতে পাথুরে জায়গা আর নেই। মেষপালক কি ও-জায়গায় থাকে? আপনার ধারণাটা একেবারে উদ্ভট।
মিন মিন করে বললাম, তা হতে পারে। না-জেনে বলেছি তো। নতিস্বীকারে কাজ হল। খুশি হয়ে বুড়ো বিশ্বাস করে বলল আরও কথা।
মশায়, যথেষ্ট কারণ না-থাকলে কোনো কথা আমি বলি না জানবেন। বোঝা নিয়ে হাঁটতে ছোঁড়াটাকে একবার নয়–বহুবার দেখেছি। রোজ–এমনকী মাঝে মাঝে দিনে দু-বার–দাঁড়ান, দাঁড়ান, ডক্টর ওয়াটসন। চোখের ভুল, না, সত্যিই এই মুহূর্তে কী যেন পাহাড়ের ধারে নড়ছে না?
মাইল কয়েক দূরে হলেও ম্যাড়মেড়ে সবুজ এবং ধূসর পটভূমিকায় কালচে বিন্দুর মতো কী যেন একটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের মতো উঠতে উঠতে চেঁচাতে লাগলেন ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড চলে আসুন মশায়, চলে আসুন। নিজের চোখেই দেখুন ঠিক বলছি কিনা।
চ্যাটালো ছাদে তিনপায়ার উপর বসানো টেলিস্কোপটা দেখলে ভয় লাগে। হাতের তেলো দিয়ে চোখের ওপর ঠুলি ধরে যন্ত্রে চোখ রাখলেন ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড এবং চেচিঁয়ে উঠলেন হৃষ্টকণ্ঠে।
চটপট, ডক্টর ওয়াটসন, চটপট পাহাড় পেরিয়ে গেলে আর দেখতে পাবেন না!
সত্যিই উঞ্ছ চেহারার একটা ছোঁড়াকে দেখা যাচ্ছে, কাঁধের ওপর একটা ছোটো বান্ডিল নিয়ে আস্তে আস্তে পাহাড় ভেঙে ওপর উঠছে। কিনারায় পৌঁছানোর পর মুহূর্তের জন্যে সুনীল শীতল আকাশের বুকে দেখলাম তার ছেড়া পোশাক পরা কদাকার মূর্তি। চোরের মতো আশপাশে এমনভাবে তাকিয়ে নিল যেন ফেউ লেগেছে পেছনে। পরক্ষণেই অদৃশ্য হল পাহাড়ের ওদিকে।
কী! ঠিক বলিনি?
সত্যি একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে! চুপিসারে যাচ্ছে কোনো গোপন উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্যটা কী, তা যেকোনো গাঁইয়া পুলিশও বলে দেবে। কিন্তু আমার পেট থেকে একটা কথাও বেরোবে না। ডক্টর ওয়াটসন, কথা দিন, আপনিও বলবেন না। একটা কথাও নয়! বুঝেছেন?
আপনি যা বলবেন, তাই হবে।
খুব যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে ওরা আমার সঙ্গে, ফ্র্যাঙ্কল্যান্ড বনাম রেজিনা মামলা সংক্রান্ত ঘটনা যখন ফাঁস হতে থাকবে, টি-টি পড়ে যাবে দেশে, ধিক্কারের শেষ থাকবে না। পুলিশকে কোনোভাবেই সাহায্য করব না–শত প্রলোভনেও নয়। ওরা চায় আমার কুশপুত্তলিকা নয়–আমাকেই দাহ করতে। যাচ্ছেন নাকি! এমন একটা শুভদিনে মদের পাত্রটা খালি করতে যদি দয়া করে সাহায্য করতেন।
অনুরোধে টললাম না। শেষকালে আমার সঙ্গে হেঁটে বাড়ি পর্যন্ত আসতে চাইলেন বৃদ্ধ। অতিকষ্টে নিবৃত্ত করলাম। যতক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে, ততক্ষণ রাস্তা ধরেই হাঁটলাম। তারপরেই নেমে এলাম বাদায় ছোঁড়াকে যে-পাহাড়ের ওপারে অদৃশ্য হতে দেখেছি, চললাম সেই পাহাড় অভিমুখে। অদৃষ্ট এখন আমার সহায়। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা বা উদ্যমের অভাবে দৈব-প্রদত্ত এই সুযোগ যাতে হেলায় না-হারাই, খর-নজর রাখলাম সেদিকে।
চুড়োয় যখন পৌঁছালাম, সুর্য তখন ড়ুবু-ড়ুবু। আমার পেছনে টানা লম্বা গড়ানের একদিকে পড়েছে সোনালি-সবুজ ছায়া, আর একদিকে ধূসর ছায়া। বহুদূরে আকাশ যেখানে মর্তে মিশেছে, সেইখানে ঝাঁপসাভাবে দেখা যাচ্ছে বেলিভার আর ভিক্সেন পাহাড়ের অত্যাশ্চর্য খোঁচা খোঁচা চেহারা। দিগন্তব্যাপী ধু-ধু বিস্তৃতির কোথাও কিছু নড়ছে না, কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। অনেক উঁচুতে নীল স্বর্গের দিকে উড়ছে গাংচিল বা কার্লিউ পাখি জাতীয় একটা জলচর বিহঙ্গ। নীচের মরুভূমি আর ওপরকার বিশাল খিলেনের মাঝে জীবিত প্রাণী বলতে যেন শুধু সে আর আমি, অনুর্বর এই দৃশ্য নিঃসঙ্গতার অনুভূতি এবং আরব্ধ কর্মের রহস্য ও জরুরি প্রয়োজনীয়তা বুকের মধ্যে দুরুদুরু কাঁপন জাগাল। ছেলেটাকে কোনোদিকেই দেখা যাচ্ছে না। আমার পায়ের নীচে কিন্তু পাহাড়ের খাঁজে বৃত্তাকারে সাজানো কতকগুলো পাথরের কুটির ঠিক মাঝখানেরটির মাথায় এখনও অটুট রয়েছে ছাদ–আবহাওয়ার দাপট থেকে মাথা বাঁচাননার পক্ষে যথেষ্ট। দেখেই তুরুক নাচ নেচে উঠল আমার হৃদয়। এই সেই বিবর—এইখানেই ঘাপটি মেরে রয়েছে নতুন আগন্তুক। গুপ্ত আস্তানার চৌকাঠে পা দিয়েছি, ওর গুপ্তরহস্য এখন আমার হাতের মুঠোয়।
প্রজাপতির জাল দুলিয়ে স্টেপলটন যেমন আস্তে আস্তে হাঁটেন, আমিও তেমনি ধীরেসুস্থে চারদিক দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম। বসবাসের অনেক নিদর্শন চোখে পড়ল। গোলাকার মসৃণ বিরাট বিরাট পাথরের চাইয়ের মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা একটা সরু রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে দরজার মতো হাঁ-করা একটা ভাঙাচোরা প্রবেশপথের সামনে। ভেতরে সব নিস্তব্ধ। অজ্ঞাত ব্যক্তিটি হয় ভেতরে ওত পেতে বসে রয়েছে নয়তে টহল দিচ্ছে বাদায়। অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনায় টান-টান হয়ে ওঠে আমার স্নায়ু! সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরলাম রিভলবারের কুঁদো এবং দ্রুতপদে হেঁটে ঝুঁকে পড়লাম ভেতরে। তাকিয়ে দেখি কুটির শূন্য।
কিন্তু আমি যে ভুল করিনি, মিছে ছুটে আসিনি, তার বহু চিহ্ন রয়েছে ঘরের সর্বত্র। এইটেই তার ডেরা বটে। একদা যে প্রস্তরবেদিতে প্রস্তরযুগের মানব নিদ্রা গিয়েছে, কতকগুলো কম্বল একটা বর্ষাতি মুড়ে গোল পাকিয়ে রাখা হয়েছে তার ওপর। বদখত একটা অগ্নিচুল্লিতে স্তুপীকৃত ছাই। পাশে রান্নার বাসন আর আধ বালতি জল। আলো-আধারিতে চোখ সয়ে যাওয়ার পর দেখলাম কোণে কোণে জড়ো করা বেশ কিছু খালি টিন–যেন বেশ কিছুদিন ধরেই মানুষ আছে এখানে। ধাতুর তৈরি একটা পানপাত্রর পাশে আধ বোতল সুরাও চোখে পড়ল। মাঝখানে একটা চ্যাটালো পাথরকে ব্যবহার করা হয়েছে টেবিলের মতো। ওপরে একটা কাপড় বাঁধা ছোটো পুটলি টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে ছোকরার কাঁধে দেখেছিলাম। পুঁটলির ভেতরে একটা পাঁউরুটি, এক-টিন মাংস এবং দুটিন পিচফলের মোরব্বা। দেখেশুনে নামিয়ে রাখবার পর বুকটা নেচে উঠল পুঁটলি-চাপা-দেওয়া একটা কাগজ দেখে। কী যেন লেখা রয়েছে কাগজে। তুলে দেখলাম পেনসিল দিয়ে মোটা মোটা হরফে লেখা একটা পঙক্তি :
ডক্টর ওয়াটসন কুমবে-ট্রেসি গেছেন।
থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কাগজটা হাতে নিয়ে ছোট খবরটার মানে বুঝতেই গেল ঝাড়া একটা মিনিট। লোকটা তাহলে স্যার হেনরির পেছনে নয়, লেগেছে আমার পেছনে। নিজে পিছু নেয়নি, লেলিয়ে দিয়েছে এই ছোকরাকে–খবরটা তারই আনা। জলায় আমি যা কিছু করেছি, কিছুই হয়তো এদের চোখ এড়ায়নি। প্রতিমুহূর্তেই তো টের পেয়েছি একটা অদৃশ্য শক্তি যেন ঘিরে রয়েছে আমাকে, সমস্ত সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করেছি একটা অতি-সূক্ষ্ম জাল সুকৌশলে ও সুনিপুণভাবে গুটিয়ে আনা হচ্ছে আমার চারধারে–এত আলতোভাবে চেপে বসছে যে জালে জড়িয়ে যাওয়ার পর চরম মুহূর্তেই কেবল বোঝা যায় তার অস্তিত্ব।
একটা রিপোর্ট যখন পাওয়া গেছে, তখন খুঁজলে নিশ্চয় আরও রিপোর্ট পাবো। সেই আশায় তন্নতন্ন করে খুঁজলাম কুটিরের অভ্যন্তরে, কিন্তু কোনো চিহ্নই পেলাম না। অসাধারণ এই জায়গায় এভাবে যে লোক বসবাস করতে পারে, তার স্বভাব চরিত্র বা মতিগতিরও কোনো নিদর্শন পেলাম না। শুধু বুঝলাম, লোকটা গ্রিসদেশের স্পার্টানদের মতো কষ্টসহিষ্ণু। আরাম-টারামের ধার ধারে না। ফুটো ছাদের পানে তাকিয়ে তুমুল বর্ষার কথা ভাবতেই উপলব্ধি করলাম কী প্রচণ্ড এবং অপরিবর্তনীয় উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে এহেন নিরানন্দ আশ্রমে সে থেকেছে অহোরাত্র। কে সে? বিষধর শত্রু? দেবদূত? পণ করলাম, না-জানা পর্যন্ত কুটির ছেড়ে বেরোব না।
বাইরে সূর্য ড়ুবছে। পশ্চিম আকাশ লাল আর সোনা রঙে যেন জ্বলছে। অনেক দূরে সুবিশাল গ্রিমপেন পঙ্কভূমির মাঝে বিক্ষিপ্ত জলাশয়গুলোর ছোপছোপ লালচে আভা ঠিকরে যাচ্ছে। বাস্কারভিল হলের জোড়া টাওয়ার আর অনেকদূরে গ্রিমপেন গ্রামের মাথায় ঝাঁপসা ধোঁয়া ভাসতে দেখা যাচ্ছে। এই দুইয়ের মাঝে পাহাড়ের আড়ালে রয়েছে স্টেপলটন ভাইবোনের বাড়ি। গোধুলির সোনালি প্রভায় সবই আশ্চর্য কোমল শান্ত ও স্নিগ্ধ; তা সত্ত্বেও প্রকৃতির এই অনাবিল শান্তিতে ভাগ বসাতে পারছে না আমার অন্তরাত্মা–প্রতি মুহূর্তে শিউরে উঠছে আসন্ন সাক্ষাৎকারের নামহীন আতঙ্কে। বুক ধড়াস ধড়াস করা সত্ত্বেও অবিচল সংকল্পে বসে রইলাম কুটিরের অন্ধকার কোণে চনমনে হয়ে রইল প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্র, অশুভ প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে রইল প্রতিটি কোণ–এ-প্রতীক্ষা এই কুটিরের অস্থায়ী বাসিন্দার জন্যে।
অবশেষে শুনলাম তার পদশব্দ। অনেকদূরে পাথরের ওপর বুট জুতোর তীক্ষ্ণ্ম কটাৎ কটাৎ আওয়াজ হল। ক্রমশ কাছে এগিয়ে এল বুটের শব্দ। সবচেয়ে অন্ধকার কোণে সেঁটে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, পকেটের মধ্যে তৈরি রাখলাম পিস্তল। লোকটার চেহারা ভালোভাবে দেখার আগে কিছুতেই তাকে জানতে দেব না আমি লুকিয়ে আছি এখানে। বেশ কিছুক্ষণ বিরতি গেল–থেমে গিয়েছে আগন্তুক। তারপর আবার এগিয়ে এল পদশব্দ। একটা ছায়া পড়ল কুটিরের সামনে খোলা জায়গায়।
শুনলাম একটা অতি-পরিচিত কণ্ঠস্বর, অপূর্ব সন্ধে, ভায়া ওয়াটসন। ভেতরের চাইতে বাইরে এলে কিন্তু আরও ভালো লাগবে।