এগারো – পালা বদলের দিনগুলি
সেই শেষরাতে চাঁদ যখন আঁরোয়ার জঙ্গলের মাথায়, তখন সুধাময় চা খেতে খেতে হঠাৎ মিষ্টি হেসে একটা অদ্ভুত কথা বলে বসে স্বর্ণকে।… ‘জর্জ আমাকে প্রায়ই বলে কেন তুমি বিয়ে করছ না ডাক্তারের মেয়েকে? অস্ট্রেলিয়ানটাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনে আমাদের হিন্দুদের আচার—বিচার কীরকম। ও আনকোরা সায়েব কি না। ব্যাটার মাথায় ঢোকে না কিছু।… হুঁ, জর্জ ভীষণ অবাক হয়। এ কী নিয়ম? স্বামী মারা গেছে বলে সারাজীবন ওইরকম কষ্ট সহ্য করে শুকিয়ে তিলে তিলে মরতে হবে? হররিবল! শালা ইংরেজ আমাকে দু’বেলা উসকানি দ্যায়। তোমরা ভারতের লোকেরা বড্ড কাপুরুষ। শালা জর্জ আমাকে গাল দ্যায় হিজড়ে বলে। হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ।’
পিছনে জঙ্গলে বসন্তের পাখিরা তখন সবে ডাকাডাকি শুরু করল। অনেক কোকিল আর কাক। তারপর খুব কাছেই ‘বউ কথা কও’ ডাকতে লাগল। ভোরবেলাকার জঙ্গলে শেষ বসন্তে এই ডাক শুনে মন অন্যরকম হয়ে যায়। কোত্থেকে মিষ্টি গন্ধও ভেসে আসে। সুধাময় যেন সে—সবের মধ্যে বসে গ্রাম্য লোকদের মতো অবলীলাক্রমে পেচ্ছাপ করে দিল। সুধাময় হাসতে লাগল।
স্বর্ণ কি তার সামনে বসে আছে—হাতে চায়ের কাপ, ফুলহাতা ব্লাউজ আর সাদা নকশিপাড় ছত্রখান শাড়ি, নিষ্পলক চোখ? সুধাময় নিজের বক্তব্যের প্রচণ্ড ভিড়ে ডুবে গেছে। সে ফের কাটাকাটা ভাবে বলে, ‘অবশ্য—ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর…হুঁ, সে জোর এই অজ পাড়াগাঁয়ে কোথায়? বরং পাদরি সাইমনটা এলে খেরেস্টানই হয়ে যেতে রাজি ছিলুম। ওরা বেশ আছে মানে, খেরেস্টান আর মুসলমানরা! তবে স্বর্ণ, তুমি যদি ভাই ওদের কারও জাত হতে—আমি সে জাতে জাত দিতুম, তাতে কোনো ভুল নেই।’
আবেগে স্বর্ণকে সে ‘তুমি’ বলে ফেলে। চায়ে চুমুক মেরে আরেকদফা নিজের মনে খিকখিক করে হাসে।… ‘হ্যাঁ, একটা সমস্যা। এমন সমাজ আমাদের—দেখ কাণ্ড, রক্ষিতা অ্যালাউ করবে প্রকাশ্যে—অথচ….ধ্যাৎ!’ বলে সে বিরক্তিতে চুপ করে যায়।
স্বর্ণ আগের মতোই স্থির। দুর্ধর্ষ জলস্রোতের মধ্যে একটা বিশাল পাথর আটকে থাকার মতন নদীগর্ভে। ভিজে পাথর।
সুধাময় শেষ চুমুক দিয়ে বলে, ‘বাতি নেভাও। ভোর হয়ে গেছে।…’ তারপর নিজেই লন্ঠনের দম কমিয়ে দিতে দিতে রেলবাতিটি হত্যা করে নিষ্ঠুর মুখে। নালা খুলে দ্যায়। উঠে দাঁড়ায়।…’তার চেয়ে একটা সহজ সমাধান আমি খুঁজে পেয়েছি। আমরা বরং ভাইবোন হয়ে যাই। স্বর্ণ!’
সে ধৃষ্টতায় স্বর্ণর চিবুকের তলায় তার ডান তর্জনি ছুঁইয়ে ফেলে। স্বর্ণ আস্তে আঙুলটা সরিয়ে দিয়ে চায়ের কাপটা মেঝেয় রাখে। নিচে অল্প অন্ধকার থাকায় দেখা যায় না কতটুকু চা খেতে বাকি রইল।
নির্বোধ সহকারী স্টেশনমাস্টার তবু কথা বলতে দমে না। ‘স্বর্ণ, আমার এই চরম প্রস্তাব। দয়া করে প্রত্যাখ্যান করোনা ভাই। এ ছাড়া কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছিনে। তুমি বোন, আমি দাদা—এর বিকল্প নেই। আমরা পরস্পরকে যথেষ্ট স্নেহ করব। আমাদের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক থাকবে। এই ব্রাহ্মমুহূর্তে—আমি ব্রাহ্মণসন্তান—আমি এই পৈতে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি—আমি বিয়ে করব না।—কক্ষনো না—কোনোদিনও না। স্বর্গের অপ্সরা আর মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে বেছে নিতে বলা হলে আমি মৃত্যুদণ্ডই নেব স্বর্ণ।’
আচমকা সেই প্রগলভ স্রোতের মধ্যবর্তী স্থির পাথর লাফিয়ে পড়ল সুধাময়ের ওপর। সুধাময় প্রস্তুত ছিল না। হিংস্র হাতে তার জামার কলার ধরে এক চড় মারে এবং ঠেলে বের করে দ্যায়। উঁচু বারান্দা থেকে নিচে পড়ে যায় সহকারী স্টেশনমাস্টার। স্বর্ণ সশব্দে দরজা বন্ধ করে।
শুকনো ধূলোট মাটি থেকে হাঁচড়পাঁচড় করে ওঠে স্তম্ভিত লোকটি। এদিক ওদিক তাকায়। বটতলায় ময়ারবুড়ি ঝাঁটা হাতে এদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পায়। আরও দ্যাখে, সেই নিঃঝুম ভোরে কোন বাবু সওয়ারি মোষের গাড়ির টাপর থেকে উঁকি মেরে স্টেশন দেখতে—দেখতে এই দৃশ্য দেখতে পেয়ে হতভম্ব হয়েছে।
শিশির ভেজা সাপের মতো প্রেমিকের খোলসটি ছেড়ে নির্জীব সুধাময় আস্তে আস্তে এগিয়ে কাঁটাতারের ফটক পেরিয়ে, তারপর লাইন ডিঙিয়ে স্টেশনের দিকে যায়।…
তারপর থেকে সবাই দেখল শান্ত সজ্জন ভদ্র সহকারী স্টেশনমাস্টারের চুল ইঞ্চি—ইঞ্চি বেড়ে কাঁধ ছুঁতে লাগল। গোঁফদাড়িও সেই অনুপাতে পরিব্যাপ্ত হল। সন্ন্যাসীর চেহারা নিয়ে মানুষটি মিষ্টি হেসে যাত্রীদের টিকিট বিক্রি করে। দরকার ছাড়া কথা বলে না। মালগাড়ি পাস করানোর সময় সবুজ পতাকাটা এমনভাবে দোলায় স্টেশনের উঁচু খোলা চত্বরে, যেন মনে হয় ওই তার বাক্য : চলে যাও বাছা, তোমাকে বাধা দেবার কেউ নেই। এবং ট্রেনটা চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ সে তার গতিপথের দিকে তাকিয়ে পতাকা দুলিয়ে চলে। মাঝে মাঝে কোনো সময় সে বিনা কারণে সিগনালযন্ত্রের পাশে ওই চত্বরটায় দাঁড়িয়ে থাকে, আকাশের দিকে দৃষ্টি। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে, বিনীতভাবে প্রশ্ন করে: ‘কিছু বললেন আমাকে?’ পায়ে চটি করে বৃদ্ধদের মতন সে প্রখ্যাত জলের ইঁদারার পাশ দিয়ে আস্তে কোয়ার্টারে চলে যায়। সময় থাকলে জানলার পাশে বসে চাপা গলায় সুর ধরে গীতাপাঠ করে। বড় মাস্টার জর্জ তাকে শুধিয়েছিল, ‘কী ঘটেছে তোমার সুধাবাবু? তুমি বদলে যাচ্ছ তাড়াতাড়ি। তুমি কি চাকরি ছেড়ে দেবে? তুমি কি সন্ন্যাসী হয়ে যাবে? কেন তুমি আগের মতন হাসিখুশি চঞ্চল মানুষ নও সুধাবাবু?’
সুধাময় বলেছিল, ‘মি. হ্যারিসন, আমি ঠিকই আছি। আশা করি, আমার কাজে কোনো গাফিলতি দেখতে পাচ্ছ না। বরং আগের চেয়েও কর্তব্যপরায়ণ হইনি কি? না মি. হ্যারিসন, আমি সন্ন্যাসী হব না। তবে আমার চুলদাড়ি কাটতে আর ভালো লাগে না। ঈশ্বর যা—যা সব আমাকে দিয়েছেন সবই উদ্দেশ্যমূলক কিনা পরীক্ষা করে দেখতে চাই। আর আমি ঐশ্বরিক বাণীগুলো পাঠ করি। কারণ, এইসব বাক্যে জীবনের গভীর উদ্দেশ্য কী—লুকিয়ে রয়েছে। অবশ্য সবকিছু তলিয়ে বোঝবার বয়স এখনও আমার হয়নি হয়তো। এখনও সব ধোঁয়া—ধোঁয়া লাগে। কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। আসলে আমি অমৃত খুঁজছি মি. হ্যারিসন। ওই দ্যাখো, আমার ঘর ভরতি হয়ে যাচ্ছে শাস্ত্রীয় বইপত্তরে। আমাদের জ্ঞানী বলেছেন, অমৃতের তত্ত্ব গুহায় নিহিত। এই আমার গুহা। অ্যাদ্দিন ভাবতুম, বাইরের জগতেই এসেন্স অফ লাইফ খুঁজে পাওয়া যায়। এখন জানি, জীবনের গূঢ় তত্ত্ব আছে আমারই আত্মার মধ্যে।’…
এক চড়ে চৈতন্যোদয় বলা যায়। জর্জ ভীষণ হাসে। এই জড়বুদ্ধি বাঙালি বাবুটি ডাক্তারের মেয়ের হাতে ঘা খেয়ে চুপসে গেছে। লেজ গুটিয়ে ঈশ্বর ইত্যাদির দিকে পালাচ্ছে। বুদ্ধিমান ইংরেজটি খালি অবাক হয়। হাউ ফানি! হোয়াট এ ফুলিশনেশ! একটি মেয়ের জন্য এই নেটিভগুলো দিব্যি সাধুসন্নেসী হয়ে যেতে পারে। একটিমাত্র চড় এদের প্রচণ্ড দার্শনিক করে তুলতে পারে।
পরে একদিন কাটোয়া জংশনের এক অফিসার বলেছিল—’প্রিয় জর্জ, গ্রিক সক্রেটিস দার্শনিক হওয়ার কারণ ছিল তাঁর দজ্জাল স্ত্রী জ্যানথিপি। তবে দজ্জাল প্রেমিকাও যে অনেক সময় দার্শনিক উৎপাদন (প্রোডিউস) করে, তা এই প্রথম তোমার কাছে শোনা গেল।’ এই লোকটিও অবশ্য গোরা।
হ্যাঁ, ঘটনাটি রয়ে গিয়েছিল ক্রমশ চারদিকে। হয়তো চাপা পড়ে যেত, কিন্তু সুধাময়ের দাড়িগোঁফ আর নতুন আচরণ এই মারীর জীবাণু ছেড়েছিল ঝাঁকেঝাঁকে। আর স্টেশন বা রেলপথের কী প্রচুর সংক্রামক শক্তি, তাও সেই প্রথম সচেতন লোকেরা টের পেয়েছিল। আপজংশন থেকে ডাউন জংশন অব্দি চিরোটির তরুণ সহকারী স্টেশনমাস্টার রেলকর্মচারীদের কাছে রীতিমতো একটি ক্যারেকটার কিংবা ক্যারিকেচার হয়ে দাঁড়াল। সুধাময়ের জনান্তিক নাম হল ‘প্রেমানন্দ মহারাজ।’ চিরোটি হয়ে যে রেলবাবু আসে পরবর্তী স্টেশনে তার উদ্দেশ্যে আর সব রেলবাবুর প্রথম প্রশ্নটি ছিল : ‘প্রেমানন্দ মহারাজের খবর কী?’ খালাসিরাও উৎসুক হয়ে থাকে। কান খাড়া রেখে অপেক্ষা করে আনাচেকানাচে। শেষ অব্দি সুধাময় পরিণত হল স্রেফ ‘মহারাজ’। ফলে সামনাসামনি তাকে মহারাজ বলে ডাকাও সম্ভব হল পরিচিতদের পক্ষে।
সেই দারোগার হাসি! মহারাজ শব্দ হয়ে আরেক মহিমা দেখিয়ে দিল। যারা স্টেশনে আসে, তারা একবার দ্যাখে ‘মহারাজ’, আরেকবার দ্যাখে ‘লেডি ডাক্তার।’ স্বর্ণলতা দিনে দিনে জনমুখে লেডিডাক্তার হয়ে ওঠে। তেজি টাট্টুর পিঠে সত্যিকার চামড়াজিন— (গোরাংবাবুর আমলে সেই কাঁথাজিন নয়—বড় মাস্টার জর্জ আনিয়ে দিয়েছে কলকাতা থেকে) এবং তাতে চেপে স্বর্ণলতা গাঁওয়ালে যায়। জর্জ অস্ট্রেলিয়ার আসলে কোন লাইনে ছিল, জানা গেছে। ও ছিল একজন হর্সব্রেকার। ঘোড়াশালের গুরুমশাই। এক জনবিরল অঞ্চলে বিশাল হ্রদের ধারে ছিল এক কোম্পানির ফার্ম। ঘোড়ার কারবারটাই ছিল তাদের মুখ্য। তার সঙ্গে ছিল খরগোস ক্যাঙারু ইত্যাদি জন্তুর চামড়া চালানের ব্যবসা। সেসব দারুণ উত্তেজনার দিন গেছে জর্জের। জর্জ তবে ঘোড়া চেনে। ঘোড়ার ভাষা বোঝে। ঘোড়াকে পুরোপুরি ‘হান্ডমেশিনে’ পরিণত করতে পারে।
এ হল একরকম অপূর্ব যোগাযোগের ব্যাপার। স্বর্ণ ওকে বাংলা শেখায়, ও স্বর্ণকে শেখায় ঘোড়াবিদ্যা। বটতলা থেকে সামান্য দূরে একটা মস্ত বড়ো ঘাসের মাঠে বিকেলবেলা একটা ঘোড়া ও দুজন মানুষ যে দৃশ্যের অবতারণা করে, তার সঙ্গে সকালে ডাক্তারখানার বারান্দায় বসে পাঠ তৈরিতে ব্যস্ত দুটি মানুষের দৃশ্যের কোনো তুলনা স্বভাবত হয় না। গ্রাম্য লোকেরা দূরে ভিড় করে বিকেলে। আর আরও দূরে স্টেশনের উঁচু খোলা চত্বর থেকে দাঁড়িয়ে এক সন্ন্যাসীর শীর্ণ চেহারাও সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চেহারা শুধু চেহারাই দেখে—অন্যকিছু নয়।
সেই সময় একদিন সুযোগ বুঝে পাদরি সাইমনের পুনরাবির্ভাব ঘটে।
তার কথা এলাকার লোকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। বহরমপুর ক্রিমেটোরিয়ামের মধ্যে সুপ্রাচীন চার্চটার কাছে অনেকে তাকে অবশ্য দেখেও এসেছে অনেকবার—অন্তত যারা জজকোর্টে সেখানে মামলা করতে গেছে। কেউ ভাবেওনি যে অমন চূড়ান্ত কাণ্ডের পর এখানকার মাটিতে ফের সে পা দেবে।
কিন্তু সাইমনসায়েব নির্ভীক মুখেই এল। জর্জের কোয়ার্টারে তার আড্ডা নিল। জর্জকে সে খুব ধার্মিক খ্রিস্টান বলে জানে বরাবর। জর্জকে সে তাই ছেলের মতন স্নেহ করে। অন্তত এই দাবি তার আছে আগাগোড়া।
তবে জর্জ এবার একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। গোরাংবাবু এবং হেরু ডাকাতের জেলের ব্যাপারে পাদরি সাইমনের গোপন চাপ ছিল অনেকটা। ইংরেজ জর্জসায়েব অন্তত বুড়ো ডাক্তারটির শাস্তি বিবেচেনা করতে তৈরি ছিলেন—কিন্তু, জর্জ ভালো জানে—ফাদার এখানেও কীভাবে নাক গলিয়েছিল। ফাদারের স্বার্থ ছিল স্পষ্ট। এলাকায় ধর্মপ্রচারের মুখ্য বাধা ছিল এলাকার ওই একমাত্র আত্মসচেতন সভ্য ও সুশিক্ষিত হোমিয়োপ্যাথ ডাক্তারটি। এবং এর হাতে ছিল হেরু নামক বিপজ্জনক অস্ত্র। ফাদার এখন বুক ফুলিয়ে কর্ণসুবর্ণ জয় করার অভিযানে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে।
স্বর্ণের কথা ভেবেই জর্জ অস্বস্তিতে ভোগে। স্বর্ণ ফাদারকে কোনোদিন যে দুচক্ষে দেখতে পারেনি, জর্জকে বলেছে অনেক সময়। এবং এখনও তার বাবার এই দুর্ভাগ্যের পিছনে ফাদারের অবদানের কথা কীভাবে জানে বলে সে আরও ক্ষিপ্ত।
জর্জ সে—বেলা খুব ভাবনায় পড়ে যায়।
দিনগুলো এই অখদ্যে নির্জন স্টেশনে নির্বাসনে কী যন্ত্রণায় কাটাতে হত। সে মাত্র একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইংরেজ বললেই চলে—অর্ধশিক্ষিত, গোঁয়ার, চাষাড়ে। ভারতে আসবার পর নানাভাবে কিছু জানাশোনা ও চর্চার ফলে মোটামুটি নিজেকে চালিয়ে নেবার ক্ষমতা তার এসেছে। এবং জর্জ জানে, তাকে এই চিরোটির মতো জায়গায় পাঠানোর কারণ রেলকোম্পানির কী যেন লজ্জাসংকোচের মনোভাব। অর্ধশিক্ষিত রাফিয়ান একটা লোককে এখানে ঠেলে কোম্পানি যেন নিজের মান বাঁচাতে চেয়েছে। জর্জের মনে এইসব অভিমান এবং ক্রোধ তো আছেই।
স্বর্ণের মতো একটা ফ্যানি নেটিভ গার্লের সহবাসে তার নির্বাসন ক্রমশ অর্থপূর্ণ আর চমৎকার হয়ে উঠেছিল; যেন তার নিজের মতনই এটা দুরন্ত আদিম বন্যতার ছাপ মেয়েটির মধ্যে লক্ষ্য করছিল। এমন নিঃসঙ্কোচ সাহসী মেয়ে ভারতে থাকতে পারে তার জানা ছিল না। তবে একথাও সত্যি, এমন কিছু ভারতীয় মেয়ের সঙ্গে তার ইতিমধ্যে পরিচয়ও ছিল না। যে তার নিরিখে সে স্বর্ণকে বিচার করে বসবে।
প্রকৃতপক্ষে স্বর্ণকে—স্বর্ণর আচরণ প্রথমে তাকে খুবই স্বাভাবিক লেগেছিল। অস্ট্রেলিয়ার সেই ফার্মে তাদের কিচেনে খাবার পরিবেশন করত যে মেয়েটি—লিডা হেক্সওয়ার্থ, তার সঙ্গে স্বর্ণর আমূল ফারাক একটুও খুঁজে পায়নি জর্জ।
অবশ্য কেউ কেউ জর্জকে বলেছে—’তোমার ধারণা ভুল জর্জ। ভারতে সব মেয়ে স্বর্ণ নয়। যদিও একশোটা ইংরেজ অস্ট্রেলিয়ানের মধ্যে পঁচানম্বইটার বেশি লিডা খুঁজে পাবে। স্বর্ণ একটা ব্যতিক্রম।’
জর্জ তার স্বল্প অভিজ্ঞতা বাজি রেখে তর্ক করেছে। শেষ অব্দি রেগে বলেছে—’সো হোয়াট?’
‘নাথিং। বাট এগেন ইউ আর রং।’…
পরে জর্জ অবশ্য খুব সহজে টের পেয়েছিল—লিডা হেক্সওয়ার্থের সঙ্গে স্বর্ণর একটা অদ্ভুত ফারাক আছে। লিডাকে দেখামাত্র ভালোবাসার প্রস্তাব করা এবং চুমু খাওয়া গিয়েছিল, স্বর্ণের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। জর্জ আগে জানত, ভালোবাসা বা লাভ মেকিং মানেই বিছানার ব্যাপার দ্রুত এসে পড়ে—পরে জেনেছে, ভারতে একটা প্রচণ্ড আলস্যের স্রোত বইছে—যার দরুন বিছানা পাততে অনেকখানি দেরি হয়ে যায়। এবং নাকি বিছানা অনেক সময় পাতাও যায় না—অথচ ‘লাভ’ থাকে। কী অদ্ভুত, কী উদ্ভট!
এখন জর্জের অদ্ভুত বা উদ্ভট লাগে না। তাই বলে স্বর্ণকে সে ‘আই লাভ ইউ’ বলেও ফেলে না কোনো অসতর্ক মুহূর্তেও।
হয়তো বলত। বলে বসত কোনো এক সময়। কারণ, তার মধ্যে এক চাষাড়ে আদিম গোঁয়ার মানুষ আছে। আজীবন ঘোড়ার সঙ্গদোষে সে ঘোড়ার মতনই দ্রুতগামী, চঞ্চল, উঁচুমুখো। সে দাঁড়িয়ে ঘুমোতে জানে। কিন্তু সুধাময়ের পতন ও প্রস্থানের নাটকীয় দৃশ্যের সে সাক্ষী।
আর ক্রমশ স্বর্ণর ঋজুতর হয়ে ওঠা পরিচ্ছন্ন পরিপাটি গম্ভীরতা ও ব্যক্তিত্ব জর্জকে ভীত করে।
আর স্বর্ণর শান্ত বাক্যগুলোর স্নেহ (যথা—জর্জ, তুমি কি ক্লান্ত, জর্জ, তুমি কি কিছু খাবে? ইত্যাদি) জর্জকে অভিভূত করে।
ওই তিনটি ভাব অস্ট্রেলিয়ান রাফিয়ানটির জীবনে নতুন। ভয়, শ্রদ্ধা, অভিভূত হওয়া।
এই প্রথম কোনো স্ত্রীলোককে সে ঘোড়া ভেবে সপাং সপাং চাবুক চালিয়ে পিঠে চেপে ছোটার ধারণা পরিত্যাগ করেছে।
অনাথ আশ্রমে মানুষ জর্জ হ্যারিসন, যার বিধবা মা এক্সেল হ্যারিসন, অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে আবহাওয়া সহ্য করতে না পেরে মারা পড়ে, এই প্রথম একটি মেয়েকে ভালোবাসতে চেয়েও ভালোবাসতে না পেরে একটা নতুন ধরনের যন্ত্রণা পেয়েছে।…
এবং সেই সময় এসে গেল ফাদার সাইমন রীতিমতো জিনিসপত্র নিয়ে একেবারে অভিযানের জন্যে পুরোপুরি তৈরি হয়ে। আপাতত জর্জের কোয়ার্টারে কিছুদিন থাকার পর কোথায় কী করবে সে কর্মসূচি ঘোষণা করে।
কর্ণসুবর্ণের ওই সবচেয়ে উঁচু চমৎকার টিলার ওপর ফাদার একটা চার্চ দেখতে পাচ্ছে। ফাদার সাইমন আঙুল দিয়ে দেখায়, ‘দেয়ার! মাই বয়, জাস্ট লুক—লুক!’
হুঁ, জর্জও দেখতে পায় বইকি। নির্জন ধূধূ ধূসর বিশাল টিলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা চার্চ—সুচলো চূড়োর শীর্ষে ঝকমক করছে ক্রুশ। ঘণ্টা বাজছে ঢং ঢং ঢং ঢং…
ফাদারের দ্বিতীয় প্ল্যান—ওখানে গিয়ে তাঁবু ফেলে বাস করবে। মিশনারস ক্যাম্পে। একটা মেলার আয়োজন করবে। পরবর্তী পর্যায়ে মেলাটা স্থায়ী হাট বা গঞ্জে রূপ নেবে। গঙ্গার কাছাকাছি এ অঞ্চলে কোনো হাটবাজার তো নেই লোকের যথেষ্ট সমর্থন পেতে দেরি হবে না।
জর্জ শুধু হাসে। তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না। তার অস্বস্তি স্বর্ণের কথা ভেবে। ফাদার এসেছে, সবার সঙ্গে হেসে হেসে অনর্গল কথা বলছে স্টেশনে,—স্বর্ণ বেলায় বেলায় দেখছে। তবু নিজ থেকে জর্জ ফাদারের প্রসঙ্গ তোলেই না স্বর্ণর কাছে। আর স্বর্ণও কেন কে জানে, তোলে না। তার যেন এমন ভাব—কে এল জর্জের ঘরে বা স্টেশনে গাছ না পাথর, আমার তাতে চোখ নেই। স্টেশন জায়গা। কত রকম লোকজন যাবে আসবে।
কিন্তু ফাদার এসেই স্বর্ণর সব খবরাখবর জর্জের কাছে জেনে নিয়েছিল। সুধাময়ের ব্যাপারটা অবশ্য চেপে গেছে জর্জ। তবু ফাদার ধূর্ত মানুষ। সুধাময়ের সন্ন্যাসীমার্কা চেহারা ও চালচলন দেখে সে অবাক হয়েছে খুবই। এই নেটিভ বাবুটি রেলের লোক। এ আবার গোরাং ডাক্তার আর হেরুর জন্যে তদ্বির করতে খুব হাঁটাহাঁটি করেছিল স্বর্ণর সঙ্গে। আর এখন ও ভুলেও লাইন পেরোয় না—ফাদার লক্ষ্য করে ফেলেছে। কিন্তু সুধাময়কে সে মনে মনে বরাবর দোষী করে রেখেছে বলে বেশি একটা কথাবার্তা বলেনি। তার রাগও হয়েছে, খুব কাছেই পাশের কোয়ার্টারে সহকারী স্টেশনমাস্টার প্রচণ্ড স্পর্ধায় উচ্চকণ্ঠে হিন্দুশাস্ত্র পাঠ করে দেখে। পুওর জর্জ এসব সহ্য করছে কীভাবে?
মাথায় সেই বিরাট প্ল্যানের দরুন ফাদার এসব ছোটখাটো ব্যাপারে মনোনিবেশ করে না। স্থানীয় লোকদের অসুখের খোঁজখবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইঁদারার কাছের অশ্বত্থগাছের তলায় টেবিলচেয়ার পেতে ওষুধের বাকসো নিয়ে বসে প্রতি সকালে। আর রোগীও জুটতে থাকে। রোগীরও সংখ্যা কদিনের মধ্যে হু হু করে বেড়ে যায়। অশত্থতলায় সে এক মেলার ভিড়। চরণ চৌকিদার নীল উর্দি পরে লাঠি হাতে তম্বি করে প্রথামত।
এদিকে বটতলার ডাক্তারখানায় রোগীর সংখ্যা বেশ হ্রাস পাচ্ছে লক্ষ্য করে লেডিডাক্তারটি। মানুষ এত নেমকহারাম হয়? একসময় গোরাংবাবুর সঙ্গে ঠিক এইরকম একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছিল ফাদার সাইমনের। হেরু শেষ অব্দি জিতিয়ে দিয়েছিল গোরাংবাবুকে। গোরাপাদরি কতকটা প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়েছিল। এখন হেরু নেই। গোরাংবাবুও নেই। পাদরি এবার স্বর্ণলতার মুখের গ্রাস কাড়বার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে বলা যায়। স্বর্ণ ভাবনায় পড়ে। ঠোঁটের নিচে বাঁকা রেখা ফোটে। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে শূন্যদৃষ্টে। সবচেয়ে ভাবনার কথা পাদরি এবার অ্যালোপ্যাথি ওষুধও এনেছে সঙ্গে।
জর্জও এ ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। কিন্তু কী করবে বেচারা? ফাদারকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যেতে বলা অসম্ভব তার পক্ষে। স্বর্ণকে দু’একবার সে বলেছে, ‘ডিডি, টোমার পেসেন্ট কমে গেল।’ ব্যাস, আর কিছু বলেনি জর্জ। স্বর্ণ শুধু একটু হেসেছে।
হঠাৎ এক রাতে স্টেশন কোয়ার্টারে হইচই কাণ্ড।
জর্জ যথারীতি স্টেশনঘরের টেবিলে ঘুমোচ্ছিল। সুধাময় তার কোয়ার্টারে ছিল। ভীষণ চেঁচামেচি শোনা গেল মধ্যরাতে। খালাসিরা চেঁচাতে লাগল। কেউ বুদ্ধি করে ক্যানাস্তারা পেটাতে শুরু করল। বাঘ ছাড়া কিছু নয়—নির্ঘাৎ আঁরোয়ার জঙ্গল থেকে এসে বাঘ হানা দিয়েছে! জর্জ জানালা দিয়ে কয়েকবার বন্দুক ছুঁড়ল ভ্যাবাচাকা খেয়ে।
সেই সময় স্পষ্ট শোনা গেল, সুধাময় চেঁচাচ্ছে—’আগুন, আগুন!’ তার সঙ্গে পাদরি সাইমনের ভাঙা গলায় দুর্বোধ্য আর্তনাদও শোনা গেল।
সবাই তখন সাহস করে লন্ঠন লাঠিসোটা নিয়ে স্টেশন কোয়ার্টারে হাজির হল। তারপর দেখল ভিতরের বারান্দায় চিত হয়ে শুয়ে আছে ফাদার সাইমন—তার কাছে জলের বালতি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সহকারী স্টেশনমাস্টার। ফাদারের জোব্বা ভিজে চবচব করছে। পোড়া গন্ধ নাকে লাগছে। ঘরের ভিতর থেকে ধোঁওয়া ভেসে আসছে তখনও।
ব্যাপারটা তক্ষুনি বোঝা গেল।
জানালা খোলা রেখে ঘুমোচ্ছিল ফাদার সাইমন। ম্যালেরিয়ার ভয়ে মশারি খাটানো ছিল। কে বাইরে থেকে মশারিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর এই অবস্থা।
সুধাময় জানাল, কীভাবে পাঁচিল ডিঙিয়ে এসে জল খোঁজাখুঁজি করে প্রজ্বলন্ত ফাদারের ওপর ঢালতে হয়েছে তাকে। সারা গায়ে আগুন নিয়ে পাগলের মতন লাফালাফি করছিল ফাদার সাইমন।
পরদিন সকালে দুঃখিত ফাদার সাইমন তলপি গুটিয়ে স্টেশন থেকে চলে গেল, আগের বারের মতো প্রস্থান অর্থে নয়—অন্যখানে। ভোর হতে না হতে ডাবকই কোদলা রাঙামাটি মধুপুর থেকে মোড়লরা এসে হাজির হয়েছিল। তারা সবাই দারুণ রাজভক্ত বরাবর—অর্থাৎ ইংরাজ ভক্ত। কর্ণসুবর্ণর বড় একটা টিলার গায়ে সমতল কয়েক একর বাঁজা চটান রয়েছে। সৈদাবাদের জমিদার তার মালিক। দানেশ ব্যাপারীর সঙ্গে সেই জমিদারের গোমস্তা যদুপুরের গোবর্ধন ঘোষ ওরফে দোর্দণ্ডপ্রতাপ গোবরা কায়েতের খুব খাতির আছে। দানেশই ডেকে নিয়ে গেল ফাদারকে। ওইখানে নতুন ডাক্তারখানা খোলা হবে। ঘরবাড়ি বানিয়ে দেবে মোড়লরা—নিজেদেরই গরজে। কারণ, এলাকায় ভালো ডাক্তার নেই, হাসপাতাল নেই—লোকেরা অসুখবিসুখে খুব কষ্ট পায়। ছুটতে হয় সেই কাটোয়া জংশন, নয়তো সদর শহর বহরমপুর।
মনে মনে সবাই অবশ্য গোরাংবাবুর মেয়েকেই এই অগ্নিকাণ্ডের দরুণ দোষী সাব্যস্ত করল। কিন্তু সে স্ত্রীলোক—কোনো পুরুষ নেই তার বাড়িতে, যার ওপর দিয়ে অভিযোগ—অনুযোগ শাস্তি চালানো যাবে। সচরাচর কোনো স্ত্রীলোকের অপরাধের জবাবদিহি করার রেওয়াজ হচ্ছে বাড়ির পুরুষদেরই। তাই ওদিকে তার এগোনো সম্ভব হল না। অবশ্য কেউ কেউ বলল, ‘আর কোনও রোগী যাতে বটতলার দিকে না যায়, তার ব্যবস্থা করা দরকার।’ কিন্তু অনেকে বলল, ‘ছেড়ে দাও। মেয়েমানুষ!’
স্বর্ণর কানে এসব পৌঁছয়নি। দেখা গেছে, প্রত্যেকটি মানুষ রাতারাতি এবার কী জাদুমন্ত্রবলে পাদরিবাবার অনুরাগী হয়ে উঠেছে। সবাই বলেছে, ‘ও কি মেয়ে? ও পুরুষের বাড়া। ওর বাবা ছিল ডাকাতের সর্দার। ডাকাত হেরু ছিল ওর পোষা বাঘ। ও দিব্যি ঘোড়ায় চাপতে পারে। দরকার হলে পুরুষ মানুষকেও ঠ্যাঙাতে পারে। বিধবা! বিধবার কী আছে ওর? মাছমাংস কড়মড়িয়ে খায়। রাঙা শাড়ি পরে। পায়ে জুতো পরে। গটমট করে ইংরিজি বলে। জাতবেজাত জ্ঞান করে না। মুসলমান খেরেস্টান হাড়িবাউরি মুদ্দোফরাস সব—সব সমান ওর কাছে।’… ইত্যাদি।
স্বর্ণকে একঘরে করার উপায়ও নেই। সে স্ত্রীলোক। তার নাপিত বন্ধ করার কথা ওঠে না। জল বন্ধ করার উপায় নেই। স্টেশনে রেলকোম্পানির ইঁদারা আছে। আগুন বন্ধ করাও অসম্ভব। রেলপথে দেশলাই আমদানির অসুবিধা নেই। স্বর্ণর ছেলেমেয়ে নেই যে অন্নপ্রাশন বিয়ে ইত্যাদির সময় কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে। তার বাবা এখন কলকাতার জেলে। সে মলেও ইংরেজ—বাহাদুরের লোকেরা ওখানে পাশে গঙ্গা পাইয়ে দেবে। স্বর্ণ শ্রাদ্ধ করবে? ভাবা যায় না, ভাবা যায় না! রতনপুরের ওমর শেখের মতন ও আসলে একজন নাস্তিক। স্ত্রীলোক নাস্তিক হলে দিনকে রাত করতে পারে।
একটা শাস্তি শুধু দেওয়া যায় ওকে। তা হল, রোগী বন্ধ করা। মোড়লরা এই ব্যবস্থা দ্রুত করে ফেলতে বদ্ধপরিকর হয়েছে।
স্বর্ণর কানে দুর্ভাগ্যক্রমে কেউ এসব কথা তক্ষুনি তোলেনি। জর্জও না। সে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। ফাদারকে সে ভক্তিশ্রদ্ধা করে ; আবার এলাকার সব লোকই এখন স্বর্ণর বিরোধী। সে হতবুদ্ধি হয়ে ভাবছিল কী করা যাবে এক্ষেত্রে। অবশ্য স্বর্ণর কাছে বাংলা শিখতে যেতে তার কোনো অসুবিধে নেই। কারণ, সে রাজার জাত। তার সাতখুন মাফ। সে মেশে আগের মতনই। কিন্তু মনে মনে অস্বস্তি থেকেই যায়। আগের মতন কৌতুকে সারাক্ষণ ফেটে পড়ে না কথায় কথায়।
কিন্তু স্বর্ণ বাইরে—বাইরে যেন তাই আছে—একটুও বদলায়নি। জর্জ দ্যাখে, স্বর্ণ যেন আরও নির্বিকার হয়েছে বরং। পৃথিবীকে তাচ্ছিল্য করার মতন একটা কুঞ্চন তার ঠোঁট ও ভুরুতে স্পষ্টতর হয়েছে। জর্জ ভাবে, এমাসে স্বর্ণর গুরুগিরির প্রাপ্যটা সে ডবল করে দেবে। শুধু সংশয়টা থেকে যায়—স্বর্ণ নেবে তো তা?
নেবে না কেন? চমৎকার বাংলা শিখে গেছে জর্জ। লিখতে—পড়তে পারছে। শুধু বলতে আড়ষ্টতা আছে—উচ্চারণ করতে পারে না। সবচেয়ে অসুবিধে ক্রিয়াপদ নিয়ে। সাধুভাষার সঙ্গে চলিতভাষা গুলিয়ে ফেলে।
তারপর জর্জ হঠাৎ কোনো এক সময় মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে—কেন তুমি বাংলা শেখার জন্যে জীবনবাজি রেখে লড়ছ বাছা? এর ইউটিলিটির সীমাই বা কতদূর এবং নেট লাভটা কী হবে? হিতৈষীরা বলেছিল, ‘প্রিয় জর্জ, নেটিভ ভাষাটা শিখে নিলে এখানকার জীবন বরদাস্ত হতে পারে। সব ইংরেজই তাই বরাবর যে দেশে গেছে, তারা সেখানকার ভাষাটা শিখতে সবার আগে চেষ্টা করেছে—অন্তত যাদের নেটিভদের মধ্যে বাস করতে হয়।’… জর্জ ভাবে, অনেকদূর তো শেখা হল—এবার ছেড়ে দেওয়া যেত। ইংরেজিতে তার জ্ঞানগম্যি মোটামুটি যা, বাংলাতেও তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে মনে হচ্ছে। বেশি জ্ঞান কষ্ট দ্যায়—’নলেজ ইজ এ ভেরি ডেঞ্জারাস এনিমি’, অস্ট্রেলিয়ার সেই ফার্মে তার এক বন্ধু বলত।
অথচ এই অদ্ভুত মেয়েটির সংসর্গ ছাড়া দিন কাটে না, রাত কাটে না। মন সবসময় পড়ে থাকে ওখানে। হঠাৎ কবে প্রথামতো তার ডাক আসতে পারে, বড়ো কোনো স্টেশনে প্রমোশন হতে পারে। তখন জর্জ কী করবে? জর্জ তখন তুমি কী করবে? লালচে চুল আঁকড়ে ধরে সে সিগন্যাল পোস্টের দিকে তাকিয়ে থাকে।…
দেখতে দেখতে গ্রীষ্মের শেষাশেষি কর্ণসুবর্ণ টিলার পাশে মাটির ঘর খড়ের চাল নিয়ে ফাদার সাইমনের ‘হাসপাতাল’ গড়ে ওঠে। শোনা যায় ফাদার কলকাতা থেকে একজন পাশকরা বড়ো ডাক্তার আনবে। সরকার বাহাদুর মোটা টাকার সাহায্য মঞ্জুর করেছেন। শুধু তাই নয়, ফাদার একটা স্কুলও করতে চায়।
সেই সময় একদিন স্বর্ণ আসছে ঘোড়ায় চেপে পাশের গ্রাম থেকে—বাগদিদের ছোট্ট গ্রাম হিজল বিলের মধ্যে। উঁচু ভিটের ওপর সব ঘর—বর্ষায় চারদিক জলে থইথই করে! তৃণভূমির ওপর খড়কাটাদের খড়ের গাড়ির চাকার চলায় সারা খরা দুফালি দীর্ঘ ধুলোর রেখা পথ হয়ে পড়ে থাকে। সেই পথে সন্ধ্যার মুখোমুখি ফিরে আসছে লেডি ডাক্তার। আজকাল অনেকটা দূর থেকে তার ডাক আসে। কাছের কেউ ডাকে না—আসে না। কিন্তু দূর তাকে আপন করতে চায়।
ধুলো উড়িয়ে চৈতক ছুটে আসছে তৃণভূমি পেরিয়ে। বাঁকী নদীর কাছে এসে আঁরোয়াগামী রাস্তায় পৌঁছতেই স্বর্ণর কানে গেল সামনের বাঁকে কে জোরালো গলায় গান গাইছে।
বাঁকীনদী শুকনো খটখটে। নদী পেরিয়ে ওপারে গেলে স্বর্ণ দেখল তিনটে গোরুর গাড়ি চলেছে আঁরোয়ার দিকে। আগের গাড়িটা ছই দেওয়া—পিছনের দুটো খোলা। এ দুটোতে গাদার গাদা আসবাব তৈজসপত্র বোঝাই।
আগেই ছই দেওয়া গাড়ি থেকে যে জোরালো সুর শোনা যাচ্ছে, তা গা নয়, গানের মতো। পাশ কাটিয়ে আসতেই স্বর্ণ দেখল জুহা মৌলবি গাড়োয়ানের পিছনে বসে রয়েছেন। দুর্বোধ্য ভাষায় সুর ধরে তিনি কিছু পাঠ করেছেন। নিশ্চয় আরবি তন্ত্রমন্ত্র। জুহা মৌলবি তন্ময় হয়ে থাকার দরুন হয়তো লক্ষ্য করতেন না পাশ দিয়ে কে ধুলোর ঝড় তুলে অস্পষ্ট চলে গেল ঘোড়ার সওয়ার। কিন্তু স্বর্ণ থামল।…’মৌলুবি চাচা! কেমন আছেন? কোথায় চললেন এতসব জিনিসপত্র নিয়ে?’
ধূসর আলোয় মৌলবি স্বর্ণর মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক কয়েক মুহূর্ত। পরক্ষণে চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘স্বর্ণ! স্বর্ণময়ী! স্বর্ণলতা! ও মা তুমি? খোয়াব দেখছি না তো মা? বাবাকে টেক্কা দিয়েছ—অ্যাঁ!’ হো হো করে হেসে ওঠেন মৌলবি।
স্বর্ণ বলে, ‘কোথায় চললেন এমনভাবে?’
‘ডাবকই!’ জুহা মৌলবি জবাব দিলেন। ‘শিষ্যরা ছাড়ল না আর। ঘরবাড়ির ব্যবস্থা সব করে দিয়েছে। আমিও দেখলুম স্টেশন জায়গা—ভালোই হবে দেশবিদেশ যাওয়া আসা করতে। তুমি কেমন আছো বাছা? বাবার চিঠিপত্র পাচ্ছ?
‘পাচ্ছি। ভালো আছেন।’
‘তোমার খবর কিছুকিছু পাই, স্বর্ণ। দেশচর লোক—কানে আসে। তা বাবার মতন পসার করতে পেরেছ তো মা?’
স্বর্ণ সকৌতুকে হাসে।…’না চাচা, পারলুম কই? সবাই যে একঘরে করতে চায়। রোগী আসতে দ্যায় না। পাদরিবাবার ওখানে হাসপাতাল হচ্ছে শোনেননি?’
জুহা মৌলবি ভুরু কুঁচকে ঝুঁকে আসেন।…’কী হচ্ছে? হাসপাতাল?’
‘হ্যাঁ।
‘কোন পাদরি এসে জুটেছে আবার? সেই সাইমন সায়েব নাকি?’
‘হুঁ।’
‘ব্যাটার শিক্ষা তাহলে হয়নি?’… জুহা মৌলবির মুখ লাল হয়ে ওঠে হঠাৎ।
স্বর্ণ হাসে।…’একবার কে ওঁর মশারিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ব্যাঙ পোড়া হতে গিয়ে খুব বেঁচেছে।’
জুহা মৌলবির ক্রোধ হাসিতে ফেটে যায়। প্রচণ্ড হাসেন।
‘লোকের ধারণা, আমিই আগুন দিয়েছি—বুঝলেন চাচা?’
‘তুমি? যাঃ!’
‘তাই তো লোকের এত রাগ আমার ওপর!’
‘মুসলমানরা কী বলে?’
‘ডাবকই তো যাচ্ছেন—থাকবেনও। সেখানেই সব শুনবেন আপনার শিষ্যদের কাছে।’
জুহা মৌলবি গম্ভীর মুখে বলেন, ‘ডাবকই গ্রামের কেউ তো আমাকে এসব কথা জানায়নি! তৌবা তৌবা! খ্রিস্টানের ওষুধ খাবে মুসলমানরা আমি তবে বেঁচে আছি, না কবরে গেছি?’
‘হিন্দুর ওষুধ খেলে যদি আপনার শিষ্যদের জাত না যায়, তাহলে খ্রিস্টানের ওষুধে যাবে কেন?’
জুহা সাহেব গর্জে ওঠেন—’ইংরেজ মুসলমানদের দুশমন। হ্যাঁ—আমি গিয়েই ফতোয়া দেব—যে মুসলমান ইংরেজ পাদরির হাতের ওষুধ খাবে, তার জন্যে জাহান্নামের দরজা খুলে যাবে।’
‘ওরা কানই করবে না দেখবেন।’ স্বর্ণ চপল স্বরে বলে।
মৌলবি মুঠো শূন্যে তুলে ঘোষণা করেন—’এ আমার জেহাদ। ইনশা আল্লাহ! এ জেহাদ শেষ না করে আমি আর সফরে যাব না।’
এইবার স্বর্ণ মৌলবির দুপাশে অবাক হয়ে চেয়ে থাকা তিন চারটি ছেলেমেয়েকে দেখতে পায়। সে বলে, ‘ওরা বুঝি আমার ভাইবোনেরা? ও চাচা, চাচির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন? নাকি পর্দা ভাঙলে পাপ হবে? ভয় নেই—আমি তো মেয়ে।’
জুহা মৌলবি শশব্যস্তে ঘুরে বলেন, ‘কই গো, একবার মুখ বের করো। এই দ্যাখো, আবার বন্ধু গৌরাঙ্গ ডাক্তারের সেই মেয়ে—স্বর্ণমা। আমার বেটি জোয়ান অফ আর্ককে একবার দ্যাখো!’
স্বর্ণ দ্যাখে, ছায়ার নিচেকার ঘাসের মতন ফ্যাকাসে রুগণ একটি মুখ বেরিয়ে এল শাড়ির পর্দার ফাঁকে। লাল টুকটুকে ঠোঁট। হাসল। শীর্ণ সাদা লম্বাটে আঙুল, নীল শিরা প্রতিভাত হল। সেই হাত আদাব দেবার ভঙ্গিতে একটু উঠল। মৃদু চুড়ি বাজল। কিন্তু কোনো কথা নয়।
জুহা মৌলবি খুশিতে বলেন, ‘এক দুর্ভাবনা ছিল চিকিৎসার। ছেলেপুলেগুলো ভীষণ ভোগে। পেটে ইয়াবড়ো সব পিলে। ভালোই হল—ঘরের ডাক্তার পেলুম। মা স্বর্ণ, লাইনের ধারেই পশ্চিমপাড়ায় তৈরি বাড়ি পেয়েছি। যাবে মা—কাল সকালেই একবার গিয়ে দেখে আসবে।’
হাউলিতে সামান্য পাঁক আছে। গাড়োয়ানরা গোরুর লেজ মুচড়ে চেঁচামেচি করতে থাকে। স্বর্ণ একটু তফাতে সরু বাঁধের ওপর দিয়ে ঘোড়া নিয়ে পেরোয়। ওপারে পৌঁছে সে বলে, ‘চলি মৌলবিচাচা! কাল নিশ্চয় যাব।’
চৈতকের গতি বেড়ে যায়। শুকনো রাঙামাটির পথ। ধুলো উড়িয়ে জঙ্গল পেরিয়ে যায়। শাড়ি পরে ঘোড়ার চড়ার খুব অসুবিধে আছে। হাঁটুর নিচে সারা পা খোলা। ধুলোয় রাঙা হয়ে গেছে। জর্জ বলেছিল একটা রাইডিং ড্রেসের কথা। প্রথম প্রথম লজ্জা করতে পারে পরতে। কিন্তু উপায় নেই। জর্জকে বলতে হবে—যা দাম লাগে, আনিয়ে দিক কলকাতা থেকে।…
বটতলায় পৌঁছে এসে দ্যাখে নিচু প্ল্যাটফর্মের নিচে সুধাময় বসে আছে চুপচাপ। গা জ্বলে ওঠে স্বর্ণর।
ঘোড়া থেকে নেমে সে সদর দরজায় তালা খুলে ভেতরে ঢোকে। ঘোড়াটা উঠোনে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু স্বর্ণ জর্জের শিক্ষানুসারে তার গলার চামটি ধরে উঠোনে পায়চারি করায় কিছুক্ষণ।
একসময় অন্ধকার হয়ে এলে আলো জ্বেলে বসে এবং চা খেতে খেতে স্বর্ণর হঠাৎ মনে হয় পাদরি সাইমনের মশারিতে আগুন কে দিতে পারে আর—সুধাময় ছাড়া? অবশ্যই সুধাময়।
এবং তার গা ছমছম করে, ওই ভীতু বোকা প্রেমিকটি সাইমনের হাসপাতালের খড়ের ঘরে এবার আগুন লাগিয়ে দেবে না তো?
স্বর্ণলতার এমন হিতসাধনের প্রবৃত্তি কার হতে পারে? কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে গেছে আপাতত। যদি সত্যি সুধাময় ওকাজ করে থাকে, তবে হাসপাতালেও আগুন লাগাতে পারে।
স্বর্ণ ভাবে এক্ষুনি লোকটাকে হুঁশিয়ার করে দিলে ভালো হয়। কারণ এরপর হাসপাতাল পুড়লে কিংবা পাদরির গায়ে সামান্য আঁচড় লাগলে স্বর্ণর ঘরেও আগুন লাগতে দেরি হবে না। এ এলাকায় পালটাপালটি আগুন লাগানো রেওয়াজ আছে। সারা গ্রীষ্মকাল লোকেরা খুব ভয়ে ভয়ে কাটায়।
তাছাড়া শুধু পালটা ঘর পোড়ানো নয়—স্বর্ণর ওপর অন্যরকম অত্যাচারও শুরু হওয়া বিচিত্র নয়। এখন স্বর্ণকে বাঁচানোর কেউ নেই—নিজেই নিজের সতর্ক রক্ষী।
স্বর্ণ অমনি ওঠে। দরজার বাইরে থেকে শুধু শেকল আটকে অন্ধকারে হন হন করে হেঁটে যায়। নির্জন স্তব্ধ স্টেশন আর প্ল্যাটফরম। পিপুলতলায় কেউ নেই। ল্যাম্পপোস্টগুলো থেকে মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। লোকাল ট্রেন চলে গেছে একটু আগে। কোনো যাত্রী নেই। খালাসিরা রাতের খাবার তৈরি করতে গেছে তাঁবুতে। স্টেশনের ভিতরে জর্জ একা বসে কী লিখছে প্রকাণ্ড খাতায়।
অন্ধকারে স্বর্ণ হাঁটে। কোয়ার্টারের কাছে গিয়ে থামে। গুনগুন করে সুর করে সুধাময় কী সংস্কৃত শ্লোক উচ্চারণ করছে শোনা যায়। জানালা খোলা। আলো আছে ঘরে। বিছানায় শুয়ে আছে সুধাময় চিত হয়ে। দুটো হাত বুকের ওপর, আঙুল জড়ানো। চোখ বোজা আছে। তার ঠোঁট নড়ছে শুধু।
স্বর্ণ অস্ফুট স্বরে জানলার ধার থেকে—’মাস্টারবাবু!’
চমকে লাফিয়ে ওঠে সহকারী স্টেশনমাস্টার। ‘কে? কে?’ বলে একচোখা রেলবাতিটা নিয়ে জানলায় চলে আসে।
স্বর্ণ কঠোর মুখে বলে, ‘শুনুন মাস্টারবাবু, একটা কথা বলতে এলুম। আপনি আমাকে ভীষণ বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি। খবরদার, পাদরি সায়েবের আর কোনো ক্ষতি করতে চেষ্টা করবেন না। তাহলে এবার আপনিই বিপদে পড়বেন বলে দিচ্ছি।’
জানলার রডের ওদিকে দাড়িগোঁফওয়ালা মুখটা আবছা হয়ে আছে—শুধু জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দেখা যাচ্ছে।
স্বর্ণ সাঁৎ করে চলে যায়। তারপরও কতক্ষণ সেই মুখ একই ফ্রেমে আটকে থাকে ছবির মতন—আলোও কাঁপে না।
স্টেশনের বারান্দায় জর্জ বেরিয়েছে। স্বর্ণকে দেখে সে বলে, ‘কী হল ডিডি?’
স্বর্ণ তখন হাসে।…’একা ভাল্লাগছিল না। তাই চলে এলুম। চলো তোমার টেলিগ্রাফ করা দেখব।’
ঘরে ঢুকে টেবিলে পা ঝুলিয়ে সে বসে। জর্জ এসে তার পাশেই নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। তার মুখটা কেমন গম্ভীর।
স্বর্ণ বলে, ‘তোমার আবার কী হল জর্জ? কথা বলছ না কেন’?
‘ডিডি!’… জর্জ একটু হাসে।
‘হুঁ বলো।’
‘টুমি—ইউ ওয়েন্ট দেয়ার—আমি ডেকসিলো।’
‘হুঁ—দেখেছিল নয় দেখেছিলাম—দেখেছিলুম।’
‘ডিডি, সুঢাবাবু কী বলল—হোয়াই—কেন গিয়াসিল?’
‘ভ্যাট কে—ন গি—য়ে—ছি—লে? হোয়াই ইউ ওয়েন্ট দেয়ার?’
জর্জ গতিক বুঝে প্রসঙ্গ বদলায়।….