[মান্দ্রাজ হইতে প্রকাশিত ইংরেজী ‘ব্রহ্মবাদিন’ পত্রিকার জন্য লিখিত—১৮৯৯]
১
ভগবান্ বুদ্ধ ধর্মের অন্যান্য প্রায় সকল ভাবকে সেই সময়ের জন্য বাদ দিয়া ‘তাপিত জগৎকে সাহায্য করাই সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম’—এই ভাবটিকেই প্রাধান্য দিয়া গিয়াছেন, কিন্তু স্বার্থপূর্ণ আমিত্বে আসক্ত যে সম্পূর্ণ ভ্রমমাত্র, ইহা উপলব্ধি করিবার জন্য তাঁহাকেও অনেক বৎসর ধরিয়া আত্মানুসন্ধানে কাটাইতে হইয়াছিল। আমাদের উচ্চতম কল্পনাশক্তিও বুদ্ধদেব অপেক্ষা নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত কর্মীর ধারণা করিতে অক্ষম; তথাপি সমুদয় বিষয়ের রহস্য বুঝিতে তাঁর অপেক্ষা আর কাহাকে কঠোরতর সংগ্রাম করিতে হইয়াছিল? এ-কথা সকল সময়েই সত্য যে, কার্য যে পরিমাণে মহৎ, তাহার পশ্চাতে সেই পরিমাণে উপলব্ধির শক্তি নিহিত। পূর্ব হইতেই প্রস্তুত একটি সুচিন্তিত কার্য-প্রণালীর প্রত্যেক খুঁটিনাটিকে কার্যে পরিণত করিবার জন্য অধিক একাগ্র চিন্তাশক্তির প্রয়োজন না হইতে পারে, কিন্তু প্রবল শক্তি গভীর মনঃসংযোগেরই পরিণাম মাত্র। সামান্য প্রচেষ্টার জন্য হয়তো মতবাদমাত্র পর্যাপ্ত হইতে পারে; কিন্তু যে ক্ষুদ্র বেগের দ্বারা ক্ষুদ্র লহরীর উৎপত্তি হয়, প্রবল উর্মির জনক তীব্র বেগ হইতে তাহা নিশ্চয় খুবই পৃথক্। তাহা হইলেও ঐ ক্ষুদ্র লহরীটি প্রবল উর্মি-উৎপাদনকারী শক্তির এক ক্ষুদ্র অংশেরই বিকাশমাত্র।
মন নিম্নতর কর্মভূমিতে প্রবল কর্মতরঙ্গ তুলিতে সক্ষম হইবার পূর্বে তাহাকে তথ্যসমূহের—নগ্ন সত্যসমূহের নিকট পৌঁছিতে হইবে, সেগুলি যতই কঠোর ও ভীষণ হউক; সত্যকে—খাঁটি সত্যকে (যদিও উহার তীব্র স্পন্দনে হৃদয়ের প্রত্যেকটি তন্ত্রী ছিন্ন হইতে পারে) লাভ করিতে হইবে এবং নিঃস্বার্থ ও অকপট প্রেরণা (যদিও উহা লাভ করিতে একটির পর আর একটি করিয়া প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাটিয়া ফেলিতে হয়) অর্জন করিতে হইবে। সূক্ষ্ম বস্তু কালচক্রে প্রবাহিত হইতে হইতে ব্যক্তভাব ধারণা করিবার জন্য উহার চতুর্দিকে স্থূলবস্তুসমূহ একত্র করিতে থাকে; অদৃশ্য—দৃশ্যের আকার ধারণ করে; সম্ভব—বাস্তবে, কারণ—কার্যে এবং চিন্তা—প্রত্যক্ষ কর্মে পরিণত হয়।
সহস্র সহস্র ঘটনা যে কারণকে এখন কার্যে রূপায়িত হইতে দিতেছে না, তাহা শীঘ্র বা বিলম্বে কার্যরূপে প্রকাশিত হইবে; বর্তমানে যতই নিস্তেজ হউক না কেন, জড়জগতে শক্তিশালী চিন্তার গৌরবের দিন আসিবে। আর যে আদর্শ ইন্দ্রিয়সুখ-প্রদানের সামর্থ্য দ্বারাই সকল বস্তুর গুণাগুণ বিচার করে, তাহা যথার্থ আদর্শ নহে।
যে প্রাণী যত নিম্নস্তরের, সে ইন্দ্রিয়ে তত অধিক সুখ অনুভব করে, সে তত অধিক পরিমাণে ইন্দ্রিয়ের রাজ্যে বাস করে। ইন্দ্রিয়-সুখের পরিবর্তে উচ্চতর স্তরের দৃশ্য দেখাইয়া ও সেখানকার সুখ আস্বাদ করাইয়া পশুভাবাপন্ন মানুষকে অতীন্দ্রিয় রাজ্যে লইয়া যাইবার শক্তিকেই যথার্থ সভ্যতা বলিয়া বুঝা উচিত।
মানুষ সহজাত প্রবৃত্তি অনুযায়ী ইহা জানে। সকল অবস্থায় সে নিজে ইহা স্পষ্টরূপে না-ও বুঝিতে পারে। ভাবময় জীবন সম্বন্ধে তাহার হয়তো ভিন্ন মত থাকিতে পারে, কিন্তু এ সকল সত্ত্বেও তাহার প্রাণের এই স্বাভাবিক ভাব লুপ্ত হয় না, উহা সর্বদাই আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করে—তাই সে বাজিকর, চিকিৎসক, ঐন্দ্রজালিক, পুরোহিত অথবা বিজ্ঞানের অধ্যাপককে সম্মান না করিয়া থাকিতে পারে না। মানুষ যে-পরিমাণে ইন্দ্রিয়ের রাজ্য ছাড়াইয়া উচ্চ ভূমিতে বাস করিবার শক্তি লাভ করে, তাহার ফুসফুস যে-পরিমাণ বিশুদ্ধ ভাব গ্রহণ করিতে পারে এবং যতটা সময় সে এই উচ্চাবস্থায় থাকিতে পারে, তাহা দ্বারাই তাহার উন্নতির পরিমাপ হয়।
সংসারে ইহা দেখা যায় এবং স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, উন্নত মানবগণ জীবনধারণের জন্য যতটুকু আবশ্যক, ততটুকু ব্যতীত তথাকথিত আরামের জন্য সময় ব্যয় করিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক; আর যতই তাঁহারা উন্নত হইতে থাকেন, ততই নিতান্ত আবশ্যক কাজগুলিতে তাঁহাদের উৎসাহ কমিয়া যায়।
ভাব ও আদর্শ অনুসারে মানুষের বিলাসের ধারণা পর্যন্ত পরিবর্তিত হইতে থাকে। মানুষ চেষ্টা করে, সে যে-চিন্তাজগতে বিচরণ করিতেছে, তাহার বিলাসের বস্তুগুলিও যেন যথাসম্ভব তদনুযায়ী হয়—আর ইহাই কলা বা কৌশল।
‘যেমন এক অগ্নি জগতে প্রবিষ্ট হইয়া নানারূপে প্রকাশ পাইতেছে, অথচ যতটুকু ব্যক্ত হইয়াছে, তদপেক্ষাও ইহা অনেক বেশী’২৬—ঠিক কথা, অনন্তগুণে অধিক। এক কণা—সেই অনন্ত জ্ঞানের এক কণা-মাত্র আমাদের সুখবিধানের জন্য জড়-জগতে অবতরণ করিতে পারে, ইহার অবশিষ্ট ভাগকে জড়ের ভিতর টানিয়া আনিয়া এইভাবে স্থূল কঠিন হস্তে নাড়াচড়া করা যাইতে পারে না। সেই পরম সূক্ষ্ম পদার্থ সর্বদাই আমাদের দৃষ্টিক্ষেত্র হইতে পলাইয়া যাইতেছে এবং ইহাকে আমাদের স্তরে আনিবার চেষ্টা দেখিয়া উপহাস করিতেছে। এক্ষেত্রে মহম্মদকেই পর্বতের নিকট যাইতে হইবে—‘না’ বলিবার উপায় নাই। মানুষ যদি সেই উচ্চস্তরের সৌন্দর্যরাশি ভোগ করিতে চায়, যদি সে ইহার বিমল আলোকে অবগাহন করিতে চায়, যদি সে দেখিতে চায় যে, তাহার নিজের জীবন সেই জগৎকারণের সহিত এক ছন্দে স্পন্দিত হইতেছে, তবে তাহাকে সেই স্তরে উঠিতে হইবে।
জ্ঞানই বিস্ময়-রাজ্যের দ্বার খুলিয়া দেয়, জ্ঞানই পশুকে দেবতা করে; যে জ্ঞান আমাদিগকে সেই বস্তুর নিকট লইয়া যায়, যাঁহাকে জানিলে আর সকলই জানা হয়২৭, যাহা সকল জ্ঞানের কেন্দ্রস্বরূপ, যাহার স্পন্দনে সকল বিজ্ঞান জীবন্ত হইয়া উঠে—সেই ধর্মবিজ্ঞান নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ, কারণ উহাই কেবল মানুষকে সম্পূর্ণ ধ্যানময় জীবনযাপনে সমর্থ করে। ধন্য সেই দেশ যে দেশ ইহাকে ‘পরাবিদ্যা’ নামে অভিহিত করিয়াছে!
কর্মজীবনে তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হইতে প্রায় দেখা যায় না, তথাপি আদর্শটি এখনও নষ্ট হয় নাই। একদিকে আমাদের কর্তব্য এই যে, আমরা আমাদের আদর্শের দিকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপেই অগ্রসর হই বা অতি ধীরে ধীরে অননুভবনীয় গতিতে অগ্রসর হই, আমরা যেন কখনও ইহা ভুলিয়া না যাই। আবার অপর দিকে দেখা যায়, যদিও আমরা আমাদের চোখে হাত দিয়া সত্যের জ্যোতিকে ঢাকিয়া রাখিবার যথাসাধ্য চেষ্টা করি, তথাপি সে আদর্শ সর্বদাই আমাদের সম্মুখে স্পষ্টভাবে বিদ্যমান।
আদর্শই কর্মজীবনের প্রাণ। আমরা দার্শনিক বিচারই করি বা প্রাত্যহিক জীবনের কঠোর কর্তব্য সম্পন্ন করি, আদর্শই আমাদের সমগ্র জীবনকে ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছে। আদর্শের রশ্মি সরল বা বক্র নানা রেখায় প্রতিবিম্বিত ও পরাবর্তিত (refracted) হইয়া আমাদের জীবনগৃহের প্রতিটি গবাক্ষপথে আসিতেছে, আর জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ইহার আলোক আমাদিগকে প্রত্যেক কার্যই করিতে হয়, প্রত্যেক বস্তুকেই ইহা দ্বারা পরিবর্তিত সুন্দর বা বিকৃতরূপে দেখা যায়। আমরা বর্তমানে যাহা হইয়াছি, আদর্শই আমাদিগকে তাহা করিয়াছে; আর ভবিষ্যতে যাহা হইব, আদর্শই আমাদিগকে তাহা করিবে। আদর্শের শক্তি আমাদিগকে আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে; আমাদের সুখে দুঃখে, বড় বা ছোট কাজে, আমাদের ধর্মাধর্মে ইহার শক্তির পরিচয় অনুভূত হইয়া থাকে।
যদি কর্মজীবনের উপর আদর্শের এইরূপ প্রভাব হয়, কর্মজীবনও আদর্শ গঠনে কম শক্তিমান্ নহে। আদর্শের সত্য কর্মজীবনেই প্রমাণিত। আদর্শের পরিণতি কর্মজীবনের প্রত্যক্ষ অনুভবে। আদর্শ থাকিলেই প্রমাণিত হয় যে, কোন না কোন স্থানে, কোন না কোনরূপে ইহা কর্মজীবনেও পরিণত হইয়াছে। আদর্শ বৃহত্তর হইতে পারে, কিন্তু ইহা কর্মজীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের বিস্তৃত ভাবমাত্র। আদর্শ অনেক স্থলেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্মের সমষ্ঠি ও সাধারণ ভাবমাত্র।
কর্মজীবনেই আদর্শের শক্তিপ্রকাশ। কর্মজীবনের মধ্য দিয়াই ইহা আমাদের উপর কার্য করিতে পারে। কর্মজীবনের মাধ্যমে আদর্শ আমাদের জীবনে গ্রহণোপযোগী আকারে পরিবর্তিত হইয়া আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্তরে অবতরণ করে। কর্মজীবনকে সোপান করিয়াই আমরা আদর্শে আরোহণ করি। উহারই উপর আমাদের আশা-ভরসা নির্ভর করে; উহা আমাদিগকে কার্যে উৎসাহ দেয়।
যাহাদের বাক্যবিন্যাস আদর্শকে অতি সুন্দরভাবে প্রকাশ করিতে পারে অথবা যাহারা সূক্ষ্মতম তত্ত্বসমূহ উদ্ভাবন করিতে পারে, এরূপ লক্ষ লক্ষ লোক অপেক্ষা আদর্শকে নিজ জীবনে প্রতিফলিত করিতে পারিয়াছে—এরূপ একজন মানুষ অধিক শক্তিশালী।
ধর্মের সহিত সংযুক্ত না হইলে, এবং অল্পবিস্তর সফলতার সহিত কর্মজীবনে ধর্ম পরিণত করিতে যত্নবান্ একদল অনুবর্তী না পাইলে মানবজাতির নিকট দর্শনশাস্ত্রসমূহ নিরর্থক প্রতীয়মান হয়, বড়জোর উহা কেবল মানসিক ব্যায়ামমাত্র বলিয়া গণ্য হইতে পারে। যে-সকল মতবাদ একটা কিছু প্রত্যক্ষ বস্তু পাইবার আশা জাগ্রত করে না, কতক লোক সেই সকল মতবাদ গ্রহণ করিয়াও কিছুটা কার্যে পরিণত করিতে পারে, এগুলিও স্থায়িত্বের জন্য বহু লোক প্রয়োজন, কারণ তাহার অভাবে অনেক নিশ্চিত মতবাদও লোপ পাইয়াছে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাবময় জীবনের সহিত কর্মের সামঞ্জস্য রাখিতে পারে না। কোন কোন মহাত্মা পারেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই বোধ হয়, গভীরভাবে চিন্তা করিলে কার্যশক্তি হারাইয়া ফেলে, আবার বেশী কাজ করিলে গভীর চিন্তাশক্তি হারাইয়া থাকে। এই কারণেই অনেক মহামনস্বী যে-সকল উচ্চ উচ্চ আদর্শ জীবনে উপলব্ধি করেন, সেইগুলিকে জগতে কার্যে পরিণত করিবার ভার তাঁহাদিগকে কালের হস্তে ন্যস্ত করিয়া যাইতে হয়। যতদিন না অপেক্ষাকৃত ক্রিয়াশীল মস্তিষ্ক আসিয়া আদর্শগুলিকে কার্যে পরিণত করিয়া প্রচার করিতেছে, ততদিন তাঁহাদের চিন্তারাশিকে অপেক্ষা করিতে হইবে। কিন্তু এ কথা লিখিবার সময়েই আমরা দিব্যচক্ষে সেই পার্থসারথীকে দেখিতেছি, তিনি যেন উভয় বিরোধী সৈন্যদলের মধ্যে রথে দাঁড়াইয়া বামহস্তে দৃপ্ত অশ্বগণকে সংযত করিতেছেন—বর্মপরিহিত যোদ্ধৃবেশে প্রখর দৃষ্টি দ্বারা সমবেত সৈন্যদলকে দর্শন করিতেছেন এবং স্বাভাবিক জ্ঞানের দ্বারা উভয় পক্ষের সৈন্যসজ্জার প্রত্যেক খুঁটিনাটিও বিচার করিয়া দেখিতেছেন; আবার অপর দিকে আমরা যেন শুনিতেছি—ভীত অর্জুনকে চমকিত করিয়া তাঁহার মুখ হইতে কর্মের অত্যদ্ভুত রহস্য বাহির হইতেছেঃ
যিনি কর্মের মধ্যে অকর্ম অর্থাৎ বিশ্রাম বা শান্তি এবং অকর্মের অর্থাৎ বিশ্রামের ভিতর কর্ম দেখেন, মনুষ্যগণের মধ্যে তিনি বুদ্ধিমান্, তিনিই যোগী, তিনিই সকল কর্ম করিয়া থাকেন।২৮
ইহাই পূর্ণ আদর্শ। কিন্তু খুব কম লোকেই এই আদর্শে পৌঁছিয়া থাকে। সুতরাং যেমনটি আছে, আমাদিগকে তেমনিই লইতে হইবে এবং বিভিন্ন ব্যক্তিতে প্রকাশিত বিভিন্ন চরিত্র-বৈশিষ্ট্যগুলিকে একত্র গ্রথিত করিয়াই আমাদিগকে সন্তুষ্ট থাকিতে হইবে।
ধার্মিক লোকেদের ভিতর আমরা তীব্র চিন্তাশীল (জ্ঞানযোগী), লোকহিতের জন্য প্রবল কর্মানুষ্ঠানকারী (কর্মযোগী), সাহসের সহিত আত্মসাক্ষাৎকারে অগ্রসর (রাজযোগ) এবং শান্ত ও বিনয়ী (ভক্তিযোগী)—এই চারি প্রকারের সাধক দেখিতে পাই।
২
বর্তমান প্রবন্ধে যাঁহার চরিত্র সংক্ষেপে বর্ণিত হইবে, তিনি একজন অদ্ভুত বিনয়ী ও গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধিসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন।
পওহারী বাবা (শেষ জীবনে ইনি এই নামে অভিহিত হইতেন) বারাণসী জেলার গুজী নামক স্থানের নিকটবর্তী এক গ্রামে ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করেন।২৯ তিনি অতি বাল্যকালেই গাজিপুরে তাঁহার পিতৃব্যের নিকট থাকিয়া শিক্ষালাভ করিবার জন্য আসিলেন।
বর্তমানকালে হিন্দু সাধুরা—সন্ন্যাসী, যোগী, বৈরাগী ও পন্থী—প্রধানতঃ এই চারি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। সন্ন্যাসীরা শঙ্করাচার্যের মতাবলম্বী অদ্বৈতবাদী। যোগীরা যদিও অদ্বৈতবাদী, তথাপি তাঁহারা বিভিন্নপ্রকার যোগপ্রণালীর সাধন করিয়া থাকেন বলিয়া তাঁহাদিগকে স্বতন্ত্র শ্রেণীরূপে পরিগণিত করা হয়। বৈরাগীরা রামানুজ ও অন্যান্য দ্বৈতবাদী আচার্যগণের অনুবর্তী। মুসলমান রাজত্বের সময় যে-সকল ধর্মসম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাদিগকে ‘পন্থী’ বলে; ইহাদের মধ্যে অদ্বৈত ও দ্বৈত উভয় প্রকার মতাবলম্বীই দেখিতে পাওয়া যায়। পওহারী বাবার পিতৃব্য রামানুজ বা শ্রী-সম্প্রদায়ভুক্ত একজন নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারী ছিলেন—অর্থাৎ তিনি আজীবন অবিবাহিত থাকিবেন, এই ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন। গাজিপুরের দুই মাইল উত্তরে গঙ্গাতীরে তাঁহার একখণ্ড জমি ছিল, সেইখানেই তিনি বাস করিতেন। তাঁহার অনেকগুলি ভ্রাতুষ্পুত্র ছিল বলিয়া তিনি পওহারী বাবাকে নিজ বাটীতে রাখিয়াছিলেন, আর তাঁহাকেই তাঁহার বিষয়-সম্পত্তি ও সামাজিক পদমর্যাদার উত্তরাধিকারী মনোনীত করিয়াছিলেন।
পওহারী বাবার এই সময়কার জীবনের ঘটনা বিশেষ কিছু জানা যায় না। যে-সকল বিশেষত্বের জন্য ভবিষ্যৎ জীবনে তিনি এরূপ সুপরিচিত হইয়াছিলেন, সেগুলির কোন লক্ষণ তখন তাঁহাতে প্রকাশ পাইয়াছিল বলিয়াও বোধ হয় না। লোকের এইটুকুই স্মরণ আছে যে—তিনি ব্যাকরণ, ন্যায় এবং নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থসমূহ অতিশয় মনোযোগের সহিত অধ্যয়ন করিতেন; এদিকে খুব চটপটে ও আমুদে ছিলেন। সময় সময় আমোদের মাত্রা এত বাড়িয়া উঠিত যে, তাঁহার রঙ্গপ্রিয়তার ফলে সহপাঠী ছাত্রগণকে বিলক্ষণ ভুগিতে হইত।
এইরূপে প্রাচীন ধরনের ভারতীয় ছাত্রজীবনের দৈনন্দিন কার্যের ভিতর দিয়া ভাবী মহাত্মার বাল্যজীবন কাটিতে লাগিল; তাঁহার অধ্যয়নে অসাধারণ অনুরাগ ও ভাষাশিক্ষায় অপূর্ব দক্ষতা ব্যতীত সেই সরল সদানন্দ ক্রীড়াশীল ছাত্রজীবনে এমন কিছু দেখা যায় নাই, যাহা তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের সেই প্রবল গাম্ভীর্যের পূর্বাভাস দেয়—যাহার চূড়ান্ত পরিণতি হইয়াছিল এক অদ্ভুত ও ভয়ানক আত্মাহুতিতে।
এই সময় এমন একটি ঘটনা ঘটিল, যাহাতে এই অধ্যয়নশীল যুবক—সম্ভবতঃ এই প্রথম—জীবনের গভীর মর্ম প্রাণে প্রাণে বুঝিলেন; এতদিন তাঁহার যে দৃষ্টি পুস্তকে নিবদ্ধ ছিল, এখন সেখান হইতে উঠাইয়া তাহা দ্বারা তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নিজ মনোজগৎ পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন; পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া ধর্মে যথার্থ সত্য কিছু আছে কি না, তাহা জানিবার জন্য তাঁহার প্রাণ ব্যাকুল হইল। এই সময় তাঁহার পিতৃব্যের দেহত্যাগ হইল। যাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া তিনি জীবন ধারণ করিতেন, যাঁহার উপর এই যুবক-হৃদয়ের সমুদয় ভালবাসা নিষিদ্ধ ছিল, তিনি চলিয়া গেলেন; তখন সেই উদ্দাম যুবক হৃদয়ের অন্তস্তলে শোকাহত হইয়া ঐ শূন্যস্থান পূরণ করিবার জন্য এমন বস্তুর অন্বেষণে দৃঢ়সঙ্কল্প হইলেন, যাহা অপরিবর্তনীয়।
ভারতে সকল বিষয়ের জন্যই একজন গুরুর প্রয়োজন হয়। আমরা হিন্দুরা বিশ্বাস করি, পুস্তকে তত্ত্ববিশেষের ভাসা-ভাসা বর্ণনামাত্র থাকে। সকল শিল্পের, সকল বিদ্যার, সর্বোপরি ধর্মের জীবন্ত রহস্যসমূহ গুরু হইতে শিষ্যে সঞ্চারিত হওয়া চাই।
স্মরণাতীত কাল হইতে ভারতে ঈশ্বরানুরাগী ব্যক্তিগণ অন্তর্জীবনের রহস্য নির্বিঘ্নে মনন করিবার জন্য সর্বদাই লোকালয় পরিত্যাগ করিয়া অতি নিভৃত স্থানে গিয়া বাস করিয়াছেন; আর এখনও এমন একটি বন, পর্বত বা পবিত্রস্থান নাই, কিংবদন্তী যাহাকে কোন না কোন মহাত্মার বাসস্থান বলিয়া মহিমান্বিত করে নাই।
তাহার পর এই উক্তিটিও সর্বজনপ্রসিদ্ধ যে, ‘রমতা সাধু, বহতা পানি। যহ কাভি না মৈল লখানি॥’
অর্থাৎ যে জল প্রবাহিত হয় তাহা যেমন বিশুদ্ধ থাকে, তেমনি যে সাধু ভ্রমণ করিয়া বেড়ান, তিনিও তেমনি পবিত্র থাকেন।
ভারতে যাঁহারা ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া ধর্মজীবন গ্রহণ করেন, তাঁহারা সাধারণতঃ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিচরণ করিয়া বিভিন্ন তীর্থ ও দেবমন্দির দর্শন করিয়াই অধিকাংশ জীবন কাটাইয়া থাকেন—কোন জিনিষ যেমন সর্বদা নাড়াচাড়া করিলে তাহাতে মরিচা ধরে না, তাঁহারা বলেন, এরূপ ভ্রমণ করিলে তাঁহাদের মধ্যেও সেইরূপ মলিনতা প্রবেশ করিবে না। ইহাতে আর এক উপকার হয় এই যে, তাঁহারা দ্বারে দ্বারে ধর্ম বহন করিয়া লইয়া যান। যাঁহারা সংসারত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সকলের পক্ষেই ভারতের চারি কোণে অবস্থিত চারিটি৩০ প্রধান তীর্থ দর্শন করা একরূপ অবশ্য-কর্তব্য বলিয়া বিবেচিত হয়।
এইসব চিন্তাই বোধ হয় আমাদের যুবক ব্রহ্মচারীকে প্রভাবিত করিয়াছিল, তবে আমরা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি, জ্ঞানতৃষ্ণাই তাঁহার ভ্রমণের সর্বপ্রধান কারণ। আমরা তাঁহার ভ্রমণ সম্বন্ধে খুব অল্পই জানি, তবে তাঁহার সম্প্রদায়ের অধিকাংশ গ্রন্থ যে ভাষায় লিখিত সেই দ্রাবিড় ভাষাসমূহে তাঁহার জ্ঞান দেখিয়া এবং শ্রীচৈতন্য-সম্প্রদায়ভুক্ত বৈষ্ণবগণের প্রাচীন বাঙলা ভাষার সহিত তাঁহার ব্যাপক পরিচয় দেখিয়া আমরা অনুমান করি, দাক্ষিণাত্যে ও বাঙলাদেশে তাঁহার স্থিতি বড় অল্পদিন হয় নাই।
কিন্তু একটি স্থানে গমনের সম্বন্ধে তাঁহার যৌবনকালের বন্ধুগণ বিশেষ জোর দিয়া বলিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, কাথিয়াওয়াড়ে গিরনার পর্বতের শীর্ষদেশে যোগসাধনার রহস্যে প্রথম দীক্ষিত হন।
এই পর্বত বৌদ্ধদের চক্ষে অতি পবিত্র ছিল। এই পর্বতের পাদদেশে সেই সুবৃহৎ শিলা বিদ্যমান, যাহার উপর সম্রাটকুলের মধ্যে ধার্মিকচূড়ামণি ধর্মাশোকের সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত অনুশাসন খোদিত আছে। উহার নিম্নদেশে শত শত শতাব্দীর বিস্মৃতির অন্ধকারে অরণ্যাবৃত বিরাট স্তুপরাজি লীন হইয়াছিল—ঐগুলিকে অনেকদিন ধরিয়াই গিরনার পর্বতশ্রেণীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শৈলমালা বলিয়াই লোকে মনে করিত। বৌদ্ধধর্ম এক্ষণে যে সম্প্রদায়ের সংশোধিত সংস্করণ বলিয়া বিবেচিত হয়—সেই ধর্মসম্প্রদায় এখনও উহাকে বড় কম পবিত্র মনে করেন না; আর আশ্চর্যের বিষয়, ঐ ধর্মের জগজ্জয়ী উত্তরাধিকারী আধুনিক হিন্দুধর্মে মিশিয়া যাইবার পূর্ব পর্যন্ত ঐ ধর্ম সাহসপূর্বক স্থাপত্যক্ষেত্রে জয়লাভ করিবার চেষ্টা করে নাই।
৩
মহাযোগী অবধূতগুরু দত্তাত্রেয়ের পবিত্র নিবাসভূমি বলিয়া গিরনার হিন্দুদের মধ্যে বিখ্যাত; আর কিংবদন্তী আছে যে, এই পর্বতচূড়ায় ভাগ্যবান ব্যক্তিগণ এখনও বড় বড় সিদ্ধযোগীর সাক্ষাৎ পাইয়া থাকেন।
তারপর আমরা দেখিতে পাই, এই যুবক ব্রহ্মচারী বারাণসীর নিকটে গঙ্গাতীরে জনৈক যোগসাধক সন্ন্যাসীরা শিষ্যরূপে বাস করিতেছেন। এই সন্ন্যাসী নদীর উচ্চতটভূমির উপর খনিত একটি গর্তে বাস করিতেন। আমাদের প্রবন্ধের বিষয়ীভূত মহাত্মাও পরবর্তী জীবন গাজিপুরের নিকট নদীর উচ্চতটভূমিতে একটি গভীর গহ্বর নির্মাণ করিয়া বাস করিতেন; ইহা তিনি ওই গুরুর নিকটে শিখিয়াছিলেন, বেশ বুঝিতে পারা যায়।
যোগীরা যোগাভ্যাসের সুবিধার জন্য সর্বদাই গুহা অথবা যেখানকার আবহাওয়ার কোন রূপ পরিবর্তন নাই, এবং যেখানে কোন শব্দ মনকে বিচলিত করিতে পারে না, এমন স্থানে বাস করিতে উপদেশ দিয়াছেন।
আমরা আরও জানিতে পারি যে, তিনি প্রায় এই সময়ে বারাণসীতে জনৈক সন্ন্যাসীর নিকট অদ্বৈতবাদ শিক্ষা করিতেছিলেন।
অনেক বর্ষ ভ্রমণ, অধ্যয়ন ও সাধনার পর এই ব্রহ্মচারী যুবক, যেস্থানে বাল্যকালে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন, সেস্থানে ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার পিতৃব্য যদি তখন জীবিত থাকিতেন, তবে তিনি সম্ভবতঃ এই বালকের মুখমণ্ডলে সেই জ্যোতিঃ দেখিতে পাইতেন, যাহা প্রাচীনকালে জনৈক শ্রেষ্ঠ ঋষি তাঁহার শিষ্যের মুখে দেখিয়া বলিয়া উঠিয়াছিলেন—সৌম্য ব্রহ্মজ্যোতিতে আজ তোমার মুখ উদ্ভাসিত দেখিতেছি।৩১ কিন্তু এক্ষেত্রে বাল্যকালের সঙ্গীরাই তাঁহার গৃহপ্রত্যাবর্তনে স্বাগত অভ্যর্থনা করিলেন, তাঁহাদের অনেকেই সংসারে প্রবেশ করিয়াছিলেন—সংসার চিরদিনের জন্য তাঁহাদিগকে বাঁধিয়া ফেলিয়াছিল, যে সংসারে চিন্তার অবসর নাই, কিন্তু কর্ম অনন্ত।
তথাপি তাঁহারা তাঁহাদের সহপাঠী বন্ধু ও খেলার সাথীর (যাঁহার ভাব বুঝিতে তাঁহারা অভ্যস্ত ছিলেন) সমুদয় আচার-আচরণে এক পরিবর্তন—রহস্যময় পরিবর্তন লক্ষ্য করিলেন। ঐ পরিবর্তন দেখিয়া তাঁহাদের হৃদয়ে ভয় ও বিস্ময়ের উদ্রেক হইল। কিন্তু উহাতে তাঁহাদের হৃদয়ে তাঁহার মত হইবার ইচ্ছা, অথবা তাঁহার ন্যায় তত্ত্বান্বেষণ-স্পৃহা জাগরিত হইল না। তাঁহারা দেখিলেন, এ এক অদ্ভুত মানব—এই যন্ত্রণা ও জড়বাদপূর্ণ সংসার একেবারে অতিক্রম করিয়া চলিয়া গিয়াছে, এই পর্যন্ত। তাঁহারা স্বভাবতই তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইলেন, আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন না।
ইতোমধ্যে এই মহাত্মার বিশেষত্বসমূহ দিন দিন অধিকতর পরিস্ফুট হইতে লাগিল। বারাণসীর নিকটে তাঁহার গুরু যেমন করিয়াছিলেন, তিনিও সেইরূপ ভূমিতে একটি গর্ত খনন করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশকরতঃ অনেকক্ষণ সেখানে বাস করিতে লাগিলেন। তারপর তিনি আহার সম্বন্ধে অতি ভয়ানক কঠোর সংযম আরম্ভ করিলেন। সারাদিন তিনি নিজের ছোট আশ্রমটিতে কাজ করিতেন, তাঁহার পরম প্রেমাস্পদ প্রভু রামচন্দ্রের পূজা করিতেন, উত্তম খাদ্য রন্ধন করিয়া (কথিত আছে, তিনি রন্ধনবিদ্যায় অসাধারণ পটু ছিলেন) ঠাকুরের ভোগ দিতেন, তার পর সেই প্রসাদ বন্ধুবান্ধবগণ ও দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিতেন, এবং অনেক রাত্রি পর্যন্ত তাহাদের সেবা করিতেন। তাহারা সকলে যখন শয়ন করিত, তখন এই যুবক গোপনে সন্তরণ করিয়া গঙ্গার অপর তীরে যাইতেন। সেখানে সারা রাত সাধনভজনে কাটাইয়া ঊষার পূর্বেই ফিরিয়া আসিয়া বন্ধুবর্গকে জাগাইতেন এবং আবার নিত্যকর্ম আরম্ভ করিতেন, আমরা ভারতে এরূপ কাজকে ‘অপরের সেবা বা পূজা’ বলিয়া থাকি।
ইতোমধ্যে তাঁহার নিজের খাওয়াও কমিয়া আসিতে লাগিল; অবশেষে আমরা শুনিয়াছি, উহা প্রত্যহ এক মুঠ তেতো নিমপাতা বা কয়েকটা লঙ্কা মাত্রে দাঁড়াইল। তারপর গঙ্গাতীরস্থ জঙ্গলে প্রত্যহ রাত্রে সাধনার জন্য গমন ক্রমশঃ কমিয়া যাইতে লাগিল—তিনি নিজহাতে নির্মিত গুহাতে আরও বেশী সময় বাস করিতে লাগিলেন। আমরা শুনিয়াছি, সেই গুহায় তিনি দিনের পর দিন ও মাসের পর মাস ধ্যানমগ্ন হইয়া থাকিতেন, তারপর বাহির হইতেন। এই দীর্ঘকাল তিনি কি খাইয়া থাকিতেন, তাহা কেহই জানিত না; এই জন্য লোকে তাঁহাকে ‘পও-আহারী’ অর্থাৎ বায়ুভক্ষণকারী বাবা বলিতে আরম্ভ করিল।
তিনি তাঁহার জীবনে আর কখনও এই স্থান ত্যাগ করেন নাই। একবার তিনি এত অধিক দিন ধরিয়া ঐ গুহার মধ্যে ছিলেন যে, লোকে তাঁহাকে মৃত বলিয়া স্থির করিয়াছিল। কিন্তু অনেক দিন পরে বাবা আবার বাহির হইয়া বহুসংখ্যক সাধুকে এক ভাণ্ডারা দিলেন।
যখন ধ্যানমগ্ন না থাকিতেন, তখন তিনি তাঁহার গুহার মুখের উপরিভাগে অবস্থিত একটি গৃহে বাস করিতেন, আর এই সময়ে যাহারা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিত, তাহাদের সহিত তিনি সাক্ষাৎ করিতেন। তাঁহার যশঃসৌরভ চতুর্দিকে বিস্তৃত হইতে লাগিল। গাজিপুরের অহিফেন বিভাগের রায় গগনচন্দ্র বাহাদুর—যিনি স্বাভাবিক মহত্ত্ব ও ধর্মপ্রাণতার জন্য সকলেরই প্রিয় ছিলেন—আমাদিগকে এই মহাত্মার সহিত আলাপ করাইয়া দেন।
ভারতের আরও অনেক মহাত্মার জীবনের ন্যায়, এই জীবনেও বাহ্য কর্মমুখরতা বিশেষ কিছু ছিল না। ‘বাক্যের দ্বারা নয়, জীবনের দ্বারা শিক্ষা দিতে হইবে; আর যাহারা সত্য ধারণ করিবার উপযুক্ত হইয়াছে, তাহাদের জীবনে সত্য প্রতিফলিত হয়’—এই মহাপুরুষের জীবন ঐ ভারতীয় আদর্শেরই অন্যতম উদাহরণ। এই ধরনের ব্যক্তিগণ যাহা জানেন, তাহা প্রচার করিতে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক, কারণ তাঁহাদের দৃঢ় ধারণা এই যে, বাক্যের দ্বারা নয়, ভিতরের সাধনার দ্বারাই সত্যলাভ হয়। ধর্ম তাঁহাদের নিকট সামাজিক কর্তব্যের প্ররোচক শক্তিবিশেষ নয়, ধর্ম সত্যের ঐকান্তিক অনুসন্ধান এবং এই জীবনে সত্যের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি।
কালের একটি মুহূর্ত অপেক্ষা অপর একটি মুহূর্তের অধিকতর শক্তি আছে, এ-কথা তাঁহারা অস্বীকার করেন। অতএব অনন্তকালের প্রতিটি মুহূর্তই অন্যান্য মুহূর্তের সমান বলিয়া তাঁহারা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা না করিয়া এখানেই এবং এখনই ধর্মের সত্যসমূহের সাক্ষাৎ দর্শন করিবার উপর জোর দিয়া থাকেন।
বর্তমান লেখক এক সময়ে এই মহাত্মাকে জিজ্ঞাসা করেন, জগতের কল্যাণের জন্য কেন তিনি গুহা হইতে বাহিরে আসিবেন না। প্রথমতঃ তিনি তাঁহার স্বাভাবিক বিনয় ও রসিকতার সহিত নিম্নলিখিত দৃঢ় উত্তর প্রদান করেনঃ
কোন দুষ্ট লোক কোন অন্যায় কার্য করিতেছিল, এমন সময়ে এক ব্যক্তি তাহাকে ধরিয়া ফেলে এবং শাস্তি-স্বরূপ তাহার নাক কাটিয়া দেয়। নিজের নাক কাটা রূপ জগৎকে কেমন করিয়া দেখাইবে, ইহা ভাবিয়া সে অতিশয় লজ্জিত হইল ও নিজের প্রতি অতিশয় বিরক্ত হইয়া এক জঙ্গলে পলাইয়া গেল। সেখানে একটি ব্যাঘ্রচর্ম বিছাইয়া বসিয়া থাকিত, আর এদিক ওদিক কেহ আসিতেছে—মনে হইলে অমনি গভীর ধ্যানের ভান করিত। তাহার এইরূপ ব্যবহারে সরিয়া যাওয়া দূরে থাকুক, দলে দলে লোক এই অদ্ভুত সাধু দেখিতে এবং পূজা করিতে আসিতে লাগিল। তখন সে দেখিল, এইরূপ অরণ্যবাসে আবার তাহার সহজে জীবিকানির্বাহের উপায় হইল। এইভাবে বৎসরের পর বৎসর কাটিয়া গেল। অবশেষে সেই স্থানের অধিবাসীরা মৌনব্রতধারী ধ্যানপরায়ণ সাধুর নিকট হইতে কিছু উপদেশ শুনিবার জন্য ব্যস্ত হইল, বিশেষতঃ জনৈক যুবক তাহার নিকট দীক্ষিত হইবার জন্য বিশেষ উৎসুক হইল। শেষে এরূপ অবস্থা দাঁড়াইল যে, আর বিলম্ব করিলে সাধুর প্রতিষ্ঠা একেবারে লোপ হয়। তখন সে একদিন মৌনব্রত ভঙ্গ করিয়া ঐ উৎসাহী যুবককে বলিল, ‘আগামী কাল একখানি ধারাল ক্ষুর লইয়া এখানে আসিও।’ যুবকটি তাহার জীবনের প্রধান আকাঙ্ক্ষা অতি শীঘ্রই পূর্ণ হইবে, এই আশায় পরম আনন্দিত হইয়া পরদিন অতি প্রত্যূষে ক্ষুর লইয়া উপস্থিত হইল। নাককাটা সাধু তাহাকে বনের এক অতি নিভৃত স্থানে লইয়া গেল, তার ক্ষুরখানি হাতে লইয়া উহা খুলিল এবং এক আঘাতে তাহার নাক কাটিয়া দিয়া গম্ভীর বদনে বলিল, ‘হে যুবক, আমি এইরূপে এই আশ্রমে দীক্ষিত হইয়াছি। সেই দীক্ষাই আমি তোমাকে দিলাম। এখন তুমিও তৎপর হইয়া সুবিধা পাইলেই অপরকে এই দীক্ষা দিতে থাক।’ যুবকটি লজ্জায় তাহার এই অদ্ভুত দীক্ষার রহস্য কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে পারিল না এবং সাধ্যানুসারে তাহার গুরুর আদেশ পালন করিতে লাগিল। এইরূপে এক নাক কাটা সাধু-সম্প্রদায় উৎপন্ন হইয়া সমগ্র দেশ ছাইয়া ফেলিল। তুমি কি আমাকেও এইরূপ আর একটি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতারূপে দেখিতে চাও?
ইহার অনেক পরে, যখন তিনি অপেক্ষাকৃত গম্ভীরভাবে ছিলেন, ঐ বিষয়ে আর একবার প্রশ্ন করাতে তিনি উত্তর দিয়াছিলেন, ‘তুমি কি মনে কর, স্থূলদেহ দ্বারাই কেবল অপরের উপকার সম্ভব? একটি মন শরীরের সাহায্য-নিরপেক্ষ হইয়া অপরের মনকে সাহায্য করিতে পারে, ইহা কি সম্ভব বলিয়া মনে কর না?’
অপর এক সময় তাঁহাকে জিজ্ঞসা করা হয়, তিনি এত বড় একজন যোগী, তথাপি তিনি প্রথম শিক্ষার্থীদের জন্য উপদিষ্ট শ্রীরঘুনাথজীর মূর্তিপূজা, হোমাদি কর্ম করেন কেন? তাহাতে তিনি উত্তর দিলেন, ‘সকলেই যে নিজের কল্যাণের জন্য কর্ম করে, এ কথা তুমি ধরিয়া লইতেছ কেন? একজনও কি অপরের জন্য কর্ম করিতে পারে না?’
অতঃপর সকলেই সেই চোরের কথা শুনিয়াছেন; সে তাঁহার আশ্রমে চুরি করিতে আসিয়াছিল, সাধুকে দেখিয়াই সে ভীত হইয়া চোরাই জিনিষের পোঁটলা ফেলিয়া পলাইল। সাধু সেই পোঁটলা লইয়া চোরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অনেক দূর দ্রুতবেগে দৌড়াইয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইলেন; শেষে পদপ্রান্তে সেই পোঁটলাটি ফেলিয়া দিয়া করজোড়ে সজলনয়নে নিজকৃত বাধার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে লাগিলেন ও অতি কাতরভাবে সেইগুলি লইবার জন্য পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন। তিনি বলিতে লাগিলেন, ‘এগুলি আমার নহে, তোমার।’
আমরা বিশ্বস্তসূত্রে আরও শুনিয়াছি, একবার তাঁহাকে গোখুরা সাপে দংশন করে এবং যদিও কয়েক ঘণ্টার জন্য সকলে তাঁহাকে মৃত বলিয়াই স্থির করিয়াছিল, কিছুকাল পরে তিনি সুস্থ হইয়া উঠেন, তাঁহার বন্ধুবর্গ তাঁহাকে ঐ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, ‘ঐ গোখুরা সাপটি আমার প্রিয়তমের নিকট হইতে দূতরূপে আসিয়াছিলেন (পাহন দেওতা আয়া)।’
আমরা এই কাহিনী অনায়াসেই বিশ্বাস করিতে পারি। কারণ, আমরা জানি তাঁহার স্বভাব কী প্রগাঢ় নম্রতা, বিনয় ও প্রেমে ভূষিত ছিল। সর্বপ্রকার পীড়া তাঁহার নিকট সেই ‘প্রেমাস্পদের নিকট হইতে দূতস্বরূপ’ (পাহন দেওতা) ছিল; আর যদিও তিনি ঐ সকল পীড়ায় অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিতেন, তথাপি অপর লোক পর্যন্ত ঐ পীড়াগুলিকে অন্য নামে অভিহিত করিবে, ইহা তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। এই অনাড়ম্বর প্রেম ও কোমলতা চতুর্দিকের লোকের মধ্যে বিস্তৃত হইতে লাগিল; যাঁহারা চারিদিকের পল্লীগুলিতে ভ্রমণ করিয়াছেন, তাঁহারাই এই অদ্ভুত ব্যক্তির নীরব শক্তিবিস্তারের সাক্ষ্য দিতে পারেন।
শেষের দিকে তিনি আর লোকজনের সঙ্গে দেখা করিতেন না। যখন মাটির নীচের গুহা হইতে উঠিয়া আসিতেন, তখন লোকজনের সঙ্গে কথা কহিতেন বটে, কিন্তু মধ্যে দ্বার রুদ্ধ থাকিত। তিনি যে গুহা হইতে উঠিয়াছেন, তাহা হোমের ধূম দেখিয়া অথবা পূজার আয়োজনের শব্দে বুঝা যাইত।
তাঁহার এই একটি বিশেষত্ব ছিল যে, তিনি যখন একই কার্য করিতেন, তাহা যতই তুচ্ছ হউক—তখন তাহাতেই সম্পূর্ণ মগ্ন হইয়া যাইতেন। শ্রীরামচন্দ্রজীর পূজায় তিনি যেরূপ যত্ন ও মনোযোগ দিতেন, একটি তাম্রকুণ্ড মাজিতেও ঠিক তাহাই করিতেন। তিনি যে আমাদিগকে কর্মরহস্য সম্বন্ধে একবার বলিয়াছিলেন, ‘যন্ সাধন তন্ সিদ্ধি’ অর্থাৎ সিদ্ধির উপায়কেও এমনভাবে আদর-যত্ন করিতে হইবে, যেন উহাই সিদ্ধিস্বরূপ—তিনি নিজেই এই আদর্শের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ছিলেন।
তাঁহার বিনয়ও কোনরূপ কষ্ট যন্ত্রণা বা আত্মগ্লানিপূর্ণ ছিল না। একবার তিনি আমাদিগের নিকট অতি সুন্দরভাবে নিম্নলিখিত ভাবটি ব্যাখ্যা করিয়াছিলেনঃ হে রাজা, ভগবান্ অকিঞ্চনের ধন; হ্যাঁ, যে ব্যক্তি কোন বস্তুকে, এমন কি, নিজের আত্মাকে পর্যন্ত ‘আমার’ বলিয়া অধিকার করিবার ইচ্ছা ত্যাগ করিয়াছে, তিনি তাহারই।—এই ভাব প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াই স্বভাবতঃ তাঁহার এই বিনয় আসিয়াছিল।
তিনি সাক্ষাৎভাবে উপদেশ দিতে পারিতেন না; কারণ, তাহা হইলে নিজেকেই আচার্যের পদ গ্রহণ করিতে হয়, নিজেকে অপর অপেক্ষা উচ্চতর আসনে বসাইতে হয়। কিন্তু একবার তাঁহার হৃদয়-প্রস্রবণ খুলিয়া গেলে তাহা হইতে অনন্ত জ্ঞানবারি উৎসারিত হইত, তথাপি উত্তরগুলি সর্বদা সাক্ষাৎভাবে না হইয়া পরোক্ষভাবে হইত।
তিনি দীর্ঘাকৃতি, মাংসল ও একচক্ষু ছিলেন এবং প্রকৃত বয়স অপেক্ষা তাঁহাকে অল্পবয়স্ক দেখাইত। তাঁহার কণ্ঠস্বরের মত মধুর স্বর আর কাহারও শুনি নাই। জীবনের শেষ দশ বৎসর বা ততোধিক কাল তিনি লোকচক্ষুর সম্পূর্ণ অন্তরালে অবস্থান করিতেন। তাঁহার গৃহদ্বারের পশ্চাতে গোটাকতক আলু ও একটু মাখন রাখিয়া দেওয়া হইত; যখন তিনি সমাধিতে না থাকিতেন, তখন রাত্রে ঐগুলি গ্রহণ করিতেন। গুহার মধ্যে থাকিলে তাহাও তাঁহার প্রয়োজন হইত না। এইরূপে যোগশাস্ত্রের সত্যতার প্রত্যক্ষ প্রমাণস্বরূপ এবং পবিত্রতা, বিনয় ও প্রেমের জীবন্ত দৃষ্টান্তস্বরূপ এই নীরব জীবন অতিবাহিত হইতে লাগিল।
আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, ধূম দেখিলেই তিনি সমাধি হইতে উঠিয়াছেন বলিয়া বুঝা যাইত। একদিন ধূমে পোড়া মাংসের গন্ধ পাওয়া যাইতে লাগিল। চতুর্দিকের লোকে কিছু স্থির করিতে পারিল না। শেষে গন্ধ অসহ্য হইয়া উঠিল এবং ধূম পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিতেছে দেখিয়া তাহার গৃহের দ্বার ভাঙিয়া ফেলিল এবং দেখিল, সেই মহাযোগী নিজেকে হোমাগ্নিতে শেষ আহুতি দিয়াছেন। অল্পক্ষণের মধ্যে তাঁহার দেহ ভস্মে পরিণত হইল।
আমাদিগকে এখানে কালিদাসের সেই বাক্য স্মরণ করিতে হইবেঃ
মন্দবুদ্ধি ব্যক্তিগণ মহাত্মাগণের কার্যের নিন্দা করিয়া থাকে; কারণ সেই কার্যগুলি অসাধারণ এবং তাহাদের কারণও লোক ভাবিয়া স্থির করিতে পারে না।৩২
তথাপি তাঁহার সহিত বিশেষ পরিচয় ছিল বলিয়া তাঁহার এই কার্যের কারণ সম্বন্ধে একটি আনুমানিক সিদ্ধান্ত করিতে সাহসী হইতেছি। আমাদের মনে হয়, মহাত্মা বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার অন্তিমকাল উপস্থিত; তখন তিনি মৃত্যুর পরেও যাহাতে কাহাকেও কষ্ট দিতে না হয়, সেজন্য সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরে ও সুস্থ মনে আর্যোচিত এই শেষ আহুতি দিয়াছিলেন।
বর্তমান লেখক এই পরলোকগত মহাত্মার নিকট গভীরভাবে ঋণী; সেজন্য তাঁহার প্রেমাস্পদ ও তৎসেবিত শ্রেষ্ঠ আচার্যদিগের অন্যতম মহাত্মার উদ্দেশ্যে—এই কয়েকটি পঙ্ক্তি অযোগ্য হইলেও উৎসর্গীকৃত হইল।