পরের দিন ময়না তদন্তের রিপোর্ট ও কাচের গ্লাস ও সঙ্গের বোতলের কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট পাওয়া গেল।
গ্লাসে বা বোতলের মধ্যে কোন রকম বিষ যেমন পাওয়া যায় নি তেমনি মৃতদেহেও কোন রকম বিষের সন্ধান মেলেনি। ময়না তদন্তকারী ডাক্তার রিপোর্ট দিয়েছেন, মৃত্যুর কারণ হাই। ভোল্টের ইলেকট্রিক কারেন্ট।
তালুকদারই রিপোর্টটা নিয়ে এসেছিল কিরীটীর এখানে।
তিনি বলেন, ব্যাপারটা কেমন হল কিরীটী, এ যে কেমন গোলমাল হয়ে গেল!
রিপোর্টগুলো দেখবার পরই কিরীটী যেন কেমন আত্মচিন্তায় সমাহিত হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের। জন্য। হাতের ধরা পাইপটা নিভে গিয়েছিল।
সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী বলে, যদিও হত্যাকারী নিঃসন্দেহে খুব চতুর এবং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে হত্যার ব্যাপারে তবু বলব সেদিনকার একটা ব্যাপার তাকে—যাকে বলে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল।
বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করেন তালুকদার, সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল একটা ব্যাপার?
হ্যাঁ।
কি বল তো?
কারোরই তো ব্যাপারটা অজানা থাকবার কথা নয় তালুকদার, কারণ ঐদিন সকালেই কাগজে ঘোষণা করা হয়েছিল কলকাতা শহরে কোন কোন এলাকায় সেদিন রাত্রে কিছুক্ষণের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে।
কথাটা একটু পরিষ্কার করে বল তো?
এখনও ঠিক বলতে পারছিনা তালুকদার, কারণ একটা জায়গায় এসে আমার চিন্তার যোগসূত্রটা ছিঁড়ে যাচ্ছে- আচ্ছা কিরীটী, তালুকদার প্রশ্ন করেন, এখনও কি তোমার ধারণা ব্যাপারটা হতাই?
নিঃসন্দেহে। আত্মহত্যা আদৌ নয়। হতভাগ্য ব্রজদুলাল সাহার দেহে তাঁর অজ্ঞাতেই হাই ভোল্টেজের ইলেকট্রিক কারেন্ট পাস করিয়ে তাঁকে মুহূর্তে হত্যা করা হয়েছে।
বল কি?
ঠিক তাই।
কিন্তু সেটা কেমন করে সম্ভব হল?
কেমন করে যে সম্ভব হল সেটাই ভাবছি এখনও। তবে সম্ভব হয়েছিল নিশ্চয়ই, নচেৎ ঐভাবে তাঁকে অতর্কিতে মৃত্যুবরণ করতে হত না।
তারপরই একটু থেমে হঠাৎ কি একটা কথা মনে পড়ায় কিরীটী বলে, ভাল কথা তালুকদার, সাহার সেই শয়নকক্ষটা লক-আপ করে রাখা হয়েছে, না?
হ্যাঁ। কেন, তুমিই তো সুখময়বাবুকে ঘরটাতে তালাবন্ধ করে রাখতে বলে দিয়েছিলে! একটু বস তালুকদার, আমি চট করে একটা টেলিফোন করে আসি।
কাকে ফোন করবে?
সুখময়বাবুকে।
কিরীটী ঘর থেকে উঠে গেল।
.
তালুকদার অতঃপর সোফাটায় বসে একটা পিকটোরিয়াল সাপ্তাহিক ইংরাজী ম্যাগাজিনের পাতাগুলো উল্টে উল্টে ছবি দেখতে থাকেন।
পুলিসের বড়কতা ঐদিন সকালেই তালুকদারকে ডেকে ব্রজদুলাল সাহার হত্যার রহস্যজনক ব্যাপারটার যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। সেই সূত্রেই ঐদিন সন্ধ্যায় কিরীটীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন তালুকদার।
কারণ থানা অফিসার সুখময় মল্লিকের কাছে গিয়ে শুনেছিলেন কি ভাবে ঘটনাচক্রে কিরীটী ব্রজদুলালের হত্যার পরের দিন গিয়ে অকুস্থানে হাজির হয়েছিল।
কিন্তু কিরীটীর ওখানে এসে, তার মতামত শুনে ব্রজদুলালের হত্যার রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যে খুব বেশী আশান্বিত হয়েছেন তা নয়।
অথচ এও সে ভালভাবেই জানে যে, কিরীটী ঐ হত্যারহস্যের মীমাংসায় পৌঁছবার একটা-না-একটা পথ খুঁজে পেয়েছে যদিও—তথাপি সে নিজে থেকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যতক্ষণ মুখ না খুলবে ততক্ষণ যতটুকু সে বলেছে তার বেশী জানবার আর কোন উপায়ই নেই।
একটু পরেই কিরীটী ফিরে এল একেবারে বাইরে বেরুবার বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে।
রাত তখন বোধ হয় পৌনে আটটা।
গ্রীষ্মের রাত। পৌনে আটটা বিশেষ করে কলকাতা শহরে তো এমন কিছুই নয়। একেবারে সন্ধ্যারাত্রি বললেও বেশী বলা হয় না।
কিরীটীর পরিবর্তিত বেশের দিকে তাকিয়ে তালুকদার প্রশ্ন করেন, কোথাও বেরুচ্ছ নাকি এখন?
হ্যাঁ, একটু ঘুরে আসা যাক। তোমার হাতে যদি তেমন জরুরী বা প্রয়োজনীয় কোন কাজ থাকে তো আমার সঙ্গে যেতে পার।
কিরীটী টোবাকো পাউচ ও লাইটারটা হাতে তুলে নিতে নিতে ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে কথাগুলো।
তালুকদার ম্যাগাজিনটা টেবিলের উপর রেখে দাঁড়িয়ে বলেন, না, অন্য কোন কাজ তেমন নেই, তোমার এখানেই তো এসেছিলাম। চল।
রাস্তায় বের হয়ে দুজনে একটা ট্যাক্সি নেয়।
ট্যাক্সিওয়ালা কিরীটীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোন দিকে যাব বাবুজী?
গর্চা লেন চল। কিরীটী বলে।
পার্শ্বে উপবিষ্ট তালুকদার গচা লেন কথাটা কানে যেতেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকান।
গাড়ি তখন গচা লেনের দিকেই ছুটে চলেছে।
কিন্তু গাড়ি কিছুদূর এগুবার পরই কিরীটী ড্রাইভারকে সোজা এগিয়ে যেতে বলল একটা রেস্তোরাঁর দিকে চায়ের পিপাসা পেয়েছে বলে।