১১.
পরদিন বিকেল।
রবিনকে ফোন করল মুসা।
রবিন, আমি, কান আর কাঁধ দিয়ে ফোনের রিসিভারটা চেপে রেখে উবু হয়ে জুতোর ফিতে বাধতে লাগল সে।
কেমন আছ? জিজ্ঞেস করল রবিন। খসখসে কণ্ঠস্বর। কথাতেই বোঝা গেল ক্লান্তি এখনও কাটেনি ওর। নিশ্চয় আবার কোন ফাঁকে ওর রক্ত খেয়েছে ভ্যাম্পায়ার।
ঘাবড়ে গেল মুসা। দেরি করে ফেলল না তো! জরুরী কণ্ঠে বলল, রবিন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
এখন তো বলতে পারব না, রবিনের কণ্ঠস্বর এত দুর্বল, বোঝাই যায় না। প্রায়। কণিকার সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওকে আমি কথা দিয়েছি…
ওর ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই, বাধা দিয়ে বলল মুসা। ফিতে বাধা শেষ। সোজা হয়ে বসল। রিসিভারটা হাতে নিল আবার।
কণিকা? অবাক মনে হলো রবিনকে।
শোনো, রবিন, আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, তবু। বলি। ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি।
ওপাশ থেকে মৃদু হাসি শোনা গেল। দুর্বল হাসি।
দেখো, রবিন, আমি সিরিয়াস, গভীর কণ্ঠে বলল মুসা। হেসো না। আমার কথা শোনো।
আমার ভাল লাগছে না, মুসা, কাশতে কাশতে বলল রবিন। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বেরোতে হবে।
রবিন, একবারও কি তোমার মনে হয়নি হঠাৎ করে এত দুর্বল লাগছে। কেন তোমার? কিসের অসুখ? কারণটা আর কিছুই না, রবিন। সব কিছুর মূলে ওই কণিকা।
দীর্ঘ নীরবতার পর রবিন বলল, তাই?
কণিকা একটা ভ্যাম্পায়ার, রবিন, গরম হয়ে উঠছে মুসা। আমি জানি, কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু ও ভ্যাম্পায়ার। তোমার রক্ত খাচ্ছে। অল্প অল্প করে খাচ্ছে, যাতে মরে না যাও। রিকি, অ্যানি আর ইমির মত একবারে খেয়ে ফেলছে না। এখনও যদি সাবধান না হও…
মুসা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাধা দিল রবিন। এখন এসব ভূতের গল্প ভাল লাগছে না…।
রবিন, গল্প নয়! বিশ্বাস করানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল মুসা। রিকির বেলায় কি ঘটেছে, বলেছি তোমাকে। জিনার অবস্থা তো নিজের চোখেই দেখলে। জিনার মতই তোমাকেও…
জিনার মাথায় গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, তাই ওরকম করেছে। আমার তো আর তা হয়নি…
ভ্যাম্পায়ারেই ওর মাথাটা বিগড়েছে, রবিন। আমার কথা না শুনলে তোমারও এই অবস্থা হবে। যদি ভাগ্য ভাল হয়, বেঁচে থাকো, রিকির মত মরে না যাও। কণিকা তোমাকে…
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার, মুসা। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছি। সেটা। ভূতের কারণে নয়। নিশ্চয় কোন ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে, ফুয়ু হবে। মুসা, তুমি বরং আমার কথা শোনো। রকি বীচেও বলেছি, এখনও বলছি–ডাক্তার দেখাও। জিনার আর তোমার একই অসুখ। কি হয়েছিল তোমাদের, কে জানে। অতিরিক্ত ভয় পেলে হয় ওরকম। সেরাতে নৌকা। নিয়ে একা একা দ্বীপে যাওয়া তোমাদের মোটেও উচিত হয়নি।…আঙ্কেল আর আন্টি ফিরেছেন?
আঁ? … হ্যাঁ।
কথা বলেছ তাঁদের সঙ্গে?
না।
তাহলে বলে ফেলল। আর দেরি কোরো না। সত্যি কথাটাই জানাও। বলবে, ভ্যাম্পায়ারের আতঙ্ক তোমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। তোমার যদি বলতে সঙ্কোচ হয়, আমিই নাহয় বলে দেব। মোট কথা, তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। দেরি করলে শেষে জিনার মত হাসপাতালে যেতে হবে।
নিজের জীবন বিপন্ন, আমাকে ভাবছে পাগল! কি যে করি!–চুপ করে রইল মুসা।
অ্যাই, মুসা, শুনছ?
হ্যাঁ, বলো।
আমি বেরোচ্ছি।…ওই যে, কণিকা এসে গেছে। পরে দেখা হবে…
প্লীজ, রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। দোহাই লাগে তোমার! ওর সঙ্গে বেরিয়ো না! মারা পড়বে, রবিন…
কট করে শব্দ হলো। লাইন কেটে গেছে।
*
টপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ল মুসার ঘাড়ে। বরফের মত শীতল পানি ঘাড় বেয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। চামড়ায় অদ্ভুত সুড়সুড়ি তুলে।
ঘন হচ্ছে কুয়াশা। শহর ঢেকে দিয়েছে। স্ট্রীট ল্যাম্পগুলোকে আলো ছড়াতে দিচ্ছে না। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে ঘোলাটে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে কেবল ওগুলো।
মেইন স্ট্রীটে উঠল মুসা। পিজ্জা কোভে খুজল রবিন আর কণিকাকে। পেল না।
আর্কেডে এসে প্রিন্সেস-এর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বাইরের ভেজা রাতের চিহ্নও নেই এখানে। প্রচুর আলো। জোরাল মিউজিক বাজছে। বাজনার শব্দকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর হাসির শব্দ। ভিডিও গেম খেলছে।
আইসক্রীম পারলারে উঁকি দিল। পাশাপাশি টুলে বসে আছে টনি আর কিমি। টনির হাতে আইসক্রীম।
এগিয়ে গেল মুসা। ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। টনি, রবিনকে দেখেছ?
ঝট করে মাথা ঘোরাল কিমি। মুসাকে দেখে বদলে গেল চাহনি। মাথা নেড়ে বলল, না, দেখিনি। তুমি বাপু এখন যাও তো। আবার কোন্ ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করবে…।
তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি আমি! কঠোর স্বরে জবাব দিয়ে টনির দিকে ফিরল মুসা, কি, দেখেছ রবিনকে?
নাহ, গতকাল থেকেই দেখছি না, টনিও অধৈর্য।
কিন্তু ওকে আমার দরকার। খুঁজে বের করতেই হবে। ভীষণ বিপদে আছে ও।
আবার নাক গলাল কিমি, কিসের বিপদ?
কণিকা একটা ভ্যাম্পায়ার। রবিনকে সাবধান করেছি। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করল না। কণিকা ওকে…
আহ, দয়া করে এবার থামাও না তোমার ওই ভ্যাম্পায়ারের গপ্পো! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল টনি। কুটি করল।
বললাম তো গপ্পো নয়..
চোখের পাতা সরু করে ফেলল টনি। কথা শেষ করতে দিল না মুসাকে। দেখো, অতিরিক্ত জ্বালাতন শুরু করেছ তুমি। সহ্যের একটা সীমা আছে। তোমার মাথায় গোলমাল হয়ে গেল নাকি ভাবছি।
গোলমাল! কিসের গোলমাল? ফেটে পড়ল মুসা। রিকি মরল। জিনার যখন এই অবস্থা হয়েছিল, তখনও তোমাদের জানিয়েছি। বিশ্বাস করোনি। হাসাহাসি করেছ। আমাকে পাগল ভেবেছ। ওর কি অবস্থা হয়েছে, দেখেছ…
দেখেছি। সে-ও তোমার মত পাগল হয়ে গেছে। কোন কারণে। তোমাদের দুজনেরই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, হয়েছিল। এবং সেই কারণটা ভ্যাম্পায়ার! কতবার বলব এক কথা!
নিরাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল টনি। মুসার দিকে তাকালও না আর।
মুসা বুঝল, কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না এদের কাছে। যা করার তার। নিজেকেই করতে হবে। একা।
সে-ও আর কারও দিকে না তাকিয়ে গটমট করে বেরিয়ে এল আর্কেড থেকে।
.
১২.
কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলল নীরবে মুসা।
সাদা কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে স্যান্ডি হোলো। চেপে আসছে যেন চারদিক থেকে।
মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে ওর। কেউ বিশ্বাস করছে না ওকে। সবাই ভাবছে পাগল হয়ে গেছে। সাহায্য করার কেউ নেই। একেবারে একা সে। নিঃসঙ্গ।
পায়ের নিচে নরম লাগল। নিচে তাকিয়ে দেখল ভেজা বালি। সৈকতে পৌঁছে গেছে।
জুতো খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগল। আরাম লাগছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালি ঢুকে যাওয়ার সময় চমৎকার একটা অনুভূতি হয়। ওর বাঁ দিকে পানি। ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কিছুদূরে সামনে বোট হাউসটা। কোন চিন্তাভাবনা না করে সেদিকেই এগিয়ে চলল সে।
মাথার ওপরে ডানা ঝাপটানোর শব্দ হতেই চমকে মুখ তুলে তাকাল। তিনটে বাদুড়। কুয়াশার মধ্যে অস্পষ্ট। নিচ দিয়ে না উড়লে চোখে পড়ত না। তাকিয়ে রইল ওগুলোর দিকে। বাদুড়ের রূপ ধরে আসে ভ্যাম্পায়ার। কুয়াশার মধ্যে এসেছে। কুয়াশার মধ্যে বাদুড় ওড়ে কিনা, খাবারের খোঁজে বেরোয় কিনা, জানা নেই ওর। ভূত হওয়ার সম্ভবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সাবধান রইল। কিন্তু থেকেই বা কি করবে বুঝতে পারছে না। ভ্যাম্পায়ার হলে কি দিয়ে ঠেকাবে? কোন অস্ত্র তো নেই সঙ্গে।
বোকামি হয়ে গেছে। মস্ত বোকামি। যে সৈকতে দুদুটো খুন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে, সেখানে এভাবে নিরস্ত্র চলে আসাটা উচিত হয়নি।
কিন্তু আক্রমণ করল না বাদুড়গুলো। তিনটে কালো ছায়ার মত মিলিয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।
ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে এগিয়েই চলল সে। আপন চিন্তায় বিভোর।
আরেকটা শব্দ কানে এল।
পেছনে।
কেউ অনুসরণ করছে ওকে!
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল সে।
কেউ নেই।
কল্পনা! ভাবল সে। মাথার মধ্যে ভূতের চিন্তা পাক খাচ্ছে বলেই উল্টোপাল্টা এত কিছু দেখছে।
কিন্তু না, ভুল দেখেনি। কুয়াশার মধ্যে থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল একটা মেয়ে। যেন একটা কাঁপা কাঁপা ছায়া বেরিয়ে এসে মানুষের রূপ নিল। কুয়াশা আর আলোর কারসাজি নাকি!
কে? জিজ্ঞেস করল সে।
আমি, ধীরপায়ে সামনে এসে দাঁড়াল ডলি।
এত রাতে এখানে?
বাড়িতে একা একা ভাল লাগছিল না। তোমার সঙ্গে হাঁটি কিছুক্ষণ? অসুবিধে আছে?
না, অসুবিধে আর কি, সঙ্গী পেয়ে খুশিই হলো মুসা।
পাশাপাশি হাঁটতে লাগল ওরা। চারপাশ ঘিরে ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে যেন কুয়াশার সাদা দেয়াল।
খপ করে মুসার হাত চেপে ধরল ডলি, শুনছ?
ফগহর্ন।
হ্যাঁ। ওই শব্দ আমার ভাল লাগে।
কেমন যেন রহস্যময়।
সামনে এসে দাঁড়াল ডলি। মুখোমুখি হলো ওর। হাত রাখল দুই কাঁধে। মিষ্টি গন্ধ পেল মুসা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মোহনীয় কণ্ঠে বলতে লাগল ডলি, ফগহর্ন আমার ভাল লাগে। কুয়াশা ভাল লাগে। সব কিছু ঢেকে দেয়। কিছু দেখা যায় না। কেউ দেখতে পাবে না আমাদের।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিচিত্র অনুভূতি হলো মুসার। মাথার মধ্যে বো করে উঠল। মগজে সব কিছু গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে নাচতে শুরু করেছে কুয়াশা।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ডলির মুখ।
*
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল মুসা। সরিয়ে নিল গলা। হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলল, কামড় দিল কিসে?
ডলিও সরে গেছে। মশাটশা হবে। কুয়াশা পড়লে যেন পাগল হয়ে যায় রক্ত খাওয়ার জন্যে।
তোমাকে ঘাবড়ে দিলাম নাকি?
মুসার কথা যেন কানেই যায়নি। একঘেয়ে কণ্ঠে বলল ডলি, মশাকে আমি ঘৃণা করি। এমন শয়তানের শয়তান। রক্তচোষা জীব!
ঘাড় ডলছে এখনও মুসা। বলল, বাড়ি যাব। আর ভাল লাগছে না এখানে।
তুমি সব সময়ই খালি পালাতে চাও।
না, তা চাই না। তবে তোমার সঙ্গে যতবার দেখা হয় আমার, জরুরী কোন না কোন কাজ থাকে। ইচ্ছে করে কাজ বের করি ভেবো না। রবিনকে খুঁজতে এসেছিলাম এখানে। ওর জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।
কাল রাতে দেখা হচ্ছে তো? গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে মুসার চলে যাওয়ার কথায় হতাশ হয়েছে ডলি।
হ্যাঁ। কাল না হলেও পরশু। তুমি কোনদিকে যাবে? চলো, এগিয়ে দিয়ে আসি।
না, লাগবে না, থ্যাংক ইউ। এত তাড়াতাড়ি আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। এসেছি যখন, খানিকক্ষণ হাঁটব। নইলে ঘুম আসবে না।
বাড়ি রওনা হলো মুসা। প্রায় দৌড়ে চলল। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকাল। দেখা গেল না ডলিকে। হারিয়ে গেছে কুয়াশায়।
মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দ হলো। ওপরে তাকিয়ে বাদুড়টাকে দেখতে পেল না মুসা। বেশ কিছুটা ওপরে কুয়াশার মধ্যে রয়েছে।
নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিল ওর। গতি বাড়িয়ে দিল। তবে বাদুড়টা ভ্যাম্পায়ার হয়ে গিয়ে আক্রমণ করল না ওকে। নিরাপদেই বাড়ি ফিরে এল সে।
বাড়িতে ঢুকেই আগে টেলিফোনে রবিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল।. পারল না। ফেরেনি সে।
*
সৈকতে বসে আছে রবিন। কান পেতে শুনছে ঢেউয়ের গর্জন। গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে পানি জেটি থেকে, সৈকতের বালি থেকে। শব্দটা কেমন দূরাগত মনে হচ্ছে। যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে এসব।
পাশে বসে আছে মেয়েটা।
এটাও কি বাস্তব?
নাকি কল্পনা?
ফিসফিস করে ডাকল, কণিকা, তুমি সত্যি আছ?
জবাব দিল কণিকা, আছি।
ওপরে উঠতে আরম্ভ করেছে কুয়াশা। হালকা হয়ে আসছে নিচের দিকের কুণ্ডলীগুলো। ঢেউয়ের বুকে এখন চাঁদের আলোর প্রতিফলন। সব কিছু ঝিলমিল করছে। সব কিছু কেমন কাঁপছে।
কণিকার দিকে ফিরে তাকাল রবিন। চাঁদের আলোয় আরও ফ্যাকাসে লাগছে মেয়েটার মুখ। চামড়ার রঙ এমন মোমের মত কেন? কালো চুল কুয়াশায় ভিজে গিয়ে ধূসর লাগছে। পাশে বসে থাকলেও এ মুহূর্তে মেয়েটাকে অবাস্তবই লাগছে ওর কাছে।
তার চোখের সামনে অস্পষ্ট, ধোয়াটে হতে আরম্ভ করল কণিকা।
রাতের হালকা বাতাস বয়ে গেল। কুয়াশার শেষ পুজগুলোকেও উড়িয়ে নিয়ে গেল। কণিকাকে অবাস্তব লাগছে এখনও ওর কাছে। ফিসফিস করে ডাকল আবার, কণিকা! জোরে ডাকতে যেন ভয় লাগছে।
কি? সাড়া দিল কণিকা।
বুঝতে চাইছি সত্যি তুমি আছ নাকি?
আবার রবিনের কাঁধে হাত রাখল কণিকা, আছি। তোমার খুব খারাপ লাগছে?
দুর্বল। পা-টা ভাঙার পর আর সুস্থ হতে পারলাম না। একটার পর একটা রোগ ধরতেই আছে।
সেই সঙ্গে ওষুধের প্রতিক্রিয়া, কণিকা বলল। এত অ্যান্টিবায়োটিকে শরীর দুর্বল হতে বাধ্য। তার ওপর নিশ্চয় কোন ধরনের জটিল ভাইরাস ঢুকেছে রক্তে। তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত। দরকার হয় হাসপাতালে কাটাওগে কয়েক দিন।
কণিকা?
বলো?
দ্বিধা করল রবিন। একটা কথা। কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। মুসা যে বলে ভ্যাম্পায়ারে রক্ত খেলে এমন হয়, কথাটা কি বিশ্বাস করা উচিত?
না। আমি ভ্যাম্পায়ার বিশ্বাস করি না। তবে কিছু একটা এসে যে রক্ত খেয়ে যাচ্ছে, খুন করে মানুষগুলোকে ফেলে যাচ্ছে সৈকতে, এটা ঠিক।
তোমার কি মনে হয়? কারা করে? জানো কিছু?
ঢেউয়ের দিকে তাকাল কণিকা। চিন্তা করল একমুহূর্ত। তারপর জবাব দিল, বোধহয় জানি!
.
১৩.
মেইন স্ট্রীটে ঘোরাফেরা করছে মুসা। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত দোকানগুলোর দিকে নজর। বেরিয়ে আসা প্রতিটি মুখ দেখছে। রবিনকে খুঁজছে।
বোর্ডিং হাউসে ক্রমাগত ফোন করেছে। রবিনকে পায়নি। অ্যাটেনডেন্ট জানিয়েছে, কোথায় গেছে বলে যায়নি। ধরেই নিয়েছে মুসা, কণিকার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে রবিন। কণিকার মায়াজালে জড়িয়েছে।
ভ্যাম্পায়ারের জাল। বড় ভয়ঙ্কর জাল। একবার জড়ালে ছিন্ন করা কঠিন।
সম্মোহন করে করে নিশ্চয় রবিনের মনটাকে ধোয়াটে করে দিয়েছে কণিকা। সেজন্যেই অন্য কারও কথা আর শুনতে চাইছে না সে। কোন কিছু ভাবতে চাইছে না। জিনারও এ অবস্থা করেছিল জন।
জিনাকে মুক্ত করেছে। রবিনকেও করতে হবে। ভ্যাম্পায়ারের হাতে ওকে কোনমতেই মরতে দিতে পারে না।
অ্যানটিক হাউসটা থেকে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে এল একটা পেশীবহুল ছেলে আর একটা সোনালি-চুল মেয়ে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
টনি! কিমি! ডাকতে ডাকতে ওদের দিকে এগিয়ে গেল মুসা।
ফিরে তাকাল ছেলেমেয়ে দুটো। অবাক চোখে তাকাল। টনি আর কিমি নয়। মুসার অপরিচিত।
সরি, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। আমার বন্ধু মনে করেছিলাম। তোমরা দেখতে ওদেরই মত।
হেসে হাত নেড়ে আবার হাঁটতে শুরু করল ছেলেমেয়ে দুটো।
গেল কোথায় সব? ভাবছে মুসা। চেনা কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন?
শহরে রবিনকে না পেয়ে সৈকতে চলে এল। আজ কুয়াশা নেই। চাঁদের আলো আছে। কিন্তু লোকজন বড় কম। পর পর দুটো খুন হওয়ার পর থেকে রাতের বেলা সৈকতে আসা কমিয়ে দিয়েছে লোকে। কয়েক জোড়া দম্পতি, আর হাতে গোণা কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখা গেল। দুএকজন তার। মুখচেনা আছে, বাকি সবাই অপরিচিত।
রবিনকে খুঁজছে আর কণিকাকে ধ্বংস করা যায় কিভাবে ভাবছে। সবচেয়ে সহজ হত যদি রোদে বের করে আনা যেত। কিন্তু আনাটাই হলো। কঠিন। ও গিয়ে বললেই বেরিয়ে চলে আসবে না কণিকা। ধ্বংস করার দ্বিতীয় উপায়টা হলো বুকে কাঠের গজাল ঢোকানো। তার জন্যে ভ্যাম্পায়ারের আস্তানা খুঁজে বের করতে হবে।
কণিকার আস্তানা কোথায়? দ্বীপটাতে? জন আর লীলাকে ধ্বংস করার পরেও কি ওখানে থাকতে সাহস করবে ভ্যাম্পায়াররা?
দ্বীপটাতে গিয়ে খুঁজে দেখার কথা ভাবল। গেলে দিনের বেলা যেতে হবে। তখন কফিনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে ভ্যাম্পায়ার।
রবিনের সাহায্য পেলে সবচেয়ে ভাল হত। রোদে বের করে আনতে পারত কণিকাকে। গজাল ঠুকে মারা অনেক বেশি কঠিন কাজ। নিজের আস্তানায় ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায় ভ্যাম্পায়ারের। দিনের বেলায়ও জেগে, উঠে আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে। যদি আস্তানায় কোন ফাঁকফোকর না। থাকে, আলো আসার পথ না থাকে, অন্ধকার হয়।
সৈকতেও রবিনকে না পেয়ে সোজা ওর বোর্ডিং হাউসে রওনা হলো সে। খুঁজে আজকে বের করবেই। যেখান থেকেই হোক।
বারান্দার পরে হলঘর। ডেস্কে বসে পত্রিকা পড়ছে অ্যাটেনডেন্ট। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ঘরেই আছে রবিন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। যাক, পাওয়া গেল। দুশ্চিন্তাও হলো। নিশ্চয় খুব অসুস্থ। ওঠার শক্তি নেই। নইলে ঘরে থাকত না।
ওর ধারণাই ঠিক। বেশ কয়েকবার থাবা দেয়ার পর দরজা খুলে দিল রবিন। চোখের পাতা আধবোজা। সাংঘাতিক দুর্বল। মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়েছে। টলছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।
এই অবস্থা হয়েছে তোমার! প্রায় চিৎকার করে উঠল মুসা। আমাকে খবর দাওনি কেন?
ভাবলাম রেস্ট নিলে সেরে যাবে…
ভেতরে ঢুকল মুসা।
একটা কাউচে পাশাপাশি বসল দুজনে।
কাল রাতে কোথায় ছিলে? কোন পার্টিতে গিয়েছিলে নাকি? জানতে চাইল মুসা।
কাল রাতে? কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগল রবিন। মনে করার চেষ্টা করল। না, পার্টিতে যাইনি। কণিকার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। সৈকতে গিয়ে বসে থেকেছি অনেকক্ষণ। খুব কুয়াশা ছিল কাল, তাই না?
জবাব দিল না মুসা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিনের মুখের দিকে। রক্তশুন্য মুখ। বিধ্বস্ত।
গলার দিকে তাকাল। দাঁতের দাগ দেখল না। তবে আছে, আজও ভাবল একই কথা। আরও নিচে। শার্টের কলারের নিচে লুকানো।
কেন, কুয়াশা ছিল কিনা মনে করতে পারছ না? জিজ্ঞেস করল মুসা।
পারছি। তবে অস্পষ্ট। সবই যেন ঘোরের মধ্যে ঘটেছে। কিংবা স্বপ্নের মধ্যে।
হবেই এ রকম–জানা আছে মুসার। ভ্যাম্পায়ারের মায়াজালে পড়লে এইই হয়। সব কিছু ভুলিয়ে দেয় ওরা। সম্মোহন করে। চোখে ঘোর লাগায়। তারপর ওই ঘোরের মধ্যে ধীরে সুস্থে ওদের কাজ সারে।
কেন ওরকম লেগেছে জানো? ভ্যাম্পায়ার তোমাকে সম্মোহন করেছে। বলে।
নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল রবিন, আবার সেই ভ্যাম্পায়ার!
ভ্যাম্পায়ারেই যখন করছে এ সব, আবার সেই ভ্যাম্পায়ারই তো হবে। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি তোমাকে প্রমাণ। আমার কথা বিশ্বাস না করে আর পারবে না।– শার্টের কলার চেপে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ওপরের বোতামটা ছিঁড়ে ফেলল মুসা। কলারটা নামিয়ে দিল নিচের দিকে।
আরে, আরে, কি করছ! চিৎকার করে উঠল রবিন।
এই দেখো! মুসাও চিৎকার করে উঠল। জানতাম, থাকবেই!
রবিনের গলার নিচের দিকে দুটো ছোট ছোট ফুটোর দাগ। কালচে বেগুনি হয়ে আছে।
দেখো এখন! দাগগুলো দেখো ভাল করে! টানতে টানতে রবিনকে আয়নার কাছে নিয়ে এল মুসা।
কি হবে দেখলে?
দেখোই না।
কি দেখব? তুমি কি বলতে চাও বুঝতে পারছি না।
কামড়ের দাগ।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। তুমি বলতে চাইছ ভ্যাম্পায়ারের কামড়?।
তো আর কিসের? এমন করে আর কে ফুটো করবে?
পোকার কামড়! অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, মুসা, তোমার পাগলামি থামাও! ছুটিতে এসে অসুস্থ হওয়াটাই একটা জঘন্য ব্যাপার। তার। ওপর তোমার পাগলামির অত্যাচার সহ্য করতে পারছি না।
ভুলে যেয়ো না, ছুটিতে বেড়াতে আসোনি তুমি। জোর করে তোমাকে ধরে এনেছি আমি। ভ্যাম্পায়ার রহস্যের তদন্ত করতে। সেটা করছ না। উল্টো আমার কাজে বাধা দিচ্ছ। তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। ভ্যাম্পায়ার তোমার মাথাটা গড়বড় করে দিয়েছে। তবে তোমাকে আমি মরতে দেব না। রিকির মত। দেরি হওয়ার আগেই যা হোক একটা কিছু করব।
রিকি পানিতে ডুবে মরেছে। রাতের বেলা ভাটার সময় আমি পানিতেও নামব না, ঢেউয়ে ভাসিয়েও নিতে পারবে না। অতএব মরব না। ভয় নেই।
রিকিকে ঢেউয়ে ভাসিয়ে নেয়নি, রবিন, বিশ্বাস করো আমার কথা! রক্ত খেয়ে ওকে শুষে মেরে ফেলেছিল ভ্যাম্পায়ারে। লাশটা পানিতে ফেলে দিয়েছিল। কণিকা তোমাকে সম্মোহন করে তোমার মাথাটা ঘোলাটে করে। দিয়েছে, তাই স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারছ না। গলায় দাগ দেখেও তাই পোকার কামড় ভাবছ।
মুসার দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল রবিন। কণিকাকে তুমি ভ্যাম্পায়ার ভাবছ? তুমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছ, মুসা। নইলে ওর মত ভাল মেয়েকে…
রবিন, থামিয়ে দিল ওকে মুসা। কথা আজ শোনাতেই হবে রবিনকে। জোর করে হলেও। আমার কথা শোনো। কণিকা যে ভ্যাম্পায়ার, কোন সন্দেহই নেই আমার তাতে। রক্ত শুষে খেয়ে যাওয়ার সময় তার দাঁত আর মুখ থেকে তোমার রক্তে বিষ ঢুকে যায়। সেই বিষ তোমাকে অসুস্থ করে রেখেছে। এত দুর্বল লাগে সেজন্যেই। জিনার ব্যাপারে ডাক্তার কি বলেছে, ভুলে গেছ? বলেছে, রক্তে বিষ ঢুকেছে। তোমাকে এ ভাবে চলতে দিলে শেষমেষ তোমার কি হবে জানো? মারা যাবে। আর ভ্যাম্পায়ারের হাতে মারা পড়লে তুমি নিজেও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাবে। জীবত। মানুষের রক্ত ছাড়া আর তখন চলবে না তোমার…
উফ, কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম রে! অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে লাগল রবিন। মুসা, তোমার দোহাই লাগে, তুমি যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
রবিন! মুসাও চিৎকার করে উঠল, কেন তোমরা শুরুতেই আমার কথা বিশ্বাস করো না! কি করলে বিশ্বাস করবে? কি করে বোঝাব তোমাকে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?
মুসা, তুমি যাও। ঘুম না এলে ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুম দাওগে। আমি একটু ভাল হলেই তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব…
রাগে, দুঃখে, হতাশায় কেঁদে ফেলার উপক্রম হলো মুসার। ফোঁস করে। নিঃশ্বাস ফেলে জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, পারলাম না, রবিন! কিন্তু আমি চেষ্টা করেছিলাম…
এক মুহূর্তও আর দাঁড়াল না সে। ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নিজেকে বোঝাল, হাল ছাড়বে না কোনমতেই। জিনার বেলায়ও ছাড়েনি। ওকে বাঁচিয়েছে। আগে জানা থাকলে রিকিকেও মরতে দিত না। রবিনকেও বাঁচাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রমাণ করে ছাড়বে, সে পাগল নয়, তার সন্দেহই ঠিক।
সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখল, হলে ঢুকছে কণিকা। মুসাকে দেখে হেসে হাত তুলল, হাই, মুসা।
কটমট করে তাকাল মুসা।
কণিকা হাসল।
তুমি কোত্থেকে এলে? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মুসা।
সৈকত থেকে। পার্টি হচ্ছে। দাওয়াত দিয়েছে আমাদেরকে। রবিনকে নিতে এলাম।
ও যাবে না। শরীর ভীষণ খারাপ।
তাহলে তুমিই চলো। যাবে?
যাব, সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল মুসা। রবিন আজ গেলে আর বাঁচবে না। রিকির মতই কাল তার লাশ পাওয়া যাবে সাগরে। ওর বদলে সে নিজে গেলে রবিন বাঁচবে। আর কণিকাও তার কিছু করতে পারবে না।
চলো, মুসার হাত ধরে টান দিল কণিকা। সাংঘাতিক খিদে পেয়েছে আমার।
.
১৪.
পরদিন সন্ধ্যা।
মুসাকে দেখেই সরে পড়তে চাইল রবিন।
কিন্তু মুসা নাছোড়বান্দা।
শেষে প্রায় হাতজোড় করার মত করে রবিন বলল, দোহাই তোমার, আমার সঙ্গে কথা বোলো না। আর যদি বলোই, তো শুধু নাটকের কথা বলো। তোমার ওই ভ্যাম্পায়ারের গল্প শুনতে শুনতে কান পচে গেছে আমার।
থিয়েটারে নাটকের রিহারস্যাল দিতে এসেছে ওরা।
রবিন…
কিন্তু শুনল না রবিন। সরে গেল মঞ্চের দিকে।
তাকিয়ে রইল মুসা। ছাড়বে না সে। যতই রাগুক রবিন, তাকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়বে। রবিন বিপদটা বুঝতে পারছে না, কিন্তু সে তো পারছে।
সময়মত শুরু করা গেল না রিহারস্যাল। কয়েকজন ছেলেমেয়ে তখনও এসে পৌঁছায়নি। তাদের মধ্যে কিমি, ডলি আর কণিকাও রয়েছে। মঞ্চের সামনের দিকে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন মিসেস রথরক। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন।
রবিনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল মুসা। আগের দিনের চেয়ে খারাপ অবস্থা ওর। চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে, পানিতে ভরা। মুখের চামড়া মোমের মত ফ্যাকাসে। যেন জীবনে কোনদিন রোদের মুখ দেখেনি।
ভ্যাম্পায়ারের মত।
জীবন্মৃতদের দলে যোগ দিতে আর কত সময় লাগবে রবিনের? কিংবা মারা যেতে?
*
রিহারস্যালের পর টনি আর কিমিকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে বললেন মিসেস রথরক, ওদের দৃশ্যগুলো ভালমত বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে। দুজনেই কাঁচা।
থিয়েটারের দরজা দিয়ে কণিকার সঙ্গে রবিনকে বেরিয়ে যেতে দেখল মুসা। ওদের দিকে এগোতে যাচ্ছিল সে, সামনে এসে দাঁড়াল ডলি।
বাইরে খুব সুন্দর রাত। হাঁটতে যাবে?
চলো, রাজি হয়ে গেল মুসা। রবিনকে নিয়ে কোথায় গেল কণিকা দেখা দরকার।
বাইরে বেরিয়ে এল দুজনে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রবিন আর কণিকাকে খুঁজতে লাগল মুসা। বাড়িটার মোড় ঘুরে অন্যপাশে চলে যেতে দেখল একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে। সরু রাস্তা ধরে শহরের দিকে চলেছে আরও অনেক ছেলেমেয়ে। কেউ কেউ যাচ্ছে সৈকতে।
রবিনের দেখা নেই।
কোথায় গেল ও? ভুলিয়েভালিয়ে ওকে থিয়েটারের পেছনের বনে নিয়ে গেল না তো কণিকা? এখন হয়তো রবিনের রক্ত খাচ্ছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? তাড়া দিল ডলি, চলো, শহরে চলে যাই।
ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আশপাশের গলিগুলোর দিকে নজর রাখল মুসা। রবিন আর কণিকাকে খুঁজছে ওর চোখ। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে ছেলেমেয়েরা। হট ডগ খাচ্ছে। বীচ এমপোরিয়ামের উইন্ডোতে সাজানো জিনিসপত্র দেখছে।
আমাদের ডায়লগগুলো আরেকবার প্র্যাকটিস করলে কেমন হয়? ডলি বলল।
কি আর প্র্যাকটিস করব? হাতে গোণা কয়েকটা বাক্য আমার, মুখস্থ হয়ে গেছে। ভুলব না।
কিন্তু আমার ডায়লগ অনেক। কিছুতেই মনে থাকে না। প্র্যাকটিস করতে পারলে ভাল হত। স্ক্রিপ্টটা আছে তোমার কাছে?
না। ওটা আমার লাগে না।
আমারটা ভুলে ফেলে এসেছি থিয়েটারে। এনে দিতে পারবে?
ঠিক আছে, যাচ্ছি।
যাও। সৈকতে চলে এসো। কাঠের সিঁড়ির কাছে থাকব আমি।
দৌড় দিল মুসা। ও ভেবেছিল, তখনও টনি আর কিমিকে রিহারস্যাল দিচ্ছেন মিসেস রথরক। কিন্তু এসে দেখল অন্ধকার।
নিশ্চয় তালা দিয়ে চলে গেছেন মিসেস রথরক, ভেবে দরজার নব ধরে মোচড় দিল সে।
সহজেই খুলে গেল দরজা। লবিতে ঢুকল মুসা। পেছনে বাতাস লেগে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লাটা। চমকে উঠল সে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলল।
বাতির সুইচটা কোনখানে অনুমানের চেষ্টা করল সে। লবিতে কোথায় কি আছে জানে। টিকেট বুদ। একটা কোকের মেশিন। সীটের কাছে যাওয়ার দরজা। সবই দেখতে পাচ্ছে কল্পনায়। কিন্তু সুইচটা কোথায়?
খসখস শব্দ হলো। বাঁয়ে। তারপর খুট করে আবার শব্দ।
কে? ডেকে জিজ্ঞেস করল সে।
জবাব নেই।
বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটাতে শুরু করল যেন হৃৎপিণ্ডটা।
থিয়েটারের দরজা খোলা, অথচ সব আলো নেভানো। খটকা লাগল তার। ঘটনাটা কি?
বড়, ভারী একটা কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা লাগল। ঠং-ঠং, ঝনঝন, নানা রকম শব্দ হলো।
কোকের মেশিনটা।
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ধীরে ধীরে ছাড়ল মুসা। লাইট সুইচটা খুঁজতে শুরু করল।
শব্দ হলো আবার। পা টিপে টিপে হাঁটার মৃদু শব্দ। বিড়ালের পায়ের মত। চারপাশের দেয়ালে মোলায়েম প্রতিধ্বনি তুলল যেন।
কে? আবার জিজ্ঞেস করল সে। গলা কাঁপছে।
এত ভয় পাচ্ছ কেন? নিজেকে ধমক দিল সে। ওটা ইঁদুর। অন্য কিছু না।
দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে চলল সে। সুইচটা কোথায়? পাচ্ছে না কেন?
পেল অবশেষে। সুইচ বোর্ডের কিনারে হাত পড়ল। সুইচটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিপে দিল।
আলো জ্বলল মাথার ওপর।
চোখ মিটমিট করে সইয়ে নিতে লাগল এই হঠাৎ উজ্জলতা। চারপাশে আকাল। লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। একা। ইঁদুর থেকে থাকলে আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে।
কিন্তু মনের খুঁতখুতি গেল না। সত্যি কি ইঁদুর? নাকি রেস্ট রূমে কেউ লুকিয়ে রয়েছে?
দরজা খুলে একটা ঘরে ঢুকল সে। এটা পুরুষদের রেস্ট রূম খালি। মেয়েদেরটাতেও উঁকি দিল। এটাও খালি। কেউ নেই।
ধূর! অহেতুক দেখাদেখি করছে এভাবে। কোন প্রয়োজন ছিল না। তারচেয়ে যা নিতে এসেছে, সেটা নিয়ে কেটে পড়া উচিত। দেরি দেখলে ডলি আবার চিন্তা শুরু করবে।
ডাবল ডোরটা পার হয়ে অডিটরিয়ামে চলে এল সে। সামনে সারি সারি সীট তার দিকে মুখ করে রয়েছে। সব যেন তাকিয়ে রয়েছে শূন্য মঞ্চটার দিকে।
ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগোল সে। নির্জন অডিটরিয়ামে প্রতিধ্বনি তুলল তার পায়ের শব্দ। অনেক জোরাল হয়ে কানে বাজল।
ডলি বলেছে, উইঙসের ভেতরে একটা টুলের ওপর স্ক্রিপ্টটা ফেলে গেছে।
সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠতে শুরু করল সে। মঞ্চের পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে কাপড়ের স্তূপ। ভাল করে দেখল মুসা। ধূসর রঙ চোখে পড়ল। পরিচিত রঙ।
ওগুলো দৃশ্যপট। নাটকের জন্যে তৈরি করা হয়েছে। মাটির নিচের ঘরে ভ্যাম্পায়ারের আস্তানার ছবি। কফিনের মধ্যে শুয়ে থাকা ভ্যাম্পায়ার।
এগিয়ে গেল মুসা। এভাবে ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। ছড়িয়ে নিয়ে ঠিকমত, রোল করে কিংবা ভাঁজ করে রাখতে হবে। দেখেই যখন ফেলেছে, ঠিক করে রাখাটা তার কর্তব্য।
একটা কাপড়ের কোণা ধরে টান দিল সে।
দিয়েই থমকে গেল। চমকে উঠল ভীষণভাবে।
কাপড়টাকে ওভাবে স্তূপ করে রাখার কারণ আছে।
কাপড়ের নিচে একটা লাশ।
একজন মহিলার।
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল মুসার। নাড়িভুড়িগুলো যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
খাইছে! একটিমাত্র শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
মিসেস রথরক। চিত হয়ে পড়ে আছেন। দৃশ্যপটের রঙের মতই তাঁর মুখটাও ফ্যাকাসে ধূসর।
কাঁপা পায়ে হাঁটু গেড়ে বসল মুসা। ভাল করে তাকাল গলার দিকে। দুটো দাঁতের দাগ স্পষ্ট।
খোদা, আবার খুন করল ভ্যাম্পায়ার! এই লাশটাও প্রথম চোখে পড়ল। তার! কি ভাববে এখন পুলিশ?
চোখের কোণ দিয়ে একটা নড়াচড়া দেখতে পেল।
ভ্যাম্পায়ারটা কি এখনও ঘরেই আছে!
বুকের দুরুদুরু বেড়ে গেল তার। পাঁই করে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল একটা ছায়ামূর্তি। চিনে ফেলল।
কণিকা!
.
১৫.
গাঢ় ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। মঞ্চের পেছনে। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। ঠোঁট ফাঁক।
কেন? দাঁতের জন্যে? এখনও গুটিয়ে নেয়নি শ্বদন্ত?
যেন মুসার মনের কথা পড়তে পেরেই তাড়াতাড়ি মুখের কাছে হাত নিয়ে গেল কণিকা। চিৎকার ঠেকাল, না শ্বদন্ত গোপন করল, বোঝা গেল না।
আবার অভিনয় করা হচ্ছে! রাগ লাগল মুসার। বলবে নাকি এসব ভণ্ডামি বন্ধ করতে? বলবে, আমি জানি, তুমি ভ্যাম্পায়ার!
নাহ, আপাতত না বলাই ভাল।
সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয় ঝেড়ে ফেলে গটমট করে ওর দিকে এগিয়ে গেল মুসা। মঞ্চের পেছনে ছায়ায় এসে দাঁড়াল। খপ করে চেপে ধরল কণিকার একটা হাত। হ্যাঁচকা টানে নিয়ে এল ছায়া থেকে আলোতে।
এতক্ষণে যেন লাশটাকে চোখে পড়ল কণিকার। ছোট্ট একটা চিৎকার বেরোল মুখ থেকে। চোখে ফুটল বিস্ময়। কুঁচকে গেল কপাল। নিজের অজান্তেই পিছিয়ে গেল এক পা।
এখানে কি তোমার? গর্জন করে উঠল মুসা। আমি তো জানতাম তুমি রবিনের সঙ্গে রয়েছ।
ছিলাম, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে কণিকার। কিন্তু ও অতিরিক্ত দুর্বল। হাঁটা তো দূরের কথা, দাঁড়াতেই পারছিল না। বাড়ি চলে যেতে বললাম। একটা জরুরী কথা মিসেস রথরককে জিজ্ঞেস করতে থিয়েটারে ফিরে। এসেছিলাম আমি। কিন্তু…
থেমে গেল সে।
আর ন্যাকামি করতে হবে না। মনে মনে বলল মুসা। তুমিই খুন করেছ। মহিলাকে। কোন সন্দেহ নেই আর আমার। জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ আগে এসেছ?
এই তো, মিনিটখানেকও হয়নি। মিসেস রথরকের লাশটা দেখে কি করব ভাবছি, এই সময় একটা শব্দ কানে এল। ভাবলাম খুনী ফিরে এল বুঝি। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম। কারণ আমাদের এই খুনীটা ডেঞ্জারাস। বাগে পেলে আমাকেও ছাড়ত না। তাই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখি তুমি।
আমি পুলিশকে ফোন করতে যাচ্ছি, মুসা বলল।
মাথা ঝাঁকাল কণিকা।
লবিতে দৌড়ে গেল মুসা। ফোন আছে ওখানে। থানায় ফোন করল। ডিউটি অফিসার বলল, কয়েক মিনিটের মধ্যে লোক পাঠাবে।
পুলিশ এবার আমাকে দেখলে খুশিতে মাথায় তুলে নাচবে! তেতো হয়ে গেল মুসার মন। আছাড় দিয়ে নামিয়ে রাখল রিসিভার। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, পেছনে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা।
বুকের মধ্যে আবার ধড়াস করে উঠল মুসার। মনে পড়ল কণিকা ভ্যাম্পায়ার। একটা ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে একা এক ঘরে রয়েছে সে। তিন তিনটে খুন যে ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে।
পিছিয়ে যেতে শুরু করল মুসা।
দেয়ালে গিয়ে পিঠ ঠেকল। কণিকার চোখে চোখ।
এক পা আগে বাড়ল কণিকা।
আরেক পা।
আর দাঁড়াল না মুসা। ঘুরে দৌড় মারল।
মুসা, শোনো, চিৎকার করে ডাকল কণিকা। দাঁড়াও। পালাচ্ছ কেন? কিন্তু ফিরেও তাকাল না মুসা। এক ছুটে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। বাইরে গিয়ে পুলিশের অপেক্ষা করা বরং ভাল, নিরস্ত্র হয়ে একঘরে একটা ভয়ঙ্কর ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে থাকার চেয়ে।