ধৃতরাষ্ট্র-প্রার্থিত ধনদানে ভীমের অনিচ্ছা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর রজনী প্রভাত হইলে, অন্ধরাজ বিদুরকে যুধিষ্ঠিরের নিকট প্রেরণ করিলেন। মহাত্মা বিদুর যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “রাজন! মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বনগমনার্থ প্রস্তুত হইয়াছেন। তিনি এই কার্ত্তিকী পূর্ণিমাতে যাত্রা করিবেন। এক্ষণে তিনি সমরনিহত মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য্য, সোমদত্ত, বাহ্লীক, তাঁহার পুত্রগণ ও অন্যান্য বান্ধবগণের শ্রাদ্ধ-সম্পাদনার্থ আপনার নিকট কিঞ্চিৎ ধন প্রার্থনা করিতেছেন। যদি আপনার অভিমত হয়, তাহা হইলে তিনি ঐ ধনদ্বারা সৈন্ধবাপসদ [সিন্ধুরাজবংশের অধম] জয়দ্রথেরও শ্রাদ্ধ করিবেন।”
মহাত্মা বিদুর এই কথা কহিবামাত্র রাজা যুধিষ্ঠির ও অর্জ্জুন তাঁহার বাক্যশ্রবণে পরম পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে যথোচিত সম্মাননা করিলেন, কিন্তু জাতক্রোধ ভীমসেন দুর্য্যোধনের দৌরাত্ম্য স্মরণ করিয়া বিদুরের সেই বাক্যে তাদৃশ আস্থা প্রকাশ করিলেন না। তখন মহাবীর অর্জ্জুন বৃকোদরের অভিপ্রায় অবগত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৃকোদর! আমাদিগের পিতৃব্য বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র বনগমনে দীক্ষিত হইয়া ভীষ্মদি মহাত্মাদিগের ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া সম্পাদনার্থ আপনাকর্ত্তৃক নির্জ্জিত ধন যাচ্ঞা করিতেছেন। অতএব উহা প্রদান করিতে অনুজ্ঞা করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। হায়! কালের কি আশ্চর্য্য গতি। পূর্ব্বে যে ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আমরা যা করিয়াছি, এক্ষণে তিনি আমাদিগের নিকট যা করিতেছেন। যিনি সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি ছিলেন, আজ তিনি শত্ৰুকর্ত্তৃক পরাজিত হইয়া বনগমনে অভিলাষী হইয়াছেন। এক্ষণে আপনি ধৃতরাষ্ট্রকে ধনপ্রদানে অনুমতি করুন। উহাকে ধন প্রদান না করিলে আমাদের অধর্ম্ম এবং অকীৰ্ত্তি ঘোষণা হইবে। বরং আপনি ধন প্রদান করা উচিত কি না, তাহা জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৰ্ম্মরাজকে জিজ্ঞাসা করুন।”
মহাত্মা অৰ্জ্জুন এই কথা কহিবামাত্র রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহার বাক্যে অনুমোদন করিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ধনঞ্জয়কে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! আমরা স্বয়ং মহাবীর ভীষ্ম, সোমদত্ত, ভূরিশ্রবা, বাহ্লীক, মহাত্মা দ্রোণাচার্য্য ও অন্যান্য বান্ধবগণের প্রেতকার্য্য সম্পাদন করিব এবং ভোজনন্দিনী কর্ণের ঔর্দ্ধদেহিক কাৰ্য্য সম্পাদন করিবেন। উঁহাদিগের শ্রদ্ধার্থ ধৃতরাষ্ট্রকে ধন দান করিবার প্রয়োজন কি? আমার মতে দুৰ্য্যোধনাদির ঔর্দ্ধদেহিক কাৰ্য্য করাই বিধেয় নহে। আমাদিগের শত্রুগণ যেন কোন স্থানেই আহ্লাদিত না হয়। দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি যেসকল কুলাঙ্গারদ্বারা এই পৃথিবী উৎসন্নপ্রায় হইয়াছে, তাহারা যেন সকলেই ঘোরতর ক্লেশে নিপতিত হয়। তুমি কি দ্রৌপদীর ক্লেশাবহ দ্বাদশ বৎসর বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস এককালে বিস্মৃত হইয়াছ? তৎকালে ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহ কোথায় তিরোহিত হইয়াছিল? যখন তুমি হৃতসর্ব্বস্ব হইয়া কৃষ্ণাজিন ধারণপূর্ব্বক পাঞ্চালীর সহিত রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুগমন করিয়াছিলে, তখন ভীষ্ম, দ্রোণ ও সোমদত্ত ইঁহারা কোথায় অবস্থান করিয়াছিলেন। যখন তুমি ত্রয়োদশ বৎসর বন্য ফলমূল ভক্ষণ করিয়া বনে বনে ভ্রমণ করিয়াছিলে, তখন তোমার জ্যেষ্ঠতাতের পিতৃস্নেহ কোথায় তিরোহিত হইয়াছিল? দুরাত্মা অন্ধরাজ যে দ্যূতক্রীড়ার সময় ‘এইবার আমাদের কি লাভ হইল’ বলিয়া বারংবার বিদুরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, তাহা তুমি কি একেবারে বিস্মৃত হইয়াছ?”
মহাবীর বৃকোদর ক্রোধভরে এই কথা কহিলে, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহাকে ভৎসনা করিয়া মৌনাবলম্বন করিতে কহিলেন।