১১. দূরে রাহেলার দিকে তাকিয়ে থেকে

দূরে রাহেলার দিকে তাকিয়ে থেকে নিশীতা বলল, এখন কী হবে?

রিয়াজ বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা আটকে রেখে বলল, জানি না। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হল। কীভাবে শুরু করব সেটা নিয়ে আর সিদ্ধান্ত নিতে হল না। রাহেলাই শুরু করে দিল।

কী সিদ্ধান্ত?

ফ্রেড লিস্টার আর মহাজাগতিক প্রাণী যে কথাবার্তা বলছে তার মাঝখানে আমাদের কথা বলা।

কীভাবে করব সেটা?

দেখা যাক রিয়াজ চিন্তিত মুখে বলল, ক্যাপ্টেন মারুফ।

বলুন।

ফ্রেড লিস্টার যেই মুহূর্তে রাহেলাকে দেখতে পাবে তখন টের পাবে আমরা এখানে চলে এসেছি। কিছু একটা করতে পারে তখন। আপনি সেটা সামলাবেন।

ক্যাপ্টেন মারুফ তার ঘাড়ে ঝোলানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। নিশ্চিন্ত থাকেন।

চমৎকার। রিয়াজ নিশীতাকে ডাকল, নিশীতা।

কী হল?

কাছে এস, তোমার সাহায্য দরকার এখন।

আমি? আমি কী করব?

তুমি কথা বলবে।

কী কথা বলব? কার সাথে কথা বলব?

মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে।

নিশীতা অবাক হয়ে বলল, আমি কীভাবে কথা বলব? আমি তো আপনার কোডিং সম্পর্কে কিছুই জানি না।

সেজন্যই তুমি কথা বলবে। কোডিং জানা থাকলে কথা বলা যায় না, কথাগুলোতে তখন এক ধরনের পক্ষপাত এসে যায়।

নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমি কী বলব?

তোমার যা ইচ্ছে। তুমি একজন মানুষ। তোমার সামনে একটি মহাজাগতিক প্রাণী। সে কিছু ক্রিমিনালের শরীর দখল করে নিয়েছে সেই শরীর ব্যবহার করে এখানে কাজ করছে। আমার ধারণা মানুষ সম্পর্কে তার হিসাবটি ভুল। এই প্রাণী ধরে নিয়েছে সব মানুষই বুঝি কব্জি কাটা দবির–ধরে নিয়েছে যারা ক্রিমিনাল তারা সত্যিকারের মানুষ, অন্যরা দুর্বল, অন্যরা অক্ষম। তার সেই ভুল ধারণা ভেঙে দিতে হবে।

নিশীতা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সেই ভুল ধারণা ভেঙে দেব?

হ্যাঁ। আর কেউ নেই। রিয়াজ নিশীতার দিকে একটা অত্যন্ত সংবেদনশীল মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও কথা বলতে ভ্রু কর। নিশীতা অবাক হয়ে রিয়াজের দিকে তাকাল, রিয়াজ অধৈর্য হয়ে বলল, দেরি কোরো না রাহেলা পৌঁছে যাচ্ছে

নিশীতা মাইক্রোফোনটি নিয়ে ইতস্তত করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণী আমি তোমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছি, কিন্তু আমি জানি না তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ কি না। যদি বুঝেও থাক তার কতটুকু বুঝেছ–কীভাবে বুঝেছ। পৃথিবীর পক্ষ থেকে তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছি।

রিয়াজ তার হেডফোনে নিশীতার কথা শুনছিল কোডিং করার পর সে কথাটি হল, এক চার এক পাঁচ নয়, দুই ছয় পাঁচ তিন পাঁচ। আমন্ত্রণ সম আমন্ত্রণ।

নিশীতা আবার বলল, খুব দুঃখের কথা তোমার মতো বুদ্ধিমান একটা প্রাণীর সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ হল না। তুমি কব্জি কাটা দবিরের মতো একটা ক্রিমিনালকে পেয়ে ভাবলে সে পৃথিবীর মানুষের উদাহরণ। আসলে সে উদাহরণ ছিল না। পৃথিবীর সাধারণ মানুষ এত নিষ্ঠুর নয়, এত স্বার্থপর নয়, এত নীতিবিবর্জিত নয়।

রিয়াজ শুনল সেটি কোডিং করা হল, ভুল পরিচয় মানুষ।

নিশীতা বলল, তুমি কব্জি কাটা দবিরের মতো একজন একজন মানুষকে দখল করে নিলে, কী লাভ হল তাতে? পৃথিবীর সত্যিকার মানুষের সাথে তোমার পরিচয় হল না। সত্যিকার মানুষের সাথে পরিচয় হবে ভালবাসা দিয়ে। তুমি তার সুযোগ দিলে না। মানুষের সত্যিকার পরিচয় তোমার কাছে অজানা থেকে গেল।

নিশীতার কথাগুলো কোডিং হল এভাবে, দুই এক ছয় চার দুই শূন্য এক নয় আট নয় ভুল ভুল ভুল।

তুমি কেন এসেছ এখানে? পৃথিবীর মানুষের কাছে গোপন রেখে একটা ভয়ঙ্কর ত্রাস সৃষ্টি করে তোমার কী লাভ? এক বুদ্ধিমান প্রাণী অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীকে কি ভয় পেতে পারে? নাকি পাওয়া উচিত?

কোডিং হল, ভয় ঠিক নয়, কারণ নয় বোধগম্য।

নিশীতা বলল, এখানে এসে তুমি ফ্রেড লিস্টারের মতো বাজে মানুষের সাথে ব্যবসা করতে নেমে গেলে, তুমি তাকে দেবে প্রযুক্তি আর সে তোমাকে দেবে একটা মানব শিশু, এই মানব শিশু দেওয়ার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? তার কত বড় দুঃসাহস, সে মায়ের বুক খালি করে তোমাকে একটা শিশু দিয়ে দেয়?

কোডিং করা হল, অগ্রহণযোগ্য অসম বিনিময়।

নিশীতা আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন স্পিকারে কথা ভেসে এল, আমন্ত্রিত চুক্তিবদ্ধ আমন্ত্রিত।

নিশীতা চমকে উঠল, রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণী কথা বলছে, সে বলছে তাকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। তার সাথে চুক্তি করা হয়েছে।

কে তোমাকে আমন্ত্রণ করেছে? কে তোমার সাথে চুক্তি করেছে? আমরা সেই চুক্তি মানি না, বিশ্বাস করি না। পৃথিবীর মানুষকে বিপদের মাঝে ফেলে এ রকম চুক্তি করার অধিকার কারো নেই।

মহাজাগতিক প্রাণী বলল, মানুষ দুর্বল! মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। অক্ষম। ধ্বংসযোগ্য।

নিশীতা চিৎকার করে বলল, কখনো নয়। মানুষ কখনো দুর্বল নয়, আতঙ্কগ্রস্ত নয়। অক্ষম নয়, ধ্বংসযোগ্য নয়। তুমি যে মানুষদের দেখেছ তারা ভীতু, আতঙ্কগ্রস্ত। তারা। অক্ষম। কিন্তু তার বাইরেও মানুষ আছে।

মস্তিষ্ক নিউরন সিনান্স সংযোগ আতঙ্ক ভীতি।

না। নিশীতা জোর দিয়ে বলল, মানুষ মাত্রেই আতঙ্কিত নয়। ভীত নয়।

প্রমাণ। তথ্য যুক্তি।

তুমি প্রমাণ চাও? ঠিক আছে আমি তোমাকে প্রমাণ দেব। ঐ দেখ কমলা রঙের শাড়ি পরে একজন মা তোমাদের কাছে যাচ্ছে। তার সন্তানকে তোমরা নিয়ে গেছ। সেই মা তার সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। তার মস্তিষ্কের মাঝে ঢুকে দেখ সে ভয় পায় কি না! আমি তোমাকে বলে দিতে পারি একজন সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মা যখন রুখে দাঁড়ায় তার। ভিতরে কোনো ভয় থাকে না, আতঙ্ক থাকে না, কোনো দুর্বলতা থাকে না। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে তুমি এই মাকে থামাও। তোমার সমস্ত শক্তি দিয়েও তুমি তাকে থামাতে পারবে না। তুমি তাকে ধ্বংস করে দিতে পারবে, তুমি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারবে, তাকে হত্যা করতে পারবে কিন্তু তুমি তাকে থামাতে পারবে না। সন্তানের জন্য মায়ের বুকের ভিতরে কী ভালবাসার জন্ম হয় তুমি সেটা জান না। তোমার ভিতরে মানুষের অনুভূতি থেকে লক্ষগুণ তীব্র অনুভূতি থাকতে পারে কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। কারণ সন্তানের জন্য মায়ের তীব্র ভালবাসার কাছে তোমার সব অনুভূতি ধুয়ে মুছে যাবে। বানের জলের মতো ভেসে যাবে, ধুলোর মতো উড়ে যাবে!

রিয়াজ নিশীতার হাত স্পর্শ করে বলল, নিশীতা।

নিশীতা নিজেকে সংবরণ করে থামল, রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে, ড. হাসান?

তুমি এখন থামতে পার, নিশীতা।

কেন?

তুমি যে কথাগুলো বলেছ সেটাকে কোডিং করে মহাজাগতিক প্রাণীকে জানানো হয়েছে। মহাজাগতিক প্রাণী সেটা গ্রহণ করেছে।

নিশীতা তীক্ষ্ণ চোখে রিয়াজের দিকে তাকাল, বলল, কী গ্রহণ করেছে?

চ্যালেঞ্জ।

চ্যালেঞ্জ? কিসের চ্যালেঞ্জ? কে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ?

তুমি দিয়েছ। রাহেলা বনাম মহাজাগতিক প্রাণী

কখন দিলাম?

এই মাত্র!

কী হবে এই চ্যালেঞ্জে?

মহাজাগতিক প্রাণী মুখোমুখি হবে রাহেলার। মানুষের শরীর ব্যবহার করে নয় সত্যি সত্যি। আসল মহাজাগতিক প্রাণী। রাহেলা যদি তাকে পরাজিত করতে পারে তা হলে আমরা বেঁচে যাব। পৃথিবীর মানুষ বেঁচে যাবে।

আর যদি না পারে?

সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করার কেউ থাকবে না নিশীতা।

.

রাহেলা সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, জায়গাটা উঁচু–নিচু, মনে হয় কাটাকুটো আছে। পায়ে খোঁচা লাগছে, হয়তো কেটেকুটে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না। দূরে মাটির ওপরে কিছু একটা ভাসছে–শার্টপ্যান্ট পরে থাকা মেয়ে আর চমশা পরা। মানুষটা এটা নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার কিন্তু সে এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। জিনিসটার নিচে নীল আলো, কী বিচিত্র নীল আলো, এ রকম নীল আলো সে কখনো দেখে নি। মনে হচ্ছে জ্যোৎস্নার আলোকে কেউ নীল রং দিয়ে রং করে। দিয়েছে। নীল আলোর নিচে ঐ প্রেতগুলো আস্তে আস্তে নড়ছে। কে জানে কোথা থেকে। এসেছে এগুলো। দেখতে মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়। দেখলে কী ভয় লাগে! সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে ভয়ে। ভয় আর ঘেন্না–শরীর থেকে শুড়ের মতো কী যেন বের হয়ে আসছে, সেগুলো আবার কিলবিল করে নড়ছে। তার বাচ্চাটিকে ঘিরে রেখেছে এই প্রেতগুলো, এই দানবগুলো, এই রাক্ষসগুলো। কিন্তু রাহেলা ঠিক করেছে আজকে সে ভয় পাবে না। সে ঘেন্নাও করবে না। সে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে যাবে তার বাচ্চার কাছে, তাকে ধরে শক্ত করে বুকে চেপে ধরবে। তারপর আর কিছু আসে–যায় না। তাকে মেরে ফেললেও আর কিছু আসে–যায় না। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সে তার বাচ্চাটিকে বুকে চেপে ধরে একবার আদর করতে চায়। আর কিছুতে কিছু আসে যায় না।

রাহেলা হঠাৎ এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো এক ধরনের শব্দ কিন্তু সে জানে এটা ঝিঁঝি পোকার ডাক নয়। এটা অন্য কিছু। এই শব্দের সাথে সাথে মাথায় কেমন জানি যন্ত্রণা করে ওঠে। শুধু যন্ত্রণা নয় তার মনে হয় মাথার ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে। হঠাৎ করে রাহেলা কিছু একটা দেখতে পায়। নিঃসীম শূন্য একটা প্রান্তরের মতো একটা কিছু, তার মাঝে কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে, বিশাল কিছু আদি নেই অন্ত নেই সেরকম একটা কিছু। প্রচণ্ড আতঙ্কে রাহেলার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। মনে হয় অচেতন হয়ে পড়বে সে।

কিন্তু না, তাকে অচেতন হলে চলবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে, যেভাবেই হোক তাকে জেগে থাকতে হবে। তাকে ভয় পেলেও চলবে না, পৃথিবীর সব ভয়কে এখন তার বুকের ভিতর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে। কাউকে সে ভয় পাবে না–সে যতক্ষণ তার সোনামণিকে বুকে চেপে না ধরবে ততক্ষণ সে পৃথিবীর কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করবে না।

রাহেলা জোর করে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখল—ঐ তো দেখা যাচ্ছে তার শিশু সন্তানকে, শুয়ে শুয়ে হাত পা নাড়ছে, কাঁদছে অসহায়ের মতো। রাহেলা আবার ছুটে যেতে থাকে।

মাথার ভিতরে আবার একটা ভোঁতা যন্ত্রণা হয় কিছু একটা ঘটে যায় মাথার ভিতরে, জ্বর হলে যেরকম বিকার হয় ঠিক সেরকম লাগুর্তিার। মনে হয় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে সে, কেউ একজন তাকে ভয় দেখাচ্ছে। কে বলছে ফিরে যেতে। বলছে ফিরে না গেলে তাকে খুন করে ফেলবে, তাকে পুড়িয়ে ফেলবে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। তাকে ধ্বংস করে ফেলবে। রাহেলার হাসি পেক উঠাৎ সে কি মৃত্যুকে ভয় পায়? তাকে ধ্বংস করতে চাইলে করুক। তার যাদুমণিকে, সোনামণিকে বুকে চেপে ধরতে না পারলে সে কি বেঁচে থাকতে চায়? বেঁচে থেকে কী হবে তা হলে?

রাহেলা টলতে টলতে হাঁটতে থাকে। মাথা থেকে কিলবিলে শুড় বের হয়ে আসা দানবগুলো তাকে ঘিরে ধরতে চেষ্টা করছে কিন্তু রাহেলা আজকে থামবে না। আজকে কেউ তাকে থামাতে পারবে না। রাহেলা ছুটতে শুরু করে। কিলবিলে একটা গঁড় দিয়ে তাকে ধরে ফেলে একটা দানব, কী ভয়ঙ্কর শীতল পিচ্ছিল সেই অনুভূতি, রাহেলার সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। চিৎকার করে ঝটকা মেরে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। সাথে সাথে আরেকটি দানব তাকে জাপটে ধরে। প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করে নেয়, পিছন থেকে দানবগুলো ছুটে আসছে, তাকে ধরে ফেলছে। চিৎকার করতে করতে ছুটে যায় রাহেলা, পা বেঁধে পড়ে যায় হঠাৎ দানবগুলোর হাত থেকে বিদ্যুতের ঝলক বের হয়ে আসছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপতে থাকে, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে চায়, ভারী একটা লাল পরদা নেমে আসছে চোখের সামনে, নিশ্বাস নিতে পারছে না রাহেলা, মনে হচ্ছে বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসছে পাথরের মতো। রাহেলা বুঝতে পারে সে মরে যাচ্ছে, তাকে মেরে ফেলছে সবাই।

কিন্তু সে মরবে না, তার সোনামণিকে স্পর্শ না করে সে কিছুতেই মরবে না। হাতে ভর দিয়ে নিজেকে টেনে নিতে থাকে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে থরথর করে কেঁপে কেঁপে সে এগুতে থাকে। তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে তাকে গেঁথে ফেলছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর। মুখ দিয়ে দমকে দমকে কাঁচা রক্ত বের হয়ে এল রাহেলার, কিন্তু সে তবু থামল না। নিজেকে টেনে টেনে নিতে থাকল সামনে, এই তো আর মাত্র কয়েক ফুট।

প্রচণ্ড আঘাতে রাহেলা ছিটকে পড়ল, ভয়ঙ্কর আক্রোশে কেউ তাকে আঘাত করেছে, মনে হচ্ছে তার সমস্ত শরীর বুঝি ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছু আসে–যায় না তাতে তার। শরীরের একটা ক্ষুদ্র অংশও যদি বেঁচে থাকে সেটিই এগিয়ে যাবে, স্পর্শ করবে তার সোনামণিকে, তার যাদুকে, তার বুকের ধনকে।

রাহেলা মাটি কামড়ে কামড়ে এগিয়ে গেল, চোখ খুলে দেখতে পেল ভয়ঙ্কর একটি শক্তি, বিচিত্র একটা প্রাণী তাকে থামিয়ে দিতে চাইছে, তাকে শেষ করে দিতে চাইছে কিন্তু পারছে না, কর্কশ শব্দে কান ফেটে যাচ্ছে রাহেলার, মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে, মনে হচ্ছে তার শরীরকে কেউ মাটির সাথে গেঁথে ফেলছে।

তার মাঝেও সে এগিয়ে গেল, বিন্দু বিন্দু করে এগিয়ে গেল। পৃথিবীর সকল শক্তি, মহাজাগতিক প্রাণীর সমস্ত শক্তি তুচ্ছ করে সে এগিয়ে গেল, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে সে এগিয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে সে তার হারিয়ে যাওয়া ছিনিয়ে নেওয়া সন্তানকে জাপটে ধরল।

সাথে সাথে মনে হল তার শরীরের মাঝে হঠাৎ মত্ত হাতির বল এসেছে। পৃথিবীর সব কোলাহল, সব ধ্বনি হঠাৎ করে নীরব হয়ে যায়। হঠাৎ করে সব যন্ত্রণা সব কষ্ট মিলিয়ে যায়। সব অশুভ শক্তি হঠাৎ করে দূরে সরে যায়। রাহেলা গভীর ভালবাসায় তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বুকে টেনে নেয়, গভীর মমতার বুকের মাঝে চেপে ধরে। চারপাশের জগৎ হঠাৎ করে দুলে ওঠে। অশরীরী দানবের মতো মূর্তি, মাথার উপরে বিচিত্র মহাকাশযান, অতিপ্রাকৃত নীল আলো, কোনো কিছুকেই আর সত্যি মনে হয় না, সবকিছু যেন স্বপ্ন। সবকিছুই যেন অর্থহীন। কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। রাহেলা জানে সে আছে এবং তার বুকের মাঝে আছে তার সন্তান। পৃথিবীর কোনো শক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো শক্তি তাকে নিতে পারবে না। বুকের মাঝে এক গভীর প্রশান্তি নিয়ে রাহেলা জ্ঞান হারাল।

.

নিশীতা আর রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে ছিল, তারা এবার একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, রিয়াজ নিশীতার হাত স্পর্শ করে বলল, আমরা বেঁচে গেলাম নিশীত।

নিশীতা বুকের ভিতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, এখন কী হবে?

আমার ধারণা মহাকাশযানটি চলে যাবে।

চলে যাবে?

হ্যাঁ।

রিয়াজের কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযানটি কাঁপতে শুরু করে, অত্যন্ত উচ্চ কম্পনের একটা শব্দ শোনা যায়, নীল আলোটিও হঠাৎ তীব্র হয়ে ওঠে। নিশীতা আর রিয়াজ দেখতে পেল মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করেছে, উপরে উঠতে উঠতে সেটি কয়েক শ মিটার উপরে উঠে গেল, তারপর হঠাৎ কানে তালা লাগানো শব্দ করে মহাকাশযানটি আকাশ চিরে উড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য আকাশে একটা নীল আলোর রেখা দেখা গেল, তারপর আর কোথাও কিছু নেই। পৃথিবীর বুক থেকে মহাকাশযানটি চিরদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেছে।

একটু আগে যেখানে নীল আলো ছিল এখন সেখানে গাঢ় অন্ধকার, সেখানে রাহেলা তার সন্তানকে বুকে চেপে ধরে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে কিছু অপ্রকৃতিস্থ মূর্তি। মহাকাশযান আর মহাজাগতিক প্রাণী চলে যাবার পর সেগুলো এখন কী করছে কে জানে!

রিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল নিশীতা। রাহেলার কাছে যেতে হবে।

চলুন।

ফ্রেড লিস্টার? ফ্রেন্ড লিস্টার কী করবে এখন?

জানি না। মনে হয় মাথা কুটছে।

কিন্তু ওকে ধরতে হবে না?

ক্যাপ্টেন মারুফ ধরবে। মনে নেই সে কী রকম টাইকোয়ান্ডো জানে! থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট।

ঝোঁপঝাড় কাদা জলা মাটি ভেঙে ওরা সামনে যেতে যেতে হঠাৎ করে প্রেতের মতো মানুষগুলোর একটার মুখোমুখি হল। এর আগে যারা বর্ণনা দিয়েছিল সবাই বলেছে–চোখ দুটো থেকে অন্ধকারের মাঝে লাল আলোর মতো জ্বলতে থাকে, দূরে বসে তারাও দেখেছে, কিন্তু এখন সেই আলো নেই। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ইতস্তত হাঁটছে, তাদের দেখতে পেল বলে মনে হল না, পাশে একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, একবার ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু উঠতে পারল না। একটা পা অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে নড়তে থাকল, মনে হতে লাগল শরীরের সাথে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

রিয়াজ অকারণেই গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই জম্বিগুলো শেষ হয়ে গেছে, এখন আর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।।

এদের শরীরের ভিতরে ইঁদুরের মতো কী যেন থাকে।

এখন আছে কি না জানি না। থাকলেও আর ভয় নেই।

দুজনে পড়ে থাকা মানুষটিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়, আশপাশে আরো কিছু মূর্তি ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ পড়ে গিয়েছে, কেউ কেউ গাছপালায় আটকে গিয়েছে, কেউ কেউ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় এক জায়গায় ঘুরছে। মানুষের মতো এই প্রাণীগুলোর আচরণে এমন একটি অস্বাভাবিকতা রয়েছে যে দেখলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রাণীগুলোকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে তারা রাহেলার কাছে ছুটে গেল।

রাহেলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে, শরীরে মুখে ছোপ ছোপ রক্ত। অচেতন হয়েও সে হাত দিয়ে পরম আত্মবিশ্বাসে তার সন্তানকে জড়িয়ে রেখেছে। সন্তানটিও পরম নির্ভাবনায় তার মায়ের বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। নিশীতা নিচু হয়ে রাহেলার বুক থেকে সাবধানে শিশুটিকে তুলে নেয়, পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে, শিশুটি ক্ষুধার্ত, মুখ নেড়ে বৃথাই খাওয়ার চেষ্টা করতে করতে তারস্বরে কেঁদে উঠল।

রিয়াজ নিচু হয়ে রাহেলাকে একটু পরীক্ষা করল, বলল, আমাদের এখনই মেডিক্যাল হেল্প দরকার।

নিশীতা বলল, আমি রাহেলার সাথে আছি, আপনি দেখুন কিছু করা যায় কি না।

নিশীতার কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল কেউ একজন টর্চ লাইটের আলো ফেলে ছুটে ছুটে আসছে, কাছে এলে দেখা গেল মানুষটি ক্যাপ্টেন মারুফ। কপালের কাছে কেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। রিয়াজ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে আপনার?

ও কিছু না। একজন মিলে চার-পাঁচজনকে ধরতে গেলে ওরকমই হয়।

চার-পাঁচজনকে ধরেছেন?

হ্যাঁ। বেঁধেছেদে রাখতে সময় লাগল। এক বদমাইশের কাছে আবার আর্মস ছিল, তাকে কাবু করতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।

কী রকম বাড়াবাড়ি?

মনে হয় ব্যাটার নাকের হাড়টা ভেঙে গেছে। পাঁজরের হাড়ও যেতে পারে দুই-একটা।

নিশীতা অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, আপনি একা ঐ মোষের মতো এতগুলো মানুষকে কাবু করেছেন?

আর কাকে পাব! একাই তো করতে হবে।

কীভাবে করলেন আপনি?

রিয়াজ সাহেব যখন আমাকে বললেন আপনাদের প্রকেটশন দিতে তখনই বুঝেছিলাম কাজটা সহজ হবে না। আমাদের মিলিটারি লাইনে একটা কথা আছে যে, অফেন্স ইজ বেস্ট ডিফেন্স। তাই আমি আর দেরি করি নি, পিছন থেকে গিয়ে সবগুলোকে আটক করেছি। খুব কপাল ভালো গুলি করতে হয় নি। দরকার হলে করতাম!

রিয়াজ রাহেলার দিকে তাকিয়ে বলল, রাহেলার মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স দরকার। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।

ক্যাপ্টেন মারুফ চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, বদমাইশগুলোর হেলিকপ্টারটা আছে। পাইলটকে একটু ধোলাই দিতে হয়েছে কিন্তু মনে হয় হেলিকপ্টারটা নিয়ে যেতে পারবে। আমি সাথে থাকব, মাথায় একটা রিভলবার ধরে রাখব–

নিশীতা বলল, মনে হয় তার দরকার হবে না।

কেন?

ঐ দেখেন।

রিয়াজ এবং ক্যাপ্টেন মারুফ তাকিয়ে দেখল, বহুদূর থেকে মশাল জ্বালিয়ে শত শত গ্রামবাসী ছুটে আসছে। হেডলাইট দেখে মনে হয় পিছনে দুই–একটা গাড়িও আসছে। নিশীতা কান পেতে শুনল হেলিকপ্টারের শব্দও শোনা যাচ্ছে। কাঁদের হেলিকপ্টার কে জানে, কিন্তু এখন আর কিছু আসে–যায় না। কিছুক্ষণের মাঝেই এখানে এই এলাকার শত শত মানুষ চলে আসবে। কেউ তখন আর কিছু করতে পারবে না।