১১. দুঃস্বপ্নের রাজ্যে

একাদশ পরিচ্ছেদ

০১.

আমি যেন দুঃস্বপ্নের রাজ্যে উপস্থিত হয়েছি। মৃত মানুষদের মধ্যে সময় কাটাচ্ছি।

নাটলের দিকে চেয়ে বুঝলাম এই হোটেলে কেউ আমাকে দেখতে পেলে চলবে না এবং পুলিশ আসার আগেই আমাকে পালাতে হবে।

মহিলাটি প্যাসেজের কোথাও দাঁড়িয়ে প্রাণপণে চিৎকার করছিলেন এবং উপর তলার আর একজন মেয়ে চীৎকারে যোগ দিল।

চীৎকার করতে থাকা মেয়েটা এবার জানালা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠল, পুলিশ! খুন! পুলিশ। ভয়ে এবার ছুটতে লাগলাম। ভয়ঙ্কর জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে। আর একটা অপ্রত্যাশিত আঘাত আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।

 রাতের কেরানীটি ডেস্কের উপর মুখ নিচু করে শুয়ে ছিল, তার মাথার চারপাশে রক্ত। তার ডানদিকের কপালে কেউ ভীষণ জোরে আঘাত করছে, একই ভাবে ডলোরেস লেনকে হত্যা করা হয়েছিল।

 মৃতদেহটা দেখবার জন্য দাঁড়ালাম কিন্তু দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনে ভয়ে আমার শরীরটা শক্ত হয়ে উঠল।

কাঁচের দরজা দিয়ে যাবার পথটা বড় রাস্তায় এসে পড়েছে, কম্পিত বুক নিয়ে সেদিকে ছুটলাম। খেয়াল হল যদি এই পথে যাই পুলিশের গাড়ির সামনে গিয়ে পড়ব।

রিসেপশান ডেস্কের ঠিক পেছনে একটা দরজায় লেখা সার্ভিস।

কাউন্টারের পাশ দিয়ে ছুটে প্যাসেজে এলাম। অল্প আলোতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে আর একটা প্যাসেজ পেলাম যেটা রান্নাঘরে পৌঁছেছে। একটা দরজার সামনে লেখা ফায়ার এক্রিট।

শক্ত করে আটকানো ছিটকিনি খুলে একটা অন্ধকার গলি পেলাম।

দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিয়েই গলি দিয়ে সদর রাস্তায় এলাম। গলির শেষে এসে রাস্তার দুপাশে চেয়ে দেখলাম।

হোটেলের প্রবেশ পথে একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে। কোন পুলিশের লোক নেই।

অন্ধকারে ক্লান্ত পা দুটো টেনে রাস্তার উল্টো দিকে ছুটলাম।

 দুটো রাস্তা পেরিয়ে যখন হাঁটছি তখন একটা ট্যাক্সি উল্টোদিক থেকে আমার দিকে আসছে। ট্যাক্সিটা দাঁড় করালে বিপদের সম্ভাবনা। কিন্তু তখন এত ক্লান্ত যে এসব বিবেচনা করার মত অবস্থা ছিল না।

হাত নাড়তেই ট্যাক্সিটা দাঁড়াল। ড্রাইভারকে বললাম, ম্যাডক্স অ্যাভিনিউয়ে নিয়ে যেতে।

দশ মিনিটের মধ্যেই ম্যাডক্স অ্যাভিনিউয়ে এসে পৌঁছলাম। ম্যাডক্স আর্মস পেরিয়ে যাবার সময় জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম।

পুলিশের তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ির পাশে পাঁচজন উর্দিপরা এবং একজন সাদা পোশাকের পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। ঠিক পরের মোড়ে ট্যাক্সিটাকে দাঁড়াতে বলে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিলাম। ট্যাক্সিটা চলে যেতে যেখানে বুইকটা রেখেছিলাম সেখানে এলাম।

সেখান থেকে যখন বেরিয়ে এলাম সাড়ে তিনটে বাজে। বাংলোয় যাবার পথে ভাবছিলাম, আজকের রাতটা কী ভয়ঙ্কর।

শুধু একটি পুলিশের মৃত্যুর সঙ্গে যে জড়িয়ে পড়েছি তা নয়। এখন আমি তিনটে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এর অবশ্যম্ভাবী ফল যাচিয়ে দেখবার মত মনের অবস্থা ছিল না।

বাংলোতে চারটে বাজতে পাঁচ মিনিট আগে এসে পৌঁছলাম।

সদর দরজার তালা খুলে অন্ধকার হলঘরে এসে পড়লাম। আলো জ্বালার প্রয়োজন হল না। হলঘরের ভিতর দিয়ে গিয়ে শোবার ঘরের দরজা খুলে অন্ধকারে ভিতরে ঢুকলাম।

হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম, একটা মিষ্টি মৃদু গন্ধ ঘরের বদ্ধ বাতাসকে ভরিয়ে তুলেছে, এ ধরনের গন্ধ জীবনে কোনদিন শোবার ঘরে পাইনি।

আলোটা জ্বালতেই দেখলাম আমার বিছানায় বাদামি রঙের চুলে মুখটা অর্ধেক ঢেকে নগ্ন হাত দুটো বিছানার চাদরে এলিয়ে দিয়ে লুসিলি শুয়ে আছে। মরে গেছে না ঘুমিয়ে আছে বুঝলাম না।

নড়াচড়ার বা নিঃশ্বাস ফেলার কোন লক্ষণ দেখলাম না। আমার বিছানায় তাকে দেখতে পাওয়া এক চরম বিস্ময়। সে হয়তো মৃত।

আজ রাতে তিনজন লোক মারা গেছে, এ হয়ত চতুর্থ। তিনজন মারা যাওয়ার পরে পালিয়ে আসতে পেরেছি। কিন্তু লুসিলি মারা গেলে পালিয়ে যেতে পারব না। তাকে কোনদিনও ভুলতে পারব না, কারণ সে আমার বাংলোয়, আমার বিছানায় মরে পড়ে আছে।

বিছানার কাছে এসে কাঁপা হাতে আস্তে তার বাহুতে হাত দিলাম।

লুসিলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফিরল। যেন আলোটা এড়াতে চাইছে।

স্বস্তি পেয়ে সরে এলাম। তার পোশাক মেঝের উপর ছড়িয়ে পড়ে আছে, এক জোড়া বাসন্তী রঙের স্ন্যাক্স। একটা সাদা জামা, এক জোড়া প্যান্টি এবং চেয়ারে একটি ব্রা।

ভাবতে পারছিলাম না। সে কেন আমার বিছানায় শুয়ে আছে, এবং তার ফল কি হতে পারে।

এখন আমার ঘুমের দরকার।

পাশের অব্যবহৃত শোবার ঘরটার গিয়ে জামা কাপড় খুলে বিছানার চাদরটা টেনে শুয়ে পড়লাম।

বালিশে যখন মাথা রাখলাম। মনে হল যেন অতলে ভেসে যাচ্ছি। আমার বিছানায় লুসিলি। ভালাক্যাডিলাক, পুলিশের ভয় এবং অসকার রসের ভয়াবহতা–সব গুলিয়ে যখন ঘুমিয়ে ছিলাম তখন আমার সমস্যা ও ভয় আড়ালে বসে অপেক্ষা করছিল, কখন আমার ঘুম ভাঙে।

.

০২.

 চোখ খুলে দেখি বিছানার পাশে ঘড়িতে এগারটা বেজে পাঁচ। কাঠের খড়খড়ির ভিতর দিয়ে সূর্যের প্রখর কিরণ এসে পড়েছে।

চুপ করে শুয়ে কিছুক্ষণ ভাবছিলাম গত রাতের ঘটনাগুলো কি সত্যিই ঘটেছে না আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুম একেবারে ছুটে যেতে যখন বুঝতে পারলাম এসব কল্পনা নয়, গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে স্নানের পোশাক নিয়ে বাথরুমে গেলাম।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে শোবার ঘরে চলাফেরার শব্দ পেলাম। একটু পরেই দরজা খুলে দোরগোড়ায় লুসিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।

বললাম, এই যে, অতিরিক্ত বিছানাটা ব্যবহার করনি কেন? নাকি তোমার অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল?

লজ্জিত ভাবে বলল, অত্যন্ত দুঃখিত। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম তোমার জন্য। এত ক্লান্ত ছিলাম যে কখন তোমার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

আর ঘুমের মধ্যেই বুঝি জামাকাপড় খুলে ঘরময় ছড়িয়ে বিছানার চাদরের মধ্যে ঢুকেছিলে? আশা করি তুমি আমার মতই ঘুমিয়েছিলে। আমি একটু বেড়িয়ে ফিরেছিলাম, ভাবলাম তোমাকে জাগানো ঠিক হবে না। তা এখানে আসার কি কারণ ছিল, না ভেবেছিলে যে বিছানার পরিবর্তন হলে গেবলসে রাত কাটানোর একঘেয়েমি কাটবে।

তুমি বলেছিলে সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে পেয়েছ। কিন্তু সেটা কি বলনি, সেটা জানতেই এখানে এসেছিলাম।

আচ্ছা, ভিতরে ঢুকলে কি করে?

আমি–আমি একটা জানলা খোলা দেখতে পাই।

সেটা আমার গাফিলতির জন্য হয়েছে। দেখ, শরীরটা ভাল লাগছেনা। তুমি কি লক্ষ্মী মেয়ের মত সাইকেলে চেপে এখন চলে যাবে? আজ সকালে একটু নিরিবিলিতে বিশ্রাম চাই।

চেস, একটু শোন। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। যে লোকটা ফোন করেছিল…সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সে আমাদের ব্ল্যাকমেল করতে চায়।

হ্যাঁ, আমি ব্যাপারটা জানি। ঠিক আছে, এ নিয়ে কথা বলব। কিন্তু এখন একটু কফি চাই। তুমি বাথরুমে গিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে নাও। তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি নর্দমায় ঘুমিয়েছিলে। কফি নিয়ে আসি, পরে কথা হবে।

কফি তৈরি করতে রান্নাঘরে গেলাম, লুসিলি বাথরুমে গেল।

সে বাথরুম থেকে সবে বেরিয়েছে, আমি টেবিলের উপর কফি, কমলালেবুর রস ও টোস্ট রাখলাম। অনেক মেয়েরই যেমন পুরুষের ড্রেসিং গাউন পরার আগ্রহ থাকে তেমনি সেও আমার গাউনের হাত দুটো গুটিয়ে পরেছে, তাকে সুন্দর ও লোভনীয় দেখাচ্ছিল।

বসে কফি খাও, কোন আলোচনা এখন নয়, কথা বলার অনেক সময় পাবে।

কিন্তু চেস….

বললাম তো কফি খাওয়ার সময় একটু চুপচাপ থাকতে চাই।

সে বিষণ্ণভাবে কাপে কফি ঢালল।

পরিবেশটা ভারী সুন্দর। যদি আমার কোন সমস্যা না থাকত, যদি আইকেন মারা যেতেন। ও লুসিলি আমাকে বিয়ে করত, তবে আগামী কুড়ি বছরের এমনিভাবে দুজনে কফি খাওয়ার সুন্দর ছবি কল্পনা করতে ভাল লাগল।

দুজনে নিঃশব্দে কফি খাচ্ছিলাম। কফি খাওয়া শেষ হলে সিগারেটের বাক্সটা তার দিকে ঠেলে দিলাম। সিগারেট ধরিয়ে আমি ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লাম। কিছুটা সুস্থ বোধ হল। এবার শোনা যাক।

ঠিক আছে, বল কি বলতে চাও। তোমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা হচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ, কাল সন্ধ্যায় এসেছিল। আমি তখন সাঁতার কাটছিলাম। জল থেকে উঠে আসার সময় হঠাৎ সে সামনে এসে দাঁড়াল।

তোমাকে বিকিনি পরে যে অবস্থায় একদিন দেখেছিলাম। আমার সন্দেহ, সেই অবস্থায় কেউ তোমাকে দেখলে যে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবে। লোকটাকে তোমার পছন্দ হয়েছে? মেয়ে দেখলে অনেকে যেমন পাগলের মত ভুল বকে আমার মনে হচ্ছে লোকটা সেই ধরনের।

সত্যি? জঘন্য, বোধহয় লোকটা টাকা চেয়েছিল সেইজন্য। সে যদি তোমাকে জল থেকে বেরিয়ে এসে ডিনারে যেতে বলত তবে তোমার তাকে পছন্দ হত।

চেস! তুমি কি পাগলের মত বকা বন্ধ করবে? লোকটা তিরিশ হাজার ডলার দাবী করেছে। তার মতে, তুমি ও আমি ঐ টাকাটা দিতে পারি।

জানি। আমার কাছেও সে একই প্রস্তাব করেছিল। আমাকে এক সপ্তাহ সময় দিয়েছে। তোমার কি মনে হয় তিরিশ হাজার ডলার জোগাড় করতে পারবে?

কোনমতেই সম্ভব নয়।

 তুমি কি পরিমাণ জোগাড় করতে পারবে?

জানি না। আমার একটা হীরার আংটি আছে। এইটিই আমার সম্বল। আমাদের বিয়ের আগে রোজার আমাকে দিয়েছিল, জানি না এর দাম কত হবে। ইচ্ছা করলে তুমি এটা বিক্রি করতে পার।

একবার দেখতে দাও।

 সে আমার দিকে চেয়ে থেকে পরে আঙুল থেকে আংটি খুলে আমার হাতে তুলে দিল।

ইজিচেয়ারের পাশটা দেখিয়ে বললাম, এখানে এসে বস।

সে হাতদুটো কোলের উপর রেখে বসল।

হীরার টুকরোটা মন্দ নয়। তবে এমন কিছু লোভনীয় নয় যে ব্যবসায়ীরা কেনার জন্য হুমকি খেয়ে পড়বে।

আমার ধারণা পাঁচশো ডলার পেতে পার। অবশ্য তুমি যদি তাকে বল যে তোমার মত অনাহারে আছে এবং তুমি খাদ্যের অভাবে মরতে বসেছ, এবং যদি সে বিশ্বাস করে। ঠিক আছে আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের এখন উনত্রিশ হাজার পাঁচশো ডলার দরকার।

চেস, আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছ কেন? আমি কি করেছি? আমাদের ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করা হচ্ছে তাই তোমাকে সাবধান করতে চাইছি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করছনা, বরং আমার উপর চটে যাচ্ছ। এটা আমার দোষ নয়।

গত রাত আমার ভয়ানক ভাবে কেটেছে। তোমার সমস্যার ব্যাপারে আমার এখনই কোন আগ্রহ নেই, লুসিলি। বর্তমানে মাথা ঘামাবার মত অন্য অনেক কিছু আছে।

কিন্তু এসব তোমার নিজেরও সমস্যা। কেমন করে টাকা জোগাড় করবে?

হ্যামলেটও একদিন একই প্রশ্ন করেছিল। তোমার নিজের এ ব্যাপারে কোন মতামত আছে

হ্যাঁ, এর বেশির ভাগটা তুমি নিজেই দিতে পার, পার না?

তুমি বলেছিলে না তোমার বিশ হাজার ডলার আছে?

লুসিলি সামনে ঝুঁকে বসেছিল, তার চোখে ভয় ও উদ্বেগ।

তোমার স্বামীকে ব্যবসায়ে এই টাকাটা দিতে হবে। তার বদলে অসকারকে এই অর্থ দিলে তিনি রাগ করবেন।

চেস! ব্যাপারটা তুমি সিরিয়াসলি নিচ্ছ না! কি হয়েছে বলত? এই লোকটা বলল যে সে রোজারকে গিয়ে বলবে। আমরা সমুদ্রের তীরে প্রেম করছিলাম এবং পুলিশকে গিয়ে বলবে যে পুলিশের লোকটাকে আমি চাপা দিয়েছি। তুমি যখন গাড়ির নম্বর প্লেটটা পাল্টাচ্ছিলে তখন সে একটা ছবি তুলে নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমি যতটা জড়িত, তুমিও ততটা। এখন বল আমরা কি করব?

আমরা চাই না যে এ ব্যাপারে আমাদের সর্বনাশ ঘনিয়ে আসুক। এইটিই হচ্ছে প্রথম কথা দু নম্বর, অসকারকে এক পয়সাও দেব না, আর তিন নম্বর হচ্ছে কেউ আমাদের দেখে ফেলার আগে তুমি এখান থেকে চলে যাও।

সে শক্ত হয়ে উঠল।

তুমি টাকা দেবেনা? তোমাকে অবশ্যই দিতে হবে। সে পুলিশের কাছে যাবে। সে রোজারকে গিয়ে বলবে…তোমাকে দিতেই হবে।

এ ব্যাপারে কোন অবশ্য চলে না। সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত আমাদের সময় আছে, তার মানে ছ-দিন। রস যাতে জোর করে টাকা আদায় করতে না পারে সেজন্য তাকে নিরঙ করার উপায় যদি এ কদিনে না পাই। তবে খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। এ ধরনের লোকের একটা অতীত থাকে শহর থেকে চলে যাওয়ার তার যথেষ্ট আগ্রহ। তার অতীত ও কেন শহর ছেড়ে চলে যেতে চাইছে জানার চেষ্টা করছি। যতক্ষণ না বুঝতে পারছি যে তাকে টাকা দেওয়া উচিত তার আগে তাকে এক পয়সাও দিচ্ছি না।

যদি সে জানতে পারে যে তুমি তার অতীত জানার চেষ্টা করছ, সে সেটা বরদাস্ত নাও করতে পারে। সে তখন পুলিশের কাছে যেতে পারে…

সে যাবে না। তুমি কি এখন লক্ষ্মী মেয়ের মত জামাকাপড় পরে বাড়ি যাবে? আমার অনেক কাজ, তুমি থাকায় বাধা পড়ছে।

সত্যিই কি তুমি সিরিয়াস নও? অযথা তাকে চটাতে যাচ্ছ। সে টাকা তুলে নেবে।

সে পারবে না। সে বোকা নয়। সে নিজেও জানে যে তিরিশ হাজার ডলার তার পক্ষে আশাতীত। এখন তুমি কি বাড়ি যাবে?

সে অনিচ্ছা সত্ত্বে উঠে দাঁড়াল।

চেস, তোমার কি মনে হয় না যে তার পাওনা মিটিয়ে দেওয়াই ভাল। চালাক হবার চেষ্টা করতে গেলে দুজনকেই জেল খাটতে হবে।

হেসে বললাম, এসব চিন্তা আমার হাতে ছেড়ে তুমি বিশ্রাম নাও। যথেষ্ট সময় আছে, এমন কি ভাগ্য ভালর দিকেও মোড় নিতে পারে।

আমার এটা পছন্দ হচ্ছে না, তার পাওনা মিটিয়ে তার হাত থেকে মুক্তি পাওয়াই ভাল।

তোমার পক্ষে ভাবা স্বাভাবিক কারণ টাকাটা তোমার নয়। লোকটাকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে তোমার এত আগ্রহ থাকলে তোমার স্বামীর কাছে তিরিশ হাজার ডলার ধার চাও না কেন? অবশ্য তিনি দেবেন এই আশা খুবই কম।

সে রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টেলিফোন গাইডের পাতা উল্টে আর পৃষ্ঠায় এলাম। বিচ বুলেভার্দে বেলে–ভিউতে একজন অসকার রসের নাম পেলাম। পাড়াটা শহরের সবচেয়ে অভিজাত অঞ্চল না হলেও অনেকটা আমার পাড়ার মত।

কৌতূহল বশত আর্ট গ্যালগানোর নাম আছে কিনা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পেলাম না।

বইটা নামিয়ে আর এক কাপ কফি ঢালোম। মাথাটা আবার ব্যথা করছিল তিনটে অ্যাসপিরিন অল্প গরম কফির সঙ্গে খেয়ে নিলাম।

ঘটনাগুলো ভাবছিলাম, মিনিট দশেক পরে লুসিলি আমার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। হলদে লেবু রঙের স্ন্যাক্স ও সাদা জামায় তাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। তার ডান হাতে সাদা কাগজে মোড়া একটা হ্যারল্ডব্যাগ।

সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, চেস, এ ব্যাপারে আমাদের বাস্তব দৃষ্টি নেওয়া উচিত। আমি ভাবছিলাম….

আর বলতে হবে না, তুমি ঠিক করেছ। আমাদের উভয়ের মঙ্গলের জন্য। আমার প্রতিটি পয়সা লোকটার হাতে তুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু তুমি জান না, ব্ল্যাকমেলারকে একবার পয়সা দিলে সে বার বার আসে। রস আনন্দের সঙ্গে সমস্ত টাকা নেবে, সম্ভবত বছর খানেক চুপচাপ থাকবে। আমরা যখন ভাবব সব ঠিক হয়ে গেছে তখন হঠাৎ সে এসে হাজির হবে এবং কামড় বসাবে। এটা আমার টাকা, লুসিলি। আমার সমস্ত টাকা তখনই খোয়াবো, যখন বুঝব এছাড়া কোন গতি নেই।

সে পায়চারি করতে করতে বলল, তাহলে আমার মনে হয় রোজারকে সব ঘটনা বলাই ভাল। সে ক্ষেত্রে আমার জেলে যাওয়ার বদলে সে টাকাটা দিতে হয়তো রাজি হবে।

এ ধরনের কথা তো আগেও অনেকবার হয়েছে। মনে হয় আমার রেগে যাওয়ার আগেই তোমার এখান থেকে চলে যাওয়া ভাল।

সে চোখ লাল করে বলল, এই টাকা আমাদের দিতেই হবে। যদি তুমি না দাও তবে রোজারকে বলতেই হবে।

আগের বারও এই অভিনয় করেছিলে, শেষে বলেছিলে যে তাকে কোনদিন বলবে না এবং আমার সামনে তার নাম উচ্চারণও করবে না। ঠিক আছে, যদি বলার আগ্রহ এত বেশি থাকে, তবে চল দুজনে একসঙ্গে যাওয়া যাক। অন্তত জানতে পারব যে প্রকৃত ঘটনা তাকে বলা হয়েছে।

তোমাকে ঘেন্না হচ্ছে, তীক্ষ্ণস্বরে চীৎকার করে উঠে হ্যারল্ডব্যাগ দিয়ে জোরে আমার মুখে আঘাত করল।

সময় মত হাত তুলে আড়াল করতে আঘাতটা আমার হাতের কব্জিতে এসে পড়ল। তার হাত থেকে হ্যারল্ডব্যাগটা ছিটকে দেয়ালে লেগে ফেটে গেল, ভিতরের সমস্ত জিনিস ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল।

একটা জিনিসে চোখ পড়তেই, বিস্ময়ে চিৎকার করে বললাম, আচ্ছা এটা কি?

সে ছোঁ মেরে জিনিসটা নিয়ে শার্টের নিচে লুকিয়ে রাখল। ভীত ও বিস্মিত চোখ দুটো বড় বড় করে পিছন দিকে সরে গেল।

সে দরজার ছিটকিনি খোলার জন্য ছুটল, আমিও তার দিকে ছুটে গেলাম।

 হলঘরের ভিতরে তাকে ধরে ফেললাম। সে নিজেকে মুক্ত করে সদর দরজা খোলার চেষ্টা করল। তাকে চেপে ধরে পাঁজাকোলা করলাম। সে হাত পা ছুঁড়ে আমাকে কিল লাথি মেরে কামড়াবার চেষ্টা করল। গায়ের জোর অদ্ভুত, হাত দুটো চেপে ধরার আগেই কয়েকটা ঘুষি মত পড়তে পাগলের মত হয়ে উঠলাম।

তাকে পিছন থেকে চেপে ধরে বল প্রয়োগ করলাম। সে চিৎকার করল। তাকে জোর করে হাঁটুর উপর বসাতে বাধ্য করলাম।

সে পাক খেয়ে নিজেকে মুক্ত করে আবার সদর দরজার দিকে ছুটল। আবার তাকে ধরে ফেললাম। সে মোচড় খেয়ে আমাকে লক্ষ্য করে লাথি ছুঁড়ল। আমি প্রস্তুত ছিলাম, লাথিটা এড়িয়ে গেলাম।

তার মাথা দিয়ে আমার নাকে আঘাত করার চেষ্টা করল, একটা হাত মুক্ত করে আমার ঘাড়ে নখ বসিয়ে দিল।

নখগুলো কেটে বসে যেতেই আমার রাগ বেড়ে গেল। অনেকটা যেন এক বন বিড়াল ধরার চেষ্টা করলাম। সে হাঁটু দুটো উপরে তুলে আমার বুকে জোরে আঘাত করল এবং নিজেকে মুক্ত করে ছুটে পালাতে গিয়ে জিনিসটা মাটিতে পড়ে গেল।

জিনিসটা তুলে দেখলাম গাড়ি চালানোর পারমিট।

ভাল ভাবে দেখলাম লুসিলির নামে পারমিট, দু বছর আগে দেওয়া হয়েছিল।

তার দিকে দেখলাম।

সে নড়ল না। এক কোনে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করল।