দিন-পনের পরের কথা।
ইতিমধ্যে সুশান্ত আবার কাজে জয়েন করেছিল। প্রাত্যহিক ডিউটি যেমন দেয় দিতে আরম্ভ করেছিল। অবনী সাহা কয়েকদিন আগে সুশান্তর ওখানে এসে বলে গিয়েছিলেন, আপনি যেমন ডিউটি করছিলেন করতে পারেন।
শকুন্তলা-তার স্ত্রী—বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি।
তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, কথাটা সত্যিই যেন কেমন একটু বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল তাকে।
সেই সঙ্গে যে মনের মধ্যে একটা আশঙ্কাও দানা বেঁধে ওঠেনি তাও নয়।
সর্বক্ষণ কেমন যেন একটা ভয়-ভয়।
এমন সময় অবনী সাহা এসে ঐ কথা বললেন।
মনে হল অবনী সাহার কথায় যেন সুশান্তর মনের উপর থেকে একটা পাষাণভার নেমে যায়।
এবং বোধ হয় আরও বেশী করে নিশ্চিত হবার জন্যই প্রশ্ন করে, মিঃ সাহা।
কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ, মানে–এখনো কি আপনাদের ধারণা—
কী?
মানে বলছিলাম, আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেনি, তাকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে কেউ হত্যা করেছে!
আরে মশাই, যত সব উদ্ভট idea মিঃ রায়ের-plain simplecase of suicide, অথচ তিনি বলতে চান তাকে হত্যা করা হয়েছে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে।
কিন্তু তিনি যে কি বলেছিলেন–
কী?
আপনাদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নাকি—
হ্যাঁ, ছেড়ে দিন তো। ডাক্তারগুলোও হয়েছে তেমনি!
সত্যি মশাই, সুশান্ত বলে, সেদিন তো কিরীটীবাবুর মুখে ঐ কথা শুনে আমি অবাক। বলেন কি! তাছাড়া মিত্ৰাণী তাহলে ব্যাপারটা কি জানতে পারত না? সে তত জেগেই ছিল বলতে গেলে সে-রাত্রে!
অবনী সাহা অতঃপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার ছেলে রাহুল কেমন আছে?
ভাল-ভাল হয়ে গেছে।
আর সেরকম ভয়টয় পায় না তো?
না।
আচ্ছা তাহলে আমি উঠি সুশাবাবু।
বসুন বসুন-চা খেয়ে যান।
না, এখন আর চা খাব না।
না না, বসুন নাচা না খান, কফি কিংবা ওভালটিন—
না, কিছু প্রয়োজন নেই। মৃদু হেসে অবনী সাহা বলেন, আমি তাহলে উঠি।
অবনী উঠে পড়েন।
সুশান্ত একটা সিগারেট ধরায়। এবং ধূমপান করতে করতে একসময় সুশান্ত এসে জানালাটার সামনে দাঁড়ায়।
বাইরে আলোঝলমল প্রকৃতি।
গেটের সামনে এই কোয়ার্টারে এসে শকুন্তলা শখ করে একটা রক্তকরবীর গাছ এনে পুতেছিল।
হঠাৎ নজরে পড়ল সুশান্তর, গাছটা একেবারে ফুলে ফুলে যেন ছেয়ে গিয়েছে। থোকা থোকা লাল ফুল। কেবল রক্তকরবীই নয়। শকুন্তলার বরাবর ফুলের শখ।
সে আবার নানা প্রকারের ফুলগাছ এনে কোয়ার্টারের সামনে যে ছোট জমিটুকু-সেই জমিতে পুঁতেছিল।
গরীবের ঘর থেকে নিজে পছন্দ করে শকুন্তলাকে বিয়ে করে এনেছিল সুশান্ত।
তখনও তার চাকরি বেশী দিন হয়নি। সামান্য দুবছর মাত্র হয়েছে। নিজের আলাদা ফ্যামিলি-কোয়ার্টারও পায়নি। কোয়ার্টার তো মাত্র বছর-তিনেক হল পেয়েছে সুশান্ত।
কোয়ার্টার পাওয়ার আগে শকুন্তলা তো তার মায়ের কাছেই ছিল কৃষ্ণনগরে। যাতায়াত করত সুশান্ত সেখানে।
শাশুড়ীরও ঐ একমাত্র মেয়ে।
কী আনন্দ কোয়ার্টারে এসে শকুন্তলার! সুখের ছোট্ট সংসারটি। স্বামী-স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে রাহুল।
আনন্দের-শান্তির সংসার।
কিন্তু দেড়টা বছরও গেল না, অনেকদিন পরে দ্বিতীয়বার সন্তান হতে গিয়ে একটি মৃত সন্তান প্রসব করে শকুন্তলা অসুস্থ হয়ে পড়ল।
শকুন্তলার শরীরটা যেন ভেঙে গেল। রেলের ডাক্তারকে দেখানো হল। তিনি বললেন স্প্রু। ক্রমশঃ শকুন্তলা রোগে রোগে জীর্ণ হয়ে যেন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল।
সেই সময়-হ্যাঁ, সুশান্তর মনে পড়েছে, রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে শকুন্তলাও যেমন ক্রমশঃ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সুশান্তও যেন ক্রমশঃ তেমনি বিরক্ত হয়ে পড়েছিল।
রোগ রোগ, আর লোগ। কেবল রোগের আর ঔষধের ফিরিস্তি।
সেই সময়ই একটু একটু করে সুশান্ত যেন সংসার থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করে। কাজকর্মের ফাকে ফাকে যেটুকু সময় পেত, বাড়িতে আসতে মন যেন কিছুতেই চাইত না। হয় বন্ধু বান্ধবের বাসায়, না হয় ক্লাবে আডড়া দিয়ে বাইরে বাইরেই কাটিয়ে আসত। ঐসময় বাপ সুকান্তও যেন ক্রমশঃ অথর্ব হয়ে পড়তে থাকেন।
বরাবরই হাঁপানী রোগ ছিল।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই হাঁপানী রোগটা যেন আরও বেশী করে সুকান্তকে আক্রমণ করে। তিনি একপ্রকার শয্যাশায়ীই হয়ে পড়েন।
দুধারে দুজন রোগী—এক ঘরে স্ত্রী, অন্য ঘরে বাপ সুকান্ত। সংসারটা ক্রমশঃ অচল হয়ে উঠতে থাকে। সুশান্তর মন-মেজাজ ক্রমশঃ বিশ্রী হয়ে উঠতে থাকে যেন। ভাল লাগে না—কিছু তার ভাল লাগে না। হাতের সিগারেটটা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, সেটা ছুঁড়ে জানালার বাইরে ফেলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সুশান্ত।
ঘুরে দাঁড়াতেই দেওয়ালে টাঙানো শকুন্তলার ফটোটার ওপরে নজর পড়ল। বিয়ের পরে ভোলা শকুন্তলার ফটো। যৌবনলাবণ্যে যেন ঢলঢল করছে।
শকুন্তলা হাসছে।
মিত্ৰাণী বোধ হয় রাঁধছে, বাতাসে চমৎকার মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে।
মিত্ৰাণী!
ও-ঘর থেকে সুকান্তর কাশির শব্দ আসছে। সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরের দরজাটা খোলা। মিত্ৰাণী রান্নাঘরে রাঁধছে।
মিতা!
মিত্ৰাণী সুশান্তর ডাকে সাড়া দেয়, ডাকছেন জামাইবাবু?
হ্যাঁ, আজ অফিসে যাব। সুশান্ত বলে।
মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল আঁচলে হাত মুছতে মুছতে।
অফিসে যাবেন?
হ্যাঁ।
অবনীবাবু এসেছিলেন—
অবনীবাবু!
হ্যাঁ, থানার O.C., বলে গেলেন আমি ডিউটিতে জয়েন করতে পারি।
জয়েন করবেন?
হ্যাঁ-আর বসে থাকব কেন? মিছিমিছি কটা দিন বসে রইলাম। এই কটা দিনের মাইনে শুধু শুধু কাটা গেল। রাহুল বুঝি স্কুলে গিয়েছে?
হ্যাঁ।
তোমার রান্নার আর কত দেরি?
বেশী দেরি নেই। আপনি স্নান করে নিতে-নিতেই সব হয়ে যাবে।
বেশ, আমি স্নানটা করে নিই তাহলে।
সুশান্ত চলে গেল ঘরের দিকে।
শকুন্তলার ঘরটা আজও তালা দেওয়া। পুলিশই তালা দিয়ে গিয়েছে। তালা-দেওয়া ঘরটার দিকে তাকিয়ে ক্ষণেকের জন্য দাঁড়ায় সুশান্ত।
ঘরের দরজাটা সর্বদা খোলাই থাকত। এবং দরজা-বরাবর এমন ভাবে শকুন্তলার খাটটা পাতা ছিল যে খাটে শুয়ে-শুয়েই যেন সব কিছু দেখতে পেত।
ফিরে তাকাল আবার রান্নাঘরের দিকে সুশান্ত এবং তাকাতেই মিত্ৰাণীর সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল।
মিত্ৰাণী তখনও রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরিশ্রমে ও আগুনের তাপে কপালে কিছু কিছু ঘাম জমে উঠেছে-যেন কয়েকটি টলটলে মুক্তা।
চোখাচোখি হতেই সুশান্তর দিক থেকে মিত্ৰাণী তার চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল।
সুশান্ত আর দাঁড়াল না। ঘরের মধ্যে দিয়ে ঢুকল। মিত্ৰাণী তাকাল সামনের দিকে।
শকুন্তলার ঘরের দরজায় তালাটা ঝুলছে।
.
জামা-কাপড় পরে খেতে বসে সুশান্ত হঠাৎ একসময় বলে, উঃ, এই কটা দিন যেন ভাল করে নিঃশ্বাস নিতে পারিনি।
মিত্রাণী কোন জবাব দেয় না।
সে মাংসের বাটিটা নিঃশব্দে সুশান্তর পাতের সামনে নামিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।
সুশান্ত ডাকে, মিত্রা!
মিত্ৰাণী সাড়া দেয় রান্নাঘর থেকেই, আর চারটি ভাত দেব?
না না, শোন—এদিকে এস। সুশান্ত ডাকে।
মিত্ৰাণী রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এল।
কিছু বলছেন?
হ্যাঁ, বলছিলাম আজ সন্ধ্যার শোতে সিনেমায় যাবে?
সিনেমায়! মিত্ৰাণী সুশান্তর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ, যাবে তো বল, টিকিট কেটে নিয়ে আসব।
না।
যাবে না?
না।
কেন, চল না—ভাল বই একটা হচ্ছে!
না। পূর্ববৎ সংক্ষিপ্ত জবাব।
মিত্ৰাণী আর দাঁড়াল না।
নিঃশব্দে রান্নাঘরের মধ্যে গিয়ে আবার ঢুকল।
সুকান্ত কাশছে।
আজ কদিন থেকে সুকান্তর কাশিটা যেন বেড়েছে।
সর্বক্ষণই কাশছে ঘং ঘং করে একটা বিচিত্র ধাতব শব্দ তুলে।
মনে হয় যেন বড় কষ্ট হচ্ছে ওঁর। রান্নাঘরে বসে বসে মিত্ৰাণী ভারতে থাকে।
সুশান্তর কাছে হঠাৎ আহার্য যেন কেমন বিস্বাদ ঠেকে। উঠে পড়ে ভাতের থালা ছেড়ে। হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপড় পরে দীর্ঘ পনের দিন পরে সুশান্ত আবার বাড়ি থেকে বেরুল।
অফিসে ব্যাপারটা এখনও স্পষ্টাস্পষ্টি জানে না কেউ। জানে কেবল শকুন্তলা তার স্ত্রী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। দু-চারজন বন্ধু এসে সহানুভূতিও জানিয়ে গিয়েছে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে সুশান্ত হনহন করে এগিয়ে চলে।
আগে কোনদিন সে সিগারেট খায়নি। বাড়িতে এই কদিন বন্দী থাকতে থাকতে সিগারেট খেতে অভ্যাস করেছে সে। এককালে অবিশ্যি সিগারেট খেত, বছর দুই আগে অভ্যাসটা ত্যাগ করে ছিল। কিন্তু এখনও ঠিক ব্যাপারটা ভাল করে রপ্ত করতে পারেনি, নতুন করে আবার খেতে শুরু করে।
দু-একটা টান জোরে দিলেই কাশি আসে। মুখটা তেতো লাগে কেমন যেন।
কাশতে শুরু করে সুশান্ত এবং বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত আধখানা সিগারেট ছুঁড়ে পথের ধারে ফেলে দেয়।
বিশ্রী তেতো হয়ে গেল মুখটা। একটা মিঠে পান খেতে হবে রাস্তার ধারে পানের দোকান। থেকে। কি করে যে মানুষ ধূমপান করে!
হনহন করে হাঁটতে শুরু করে সুশান্ত।
সুশান্ত লক্ষ্য করে না, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত একটি যুবক-এতক্ষণ যে তার কোয়ার্টারের অদূরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল, সে তাকে দূর থেকে অনুসরণ করে চলেছে।
সুশান্ত বড় রাস্তায় এসে একটা পানের দোকান থেকে একখিলি মিঠে পান নিয়ে খেলে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে বড় রাস্তায় এসে বাস ধরল।
সেই লোকটিও ঐ একই বাসে উঠে পড়ে, ভিড়ের মধ্যে নিজেকে গোপন করে রাখে।
বাসটা যাত্রীতে একেবারে ভর্তি। অফিস-টাইম উৎরে গেলেও বাসে ভিড় যথেষ্ট তখনও। বাসটা শিয়ালদার দিকে চলেছে।
.
সুশান্ত বের হয়ে যেতে মিত্ৰাণী সদরটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।
বেশী বেলা হয়নি। মাত্র সোয়া এগারোটা।
সুকান্ত বড্ড বেশী কাশছে আজ।
কী যে হয়েছে সুকান্তর, সে তার ঘরের সামনে গেলেই ভুকুটি করে তার দিকে তাকায়। যেন মনে হয় তাকে একেবারে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেবে।
সুকান্তর সেই দৃষ্টি যেন মিত্ৰাণীর সর্বাঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেবে।
তবু মিত্ৰাণী রান্নাঘরে ঢুকে এক কাপ চা তৈরী করল বেশী দুধ চিনি ও আদার রস দিয়ে, তারপর চায়ের কাপটা হাতে সুকান্তর ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
একটু যেন ইতস্ততঃ করল, তারপর ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকল। সুকান্ত চিরদিনই একটু চায়ের ভক্ত। দিনে-রাত্রে আট-দশ বার চা পান করত। এখানে এসে প্রথম প্রথম সে চা করেও দিয়েছে বার বার সুকান্তকে। কথাটা শকুন্তলাই তাকে বলে দিয়েছিল।
বাবা একটু চা খেতে ভালবাসেন, ওঁকে মাঝে মাঝে চা করে দিস।
প্রথম দিন চা করে নিয়ে যাবার পর এক দ্বিপ্রহরে সুকান্ত কি সই না হয়েছিল। বলেছিল, কী-চা?
হ্যাঁ।
আনন্দে সুকান্তর চোখের তারা দুটো চক্ করে ওঠে। বলে, দাও।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে সুকান্ত বলেছিল, বাঃ, চায়ের হাতটা তো তোমার চমৎকার!
মিত্ৰাণী চুপ করে ছিল।
কিন্তু কেমন করে জানলে? সুকান্ত চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্নটা করে।
কী?
আমি চা একটু বেশী ভালবাসি।
দিদি বলেছে।
বৌমা! সত্যি বৌমার মত আর মেয়ে হয় না। কী যে অসুখ ধরেছে ওকে! একটু যত্নআত্তি করো।
মিত্রাণী কোন জবাব দেয়নি সে কথার।
তারপর দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু ফুরসৎ পেলেই সুকান্তকে চা করে দিয়ে এসেছে।
সুকান্ত খুশি হয়েছে।
মধ্যে মধ্যে সুকান্তও ডেকেছে, মিতু মা!
যাই তাওইমশাই–
মিত্ৰাণী হয়তো কাজ করতে করতে জবাব দিয়েছে এবং বুঝতে পেরেছে কেন সুকান্ত ডাকছে।
তাড়াতাড়ি এক কাপ চা করে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে।
চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে সুকান্ত বলেছে, কেমন করে বুঝলে মা যে আমার চায়ের পিপাসা পেয়েছে?
মিত্ৰাণী কোন জবাব দেয়নি।
কিন্তু ইদানীং কয়েক মাস ধরে যেন সুকান্ত মিত্ৰাণীকে সহ্যই করতে পারছিল না।
এমন কি চা দিয়ে গেলেও বিরক্ত হত। মুখটা ভার-ভার এবং মিত্ৰাণীর দিকে না তাকিয়েই বলেছে, রেখে যাও।
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি।
তখনও শকুন্তলা একটু-আধটু হাঁটা-চলা করতে পারত। মধ্যে মধ্যে শ্বশুরের ঘরে যেত শ্বশুরের খবরাখবর নিতে।
বাবা, কেমন আছেন?
আমার কথা ছেড়ে দাও, তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠ।
মিত্ৰাণী জানে, বুঝতে পেরেছিল, শকুন্তলাই সুকান্তর মনটা বিষিয়ে দিয়েছিল। তার প্রতি, যার ফলে ইদানীং সুকান্ত মিত্ৰাণীর প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছিল।
মিত্রাণী তাই বুঝি সুকার ঘরে যাওয়াটা ক্রমশঃ কমিয়ে দিয়েছিল।
দিদিও তার প্রতি বিরক্ত, সুকান্তও বিরক্ত। ভাল লাগত না মিত্ৰাণীর ব্যাপারটা।
মধ্যে মধ্যে মনে হয়েছে, দিদিকে সে বলবে মালদহে তাকে আবার রেখে আসতে। একদিন কথাটা বলেও ছিল।
দিদি!
কি?
একটা কথা ভাবছিলাম—
ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকায় শকুন্তলা বোনের দিকে, কী কথা?
আমি মালদহেই আবার ফিরে যাই।
অকস্মাৎ যেন ক্ষেপে উঠেছিল সে কথায় শকুন্তলা।
বলেছিল, চোখের আড়াল হতে পারলে আরও সুবিধা হয়, না? জানি-তোমার ঐ ভগ্নীপতিটির পরামর্শ, তাই না?
মিত্ৰাণী চুপ করে ছিল।
শকুন্তলা বলেছিল, কিন্তু তা হবে না বলে দিও তোমার জামাইবাবুটিকে, সর্বনাশ যা ঘটতে চলেছে আমার চোখের সামনেই ঘটুক। তোমরা যে আমার আড়ালে গিয়ে তোমাদের ইচ্ছামত বেলেল্লাপনা করবে তা আমি হতে দেব না বলে তাকে। ঘাসজল খাই না, ঐ ছল-চাতুরীটুকু বোঝবার মত আমার বুদ্ধি আছে।
বলতে বলতে ক্ষোভে আক্রোশে কেঁদে ফেলেছিল শকুলা, কেন, সবই তো চলেছে, বেলেল্লাপনার তো কোন কমতিই নেই, তবে আবার চোখের আড়াল হতে চাওয়া কেন?
বলাই বাহুল্য, অতঃপর মিত্ৰাণী আর কোনদিন ওকথা তোলেনি। কিন্তু সত্যিই যেন তার ভাল লাগছিল না। চলেও হয়ত যেত। কিন্তু পারেনি ঐ রাহুল আর ভগ্নীপতি সুশার জন্যে।
সুশান্ত বার বার বলেছে, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে, আমি জানি মিত্রা–
না, কষ্ট কি।
সত্যিই কুন্তলা যেন ক্রমশঃ ইনকরিজিবিল হয়ে উঠছে—
অসুস্থ মানুষ—
কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে, মিত্রা।
সব কথাই কদিন ধরে নতুন করে যেন বার বার মনে পড়ছে মিত্ৰাণীর।
শকুন্তলা যেন মরেনি।
তার শরীরী উপস্থিতিটাই শুধু চোখের সামনে নেই কিন্তু তবু সে যেন আছে—সর্বক্ষণ যেন তার বিদেহী একটা উপস্থিতি মিত্ৰাণী অনুভর করে এ বাড়ির সর্বত্র।
শকুন্তলার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকালেই যেন মনে হয়–শকুন্তলা মরেনি—ঐ ঘরের মধ্যেই এখনও আছে।
দরজাটা খুললেই দেখা যাবে—এই দিকে তাকিয়েই সে বসে আছে এখনও।
দুচোখের দৃষ্টিতে ঘৃণা আক্রোশ আর সন্দেহ।
চা তৈরী করতে করতেও ঐ কথাই ভাবছিল আজ মিত্ৰাণী।