দিনের বেলা এখানে একটু একটু গরম পড়লেও রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে। উঠোনের একপাশে কিছু চ্যালা কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালা হয়েছে। সেই আগুন ঘিরে বসে আছে ওরা কয়েকজন। বিল্টুর একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে। শিবু সর্দার। কাকাবাবু উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মাটিতে। এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি। কালো চশমা পরা লোকটা অন্ধকারেও চশমা খোলেনি। বোধহয় তার চোখের অসুখ আছে। সে-ই বড়বাবু। আর তার পাশের লোকটির নাম বলরাম। তার চেহারাটা ভীমের মতো। মুখ ভরতি দাড়ি-গোঁফ, কিন্তু মাথাটা ন্যাড়া।
চায়ের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে বড়বাবু জিজ্ঞেস করল, আরে শিবু, সত্যি করে বল, তিলকরাম কোথায় গিয়েছে?
শিবু সর্দার বলল, গাঁও মে গিয়া বড়াসাব।
বড়বাবু ভেঙিয়ে বলল, গাঁও মে গিয়া? কাঁহে গিয়া। নাকি একেবারেই কেটে পড়েছে?
শিবু বলল, সে তো হামি জানি না বড়াসাব।
বড়বাবু বলল, আমার হুকুম, তোমরা দুজনে কেউ এক মিনিটের জন্যও বাইরে যেতে পারবে না। সর্বক্ষণ পাহারা দেবে। এই খোঁড়া লোকটা যদি আজ ছেলেটাকে নিয়ে পালাত? এই ডেরার খবর জেনে যেত! বলরাম আর আমি একেবারে ঠিক সময়ে এসে পড়েছি ভাগ্যিস!
বলরাম বলল, রায়চৌধুরীকে এবার বাগে পাওয়া গিয়েছে। ওকে খতম করে দিতে হবে।
বড়বাবু বলল, অনেকক্ষণ নড়াচড়া করছে না, টেঁসেই গেল নাকি?
বলরাম বলল, পেটে খুব জোর আঘাত লাগলে অনেক সময় কিডনি ফিডনি ফেটে যায়, তাতে মানুষ বাঁচে না।
বড়বাবু বলল, দেখা যাক আর কিছুক্ষণ। জ্ঞান ফিরলে ওকে জেরা করে জানা যেত, ও এখানে এল কী করে? আর যদি জ্ঞান না ফেরে, তা হলেও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য রায়চৌধুরীর মাথায় গোটাচারে গুলি চালিয়ে দিতে হবে!
বলরাম বলল, তিলকরাম বোধহয় ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে। ও তো বুঝেছে, ওকে আজ শাস্তি পেতেই হবে। ওর ভুলের জন্যই তো এই গোলমালটা হল। এই ছেলেটার বদলে অন্য ছেলেটাকে গাড়িতে তুলে দিল।
বড়বাবু বলল, তুমিই বা ভাল করে দেখে নিলে না কেন?
বলরাম বলল, তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। দুটো ছেলেই একবয়সি, একইরকম চেহারা। মুখ বাঁধা ছিল বলে কথাও শুনিনি। তাই বুঝতে পারিনি। তার জন্য যদি আমায় কিছু শাস্তি দিতে চান, মাথা পেতে নেব।
বড়বাবু বলল, সেটা পরে দেখা যাবে। কালিম্পং-এর ছেলেটার জন্য কত টাকা পাওয়া যেত, তা হাতছাড়া হয়ে গেল। এখন এই ছেলেটাকে নিয়ে কী করা যায়। ফেরত দেওয়াও তো শক্ত। পুলিশ সব জেনে গিয়েছে। এই বাচ্চাটাকে পেলে ওর মুখ থেকে আমাদের খোঁজ পেয়ে যেতে পারে।
বলরাম বলল, এখন আর ফেরত দেওয়া যাবে না। ভেরি রিস্কি। ইট ইজ বেটার টু কিল হিম।
বিল্টু বলল, আই নো ইংলিশ। ইউ ওয়ান্ট টু কিল মিঃ ইঃ, অত সোজা নয়। কাকাবাবু তোমাদের এমন মারবেন।
শিবু সর্দার বিলুর একটা কান ধরে ঝাকুনি দিতে দিতে বলল, আরে যাঃ! তুমহার কাকাবাবু খতম হো চুকা!
বিল্টু বলল, তুমি আমার কান ধরেছ কেন? আমিও তোমার কান ধরব।
সে হাত তুলতেই শিবু খপ করে সেই হাতটা ধরে মুচড়ে দিল।
ব্যথা লাগলেও বিল্টু কাঁদল না। সে বলল, ইউ আর এ পাজি লোক। পাজি লোকরা হাত মুচড়ে দেয়।
বড়বাবু বিরক্ত হয়ে বলল, অ্যাই, ছেলেটাকে ঘরে বন্ধ করে রেখে দিয়ে আয় না। এখন কাজের কথা হচ্ছে।
শিবু বলল, ওকে খেতে দিয়েছি, কিছু খায়নি স্যার।
বড়বাবু বলল, এ ছেলেটার একটা ব্যবস্থা করে এখন কিছুদিনের জন্য আমাদের গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। নো অ্যাক্টিভিটি। তারপর সব চাপা পড়ে গেলে আবার অ্যাকশন শুরু করব।
বলরাম বলল, দেখুন, দেখুন স্যার, রায়চৌধুরীর হাতদুটো আগুনের মধ্যে পড়েছে, তবু লোকটা একটুও নড়ছে না! বড়বাবু বলল, এখনও জ্ঞান ফেরেনি?
বলরাম বলল, আগুনের ছ্যাকা লাগলে তো অজ্ঞান লোকেরও জ্ঞান ফিরে আসে।
বড়বাবু বলল, যদি খতম হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তো চুকেই গেল।
সত্যিই কাকাবাবুর বাঁধা হাতদুটো পড়েছে আগুনের মাঝখানে। প্রথমে দুটো হাতই কালো হয়ে গেল, তারপর পুড়তে লাগল চামড়া। পটপট করে শব্দ হতে লাগল। সকলেরই নাকে এল মড়া পোড়ার বিশ্রী গন্ধ।
বড়বাবু বলল, মনে হচ্ছে সত্যিই মরেছে লোকটা। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ওর নাকের কাছে হাত নিয়ে দ্যাখ তো বলরাম, নিশ্বাস পড়ছে কিনা। যদি এখনও নিশ্বাস পড়ে, তা হলে মাথার খুলিতে চারটে গুলি চালিয়ে দে।
বলরাম উঠে এসে পা দিয়ে ঠেলে কাকাবাবুর দেহটা উলটে দিল। উপুড় থেকে চিত হয়ে গেল। এতদিনে একবারও কাঁদেনি বিল্টু। এইবার সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আর বলতে লাগল, কাকাবাবু, কাকাবাবু! তার ক্ষুদ্র হৃদয় বুঝেছে যে, কাকাবাবু আর আেঁচে নেই।
বলরাম কাকাবাবুর শরীরটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে রাইফেলটা নামিয়ে রাখল। তারপর একটা আঙুল কাকাবাবুর নাকের কাছে নিয়ে একটুক্ষণ দেখে বলল, নাঃ, নিশ্বাস পড়ছে না। শেষ!
সঙ্গে সঙ্গে কাকাবাবু হাতদুটো দুদিকে ছড়িয়ে উঠে বসলেন! আগুনে যেমন তার হাত পুড়েছে, তেমন দড়ির বাঁধনটাও পুড়েছে! এখন খসে পড়ে গেল।
দারুণ ভয় পেয়ে গিয়ে বলরাম বলে উঠল, এ কী? ভূ-ভূ-ভূত?
কাকাবাবু বিকৃত গলায় বললেন, হ্যাঁ, আমি ভূত হয়েছি। এবার তোদের সবকটার সর্বনাশ করব।
তিনি দুহাতে বলরামের গলা টিপে ধরলেন। বলরামের অত বড় শক্তিশালী চেহারা, কিন্তু কাকাবাবুর হাতে যে এত জোর, তা সে কল্পনাই করতে পারেনি! একমাত্র ভূতের হাতেই এমন জোর থাকতে পারে। ছটফট করে সে নিজেকে ছাড়াতে পারল না। কাকাবাবু এক ঝটকায় তাকে পাশে ফেলে দিয়েই রাইফেলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। শিবু সর্দার তার রাইফেলটা তুলে ঠিক করার আগেই কাকাবাবু তার দিকে দুটো গুলি চালিয়ে দিলেন। সে হাউ হাউ করে চেঁচিয়ে উঠল। বড়বাবু কয়েক মুহূর্তের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। তারপর সে বুঝে গেল, ভূত নয়, রায়চৌধুরী এখনও বেঁচেই আছেন, আর তার হাতে রাইফেল।
সে ঝট করে বিন্দুকে তার বুকের কাছে টেনে এনে বলল, রায়চৌধুরী, তোমার রাইফেলটা ফেলে দাও। তুমি আর কোনও চালাকি করতে গেলেই আমি এ ছেলেটার কানের মধ্যে দিয়ে গুলি চালাব। আমার হাতের রিভলভারটা দ্যাখো!
কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত কটমট করে তাকিয়ে রইলেন সেই বড়বাবুর দিকে। জায়গাটায় যদি আলো থাকত, তা হলে কাকাবাবু ওই লোকটাকে হিপনোটাইজ করতে পারতেন। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে তা সম্ভব নয়। কাকাবাবুর দুহাত দিয়ে এখনও একটু একটু ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কিন্তু মুখে একটুও ব্যথার চিহ্ন নেই। বরং রাগে গনগন করছে মুখ।
তিনি কর্কশ গলায় বললেন, তুমি ওই ছেলেটাকে গুলি করে মারবে? মারো দেখি! নিতান্ত গাধা না হলে তুমি তা করবে না। তারপর তুমি বাঁচবে কী করে? সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা পাগলা কুকুরের মতো তোমার শরীর আঁঝরা করে দেব গুলি চালিয়ে!
লোকটি একটু থমকে গেল। বিড়বিড় করে আপন মনে বলল, তুমি এত সহজে মরবে, এটা ভাবাই আমার ভুল হয়েছিল। তখনই যদি গুলি চালিয়ে দিতাম!
কাকাবাবু বললেন, তখন গুলি চালাওনি, এখন তোমার প্রাণ আমার হাতে। যদি বাঁচতে চাও, ছেলেটাকে ছেড়ে দাও আর রিভলভারটা ফেলে দাও।
লোকটি বলল, ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেই তুমি আমাকে মারবে। তোমার কথায় কোনও বিশ্বাস নেই।
কাকাবাবু বললেন, আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে প্রাণে মারব না! রাজা রায়চৌধুরীর কথার দাম আছে।
লোকটি জিজ্ঞেস করল, তুমি আমাকে এখান থেকে ধরে নিয়ে যাবে?
কাকাবাবু বললেন, না, তাও নিয়ে যাব না। সে অনেক ঝামেলা। আমি শুধু বিন্দুকে নিয়ে চলে যাব।
লোকটি বলল, প্রমিস?
কাকাবাবু বললেন, প্রমিস!
লোকটি বিল্টুকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিল।
কাকাবাবু বললেন, রিভলভারটা ফেলে দাও!
সে সেটা ফেলে দিতেই কাকাবাবু সেটা তুলে নিয়ে পকেটে ভরলেন। তারপর বিন্দুকে বললেন, বিল্টু, তুই উঠোনের বাইরে গিয়ে দাঁড়া তো।
বিল্টু বলল, না, আমি তোমার সঙ্গে যাব।
কাকাবাবু বললেন, যা বলছি, কথা শোন। বাইরে দাঁড়া। রান! ওয়ান, টু, থ্রি।
বিন্দু দৌড়ে চলে গেল।
কাকাবাবু এবার লোকটিকে বললেন, তোমাকে প্রাণে মারব না কথা দিয়েছি, কিন্তু তোমাকে শাস্তি তো পেতেই হবে। ছোট ছেলেমেয়েদের চুরি করে নিয়ে তাদের প্রাণ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলে, তারা অমানুষ! তাদের ক্ষমা নেই।
কাকাবাবু সেই বড়বাবুর দুই ঊরুতে দুটি গুলি চালিয়ে দিলেন। লোকটি আর্তনাদ করে উঠল।
কাকাবাবু বললেন, পায়ে গুলি করলে কেউ মরে না। চিকিৎসা করালে সেরে উঠবে। বড়জোর খোঁড়া হয়ে থাকবে আমার মতো। আর এখন আমাকে তাড়াও করতে পারবে না।
বলরাম এর মধ্যে অনেকটা সামলে উঠেছে। কাকাবাবু তার দিকে পিছন ফিরে রয়েছেন। সে একটা জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে ছুড়ে মারল কাকাবাবুর দিকে। জ্বলন্ত কাঠটা কাকাবাবুর মাথায় লাগলে সাংঘাতিক কাণ্ড হতে পারত। কিন্তু সেটা লাগল কাকাবাবুর পিঠে!
তিনি অমনই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমিই বা বাদ যাবে কেন? তারও দুই ঊরু ফুড়ে গেল দুই গুলিতে! কাকাবাবু গায়ের কোটটা তাড়াতাড়ি খুলে ফেলে মাটিতে চাপড়ে আগুন নেভালেন। ওদের তিনজনের দু পায়ে গুলি লেগেছে। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, থাকো এইভাবে। আমি তোমাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছি।
বিল্টু উঠোনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
কাকাবাবুর এক হাতে রাইফেল, অন্য হাতটা বিল্টুর কাঁধে রেখে বললেন, চল রে বিল্টু।
বিল্টু বলল, তোমার হাত জ্বালা করছে না? কতটা পুড়েছে!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে!
ভাঙা জায়গাটা পার হওয়ার পর সেই দুধওলাকে দেখা গেল, পাশে আরএকটা লোক।
কাকাবাবু তাদের ভয় দেখাবার জন্য শূন্যে একটা গুলি ছুড়লেন। অমনই দৌড় লাগাল তারা!
কাছেই রয়েছে একটা জিপ। কাকাবাবু বিন্দুকে নিয়ে সেই গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন। আধঘণ্টা পর রাস্তার ধারে একটা থানা দেখে থামলেন কাকাবাবু।
ভিতরে ঢুকে একজন পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেন, কাছাকাছি কোনও ডাক্তারের চেম্বার কিংবা হাসপাতাল আছে? আমার হাতের চিকিৎসা করাতে হবে।
কাকাবাবুর দুহাতের কবজির অবস্থা দেখে শিউরে উঠে পুলিশটি বলল, ওরেব্বাস, এই হাত নিয়ে আপনি গাড়ি চালালেন কী করে?
কাকাবাবু যে এই হাতে রাইফেলও চালিয়েছেন, তা সে জানবে কী করে!
ডাক্তারের কথা জেনে নিয়ে কাকাবাবু পুলিশটিকে বললেন, জঙ্গলের মধ্যে ভাঙা বাড়িটায় যান। এখনই। সেখানে তিনজন ক্রিমিনালকে পাবেন?