কৃষ্ণের শরীর পার্থ কোলেতে করিয়া।
বিলাপ করেন বহু কান্দিয়া কান্দিয়া॥
কৃষ্ণ প্রাণ কৃষ্ণ নাথ কৃষ্ণ ধন জন।
কৃষ্ণ বিনা পাণ্ডবের আছে কোন্ জন॥
এতদিনে পাণ্ডবেরে বঞ্চিলেন বিধি।
কোন দোষে হারাইনু কৃষ্ণ গুণনিধি॥
এই দ্বারাবতী আমি পূর্ব্বে আসিতাম।
আমারে পাইলে কত পাইতে বিশ্রাম॥
সখা সখা বলি মোরে করি সম্বোধন।
ভূজ প্রসারিয়া আসি দিতে আলিঙ্গন॥
পূর্ব্বেতে কহিলে তুমি সভার ভিতর।
কৃষ্ণার্জ্জুন এক তনু নহে ভিন্ন পর॥
পাণ্ডুপুত্রগণ মম প্রাণের সমান।
পাণ্ডবের কার্য্যেতে বিক্রীত মম প্রাণ॥
সলিল রক্ষিত যেন মৎস্য আদি জন।
সেইরূপ পাণ্ডব রক্ষিত নারায়ণ॥
সারথিত্ব করিয়া সঙ্কটে কৈলে পার।
দুর্য্যোধন ভয় হৈতে করিলে উদ্ধার॥
আমি তব সখা প্রাণসখী যাজ্ঞসেনী।
পরম বান্ধবরূপে রাখিলে আপনি॥
পাখা যেন রক্ষা করে পাখীর জীবন।
সলিল রক্ষিত যেন জলচরগণ॥
ওহে প্রভু যদুনাথ নাহি শুন কেনে।
কোন্ দোষে দোষী হৈনু তব ও চরণে॥
তব প্রিয় সখা আমি সেই ধনঞ্জয়।
সখারে বিমুখ কেন হৈলে মহাশয়॥
একবার চাও প্রভু মেলিয়া নয়ন।
সখা বলি বারেক করহ সম্বোধন॥
বারেক দেখাও চাঁদমুখের সুহাস।
বারেক বদনচাঁদে কহ সুধাভাষ॥
রত্ন সিংহাসন ত্যজি ভূমিতে শয়ন।
চাঁদমুখে লাগিয়াছে রবির কিরণ॥
কোন্ মুখে যাব আমি হস্তিনানগরে।
কি বলিব গিয়া আমি রাজা যুধিষ্ঠিরে॥
ভাইগণে কি বলিব দ্রৌপদীর তরে।
কেমনে ধরিবে প্রাণ ধর্ম্ম নৃপবরে॥
হায় বিধি! এতদিনে করিলে নিরাশ।
কোন্ দোষে হারাইনু মিত্র শ্রীনিবাস॥
বিস্মরিলা সব কথা স্বীকার করিয়া।
সঙ্গে নিলে নিজ জনে পাণ্ডবে ত্যজিয়া॥
ভাগ্যবন্ত যদুকুল পুণ্য নাহি সীমা।
ইহলোকে পরলোকে পাইলেক তোমা॥
আমা সম হতভাগ্য পাপিষ্ঠ দুর্ম্মতি।
কোন্ গুণে পাব সেই কৃষ্ণপদে মতি॥
হা কৃষ্ণ কমলাকান্ত করুণা নিদান।
তোমা বিনা দহে মম হৃদয় পরাণ॥
কি বুদ্ধি করিব আমি কোথায় বা যাব।
আর কোথা সে চাঁদবদন দেখা পাব॥
শিরেতে হানিয়া হাত কাঁন্দি উচ্চৈঃস্বরে।
ভূমে গড়াগড়ি যান পার্থ ধনুর্দ্ধরে॥
দারুক সারথি বোধ করায় অর্জ্জুনে।
স্থির হও ধনঞ্জয় শোক ত্যজ মনে॥
অকারণে শোক কৈলে কি হইবে আর।
আমি যাহা কহি তাহা শুন সারোদ্ধার॥
বিধি নীতি আছে যেই ক্ষত্ত্রিয়ের ধর্ম্ম।
আপনি সবার তুমি কর প্রেতকর্ম্ম॥
পূর্ব্বেতে আমারে কহিলেন গদাধর।
সর্ব্ব হৈতে বড় প্রিয় পার্থ ধনুর্দ্ধর॥
যোগ আচরিয়া পরে পাইবে আমারে।
এই কথা দারুক কহিবা পাণ্ডবেরে॥
সে কারণে এই কর্ম্ম তোমার বিহিত।
সবার সৎকার কর্ম্ম করিতে উচিত॥
বহুমতে সান্ত্বনাদি করিল অর্জ্জুনে।
সৎকার করিতে পার্থ করিলেন মনে॥
চন্দনের কাষ্ঠ তথা করি রাশি রাশি।
জ্বালিলেন চিতানল গগন পরশি॥
দেবকী রোহিণী বসুদেবের সহিত।
অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করিল হরষিত॥
রেবতী রামের সনে পশি হুতাশন।
অগ্নিকার্য্য সবাকার করিল অর্জ্জুন।
সবাকার অগ্নিকার্য্য করি সমাপন।
বিধিমতে করিলেন শ্রাদ্ধাদি তর্পণ॥
দারুক পুনশ্চ কয় অর্জ্জুনের প্রতি।
অর্জ্জুন বন্ধুর কার্য্য করহ সম্প্রতি॥
স্ত্রী গণে লইয়া যাও হস্তিনানগরে।
প্রভুর রমণীগণ বিদিত সংসারে॥
তোমা বিনা কার শক্তি রাখিবারে পারি।
সমুদ্র গ্রাসিবে এই দ্বারকানগরী॥
আজ্ঞা কর আমি বনে যাই মহাশয়।
শুনিয়া স্বীকার করিলেন ধনঞ্জয়॥
এতেক বৃত্তান্ত পার্থে কহি মহামতি।
দারুক চলিল যথা বনের নিবৃত্তি॥
কৃষ্ণের রমণীগণে লইয়া সংহতি।
গেলেন হস্তিনাপথে পার্থ মহামতি॥
দ্বারকা গ্রাসিল আসি সমুদ্রের জল।
প্রভুর মন্দির মাত্র জাগয়ে কেবল॥
এক শত পঞ্চ বর্ষ শ্রীমধুসূদন।
মর্ত্ত্যপুরে নিবসেন দ্বারকা ভুবন॥
স্ত্রীগণে লইয়া পার্থ করেন গমন।
হাতে ধরি গাণ্ডীব অক্ষয় শরাসন॥
হেনকালে দৈত্যগণ আছিল কোথায়।
কৃষ্ণের রমণীগণে দেখিবারে পায়॥
একত্র হইয়া যুক্তি করে সর্ব্বজন।
কৃষ্ণের রমণীগণে হরিব এখন॥
অর্জ্জুন লইয়া যায় যতেক সুন্দরী।
কাড়িয়া লইব হেন হৃদয়ে বিচারি॥
পার্থে আগুলিল আর সকল রমণী।
হস্তে ধরি স্ত্রীগণের করে টানাটানি॥
দেখিয়া কুপিত অতি বীর ধনঞ্জয়।
গাণ্ডীব ধরিল বীর ক্রোধে অতিশয়॥
অগ্নিদত্ত গাণ্ডীব অক্ষয় শরাসন।
যাহাতে করেন পার্থ ত্রৈলোক্য শাসন॥
দেবের বাঞ্ছিত ধনু অতি মনোহর।
খাণ্ডবদাহন কালে দিল বৈশ্বানর॥
ধরি ধনু হেলায়, হেলায় দিত গুণ।
এবে গুণ দিতে শক্ত নহেত অর্জ্জুন॥
মহাভয় হৈল ধনু তুলিতে না পারি।
কত কষ্টে গুণ দেন বহু শক্তি করি॥
টানিতে না পারি ধনু আকর্ণ পূরিয়া।
কিছু অল্প টানি, বাণ দিলেন ছাড়িয়া॥
মহাকোপে ছাড়িলেন বজ্রসম বাণ।
দৈত্য অঙ্গে ঠেকি পড়ে তৃণের সমান॥
বাছিয়া বাছিয়া বাণ বিন্ধে প্রাণপণে।
অবহেলে বাণ ব্যর্থ করে দৈত্যগণে॥
এড়িল অক্ষয় অগ্নি বাণ ধনঞ্জয়।
যত বাণ এড়িলেন সব ব্যর্থ হয়॥
যত বিদ্যা পাইলেন দ্রোণগুরু স্থান।
যত বিদ্যা পাইলেন অমর ভুবন॥
এ তিন ভুবনে যারে মানে পরাজয়।
দৈত্য সনে রণে সর্ব্ব অস্ত্র ব্যর্থ হয়॥
ব্রহ্ম অস্ত্র অর্জ্জুনের হৈল পাসরণ।
বিস্ময় মানিয়া চিন্তিলেন মনে মন॥
গাণ্ডীব ধনুক বীর ধরি দুই করে।
প্রহার করেন দৈত্যগণের উপরে॥
ইতর মনুষ্য যেন করে ধরি বাড়ি।
দৈত্যগণ অর্জ্জুনেরে করে তাড়াতাড়ি॥
দৈত্যগণ অর্জ্জুনেরে পরাজিয়া রণে।
স্ত্রীগণে লইয়া গেল স্বচ্ছন্দ গমনে॥
দৈত্যগণ পরশে প্রভুর নারীগণ।
পাষাণ পুত্তলি হ’ল ত্যজিয়া জীবন॥
পরাজয় মানি পার্থ পরম চিন্তিত।
কান্দিতে কান্দিতে যান অত্যন্ত দুঃখিত।।
বদরিকাশ্রমে গিয়া ব্যাসের নিকটে।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিল করপুটে।।
অর্জ্জুনেরে মলিন দেখিয়া অতিশয়।
জিজ্ঞাসা করেন তাঁরে ব্যাস মহাশয়।।
কি হেতু হইলে দুঃখী কুন্তীর নন্দন।
আজি কেন দেখি তব মলিন বদন।।
দুষ্কর্ম্ম করিলে কিবা কহত আমারে।
পরাজয় হৈল কিবা সংগ্রাম ভিতরে।।
দেব-দৈত্যে হিংসিলে কি সুজনে পীড়িলে।
দুর্জ্জন সেবনে কিবা হীনতা পাইলে।।
এত বলি আশ্বাসিয়া মুনি মহাশয়।
করে ধরি বসাইল বীর ধনঞ্জয়।।
কান্দিয়া কহেন পার্থ মহাধনুর্দ্ধর।
কি কহিব মুনি সব তোমাতে গোচর।।
এত দিনে পাণ্ডবেরে বিধি হৈল বাম।
গোলোকনিবাসী হ’ল কৃষ্ণ বলরাম।
যাঁর অনুগ্রহে আমি বিজয়ী সংসারে।
হেলায় গাণ্ডীব ধনু ধরি বাম করে।।
যম সম বৈরীগণে না করিনু ভয়।
পরাক্রমে করিলাম তিনলোক জয়।।
মম পরাক্রম-দেব সব জান তুমি।
এক রথে চড়িয়া জিনিনু মর্ত্ত্যভূমি।।
সেই তূন সেই ধনু সেই ধনঞ্জয়।
সকল নিষ্ফল হৈল শুন মহাশয়।।
দৈত্যগণ আসি মোরে পরাজিল রণে।
কৃষ্ণের রমণী কাড়ি নিল মম স্থানে।।
প্রভু বিনা এই গতি হইল এখন।
এ পাপ জীবনে মম নাহি প্রয়োজন।।
বিক্রম বিজয় মোর সব দামোদর।
তাঁহার অভাবে ধরি পাপ কলেবর।।
কহ মুনি কি উপায় করিব এখন।
কেমনে পাইব আমি শ্রীমধুসূদন।।
উচ্চৈঃস্বরে কান্দেন সঘনে বহে শ্বাস।
অর্জ্জুনেরে আর্শ্বাসিয়া কহিলেন ব্যাস।।
স্থির হও ধনঞ্জয় শোক পরিহর।
আমি যাহা করি তাহা শুন বীরবর।।
যা হইলে ধনঞ্জয় সব আমি জানি।
বল বুদ্ধি পরাক্রম দেব চক্রপাণি।।
অনাদি পুরুষ তিনি ব্রহ্ম সনাতন।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি সেই নারায়ণ।।
নির্লেপ নির্গুণ নিরঞ্জন নিরাকার।
অক্ষয় অব্যয় তিনি অনন্ত আকার।
জল স্থল শূণ্য তিনি সকল সংসার।
সর্ব্বভূতে আত্মারূপে নিবাস তাঁহার।।
আত্মপর নাহি তাঁর সব সমজ্ঞান।
কীট পক্ষী মনুষ্যাদি সকলি সমান।।
তিনি ব্রহ্মা তিনি বিষ্ণু তিনি পঞ্চানন।
ইন্দ্র চন্দ্র সূর্য্য তিনি পবন শমন।।
চরাচর সর্ব্বভূতে বিশ্বে যেই জন।
পরমাত্মা রূপে ব্রহ্ম সেই সনাতন।।
কে জানিতে পারে সেই প্রভূর মহিমা।
চারিবেদে কিঞ্চিৎ না পায় যাঁর সীমা।।
শত কোটি কল্প যোগী ধ্যানে রাখি মন।
তবু নাহি পায় সেই প্রভু দরশন।
তোমরা পাইলে কত পুণ্যে সে বান্ধব,
কৃষ্ণ বিনা অন্য নাহি জান তোমা সব।।
ভক্তির অধিন সেই প্রভু নারায়ণ।
ভক্তিযোগে পাই সেই প্রভু দরশন।।
ত্যজিয়া মনের ধন্দ ভজ গিয়া তাঁহে।
ভক্তিরূপ ভগবান দূর হরি নহে।।
অচিরে অর্জ্জুন সেই কৃষ্ণকে পাইবে।
প্রিয়জন স্মরণেতে সতত চিন্তিবে।।
নিকটে থাকিতে তাঁরে যত ভক্তি ধরে।
শত কোটি ভক্তি হয় থাকিলে অন্তরে।।
জানিয়া অর্জ্জুন তুমি স্থির কর মন।
গৃহেতে গমন কর জানিয়া কারণ।।
পুনশ্চ বলেন পার্থ শুন মহাশয়।
এক কথা কহি, মোর খণ্ডাও বিস্ময়।।
দৈত্য হরি লইল প্রভুর নারীগণ।
ইহার কারণ তুমি কহ তপোধন।।
পূর্ব্বপুণ্যে কৃষ্ণ পতি পাইল স্ত্রীগণ।
সদাকাল সেবিলেক শ্রীকৃষ্ণ-চরণ।।
তাহা সবাকার কেন হৈল হেন গতি।
কহিবে ইহার হেতু মুনি মহামতি।।
অর্জ্জুনের বাক্য শুনি কহিলেক মুনি।
কার শক্তি হরিবেক শ্রীকৃষ্ণ-রমণী।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত কহি শুন ধনঞ্জয়।
বিদ্যাধরীগণ ছিল ইন্দ্রের আলয়।।
প্রভুর প্রকাশ যবে হইল অবনী।
তাহা সবাকারে আজ্ঞা হৈল পদ্মযোনি।।
পৃথিবীমণ্ডলে জন্ম লহ গিয়া সবে।
ভাগ্য পূণ্যফলে সবে কৃষ্ণ পতি পাবে।।
লক্ষ্মী অংশ পেয়ে হবে লক্ষ্মীর সমান।
ভক্তিতে করিবে বশ বিষ্ণু ভগবান।।
বিধির আদেশ সর্ব্ব কন্যাগণ লৈয়া।
পৃথ্বীতে চলিত সবে হৃষ্টমতি হৈয়া।।
স্নান করিবারে গেল পুণ্যনদী তীরে।
অষ্টাবক্র নামে মুনি তথা তপ করে।।
ভক্তি করি কন্যাগণ প্রণতি করিল।
তুষ্ট হৈয়া মুনিবর আশীর্ব্বাদ দিল।।
পৃথিবীতে গিয়া সবে পাবে কৃষ্ণ পতি।
মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে শুন গুণবতী।।
আশীর্ব্বাদ লাভ করি চলিল রমণী।
হেনকালে জল হৈতে উঠে মহামুনি।
অষ্ট ঠাঁই কুব্জ বক্র খর্ব্ব কলেবর।
পাদযুগ বঙ্কিম, বঙ্কিম দুই কর।।
শ্রবণ নাসিকা চক্ষু সব বিপরীত।
দেখিয়া অপূর্ব্ব সব হইল বিস্মিত।।
মুনিরূপ দেখি সবে উপহাস কৈল।
তাহা শুনি মুনিবর কূপিয়া কহিল।।
আমা দেখি উপহাস কর নারীগণ।
সে কারণে শাপ দিব শুন সর্ব্বজন।।
পৃথিবীতে গিয়া সবে কৃষ্ণে পতি পাবে।
এই অপরাধে সবে দৈত্য হরি লবে।।
মুনির বচনে সবে কম্পিত শরীর।
নিবেদন করে তবে চরণে মুনির।।
অবলা স্ত্রীজাতি মোরা সহজে চঞ্চলা।
ক্ষম অপরাধ মুনি দেখিয়া অবলা।।
প্রসন্ন হইয়া কর শাপ বিমোচন।
ধর্ম্মে মতি রহু আজ্ঞা কর তপোধন।।
তুষ্ট হ’য়ে পুনরপি মুনিবর কহে।
কহিলাম যে কথা সে কভু ব্যর্থ নহে।।
অবশ্য হরিবে দৈত্য না হবে এড়ান।
দৈত্যের পরশে সবে হইবে পাষাণ।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই জানাই তোমায়।
কন্যাগণে দৈত্য হরে এই অভিপ্রায়।।
পাষাণ হৈল তারা দৈত্যের পরশে।
প্রভুর রমণীগণ গেল তাঁর পাশে।।
না ভাবিও চিত্তে দুঃখ চল নিজ ঘরে।
ভোগ অভিলাষ ত্যজি ভজহ কৃষ্ণেরে।।
এত বলি অর্জ্জুনেরে দিলেন বিদায়।
প্রণমিয়া ধনঞ্জয় যান হস্তিনায়।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।