১১. দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিল অর্জুন

দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিল অর্জুন, মা ঘুম ভাঙালেন, তখন থেকে লোকটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, ওর সঙ্গে কথা বলে স্নানখাওয়া করে নিয়ে না হয় আবার ঘুমিয়ে পড়।

সারারাত জেগে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েও অর্জুনের ঘোর কাটছিল না। জিজ্ঞেস করল, কে লোক? নাম কিছু বলেছে?

হ্যাঁ, গোরক্ষনাথ।

অর্জুন মায়ের দিকে তাকাল, মা বললেন, লোকটা যেন কীরকম!

অর্জুন ধড়মড়িয়ে উঠে বাথরুমে চলে গেল। একটু ভদ্রস্থ হয়ে যখন বাইরের ঘরের দিকে এগোল তখন মা জিজ্ঞেস করল, চা দেব?

হ্যাঁ। অর্জুন দেখল এখন বারোটা বাজে।

দরজা খুলতেই গোরক্ষনাথকে দেখতে পেল সে। তাকে দেখে ডান হাত মুঠো করে কপালে দুইয়ে নমস্কারের ভঙ্গি করল সে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

একটু কথা ছিল। চারপাশে তাকাল গোরক্ষনাথ।

আসুন।

গোরক্ষনাথ ভেতরে এসে সন্তর্পণে বসল। অর্জুন তাকাল।

গোরক্ষনাথ বলল, সন্দীপবাবুদের পুলিশ ধরেছে, ডাকাতি করত ওরা। মুশকিল হল আমাকেও ওরা জড়িয়ে ফেলবে ওই মামলায়।

কেন? আপনি ওসব করতেন নাকি?

না, না। প্রবল আপত্তি জানাল গোরক্ষনাথ, ওসব করার কথা চিন্তাও করতে পারি না। সেকেন্ড অফিসার বললেন, ডাকাতির মাল যার কাছে পাওয়া যায় তাকে যেমন শাস্তি দেওয়া হয়, তেমনি যার সাহায্যে ডাকাতি করা হয় তাকে যে হেফাজতে রাখে তাকেও ধরা হয়। আপনি বলুন, আমি কি জেনেশুনে বেড়ালটাকে আমার কাছে রেখেছি! ওরকম বড়লোকি বেড়ালকে এক মাস রাখলে আমি ফতুর হয়ে যাব।

অর্জুন বলল, আপনি অবনীবাবুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন?

উনি নাকি সারারাত জেগে ছিলেন তাই এখন ঘুমোচ্ছেন, দেখা পাইনি।

তা হলে নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনার কোনও ভয় নেই।

আপনি একটু দেখুন বাবু। ওই বেড়ালটাকে আমি থানায় ফেরত দিতে গিয়েছিলাম, ওনারা বললেন, না। বলেছেন, আমার সঙ্গে ওটাকে আদালতে তুলবেন। তবে একটা কথা বাবু, বেড়ালটা দেখতে পায়। হঠাৎ মুখচোখ পালটে গেল গোরক্ষনাথের।

এই সময় মা চা দিয়ে গেলেন, সঙ্গে বিস্কুট।

মা চলে গেলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, দেখতে পায় মানে?

তেনাদের। কাল রাত্রে আমি প্রমাণ পেয়েছি।

কীরকম?

খাঁচার মধ্যে যেন লড়াই করছিল বেড়ালটা। একা একা।

হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল অর্জুনের। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে আপনার কাজকর্ম এখন কীরকম? খুব চাপ?

চাপ কোথায় বাবু? আগের দিন কি আছে? বেঁচে থাকার এত সমস্যা যে, মানুষের সময় কোথায় তেনাদের নিয়ে ভাবার? দিন পনেরো পরে রায়কত পাড়ায় একটা যজ্ঞ করতে হবে। কেন বাবু?

চা খাব।

মায়ের আপত্তি ছিল স্নানখাওয়া না সেরে বেরনোতে, কিন্তু তাঁকে বোঝাল, মেজরের সঙ্গে একবার দেখা করে আসা উচিত। ওরা বাড়ি থেকে বেরোতেই হাবুকে দেখতে পেল। হন্তদন্ত হয়ে আসছে। হাবু ইশারায় যা বোঝাল তাতে অর্জুন বুঝল এখন সার্কিট হাউসে যাওয়ার দরকার নেই। মেজর এবং গোরানসাহেব অমল সোমের বাড়িতে চলে এসেছেন এবং তাকে খবর পাঠিয়েছেন।

ওদের আগে আগে হাবু যাচ্ছিল। গোরক্ষনাথের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তাকে। জোর করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নেহাত পুলিশের ঝামেলায় সে পড়েছে, নইলে সে কখনওই অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে আসত না।

অমল সোমের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলেন মেজর। তাঁর লক্ষ যার দিকে সেটি যে একটা কাক, তা বুঝে হেসে ফেলল অর্জুন। কাছে গিয়ে বলল, আপনি একটা কাককে ওভাবে ধমকাচ্ছেন?

আরে বিস্তর কাক দেখেছি কিন্তু এমন পাজির পাঝাড়া কাক কখনও দেখিনি। সেই কখন থেকে এসেছি তখন থেকে সমানে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কানের পোকা বের করে ফেলল। ব্যাটা ইঁদুর, ধর্মের গাধা!

অর্জুন মজা পেল, ধর্মের গাধা কী প্রাণী?

কেন? কাশীতে যদি ধর্মের ষাঁড় থাকতে পারে তা হলে জলপাইগুড়িতে ধর্মের গাধা থাকবে না কেন? দেখছ, এখনও থামছে না হাঁড়িচাচাটা। মেজর বারান্দা থেকে নেমে একটা ছোট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে কার্নিসে বসা কাকটার দিকে তার্ক করতে লাগলেন। হঠাৎ ছুটে এল গোরক্ষনাথ, মারবেন না, মারবেন না। একটু দাঁড়ান, ভাল করে দেখি।

এ আবার কী? কাকের জন্যে দরদ উথলে উঠল? ওহে, কাক হল এমন চিজ, যে কখনও পোষ মানে না। হ্যাঁ। মেজর বললেন।

হঠাৎ চিৎকার করে উঠল গোরক্ষনাথ। দুটো হাত মাথার ওপর তুলে নাচতে লাগল পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি বলে। এবং চিঙ্কার কানে যাওয়ামাত্র কাকটা চুপ করে একদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করতে লাগল।

এ এমন চিংড়ির মতো লাফাচ্ছে কেন হে অর্জুন? মেজর অবাক।

গোরক্ষনাথ ছুটে এল অর্জুনের সামনে, বাবু, যে করেই হোক ওটাকে ধরতে হবে। ওই দেখুন ওর এক চোখ কানা। ডান দিকটা দিয়ে দেখতে পায় না বলে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ দিকটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।

কানা কাক? অর্জুনের মনে পড়ে গেল। খোঁড়া শকুন, কালো বেড়াল সংগ্রহে এসে গেছে কিন্তু গোরক্ষনাথ এখনও কানা কাক খুঁজে পায়নি।

মেজরকে ব্যাপারটা বোঝাতে হল। প্রথমে তিনি বললেন, যতসব গ্যাঁজাখোরের কাণ্ড তারপর বললেন, একে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমেরিকাতেও এখন দিন দিন গেঁজেল বেড়ে যাচ্ছে। যাকগে, কাকটাকে ধরতে চাও?

গোরক্ষনাথ সবেগে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ বাবু।

তা হলে ভাত নিয়ে এসো। ভাত ছড়ালে যেমন কাকের অভাব হয় না তেমনই কাক ধরতেও সুবিধে হয়। আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে ইগমি নামের একটি উপজাতি থাকে। খুব কম লোকই তাদের দেখা পায়। আমি ওদের কাছ থেকে পাখিরা শিখেছিলাম।

আফ্রিকা একটি বিশাল মহাদেশ। তার কিছুটা নাকি এখনও অনাবিষ্কৃত, সেখানে ইগমি নামের উপজাতি থাকতেই পারে। সন্দেহ প্রকাশ করে কোনও লাভ নেই। হাবুকে বলে কিছুটা শুকনো ভাত জোগাড় করা হল।

কিন্তু মেজর যে কায়দাটা করল তা পশ্চিমবাংলার শিশুরাও জানে। একটা বড় ঝুড়ি খাড়া করে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। ভাত রাখা হল ঝুড়ির সামনে। দড়িটা লম্বা। সেটার প্রান্ত ধরে মেজর আড়ালে চলে গেলেন। কাকটা অনেকক্ষণ একচোখে যাচাই করল। কোনও কাককে অতক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে দেখেনি অর্জুন। শেষ পর্যন্ত লোভ প্রবল হওয়াতে কাকটা উঁচু কার্নিস থেকে নেমে এল ঝুড়ির সামনে। এক পা দু পা করে ভাতের কাছে পৌঁছে গিয়ে খপ করে কিছুটা তুলে লাফিয়ে সরে এল ঝুড়ির আওতা থেকে। ঝুড়ি পড়ল না, কোনও বিপদ ঘটল না দেখে বোধহয় কাকটার সাহস বাড়ল। এগিয়ে গিয়ে গপগপ করে ভাত খেতেই মেজরের দড়ির টানে ঝুড়িটা পড়ে যেতেই চিৎকার করে উঠল গোরক্ষনাথ। কাকটা ধরা পড়ে গেছে।

গোরানসাহেব কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কেউ টের পায়নি। এবার তিনি এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন ব্যাপারটা কী? অর্জুন তাঁকে গোরক্ষনাথের সাধনার জন্যে যেসব সামগ্রীর প্রয়োজন, সেটা ব্যাখ্যা করল। সঙ্গে সঙ্গে চোখমুখ। উজ্জ্বল হয়ে উঠল গোরানসাহেবের। ঝুড়ির পাশে উবু হয়ে বসে লক্ষ করছিল গোরক্ষনাথ, তিনি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, তুমি সত্যি বলছ?

গোরক্ষনাথ মুখ তুলে সাহেবকে দেখে দু হাত নাড়ল, নো ইংরেজি।

মেজর বাংলায় অনুবাদ করলে সে দ্রুত মাথা নাড়ল, ইয়েস ইয়েস।

দেন হি উইল গো উইদ আস।

মেজরের কাছে বাংলা শুনে গোরক্ষনাথের মুখ চুপসে গেল, আমাকে ছেড়ে দিন সাহেব। এত কষ্টে কাকটাকে পেয়েছি, এখন এখানে আমার ডিম্যান্ড বেড়ে যাবে।

কত টাকা রোজগার করো দিনে?

প্রতিদিন তো হয় না। তেমন খদ্দের পেলে সেটা হয়।

গোরক্ষনাথ অর্জুনের দিকে তাকাল, ও বাবু, ওঁদের একটু বুঝিয়ে বলুন না!

অর্জুন বলল, কিন্তু গোরক্ষনাথ, আপনার এখানে থেকে কোনও লাভ হবে না।

কেন?

পুলিশ তো বেড়ালটাকে নিয়ে যাবে। আর একটা বেড়াল জোগাড় না করা পর্যন্ত! তার চেয়ে এঁরা যা বলছে শুনুন। পুলিশের চোখের সামনে থেকে চলে গেলে তারাও হয়তো আপনাকে ভুলে যাবে। কদিন বাদে সব ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ফিরে আসবেন।

অর্জুনের কথাটা বোধহয় মনে ধরল গোরক্ষনাথের। তারপর একটু ভেবে বলল, আমার মুশকিল হল ওই বুড়িটাকে নিয়ে। আমি চলে গেলে কে ওকে দেখবে? কে ওর বাজার করে এনে দেবে? আচ্ছা, কদ্দূর যেতে হবে?

হাসিমারার কাছে।

অ। ঠিক আছে, পাড়ার একটা ছেলেকে বলে দেখি। কিছু পয়সা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেতে হবে।

গোরানসাহেব বুঝলেন গোরক্ষনাথ খুশি হয়েছে। উনি সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বের করে গোরক্ষনাথের হাতে গুঁজে দিলেন। এবার অর্জুন এগিয়ে এল ঝুড়িটার দিকে, কিন্তু গোরক্ষনাথ, মানলাম এই কাকটা কানা। কিন্তু আপনি বলেছিলেন ওকে জন্মাতে হবে কানা হয়ে। এই কাকটা যে সেই শ্রেণীর তা বুঝলেন কী করে?

দাঁড়ান, দেখাচ্ছি। গোরক্ষনাথ তার জামাটা খুলে ফেলল। ডান হাত জামার ভেতর ঢুকিয়ে ঝুড়িটাকে সামান্য তুলে খানিকটা চেষ্টার পর কাকটাকে ধরে ফেলল। তারপর ঝুড়ি সরিয়ে ওটা বের করতে কাকটা আর্তনাদ শুরু করল। বাঁ হাতে ওর মুখ চেপে ধরে কানা চোখটাকে অর্জুনের সামনে নিয়ে এল সে, দেখুন বাবু, চোখটা একদম সাদা। কোনও খোঁচা খেয়ে কানা হলে আশেপাশের জায়গা ফুলে থাকত। চোখের মণিও অন্যরকম দেখাত। এ একেবারে আমার জন্যই এখানে বসে অপেক্ষা করছিল। তা হলে আমি যাই?

অর্জুন মেজরকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কী ঠিক করলেন? আজই যাবেন, না কাল ভোরে রওনা হবেন?

মেজর গোরানসাহেবকে প্রশ্নটা করতে তিনি বললেন, এখানে খামোকা সময় নষ্ট করে কী লাভ?

অর্জুন জানাল, কিন্তু তৈরি হয়ে হাসিমারায় পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। বরং শহরে থেকে আর একটু প্রস্তুতি নিয়ে গেলে ভাল হয়।

সেই সিদ্ধান্ত হল। গোরক্ষনাথ তার সাধনার সামগ্রী নিয়ে সকাল সাতটার সময় জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।

গোরক্ষনাথ চলে গেলে অর্জুন মালপত্রগুলো ভাল করে দেখল। মেজর এখান থেকেই চাল ডাল নুন কিনে নিয়ে যেতে চান। যদি জঙ্গলের গভীরে থাকতে হয় টেন্ট পেতে, তখন দরকার হবে। অর্জুন জানতে চাইল, রাঁধবে কে?

কেন? আমি কি মরে গেছি? বছর তিনেক আগে উত্তরমেরুর একটা ইলুতে বসে সিল দ্য মাঞ্চুরিয়ান রান্না করেছিলাম। ওঃ, তোমাকে কী বলব অর্জুন, তাই খেতে এত এস্কিমো জড়ো হয়েছিল যে, ইগলুতে বসে ঘামতে হয়েছিল আমাকে। মনে হয়েছিল ফ্যান থাকলে ভাল হত। মেজর স্বর্গীয় হাসি হাসলেন, যেটা তাঁর গোঁফদাড়ির জঙ্গল ছাপিয়েও দেখা গেল।

ঘামতে হয়েছিল কেন? বেশি ঝাল দিয়ে ফেলেছিলেন?

দুর। একটা বড় ইগলুতে কুড়িজন কোনওমতে আঁটতে পারে, সেখানে একশোজন ঢুকে পড়লে শরীরের গরমেই ভেতরটা তেতে উঠবে। ঘাম তো হবেই।

কিন্তু ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে সিল মাছ তো পাবেন না?

উঃ, জঙ্গলে গিয়ে আমি তোমাকে রাইস দ্য হেন খাওয়াব।

অর্জুন আর কথা বাড়াল না। যত জিনিস যাবে তা একটা গাড়িতে আঁটবে না। বড় সুমো গাড়ির ছাদে চড়ালে একরকম ম্যানেজ হতে পারে। ওঁরা অর্জুনকে দায়িত্ব দিলেন তার ব্যবস্থা করতে। তা ছাড়া জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে হলেও এস. পি. সাহেবের বিশেষ অনুমতি নিতে হবে।

মেজর এবং গোরান আজ কৌটোর খাবার খাবেন। অতএব অর্জুন বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে স্নান-খাওয়া শেষ করল। বাইরে যাওয়ার কথা বললে আগে মায়ের মুখ গম্ভীর হয়ে যেত। এখন শুধু বলেন, তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

 

কদমতলার মোড়ে একটা সুমো গাড়ি পাওয়া গেল। ওখানেই প্রাইভেট ট্যাক্সিগুলো খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে। সুমো গাড়ির ড্রাইভারের নাম বটা। টাকাপয়সার কথা হয়ে যাওয়ার পর বটা বলল, দাদা, আপনাকে আমি চিনি। আপনি তো জলপাইগুড়ির গর্ব। আমাকে একটা ব্যাপারে মাপ করতে হবে। সন্ধের পর যদি গাড়ি না চালাই তখন আমার খোঁজ করবেন না।

কেন?

এই এমনি।

অর্জুন বুঝল লোকটা তখন নেশা করবে। সে বলল, যদি তোমাকে রাতের জন্যে একেবারে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় তা হলে যা ইচ্ছে করো, নইলে নয়। কথা হল, বটা ভোর ছটায় তার গাড়ি নিয়ে অর্জুনের বাড়িতে চলে আসবে। আর সুমোর ওপরে একটা ক্যারিয়ার লাগিয়ে নেবে আজই।

বিকেলে থানায় এল অর্জুন। অবনীবাবুর চেয়ারে যে ভদ্রলোক বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে এখনও আলাপ হয়নি ওর। এস. পি সাহেব নতুন এসেছেন। অবনীবাবুর উলটোদিকে বসে ছিলেন। অর্জুনকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আসুন, আসুন। সার ইনি অর্জুন, এঁর কথা আপনাকে বলছিলাম।

এস.পি. সাহেবও উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করে বললেন, অনেক, অনেক ধন্যবাদ। আপনার সাহায্য ছাড়া এত বড় ক্রিমিনালদের ধরা একটু কঠিন হত।

অর্জুন বলল, আমার মনে হয় এরা বড় ক্রিমিনাল নয়। কিন্তু কাজটা যে ঠিক করেনি এতে সন্দেহ নেই। যা হোক, আমি আপনার কাছে যাচ্ছিলাম, এখানে দেখা পেয়ে ভাল হল।

বলুন।

আমরা আগামীকাল হাসিমারার দিকে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে একজন বাঙালি এবং একজন ইংরেজভাষী আমেরিকান আছেন। ওঁরা ওদিকের জঙ্গলে কয়েকদিন থাকতে চান। এ ব্যাপারে কোনও অসুবিধে হলে যাতে লোকাল থানা সাহায্য করে তাই অনুরোধ করছি। অর্জুন বলল।

নিশ্চয়ই। আমি জানিয়ে দেব। কিন্তু ফরেস্টে থাকতে হলে আপনাকে ডিএফওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ও। নিশ্চয়ই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করব।

অবনীবাবু বললেন, আজ ওদের আমরা কোর্টে তুলেছিলাম। ওদের আত্মীয়রা বেলের জন্যে এসেছিল, একমাত্র সন্দীপের জন্যে কেউ আসেনি। কিন্তু আরও তদন্তের জন্যে কোর্ট ওদের কাউকেই বেল দেয়নি।

অর্জুনের মনে পড়ে গেল, আচ্ছা, গোরক্ষনাথকে কবে লাগবে আপনার?

ও ওই বেড়ালটার ব্যাপার! ওকে লাগবে কেস ওঠার সময়। দেরি আছে।

গোরক্ষনাথ আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে।

সে কী? ওখানে ভূতপ্রেতের ব্যাপার আছে নাকি?

তার চেয়ে একটু ভয়ঙ্কর। ড্রাকুলা। অর্জুন হেসে বেরিয়ে এল।

 

ঠিক সকাল ছটায় বটা গাড়ি নিয়ে এল। অর্জুন তৈরি ছিল। গতকাল সন্ধেবেলায় সে ডিএফও সাহেবের সঙ্গে দেখা করে লিখিত অনুমতি নিয়ে এসেছে। তিনি তাঁর দফতরকে জানিয়ে দেবেন বলেছেন। মেজর এবং গোরানসাহেবকে তুলে সে চলে এল সুমো নিয়ে অমল সোমের বাড়িতে। কাল বিকেলে মেজর এত বাজার করেছেন যে বটার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। গাড়ির ছাদে মালপত্র তুলে ত্রিপল দিয়ে বেঁধেও যা উদ্বৃত্ত রইল তা পেছনের সিটে রাখতে হল।

সুমো দেখে গোরানসাহেব খুশি। মেজরও। তিনি বললেন, আফ্রিকার জঙ্গলে আমি যে গাড়ি ব্যবহার করতাম সেগুলো হল ব্রিটিশ জিপ। খুব শক্তপোক্ত। পাম্প থেকে গাড়ির ট্যাঙ্ক ভর্তি করে নিয়ে ওরা শহর ছেড়ে যাওয়ার মুখে রাজবাড়ির সামনে দাঁড়াল। সেই ভোরে তিন-তিনটে খাঁচা আর একটা বড় ব্যাগ নিয়ে গোরক্ষনাথ দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন বলল, উঠে আসুন।

খাঁচাগুলো তুলে পেছনের সিটে বসে গোরক্ষনাথ বলল, কাল রাত্রে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাবু। এই তিনটে না থাকলে…!

কেন, কী হয়েছিল? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

তেনাদের কেউ পথ ভুল করে চলে এসেছিলেন। গোরক্ষনাথ বলল।