হঠাৎ ডান হাতটা বাইরে বেরিয়ে এল, তার মুঠোয় রিভলভার।
বরেন ঘোষালের ভাই চিৎকার করে উঠল, তিন গুনব, এর মধ্যে কথা না শুনলে গুলি চালাতে বাধ্য হব। ওয়ান–।
মেজর হকচকিয়ে গেলেন। চাপা গলায় বললেন, এ দেখছি উন্মাদ। কী হবে?
অমল সোম বললেন, গুলি করে সবাইকে মেরে ফেলতে পারবে না। যে বেঁচে থাকবে, সে থানায় যাবে। তোমার নির্ঘাত ফাসি হবে।
মেজর বললেন, আশ্চর্য! আপনি এখনও ঠাণ্ডা মাথায় আছেন?
অর্জুনের মাথায় একটা মতলব খেলে গেল, আপনার কলমটা দিন তো?
কী করবে?
দিন না। ব্যস্ত হয়ে হাত বাড়াতেই বরেন ঘোষালের ভাই চিৎকার করল, টু!
তড়িঘড়ি কলমটা দিয়ে দিলেন মেজর। অর্জুন সেটা নিয়ে নীচে নামল। তারপর দুটো হাত মাথার ওপর তুলে এগোতে লাগল। ছেলেটা চিৎকার করল, গৌর-নিতাই হয়ে কোনও লাভ নেই, গাড়ি হঠাও, নইলে তিন বললেই গুলি চালাব।
কজনকে মারবে? একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল অর্জুন।
সবকটাকে। আমাকে তো চেনো না।
কিন্তু তার আগে যদি তোমার শার্টে আগুন ধরে যায়?
আমার শার্টে? হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার গায়ে আগুন দেবে এমন কেউ জন্মায়নি রে! আমি এবার থ্রি বলছি। রিভলভারটাকে অর্জুনের বুক লক্ষ করে ধরল সে।
কথা বলার সময় হাত মাথার ওপর রেখেই পেনটাকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল অর্জুন। এবার বলল, এক মিনিট। আমি ম্যাজিক জানি। সেটা কী রকম একটু দ্যাখো।
তক্ষুণি বোম টিপল সে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হুডটা জ্বলে উঠল। প্রাণপণে লাফ দিল বরেন ঘোষালের ভাই। ব্যালান্স রাখতে না পেরে চা-গাছের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই রিভলভার ছিটকে গেল হাত থেকে। অর্জুন দ্রুত সেটা তুলে নিল। ততক্ষণে গাড়ির নরম হুডটা পুড়ে ছাই। বরেন ঘোষালের ভাই ততক্ষণে উঠে দাড়িয়ে দৃশ্যটি দেখে বলে উঠল, আই বাপ!
এবার বীরদর্পে মেজর নেমে এলেন। সোজা ছেলেটার পাশে পৌঁছে ওর কান টেনে ধরলেন, সেদিনের ছেলে, গুণ্ডামি করে বেড়াচ্ছ। মেরে হাড় ভেঙে দেব বানর! যা, তাড়াতাড়ি গাড়ি ব্যাক কর, নইলে তোকে পুড়িয়ে মারা হবে।
ওপরের কভার পুড়িয়ে আগুন নিভে গিয়েছিল। অমল সোম ডাকলেন, শোনো, ওকে এই গাড়িতে নিয়ে এসো। মেজর, আপনি গাড়িটা চালাতে পারবেন?
মেজর বললেন, আমার আবার গিয়ার-ছাড়া গাড়ি চালানো অভ্যেস। বুঝলে অর্জুন, আমেরিকায় গাড়িতে গিয়ার থাকে না।
অর্জুন গাড়িটা পরিষ্কার করে উঠে বসল। বাইক চালানো অভ্যেস, গাড়ির হাত খুবই কঁচা। মেজর বললেন, ওটা দাও। সঙ্গে রাখা ভাল। চলো হে।
টর্চ সঙ্গে নিয়ে তিনি ফিরে গেলেন বরেন ঘোষালের ভাইয়ের হাত ধরে। যে ছেলেটা এতক্ষণ বীরদর্পে তড়পাচ্ছিল, সে হঠাৎ ভেজা মুড়ির মতো মিইয়ে গেছে। বারংবার ঘুরে ঘুরে দেখছে অর্জুনকে।
বেশ সজাগ হয়ে অমল সোমদের অনুসরণ করে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে এল অর্জুন। সামনের গাড়ির ড্রাইভার সোজা থানার সামনে দাড়িয়ে গেলে সেও ব্রেক চাপল। থানার বাইরে দুজন সেপাই দাড়িয়ে ছিল, তাদের ডাকলেন অমল সোম, বড়বাবু আছেন?
হ্যাঁ সার।
তা হলে একে নিয়ে ওঁর কাছে চলুন।
সেপাইটি বরেন ঘোষালের ভাইকে দেখে হকচকিয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছে সে চিনতে পেরেছে। তাকে ইতস্তত করতে দেখে অমল সোম ধমকালেন, যা বলছি তাই করুন।
সেপাইটি নিতান্ত অনিচ্ছায় আদেশ পালন করল। হয়তো সে অমল সোমকে বড় অফিসার মনে করেছিল। অর্জুন রিভলভারটা সঙ্গে নিয়ে ওদের অনুসরণ করল।
থানার বড়বাবুর বয়স হয়েছে। দেখলেই বোঝা যায় রিটায়ার করার মুখে এসে পৌঁছেছেন। হঠাৎ এইসব ব্যাপার দেখেশুনে খুবই অস্বস্তিতে পড়লেন। অমল সোম বললেন, এই ছেলেটির শিক্ষা হওয়া দরকার। আমার বক্তব্য
রেকর্ড করে ওকে হাজতে পুরুন।
বরেন ঘোষালের ভাই ততক্ষণে একটু সাহস ফিরে পেয়েছে। চাপা গলায় বলল, আপনারা ঝামেলা বাড়াবেন না। সেই স্যামিলটনের কেসটা মনে আছে তো!
বড়বাবু সোজা হয়ে বসলেন, অল্পবয়সী ছেলের ব্যাপার, হঠাৎ মাথা গরম করে ফেলেছিল। এটা নিয়ে আর না এগোলেই তো ভাল।
অল্পবয়সী ছেলে যখন গালাগাল দিয়ে রিভলভার থেকে গুলি চালাবার চেষ্টা করে, তখন তার শাস্তির জন্যে এগোতে হয়। আপনি ডায়েরি নিন। আপনার অসুবিধে থাকলে এস পি.কে ফোন করে বলুন জলপাইগুড়ির অমল সোম ইনসিস্ট করছেন, কিন্তু আপনি ডায়েরি নিচ্ছেন না। কী করবেন ভেবে দেখুন। অমল সোমের কথা শেষ হওয়ামাত্র কাজ শুরু হয়ে গেল। বরেন ঘোষালের ভাইকে পুলিশের হেফাজতে দিতে সে চিৎকার করে উঠল, আমিও ডায়েরি করব। আমার গাড়িতে এরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।
বড়বাবু বললেন, সে কী!
হ্যাঁ। বাইরে চলুন, দেখাচ্ছি।
বড়বাবু যেন উৎসাহিত হয়েই বাইরে এলেন। ছেলেটি দেখাল, ওই যে, কভার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অল্পের জন্যে বেঁচে গিয়েছি আমি।
আপনারা আগুন লাগিয়েছেন? বড়বাবু ঘুরে দাড়ালেন।
অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, ওকে জিজ্ঞেস করুন আগুন যদি লাগানো হয়ে থাকে, তা হলে কী দিয়ে লাগানো হয়েছে?
মাজিক, ম্যাজিক করে আগুন ধরিয়েছে ও। অর্জুনকে দেখিয়ে দিল ছেলেটা।
ম্যাজিক? ম্যাজিকের আগুন আসল হয় নাকি! লোকে বিশ্বাস করবে?
গাড়িতে উঠে অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের অস্ত্রটি একবার দেখতে পারি?
মেজর সোৎসাহে এগিয়ে দিলেন। চোখের সামনে ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন অমল সোম। মেজর বললেন, আপনি যদি ইচ্ছে করেন, তা হলে রেখে দিতে পারেন।
অমল সোম কলমটা ফিরিয়ে দিলেন, সঙ্গে অস্ত্র রাখা আমি অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ছেলেটার কী হবে মনে হয়?
কী আর হবে? আধঘণ্টা বাদেই জামিন নিয়ে যাবে। কষ্ট করে কোর্টে তুলবে বলে মনে হয় না। তবে থানার রেকর্ডে ঘটনাটা লেখা থাকল, এইটেই লাভ।
ওরা ফিরে এল জঙ্গলের ভেতর। আকাশে মেঘ জমছে। ড়ুয়ার্সের বৃষ্টি একবার শুরু হলে কদিন ধরে চলে। মেজর গম্ভীর হয়ে বললেন, সমস্যা হয়ে গেল।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কীরকম?
বৃষ্টি নামলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বিষফুলের গন্ধ টের পাওয়া যাবে না। খুঁজে বের করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কী মনে হয়, বৃষ্টি হবে?
অর্জুন তাকাল। বৃষ্টি আসবে, কিন্তু সেটা যে প্রবল হবে এমন মনে হচ্ছে।
অমল সোম বললেন, আচ্ছা মেজর, বৃষ্টি হবে কিনা তা ভবিষ্যতের ব্যাপার, আপনারা কেউ ওই লোকটাকে নিয়ে চিন্তা করছেন না কেন, যে আপনাকে জঙ্গলের ভেতর আঘাত করেছিল?।
আমি ভাবিনি, তা কে বলল? ভেবেছি। এই সব জঙ্গলে প্রচুর বন্যজন্তু-শিকারি লুকিয়ে আছে। তাদের কেউ আমাকে দেখে ভয় পেয়ে আঘাত করেছে।
এটা হওয়া সম্ভব। কিন্তু যারা গোপনে জঙ্গলে শিকার করে, তারা বাংলোর কিচেন থেকে খাবার চুরি করে খাবে বলে মনে হয় না।
ও, খাবার চুরির ঘটনাটা একদম আলাদা। আমি বাবুর্চির সঙ্গে কথা বলেছি। এদিকে এমন ঘটনা না ঘটলেও ঘটা অসম্ভব নয়। পাঁচ-ছ কিলোমিটার দূরে গরিব মানুষের গ্রাম আছে। ওদের কেউ আসতে পারে। মেজর বললেন।
অমল সোম মাথা নাড়লেন, তা ঠিক। তবে সেরকম হলে দিনের বেলায় খাবার চুরি যেত। সন্ধে নামলে কেউ জঙ্গলের ভেতর ঢুকবে না। চুরি করা খাবারের চেয়ে নিজের কাছে জীবন অনেক মূল্যবান।
দুপুরের খাওয়ার পর মেজর নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। এরকম মেঘলা দুপুরে ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। এখানে এসে কয়েকটা ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া ছাড়া তেমন কিছুই ঘটল না। অর্জুনের মনে হচ্ছিল অমল সোম তার স্বভাব অনুযায়ী কোনও কথাই বলতে চাইছেন না। অর্জুন বাংলো থেকে বেরিয়ে এল। চারধার খুব বেশি চুপচাপ। আকাশে মেঘ জমলে পাখিরাও বোবা হয়ে যায়? গতকাল যেদিক দিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছিল তার বিপরীত দিকে ঢুকল সে। সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই। কলমটা মেজরের কাছে রয়ে গেছে। অবশ্য দিনের বেলায় অস্ত্রের তেমন প্রয়োজন হবে না। কিছুটা হাঁটতে চমৎকার গন্ধ নাকে এল। মিষ্টি গন্ধ। মাথা ঝিমঝিম করছে না। অর্জুন কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকল। বিষফুল যদি হয়, তা হলে আর দেখতে হবে না। মিনিট দুয়েকেও যখন শরীরে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না, তখন সে পা বাড়াল।
হঠাৎ সামনের বুনো ঝোপের ভেতর ঝটপটানি শুরু হল। তারপরই একটা শেয়াল দ্রুত বাইরে বেরিয়ে এসে অর্জুনের দিকে তাকাল। এরকম ভয়-পাওয়া বোকা-বোকা চাহনি দেখে মজা লাগল অর্জুনের। সে কপট ধমক দিল, ভাগ।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উধাও হল জন্তুটা। অর্জুন বুঝতে পারল, গন্ধটা আসছে ওই ঝোপের মধ্যে থেকে। শেয়ালটা যখন ওখান থেকে বের হল, তখন বোঝাই যাচ্ছে গন্ধটা বিষ ফুলের নয়। সে ঝোপটার ভেতর উঁকি মারার চেষ্টা করল। ডালপালা সরিয়ে এগিয়ে যেতে দৃশ্যটা দেখতে পেল অর্জুন, গোটাদুয়েক শেয়ালের বাচ্চা হতভম্ব হয়ে তাকে দেখছে। বাচ্চাগুলো দিন সাতেকের বেশি নয়। কুকুরের বাচ্চার মতোই আদুরে দেখতে। আর তাদের পাশে মাটি খানিকটা খোঁড়া রয়েছে। সেখানেই গন্ধের উৎস। কাজটা মা-শেয়ালের, গর্ত খুঁড়ে বাচ্চাদের নিয়ে খাওয়া শুরু করেছিল সে। মাটির তলায় কোনও ফল বড় হয়ে পেকে উঠেছিল, নিজস্ব ঘ্রাণশক্তিতে শেয়াল তার খবর পেয়ে গিয়েছিল। জলপাইগুড়ির বাড়িতে একটা কাঠালগাছ আছে। যার ফল মাটির নীচে হয়। সেই কঁঠাল পেকে যাওয়ার সময় ওপরের মাটিতে চিড় ধরে, তার ফঁক দিয়ে গন্ধ বের হয়। এটা কী ধরনের ফল, বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু ধরনটা ওইরকমের।
এই সময় পেছনে পাতার শব্দ হতে চোখ ফেরাল অর্জুন। এবং তাকে অবাক করে দিয়ে সুন্দর এগিয়ে এল, নমস্কার বাবু।
সুন্দরের মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, পোশাকও ময়লা। তুমি এখানে?
কাল থেকে এদিকেই আছি বাবু। সুন্দর হাসল, বাচ্চাগুলোকে খেতে দিন বাবু। পুরোটা খেতে পারবে না, বাকিটা আমি খাব। আসলে এই জঙ্গলে তেমন ফলমূল তো নেই। জন্তুগুলোর খুব অসুবিধে হয়।
তুমি গতকাল মেজরের মাথায় আঘাত করেছিলে?
আজ্ঞে। তিনি কে?
ওঃ, মোটাসোটা মানুষ। পাতার ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন।
ও হ্যাঁ। নাহলে আমাকে ধরে ফেলতেন। পরে যখন আপনারা আমাকে খুঁজতে এসেছিলেন, তখন আমি দেখিয়ে দিয়েছিলাম উনি কোথায় শুয়ে আছেন।
বাংলোর রান্নাঘর থেকে তুমিই খাবার চুরি করেছিলে?
হ্যাঁ বাবু। এত খিদে পেয়েছিল যে, নিজেকে সামলাতে পারিনি। তা ছাড়া আপনি ওদের মধ্যে আছেন দেখে ভরসা হল। অন্যায়টা মাফ করে দেবেন।
তুমি এই জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরছ কেন?
আমার কথা থাক। আপনি শহরের মানুষ, আপনি কি বেড়াতে এসেছেন?
কাজও আছে। শোনো সুন্দর, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। আমি জানি, তুমি নীল চ্যাটার্জির ভয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াচ্ছ। অর্জুন জানিয়ে দিল।
সুন্দরের চোখ ছোট হল। সে জিজ্ঞেস করল, আপনি নীলবাবুকে চেনেন?
চিনতাম না। এখানে এসে চিনতে বাধ্য হয়েছি।
এই জায়গা রাস্তা থেকে বেশি দূরে নয়। ওপাশে একটা ভাল জায়গা আছে। আসুন আমার সঙ্গে। সুন্দর হাঁটতে আরম্ভ করল। ড়ুয়ার্সের জঙ্গলের মধ্যে স্বচ্ছন্দে হাঁটা মুশকিল। বুনো ঝোপ আর লতাপাতা সরিয়ে রাস্তা করতে হচ্ছে। মিনিট দশেক হাঁটার পর ওরা একটা অদ্ভুত জায়গায় পৌঁছল। গোটাদশেক মোটা-মোটা শালগাছ গোল হয়ে দাড়িয়ে আছে। মাঝখানের জায়গাটা একদম ন্যাড়া। যেন গাছেরা দেওয়াল হয়ে ঘর তুলেছে।
সেখানে দাড়িয়ে সুন্দর বলল, অল্প বৃষ্টি হলে এখানে জল পড়ে না। দেখুন মাথার ওপর পাতার ছাউনি কী ভাল। আকাশ দেখা যায় না।
কথাটা ঠিক। আর সেই কারণেই জায়গাটা ছায়ায় ভরা। সূর্য ডোবার আগেই অন্ধকার হয়ে যাবে। সুন্দর বলল, এখানে কথা বললে কেউ টের পাবে না।
শোনো, তোমার জন্যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি ঠিক করে খবর দিতে গিয়েছিলাম। পার্বতী বড়ুয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। সেখানেই জানতে পারলাম, তুমি জঙ্গলে লুকিয়ে আছ।
অ। দিদি তোতা জানবেনই। বউ তো ওঁকেই প্রথমে বলবে।
কিন্তু সেই জঙ্গল তো অনেক দূরে। এখানে এলে কী করে?
হেঁটে। জঙ্গলে জঙ্গলে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম।
কী হয়েছিল বলো তো?
বাবু, এ-সবই পাপের শাস্তি। চাকরিবাকবি নেই, খেতজমি নেই অথচ সংসার চালাতে গেলে টাকার দরকার হয়। পাখি ধরা শুরু করলাম। প্রথমে ঘুঘু, বনমুরগি ধরতাম, ভাত না জুটুক মাংস খেতে পেত বউ ছেলে। তারপর ময়না, টিয়া ধরতে লাগলাম। সেগুলো বিক্রি করে দুটো পয়সা হত। সেই পাখি ধরার ধান্দায় জঙ্গলগুলো ঘুরতে হত। হঠাৎ একদিন একটা লোক এসে বলল আমি যদি আরও বেশি টাকা রোজগার করতে চাই, তা হলে সে হদিস দিতে পারে। যা পাচ্ছিলাম তাতে আমার চলছিল না। লোভ হল। গেলাম তার সঙ্গে। যার কাছে নিয়ে গেল সে নীলবাবুর লোক। এই এলাকায় সবাই চেনে। লোকটা বলল, ময়না টিয়া ধরা বন্ধ কর। নইলে পুলিশ তোকে ধরবে। ওই সব পাখি ধরা আইনের চোখে অপরাধ। তুই এখন থেকে এই সব পাখি ধরবি। আমাকে ছবি দেখাল লোকটা। ওই রকম পাখি আমি জঙ্গলে দেখেছি। তবে বেশি নয়। কথা বলে না আর মাংসও খাওয়া যায় না বলে কোনওদিন ধরার চেষ্টা করিনি। লোকটা বলল, অন্তত গোটা কুড়ি পাখি তোকে ধরতে হবে। সেই পাখি নিয়ে জলপাইগুড়ির স্টেশনের কাছে তোকে যেতে হবে। পাখি নিয়ে যাওয়ার আগে আমাকে দেখিয়ে যাবি। কুড়িটা পাখি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আড়াইশো করে টাকা পাবি। কি রে, খুশি তো?
খুশি আমি হয়েছিলাম। আড়াইশো করে সপ্তাহে হলে মাসে হাজার টাকা। এর সঙ্গে ঘুঘু আর মুরগি ধরলে অসুবিধে নেই। কিন্তু লোকটা যে ছবি দেখিয়েছিল, সেই জাতের পাখি চাইলেই পাওয়া যায় না। সারাদিন ঘুরে হয়ত একটারও দর্শন পেলাম না, আবার একদিনেই আট-দশটা জুটে গেল। ফরেস্ট ডিপার্টের লোকদের আর আমি কেয়ার করতাম না। ওরা জেনে গিয়েছিল আমি নীলবাবুর লোক। ভয়ে আমাকে কিছু বলত না। এদিকের বাসে পুলিশ কিছু বলবে না জানি, মুশকিল হত জলপাইগুড়ির দিকে। তবু আমি এই ব্যবসা চালাচ্ছিলাম। রোজগারও হচ্ছিল মন্দ নয়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমার কৌতূহল হচ্ছিল না, ওই সব পাখি কী জন্যে ধরা হচ্ছে?
হয়নি যে তা বলব না। তবে আমি গরিব মানুষ, যে যা ইচ্ছে করুক আমি আর মাথা ঘামাইনি। পাখি দিতাম টাকা নিতাম। লোকটা বসে থাকত স্টেশনের কাছে চায়ের দোকানে। আমি গেলেই টাকা ধরিয়ে দিয়ে পাখি নিয়ে চলে যেত।
তা, এমন সুন্দর ব্যবসা বন্ধ করলে কী জন্যে?
আপনি আমাকে লোভ খালেন। ভালভাবে বাঁচার লোভ। পাখিগুলোকে দেখে বউ বলত, আহা কী নিরীহ বেচারা, তোমার পাপ হচ্ছে, সেইসঙ্গে আমাদেরও।
আমি ধমক দিতাম, পাপ-পাপ করিস না। আমি পাপ না করলে না খেয়ে মরতিস।
বুঝতে পারি বউ কথাগুলো পার্বতীদিদিকে বলেছে। পার্বতীদিদি আমাকে ডেকে খুব ধমকাল। বলল আর পাখি ধরলে পুলিশের হাতে তুলে দেবে আমাকে। তা পার্বতীদিদির ক্ষমতা আছে। বড়বড় অফিসাররা আসেন তার কাছে। কিন্তু পার্বতীদিদির তো চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা নেই। হাতির কাজ আমি জানি না। ছেলেটার সঙ্গে হাতিদের বন্ধুত্ব হয়েছে কিন্তু আমাকে দেখলে ওরা এমন রেগে যায় যে, ভয়ে ওদিকে যেতাম না। এই সময় আপনি লোভ দেখালেন। ফেরার সময় বাসে বসে ঠিক করলাম, আপনি যদি সত্যি কথা বলেন তা হলে জীবনে আর পাপ করব না। বাবু, লোকে মুখে অনেক উপকার করবে বলে আশা দেয়, কিন্তু কাজের বেলায় কথা রাখে না। তাই ভয়ও ছিল।
তারপর? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
ফিরে আসার পরই নীলবাবুর লোক আমাকে ডেকে পাঠালেন। গেলাম। তিনি বললেন, তোকে আর পাখি ধরতে হবে না।
আমি অবাক হলাম। এভাবে নিষ্কৃতি পাব, কল্পনা করিনি।
তিনি বললেন, তোকে একটা নতুন কাজ দিচ্ছি। এখন থেকে ভূটানের পাহাড়ের দিকে যে জঙ্গল আছে সেখানে থাকবি। সেখানে গিয়ে থর খুঁজবি। থর দেখেছিস?
বললাম, দুবার দেখেছি।
ব্যস! তোর আর চিন্তা নেই। থর দেখতে পেলেই আমাদের খবর দিবি। কী করে ফঁদ পেতে ওদের ধরতে হয়, শিখিয়ে দেওয়া হবে তোকে।
বাবু, থর হল ছাগলের মতো দেখতে, কিন্তু ছাগল নয়। নেপালিরা ওদের থর বলে ডাকে। এদিকে দেখা যায় না বড় একটা। কেউ-কেউ অবশ্য ওদের জংলা ছাগল বলে। সহজে ধরা দেয় না ওরা।
তুমি কী করলে?
আমি আর পাপের পথে যাব না বলে ঠিক করলাম।